ছাত্রসংঘঃ আবু মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর

জাহাঙ্গীর ভাই শহীদ হয়ে গেলেন! 
ঢাকায় আল বদরের তিনটি কোম্পানি ছিল। কমান্ডারসহ প্রতিটি কোম্পানিতে ১০৪ জন করে মুজাহিদ থাকতেন। কোম্পানিগুলো হচ্ছে- 
১. শহীদ আব্দুল মালেক কোম্পানি 
২.শহীদ আজিজ ভাট্টি কোম্পানি 
৩.গাজী সালাহউদ্দীন কোম্পানি 

এর মধ্যে শহীদ আব্দুল মালেক কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন আবু মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। নারায়ণগঞ্জ-মুন্সীগঞ্জের কোনো এক চরে যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর বুলেটে শাহাদাত বরণ করেন তিনি।

১. 
জনৈক আবু নসর ফারুকী ওই যুদ্ধের স্মৃতি বর্ণনা করে বলেন- "ঢাকা থেকে ১১ মাইল দূরে নারায়ণগঞ্জ। সেখান থেকে কিছু দূরে মুন্সীগঞ্জের দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি এলাকায় অভিযানের আদেশ পাই। ওই অভিযানে আর্মির ১০ ও আল বদরের ৫০ ক্যাডেট এবং ৪০ জন রাজাকারের একটি ফোর্স অংশ নেয়। আমরা ক্যাম্প থেকে বের হয়ে রাত তিনটা নাগাদ নারায়ণগঞ্জে পৌঁছাই। মাসটা ছিল নভেম্বর। আমরা সেহরি খেয়ে নিয়ে লঞ্চে চড়ে নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে পৌঁছাই। তথ্য মোতাবেক, ওখানে ভারতীয় দুষ্কৃতিকারীরা অবস্থান করছিল। তারা পুরো এলাকাটি খালি করে দিয়েছিল। ফলত তাদের পজিশন ছিল খুব পোক্ত। 

তবু আমরা আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। বিশ্বাস ছিল পাক নৌ-বাহিনী আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা রাস্তা ভুলে গিয়ে অন্য দিকে চলে যায়। মূলত ওয়্যারলেস কোড আউট হয়ে যাওয়ার কারণে এই দুঃখজনক ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। পুরো অভিযানের সময় নৌ-বাহিনীর কোনো খোঁজ মিলছিল না। রাত প্রায় চারটার দিকে শত্রুবাহিনীর মুখোমুখি হই আমরা। আমরা দুর্বার আক্রমণ করি। আমাদের দিক থেকে স্টেনগান ব্যবহার হচ্ছিল। 

কিন্তু খুব সমস্যা হচ্ছিল আমাদের। কেননা আমরা নিচু অবস্থানে ছিলাম, জায়গাটিও ছিল খালি। কোনো গাছ সেখানে ছিল না। অপরদিকে হিন্দুস্তানি ফৌজ এবং মুক্তি বাহিনী ছিল উঁচু জায়গায়। একই সাথে তারা গাছের আড়ালে থেকে নিজেদের বাঙ্কারে বসেই ফায়ার করছিল। 

আল বদর কমান্ডার আবু মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর ব্যাপক দৌঁড়-ঝাপের মধ্যে ছিলেন। তিনি আমাদের নির্দেশনা দিচ্ছিলেন এমন অবস্থায় দুশমন পক্ষে স্টেনগানের নল ঝলসে উঠল। তৎক্ষণাৎ জাহাঙ্গীর ভাইয়ের মাথা ও বুকে গুলি বিদ্ধ হয়। তিনি গুরুতর আহত হয়ে পড়ে গেলেন। গুলি যেন বৃষ্টির মতো পড়ছিল। এর মধ্যে কারো সাহস হলো না জাহাঙ্গীর ভাইকে ওঠানোর। 

পরে আল বদরের দুই যোদ্ধা এগিয়ে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে সুরক্ষিত স্থানে নিয়ে আসে। কিন্তু জায়গাটি কতটুকুই আর সুরক্ষিত ছিল! না কোনো প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা, আর না কোনো আর্মি চিকিৎসক! চিকিৎসার উপকরণ ছিল শুধু ঘাস, লতাপাতা আর গাছের রস। যুদ্ধ অব্যাহত ছিল। শত্রুকে উৎখাত করা যাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল তারা কোনো অবস্থাতেই পিছু না হঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতেও পারছি না। সেই পজিশনও ছিল না আমাদের। 

এমন পরিস্থিতিতে খবর পেলাম জাহাঙ্গীর ভাই শহীদ হয়ে গিয়েছেন। সাথে সাথে আমাদের আর্মি কমান্ডার আদেশ দিলেন- পিছিয়ে যাও। 
আমরা বললাম, আমরা পিছে যাব না। আমাদের কমান্ডার শহীদ হয়েছেন। আমরা অবশ্যই তার বদলা নিব। 

এতে কমান্ডার অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, এই পরিস্থিতিতে আমি পাক বাহিনীকে ক্ষতির মুখে ফেলতে পারি না। আপনাদের যা ইচ্ছা তা করুন। আপনি চাইলে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারেন, আমি আমার জওয়ান পিছিয়ে নিচ্ছি। 

এর সাথে সাথেই সেনাবাহিনী আমাদের ছেড়ে চলে গেল। 

অপরদিকে আল বদরের ক্যাডেটরা শাহাদাতের তামান্নায় উজ্জীবিত হয়ে নতুন উদ্যমে অগ্রসর হওয়া শুরু করে। আমাদের এই আক্রমণ এত তীব্র ও আচমকা ছিল যে শত্রু বাহিনী পিছপা হতে শুরু করে। হিন্দুস্তানি ফৌজের কিছু সৈন্য একটি স্কুল আর কিছু সৈন্য একটি মসজিদে আশ্রয় নেয়। অন্যরা পালিয়ে যায়। 

এই সফল আক্রমণের পর আমরা তাদের বাঙ্কারে গিয়ে তো হয়রান। সবগুলো বাঙ্কার কংক্রিট দিয়ে বানানো। বুঝতে পারছিলাম না এই পরিস্থিতিতে এত দ্রুত তারা কিভাবে কংক্রিটের বাঙ্কার তৈরি করল? মসজিদ আর স্কুলে আশ্রয় নেওয়া লোকদের আটক করা হয়। এসব যুদ্ধবন্দী থেকে আমরা জানতে পারি তারা ঢাকা দখলের উদ্দেশ্যে এই পয়েন্ট থেকে রাস্তা তৈরি করতে এসেছিল। 

পরদিন আজিমপুর কবরস্থানে শহীদ জাহাঙ্গীরের দাফন-কাফন করা হয়। দাফনের সময় সঙ্গীদের ধৈর্য ধারণ করা খুব মুশকিল হয়ে উঠেছিল। সবার চেহারা মলিন হয়ে উঠছিল, আর দু'চোখের শূন্যতা জুড়ে ছিল কেবলই অশ্রুর বান।" 

২. 
ফাজারুল ইসলাম (নাম অস্পষ্ট) বলেন- 
"বিকাল ৪টা বাজে আর্মির পক্ষ থেকে আমাদের জানানো হলো অপারেশনের জন্য তৈরি হতে হবে। এটি ছিল আমার প্রথম অপারেশন। রাত ৯টার দিকে আমরা নারায়ণগঞ্জে পৌঁছাই। শীত ছিল অনেক। তাছাড়া আমাদের কাছে পর্যাপ্ত শীতের কাপড়ও ছিল না। 

সিদ্ধান্ত হলো, আমরা রাতভর আরাম করে সকালে কার্যক্রম শুরু করব। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে জানানো হলো, রাত ৪টার সময়ই হামলা শুরু হবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক সবাই আর্মির গানবোটে চড়ে কিছু মাইল দূরে নদীর কিনারে নেমে পড়লাম। তখন সেহরির সময়। তীব্র শীত আর হেটে চলার কারণে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ছিল। তবুও মৃতের মতোই আমরা চলতে থাকলাম। হাটতে হাটতে একটি নদী সামনে পড়ল। আমরা এক কাপড়েই মাল- সামানসহ নদী সাঁতরে পার হলাম। 

পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক আমরা ওপারের গ্রামটি ঘেরাও করি। ওখানে মুক্তি বাহিনী বাঙ্কার প্রস্তুত করে রেখেছিল। আমাদের উপস্থিতি টের পেতেই শত্রুপক্ষ তীব্র আক্রমণ শুরু করে দেয়। আমরা মাটিতে শুয়ে ক্রলিং করে এগোতে থাকলাম। আস্তে আসতে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, এমন সময় আমাদের এক সহযোদ্ধাকে গুলি লাগে। কিন্তু আমরা পরে বুঝতে পারলাম, সে গুলিবিদ্ধ হয়নি। আল্লাহর রহমতে গুলিটি তার রাইফেলে লাগে। এতে রাইফেল ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সে অক্ষত থাকে। যদিও কিছুক্ষণ পর আমাদের এক সেনা শহীদ হয়ে যায়। 

শত্রুর প্রতিরক্ষা ব্যূহ খুব শক্তিশালী ছিল। হাজার আক্রমণেও কোনো ফলাফল পাচ্ছিলাম না। উল্টো আমরাই লোকসানের মধ্যে ছিলাম। তখন আল বদরের কোম্পানি কমান্ডার আবু মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর রাইফেল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। তিনি শত্রুর বাঙ্কার লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করতে করতে আমাদের কাতারবন্দি করতে লাগলেন। এতে সহযোদ্ধারা সাহস ফিরে পান। 

পূর্ণ উদ্যমে তারা আবারও ময়দানে নেমে আসে। আবু মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর নারায়ে তাকবির ধ্বনি দিতে দিতে আমার সামনে দিয়ে অতিক্রম করছিলেন এমন সময় স্টেনগানের নল ঝলসে ওঠে। গুলি এসে বিদ্ধ করে আবু মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের বুক আর মাথা। আমাদের মেডিকেল কলেজের দুই সিনিয়র সহযোদ্ধা তাকে উদ্ধার করে পিছনে নিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর আমরা জানতে পারি তিনি শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেছেন। 

আমাদের তখন আর কী করার ছিল! প্রতিশোধের আগুনে আমরা পাগলের মতো অগ্রসর হতে থাকলাম। আমাদের শপথ ছিল কোনো পরিণতির পরোয়া না করে আমরা এগিয়ে যাব। নারায়ে তাকবিরের ধ্বনির সাথে সাথে আমরা এগিয়ে চলেছিলাম। শত্রুপক্ষও সাহসের সাথে জবাব দিয়ে চলেছিল। কিন্তু আমাদের ঝোড়ো আক্রমণের সামনে তারা উদ্যম হারিয়ে ফেলে। 

দুপুর প্রায় একটার দিকে আমরা ওই যুদ্ধে বিজয় অর্জন করি। ওখান থেকে ১৮ দুষ্কৃতিকারীকে গ্রেফতার করা হয়। এ ছাড়া বেশ কিছু অস্ত্র আমরা উদ্ধার করি।" 

 📖 আল বদর, সালিম মনসুর খালিদ

- Shukran Sabit এর ফেসবুক পোষ্ট থেকে সংগৃহীত।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম