শাহজামাল নাই , ইমরান ও নাই, জাহাঙ্গির, ইলিয়াস, খলিল ও নাই.. শহীদে শহীদে জনপদ শেষ গানে উল্লেখিত শহীদদের ইতিহাস খুজে পাওয়া যায়না এখন আর। পরাজয়ের হীনমন্যতা নাকি রাজনীতির কৌশলে এই লুকোচুরি, তাও স্পষ্ট না।
১.
"যুদ্ধ শেষের দিকে। একদিন ছাত্রসংঘের দপ্তরে একটা ফোন আসে। অপর পাশ থেকে কথা শুনতে শুনতে মোস্তফা শওকত ইমরান অট্টহাসি দিয়ে উঠলেন। জবাব দিলেন, "জনাব! মরণকে ভয় পাই না। ওকে সামনে দেখেও এভাবেই হাসি, যেভাবে আপনি শুনছেন।"
ঘটনা কী, জানতে চাইলাম। জানালেন তার এক আওয়ামী আত্মীয় তাকে ফোন দিয়েছিল। বলে, "তোমার মৃত্যুর সময় খুব কাছে।"
এরপর ১৫ ডিসেম্বরের রাত এলো। যে রাত কখনো ভুলবার নয়। দশটার দিকে ঢাকা জামায়াতের আমীর খুররম জাহ মুরাদ সাহেবের ফোন আসে। তিনি বললেন, সিদ্দিক বাজার অফিসে চলে আসো। শওকত ইমরান আমাকে সাথে নিয়ে জিপে রওনা দিলেন। ওখানে পৌঁছতেই খুররম সাহেব বলেন, "সেনাবাহিনী যদিও স্বীকার করছে না, তবে আমার মনে হচ্ছে এরা নিশ্চিত অস্ত্র সমর্পণ করে দিবে।"
তার পরামর্শ নিয়ে আমরা প্রথমে এক সাবেক প্রাদেশিক সভাপতির বাড়ি গেলাম। তাঁর ছেলেমেয়েদের সুরক্ষিত স্থানে রাখার জন্য গেলাম গুলশান এলাকায়। ঘরে ফিরি রাত তিনটায়।
ঘরে ফিরেই আমি বললাম, "ইমরান ভাই, আপনি খুব ক্লান্ত। কিছুক্ষণ আরাম করে নিন।"
তিনি গা এলিয়ে দিলেন। একই কামরায় আল বদরের আরও কয়েকজন সাথীও ঘুমাচ্ছিল।
ফজরের আজান শুনে যেন ঘুম ভাঙলো এক মর্মান্তিক সকালের। নামাজ পড়ার পর ইমরান ভাই আর আমি কর্নেল হিজাযী সাহেবের কাছে গেলাম। তিনি সিভিল পোশাকে জায়নামাজ বিছিয়ে তসবিহ তাহলিল করছিলেন। আমরা তাকে অস্ত্র সমর্পণের খবরের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, "বাবা, ব্রিগেডিয়ার বশির বলতে পারবেন।"
বশির সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, "এরকমই কথা চলছে। আপনারা চাইলে আমাদের সাথে থাকতে পারেন, আমাদের যা পরিণতি হবে তা আপনারাও সইলেন। বাকি সিদ্ধান্ত আপনাদের।"
আমরা ওখান থেকে ধানমণ্ডি আল বদর ক্যাম্পে চলে আসি। সবাইকে পরিস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক করলাম। এর মধ্যেই খবর পেলাম যে মোহাম্মদপুর থানা থেকে একটা গ্রুপ আমাকে গ্রেফতার করতে আসছে। ইমরান ভাই আমাকে বললেন, "আপনি দ্রুত জিপ নিয়ে এখান থেকে বের হোন।"
আমি রাজি হচ্ছিলাম না। কারণ এই মুহূর্তে ঢাকাতে আমাদের ১১টি ক্যাম্পে এক হাজারের বেশি আল বদর ক্যাডেট অবস্থান করছে। তাদের না সরিয়ে আমি কিভাবে সরে যেতে পারি! আমার কথা যেন তিনি শুনলেনই না। বাহু ধরে টেনে জোর করে আমাকে জিপে উঠিয়ে ড্রাইভারকে হুকুম দিলেন, "দ্রুত নিয়ে যান।"
আমি চলে আসার পর ওখানে দায়িত্বশীল শুধু ইমরান ভাই ছিলেন। এরই মধ্যে সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। ইমরান ভাই পুরো দায়িত্বশীলতার সাথে সকল সাথীকে বিভিন্ন দিকে হিজরত করার জন্য পরামর্শ দিয়ে অন্য ক্যাম্পে রওনা হলেন। কিন্তু রাস্তায় একটা দুর্ঘটনায় উনার হাতে মারাত্মক জখম হয়। খুব কাছেই তার বোনের বাড়ি ছিল। কিন্তু দুলাভাই দোশ নওয়াজ 'ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি'র কর্মী। ওখানে আশ্রয় হলো না। তিনি চলে গেলেন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। কিন্তু সেটা তার জন্য সুরক্ষিত ছিল না। কারণ তিনি মেডিকেলেরই শিক্ষার্থী ছিলেন। আর এটাই তার কাল হয়ে দাঁড়াল। হাসপাতালের এক কর্মচারী তাকে চিনে ফেলে, খবর চলে যায় দুশমনের কাছে।
কুখ্যাত সন্ত্রাসী ও ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা সংগঠক (পরবর্তীতে ড. কামালের নেতৃত্বাধীন গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক) সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিকের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী তাকে তুলে নেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে নিয়ে যাওয়া হলো ইমরানকে। ওখানে মৌলবী ফরিদ আহমদ ও ছাত্র সংঘের কর্মী আজিজুল ইসলামের উপর নির্মম নির্যাতন চালানো হচ্ছিল। দুই দিন ইমরান ভাইকে ওখানেই রাখা হলো। এ সময়ে মৌলবী ফরিদ আহমদ শহীদ হন। তার পরনে শুধু একটা গেঞ্জি আর লুঙ্গি ছিল। নামাজের জন্য যখনই পানি চাইতেন, মুক্তি বাহিনী তাকে পেশাব ভরা গ্লাস ধরিয়ে দিত।
১৮ তারিখ দুশমনরা ইমরান ভাইকে প্রথমে টিএসসি নিয়ে যায়। সেখান থেকে আধা ঘন্টা পর জিপে তুলে নিয়ে যায় হাতিরপুল। এখানে মুক্তিবাহিনীর একটা জটলা ছিল। ইতোমধ্যেই চালানো নির্যাতনের কারণে ইমরান ভাইয়ের মাথায় ক্ষত হয়েছিল। মাথায় বাঁধা রুমালটাও তখন ভেজা, রক্তাক্ত। জিপ থেকে নামাতেই আরেক দফা নির্যাতন শুরু হয়। তার কাছ থেকে জেনারেল রাও ফরমান আলীর জারি করা স্পেশাল পরিচয়পত্র পাওয়া যায়। এ যেন দুশমনের নির্মমতার উনুনে আরও আগুন ঢালে। জুলুমের পরিমাণ ও পদ্ধতি আরও বেড়ে গেল এর ফলে।
কিন্তু প্রতিটি আঘাতের জবাবেই ইমরান আরও শক্তি নিয়ে বলে উঠছিলেন 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ'। তার মুখ থেকে আল বদর সম্পর্কে কোন তথ্য বের করা গেল না। সন্ত্রাসীরা রাগে, উন্মত্ততায় নরপিশাচে রূপ নিল। ব্লেড দিয়ে জখম করে করে গায়ে লবণ মাখানো হলো। তবুও আমানতের হেফাজত করেছেন ইমরান। নির্যাতনের পরিমাণ এত বেড়ে গেছিল যে যেন তার নিশ্বাস কমে আসছে। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণ হচ্ছিল, গলা শুকিয়ে হয়তো কাঁটা হয়ে যাচ্ছিল। 'পানি' বলে চিৎকার করে উঠলেন তিনি। তার গলার কম্পিত আওয়াজে শয়তান যেন শান্তি পেল। একজন গ্লাসে পেশাব করে তা ইমরানের মুখের কাছে ধরে।
তিনি চোখ খুলেই ধাক্কা দিয়ে গ্লাস ফেলে দিলেন। তার কলুষমুক্ত চোখে গুণ্ডাদের এক নজর দেখে ভয়হীন কণ্ঠে আবার বললেন, "পানি"। শয়তানের হাসিতে তার এই আবদারও মিলিয়ে গেল।
ইমরান ভাই প্রচণ্ড তৃষ্ণায় নিজের বাম হাতের আঙুল মুখে নিয়ে রক্ত চুষতে লাগলেন। কিন্তু মুহুর্তেই তা ফেলে দিলেন। তার চোখ এখন বন্ধ হয়ে আসছে। এক মহিয়ান মঞ্জিলের দিকে তিনি সফর করতে যাচ্ছেন। তার জবান বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু কোন তথ্যই তিনি দিচ্ছেন না। ফলে প্রমাণিত হচ্ছিল তার বুক ইসলাম ও পাকিস্তানের মুজাহিদদের গোপনীয়তার দুর্গ। তাই এত নিপীড়নের পরও তার এত 'সহজ' মৃত্যু সহ্য হচ্ছিল না আধিপত্যবাদী গুন্ডাদের। তাদের একজন চাকু দিয়ে ইমরানের বুকে 'জয় বাংলা' খোদাই করতে উদ্যত হলো। এই যন্ত্রণায় ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করলেন মোস্তফা শওকত ইমরান। আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ...
কিন্তু ম্রিয়মাণ এই কালেমার আওয়াজও দুশমনের সহ্য নয়। তার কলেজেরই এক ছাত্রলীগ কর্মী বুকে চাকু দিয়ে গভীর আঘাত করে দুই হাতে বুক চিরে কলিজা বের করে আনে। ইমরানের অযুত সাহসের এই তপ্ত লাভা শুধু মাটিতে ফেলেই ক্ষান্ত হয়নি, পায়ের তলায় পিষ্টও করে সেই আধিপত্যবাদের দোসররা।
ইমরান এভাবে জীবনের বাজি হেরেছেন, কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের গৌরবদীপ্ত পথ ছেড়ে দেননি। তার কর্মীদের আর আন্দোলনের গোপনীয়তা জীবন দিয়ে রক্ষা করেছেন। দ্বীন প্রতিষ্ঠার কর্মীদের জন্য দুর্গম দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন শহীদ মোস্তফা শওকত ইমরান। ইসলামের ইতিহাসে ত্যাগ আর কুরবানির যে সিলসিলা, তা রক্ষা করেই ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যা আরও একবার উজ্জ্বল হলো তার রক্তে।"
— তৌফিক ইলাহী
[ নির্যাতনের বিস্তারিত তৌফিক ইলাহীকে জানিয়েছেন ইমরানের উপর নির্যাতনে অংশ নেওয়া মুক্তিবাহিনীর সদস্য ড. জামিল উজ জামান। তিনি আজিমপুরে থাকতেন। ইমরানের শাহাদাত তাকে ইসলামী আন্দোলনের পথ দেখায়। ]
২.
"১৬ ডিসেম্বর সকালের ঘটনা। ৯টার সময় হতে পারে। যথারীতি দুই-তিন জায়গায় অপারেশনের পরিকল্পনা নিয়ে ক্যাম্প থেকে রওনা হতেই যাচ্ছিলাম। তখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সংঘের সভাপতি, ঢাকা সভাপতিসহ মোস্তফা শওকত ইমরান গাড়ি নিয়ে আসলেন। তিনি তথ্য বিভাগের ইনচার্জ ছিলেন। সাথে আরও দুয়েকজন ছিল। তিনি বললেন, "রাতে আমরা ভয়েস অব আমেরিকা আর বিবিসিতে শুনেছি যে পাক ফৌজ অস্ত্র সমর্পণ করে ফেলেছে। চলো, আর্মি হেড কোয়ার্টার থেকে আসল সুরতহাল জেনে আসি।"
আমি জবাব দিলাম, আমার কাছে সময় নাই। দুয়েকটা জরুরি কাজ করতে হবে। মনে হচ্ছে অস্ত্র সমর্পণের খবর প্রোপাগান্ডা হবে।
আমার ধারণা এমনটাই ছিল। কিন্তু তারা আমাকে জবরদস্তি আর্মি হেড কোয়ার্টারে নিয়ে গেলেন। প্রথমে কর্নেল হিজাযীর সাথে সাক্ষাৎ হলো। উনি বললেন, ভালো হয় আপনারা ব্রিগেডিয়ার বশির সাহেবের সাথে কথা বলেন।
ব্রিগেডিয়ার বশির সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ হলো। তিনি পাক ফৌজ ও আমাদের মধ্যকার লিয়াজো রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন। উনি বললেন, রাত আটটার মধ্যে সব কিছু জানা যাবে। মোস্তফা শওকত ইমরান জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা যদি আত্মসমর্পণ করেন তাহলে আমাদের ব্যাপারে কী ভেবেছেন?
তিনি জবাব দিলেন, আপনারা সিভিল ড্রেস পরে সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে যাবেন। অথবা উর্দি পরে আমাদের সাথে অস্ত্র সমর্পণ করতে পারেন। তারপর যা আমাদের সাথে হবে, আপনাদের সাথেও তাই হবে। কিন্তু আমার ইচ্ছা, আমাদের দুর্ভোগ আপনাদের পোহানোর দরকার নাই। আমি তো এখনও এটা বুঝতে পারছি না যে পাক ফৌজ হিন্দুস্তানিদের সামনে অস্ত্র সমর্পণ করছে!
ইমরান বললেন, আল বদরের একটা সদস্যও এই বেইজ্জতির জন্য প্রস্তুত না। অন্তত আপনারা যে অস্ত্র দুশমনের সামনে জমা দিচ্ছেন, সেগুলো আমাদের দিয়ে দেন। আমরা লড়বো।
ব্রিগেডিয়ার সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললেন, আমাদের ক্ষমতাই বা কী! না কোন অর্ডার দিতে পারি, আর না হাতিয়ার। উপর থেকে যে হুকুম হয় তারই তামিল করতে হয় আমাদের।
এরপর হেডকোয়ার্টার থেকে আমরা চলে আসি।"
— আশরাফুজ্জামান
৩.
"শওকত ইমরান ভাই ছাত্র সংঘের সাথীদের জন্য আপাদমস্তক ইখলাসের উদাহরণ ছিলেন। তার সাথে দুয়েকটি ঘটনা এখনও স্মৃতিতে আছে। এর একটি— ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে যখন দ্বিতীয় দফায় আমাকে কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব অর্পণ করা হলো, তখন আমার সমস্যা তিনি কিছুটা বুঝতে পেরেছিলেন। রাত বারোটার দিকে ওষুধ নিয়ে আমার রুমে চলে আসলেন। যেহেতু উনি ডাক্তার ছিলেন, জানতেন যে আমি মানসিকভাবে পেরেশান থাকলে আমার ঘুম হয় না। তিনি সম্মেলন কেন্দ্রের ইনচার্জ ছিলেন। কিন্তু সমস্ত দায়িত্ব পূরণ করার পরও নিজে আরাম করলেন না। আমার খেয়াল না রেখে নিজে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেননি।
বিভিন্ন সম্মেলন বা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর দায়িত্ব যাদের উপর অর্পিত হতো— শহীদ আব্দুল মালেক, শহীদ শাহ জামাল, শহীদ শওকত ইমরানকে দেখেছি, কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য দিনরাত কাজ করতেন। এত দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েও মেজাজের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল। সব কাজ নিজে এগিয়ে এসে করতেন। শাহ জামাল ভাই মেঝেতে বসে বসে কাজ করিয়ে নিতেন। কিন্তু আব্দুল মালেক ও শওকত ইমরান সম্মেলন কেন্দ্রের ইনচার্জ কিংবা সম্মেলনের সভাপতি হয়েও ছোট ছোট কাজ নিজে করে ফেলতেন।"
— শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী
৪.
শওকত ইমরান ফেনী শহরে এক বিত্তবান পরিবারে জন্ম নেন। শৈশব থেকেই তিনি নম্র-ভদ্র হিসাবে বেড়ে উঠেছিলেন। কিন্তু বাবা ছিলেন আওয়ামীলীগ নেতা। ফলে ঘরে রাজনীতি চর্চা হওয়ায় তখন থেকেই দুর্বার সাহসীও হয়ে ওঠেন শওকত ইমরান। স্কুল জীবন থেকেই বিভিন্ন বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন। পরবর্তীতে মেডিকেল শিক্ষার্থী হলেও ইতিহাসের উপর তার অসামান্য দক্ষতা ছিল।
স্কুল জীবনেই ছাত্র সংঘের দাওয়াত পেয়েছিলেন তিনি। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ইচ্ছা ছিল এম.বি.বি.এস করবেন। এখানে এসে ইসলামী ছাত্রসংঘে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ৩০ এপ্রিল ১৯৬৮ সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করেন। চার মাস সদস্য প্রার্থী থাকার পর নভেম্বরে সদস্য হন। ১৯৬৯ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংঘের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। একই বছর প্রথমে প্রাদেশিক শুরা সদস্য এবং পরের বছর কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন তিনি। সর্বশেষ প্রাদেশিক তথ্য শাখার দায়িত্বে ছিলেন।
যুদ্ধ চলাকালে ঢাকা আল বদরের তিনটি কোম্পানিতেই তিনি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
শহীদের পরিবার আওয়ামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকায় মাওলানা আবুল আ’লা মওদূদী ও অধ্যাপক গোলাম আযমের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতেন। বাবা টাকার গরমে ছেলেকে জামায়াতের থেকে কিনেও নিতে চেয়েছিলেন। একবার মোস্তফা শওকত ইমরানকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন, "মোস্তফা, মাওলানা মওদূদী তোমাকে কত টাকায় কিনেছে? তুমি যদি মওদূদী আর গোলাম আযমের ক্রীতদাস হয়ে থাকো, তাহলে আমি প্রতিটি উপায়ে তোমাকে মুক্ত করতে চাই। নিজের সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে, এমনকি নিজের শরীরের চামড়া দিয়ে জুতা বানিয়ে হলেও তোমাকে গোলামী থেকে মুক্ত করতে চাই।"
এসব কারণে শওকত ইমরান পরিবারের চিঠি এড়িয়ে যেতেন। ঘন ঘন বাড়ি যাওয়াও তার পছন্দ ছিল না। তৌফিক ইলাহী চিঠির ব্যাপারটা খেয়াল করে তাকে পড়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। তখন তিনি নিজেই চিঠি খুলে তৌফিক ইলাহীকে পড়তে দেন। উপরোক্ত চিঠি পড়ার পর তৌফিক বুঝতে পারেন পরিস্থিতি। শওকত ইমরান তখন বলেন, "আমি আব্বা-আম্মার সাথে বেয়াদবি করতে চাই না। এ জন্য চিঠি খুলে দেখি না। সবর করি। কারণ, মনে হয় এই চিঠিগুলো আমাকে আব্বা-আম্মার নাফরমানি করাবে। অথবা সরিয়ে দিবে ইসলামী আন্দোলন থেকে।"
শাহাদাতের পর মোস্তফা শওকত ইমরানের বাবা ও ছোট ভাই ইসলামী আন্দোলনে যুক্ত হন।
** ১৬ ডিসেম্বর সকালের ঘটনা। ৯টার সময় হতে পারে। যথারীতি দুই-তিন জায়গায় অপারেশনের পরিকল্পনা নিয়ে ক্যাম্প থেকে রওনা হতেই যাচ্ছিলাম। তখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সংঘের সভাপতি, ঢাকা সভাপতিসহ মোস্তফা শওকত ইমরান গাড়ি নিয়ে আসলেন। তিনি তথ্য বিভাগের ইনচার্জ ছিলেন। সাথে আরও দুয়েকজন ছিল। তিনি বললেন, "রাতে আমরা ভয়েস অব আমেরিকা আর বিবিসিতে শুনেছি যে পাক ফৌজ অস্ত্র সমর্পণ করে ফেলেছে। চলো, আর্মি হেড কোয়ার্টার থেকে আসল সুরতহাল জেনে আসি।"
আমি জবাব দিলাম, আমার কাছে সময় নাই। দুয়েকটা জরুরি কাজ করতে হবে। মনে হচ্ছে অস্ত্র সমর্পণের খবর প্রোপাগান্ডা হবে।
আমার ধারণা এমনটাই ছিল। কিন্তু তারা আমাকে জবরদস্তি আর্মি হেড কোয়ার্টারে নিয়ে গেলেন।
প্রথমে কর্নেল হিজাযীর সাথে সাক্ষাৎ হলো। উনি বললেন, ভালো হয় আপনারা ব্রিগেডিয়ার বশির সাহেবের সাথে কথা বলেন।
ব্রিগেডিয়ার বশির সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ হলো। তিনি পাক ফৌজ ও আমাদের মধ্যকার লিয়াজো রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন। উনি বললেন, রাত আটটার মধ্যে সব কিছু জানা যাবে।
মোস্তফা শওকত ইমরান জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা যদি আত্মসমর্পণ করেন তাহলে আমাদের ব্যাপারে কী ভেবেছেন?
তিনি জবাব দিলেন, আপনারা সিভিল ড্রেস পরে সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে যাবেন। অথবা উর্দি পরে আমাদের সাথে অস্ত্র সমর্পণ করতে পারেন। তারপর যা আমাদের সাথে হবে, আপনাদের সাথেও তাই হবে। কিন্তু আমার ইচ্ছা, আমাদের দুর্ভোগ আপনাদের পোহানোর দরকার নাই। আমি তো এখনও এটা বুঝতে পারছি না যে পাক ফৌজ হিন্দুস্তানিদের সামনে অস্ত্র সমর্পণ করছে!
ইমরান বললেন, আল বদরের একটা সদস্যও এই বেইজ্জতির জন্য প্রস্তুত না। অন্তত আপনারা যে অস্ত্র দুশমনের সামনে জমা দিচ্ছেন, সেগুলো আমাদের দিয়ে দেন। আমরা লড়বো।
ব্রিগেডিয়ার সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললেন, আমাদের ক্ষমতাই বা কী! না কোন অর্ডার দিতে পারি, আর না হাতিয়ার। উপর থেকে যে হুকুম হয় তারই তামিল করতে হয় আমাদের।
হেডকোয়ার্টার থেকে আমরা চলে আসি। ব্রিগেডিয়ার সাহেবের কথায় আমাদের আন্দাজ হয়ে গেছিল যে বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে। ক্যাম্পে পৌঁছে অন্য সাথীদের পরিস্থিতি অবগত করলাম। যতটুকু সম্ভব টেলিফোনের মাধ্যমে ক্যাম্পগুলোতে সতর্ক করে পরামর্শ দিলাম সিভিল ড্রেস পরে আড়াল হয়ে যেতে।
এরপর (সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি) খুররম জাহ মুরাদের গাড়িতে ওখান থেকে বেরিয়ে গেলাম। সাথে আরও কয়েকজন। তাদের মধ্যে আসাদুজ্জামান শেষ পর্যন্ত আমার সাথে ছিল। সে ছিল প্লাটুন কমান্ডার, ছাত্র সংঘের সদস্য প্রার্থী।
আমরা ধানমণ্ডিতে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অফিসে পৌঁছলাম। তখন আমাদের কাছে সর্বসাকুল্যে দু’শ টাকা ছিল। ওটা দপ্তরের এক চাপরাশিকে দিয়ে শহর পর্যবেক্ষণ করতে বিভিন্ন দিকে বেরিয়ে গেলাম। রাত নয়টার দিকে টেলিফোনের সব সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। হতে পারে পাক ফৌজ অথবা মুক্তি বাহিনী তারগুলো কেটে দিয়েছে।
ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য মোস্তফা শওকত ইমরান মুক্তিবাহিনী ও আওয়ামীলীগের হাতে আটক হন। অবর্ণনীয় নির্যাতনের পর ১৮ ডিসেম্বর প্রকাশ্যে তাঁর বুক চিরে কলিজা বের করে তাঁকে হত্যা করা হয়।
- Shukran Sabit এর ফেসবুক পোষ্ট থেকে সংগৃহীত।
0 comments: