বাংলাদেশ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়। দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে এ শিক্ষাঙ্গণের যেমনি রয়েছে অসামান্য কৃতিত্ব ও অনবদ্য অবদান, ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস ভিত্তিক পর্যালোচনায় তেমনি তার আছে কিছূ দু:খজনক অধ্যায়। বাংলাদেশের কলুষিত ছাত্র রাজনীতির বলী হয়ে অনেক মেধাবী ছাত্রকেই লাশ হয়ে ফিরে যেতে হয়েছে প্রতিষ্ঠিত সন্তানের স্বপ্নে বিভোর মা-বাবার কোলে । এদেশের ছাত্র ইসলামী আন্দোলনের উপর নির্যাতনের ধারাবাহিকতায় ভিন্ন মতাদর্শীরা সবসময়ই ছিল এ ময়দানের উপর খড়গহস্থ। ফলে বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে জনশক্তি অনুপাতে সবচেয়ে বেশি রক্ত ঝরেছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৯৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর শহীদ শওকত হোসেন তালুকদার, শহীদ আলাউদ্দিন ও শহীদ মঞ্জুরুল কবীর এবং পরবর্তীতে আরও তিনজনসহ ছয় ছয়জন ভাই শহীদি মিছিলে সামিল হয়েছেন এ ময়দান থেকে। মহান আল্লাহপাক মানুষকে অনেক সৌভাগ্য দান করেন। ছোটবেলাতেই এই নিষ্পাপ শহীদদের সংস্পর্শকে আমি নিজের জন্য তাই মনে করি।
১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মাস, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্যাতন নিষ্পেষন থেকে মুক্ত হয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নেয়া সোনার বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠে এই দিনে। শহীদ জননী, বীর মুক্তিযোদ্ধা তৃপ্তির হাসি হাসে বিজয়ের দিনে। কিন্তু হাসি-আনন্দ-বিজয়ের উল্লাস সবকিছু ম্লান করে দিয়ে বাংলাদেশ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিল এক ষোলই ডিসেম্বর যেদিন কেঁদেছিল এক মুক্তিযোদ্ধা। শত্রু মোকাবেলায় জীবন বাজি রেখে যে দেশকে মুক্ত করেছিল, ছিনিয়ে এনেছিল দেশের স্বাধীনতা, বিজয়ের সেই দিনে সংবর্ধনা আর ফুলের পরিবর্তে একমাত্র ছেলে আলাউদ্দিন’র লাশ উপহার হিসেবে পাবে তা তিনি হয়ত স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। স্বাধীনতার মর্মার্থ সেদিন বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল পিতৃতের তীব্র আবেগের কাছে।
১৯৯৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর একদিকে বিজয়ের আনন্দে সারাদেশ মাতোয়ারা অন্যদিকে তৎকালীন সরকারের লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসীরা ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের রক্ত ঝরানোর নেশায় মেতে উঠেছিল হায়নার উল্লাসে। সর্বাত্মক হামলা করা হয় বাকৃবি’র ঈশা খাঁ, জামাল হোসেন ও শাহজালাল হলের সাধারন ছাত্র ও ইসলামের আন্দোলনের কর্মীদের উপর। ১৫ ডিসেম্বর গভীর রাত থেকে শুরু করে পরদিন দুপুর পর্যন্ত তাদের লোমহর্ষক আক্রমন চলতে থাকে কিন্তু প্রশাসনকে বারবার বিষয়টি অবহিত করার পরও যথাযথ কোন পদক্ষেপ তারা গ্রহন করেনি। ফলে অকালে ঝরে যায় তিন তিনটি তাজা প্রাণ। উল্টো গ্রেফতার করা হয় ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের। আবাসিক এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় প্রত্যক্ষ করেছিলাম সেদিনের অন্যায় আর অবিচারের করুণ চিত্র। ইট দিয়ে মাথা থেতলে কিভাবে মানুষ হত্যা করতে হয় তা প্রত্যক্ষ করিয়েছিলো তৎকালীন সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের নেতারা। দীর্ঘক্ষণ নির্যাতন চালিয়ে মাথা থেতলে ও গুলি করে করিম ভবন এলাকাতে জনসম্মুখেই হত্যা করা হয় শহীদ শওকত হোসেন তালুকদার ভাইকে। এলাকার মানুষের সাথে তার ছিল এক আত্মিক সম্পর্ক। শহীদ শওকত ভাই মাঝে মাঝে আমাকে ’ক্ষুদে শিবির’ বলে সম্বোধন করতেন। ক্রিকেট খেলার জন্য ব্যাট স্ট্যাম্প কিনে দিয়েছিলেন শহীদ হবার ঠিক আগের দিনই। তার মৃত্যুতে অঝরে কেঁদেছিল সেদিন উপস্থিত মানুষেরা। সেই করিম ভবন এলাকার বাসিন্দারা মানুষের সুখে-দুঃখের অংশীদার শহীদ শওকতের নাম আজও ভুলতে পারেনা । বরিশালের বাকেরগঞ্জের দরিদ্র বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান শহীদ শওকত মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করে লাশ হয়ে ফিরে গেল মায়ের কাছে। সন্তানহারা পাগলপ্রায় সেই মা আজও অশ্র“সিক্ত নয়নে সন্তানের প্রতিক্ষায় চেয়ে থাকে।
বাকৃবি’ র ১ম বর্ষের ছাত্র মঞ্জুরুল কবির ভাই আর আমি সাথী হওয়ার জন্য শেষমোড় সংলগ্ন আতিয়ার স্যারের মসজিদে বসে সূরা সফের ৮-১১নং আয়াত একসাথে মুখস্থ করছি,এ দৃশ্য এখনও মাঝে মাঝে মনে হলে চোখ অশ্র“সজল হয়ে যায়। কারণ তিনিতো সেই মঞ্জুরুল কবির যিনি এ দুনিয়ায় আল্লাহর নবীকে স্বপ্নে দেখেছিলেন, ঈশা খাঁ হলের উত্তর-পূর্ব কোণে ১৯৯৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর বুকে পিঠে গুলিবিদ্ধ মঞ্জুরুল কবির শহীদ হওয়ার ঠিক পূর্র্বমুহূর্তে তার ২৮ টাকা ঋণের কথা বলে গিয়েছিলেন, যিনি বাড়ি থেকে শেষবারের মত আসার সময় তার কবরের জায়গা নির্ধারন করে এসেছিলেন। কিন্তু সেই জায়গার মর্মার্থ বুঝা যায় তার শাহাদাতের পর রেখে যাওয়া ডায়েরী থেকে। আল্লাহর রাসূল(সঃ) এর সাথে যে জায়গাটিতে বসে তিনি কথপোকথন করেছিলেন তার জীবনের শেষ ইচ্ছাটি যে ছিল সেখানেই সমাহিত হওয়া, শাহাদাতের আগে কেইবা তা জানতো? আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে মোনাজাত করি, হায় আল্লাহ! তোমার প্রিয় এই বান্দাদের সাথে আমাদের হাশর নসিব করিও।
শুধু শওকত হোসেন তালুকদার ও মঞ্জুরুল কবির নয়, একই দিনে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করলেন বাকৃবি ক্যাম্পাসে সর্বমহলে গ্রহনযোগ্য মিষ্টভাষী মুক্তিযোদ্ধা বাবার সন্তান শহীদ আলাউদ্দিন ভাই। শহীদ আলাউদ্দিন ভাইকে জড়িয়ে ধরে একদিন বলেছিলাম,আমাদের ভাইয়েরা সবাই হলে উঠেছে, যেকোন সময়ে আমাদের ভাইদের উপর হামলা চালাতে পারে সন্ত্রাসীরা, আমাদের কোন কোন ভাইয়ের যেন মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে আলাউদ্দিন ভাই । আমার মুখে এই কথা শুনে মুচকি হেসে তিনি দৃপ্ত কন্ঠে বললেন- ধরে নাও মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে তোমার, আমার ,আমাদের সবার কারন আমরা সবাই শহীদ হতে প্রস্তুত। ১৬ ডিসেম্বর আলাউদ্দিন ভাইয়ের শহীদ হবার খবর শোনার পর সাথে সাথে আমার কানে বেজে উঠছিল তার মুখ নিঃসৃত বাণীগুলো। মনে মনে বলছিলাম, ভাইয়্যা আমি জানতাম না যে সেই ব্যক্তিই আপনি, যিনি শহীদ হবেন,জানলে হয়তো আমি ও কথা বলতাম না।
ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন ও স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রামসহ বিভিন্ন আন্দোলনে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির আছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। কিন্তু আজ লেজুরবৃত্তি ও অনৈতিকতার প্রভাবে ছাত্র রাজনীতি তার প্রকৃত পরিচয় হারাতে বসেছে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি,ভর্তি বাণিজ্য ও ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ছাত্র নেতারা। বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। দেশের শুধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নয়; আজও ঢাকা,রাজশাহী,চট্টগ্রামসহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সহিংস ও প্রতিহিংসার রাজনীতির বলি হয়ে লাশ হয়ে ফিরছে অনেক মেধাবী মুখ। বর্তমান সরকারের সময়েও সেই একই ধারা অব্যাহত রয়েছে। ঢাকা মেডিকেলের রাজীব,বিশ্ববিদ্যালয়ের আবুবক্কর,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যায়ের নোমানী,ফারুক তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আমরা চাই না আর কোন লাশ, চাই না কোন অস্থিতিশীল ক্যাম্পাস। শুধু চাই ক্যাম্পাসে শিক্ষার নান্দনিক পরিবেশ ও ছাত্র রাজনীতির সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থান। সরকার যদি সত্যিই জাতি গঠনে আন্তরিক হন,তাহলে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শান্তিপূর্ণ ক্যাম্পাস বিনির্মাণে যথাযথ ভূমিক রাখবেন বলে আমরা আশা করি।
- মুহাম্মাদ জাকির হোসাইন
0 comments: