ইসহাকের গাঁয়ের বাড়ী । নিজের বাড়ীতেই তার একাধিক ঘোড়া ছিল, সেখান থেকে দু’টো ঘোড়া প্রস্তুত করা হলো। ইসহাকের গ্রেফতারীর খবর শুনে গ্রামের লোকজন জমা হয়েছিল সেখানে। ইসহাকের স্ত্রী ও কন্যা প্রস্তুত হয়ে যখন ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করলো তখন বিকেল। গ্রামের লোকজন সুদানী কমান্ডারের কথা বিশ্বাস করে ইসহাকের স্ত্রী ও কন্যাকে কমান্ডারের সাথে বিদায় জানালো।
ডাউনলোড |
দিন থাকতে থাকতেই তারা দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল পার হয়ে এলো। তারা যখন সে অঞ্চলের শেষ প্রান্তে, তখন সন্ধ্যার লালিমা মুছে গিয়ে অন্ধকার নেমে এসেছে। পার্বত্য অঞ্চল ছেড়ে মরুভূমিতে পড়তেই অন্ধকার ফিকে হয়ে এলো। রাতের প্রথম প্রহর। বিরতিহীনভাবে তারা পথ চলছে। নিঃসঙ্গ মরুভূমিতে ক্ষুদ্র এক কাফেলা। তিন জন মাত্র যাত্রী, তাও আবার দু’জন মেয়ে। ক্ষুদ্র কাফেলা নিয়ে মরুভূমিতে পথ চলা খুবই বিপদজনক, কিন্তু সেদিকে কারো খেয়াল নেই। বালিয়াড়ি মাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে কাফেলা। নিরব নিস্তব্ধ পরিবেশ। রাস্তায় কোথাও কেউ নেই।
এক অচেনা পুরুষের সাথে এগিয়ে চলেছে দুই পর্দানসীন মহিলা। স্বামীর চিন্তায় বিভোর ইসহাকের স্ত্রী। আহত বাপের কথা ভাবছে কিশোরী কন্যা। দুনিয়ার আর কোন খেয়াল নেই ওদের। চোখে কোন নিদ্রা নেই। অন্তরে নেই কোন ভয়। পার্বত্য অঞ্চলের মহিলা হওয়ায় অশ্বারোহণেও ওদের কোন অসুবিধা হচ্ছে না। সে অঞ্চলের প্রতিটি নারী পুরুষ শিশুকাল থেকেই ঘোড় সাওয়ার ও তীরন্দাজী শিখে রাখে। পুরুষের মত সে অঞ্চলের নারীরাও সমান দুঃসাহসী।
তিনটি ঘোড়াই মরুভুমি ধরে এগিয়ে চলেছে। কমান্ডারের মন প্রফুল্ল। তার আনন্দের কারণ, ছলনা করে দুই মুসলিম পর্দানসীন মহিলাকে সে ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসতে পেরেছে।
পচাগলা লাশের পাশে ইসহাক তার কামরায় বসেছিল। এ লাশ রাখা হয়েছিলো তাকে অসুস্থ ও দুর্বল করার জন্য। কিন্তু ইসহাকের এ নিয়ে কোন বিকার ছিল না। তার শারীরিক অনুভূতি হারিয়ে গিয়েছিল। সে লাশের সাথে এমনভাবে কথা বলত, যেন লাশটি জীবিত। লাশের দুর্গন্ধের কথা সে ভুলেই গিয়েছিল।
দৈহিক চেতনা না থাকলেও আত্মার ও চিন্তার শক্তি তার নষ্ট হয়নি। সে ভেবে দেখল, আজ সারাদিন তাকে কামরার বাইরে নেয়া হয়নি। সন্ধ্যার পরও কেউ তাকে বিরক্ত করতে আসেনি। সে খুবই অবাক হলো। এমন বিশ্রাম দেয়ার মানে কি? কেন আজ কোন নির্যাতন করা হলো না? তবে কি সুদানি সেনাপতি নিরাশ হয়ে গেছে? এখন তাহলে ওকে নিয়ে ওরা কি করবে? কামরায় শুয়ে বসে এসবই ভাবছিল সে।
কমান্ডার মেয়ে দু’জনকে সাহস ও শক্তি জোগানোর জন্য ওদের সাথে গল্প জুড়ে দিল। সে ইসহাকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওদের শোনাচ্ছিল বীরত্ব ও সাহসের গল্প। মা ও মেয়ে খুব আগ্রহ সহকারে শুনছিল ওর কথা।
সুদানী সেনাপতিকে তার সঙ্গের অফিসার বললো ‘আপন কন্যা ও স্ত্রীর অপমান কি কেউ সহ্য করতে পারে? আমার বিশ্বাস, কমান্ডার ওদের দু’জনকে নিয়ে আসছে।’
‘আমি ইসহাককে বলবো, যতক্ষণ তুমি এবং তোমার সম্প্রদায়ের লোকেরা সুদানী বাহিনীতে যোগ না দেবে, ততক্ষণ তোমার স্ত্রী ও কন্যাকে মুক্তি দেয়া হবে না। তাঁদের ওপরও তোমার মতোই নির্যাতন চালানো হবে। আশা করি, এতে করে ইসহাক তার মত পাল্টাতে বাধ্য হবে’ বললো সেনাপতি।
‘সকাল নাগাদ আমাদের কমান্ডারের ফিরে আসার সম্ভাবনা আছে’ অফিসার বললো।
‘হয়তো তার আগেও এসে যেতে পারে’ সেনাপতি বললো, ‘এ লোক খুব হুশিয়ার’।
রাত। কারাগারের সেই সিপাহী, যে কমান্ডারের পর ইসহাকের বাড়ীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলো, সে একাকি মরুভূমির বালির টিলা একের পর এক অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে অর্ধেকের বেশি রাস্তা অতিক্রম করে ফেলেছে। বিরামহীন গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে সেই পার্বত্য অঞ্চলের দিকে। আকাশে চাঁদ নেই। উন্মুক্ত মরুভূমির রাতের স্বচ্ছতা সম্বল করে পথ চলছে সে। চাঁদ না থাকলেও তারকার আলোতে পথ চলতে তেমন অসুবিধা হচ্ছে না। বেশি দূর দেখা যায় না, তবে কোথাও কোন আওয়াজ হলে তা অনেক দূর থেকেও ভেসে আসে।
আনমনে পথ চলছে সে, হঠাৎ দূর থেকে ঘোড়ার পদধ্বনি কানে এলো। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। খেয়াল করে দেখল, সামনের দিক থেকে একাধিক ঘোড়া এগিয়ে আসছে প্রহরী এক বালির টিলার পেছনে ঘোড়া সমেত লুকিয়ে পড়লো।
একটু পর পদধ্বনি আরো স্পষ্ট হলো, সেই সাথে ভেসে এলো ওদের কথার আওয়াজ। প্রহরী টিলার আড়ালে বসে ওঁৎ পেতে দেখল তিনটি ঘোড়া ধীরে ধীরে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। সে তলোয়ার হাতে নিলো।
ওরা আরো খানিকটা এগিয়ে এলো। এখন সে কমান্ডারের কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। ইসহাকের ব্যাপারেই আলাপ করছে কমান্ডার। কমান্ডারের কণ্ঠ শুনেই প্রহরী চিনতে পারলো তাকে। ওই তো সেনাপতির পাঠানো কমান্ডার! তাহলে নিশ্চয়ই সাথের দু’জন দরবেশ ইসহাকের স্ত্রী ও কন্যা!
প্রহরী ভাবছিল, দরবেশের বাড়ী গিয়ে সে ওদের হুশিয়ার করবে। কমান্ডার যে এত তাড়াতাড়ি ওদের বের করে নিয়ে আসতে পারবে, তা ছিল তার ধারণার বাইরে। সে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। সংঘর্ষ ছাড়া এখন ওদের মুক্ত করার কোন পথ নেই। কিন্তু মুশকিল হলো, যাদের সে মুক্ত করতে চাচ্ছে, তারা জানেই না সে ওদের হিতাকাঙ্ক্ষী। লড়াই শুরু হলে মেয়ে দু’জনও তার প্রতিপক্ষে লড়বে। কারণ এরা পাহাড়ী নারী। লড়াইকে ওরা ভয় পায় না। একা তিনজনের বিরুদ্ধে লড়তে যাওয়া বোকামী। তার ওপর পুরুষটি কোন সাধারণ লোক নয়, একজন চৌকস কমান্ডার। কিন্তু এ ছাড়া যে আর কোন গত্যন্তর নেই! সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো, সে লড়বে। নিশ্চয়ই ভাগ্য তাকে সহায়তা করবে। কারণ সে এক দরবেশ মানুষের পরিবারকে রক্ষা করতে যাচ্ছে। দরবেশের দোয়ার কি কোন মূল্য নেই!
ওরা প্রহরীর একদম কাছে চলে এসেছে। তারার আলোয় সে ওদের ভাল করে লক্ষ করলো। কমান্ডার ওদের নিয়ে নিশ্চিত মনে এগিয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে কোন সতর্কতার ভাব নেই। তলোয়ারটি অবহেলায় তার কমরে ঝুলছে। মেয়েদের সাথে কোন তলোয়ার নেই, সারা শরীর ও মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা থাকায় খঞ্জর আছে কি না তাও স্পষ্ট বুঝা গেল না।
ওরা ওকে অতিক্রম করে গেল। ঘোড়াসহ আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো প্রহরী। এক মুহূর্তে ভাল করে দেখে নিল ওদের অবস্থান। তারপর পিছু ধাওয়া করে তীব্র বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। তার অশ্বের পদধ্বনি কমান্ডারকে চমকে দিল। সে থমকে দাঁড়িয়ে তাকাল পিছন ফিরে। সঙ্গে সঙ্গে তলোয়ার বের করে পিছনে ঘুরলো। মুহূর্তে কমান্ডারের কাছে পৌঁছে গেল প্রহরী। তার ঘোড়ার গতি ছিল তীব্র। ছুটন্ত অবস্থায় ঘোড়ার ওপর থেকে কমান্ডারকে এমন জোরে আঘাত করলো, ডান হাত কেটে পড়ে গেল কমান্ডারের।
ঘোড়া ঘুরিয়ে সে আবার ফিরে এলো কমান্ডারের কাছে। কমান্ডারের তখন আর লড়াই করার ক্ষমতা নেই। সে চিৎকার করে দয়া ভিক্ষা চাইল, কিন্তু প্রহরী তার ঘাড়ে আবারো তলোয়ারের আঘাত করলো। ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেল কমান্ডার।
সঙ্গের একমাত্র পুরুষ মানুষটি ধরাশায়ী হওয়ায় পর্দানসীন মা ও মেয়ে ভয়ে জড়সড় হয়ে গেল। ইসহাকের স্ত্রী মেয়েকে বললো, ‘পালাও! ডাকাত মনে হচ্ছে।’
প্রহরী ঘোড়া নিয়ে তাঁদের পথ আতকে দাঁড়ালো এবং বললো, ‘এখানে কোন ডাকাতের দল নেই, আমাকে ভয় পেয়ো না। আমিই বরং তোমাদেরকে এক ডাকাত ও প্রতারকের হাত থেকে রক্ষা করলাম। এক বন্দীকে দেখতে গিয়ে তোমরা নিজেরাই বন্দী হয়ে পড়ো, তা আমি চাই না। এখন আর কারাগারে যাওয়ার দরকার নেই। তোমরা তোমাদের গ্রামের বাড়ীতে ফিরে যাও। আমাকেই যদি ভয়, তাহলে আমি কথা দিচ্ছি, আমি তোমাদের সাথে যাচ্ছি না। যতক্ষণ তোমাদের নিরাপদ মনে না করবো,ততক্ষণ তোমাদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব রেখে আমি তোমাদের অনুসরণ করবো। আরো বলছি, এখানে আর কেউ নেই, আমি একাই তোমাদেরকে এক ভয়ঙ্কর বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে ছুটে এসেছিলাম। এ লোক বন্দী দরবেশ ইসহাকের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করার জন্য তোমাদের অস্ত্র হিসাবে ব্যাবহার করতে চেয়েছিল।’
মা ও মেয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল! কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা বুঝতে পারলো না। অনেক্ষন পর্যন্ত মা-মেয়ে ওভাবেই অখানে স্তব্ধ বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শেষে ইসহাকের স্ত্রী বললো, ‘কি বলছেন আপনি? আমরা যে এর কিছুই বুঝতে পারছি না! আসল ব্যাপারটা কি খুলে বলুন তো?’ প্রহরী কমান্ডারের ঘোড়ার লাগাম তার ঘোড়ার জীনের সাথে বেঁধে বললো, ‘আগে আপনাদের বাড়ি চলুন, ওখানে গিয়েই সব বলবো। মরুভূমিতে রাত কাটানো নিরাপদ নয়।‘ ওরা ফিরে চললো বাড়ীর দিকে। ইসহাকের স্ত্রী বিস্ময় ও কৌতূহল দমন করতে না পেরে একটু পর বললো, ‘তিনি কি আসলেই বন্দী এবং আহত?’
‘হ্যাঁ, তিনি এখন কারাগারেই আছেন। না, তিনি আহত ছিলেন না, তবে তার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়েছে। সে নির্যাতনের ধকল সয়ে তিনি এখনো কিভাবে বেঁচে আছেন সে রহস্য আমার জানা নেই। আমরা বিশ্বাস করি, তার কাছে আল্লাহ্র অলৌকিক শক্তি আছে।‘
‘তার ওপর এ অকথ্য নির্যাতনের কারণ কি?’
‘তাকে সুদানী সেনাবাহিনীতে নিতে চাইছে সরকার। তাকে বলা হচ্ছে, তুমি বললেই তোমার পাহাড়ি এলাকার মুসলমানরা সুদানী সৈন্য বাহিনীতে ভর্তি হবে। সরকার চাচ্ছে, তিনি এবং তার কবিলার লোকেরা সুদান সরকারের আনুগত্য স্বীকার করুক। কিন্তু তিনি তা মানছেন না।‘
‘আলহামদুলিল্লাহ্। আল্লাহ্ তাকে হেফাজত করুন। কিন্তু কমান্ডার আমাদের কেন নিতে এসেছিল?’
প্রহরী উত্তরে বললো, ‘তার সামনে তোমাদের সম্ভ্রম নষ্ট করার হুমকি দিয়ে তাকে শর্ত মানতে বাধ্য করাতে চাচ্ছিল সরকার। যাকে আমি হত্যা করেছি, সে এক ফৌজি কমান্ডার। এ উদ্দেশ্যেই সেনাপতি তোমাদেরকে নিতে পাঠিয়েছিল তাকে। আমি বিষয়টি জেনে তার পিছনে লেগেছিলাম। আমি খুশি যে, আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি।‘
‘তুমি কে?’ ইসহাকের স্ত্রী জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কি মুসলমান?’
‘আমি সে কারাগারের প্রহরী।‘ সে উত্তর দিল, ‘না, আমি মুসলমান নই।‘
‘তবে কেন তুমি এ ঝুঁকি নিতে গেলে? আমাদের জন্য তোমার এমন সমবেদনার কারণ কি?’
‘তার ওপর যে নির্যাতন হয়েছে তাতে তার মরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি বেহুশও হননি। আমি এবং আমার সঙ্গীদের বিশ্বাস, তার কাছে অলৌকিক শক্তি আছে। তিনি মুক্ত হতে পারলে সে শক্তি দিয়ে আমাদের ভাগ্য ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতিও তিনি দিয়েছেন। কিন্তু তাকে মুক্ত করার কোন উপায় এখনো আমরা বের করতে পারিনি। এর মধ্যেই তোমাদের সর্বনাশ করার জন্য সেনাপতি ষড়যন্ত্র করছে জানতে পেরে আমরা তা বানচাল করার সিদ্ধান্ত নেই। এ কারনেই আমি এখানে ছুটে এসেছি।‘ প্রহরী বললো।
‘মানুষের ভাগ্য একমাত্র আল্লাহই পরিবর্তন করতে পারেন। ভাগ্য পরিবর্তনের অলৌকিক ক্ষমতা কোন মানুষের নেই। তিনি এমন ওয়াদা করতে পারেন না। আর যদি তিনি এমনটি বলে থাকেন তাহলে ভুল বলেছেন।‘ বললো ইসহাকের স্ত্রী।
‘কি বলছেন আপনি!’ প্রহরী বললো, ‘তার অলৌকিক ক্ষমতা তো আমি নিজের চোখে দেখেছি! এই যে আমাকে দেখুন, আমি মুসলমান নই। কারাগারের সামান্য এক প্রহরী। আমার এমন সাহস বা শক্তি নেই, যা নিয়ে আমি গর্ব করতে পারি। কিন্তু দেখুন, কি দুঃসাহসিক কাজ করলাম? আমাদের সেনাপতির মুখের গ্রাস কেড়ে নেয়ার শক্তি আমি কোথায় পেলাম? কি করে সামান্য প্রহরী হয়ে নিজের কমান্ডারকে খুন করলাম? আপনারা ছিলেন তিনজন, তারপরও কি করে আমি আপনাদের আক্রমণ করার সাহস পেলাম? এসবই তার গায়েবী শক্তি। তিনি সত্যি অলৌকিক ক্ষমতাধর। আপনি কেন তাকে আমার কাছ থেকে লুকাচ্ছেন?’
ইসহাকের স্ত্রী এই অন্ধ বিশ্বাসী লোকটির দিকে তাকিয়ে রইল। কি করে সে এ বিশ্বাস ভাঙবে বুঝতে পারলো না।
সকাল বেলা। ইসহাকের বাড়ীর সামনে চারটি ঘোড়া এসে থামলো। ঘোড়া থেকে নেমে দরজার কড়া নাড়ল ইসহাকের বিবি। ইসহাকের বাবা দরজা খুলে সামনে পুত্রবধু, নাতি ও তাঁদের সাথে আরও একজন অপরিচিত লোককে দেখে খুবই আশ্চর্য হলেন। হা করে তিনি তাকিয়ে রইলেন ওদের দিকে।
‘হা করে দেখছ দাদু? আমাদের ঢুকতে দাও।’
নাতনীর কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে সরে দাঁড়ালেন তিনি। ভেতরে ঢুকে বুড়োর প্রশ্নের জবাবে আবারো সমস্ত ঘটনা বিস্তারিত বলতে হলো প্রহরীকে। শুধু বললো না, কারাগারে ইসহাকের ওপর কি নির্যাতন হচ্ছে।
ইসহাকের বাবা তৎক্ষণাৎ কবিলার লোকদের ডেকে পাঠালেন। লোকেরা জড়ো হলে প্রহরী তাদেরকে বললো, ‘পাহাড়ী অঞ্চলের সমস্ত মুসলমান সুদানের সেনাবাহিনীতে যোগ দিলে সুদান সরকার ইসহাককে মুক্তি দিতে রাজী হয়েছে। শর্ত একটাই, তোমাদের সবাইকে সুদানের আনুগত্য কবুল করতে হবে।’ লোকেরা বললো, ‘ইসহাক কি বলেছে?’
‘ইসহাক তাদের স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, তোমরা আমাকে জীবনে শেষ করে ফেললেও আমি আমার জাতির সাথে গাদ্দারি করতে পারবো না, কাউকে তোমাদের আনুগত্য কবুল করতেও বলবো না।’
শুধু ইসহাকের কবিলা নয়, এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর পাহাড়ী অঞ্চলের সমস্ত মুসলমানরাই উত্তেজিত হয়ে উঠলো। সুদান সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়লো ওরা। একজন বললো, ‘এটা আল্লাহ্র জমিন! এখানে নাস্তিক সুদান সরকারের আধিপত্য চলবে না। আমরা ইসহাকের ওপর অত্যাচারের বদলা নেবো।’
‘আমরা কারাগারে আক্রমন চালিয়ে ইসহাককে মুক্ত করে আনবো।’ বললো অন্য একজন।
‘তোমরা তা পারবে না।’ প্রহরী বললো, ‘জেলখানা বড়ই দুর্ভেদ্য, সেখান থেকে কাউকে মুক্ত করা সম্ভব নয়।’
‘তুমি কারাগারের প্রহরী, তুমি আমাদের সাহায্য করলে আমরা নিশ্চয়ই তাকে মুক্ত করতে পারবো।’ ইসহাকের বাবা বললেন।
‘আমি গরীব ও সাধারন এক প্রহরী মাত্র।’ সে বললো, ‘আমি আপনার বেটাকে মুক্ত করতে কিইবা সাহায্য করতে পারবো? তাকে আমি সম্মান ও শ্রদ্ধা করি। তার এক নগন্য ভক্ত হিসাবে আমি আমার জীবনও দিতে তার জন্য বিলিয়ে দিতে পারি। এতে যদি আপনাদের কোন উপকার হয়, আমি প্রস্তুত। শুধু আমার গরীব পরিবারকে আপনারা একটু দেখবেন।’
‘তুমি যদি সত্যি তার ভক্ত হয়ে থাকো তবে তার আদর্শকে গ্রহন করো। তাহলে তুমি আমাদের সবার ভাই হয়ে যাবে। ভাইয়ের জন্য এমন কোন কোরবানী নেই, যা আমরা করতে পারিনা। মুসলমান হয়ে যাও, আর এখানে চলে আসো।’ ইসহাকের বাবা তাকে বললেন, ‘আমাদের এ পাহাড়ী অঞ্চলই আমাদের দুনিয়ার জান্নাত। এখানে পানির ঝর্ণাধারা আছে, আছে শস্য-শ্যামল মাঠ ও নানা রকম ফলের গাছ। এখানকার মাটি এমন ফসল দেয়, যে কৃষিকাজ করে না, সেও ক্ষুধার্ত থাকে না। এটা আমাদের ওপর আল্লাহ্র এক বিশেষ রহমত। এ পাহাড়ী এলাকা আমাদের কেল্লা! আমাদের দুর্গ! আমরা এখানে সবাই স্বাধীন। তুমি তোমার পরিবার পরিজন নিয়ে আমাদের এখানে চলে আসো, তোমার ভাগ্য বদলে যাবে।’
এ প্রস্তাব প্রহরীর খুবই মনপূত হলো। সে এখানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। ইসহাকের বাবার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে ইসলাম কবুল করলো সে। বুড়ো তাকে সন্তানের মর্যাদা দিয়ে তার কাছেই রেখে দিলেন।
ভোরের সূর্য অনেক উপরে উঠে এসেছে। সুদানী সেনাপতি অধীর আগ্রহে কমান্ডারের জন্য প্রতীক্ষা করছিল, কিন্তু তার কোন খবর নেই। ক্রমশঃ সময় গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল, তবু দেখা নেই কমান্ডারের। শংকিত হয়ে উঠলো সেনাপতি, তার কি কোন বিপদ হলো? নাকি সে পথ হারিয়ে ফেলেছে?
অনেক ভেবেচিন্তে শেষে সেনাপতি তার এক অফিসারকে ডাকলো। বললো, ‘কমান্ডার যে পথে গেছে সে পথে যাও, প্রয়োজন হলে ইসহাকের বাড়ী পর্যন্ত চলে যাবে। তারা রওনা না করলে তাদেরকে দ্রুত পাঠিয়ে দেবে, আর পথে থাকলে তাড়াতাড়ি আসতে বলবে। তুমি ওদের সাথে আসার অপেক্ষা না করে খবর নিয়ে আগেই চলে আসবে।’
ইসহাক একা পড়েছিল কামরায়। কামরায় পচা লাশ গলে মেঝে ভিজিয়ে দিচ্ছিল। কারাগারের প্রহরীরা, যারা কারাগারের দুর্গন্ধে অভ্যস্থ ছিল, তারাও ইসহাকের কামরার কাছ ঘেঁষতো না বিশ্রী গন্ধের ভয়ে। এক প্রহরী নাকে কাপড় বেঁধে ইসহাকের কাছে গিয়ে বললো, ‘আরে আহাম্মক! এ দুর্গন্ধ কেমন করে সহ্য করছো? এরা তোমাকে যা মানতে বলে, মেনে নাও আর এখান থেকে বিদায় হও। এ মরার গন্ধে তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে।’
‘আমার কোন দুর্গন্ধ লাগছে না।’ ইসহাক বললো, ‘এ তো মরা লাশ নয়, শহীদ! শহীদরা মরে না। আমি রাতে ওর সাথে কত গল্প করি!’
‘তুমি পাগল হয়ে গেছ। প্রহরী বললো, ‘লাশের এমন দুর্গন্ধে কেউ পাগল না হয়ে পারে!’
ইসহাক হেসে বললো, ‘হবে হয় তো বা!’
সে লাশের পাশে বসে হৃদয়ের সমস্ত আবেগ ঢেলে পবিত্র কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করতে লাগলো।
দিন গড়িয়ে রাত এলো। তারপর সে রাতও অতীত হয়ে গেল। প্রত্যুষে ফিরে এলো সেনাপতির পাঠানো অফিসার। এক দিনেই তার বয়স যেন বেড়ে গেছে দশ বছর। চেহারা বিবর্ণ, মলিন। এক দিকে দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি, অন্যদিকে বর্ণনার অতীত চাক্ষুস এক মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতা। সে যা দেখে এসেছে তা বর্ণনা করার ভাষা ছিল না তার।
সেনাপতি বললো, ‘কি হয়েছে খুলে বলো!’
‘পথে মরুভূমির মাঝামাঝি গিয়েছি, মাথার ওপর শকুন চক্কর দিচ্ছিল। এলাকাটা উঁচুনিচু বালুর টিলায় পরিপূর্ণ। আরেকটু এগুতেই দেখতে পেলাম এক স্থানে শকুন মরা খাচ্ছে। মরার পাশে পড়ে আছে তলোয়ার, তার জুতা, ছেঁড়া কাপড়। লাশটি কার চেহারা দেখে চেনার উপায় নেই। কেবল বীভৎস নয়, জঘন্য, কদাকার। আমার মনে সন্দেহ জাগলো। ভয় হলো, এটা আমাদের কমান্ডারের লাশ নয় তো! কৌতূহলের বশে লাশের কাছে এগিয়ে গেলাম। তাড়া করতেই শকুনরা সরে গেল একটু দূরে। তার খঞ্জর ও কোমরবন্ধ দেখে নিশ্চিত হলাম, হ্যাঁ, এটা আমাদের পাঠানো কমান্ডারেরই লাশ। আমি কতক্ষণ থ’ হয়ে দাড়িয়ে রইলাম। কিভাবে, কেন তিনি মারা গেলেন সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমি পাহাড়ী অঞ্চলের দিকে আরো কিছু পথ এগিয়ে গেলাম। বালিতে তার ঘোড়ার পদচিহ্ন খুঁজতে গিয়ে দেখতে পেলাম, তার ঘোড়া পাহাড়ী অঞ্চলে গিয়ে আবার ফিরে এসেছিল। ফিরতি পথে তার সাথে ছিল আরো দু’টো ঘোড়া। এতে প্রমাণ হয়, তিনি ইসহাকের পরিজনদের সাথে নিয়েই ফিরছিলেন। আমি কমান্ডারের লাশ পেলেও তার সাথীদের লাশ পাইনি। তার মৃত্যুর কারণ আমার কাছে স্পষ্ট নয়। ইসহাকের লোকেরা তাকে হত্যা করলে গ্রামেই করতে পারতো, আর তাকে বিশ্বাস না করলে তার কন্যা ও বিবিকে ওর সাথে আসতে দিত না। পথে এক কিশোরী ও এক নারী আমাদের কমান্ডারকে হত্যা করবে, এমনটা কল্পনাও করা যায় না। তাহলে কে তাকে হত্যা করলো? কোন ডাকাত দল পড়েছিল ওদের ওপর, তেমন কোন প্রমাণও পাইনি। সেই থেকে আমি অস্থির।’
সুদানী সেনাপতি বললো, ‘এ নিয়ে এত উতলা হওয়ার কিছু নেই। নিশ্চয়ই সব কিছুই আমরা জানতে পারবো। সে অঞ্চলে আমাদের যে গোয়েন্দারা কাজ করছে তারা ওই অঞ্চলেরই মুসলমান। সংবাদ সংগ্রহে তারা বেশ দক্ষ। ইসহাক সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তারাই সরবরাহ করেছিল। সে অঞ্চলে ইসহাকের অসম্ভব প্রভাব প্রতিপত্তির খবরও তারাই দিয়েছে। একটু সবুর করো, সব খবরই আমরা পেয়ে যাবো।’
হলও তাই। সন্ধ্যার পর দুই গোয়েন্দা এসে উপস্থিত হলো সেনাপতির কাছে। তারা জানালো, ‘কমান্ডার ইসহাকের মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ঠিকই রওনা দিয়েছিল। আপনার কারাগারের এক সিপাহী তাকে হত্যা করে মেয়ে দু’জনকে তাদের বাড়ীতে পৌঁছে দেয়।’
‘আমাদের কারাগারের প্রহরী! কি নাম তার?’
‘তার নাম ইরাজ মেহের।’ গোয়েন্দারা বললো সেনাপতিকে।
সেনাপতি সঙ্গে সঙ্গে এ সমস্যা সুদান সরকারের কাছে তুলে ধরলো। সরকার এ নিয়ে পরামর্শ করলো তাদের খৃস্টান উপদেষ্টাদের সাথে। খৃস্টান উপদেষ্টারা পরামর্শ দিল, ‘এ ব্যাপারে তোমরা নীরব থাকো। এ নিয়ে মুসলমানদের ওপর অভিযান চালানোর বোকামী করো না। তাদেরকে অন্য কোন ভালো পদ্ধতিতে বন্ধু বানাতে চেষ্টা করো। খুব বেশী হলে তোমরা গোপনে শুধু সেই সিপাহীকে হত্যা করতে পারো, যে তোমাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছে। তাতে মুসলমানরা বুঝবে, তোমাদের হাত থেকে কেউ রেহাই পায় না। যদি ইসহাক তোমাদের শর্ত গ্রহণ না করে, তবে অন্য মুসলমান কয়েদীদের মানাও, আর ইসহাকের ওপর উৎপীড়ন অব্যাহত রাখো।’
ইসহাকের ওপর নির্যাতন চলতেই থাকলো। সেনাপতি তার ওপর কমান্ডার হত্যার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে নির্যাতনের মাত্রা এতই বাড়িয়ে দিল যে, জ্ঞান হারাল ইসহাক।
রাতে সে বেহুশ হয়ে পড়েছিল এক কুঠরির মধ্যে। যখন জ্ঞান ফিরলো, কুঠরি অন্ধকার। কামরার বাইরে মশাল জ্বলছে। ইসহাক পাশ ফিরে শুতে গেল, তার হাত গিয়ে পড়লো কারো শরীরে। সে মনে করলো, এটা সেই লাশ, যা কয়েক দিন ধরে পড়ে আছে কামরায়। কিন্তু একটু পর তার মনে হলো, কেউ যেন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। সে ভাবলো, হয়ত মস্তিস্ক বিকৃতি ঘটেছে তার। তার শরীর অবশ লাগছিল, তাই সে আর উঠে দেখতে চেষ্টা করলো না, আসলেই কামরায় কোন মানুষ আছে কিনা?
একটু পর কামরায় কারো নড়ে উঠার শব্দ হলো। এবার চমকে উঠলো ইসহাক। চোখ মেলে সে চাইলো কামরার ভেতর। বাইরে থেকে আসা আবছা আলোয় সে পরিষ্কার দেখতে পেলো, তার পাশে কেউ একজন শুয়ে আছে এবং সে লোকটিই নড়াচড়া করছে। ইসহাক লোকটির মুখের উপর ঝুঁকে তার দিকে গভীরভাবে তাকালো। না, এটা কোন লাশ নয়, একজন জ্যান্ত মানুষ। আর এটা তার সেই কামরাও নয়, যেখানে বারবার তাকে রাখা হতো। এটা অন্য কোন কামরা। ইসহাকের মনে হলো, লোকটিও এতক্ষন বেহুশ ছিল, ধীরে ধীরে তার জ্ঞান ফিরছে। একটু পর লোকটিও চোখ খুললো। অন্ধকারের মধ্যেই ইসহাক তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কে তুমি?’
লোকটি ক্ষীণ কণ্ঠে উত্তর দিল, ‘উমরু দরবেশ!’
‘ও, হো! উমরু দরবেশ!’ ইসহাক অভিভূত হয়ে বললো, ‘আমি ইসহাক!’
সুলতান আইয়ুবী এ পর্যন্ত বলে একটু দম নিলেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, ‘এরা একে অপরকে ভাল করেই চিনতো। উমরু দরবেশও আমার একটি সেনাদলের কমান্ডার ছিল। সেও পাহাড়ী অঞ্চলের মুসলমান কবিলার লোক। উমরু দরবেশ ইসহাকের সাথে একই অভিযানে যুদ্ধবন্দী হয়। ইসহাকের নাম শুনেই সে উঠে বসলো।
‘তোমাকে কি শর্ত দিয়েছে?’ ইসহাক জিজ্ঞেস করলো।
‘বলছে, তুমি আলেম ও হুজুর সেজে দেশে যাও।’ উমরু দরবেশ বললো, ‘লোকদের নছিহত করো, তাদের বুঝাও, সুলতান আইয়ুবী দেশ ও ইসলামের শত্রু। আরও বলছে, আমরা তোমাকে ট্রেনিং দিয়ে দেবো, তোমাকে রাজার হালে রাখবো। আর আমাদের রঙমহলের যে সুন্দরী মেয়েকে পছন্দ করো তাকে চিরকালের জন্য উপহার দিয়ে দেবো তোমাকে।’
উমরু দরবেশ জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার কাছ থেকে কোন শর্ত আদায় করতে চাচ্ছে?’
‘তারা বলছে, তোমরা সম্প্রদায়ের সমস্ত মুসলমানদের সুদান সরকারের অনুগত করে দাও।‘ ইসহাক উত্তর দিল, ‘তার বিনিময়ে আমাকে আমাদের এলাকার আমীর বানিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। এরা পাহাড়ী মুসলমানদের সুদানী সেনাবাহিনীতে শামিল করতে চায়।’
‘আমার মনে হয়েছিল, তোমার উপর ওপর খুব নির্যাতন করছে ওরা।‘ উমরু দরবেশ বললো, ‘জানি না আমাদের দু’জনকে কেন একই কামরায় বন্দী করলো। সম্ভবতঃ এতে কোন মঙ্গল নিহীত আছে। আমিও চাচ্ছিলাম, তোমার সাথে আমার দেখা হোক। আমি একটি পথ চিন্তা করেছি; সে কাজ করার আগে তোমার সাথে পরামর্শ করার প্রয়োজন ছিল। ভালই হলো, তুমি আমার কাছে এসে গেছো।’
‘কি চিন্তা করেছো?’
‘তুমি তো দেখতেই পাচ্ছো, এরা আমাদের ছাড়বে না।’ উমরু দরবেশ বললো, ‘আমরা আর কতদিন নির্যাতন সহ্য করবো? এভাবে হয়তো আরো দু’চার দিন বেঁচে থাকবো, কিন্তু মরণ আমাদের এখানেই হবে। এখানে আরও কিছু সুদানী মুসলমান বন্দী বেঁচে আছে। কেউ না কেউ তাদের জালে আটকাবেই। আমি ভয় পাচ্ছি, আমাদের সাথীদের প্রলোভন দেখিয়ে আমাদের মধ্যে ফাটল ধরিয়ে দেবে। পথ একটাই, তা হলো, এদের শর্ত মেনে নেয়া। আমার ইচ্ছা তুমিও এদের শর্ত মেনে নাও। তারপর মুক্ত হয়ে নিজের এলাকায় গিয়ে বিশ্রাম নাও। নয়তো সুযোগ মতো রাতের আঁধারে সেখান থেকে পালিয়ে মিশর চলে যেও। তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে।
এদিকে আমি তাদের কথা মেনে নেই। তারা আমাকে যে শিক্ষা দেয়, তাই গ্রহণ করি। তাদের নির্দেশ মত বহুরূপী সেজে চলে যাই নিজের কবিলার কাছে। তারপর তারা যেন সুদানীদের কোন চক্রান্তে না পড়ে সে জন্য তাদের হুশিয়ার করি। যদি আমি তাদের সাথী হতে পারি, তবে আমি তোমাকে এখান থেকে বের করার চেষ্টা করবো।’ সে আরো বললো, ‘এমনও তো হতে পারে, আমাদের অনুপস্থিতিতে আমাদের কবিলার ওপর সুদানীরা আক্রমণ করে বসবে!’
ইসহাক বললো, ‘পাহাড়ী মুসলমানরা সহজে অস্ত্রসমর্পন করার মত নয়।’
‘কিন্তু সৈন্যদের শক্তির কাছে কতদিন ওরা টিকে থাকতে পারবে?’
‘আমাদের কোরবানী ওদের ঈমানকে মজবুত করবে।’ উমরু দরবেশ বলল, ‘কিন্তু বেরোতে পারলে আমরা মিশর থেকে কমান্ডো সাহায্য পাবো। বর্তমানে আমাদের প্রয়োজন, দু’জনের অন্ততঃ একজনের এখান থেকে বের হয়ে যাওয়া। যদি আমরা দু’জনই তাদের শর্ত মেনে নিয়ে বের হতে পারি, তবে আরও ভাল হয়।‘
‘আমি এখন কারাগারেই থেকে যাই।’ ইসহাক বললো, ‘তুমি একাই তাদের ধোঁকা দাও। আমরা দু’জনই যদি এক সাথে তাদের শর্ত মেনে নেই, তবে তাদের সন্দেহ হতে পারে। তারা চিন্তা করবে, দু’জন রাতে একই কামরায় থেকে এ পরিকল্পনা করেছে। তাই আমার পরামর্শ হচ্ছে, ‘আমি এদের উৎপীড়ন সহ্য করতে থাকি, তুমি মুক্ত হয়ে যাও।’
সকালে কারাগারের দরজা খোলা হলো। এক সেপাই বর্শা দিয়ে ইসহাকের গায়ে খোঁচা মেরে ধমক দিয়ে বললো, ‘এই উল্লুক, উঠ।’
ইসহাক উঠলে তাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেল প্রহরী। সঙ্গে সঙ্গে কামরার দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল।
কিছুক্ষন পর কামরায় ঢুকল আরেক সুদানী অফিসার। সে উমরু দরবেশকে বললো, ‘আজও যদি তুমি অস্বীকার করো, তবে আমি কল্পনা করতে পারি না, তোমার শরীরে কি পরিমাণ শাস্তি দেয়া হবে। কিন্তু আমরা তোমাকে মরতে দেবো না। তুমি এ দুনিয়াতেই দোজখ দেখতে পাবে। প্রতিদিন মরবে, প্রতিদিন বাঁচবে।’
‘আমাকে কোন ভালো জায়গায় নিয়ে চলো।’ উমরু দরবেশ বললো, ‘আমাকে একটু সুস্থ মাথায় ভাবতে দাও, এখানে আমি কিছুই চিন্তা করতে পারছি না।’
‘তুমি চাইলে আমি তোমাকে জান্নাতে নিয়ে যেতে পারি।’ অফিসার বললো, ‘তুমি সেখানে জান্নাতের পরীদের সাথে খেলা করবে। যদি তারপরও অস্বীকার করো, তবে যতদিন বেঁচে থাকবে, শুধু কপাল চাপড়াবে আর আফসোস করবে। পরে কেঁদে বললেও আর তোমাকে বিশ্বাস করা হবে না, সুযোগ দেয়া হবে না।’
উমরু দরবেশ যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে বললো, ‘আমি আর এ অত্যাচার সইতে পারছি না।’
‘তাহলে বলো, আমাদের শর্ত কবুল করেছো?’
‘না, তা হবে না। আগে আমাকে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে দাও। কিসে আমার কল্যাণ আর কিসে অকল্যাণ আমাকে হিসাব করে দেখতে হবে। যে দিকে পাল্লা ভারী হবে আমি সেদিকেই যাবো।’
সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিয়ে গেল সেই সুরম্য কামরায়, ইসহাককে আগে যেখানে রাখা হয়েছিল। একটু পর ডাক্তার এলো। তার শরীর পরীক্ষা করে ঔষধ দিল। উন্নতমানের খাবার দিল। আর ওদিকে সুদানী সেনাপতি ইসহাকের শরীর গুড়ো করছিল।
রাতে সেনাপতি এলো উমরু দরবেশের কাছে। বললো, ‘তুমি কি আমাদের শর্ত মানতে রাজী আছো?’
উমরু দরবেশ বললো, ‘তোমরা তোমাদের ওয়াদা ঠিক রাখবে তো?’
‘বিলকুল। ওতে আমাদের লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। বিনিময় ছাড়া কে কাজ করে, বলো? তুমি আমাদের খুশি করবে, আমরা তোমাকে খুশি করবো।’
উমরু দরবেশ কতক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে রইলো। শেষে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বললো, ‘ঠিক আছে।’
সেনাপতি বিদায় হলো। রাতের খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লো উমরু দরবেশ। একটু পর তলিয়ে গেল ঘুমের অতল তলে। যখন চোখ খুললো, রাত শেষ হয়ে দিনেরও অর্ধেক পার হয়ে গেছে।
দীর্ঘদিন কারাগারে নির্যাতন সহ্য করে তার শরীর বেশ দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছিল অসহ্য ব্যথা ও কষ্ট। এমন আরামের বিছানায় কতকাল ঘুমায়নি সে! তাই রাতে সে বেহুশের মত ঘুমিয়েছিল।
অল্পদিনেই পুষ্টিকর খাবার ও বিশ্রামের ফলে তার স্বাস্থ্য কিছুটা ফিরে এলো। দ্রুত আরোগ্যের জন্য ডাক্তার তাকে যে ঔষধপত্র দিয়েছিল, তাও ভালো ফল দিল। দুর্বলতা বেশ কাতিয়ে উঠলো উমরু দরবেশ।
দু’দিন পর। চোখ খুলেই সে দেখতে পেলো, কামরায় এক মেয়ে। তাকে চোখ খুলতে দেখে মেয়েটি মিষ্টি করে হাসলো। মেয়েটি অসাধারণ সুন্দরী। তার সোনালী চুল কাঁধ পর্যন্ত ঝুলে আছে। মেয়েটির সুডৌল বাহু, কাঁধ এবং বুকের অর্ধেকটা খোলা।
উমরু দরবেশ এক সামরিক অফিসার। শৈশব কেটেছে পাহাড়ে, জঙ্গলে। যৌবনের শুরুতে যোগ দিয়েছে সামরিক বিভাগে। যুদ্ধের ময়দানেই কেটে গেছে বাকিটা জীবন।
মেয়েটাকে দেখে তার মনে হলো স্বপ্ন দেখছে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে কোন পরী। কিন্তু মেয়েটা যখন অগ্রসর হয়ে তার মাথায় হাত রাখলো, তখন তার বিশ্বাস হলো, এটা স্বপ্ন নয়, বাস্তব।
মেয়েটি বললো, ‘এখন কেমন বোধ করছেন? দাঁড়ান, আমি ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে আসছি।’
ও পাশের কামরা থেকে ডাক্তারকে ডেকে আনলো। ডাক্তার এসে তাকে ঔষধ খাইয়ে চলে গেল। একটু পর এলো দুই খৃস্টান, তারা চমৎকার সুদ্ধভাবে সুদানী ভাষায় তার সাথে কথা শুরু করলো। এরা এসেছিল উমরু দরবেশকে সেই মিশনের জন্য তৈরি করতে, যার জন্য সুদানীরা এতদিন অপেক্ষা করছিল। তারা তাকে বললো, ‘আপনি নিজের এলাকায় গিয়ে কখনো কাউকে বলবেন না, আপনি কারাগারে ছিলেন। তাদের আপনি বলবেন, মিশর বাহিনীর সুদান আক্রমন ঠিক হয়নি। নেতাদের এ ধরণের আত্মঘাতি সিদ্ধান্তের খেসারত দিতে হচ্ছে নিরীহ সৈনিকদের। নেতাদের ভুলের কারনেই তাদের ভাগ্যে নেমে এসেছে মৃত্যু ও বন্দিত্ব। মুসলমানদের উচিত সুদানীদের সহযোগিতা করে তাদের বন্ধুত্ব ক্রয় করা। নইলে সুদানীদের হাতে তাদের বরবাদী ও ধ্বংসের এ ধারা চলতেই থাকবে।’ খৃস্টানরা তাকে আরও উপদেশ দিল, ‘আপনি সব সময় আল্লাহ ভক্ত আলেমের পোশাকে থাকবেন। দিনভর তসবী তাহলিল ও দোয়া দরূদ নিয়ে পড়ে থাকবেন। সময় সুযোগ বুঝে মুসলমানদের মনে ঢুকিয়ে দেবেন সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ও মিশর সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও অবজ্ঞার ভাব।’
উমরু দরবেশ খুশী মনে তাদের প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ শুরু হয়ে গেল তার ট্রেনিং ও রিহার্সাল। সন্ধ্যা পর্যন্ত এ দুই খৃস্টান তার সাথে সময় কাটালো। সন্ধায় বিদায় নিল তারা।
রাতেও মেয়েরা তার সামনে সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করলো। খাবারের সাথে পরিবেশন করলো শরাব। কিন্তু তিনি শরাব স্পর্শ করলেন না। খাওয়ার পর মেয়েরা এঁটো থালা বাসন গুটিয়ে নিয়ে চলে যেতেই একটি মেয়ে ফিনফিনে পাতলা নাইটি পরে কামরায় প্রবেশ করলো। তার চোখে মুখে খেলা করছিল অশ্লীল আবেদন।
‘তুমি কেন এসেছ?’ উমরু দরবেশ মেয়েটিকে প্রশ্ন করলো।
‘আপনার সেবা করতে।’ মেয়েটি উত্তর দিল, ‘রাতে আপনার যে কোন প্রয়োজনে আমাকে আপনার পাশে পাবেন।’ ‘তোমার নাম কি?’
‘আশী!’ মেয়েটি উত্তর দিল এবং নিঃসঙ্কোচে এগিয়ে গিয়ে পালঙ্কের ওপর তার পাশে বসে পড়লো।
‘আশী!’ উমরু দরবেশ বললো, ‘আমার তোমাকে প্রয়োজন নেই। তুমি বরং এখান থেকে চলে যাও।’
‘আজ সারা রাত আপনার পাশে আমার ডিউটি আমার। দায়িত্বে অবহেলা করলে এর জন্য আমাকে জবাবদিহী করতে হবে। আপনার আমাকে প্রয়োজন না হতে পারে, কিন্তু আমার ডিউটিতে আমি অবহেলা করতে পারি না।’
‘এরা যে শর্ত মানাতে আমাকে এখানে এনেছে আমি তা মেনে নিয়েছি।’ উমরু দরবেশ বললো, ‘আমাকে বশ করতে এখন তোমার রূপের ঝলকের প্রয়োজন নেই।’
‘আমি তা জানি।’ আশী বললো, ‘আপনার সম্পর্কে আমাকে সবই বলা হয়েছে। শর্ত মানার কারণেই আমাকে পুরস্কার হিসেবে পাঠানো হয়েছে আপনার কাছে। আপনি অস্বীকার করলেও কর্তৃপক্ষ জানে, সৈন্যরা যখন যুদ্ধের ময়দান থেকে আসে তখন তার প্রাণ মেয়েদের কোমল পরশ পেতে আগ্রহী থাকে।’
‘আমি পরাজিত সৈনিক।’ উমরু দরবেশ বললো, ‘আমার মন ও প্রাণ মরে গেছে। ঘৃণা ধরে গেছে নিজের প্রতি। আমার দেহ মন দু’য়েরই আজ ফুরিয়ে গেছে সব প্রয়োজন। আমি পরাজিত সৈনিক। স্বাদ আহলাদ আমার জন্য নয়।’
মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠলো, যেন কোন জলতরঙ্গের বাজনা। বললো, শরাবের দু’চার ঢোক পান করলেই আপনার এ অনুভূতি কেটে যাবে। দূর হয়ে যাবে দেহ ও মনের সব অবসাদ। আনন্দের সুর শুনতে পাবেন নতুন করে।’ মেয়েটি বললো, ‘তখন আমার দিকে তাকালে আপনি আমার মধ্যে ফুলের সৌরভ ও সৌন্দর্য দেখতে পাবেন।’
‘আমাকে মাফ করো আশী! আমি এক মুসলমান।’ উমরু দরবেশ বললো, ‘মুসলমান কোন মেয়ের সম্ভ্রম নিয়ে খেলা করে না, বরং তাদের সম্ভ্রম হেফাজত করে।’
‘আপনি মুসলমান হিসাবে মেয়েদের সম্ভ্রমের হেফাজতের চিন্তা করতে পারেন, কিন্তু আমি মুসলমানও নই, আর আমার সম্ভ্রম বলতেও কিছু নেই। আপনি কিসের হেফাজত করবেন?’
‘তুমি মুসলমান না হতে পারো, তোমার নিজের সম্ভ্রম না থাকতে পারে, কিন্তু আমি মুসলমান। আমার ইজ্জতের ভয় আছে, পরকালের ভয় আছে। তুমি সারা রাত আমার পাশে বসে থাকলেও আমাকে তুমি পাথরের মত নিষ্প্রাণ পাবে। হালাল মেয়ে ছাড়া আমরা কারো দিকে হাত বাড়াই না।’
‘কেন, আমি কি তাদের মত সুন্দরী নই?’ প্রশ্ন করলো আশী।
‘তুমি যেমনই হওনা কেন, আমার তাতে কিছু যায় আসে না।’ উমরু দরবেশ বললো, ‘হ্যাঁ, তুমি যদি এ জঘন্য জীবন থেকে মুক্ত হও, তবে আমি তোমাকে এখান থেকে মুক্ত করে নিয়ে যেতে পারি। তুমি চাইলে কোন সম্মানিত ঘরে তোমাকে আশ্রয় দিতে পারি।’
‘আপনার আগেও একজন এখানে এসেছিল। সেও আপনার মতই কথা বলতো। সেও সুদানী মুসলমান ছিল।’ আশী বললো, ‘তবে আমি আপনার একথা মেনে নিতে পারছি না, মুসলমান বলেই মেয়েদের প্রতি আপনার কোন আগ্রহ নেই। আমি মিশরের অনেক মুসলমানকে দেখেছি, তারা মেয়েদের দেখলে ক্ষুধার্ত পশুর মত ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমি তিনজন মিশরী মুসলমানের কথা বলতে পারি, যাদের আমি এ শরাবের বোতল দিয়ে বিশ্বাসঘাতক ও গাদ্দার বানিয়ে ছিলাম। তারা কি তবে মুসলমান নয়?’
‘তারা বেঈমান! তারা নিজেদের ঈমানকে বিক্রি করে দিয়েছিল তোমাদের ফাঁদে পড়ে।’ উমরু দরবেশ বললো, ‘আশী! আমি ভাবছি, তুমি কেমন মা বাবার সন্তান? তারা কি তোমার এ ভূমিকার কথা জানে?’
‘জানি না! কে আমার বাবা আর কে মা, সে কথাও জানিনা আমি। তারা এখন কোথায়, বেঁচে আছে না মৃত, তাও জানি না!’ আশী বললো, ‘আপনার আগেও এক ব্যাক্তি আমাকে এ প্রশ্ন করেছিল। জানিনা এখন তিনি কোথায়?’
‘কি নাম ছিল তার?’
‘তার নাম ছিল ইসহাক। এ কামরাতেই তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। তিনি আমার মা-বাবাকে নিয়ে প্রশ্ন করে আমাকে ভীষণ অশান্তিতে ফেলে দিয়েছিলেন। তার আগে এমন প্রশ্ন কোন দিন কেউ আমাকে করেনি। তার প্রশ্ন শুনে আমি সারা রাত চিন্তা করেছিলাম, আমার মা-বাবা কারা, কোথায় ও কেমন ছিল? আমার স্মৃতিতে যে ছবি ভেসে উঠে আমি তা স্মরণ করতে চাই না। আমি তাদের ভুলে থাকতে চেষ্টা করি। কিন্তু আপনাদের প্রশ্নে তা সম্ভব হয় না। তখন আমার মা-বাবার স্মৃতি আবার জীবন্ত হয়ে ওঠে। আমার সব আনন্দ ও সুখ তখন কোথায় যেন হারিয়ে যায়। উদাসীনতায় ছেয়ে যায় আমার প্রফুল্ল বদন। কষ্টের ভূত চেপে বসে ঘাড়ে।’
‘তোমার কোন ভাইও বোধ হয় ছিল না।’
‘কিছুই মনে পড়ে না।’ আশী বললো, ‘আমি রক্তের সম্পর্ক কাকে বলে তা জানি না।’
‘তোমার চোখে ঘুম আসছে, শুয়ে পড়ো।’ উমরু দরবেশ বললো।
‘না, আমার চোখে আপনি যা দেখছেন তা ঘুম নয়, হতাশার হাহাকার ও কষ্টের ছোঁয়া। যা মানুষের চোখের আলোকে নিভিয়ে দেয়। আলোর এ নিষ্প্রভতাকেই আপনার মনে হচ্ছে ঘুম।’ আশী বললো, ‘আমার তো মন চাচ্ছে আপনার সাথে সারা রাত এভাবে গল্প করে কাটাই। কিন্তু আপনি কেন আমার জন্য জেগে থাকবেন! আপনি বরং ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি আপনার শান্তিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে চাই না।’
‘আশী! তোমার মনে আমি কষ্ট দিতে চাইনি। আমার কথায় তুমি কষ্ট পেয়েছো, এ জন্য আমি দুঃখিত।’
‘বিশ্বাস করুন, আপনার মত লোক আমার খুব পছন্দ। আমি যে সব লোকের সাথে সময় কাটাই তাদের আমি ঘৃণা করি, তবুও তাদের সামনে আমাকে হাসতে হয়। সেই সুদানী মুসলমান, যার কথা আপনাকে একটু আগে বলেছি, তার কথা আমার সারা জীবন মনে থাকবে। তারপর এলেন আপনি। আপনার কথাও আমি চিরদিন সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবো। আপনার সামান্য একটু কথা আমার মধ্যে এক নতুন আবেগ ও অনুভূতির জন্ম দিয়েছে। আমার মনে হচ্ছে, আমিও মানুষ, আমারও প্রাণ আছে। আপনি আমার মনে এ কোন আত্মা জাগিয়ে দিলেন? অন্যেরা আমাকে কেবল ভোগের সামগ্রী মনে করে। এতদিন আমিও নিজেকে তাই ভাবতাম। আপনি আমার মনে এ কোন সুর সৃষ্টি করলেন?’
‘আশী! তুমি তো সেই মানুষ, যাকে আল্লাহ্ তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বলেছেন। তোমার এ দেহের মাঝেই আছে আত্মা ও বিবেক। তুমি তোমার বিবেকের কথা কান পেতে শোন, বুঝতে পারবে তুমি কে? সবাই তোমাকে ভোগের সামগ্রী মনে করে, কিন্তু আল্লাহ্ তোমাকে যে জ্ঞান ও বুদ্ধি দিয়েছেন, তাঁর কাছে জিজ্ঞেস করো, তুমি কে?’ উমরু দরবেশ বললো।
‘আমি এক মনোরম সুমিষ্ট বিষ।’ আশী বললো, ‘পাথরকে গলিয়ে মোম করার ট্রেনিং দেয়া হয়েছে আমাকে। আমি কোন কোমলমতি সরল-সহজ গ্রাম্য মেয়ে নই। আমি অত্যাচারী শাসকের তলোয়ার লুটাতে পারি আমার পদতলে। ধ্যান ভাঙাতে পারি মুনি-ঋষির। কিন্তু আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আমি এখন এমন মোম, যার কোন দাহ্যগুণ নেই, সে আর পাথরকে গলাবে কি করে?’
‘এটা আমার কথার প্রভাব নয়!’ উমরু দরবেশ বললো, ‘এটা ঘটেছে তোমার ভেতরে সত্যের প্রতি যে টান আছে, সে টানের কারণে। তোমার বিবেক তোমাকে শাসন করছে। রক্তের বন্ধনের মধ্যে যে উষ্ণতা, সেই উষ্ণতার জন্য হাহাকার জুড়ে দিয়েছে তোমার হৃদয়। আমি তো কেবল তোমাকে রক্তের সম্পর্কের ব্যাপারে সামান্য সজাগ করে দিয়েছি। তুমি কারো মেয়ে, কারো বোন। কারো তুমি আদরের ধন, আবার কারো কাছে সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পাত্র। তোমার স্নেহের কাঙ্গাল কেউ, আবার কারো স্নেহ পাবার জন্য তোমার মন আকুলি বিকুলি করে। এই আত্মীয়তার বন্ধনের কারণে লোক ভেদে তোমার পরিচয় হয় ভিন্ন ভিন্ন। এভাবেই গড়ে উঠে সমাজ, সভ্যতা। বিচিত্র বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে মানুষ। নানা রকম সুর-ছন্দ, রূপ-রস, বর্ণ-গন্ধ ও চিত্তের বিত্ত বৈভবে ভরে ওঠে আল্লাহ্র এ সাজানো বাগান। মানুষ কোন জড় পদার্থ নয় যে, ভোগের মত স্থুল কোন একক উদ্দেশ্যে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।’
সম্মোহিতের মত তার কথা গিলছিল আশী! কখনো কল্পনার পাখা মেলে হারিয়ে যাচ্ছিল পাহাড়ে-জঙ্গলে। কখনো স্বপ্নের তরীতে পাড়ি দিচ্ছিল দরিয়া, সাগর। একজন কথা বলছিল নিজের ভেতর নিমগ্ন হয়ে, অন্যজন আত্মমগ্ন হয়ে শুনছিল তার কথা। উমরু দরবেশের চোখের দৃষ্টি চষে ফিরছিল পৃথিবীর প্রান্তর, আশী ডুবে গিয়েছিল ভাবনার অতল তলে।
রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। কখন যে ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে গেল আশী, নিজেই টের পেলো না। তার চোখ বন্ধ হয়ে গেলো। পালঙ্কের ওপর বসে ছিল সে, সেখানেই কাত হয়ে পড়লো। সকালে যখন চোখ খুললো, দেখলো পালঙ্কের ওপর শুয়ে আছে সে, উমরু দরবেশ নিচে বিছানা পেতে তখনো ঘুমুচ্ছে। সে উমরু দরবেশকে না জাগিয়ে তার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো। মনের ভেতর অনুভব করলো, দুরন্ত সাইমুম ঝড়ের অসহ্য দাপাদাপি। গালে হাত দিয়ে তন্ময় হয়ে বসে রইল আশী। এক সময় অনুভব করলো, তার দু’চোখ থেকে নেমে এসেছে অশ্রুর দু’টি ক্ষীণ ধারা। সে আশ্চর্য হলো, তার চোখেও অশ্রু আছে! জীবনে এত দুঃখ পেয়েছে, কই, কখনো তো কান্না পায়নি! সে উমরু দরবেশের পাশে নতজানু হয়ে বসলো। তার হাত ধরে তুলে নিজের চোখের সাথে লাগালো।
উমরু দরবেশের ঘুম ভেঙ্গে গেল। চঞ্চল হয়ে উঠে বসলো সে। আশীর থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো। আশী তার হাত ছেড়ে দিল, কিন্তু মুখে কিছু বললো না। সে এ কথাও বললো না, আমাকে পালঙ্কে শুইয়ে আপনার নিচে শোয়া উচিত হয়নি। সে নীরবে আমরা থেকে বেরিয়ে গেল এবং একটু পর অজুর পানি নিয়ে ফিরে এলো। উমরু দরবেশ অজু করে ফজরের নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। আশী ধীর পদক্ষেপে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে।
সকালে নাস্তার পরে সুদানী সেনাপতি দুই খৃস্টান উপদেষ্টাকে নিয়ে আবার দেখা করলো উমরু দরবেশের সাথে। উমরু দরবেশ তাদের বললো, ‘আমার একটি কথা আপনারা ভালভাবে শুনে নিন। আমাকে যে কাজের ভার দিয়েছেন সেটা ইসহাকের এলাকা। আমার চেয়ে ওই এলাকার ইসহাকের প্রভাব অনেক বেশী। ইসহাকের সহযোগিতা পেলে সহজেই আপনাদের উদ্দেশ্য সফল করা যাবে। আপনারা ইসহাককে দলে টানতে চেষ্টা করুন।’
‘এ জন্য হেন চেষ্টা নেই, যা আমরা করিনি। লোভ, ভয়, নির্যাতন কোনটাই বাদ রাখিনি। কিন্তু সে আমাদের প্রস্তাব কিছুতেই গিলছে না।’ বললো সেনাপতি।
‘আপনাদের সে শত্রু মনে করে, তাই আপনাদের কোন প্রস্তাব সে কবুল করেনি। সে খুব দৃঢ় চরিত্রের লোক। কোন রকম নির্যাতন, উৎপীড়ন করে তাকে আপনারা বশ করতে পারবেন না। কিন্তু আমি তার শত্রু নই, আমার কথাকে সে নিশ্চয়ই গুরুত্ব দেবে। আমার কথা হচ্ছে, আমি যখন আপনাদের দলে যোগ দিয়েই ফেলেছি, তখন তাকেই বা দূরে থাকতে দেব কেন? আমি তার জন্য অন্য রকম ফাঁদ পাতবো। দেখা যাক, সে ফাঁদ কেটে সে বেরিয়ে যেতে পারে কিনা! সে জন্য আমার প্রস্তাব হচ্ছে, তার ওপর আর কোন নির্যাতন করবেন না। তাকে মুক্ত আলো-বাতাসে এনে সুস্থ করে তুলুন। অসহ্য যাতনার কারণে তার মাথা হয়ত বিগড়ে গেছে। এ অবস্থায় কোন কিছু সে ভালো ভাবে চিন্তা করতে পারবে না। তাকে একটু সুস্থ হতে দিন। কারাগার থেকে বের করে ভালো কামরায় রাখুন। সে আমার বন্ধু। একটু সুস্থ হলে পুরনো বন্ধুত্বের রেশ ধরে তার সাথে দেখা করবো আমি। আমার বিশ্বাস, আপনারা যা পারেননি, বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে আমি তা ঠিকই আদায় করে নিতে পারবো।’
‘তার ব্যাপারে আমরা নিরাশ হয়ে পরেছি। যদি তুমি ব্যর্থ হও?’
‘ব্যর্থ আমি হবো না। সে হবে আমার প্রথম টার্গেট। আপনারা জানেন না, ভালো মানুষ খারাপ হলে সে কতোটা খারাপ হতে পারে। শয়তান কাউকে নষ্ট করতে ব্যর্থ হলে নাকি বাঁকা পথ ধরে। সারা রাত নফল নামাজে দাঁড় করিয়ে রেখে মুসল্লির ফরজ কাজা করিয়ে দেয়। আমিও সেই পথ ধরবো। এমন সুন্দর করে ছলনা ও মিথ্যা পরিবেশন করবো, সে টেরও পাবে না, তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছি। তারপরও বলছি, যদি একান্তই ব্যর্থ হই, তখন আপনারা তার সঙ্গে যেমন খুশী ব্যবহার করতে পারবেন।’
সুদানী সেনাপতি বললো, ‘ঠিক আছে, তাই হবে।’
খৃস্টান উপদেষ্টারা উমরু দরবেশকে ট্রেনিং দিতে আরম্ভ করলো। তিনিও স্বতঃস্ফূর্তভাবে শিখতে লাগলেন প্রতারণার নানা কলাকৌশল। তারা যেভাবে তাকে কথা বলতে শেখাল, সে তারচেয়েও চমৎকার ভাষায় তা ওদের শুনিয়ে দিল। এভাবেই চললো চার পাঁচ দিন। তার প্রশিক্ষণ চলতেই লাগলো। দিনে খৃস্টান উপদেষ্টারা তাকে সঙ্গ দেয়, রাতে তার পাশে থাকে আশী। ইসহাকের মত আশীকে তাড়াতে চেষ্টা করেনি, বরং তাকে সে তার মুরিদ বানিয়ে নিয়েছে। আশী যখন কামরায় আসতো তখন তার মধ্যে কোন পাপ বোধ জাগতো না; বরং নিজের মধ্যে পবিত্রতার এক নতুন অনুভূতিতে ভরে যেতো তার হৃদয়।
এভাবেই কেটে গেল ছয়-সাত দিন। উমরু দরবেশ ওদের বললো, ‘আমি ইসহাকের সাথে এখন দেখা করবো না। প্রথমে আমি এলাকায় যেতে চাই। সেখান থেকে তাকে রাজী করাতে পারে এমন লোক ও খবর নিয়ে ফিরে আসবো আমি। তার আগে সেখানকার বিস্তারিত পরিবেশ বুঝে নেয়ার চেষ্টা করবো। আমার এ মিশনের সফলতার ব্যাপারে কি কি পদক্ষেপ নেয়া যায় তার বিস্তারিত পরিকল্পনা এবং পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তখন আপনাদের কাছে করতে পারবো।’
সেনাপতি তার এ প্রস্তাবেও সম্মত হলো। বললো, ‘ঠিক আছে, ততদিন সে আমাদের হেফাজতে আরামেই থাকবে।’
পরদিন এক দরবেশের পোশাকে এলাকায় যেতে প্রস্তুতি নিতে লাগলো উমরু দরবেশ। দরবেশের বেশ ধারন করে সে যখন তৈরি হলো, আশী বললো, ‘আপনি যেখানেই যান না কেন, আমাকে সঙ্গে নিয়ে যান।’
উমরু দরবেশ সেনাপতিকে বললো, ‘এ মেয়েটিকে উপহার হিসেবে সঙ্গে রাখতে চাই।’
আশীকে তার খেদমতে দিয়ে দেয়া হলো। বোরকা পরে সে এক পর্দানসীন মহিলার বেশ ধারণ করলো। তিনটি উট তাদের উপহার দিল সেনাপতি। একটায় উমরু দরবেশ, দ্বিতীয়টায় আশী ও তৃতীয় উটে তাঁবু, খাদ্য, পানীয় এবং অন্যান্য দ্রব্য বোঝাই করা হলো।
রওনা করার সময় সুদানী সেনাপতি উমরু দরবেশকে দু’টি কথা বললো, ‘আপনার অনুরোধে ইসহাককে কারাগার থেকে মুক্ত করে ভালো কামরায় আনা হয়েছে। তার ব্যাপারটি আপনি কখনই ভুলে যাবেন না। আর মুসলমান এলাকায় আমাদের লোকেরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। তারা আপনার সঙ্গে স্বেচ্ছায় মিশে যাবে ও সাহায্য করবে। আপনি তার যে কোন সাহায্য গ্রহণ করতে পারবেন। আপনার নিরাপত্তার দিকেও তারা সতর্ক দৃষ্টি রাখবে।’
উমরু দরবেশ আশীকে সঙ্গে নিয়ে এক ভয়াবহ ও জটিল অভিযানে যাত্রা করলো।
সুদানী সেনাপতি তাদের বিদায় দিয়েই ছুটে গেল তার নিজের কামরায়। সেখানে ছয়জন লোক বসা ছিল। ওরা সবাই সুদানী মুসলমান এবং পার্বত্য এলাকার বাসিন্দা। তাদের জন্য সুদান সরকারের নিয়মিত ভাতা ও উপহার বরাদ্দ থাকতো। তারা নিজের এলাকায় পাকা মুসলমান হয়ে সুদানীদের চর হিসাবে মিশে থাকতো স্থানীয় জনগণের সাথে।
‘সে চলে গেছে!’ সেনাপতি তাদের বললো, ‘তোমরা অন্য রাস্তা দিয়ে চলে যাও। সবাই আলাদা আলাদা ভাবে যাবে। তার প্রতি প্রত্যেকেই করা দৃষ্টি রাখবে। যদি তোমাদের সন্দেহ হয়, সে ঠিকমতো কাজ করছে না, ধোঁকা দিচ্ছে, এমন পদ্ধতিতে তাকে হত্যা করবে, যেন কেউ টের না পায়। আমি আরো লোক পাঠাচ্ছি, তোমরা তাদেরকে নিজের বাড়ীতে আশ্রয় দেবে।’
তারা সকলেই একের পর এক যাত্রা করলো।
সুদানী সেনাপতি সুদানী কিন্তু মুসলমান নয়, এমন দু’জনকে ডাকলো। তাদেরকে সেনাপতি বললো, ‘এ মুসলমানদের ওপর কোন ভরসা নেই। তারা নিজেদের এলাকায় গিয়ে সব এক হয়ে যেতে পারে। এ ছয়জন আমাদেরই লোক, কিন্তু একথা ভুলো না, এরা মুসলমান। এখান থেকে গিয়ে তাদের নিয়ত বদলে যেতে পারে। যদি উমরু দরবেশ বা এদের কারো নিয়ত বদলে যায়, তবে তোমাদের অস্ত্র ও বারুদের প্রয়োজন হবে। আমাদের অস্ত্র কোথায় গোপন আছে তা তোমরা জানো। আর সে অস্ত্র কোথায়, কখন এবং কেমন করে ব্যবহার করতে হবে তাও তোমাদের অজানা নয়। যাও, এবার জলদি রওনা হও।
এ দু’জনও রওনা হয়ে গেল।
সেই প্রহরী, যে ইসহাকের মেয়ে ও কন্যাকে রক্ষা করেছিল এবং কমান্ডারকে হত্যা করেছিল, সে ইসহাকের বাড়ীতেই থাকতো। যেদিন উমরু দরবেশ যাত্রা করলো, সেদিনের ঘটনা। প্রহরী বাইরে ঘোরাফিরা করছিল। হঠাৎ একটা তীর ছুটে এসে তার শরীর ছুঁয়ে পাশ কেটে এক গাছে গিয়ে বিঁধল। প্রহরী দৌড়ে ইসহাকের বাড়ীতে ঢুকে পড়লো।
সে ইসহাকের বাবাকে বললো, ‘আমার ওপর কে যেন তীর চালিয়েছে।’ কিন্তু কে তীর চালিয়েছে, কেন চালিয়েছে, কিছুই ওরা বুঝতে পারলো না। কেউ জানতেও পারলো না, সুদানীরা তাকে হত্যা করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে প্রথমবারের মত ব্যর্থ হয়েছে।
সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান তখনো কায়রোতে। সুলতান আইয়ুবি খৃস্টানদের বন্ধু ও ক্রীড়নক মুসলাম আমীর সাইফুদ্দিন, গুমাস্তগীন ও আল-মালেকুস সালেহের সম্মিলিত সৈন্যদের পরাজিত করে সম্মিলিত বাহিনীর হেডকোয়ার্টার হলবের দিকে অগ্রসর হলেন। ওসব গাদ্দার ও স্বার্থলিপ্সু মুসলিম শাসকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে ভয়ে তখন পালাচ্ছিলো। আতঙ্ক গ্রাস করে নিয়েছিল তাদের সৈন্যদের মন-মগজ। পথে বিশ্রামের কথা চিন্তা করারও কোন অবকাশ ছিল না তাদের। তবু সেনাপতিরা রাস্তার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থান নিয়ে বিচ্ছিন্ন সৈন্যদের একত্রিত করার চেষ্টা করলো। তখনো কারো কারো মাথায় কাজ করছিল সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর মোকাবেলা করার চিন্তা। কিন্তু সৈন্যরা পালানোর জন্য ছিল ব্যতিব্যস্ত। এ পলায়নী মনোবৃত্তি সামরিক বিবেচনায় তাদের জন্য ধ্বংস ও ক্ষতির যে কারণ সৃষ্টি করছিল, তা পূরণ করা সহজসাধ্য ছিল না।
সুলতান আইয়ুবীর অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলো। পথের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো একের পর এক দখল করে এগিয়ে চললেন তিনি। তাঁর এখন একমাত্র লক্ষ্য হলব শহর। মিশরের অভ্যন্তরে কোথায় কি ঘটছে সেসব কোন অবকাশ নেই সুলতানের। তাঁর সমস্ত মনোযোগ এখন যুদ্ধের ময়দানের দিকে। তবু মিশরের আভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্পর্কে নিয়মিতই খোঁজখবর রাখছিলেন তিনি। কাসেদ যথারীতি তাঁকে সারা দেশের সংবাদ পৌঁছে দিচ্ছিল। ময়দানের অবস্থা ছাড়াও এ সংবাদের মাধ্যমে তিনি মিশরের সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সব সময় অবহিত থাকতেন।
গোয়েন্দা মারফত এমন কিছু সংবাদ তিনি পেলেন, সাদামাটা চোখে যা তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কিন্তু বিচক্ষণ সেনাপতি ও দূরদর্শী শাসক হিসাবে ঘটনা বিশ্লেষণের যে অপূর্ব দক্ষতা তিনি অর্জন করেছিলেন, তাতে তিনি কয়েকটি ঘটনার যোগফল টানতে গিয়ে শিউরে উঠলেন। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, মিশরের আকাশে নতুন এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্র দানা বেঁধে উঠছে। এ চক্রান্তের শিকড় অনেক গভীরে। তিনি অনুভব করলেন, এ চক্রান্ত নতুন যে সমস্যার আবর্তে মিশরকে নিয়ে যাবে, এখনি সতর্ক না হলে সে আবর্ত থেকে বেরিয়ে আসা দুস্কর হবে।
যুদ্ধের ময়দানে কখনও সুলতান অস্থির হন না। কিন্তু চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের যে কোন ইঙ্গিত তাঁকে পেরেশান করে তোলে। নতুন করে ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত পেয়ে তাই তিনি যথেষ্ট বিচলিত বোধ করলেন। যখন তিনি বুঝতে পারলেন, এ ষড়যন্ত্র ও ধ্বংসাত্মক কাজের পিছনে রয়েছে খৃস্টানদের কূটবুদ্ধি, আর তাদের হাতের পুতুল হয়ে যে কাজ আঞ্জাম দিচ্ছে মুসলমানরা, তখন বেদনায় ছেয়ে গেল তাঁর অন্তর।
আলী বিন সুফিয়ান ছিলেন সুলতান আইয়ুবীর ডান হাত। পর্যবেক্ষকদের ভাষায়, আইয়ুবীর চোখ ও কান। সুলতান আইয়ুবী তাঁকে নিজের অবর্তমানে মিশরে রেখে যান এই আশায়, যে বিপদ তাঁর ছোট ভাই তকিউদ্দিন দেখতে পাবে না, বিপদ আসার আগেই তাঁর গন্ধ টের পেয়ে যাবে আলী বিন সুফিয়ান। মিশরের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই তিনি আলী বিন সুফিয়ানকে সঙ্গে না এনে তাঁর সহযোগী হাসান বিন আব্দুল্লাহকে নিয়ে এসেছেন যুদ্ধের ময়দানে।
মিশরের শাসন ক্ষমতায় এখন সুলতান আইয়ুবীর ছোট ভাই সুলতান তকিউদ্দিন। ভাইয়ের অবর্তমানে এতবড় জিম্মাদারী পালন করতে যেয়ে তিনি সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন নানা রকম প্রশাসনিক জটিলতায়। রাতে দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারেন না। কিন্তু যখনি মনে হয়, আলী বিন সুফিয়ান তাঁর সর্বক্ষণের সাথী ও উপদেষ্টা, তখন কিছুটা স্বস্তি বোধ করেন। এভাবেই মিশরের নিরাপত্তা ও শান্তি রক্ষায় দু’জনেই ছিলেন আন্তরিক, সচল ও সজাগ। ভালভাবেই বুঝতে পারছিলেন, সুলতান আইয়ুবীর অবর্তমানে মিশরে ধ্বংসাত্মক কাজ বেড়ে চলেছে। নাশকতামূলক তৎপরতা চলছে খৃস্টানদের ইন্ধনে। এ ছাড়া সুদানের দিক থেকেও চলছে ভয়ানক ষড়যন্ত্র। চার মাস আগে তকিউদ্দিন সুদানীদের এক অদ্ভুত ও খুবই ভয়ংকর আক্রমণ অসাধারণ সফলতার সাথে বানচাল করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে সুদানীরা দমে যায়নি। তারা এখনো সে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ তাদের যে আক্রমণ ব্যর্থ হয়েছিল, সেতা সামরিক আক্রমণ ছিল না।
সুদানের আক্রমণের আশংকায় সীমান্তে রক্ষীদের প্রহরা আরও দৃঢ় করা হলো। সীমান্তে রক্ষীদের সংখ্যা বাড়ানো হলো। এ ছাড়াও আলী বিন সুফিয়ান তাঁর গোয়েন্দা বিভাগের অসংখ্য লোককে সীমান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখলেন। এরা যাযাবর ও মুসাফিরের পোষাকে সীমান্তে ঘোরাফিরা করতো। এদের যোগাযোগ ছিল সীমান্তের ফাঁড়িগুলোর সঙ্গে। এদের জন্য সীমান্ত ফাঁড়িতে ঘোড়াও মজুদ থাকতো। সীমান্ত বাহিনীর টহলদার গ্রুপের সাথেও এদের যোগাযোগ ছিল। তাদের জন্য আরও একটা ব্যবস্থা ছিল, আলী বিন সুফিয়ানের কিছু দক্ষ গোয়েন্দা বণিকের বেশে সুদানের সাথে অবৈধ কারবার করতো। তাদেরকে মালামাল দিয়ে সীমান্ত পার করে দেয়া হতো; এরা সুদানে গিয়ে জানাতো, তারা মিশরের সীমান্ত রক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে এসেছে। সুদানে খাদ্য-শস্যের অভাব ছিল তীব্র। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর দক্ষ প্রশাসন ও কড়া তদারকির কারণে মিশরে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়ে গিয়েছিল। ফলে বাড়তি খাদ্যশস্য স্মাগলিং করার জন্য পৃথক করে রাখা হতো। আইয়ুবীর গোয়েন্দারা সেগুলো সীমান্তের ওপারে পাচার করে অর্থ সংগ্রহের পাশাপাশি সংগ্রহ করতো প্রয়োজনীয় তথ্য।
সুদানের যে বণিকরা মিশরের বণিকদের সাথে এ কারবার করতো তাদেরও অধিকাংশই ছিল আইয়ুবীর গোয়েন্দা। এরা মিশরের জন্য সারা দেশ ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করে আনতো। বণিকের বেশে গোয়েন্দাগিরি করার সুবিধা ছিল অনেক। খাদ্যশস্যের অভাবের কারণে এসব চোরাকারবারীদের চাহিদা ছিল সর্বত্র। প্রশাসন টের পেলেও তাদের কিছু বলতো না, কারণ দেশের খাদ্য ঘাটতির অভাব ওরাই পূরণ করছিল। সুলতান আইয়ুবীও নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন, ‘চোরাপথে সুদানে আরও কম দামে শস্য চালান দাও, যেন সুদানের সবখানে গোয়েন্দারা সহজে বিচরণ করতে পারে।’
এভাবে সুদানের সর্বত্র মিশরের গোয়েন্দারা ছড়িয়ে পড়ল। ফলে সুদানের সরকার ও সৈন্যদের সব কার্যকলাপের সংবাদ নিয়মিত কায়রোতে পৌঁছে যেতে লাগল।
আলী বিন সুফিয়ান সীমান্তের কয়েক স্থানে ঘাঁটি বানিয়ে রেখেছিলেন। কোন সংবাদ ওপার থেকে এসে পৌঁছুলে সঙ্গে সঙ্গে সে খবর কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা ছিল। বিদ্যুতগতি ঘোড়া সেখান থেকে ছুটে যেতো কায়রো। এ জন্য সেখানে নিয়োজিত থাকতো আলাদা অশ্বারোহী। তারা রাত দিন বিরামহীনভাবে পথ চলতো কায়রোর উদ্দেশ্যে।
সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী জানতেন, সুদানে একটি বিস্তীর্ণ পাহাড়ী অঞ্চল আছে, যেখানে শুধুমাত্র মুসলমানরাই বাস করে। সে অঞ্চলের অধিকাংশ লোক মিশরের সেনাবাহিনীর সমর্থক। যুবকরা সবাই মিশরের সেনা সদস্য। তিনি আরও জানতেন, ওখানকার মুসলমানরা সুদানের সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয় না। এর কি কারণ তা তিনি জানেন না, তবে দীর্ঘকাল ধরেই এমনটি চলে আসছে।
সুলতান আইয়ুবীর শাসনকাল শুরু হওয়ার আগের কথা। মিশরের সেনাবাহিনীতে তখনো সুদানী মুসলমান ও হাবশীরা ছিল। তাদের কমান্ডারও থাকতো সবসময় সুদানী।
সালাহউদ্দিন আইয়ুবী সুলতান হওয়ার আগে তাদের প্রধান সেনাপতি নাজীই (পাঠকের হয়তো স্মরণ আছে, কমান্ডার নাজীর নাম। ক্রুসেড সিরিজের প্রথম বইতে তাদের প্রধান সেনাপতি নাজীর বিস্তারিত বর্ণনা আছে) মিশরের সর্বেসের্বা শাসনকর্তা ছিল। তখন মিশরের শাসন চলতো কেন্দ্রীয় খেলাফতের অধীনে। সে হিসেবে মিশরের শাসক ছিলেন আমীর। সেনাপতি নাজী তখন আমীরের মর্যাদাও ভোগ করতো। কি খলিফা, কি আমীর সবাই ছিল দারুণ স্বেচ্ছাচারী।
খৃস্টানরা মিশরকে কেন্দ্রীয় খেলাফত থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য ধ্বংসাত্মক কাজ শুরু করে দিয়েছিল। নাজী তখন তাদের দোসর। সে মিশরের সুদানী সৈন্যদের পৃথক করে তাঁর অধীনে নিয়ে নিল। এ সৈন্যের সংখ্যা দাঁড়ালো প্রায় পঞ্চাশ হাজার।
সুলতান আইয়ুবী মিশরের শাসন ভার গ্রহণ করলে প্রথম সংঘর্ষ বাঁধলো নাজীর সঙ্গেই। সুলতান আইয়ুবী নাজীর বিদ্রোহ দমন করে বিদ্রোহী সেনাপতিদের বন্দী এবং সৈন্যদেরকে মিশরের অন্যান্য সৈন্যের সাথে একীভূত করে নতুন বাহিনী গঠন করেছিলেন। যারা নাজীর সহযোগী হয়েছিল তাদের ব্যপারে যখন সুলতানের এ আদেশ জারী হলো, তারা আনুগত্য পরিবর্তন করে মিশরের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চাইলে তাদেরকে মিশরের বাহিনীতে ভর্তি করে নেয়া হবে, তখন সুদানের সমস্ত মুসলমান সৈন্য মিশরের বাহিনীতে ফিরে এলো। তারা এও জানতে পারলো, তাদেরকে খৃস্টানদের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের গুটি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল।
সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীতে যোগদান করে তারা একাধিক যুদ্ধে বিক্রমের সাথে লড়াই করে তাদের বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিল। সুলতান আইয়ুবী তাদের যুদ্ধের কৌশল ও গতি নিকট থেকে লক্ষ্য করে তাদের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন। পরে তাদেরকে সামরিক এবং সেই সাথে ধর্ম, ঈমান ও জাতীয় মর্যাদাবোধের ব্যাপারেও ট্রেনিং দিলেন। তিনি তাদের বুঝাতে সক্ষম হলেন, মুসলমানের শত্রু কোন ব্যক্তি মানুষ নয়, যিনিই ইসলামের দুশমন তিনিই মুসলমানের শত্রু। মানবতার সেবায় নিজেদের বিলিয়ে দেয়াই মুসলমানের ধর্ম। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো মুসলমানের দায়িত্ব। মেয়েদের সম্মান ও সম্ভ্রম রক্ষা করা তাদের কর্তব্য। মানবতার বিরদ্ধে কোন অমুসলমান দাঁড়ালে সেটা যেমন অপরাধ, তেমনি অপরাধ কোন মুসলমান দাঁড়ালেও। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করা ফরজ, নীতির প্রশ্নে কারো সাথে আপোসের কোন অবকাশ নেই। বংশ, গোত্র, বর্ণ নয়, মানুষকে বিচার করতে হবে আদর্শ দিয়ে। এ জন্যই সুলতান আইয়ুবীর সৈন্য বাহিনী যখন আরবের বিদ্রোহী মুসলিম আমীরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ময়দানে এগিয়ে গেলো, এসব সুদানী সেনারা একবারও দ্বিধায় ভোগেনি, কেউ বলেনি, মুসলিম হয়ে মুসলমানের বিরুদ্ধে আমরা অস্ত্র ধরতে পারবো না।
কায়রোর গোয়েন্দা সংস্থার কাছে রিপোর্ট এলো, সুদান সরকার নানাভাবে পাহাড়ী এলাকার মুসলমানদের আনুগত্য আদায়ের চেষ্টা করছে। মিশরের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার পরিবর্তে সুদানী বাহিনীতে যোগ দিতে চাপ দিচ্ছে তাদের। কিন্তু পাহাড়ী মুসলমানরা সরকারের এ আদেশের প্রতি কর্ণপাত না করায় তারা এ ব্যাপারে উৎপীড়ন-নির্যাতনও চালাচ্ছে। পাহাড়ীদের বাধ্য করতে সামরিক অভিযানও চালিয়েছে। কিন্তু এর ফল ভালো হয়নি। পাহাড়ীদের তাড়া খেয়ে পালিয়ে গেছে সুদানী বাহিনী। সুদান সেনাবাহিনীর সিনিয়র এক অফিসার গোপনে সে এলাকায় এলে আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছে। পাহাড়ী এলাকা দুর্ভেদ্য, ফলে সুদানীদের সামরিক অভিযান সেখানে সফল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। স্বাধীনচেতা মুসলমানদের আত্মরক্ষার জন্য অঞ্চলটি খুবই উপযোগী। পাহাড়ের ঘেরাও এবং উপত্যকার সারি সব সময় তাদেরকে শত্রুদের আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত ও নিরাপদ রাখে। সেখানকার মুসলমানরা স্বভাব-যোদ্ধা, তাদের সাহস ও অটুট মনোবলই তাদের নিরাপত্তার জামিন।
সুলতান আইয়ুবী আলী বিন সুফিয়ানের মাধ্যমে তাদের সব খবরই জানতে পেরেছিলেন। তিনি মিশরের গোয়েন্দা বাহিনীর যে সব সদস্য চোরাকারবারী হিসাবে দক্ষতা অর্জন করেছিল তাদের দ্বারা সেই পাহাড়ী এলাকায় ভারি অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করলেন। অল্প দিনের মধ্যেই সেখানকার মুসলমানদের হাতে এত অস্ত্র জমা হয়ে গেল যে, সারা বছর যুদ্ধ চালালেও তাদের অস্ত্র ঘাটতি দেখা দেবে না। তারা এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিভিন্ন লোকের বাড়ী ও পাহাড়ের গোপন স্থানে লুকিয়ে রাখলো। তাদের অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে সুলতান আইয়ুবীর যুক্তি ছিল, স্বাধীনচেতা এসব মুসলমানরা যেন প্রকৃত পক্ষেই স্বাধীন থাকতে পারে সে জন্য তাদের সব রকম সাহায্য করা অন্য মুসলমানদের নৈতিক দায়িত্ব।
আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দারা চোখ-কান খোলা রেখেই সে এলাকায় অবস্থান করছিল। তারা কেবল তথ্য সন্ধানী গোয়েন্দাই ছিল না, দক্ষ এবং পরীক্ষিত কমান্ডো যোদ্ধাও ছিল। সেখানকার মুসলমান নারী পুরুষ সকলেই শারীরিক ও মানসিকভাবে যুদ্ধের জন্য পূর্ণরূপে প্রস্তুত ছিল। এদের মধ্য থেকে এলাকার নিরাপত্তা বিধানের জন্য পাঁচ হাজার শক্ত সামর্থ যুবক যোদ্ধাদের নিয়ে গড়ে তোলা হলো একটি বাহিনী। আলী বিন সুফিয়ানের পাঠানো কমান্ডো অফিসাররা তাদের প্রশিক্ষণ দিল। আইয়ুবীর পাঠানো অস্ত্রগুলো হাওলা করে দেয়া হলো তাদের। সুদানী হাবশী সৈন্যদের থেকে এদের প্রকৃতি আলাদা। হাবশীরা যুদ্ধ করে ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে। খৃস্টানরা তাদের যে বর্বরতার ট্রেনিং দিয়েছে তাই ওদের সম্বল। যুদ্ধের ময়দানে তাদের চাল-চলন হয় পশুর মত। দুশমন দুর্বল হলে তারা ব্যাঘ্র হয়ে যায়, আবার শত্রু সামনে অগ্রসর হলে নিজেকে বাঁচিয়ে সরে পড়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে ওরা।
সম্প্রতি এ অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে। মিশরের কিছু মুসলমান গাদ্দার সেনাপতি অর্থ-সম্পদের লোভে সুদানে চলে এসেছিল। এসব সেনাপতিরা সুদানের সামরিক বাহিনীকে ট্রেনিং দিয়ে তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করেছে। তারপরও সুদান সরকার মিশরের ওপর প্রকাশ্যে আক্রমণ চালাতে এখনও ভয় পায়। এ জন্যই সুদান সরকার পাহাড়ী মুসলমানদেরকে সুদানী বাহিনীতে ভর্তি করার ব্যাপারে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। খৃস্টান উপদেষ্টারাও জানে, পঞ্চাশ হাজার হাবশী সৈন্যের বিরুদ্ধে পাঁচ হাজার মুসলিম সৈন্য যথেষ্ট।
সুদানের মুসলিম অধ্যুষিত পাহাড়ী অঞ্চলে একটা বিরাট কাণ্ড ঘটে গেছে। সুদানী কারাগারের এক প্রহরী সুদানের সামরিক বাহিনীর এক কমান্ডারকে হত্যা করে মুসলিম অঞ্চলে এসে আশ্রয় নিয়েছে। যথাসময়ে এ সংবাদ আলী বিন সুফিয়ানের কানেও এসে পৌঁছল। সংবাদ বাহক আলী বিন সুফিয়ানকে এ সম্পর্কে বিস্তারিত ঘটনা শোনানোর পর বললো, ‘আমি ঘটনার সত্যতা যাচাই করার জন্য সে প্রহরীর সাথেও আলাপ করেছি। তার মুখে আরো শুনেছি, সুদানের কারাগারে ইসহাক নামে এক মিশরী অফিসার প্রচুর নির্যাতনের পরও এখনো বেঁচে আছে। কারাগারে তাঁর উপর অকথ্য উৎপীড়ন চালানো হচ্ছে। সুদান সরকার তাঁর কাছ থেকে কয়েকটি শর্ত আদায় করতে চায়। শর্তগুলো হলো, তাকে স্বপক্ষ ত্যাগ করে সুদানীদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে হবে। তার নিজ এলাকা মুসলিম প্রধান পাহাড়ী অঞ্চলের মুসলমানদেরকে সুদান সরকারের প্রতি অনুগত করার জন্য তাকে চেষ্টা করতে হবে। পাহাড়ী যুবকদেরকে মিশরের পরিবর্তে সুদানী সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সুদানীরা মনে করে, সে অঞ্চলের ওপর ইসহাকের এমন প্রভাব রয়েছে, সে শুধু রাজী হলেই হয়। বিনিময়ে তাকে ওই এলাকার সরদার বানিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু বন্দী এর কোন প্রস্তাবই কবুল না করে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করায় তার ওপর চলছে অব্যাহত নির্যাতন। প্রহরীর মতে এত নির্যাতনের পর কারো বেঁচে থাকাটা এক অলৌকিক ঘটনা। কোন মানুষ এর অর্ধেক নির্যাতনও সইতে পারে না।’
‘ইসহাককে এখন কারাগার থেকে মুক্ত করা আমাদের জন্য ফরজ হয়ে গেছে।’ আলী বিন সুফিয়ান গোয়েন্দার কাছ থেকে রিপোর্ট পাওয়ার পর সুলতান তকিউদ্দিনকে বললেন, ‘আপনি তো ভালো করেই জানেন, কারাগারে যুদ্ধবন্দীদের ওপর কি দুঃসহ উৎপীড়ন চালানো হয়। বন্দী করতে পারলে আমরাও তো পাথরকে দিয়ে কথা বলাই। এমনও হতে পারে, অত্যাচার সইতে না পেরে ইসহাক সুদানীদের শর্ত কবুল করতে বাধ্য হবে। আমি আরও জানতে পারলাম, আমাদের আরও দু’তিনজন কমান্ডার তাদের কারাগারে আছে। তাদের সকলের ওপরই চালানো হচ্ছে অকথ্য উৎপীড়ন। তাই আপনার কাছে আমার জোর দাবী ও পরামর্শ হচ্ছে, অবিলম্বে আমাদের কিছু কমান্ডোকে সুদানের মুসলিম এলাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। আমি আশংকা করছি, সুদানী কমান্ডার হত্যার প্রতিশোধ নিতে তারা অচিরেই আবার মুসলমানদের ওপর আক্রমণ চালাবে।’
‘অন্য দেশে কমান্ডো পাঠানোর আগে সে বিষয়ে আমাদের গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার।’ তকিউদ্দিন বললেন, ‘যত সাবধানেই পাঠানো হোক, এর গোপনীয়তা একদিন প্রকাশ হয়ে যেতে পারে। পরিণামে শেষে প্রকাশ্য যুদ্ধও বেঁধে যেতে পারে।’
‘এতসব চিন্তা করার মত সময় এখন আর আমাদের হাতে নেই।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘অতিসত্ত্বর আমাদের দু’টি কাজ করতে হবে। এক, সতর্ক ও দ্রুতগামী একজন কাসেদকে চিঠি দিয়ে এখনই সম্মানিত সুলতান আইয়ুবীর কাছে পাঠাতে হবে যাতে তাঁর সুচিন্তিত নির্দেশ জেনে নিতে পারি। আর দ্বিতীয় কাজ হলো, আমি নিজে গোপনে সুদান প্রবেশ করতে চাই। সেখানকার মুসলমানদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে আমার। স্বচক্ষে তাদের অবস্থা দেখলে একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে। আমি চাই, সেখানে যেন কোন সামরিক হস্তক্ষেপ না হয়। খৃস্টান ক্রুসেডাররা সেখানেও ছায়ার মত লেগে আছে। তারা মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির যে কোন সুযোগকে কাজে লাগাবে। যুদ্ধ শুরু হলে সেই সুযোগে তারা ওখানকার মুসলমানদের আদর্শ ও বিশ্বাসের ধারা পাল্টে দিতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত মুসলমানদের ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে স্থানীয় মুসলিম নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে। মসজিদে তাদের পোষা মৌলভী পাঠিয়ে উল্টোপাল্টা ফতোয়া দিয়ে মুসলমানদের বিপথগামী করতে পারে। তারা এমন চক্রান্ত এর আগে মিশরেও করেছে। আমার ভয় হচ্ছে, সেই চক্রান্ত এবার সেখানকার মুসলমানদের ওপর চালিয়ে তাদের বিশ্বাস ও আকীদাকে কলুষিত ও বিপথগামী করার চেষ্টা করবে খৃস্টানরা। আপনি ভাল করেই জানেন, আমাদের মূর্খ সমাজ এ অবস্থায় নিজের ঈমানের হেফাজত করতে পারে না। শত্রুদের আবেগময় কথা ও জ্বালাময়ী ভাষণে তারা সহজেই বিপথগামী হয়ে যায়। শত্রুরা ভাল করেই জানে, মুসলমানদের যুদ্ধের ময়দানে পরাজিত করা কঠিন কিন্তু তাদের ঈমান ও আকিদা বিনষ্ট করতে পারলে, সে লোকের মুসলমান থাকা না থাকায় কিছু যায় আসে না। চেতনাহীন মুসলমানকে মেষপালের মতই যেদিকে খুশী তাড়িয়ে নেয়া যায়। আপনার অনুমতি পেলে আমি এখনই সেখানে রওনা করতে প্রস্তুত। আর আমার পরামর্শ হচ্ছে, আপনি অতিসত্ত্বর সুলতান আইয়ুবীর কাছে কাসেদ পাঠিয়ে দিন।’
‘এখানে আপনার অনুপস্থিতিতে কে আপনার দায়িত্ব পালন করবে?’ সুলতান তকিউদ্দিন জিজ্ঞেস করলেন।
‘কেন, গিয়াস বিলকিস করবে!’ আলী বিন সুফিয়ান উত্তর দিলেন, ‘তার সঙ্গে আমার একান্ত সহযোগী জাহেদীনও থাকবে। আমার অভাব ওরাই পূরণ করবে, আপনার কোন অসুবিধা হবে না।’
‘আপনার অভাব কি তাদের দ্বারা পূরণ হবে?’ তকিউদ্দিন বললেন, ‘আপনি শত্রু রাজ্যে যাচ্ছেন, যদি সেখান থেকে সহিসালামতে ফিরে আসতে না পারেন তবে মিশর অন্ধ ও বধির হয়ে যাবে।’
‘আমি না ফিরলেও এ দেশ ও জাতি ঠিকই থাকবে।’ আলী বিন সুফিয়ান হেসে বললেন, ‘ব্যক্তি জাতির জন্য প্রাণ দেয় বলেই জাতি বেঁচে থাকে। সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গী নেই, দেশ ও জাতি কি শেষ হয়ে গেছে? মনে করুন সুলতান আইয়ুবীও একদিন থাকবেন না, তাই বলে কি জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে? আর তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যুদ্ধের ময়দান থেকে ডেকে এনে কি তাঁকে ঘরে বন্দী করে রাখতে হবে? যদি তিনি তলোয়ারের সামনে বুক ফুলিয়ে না দাঁড়াতেন তবে এতদিনে ক্রুসেড বাহিনী সমস্ত দেশ করায়ত্ব করে নিতো। মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বলেই তিনি নিজে বাঁচতে পেরেছেন, বাঁচাতে পেরেছেন দেশ এবং জাতিকে। মহামান্য সুলতানের সেই কথা আমার খুবই ভাল লাগে, তিনি বলেন, ‘কখনও ঘরে বসে শত্রুর আক্রমণের অপেক্ষা করবে না। শত্রুর দিকে কড়া দৃষ্টি রাখো। তারা তোমাকে আক্রমণ করতে প্রস্তুত হলে, আঘাত হানার আগেই তুমি তাদের ওপর আক্রমণ চালাও।’ আমি তাঁর এ আদেশ স্মরণ করেই সুদান যাচ্ছি। শত্রু যদি মুসলিম এলাকায় আধিপত্য কায়েম করেই বসে, তখন তাদের উৎখাত করার জন্য আমরা প্ল্যান করতে বসবো, মহামান্য আইয়ুবী কখনোই এ নীতিতে বিশ্বাসী নন।’
‘ঠিক আছে, আপনি রওনা হোন।’ তকিউদ্দিন বললেন, ‘আমি এক্ষুনি সুলতানের কাছে চিঠি লিখে কাসেদকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
আলী বিন সুফিয়ান সুদানে প্রবেশ করার প্রস্তুতি নিতে চলে গেলেন। তকিউদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে কাতিবকে ডেকে পাঠালেন এবং চিঠি লিখাতে শুরু করলেন। তিনি সুদানের মুসলিম এলাকার ঘটনা বিস্তারিত লেখানোর পর এ কথাও লিখালেন, ‘এই পত্র আপনার কাছে পৌঁছার আগেই আলী বিন সুফিয়ান সুদানে পৌঁছে যাবেন।’ তকিউদ্দিন আলী বিন সুফিয়ানের পরামর্শও লিখে জানালেন এবং এ ব্যাপারে সুলতান আইয়ুবীর কি মত তা তাড়াতাড়ি জানাতে বললেন।
কাসেদকে চিঠি দিয়ে তকিউদ্দিন বললেন, ‘প্রত্যেক ফাঁড়িতে ঘোড়া পরিবর্তন করে নেবে। পথ চলবে তীব্র গতিতে। কোথাও অহেতুক সময় নষ্ট করবে না। পানাহার সারবে চলতি ঘোড়ার পিঠে। রাস্তায় শত্রুর হাতে ধরা পড়লে গোপনে নষ্ট করে ফেলবে চিঠি।’ তকিউদ্দিনের চিঠি ও নির্দেশ নিয়ে কাসেদ তখুনি রওনা হয়ে গেলো সুলতান আইয়ুবীর উদ্দেশ্যে।
উমরু দরবেশ শহর থেকে অনেক দূরে চলে এসেছেন। আশেপাশে কোন বসতি নেই। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। উমরু দরবেশ রাতে বিশ্রামের জন্য নিরাপদ একটা জায়গা খুঁজছেন। অনেক দূরে গাছের চিহ্ন দেখতে পেলেন তিনি। আশা করলেন, সেখানে নিশ্চয়ই পানির ব্যবস্থা আছে। কিন্তু তার এ মুহূর্তে পানির কোন প্রয়োজন নেই। নিজের এবং উটের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ পানি তার সঙ্গেই আছে। সফরে বেরুনোর সময়ই তিনি পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা করে নিয়েছিলেন। কারণ তিনি মরূদ্যান থেকে দূরে অবস্থান করতে চাচ্ছিলেন, যাতে মরু ডাকাত দলের হাত থেকে আত্মরক্ষা করা যায়। তাঁর সঙ্গে ছিল আশী। আশী পর্দানশীন মুসলিম মহিলাদের মত কালো বোরকা পরে পথ চলছিল উমরু দরবেশের সঙ্গে। আশী কেবল যুবতীই নয়, রূপে-গুণেও অনন্যা। তার কমনীয় চেহারায় কোন ডাকাতের দৃষ্টি পড়লে তাকে রক্ষা করা মুস্কিল হয়ে পড়বে। সীমাহীন বালির পাহাড়ের মাঝে এক টুকরো ছোট্ট পাথুরে পাহাড় নজরে পড়লো উমরু দরবেশের। মরূদ্যানের চাইতে এ পাহাড়ের পাদদেশই তার কাছে অধিক নিরাপদ বলে মনে হলো। তিনি সে পাহাড়ের পাশে গিয়ে উটকে থামিয়ে দিলেন। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে উট থেক নেমে এলেন নিচে। তারপর তাঁবু টানিয়ে যখন ভেতরে যাবার কথা চিন্তা করছিলেন তখন দেখলেন দূরে দু’জন অশ্বারোহী। অশ্বারোহীরা তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে।
তিনি আশীকে ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে তাঁবুর পর্দা নামিয়ে দিলেন আর নিজে তাঁবুর বাইরে প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে রইলেন। তার জোব্বার মধ্যে শুধু খঞ্জর নয়, তলোয়ারও লুকানো আছে। খঞ্জর আছে আশীর কাছেও। তীর ধনুকও আছে তাঁবুর মধ্যে। ওগুলো বাইরে আনার কোন প্রয়োজন অনুভব করলেন না উমরু দরবেশ। অশ্বারোহীদের এগিয়ে আসতে দেখে তিনি চিন্তা করতে লাগলেন, যদি তারা ডাকাতই হয় তবে তিনি একা কি তাদের মোকাবেলা করতে পারবেন? পরক্ষনেই তাঁর মনে হলো, আশী শুধু মনোরঞ্জনের মেয়েই নয়, সে যুদ্ধও করতে জানে। তীরন্দাজী ও তলোয়ার চালানোর প্রশিক্ষণ তার ভালই নেয়া আছে। এ মেয়ে গোয়েন্দা হওয়ার প্রশিক্ষণ পেয়েছে খৃস্টানদের কাছ থেকে। উপযুক্ত প্রশিক্ষণের আগে এদের কোন অভিযানে প্রেরণ করা হয় না।
অশ্বারোহীরা এগিয়ে আসছিল, উমরু দরবেশ সেদিকে তাকিয়ে থেকেই আশীকে বললেন, ‘তীর-ধনুক হাতে নাও। যদি এরা ডাকাতের দল হয় তবে আড়াল থেকেই তীর চালিয়ে যাবে।’
অশ্বারোহীরা তাঁবুর কাছে এসে থামলো। একজন ঘোড়ার পিঠে থেকেই বললো, ‘তুমি কে? কোথায় যাচ্ছো?’
উমরু দরবেশ আকাশের দিকে হাত ইশারা করে একটু মাথা ঝুঁকিয়ে কাঁপানো স্বরে বললেন, ‘যার বুকে আসমানের খবর আছে তার কি কোন ঠিকানা আছে?’ একটু থেমে আকাশের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত জড়ানো স্বরে বললেন, ‘আর আমি কে তা আমি নিজেই জানি না। এক সময় আমি একটা কিছু ছিলাম; আকাশ থেকে একটা খবর এলো। আর সে খবর আমার বুকের মধ্যে শব্দ করে উঠলো। আমার বিবেক প্রকাশ করলো আমি কে; এবং কথায় যাচ্ছি! আমার বুকের মধ্যে আলো নেমে এসেছে, সেই আলোই বলতে পারে, এতে আমার ইচ্ছার কোন প্রাধান্য নেই। আমি সামনেই যাচ্ছিলাম। খুব সম্ভব কাল সকালে পিছনের দিকে যাত্রা করবো।’
দু’জনই ঘোড়া থেকে নেমে পড়লো। একজন জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার কথায় বুঝা যাচ্ছে, আপনি একজন পীর দরবেশ। আমরা দু’জনই মুসলমান, আপনি কি কোন গায়েবী সংবাদ জানেন? আমাদের মত গোনাহগারদের সরল রাস্তা দেখাতে পারবেন?’
‘আমিও মুসলমান!’ উমরু দরবেশ ভাব-গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘তোমরা মুসলমান হলেও এখন আমি আমার চোখের সামনে কেবল তোমাদের ধ্বংসই দেখতে আচ্ছি। একদিন আমিও তোমাদের মত জিজ্ঞেস করতাম, কোনটি সোজা রাস্তা। কেউ বলতে পারলো না। রক্তাক্ত ময়দানে লাশের মধ্যে সবুজ রংয়ের জোব্বা পরা এক সাদা দাড়িওয়ালা বুজুর্গ লোককে দেখতে পেলাম; তিনি আমাকে লাশের মধ্য থেকে উঠালেন এবং সোজা সরল পথ দেখালেন। পরক্ষণেই তিনি লাশের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।’ চুপ করলেন উমরু দরবেশ। আকাশের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন আগন্তুকদের দিকে। বললেন, ‘তোমরা পাহাড়ী এলাকার বাসিন্দা হলে সে অঞ্চলে ফিরে যাও। মিশরের নাম মন থেকে মুছে ফেলো। মনে রেখো, মিশর ফেরাউনের দেশ। সেখানে যে শাসকই আসুক, তাকে মিশরের মাটি ও আবহাওয়া ফেরাউন বানিয়ে দেয়।’
‘এখন তো সেখানকার শাসক সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী।’ এক অশ্বারোহী বললো, ‘তিনি তো একজন পাক্কা মুসলমান।’
‘তার নাম তো মুসলমান ঠিকই!’ উমরু দরবেশ এমন স্বরে বললেন, যেন তিনি স্বপ্নের ঘোরে কথা বলছেন, ‘তিনিই তো তোমাদের ধ্বংস ডেকে আনছেন। বাঁচতে চাইলে তোমরা যে মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছো সে মাটির সম্মানে রক্ত প্রবাহিত করো। তোমরা সুদানের সন্তান! সুদান তোমাদের জীবন, সুদান তোমাদের স্বপ্ন। আল্লাহ্ সুদানে তোমাদের পয়দা করেছেন সুদানের সেবা করার জন্য। যারা জন্মভূমির হোক আদায় করে না তাদের কপালে দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কি থাকতে পারে!’
‘কিন্তু সুদানের শাসক তো একজন বিধর্মী, কাফের!’ এক অশ্বারোহী বললো।
‘তিনি মুসলমান হয়ে যাবেন।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘তিনি ইসলামের পথেই আছেন, কিন্তু তার সেনাবাহিনীর সবাই বিধর্মী বলে তিনি মুসলমান হিসাবে পরিচয় দিতে পারছেন না। তোমরা সবাই চলে যাও। তীর, ধনুক, তলোয়ার ও বর্শা হাতে নিয়ে উট ও ঘোরায় সওয়ার হয়ে চলে যাও ময়দানে! প্রতিরোধ করো দুশমন! তাদের বলো, আমরা এদেশের প্রহরী, সুদানের রক্ষীবাহিনী।’ তিনি উচ্চস্বরে বললেন, ‘যাও! এখান থেকে চলে যাও!’
দু’জনেই ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল সেখান থেকে। কিছুদূর যাওয়ার পর একজন অপরজনকে বললো, ‘না, নেমকহারামী করবে না, ছলনাও করবে না।’
‘আমারও তাই ধারণা।’ অপরজন বললো, ‘লোকটিকে বিশ্বাসীই মনে হয়। সে তার কথা ও ট্রেনিং মোটেও ভুলে যায়নি।’
‘আশীর মত একটি সুন্দরী মেয়ে পুরস্কার পেলে আমরাও মা-বাবাকে ভুলে যেতাম, নিজের জাতির বিরুদ্ধে চলে যাওয়া তো আরো সহজ।’ অন্য আরোহী বললো।
‘যাক, আমরা ফিরে গিয়ে বলতে পারবো, সব ঠিকই আছে। আশীও আছে তার সাথে।’
‘লোকটিকে খুবই সতর্ক মনে হয়! সতর্কতার কারণেই সে মেয়েটাকে পর্দার আড়ালে আমাদের থেকে দূরে রেখেছে।’
‘হ্যাঁ, লোকটা যে পরিমাণ সতর্ক তাতে আমার মনে হয় তাদের হেফাজতের জন্য আর আমাদের পাহারার প্রয়োজন নেই।’
‘প্রয়োজন না হওয়ারই কথা।’ অপরজন বললো, ‘সে একজন সৈনিক। তার কাছে অস্ত্র আছে, তীর-ধনুক আছে, আর আশীও ট্রেনিংপ্রাপ্ত।’
এ দুই অশ্বারোহীর দু’জনই সুদানী গোয়েন্দা! উমরু দরবেশের পিছনে গোয়েন্দাগিরী করার জন্য এদের পাঠানো হয়েছে। তিনি সুদানীদের নির্দেশ অনুযায়ী ঠিক মত কাজ করছেন কি না এটা তদারক করা ওদের দায়িত্ব। উমরু দরবেশও সুন্দর অভিনয় করে তাদের দেখিয়ে দিলেন, তিনি ওদের ট্রেনিং মোটেই ভুলেননি। লোক দু’জন তার অভিনয়ে মুগ্ধ ও খুশী হয়ে ফিরে গেল।
‘এরা ডাকাত নয়।’ উমরু দরবেশ তাঁবুর মধ্যে গিয়ে আশীকে বললেন, ‘ওরা বিদায় হয়ে গেছে।’
‘এরা ডাকাতের চেয়েও ভয়াবহ!’ আশী কঠিন কণ্ঠে বললো, ‘ভাগ্য ভাল যে, তুমি ওদের কৌশলে বিদায় করতে পেরেছ।’
‘কেন, এদের মধ্যে তুমি ভয়াবহতার কি দেখলে!’
আশী বললো, ‘যারা তোমাকে এদিকে পাঠিয়েছে এরা তাদেরই গোয়েন্দা। এরা তদন্ত করে দেখতে এসেছে, তুমি এখনো তাদের অনুকূলে কাজ করছো, নাকি তাদের প্রতিকূলে কিছু করছো।’
‘তুমি ওদেরকে চেনো?’
‘আমি তো এক বৃক্ষের অন্য এক শাখা।’ আশী বললো, ‘ওদের থেকে বিচ্ছিন্ন হলে আমি তো শুকিয়ে মরে যাবো।’
‘তবে তো তোমার থেকেও সাবধান থাকা দরকার!’ উমরু দরবেশের কণ্ঠে কৌতুক।
আশী হেসে বললো, ‘তা আর পারলে কই? নিজেই তো আমাকে পুরস্কার হিসাবে চেয়ে নিয়ে এলে!’
রাতে তার উভয়েই তাঁবুর ভেতর গভীর ঘুমে মগ্ন। হঠাৎ কাছেই কোথাও নেকড়ে বাঘ গর্জন করে উঠল। নেকড়ে বাঘের গর্জন শুনে তাঁবুর পাশে বেঁধে রাখা উট দাঁড়িয়ে গেল। নেকড়ের গর্জনের জবাবে উটও আশ্চর্য ধরনের গর্জন শুরু করলো। এ বিচিত্র গর্জন শুনে আশীর ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম ভাঙ্গতেই আশী ভয়ে একেবারে জড়োসড়ো হয়ে গেল। সে উমরু দরবেশকে জাগালো এবং ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো, ‘নেকড়ে!’
উমরু দরবেশ বাইরের শব্দ ও গর্জন শুনে আশীকে বললেন, ‘ভয়ের কিছু নেই। এটা নেকড়ে বাঘের আওয়াজ! এরা এখন আর কাছে আসবে না, কারণ উট দাঁড়িয়ে গেছে। নেকড়ে বাঘ উটের কাছে আসে না।’
সহসা নেকড়েরা নিজেদের মধ্যেই লড়াই শুরু করে দিল। এক সাথে গর্জন করে উঠল একাধিক নেকড়ে। তাতে এমন ভয়ঙ্কর শব্দ হলো যে, আশী ভয়ে চিৎকার দিয়ে উমরু দরবেশের কলে গিয়ে লাফিয়ে পড়লো। উমরু দরবেশ বিছানায় বসেছিলেন, তিনি আশীকে এমনভাবে বাহু বন্ধনে আশ্রয় দিলেন, যেমন মা তার শিশুকে আগলে রাখে। আশীর সমস্ত শরীর ভয়ে কাঁপছিল। মুখ দিয়ে কোন কথাই বলতে পারছিল না সে। নেকড়ে বাঘ পরস্পর লড়াই করতে করতে দূরে চলে গেল। আশী উমরু দরবেশকে জরিয়ে ধরে তার কোলে তেমনি পড়ে রইলো।
উমরু দরবেশ আশীকে সান্তনা দিয়ে বললেন, ‘নেকড়ের দল চলে গেছে, এখন নিশ্চিন্তে গিয়ে শুয়ে পড়ো।’
‘না!’ আশী তার মাথা কোল থেকে বের করে কম্পিত স্বরে বললো, ‘আরও একটু এমনিভাবে থাকতে দাও।’
উমরু দরবেশ এমন অবস্থা মোটেই পছন্দ করলেন না। তিনি চিন্তা করতে লাগলেন, মেয়েটি কি স্বপ্নের জালে তাকে আটকাতে চাচ্ছে? তিনি আরও কঠিন এবং পাষাণ হয়ে গেলেন। মেয়েটির নরম শরীর লেপ্টে আছে তার শরীরের সাথে। ওর রেশম কোমল চুল তাকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। তিনি চিন্তা করতে লাগলেন, এ মেয়ে যদি আরও কিছু সময় তার কোলে পড়ে থাকে তবে অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়া বিচিত্র নয়। কারণ তিনিও তো মানুষ! তিনি মনকে যথাসাধ্য বাঁধতে চেষ্টা করে গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘উঠো আশী, ঘুমোতে যাও!’
আশী তার কোল থেকে মাথা উঠালো। রাতের অন্ধকারে মেয়েটির চেহারার অভিব্যক্তি দেখতে পেলেন না উমরু দরবেশ। আশী অন্ধকারে হাতড়িয়ে উমরু দরবেশের মুখ খুঁজে নিয়ে সে মুখ দুই হাতে চেপে ধরে বললো, ‘তুমি এক রাতে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে, তোমার মা-বাবা কে, এখন তারা কোথায়?’ তোমার অন্য সাথি, যার সাথে তোমার আগেই আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল, সেও একই প্রশ্ন করেছিল। তোমাদের এ প্রশ্ন আমাকে খুবই বিচলিত করে রেখেছিল। আমি আমার অতীত জীবনের সমস্ত স্মৃতি রোমন্থন করেও এর কোন সদুত্তর খুঁজে পাইনি। শৈশবের কথা ভাবতে গিয়ে শিশুকালের কিছু স্মৃতির আবছা আভাস ভেসে উঠলো মনের কোণে। কিন্তু সে স্মৃতি মনের মধ্যেই আবার হারিয়ে গেলো। আজ যখন তুমি আমাকে দু’টি বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরে আগলে রেখেছিলে, তখন আমার মনে শিশুকালের স্মৃতি প্রভাত আলোর মতই স্পষ্ট হয়ে উঠলো। মনের কোণে জেগে উঠল বহু পুরাতন স্মৃতি। আমি তখন অতি ক্ষুদ্র এক বালিকা। আমার বাবা আমাকে এমনিভাবে দুই বাহুতে জড়িয়ে ধরে বুকে চেপে রেখেছিল।’
সে নীরব হয়ে গেল এবং সেই পুরাতন স্মৃতির মর্ম উদ্ধারের চেষ্টা করতে লগল। উমরু দরবেশ অবাক হয়ে শুনছিল তার কাহিনী। সহসা সে শিশুর মত চঞ্চল স্বরে বলে উঠলো, ‘হ্যাঁ, আমার বাবা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল। এমনই এক মরু অঞ্চল ছিল সেটা। আমার মনে নেই, তখন রাত না দিন ছিল। তবে বেশ মনে পড়ছে, আমরা এক কাফেলার সাথে কোথাও যাচ্ছিলাম। সহসা অনেক ঘোড়সওয়ার এসে কাফেলা ঘিরে ফেললো। তাদের হাতে তলোয়ার ও বর্শা। সে এক বিভীষিকাময় কাহিনী! সবকিছু স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে। আজ যখন তোমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম এবং তুমি তোমার বাহু দিয়ে আগলে ধরলে আমায়, তখনই চট করে স্মৃতি ভেসে উঠল আমার স্মরণে। একটু একটু করে এখন সব কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে আমার। সে সময় বাবা ঠিক তোমার মতই আমাকে কোলে চেপে রেখেছিল। হ্যাঁ, ঠিক তোমার মত! আমার এখন মনে পড়ছে, এক সময় আমার বাবার বাহু শিথিল হয়ে গেল। তিনি পিছনের দিকে ঢলে পড়লেন। শেষবারের মত আমাকে জোরে চেপে ধরলেন বুকের সাথে। বাবা মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই মা আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন, হয়তো আমাকে উদ্ধারের শেষ চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু মা বেশীক্ষণ আমাকে ধরে রাখতে পারলেন না। এক দিকে ঢলে পড়লেন তিনিও। চারদিকে তখন রক্ত, রক্ত আর রক্ত! আমার চোখে এখনও সে রক্তের ধারা ভাসছে। হঠাৎ কে যেন হাত দিয়ে আমাকে উঠিয়ে নিলো সে রক্তের সমুদ্র থেকে। একজন বলে উঠলো, ‘আরে! এ যে একদম খাঁটি হীরা! যৌবনকালে দেখবে এর রূপ ও সৌন্দর্য!’ আমি তখন যে চিৎকার দিয়েছিলাম সে কথাও মনে পড়ছে। আজ যেমন চিৎকার দিয়েছিলাম সেদিনও ঠিক এমন করেই চিৎকার দিয়েছিলাম আমি।’
উমরু দরবেশ তার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘আমি সমস্ত ঘটনাই বুঝতে পেরেছি। তুমি এক মুসলিম পরিবারের কন্যা! তুমি ফিলিস্তিনের অথবা তার আশপাশের কোন এলাকার সন্তান। খৃস্টানরা তখন সুযোগ পেলেই মুসলমানদের কাফেলা লুট করতো। এখনও তাদের অধীনে যেসব মুসলিম অঞ্চল আছে সেখানে তারা নিয়মিত লুটতরাজ চালায়। তারা ধনসম্পদ, সোনাদানা আর মনিমুক্তাই শুধু লুট করে না, তোমার মত মেয়েদেরও ওরা লুট করে নিয়ে যায়। এখন আমি বুঝতে পেরেছি, কি করে তুমি এদের হাতে এসে পড়েছো।’
‘আমি যখন একা নিজেকে বুঝতে ও জানতে চেষ্টা করি তখন আমার সামনে আমার মত বহু মেয়ে শিশুকে দেখতে পাই।’ আশী বললো, ‘আমাকে খুব উন্নত খাবার ও দামী দামী পোষাক পরতে দেয়া হতো। শেতাঙ্গ পুরুষ ও নারীরা আমাদেরকে খুব আদর ও যত্ন করতো। তার আমার মন থেকে অতীতের স্মৃতি মুছে ফেলেছে। আমি তাদের সংস্পর্শেই বড় হয়েছি। স্থানটি ছিল জেরুজালেম শহর। শিশুকাল সেখানেই কেটেছে আমার। বেহায়াপনা ও নির্লজ্জের যাবতীয় শিক্ষা সেখানেই আমি পেয়েছি। ওরাই আমাকে শিখিয়েছে মদ পান করতে, শিখিয়েছে আরবী ও সুদানী ভাষা।
আমি যখন যুবতী হলাম, আমাকে সেই কাজে নিয়োগ করা হলো, যে কাজে তুমি আমাকে দেখতে পেয়েছো। বিপদ থেকে বাঁচার জন্য আমাদেরকে দেয়া হয়েছে তলোয়ার ও তীরন্দাজীর ট্রেনিং। আজ হঠাৎ ভীত ও আতংকিত অবস্থায় তোমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তেই মনে পড়ে গেল বাবার কথা। আমাকে নিয়ে বাবার আবেগ যেমন পবিত্র, তেমনি তোমার আবেগও পবিত্র। এ জন্যই আমি বলেছিলাম, আমাকে তোমার কোলে আরও কিছুক্ষন থাকতে দাও। বাবার কোলের আদর ও স্নেহের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল আমার। আমি আবার সে আদরের জন্য কাঙাল হয়ে গেলাম। আমি যতদিন বেঁচে থাকবো তোমার কন্যা হয়ে থাকবো। এখন আমি খৃস্টান ও সুদানীর কবল থেকে মুক্ত। এখন আমি আর কারো নিয়োগ করা গোয়েন্দা নই, আমি শুধু তোমার হারিয়ে যাওয়া কন্যা। তোমার খেদমতে আমি কাটিয়ে দেবো সারাটা জীবন। যে মেয়ে এতদিন পাপের পঙ্কে নিমজ্জিত ছিল তার জীবন হয়ে উঠবে পবিত্র ও সৎ। যেমন জীবন হয় এক সাচ্চা মুসলমানের। কারণ আমি তো মুসলমানেরই কন্যা। তুমিই আমাকে চিনিয়ে দিয়েছো আমি কে? ছি! ছি! মুসলমান পিতার কন্যা হয়ে এতদিন আমি মুসলমানের বিরুদ্ধেই কাজ করেছি! শোন, আজ থেকে আমার নবজন্ম হলো। এখন আর আমাকে সে কাজ করতে দেবো না, যে কাজে তুমি বের হয়েছো। আমার হৃদয়ে ঈমানের যে এলো তুমি জ্বালিয়ে দিয়েছো সে আলোর কসম, তোমাকে আমি কিছুতেই সুদানী বা খৃস্টানদের পক্ষে কাজ করতে দেবো না।’ আশীর চেহারায়, চোখে-মুখে এবং প্রতিটি উচ্চারণে নতুন আলোর আবেগ টলমল করছিল।
‘কিন্তু কিছুদিন আমাকে এ কাজ করতেই হবে।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘তবে যখন সময় আসবে তখন তুমি আমাকে সেই কাজে দেখতে পাবে, যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমি বন্দীশালা থেকে বের হয়ে এসেছি। সে উদ্দেশ্যেই এগিয়ে যাচ্ছি আমি।’
‘কি সেই উদ্দেশ্য?’
‘সময় হোক, সবই জানতে পারবে।’
‘ঠিক আছে, আমিও কথা দিচ্ছি, সর্বাবস্থায় আমি তোমাকে সাহায্য করে যাবো।’ পাশাপাশি আবার দুই আলাদা বিছানায় শুয়ে পড়লো দু’জন। দু’জনই চুপচাপ, কিন্তু কারো চোখেই ঘুমের কোন চিহ্নও নেই। এক বিদঘুটে চিন্তা এসে পাকড়াও করলো উমরু দরবেশকে। তিনি ভাবতে লাগলেন, এ অপূর্ব সুন্দরী মেয়েকে পাহাড়ী অঞ্চলে নিয়ে যাওয়ার পর আমি তার কি পরিচয় দেবো? কি করবো তাকে নিয়ে? মেয়েটি এক অনাথ ও এতীম মুসলমান। এ অবস্থায় তাকে খৃস্টান বা সুদানীদের হাতে আর তুলে দেয়া যায় না। তাদের হাতিয়ার বানানোর কবল থেকে মুক্ত করতে হবে আশীকে। শুয়ে শুয়ে উমরু দরবেশ আশীকে মুক্ত করার নানা রকম পরিকল্পনা আঁটতে লাগলেন। আশীর চিন্তা তার সমগ্র সত্ত্বাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। তার মনে পড়ে গেলো, এ মেয়ে শৈশব থেকে বড় হয়েছে খৃস্টানদের কাছে। তারা তাকে যেভাবে গড়ে তুলেছে সে শিক্ষা ও সংস্কার সহজে পরিবর্তন সম্ভব নয়। পরক্ষণেই তার মনে পড়ে গেল মেয়েটির আবেগদীপ্ত কথা। তিনি ভেবে দেখলেন, মেয়েটির অন্তরে সত্যের যে উপলব্ধি এসেছে তাতে আশা করা যায়, সে খুব দ্রুত নতুন সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারেবে। কারণ সে বুঝতে পেরেছে তার পরিচয়। মুসলমান হিসাবে নতুন আবেগ ও উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করবে সে। তার মনে এরই মধ্যে খৃস্টানদের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা সৃষ্টি হয়েছে তার কথা থেকেই তা বুঝা যায়। আবার অন্য চিন্তা এসে ভর করলো উমরু দরবেশের মনে। তার মনে হলো, এটা তো মেয়েটির ছলনা নয়! এ মেয়েকে কতটুকু বিশ্বাস করা যায়! আশীকে নিয়ে এমনি সব গভীর ভাবনায় ডুবে গেলেন উমরু দরবেশ।
রাত ভোর হলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে উমরু দরবেশ গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন মেয়েটির দিকে। আশী বললো, ‘কি দেখছেন অমন করে?’
‘ভাবছি তোমাকে কতটুকু বিশ্বাস করা যায়। গোয়েন্দা মেয়েদের ছলনার তো অভাব নেই। এখনো তুমি আমাকে শত্রু মনে করছো না, তার নিশ্চয়তা কি?’
আশীর চোখ ছলছল করে উঠলো। কিভাবে সে বিশ্বাস করাবে, সে যা বলেছে তাই তার মনের কথা? এর মধ্যে কোন চাতুর্য বা ছলনার চিহ্নও নেই? সে উমরু দরবেশের প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করলো। তার চেহারায় বেদনার ছায়া। উমরু দরবেশই আবার মুখ খোললেন। বললেন, ‘বুঝতে পেরেছি, আমার কথায় তুমি কষ্ট পেয়েছো। কিন্তু তুমি জানো না আশী, তোমাদের মত মেয়েদের ছলনার জালে আটকা পড়ে কত মুসলমান ধ্বংস হয়েছে। মুসলিম জাতির অধঃপতন ও ধ্বংসের পিছনে তোমাদের মত মেয়েদের কী ভয়ংকর ভূমিকা তা জানি বলেই ওকথা আমি বলেছি।’ উমরু দরবেশ কিছুক্ষণ চুপ করে আবার বললেন, ‘তুমি কেবল যুবতীই নও, অসম্ভব সুন্দরী এবং রূপসীও! তোমার একটু হাসি, একটু চাহনী, মুখের একটু মিষ্টি কথাই একজন পুরুষ মানুষকে ঘায়েল করার জন্য যথেষ্ট। তার ওপর মানুষকে আকর্ষণ করার জন্য তোমাদের দেয়া হয়েছে বিস্তর প্রশিক্ষণ। যে কোন মানুষকে প্রলুব্ধ করে তার মনে পশুপ্রবৃত্তি জাগিয়ে তোলার ক্ষমতা তোমার আছে। আমি কোন অক্ষম পুরুষ নই! কয়েক বছর যুদ্ধের ময়দানে এবং তারপর সুদানের কারাগারে বন্দী থাকার ফলে সুদীর্ঘ সময় বাড়ীর স্নেহ-ভালবাসার পরিবেশ থেকে আমি বঞ্চিত। একই তাঁবুর মধ্যে পাশাপাশি শুয়ে রাত কাটিয়েছি আমরা। তুমি আমার এত কাছে ছিলে, হাত বাড়ালেই তোমার নাগাল পেতাম। কিন্তু আল্লাহর শোকর, তিনি আমাকে রক্ষা করেছেন। আমি সারা রাত আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের কাছে দোয়া করেছি, আল্লাহ্ যেন আমাকে হেফাজত করার ক্ষমতা দেন। আল্লাহর অসীম দয়া, তিনি এ বান্দার দোয়া কবুল করেছেন এবং আমাকে পবিত্র থাকতে সাহায্য করেছেন। রাতে তোমার কথা শোনার পর থেকে আমি সীমাহীন পেরেশানী ও দুশ্চিন্তায় আছি। আমি ভেবে পাচ্ছি না, আমি তোমাকে শত্রু ভাববো, না আপনজন মনে করবো। এখনও আমি সে কথাই চিন্তা করছি। আমি কিছুতেই এ দুশ্চিন্তার সমাধান করতে পারছি না। এ অবস্থায় তোমাকে শত্রু মনে করাই ভাল। তাতে তুমি শত্রু হলে আমার আফসোস থাকবে না। আর যদি তুমি বন্ধু হও তবে তা তোমাকেই প্রমাণ করতে হবে। তুমি কি প্রমাণ করতে পারবে, তুমি সম্পূর্ণ বিশ্বাসী ও বন্ধু!’
‘আমি তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আমার মনে তুমিই বিশ্বাস ও ঈমানের আলো জ্বালিয়েছো।’ আশী বললো, ‘সেই আলোর কসম ছাড়া আর কোন প্রমাণ পেশ করার ক্ষমতা এ মুহূর্তে আমার নেই। তবে তোমাকে এটুকু কথা দিতে পারি, তুমি যদি সুদানীদের সঙ্গ ত্যাগ করতে চাও, তবে আমাকে তোমার বিশ্বস্ত সহযোগী হিসাবে পাবে। নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত যদি তাদের ধোঁকা দিতে চাও, আমার পূর্ণ সহযোগিতা থাকবে তোমার সঙ্গে। এতে আমার জীবন চলে গেলেও আমি পিছু হটবো না। কাল যে দুই মুসাফির তোমার কাছে এসেছিল, তারা যে সুদানীদের গোয়েন্দা আমিই তো তা তোমাকে বলেছিলাম।’
‘আমাকে একটু চিন্তা করতে দাও আশী!’ উমরু দরবেশ বললেন ‘তোমার এ সাবধান বাণী থেকে আমি জানতে পারলাম, সুদানীরা আমার চারপাশে গোয়েন্দার বহর লাগিয়ে রেখেছে। তোমাকে তো ওরা এ জন্যই আমার সাথে পাঠিয়েছে, যাতে আমার প্রতিটি তৎপরতা তুমি কাছ থেকে দেখতে পারো। ফলে আমি তোমাকেও তাদেরই একজন মনে করছি। যদি আমার কথা ও আচরণে তোমার মানসিক পরিবর্তন ঘটেই থাকে, আপাতত তা ভুলে যাও। তুমি বরং সে কাজই করো যেমনটি তোমাকে বলা হয়েছে। আমিও ঠিক সে মতই কাজই করতে থাকবো, যেমন আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমি তো তোমাকে বলেছি, আমি বিশেষ উদ্দেশ্য লাভের আশায় বের হয়েছি, কিন্তু আমি তাদের মিশনকেও ত্যাগ করতে পারছি না। আমি জানি তাদের মিশন ত্যাগ করলে আমার কি ভয়ংকর পরিণাম হবে। একাধিক তীরের নিশানা আমার দিকে তাক করা আছে, কিন্তু আমি তা দেখতে পাচ্ছি না। যখন তীর আমার বুকে এসে বিঁধবে তখন আমি দেখতে পাবো।’
‘আমি সর্বাবস্থায় তোমার সঙ্গে থাকবো।’ আশী বললো, ‘সময় এলে আমি প্রমাণ করে দেখাবো, আমার ঈমান খাঁটি, আমিও এক সাচ্চা মুসলমান। আগে না জানলেও এখন আমি জানি, আমার শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে মুসলিম পিতার রক্ত।’
উমরু দরবেশ তাঁবু গুটিয়ে সুদানের মুসলিম পাহাড়ী এলাকায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। প্রস্তুতি শেষ হলে আশী এবং উমরু দরবেশ দু’জনেই উটের পিঠে চড়ে বসলেন।
এগিয়ে চললো তিনটি উটের ক্ষুদ্র কাফেলা। উটের ওপর আরোহণ করে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। চারদিকে অথৈ বালির সমুদ্র। সামনে বালি, পেছনে বালি। দু’পাশে বালির ছোট ছোট ঢেউ।
সুদানের মুসলিম এলাকা এখনো অনেক দূরে। দুই উটে ওরা দু’জন, তৃতীয় উটের উপর তাদের মালামাল ও তাঁবু। আশীর অর্ধ উলঙ্গ দেহ এখন কালো কাপড়ে ঢাকা। তাকে দেখে কেউ বলতে পারবে না, এ মেয়ে বারবণিতা, যাকে খৃস্টানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য দীর্ঘ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরি করেছে।
ওদের সাথে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে দূর দিয়ে সমান্তরাল গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে এক ঘোর সওয়ার। বার বার ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে ওদের গমন পথের দিকে। উমরু দরবেশ কয়েকবারই সে অশ্বারোহীকে দেখলেন। ভাবলেন, সুদানীদের কোন চর হবে এ আরোহী। সুদানীরা যে তার পিছনে ছায়ার মত লেগে আছে, সে তো তার জানাই আছে। কিন্তু তার মনে হঠাৎ অন্য খেয়াল জাগতেই ভয় ও আতঙ্কে তার বুক শুকিয়ে গেল। গোয়েন্দারা হলে তার তো একা থাকার কথা নয়! অন্তত তার একজন সঙ্গী তো থাকতোই! তাহলে কি এ লোক কোন মরু ডাকাত? মরু ডাকাতরা কি পরিমান ভয়ংকর হয় তা তো আর অজানা নেই উমরু দরবেশের। পলকে তিনি পেরেশান হয়ে আবারও তাকালেন সে আরোহীর দিকে। নির্বিকার ভঙ্গিতে এগিয়ে যাচ্ছে সে আরোহী। সে সে ওদের অনুসরণ করছে তা তার চলার ভঙ্গিতে এখন স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।
‘আশী!’ তিনি আশীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, ‘তুমি কি ওই অশ্বারোহীকে লক্ষ্য করেছো? অনেকক্ষণ ধরে এ আরোহী আমাদের অনুসরণ করে চলেছে।’
‘হ্যাঁ, আমিও অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ্য করছি।’
‘এ লোক কি সুদানের গোয়েন্দা? নাকি কোন মরু ডাকাত?’
‘কি জানি! গোয়েন্দা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। ওরা সাধারণত এভাবে একাকী পথ চলে না।’
‘আশী! মরু ডাকাত হলে তো খুব ভয়ের কথা! আমরা মাত্র দু’জন। মরুভূমির দুর্ধর্ষ ও সুসংগঠিত ডাকাত দলের বিরুদ্ধে আমরা দু’জন কি মোকাবেলা করতে পারবো!’ উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা তার কন্ঠে।
‘এত ঘাবড়াচ্ছ কেন? তুমি সৈনিক, আমিও অস্ত্র চালাতে জানি। আমরা নিরস্ত্রও নই।’ আশীর সাহসী কণ্ঠ, ‘রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় আক্রান্ত হলে হয়তো সাবধান হওয়ার সুযোগ থাকতো না। কিন্তু এখন দিন। আমরা সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করে যেতে পারবো। আমাকে নিয়েই যদি তোমার ভয়, তাহলে শুনে রাখো, তোমার পাশে থেকে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমি লড়ে যেতে পারবো। আমাকে জীবিত ধরে নিয়ে যাওয়ার সাধ্য কারো হবে না।’
ভয় এবং আশঙ্কা নিয়েই তারা মরুভূমির সে ভয়ংকর পথ অতিক্রম করে চলতে লাগলো। মাথার ওপর কড়া রোদ। এক সময় সূর্য মাথার ওপর থেকে পশ্চিম দিকে হেলে পড়লো। এগিয়েই চললো ওরা। তাদের অনুসরণ করে তখনো সে আরোহী সেভাবেই পথ চলছে। দূরে আবছা করে ভেসে উঠল কাঙ্খিত পাহাড়ী এলাকা। আরেকটু এগুতেই আস্তে আস্তে স্পষ্ট হতে লাগলো পাহাড়ের চূড়া।
সুউচ্চ পাহাড় চূড়া তখনও বহু দূরে। কিন্তু মুসলিম অধ্যুষিত পাহাড় চূড়া চোখে পড়তেই উমরু দরবেশের মনোবল ও শক্তি বেড়ে গেল। তার মনে হলো, গন্তব্য আর বেশী দূরে নয়। আশীকে বললো, ‘আমরা এসে পড়েছি আশী! ওই পাহাড় চূড়াই আমাদের গন্তব্যস্থল।’
উট চলতে লাগলো, তারা গন্তব্য স্থানের কাছাকাছি চলে এলো। এখানেই সুদানীদের নির্দেশ মোতাবেক মিশনের কাজ শুরু করতে হবে তাদের। উমরু দরবেশ এ এলাকারই বাসিন্দা। উটের ওপর বসে থেকেই তিনি যেন জন্মভূমির মাটির ঘ্রাণ পাচ্ছেন। পুলকিত উমরু দরবেশের চেতনা যখন জন্মভূমির মাটির স্পর্শ পাবার জন্য লালায়িত তখনই তিনি লক্ষ্য করলেন, সে অশ্বারোহী দূরত্ব কমিয়ে সোজা ছুটে আসছে তাদের দিকে। উমরু দরবেশের উৎফুল্ল চেহারায় চিন্তার ভাঁজ পড়লো। তিনি চলার গতি কমিয়ে দিয়ে গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলেন অশ্বারোহীর দিকে। একটু পরই তাদের কাছে এসে পৌছুলো অশ্বারোহী।
‘তোমাদের ক্যাম্প ও অবস্থান হবে সামনের ওই পাহাড়ী অঞ্চলে।’ অশ্বারোহী উমরু দরবেশের কাছে এসে বলল, ‘তুমি আমাকে চেন না, কিন্তু আমি তোমাকে চিনি। তুমি যাতে নির্বিঘ্নে তোমার মিশনের কাজ চালিয়ে যেতে পারো সে জন্য আমরা আশেপাশেই থাকবো। তুমি এখানে একা ও নিঃসঙ্গ নও। তোমার যে কোন বিপদে সাহায্য করার মত লোক সব সময়ই তোমার কাছাকাছি থাকবে। আশা করি তুমি তোমার মিশনের গুরুত্ব ও কথা ভুলে যাওনি!’
তাকে দেখে আশী তার মুখের আবরণ মুক্ত করলো এবং হাসতে হাসতে বললো, ‘যাক, এতক্ষণে নিশ্চিত হওয়া গেল। যেভাবে তুমি আমাদের অনুসরণ করছিলে, আমরা তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম, মরু ডাকাতের পাল্লায় পড়ে গেলাম না তো?’
আরোহীও হাসতে হাসতে বললো, ‘কিন্তু যাই বলো আশী, আমার তো মনে হয় সফরটা বেশ ভালই হয়েছে। কি বলো?’
‘হ্যাঁ! তা ভালই হয়েছে বৈকি! তবে তুমি পাহারা দিয়ে নিয়ে আসছো জানলে আরো স্বস্তি পেতাম।’ মুখের হাসি অক্ষুন্ন রেখেই উত্তর দিল আশী।
আরোহীও হাসতে হাসতেই বললো, ‘তোমরা যে এত ভীতু তা তো জানতাম না! যাক, এখন আর ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই, বুঝলে তো!’ আরোহী ওদের সান্ত্বনা দেয়ার জন্য উমরু দরবেশের দিকে ফিরে বললো, ‘সফরের সময় পুরো পথেই তোমাদের হেফাজতের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। তোমাদের ভয়ের কোন কারণ আগেও ছিল না, এখনও নেই। আমরা ছায়ার মত তোমাদের কাছাকাছি ছিলাম এবং আছি। তোমরা হয়তো সব সময় আমাদের দেখতে পাওনি, কিন্তু আমাদের নজর সব সময়ই তোমাদের ওপর আটকে ছিল। নইলে এমন সুন্দরী মেয়ে নিয়ে এত দূর রাস্তা এতটা নিরাপদে পার হয়ে আসতে পারতে না।’
‘তুমি কে?’ উমরু দরবেশ জিজ্ঞেস করলেন।
‘আমি একজন সুদানী মুসলমান!’ আরোহী উত্তরে বললো, ‘তুমি কে বা আমি কে এখন আর এ ধরনের প্রশ্ন করো না। তুমিও যা আমিও তাই। আমি আর তুমি দু’জনেই এ এলাকার মুসলমান।’ আরোহী উমরু দরবেশকে সতর্ক করে দিয়ে বললো, ‘নিজের দায়িত্বের ব্যাপারে সতর্ক থেকো। তোমার তো ভাল করেই জানা আছে, আমাদের ওপর যে দায়িত্ব আছে তা পালনে সামান্য একটু ভুল হয়ে গেলে এখানকার মুসলমানরা আমাদের হাড্ডি গুঁড়ো করে দেবে।’ আরোহী তাকে আরো বললো, ‘আর এ কথাও মনে রেখো, তুমি যদি তোমার কাজে কোন রকম গাফলতি বা অবহেলা করো কিংবা কোন রকম চালাকী বা বেঈমানী করো তবে কোন রকম সতর্ক না করেই তোমাকে খুন করে ফেলা হবে। তোমাকে এখানে কি করতে হবে সব মনে আছে তো?’
উমরু দরবেশ বললেন, ‘সব মনে আছে। আর আমি আমার দায়িত্বের ব্যাপারে পূর্ণ সচেতন।’
আরোহী বললো, ‘তাহলে আজ রাতটা ওই পাহাড় চূড়ায় তাঁবু খাঁটিয়ে বিশ্রাম নাও। কাল থেকেই তোমার কাছে এখানকার মুসলমানরা আসতে থাকবে।’ তারপর আশীর দিকে ফিরে বললো, ‘সব ঠিকঠাক আছে তো? তুমিও সতর্ক থেকো। এ মিশনের গুরুত্বের কথা মুহূর্তের জন্যও ভুলে যেও না। চলো যাওয়া যাক।’
ওরা আবার চলতে শুরু করলো। উমরু দরবেশ চিন্তা করছিল তার দায়িত্বের কথা। এ এলাকার মুসলমানদের বিপথগামী করার ওয়াদার বিনিময়ে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর ওয়াদা করে রক্ষা পেয়েছেন দুঃসহ নির্যাতনের হাত থেকে। এ অঞ্চলের জনগণের আনুগত্য সুদানের পক্ষে নেয়া এবং এখানকার মুসলমানদেরকে সুদানী সেনাবাহিনীতে ভর্তি করার জন্য উদ্বুদ্ধ কড়া এ মিশনের অন্যতম গুরু দায়িত্ব।
সুদানীরা মিশরের ওপর আক্রমণ করার পায়তারা কষছে। তাদের ভরসা, সুলতান আইয়ুবী এখন মিশর থেকে দূরে অবস্থান করছেন। সিরিয়ার সীমান্ত এলাকা থেকে দূরে ক্ষমতাচ্যুত আল মালেকুস সালেহ ও তার সহযোগীদের সাথে এক কঠিন সমরে জড়িয়ে আছেন তিনি। এ সুযোগে মিশর আক্রমণ করলে সহজেই তা অধিকার করা যাবে বলে সুদানীদের বিশ্বাস। এ নিয়ে খৃস্টানদের সাথেও সুদানীদের ব্যাপক আলাপ আলোচনা হয়েছে। খৃস্টানরা তাদের উৎসাহিত করে বলেছে, ‘শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে মিশর আক্রমণ করার এটাই উপযুক্ত সময়।’ কিন্তু একটি কারণে সুদানীরা এ আক্রমণ করার ব্যাপারে গড়িমসি করছে। তাদের প্রধান সমস্যা, সুদানী মুসলমানরা সুদানের বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও সুলতান আইয়ুবীর সমর্থক। মিশরের সাথে সংঘর্ষ শুরু হলে তাদের পক্ষ থেকে খোদ সুদানেই সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হওয়ার আশংকা আছে। উমরু দরবেশ এসেছেন মুসলমানদের এ বিশ্বাসের মূলে আঘাত করার জন্য। সেনাবাহিনী দিয়ে যা সম্ভব হয়নি সে অসাধ্য সাধনের দায়িত্ব এখন তার কাঁধে।
সূর্য ডুবে গেছে। উমরু দরবেশ অশ্বারোহীর সহযোগিতায় পাহাড়ের চূড়ায় এক স্থানে তাঁবু টানিয়ে নিলেন। অশ্বারোহী বিদায়ের আগে বললো, ‘আগামীকাল তোমার সাথে আর আলাদাভাবে কোন কথা বলার সুযোগ হবে না। লোকেরা ভোর থেকেই এখানে আসতে শুরু করবে।’ সে সামনে এক পাহাড় চূড়ার দিকে ইশারা করে বললো, ‘ওদিকে দেখো।’ উমরু দরবেশ তাকালো সেদিকে। অশ্বারোহী বললো, ‘ওখানে ছাতির মত একটি গাছ দেখতে পাচ্ছো?’ সন্ধ্যার আবছা আলোর মধ্যেও সেখানে ছাতির মত গাছটি উমরু দরবেশ ঠিকই দেখতে পেলেন। বললেন, ‘পাচ্ছি।’ অশ্বারোহী বললো, ‘ওদিকে লক্ষ্য রাখবে। আগামীকাল রাতে সেখানে আলো জ্বেলে সাহায্য করা হবে তোমাকে।’ আশীকে বললো, ‘কাল রাতে যে পোষাক তোমার পরার কথা সে কাপড় দিনের বেলাতেই প্রস্তুত করে রাখবে। আমি চললাম। এখন প্রতিটি মুহূর্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সর্বাবস্থায় সাবধান থাকবে।’
লোকটি চলে যাওয়ার আগে আশীকে ইশারায় কাছে ডাকলো। উমরু দরবেশ যেন তাদের কথা শুনতে না পায় এমন দূরত্বে গিয়ে সে আশীকে বললো, ‘মিশনের এ পর্যায়ে তোমার ভূমিকা সবচে গুরুত্বপূর্ণ। তুমি খুবই সাবধান ও সতর্ক থাকবে। এখানকার পাহাড়ী মুসলমানরা স্বভাবতই জংলী। ওদের স্বভাবের সাথে মিশে আছে বন্যতা। যদিও আমরা তোমার হেফাজতে সব সময় দৃষ্টি রাখছি তবু তোমার হেফাজত তোমাকেই করতে হবে। এ লোকটির প্রতিও সতর্ক দৃষ্টি রাখবে। ওকে তোমার বশে রাখতে চেষ্টা করবে এবং যখন যে কাজ করানো দরকার করিয়ে নেবে।’ সে আশীর কাঁধের ওপর ছড়িয়ে থাকা চুলে হাত দিয়ে একটু হেসে দুষ্টুমির ছলে বললো, এই বেনীর বাঁধনে তো তুমি সিংহ পুরুষকেও বাঁধতে পারো, এবার এ লোকটিকে বেঁধে নাও।’
‘তুমিও তো এখানকারই মুসলমান!’ আশী একটু বিদ্রূপের স্বরে বললো, ‘তুমি পশু নও?’
‘তোমাকে দেখলে কে না পশু হয়ে যায়!’ লোকটি হাসতে হাসতে ঘোড়ার পিঠে উঠে সন্ধ্যার অন্ধকারে হারিয়ে গেল। এ অশ্বারোহী সেই সব ঈমান বিক্রেতাদের একজন, যারা এরই মধ্যে সুদানীদের খপ্পরে পড়ে গেছে। লোকটি পাহাড়ী অঞ্চলে সুদানীদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল। পাহাড়ী এলাকার সহজ সরল মুসলমানদের ঈমান ক্রয়ের ব্যাপারে সে ছিল খুবই তৎপর। লোকটি এ অঞ্চলেরই বাসিন্দা। কিন্তু কেউ জানে না, তাদের ঘরের পাশেই বাস করছে এক কেউটে সাপ, জাতির চরম দুশমন ও বিশ্বাসঘাতক। এ ষড়যন্ত্রে সে শুধু একা নয়, তার গ্রুপে এখন কাজ করছে আরো আট-দশজন মুসলমান।
অশ্বপৃষ্ঠে সওয়ার হয়ে সে তার গ্রামের দিকে চলে গেল। রাস্তায় তার সাথে দেখা হলো দলের আরেক সদস্যের। সে লোক জিজ্ঞেস করলো, ‘খবর কি উস্তাদ, সব ঠিকঠাক আছে?’
‘হ্যাঁ, সবই ঠিক আছে। এদিকের অবস্থা কি বলো?’
পথিক বললো, ‘এদিকের অবস্থাও ভাল। সব ঠিকই আছে!’
অশ্বারোহী বললো, ‘কিন্তু যে কোন মুহূর্তে একটা উলট-পালট ঘটে যাওয়া বিচিত্র নয়। আমাদের খুবই হুশিয়ার থাকতে হবে। আরেকটা কথা, তুমি জানো আমি আগে থেকেই বিপদের কথা গন্ধ টের পাই। খৃস্টানরা আমাকে যে ট্রেনিং দিয়েছে তাও আমাকে সতর্ক হতে শিক্ষা দিয়েছে। আমার মন বলছে, মেয়েটার নিয়ত বদলে যেতে পারে। কারণ তাকে যখন আমি অভিযানের গুরুত্ব বুঝাচ্ছিলাম, তখন তাকে অন্যমনস্ক ও নীরব দেখাচ্ছিল।’
‘আশীকে তো খুব সতর্ক ও কর্মপটু বলেই জানতাম।’ লোকটি বললো, ‘লম্বা সফরের কারণে হয়তো ক্লান্তি ও অবসাদে ভুগছে, তাই অমন মনে হয়েছে আপনার। তাছাড়া উমরু দরবেশের মত পশুর অত্যাচারও তার ক্লান্তির কারণ হতে পারে!’
কথা বলতে বলতে ওরা গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করলো। অন্ধকার রাত। রাস্তার মোড়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দু’ব্যক্তি কথা বলছিল। আরোহী ও তার সঙ্গী তাদের পাশ কেটে যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করলো, ‘কে যায়?’
ওরা তাদের পাশে থেমে নিজেদের নাম ও গাঁয়ের নাম বললো। অন্ধকারের কারণে ওরা পরস্পরকে দেখতে পাচ্ছিল না, কিন্তু গাঁয়ের নাম শুনে ওরা চিনতে পারলো ওখান থেকে আরো দুটো গ্রাম পার হলে পড়ে সে গ্রাম পড়বে। ওরা দু’জন তাদের পরিচয় দিয়ে বললো, ‘ভাই, তোমাদের গাঁয়ে পীর সাহেব কবে এলেন?’
‘পীর!’ লোক দু’জন অবাক হয়ে বললো, ‘কিসের পীর? এখানে কোন পীর তো আসেনি!’
‘কি যে বলো! গ্রামের বাইরে ওই যে বড় পাহাড়টা আছে না, আসার পথে দেখলাম তার চূড়ায় এক পীর সাহেব বসে আছেন। আগে কোনদিন দেখিনি তো, তাই একটু কৌতূহল হলো। আমরা দু’জনই চূড়ায় পীর সাহেবকে দেখতে গেলাম। দেখি এক বুজুর্গ লোক তাঁবু টানিয়ে বসে আছেন। তিনি নাকি শুধু খোদার সাথেই কথা বলেন। দিনের বেলাতেও ডানে বামে মশাল জ্বালিয়ে রাখেন। আমি তাঁকে দেখে তার পাশে গিয়ে বসলাম, দেখলাম তিনি কোরআন পড়ছেন! তিনি কোরআন সামনে রেখেই পড়ছিলেন সে কারণে তিনি আমার দিকে তাকাতে পারেননি। আমি তাঁকে ডাকলাম, তিনি কোন কথা বললেন না। তার তাঁবুর পাশে মাটি থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছিল। এ ধোঁয়ার কুণ্ডলী উপরে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেল। সে ধোঁয়ার মধ্য থেকে একটি অপূর্ব মেয়ে বের হয়ে নেমে এলো নিচে। তার রূপের বর্ণনা দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। মনে হলো, মেয়েটি মানুষ নয়, জীন জাতির কেউ। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। মেয়েটি বুজুর্গ লোকের সামনে গিয়ে সিজদা করলো। সিজদা থেকে উঠে মুখ বুজুর্গ লোকের কানে লাগালো। বুজুর্গের ঠোঁট নড়ে উঠলো। এরপর মেয়েটি আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো।
আমি ভয় পেয়ে পালাতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু মাটি আমাকে টেনে ধরলো। মনে হলো, মেয়েটির দৃষ্টি আমাকে অবশ করে দিয়েছে। সে আমার ভীত-চকিত চেহারার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ভয় পেয়ো না, এ বুজুর্গ খোদার দূত! তোমাদের সকলের কল্যাণের জন্য খোদা একে পাঠিয়েছেন। তাঁকে তোমরা বিরক্ত করো না। তিনি এখন খোদার সাথে কথা বলছেন। তুমি বরং কালকে এসো। যদি তোমাদের ওপর তাঁর মেহেরবানী হয়, তবে তোমাদেরকে তিনি তুর পাহাড়ের জ্যোতি দেখাবেন। তাঁর ডাক পেয়ে আমি এই মাত্র তুর পাহাড় থেকে এসেছি। তিনি আমার কানে কানে বললেন, এ হতভাগাদের বলো, আমি তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করে দেবো। কিন্তু কিছু সময় তাদের ধৈর্য ধরতে হবে। যদি তারা অধৈর্য হয়ে যায় তবে আমি অন্যত্র চলে যাবো। তখন তাদের ভাগ্যে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু থাকবে না।’
আমরা মেয়েটির সঙ্গে কোন কথা বলেতে পারলাম না। মোহগ্রস্তের মত আমরা তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। শেষে মেয়েটি বললো, ‘আমার দিকে নয়, হুজুরের দিকে তাকাও।’
আমরা বুজুর্গ লোকের দিকে তাকালাম, দেখলাম তাঁর মাথার উপর জ্যোতির কিরণ। মেয়েটি বললো, ‘যাও! যাও! জলদি চলে যাও! মনের কোন আশা পূরণ করতে চাইলে কাল সকালে এসো।’ আমরা আর দেরী না করে সেখান থেকে চলে এলাম।’
লোকটি কথা বলছিল কাঁপা কাঁপা স্বরে। সে স্বরে ভয় ও বিস্ময়ের এমন ঘোর লেগে ছিল, যেন তার সামনে এখনো সেই জীনকন্যা দাঁড়িয়ে আছে।
মানুষের এই এক দুর্বলতা, বিস্ময়ের কোন কিছু শুনলে তা স্বচক্ষে দেখার আগ্রহ বোধ করে প্রতিটি মানুষ। কৌতূহল এমন এক অদম্য শক্তি, যা না মেটা পর্যন্ত তাকে থামানো যায় না। কৌতূহল তার আবেগকে নাড়া দেয়, মনে আনে শিহরন ও আনন্দের এক অপার্থিব উচ্ছ্বাস। এ উচ্ছাসেরই শিকার হলো ওই দুই শ্রোতা।
আগন্তুকরা চলে গেল। লোক দু’জন কতক্ষণে এ কথা অন্যদের বলবে এ নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। তারা কথা থামিয়ে পাশের বাড়ীর দরজায় টোকা দিল। দরজা খুলে দিল বাড়ীর লোকজন। ওরা তাদের শোনালো সেই জ্বীন-বশ করা পীরের কথা। তারা অশ্বারোহী ও তার সাথীর কাছ থেকে শোনা কাহিনী আরও রং চং মিশিয়ে বললো ওদের। মেয়েটার রূপের এমন রসালো বর্ণনা দিল, শ্রোতারা আল্লাহ্, কোরআন আর ওই বুজুর্গের কথা ভুলে মেয়েটার ধ্যানেই মগ্ন হয়ে পড়ল। বাড়ীর মেয়েরাও শুনল এ গল্প। তারা এ খবর পৌঁছে দিল পাশের ঘরে। এশার নামাজের সময় মসজিদের মুসল্লীদের কানে তুলে দেয়া হলো বুজুর্গের কাহিনী। এভাবেই রাতের মধ্যেই গ্রামের অন্যান্য বাড়ীতেও পৌঁছে গেল এ চাঞ্চল্যকর খবর।
ভোর হল। পূর্বাকাশ রাঙিয়ে গোল সূর্য উঁকি দিল আকাশে। ফজরের নামাজের পর মুসল্লীরা মসজিদ থেকেই রওনা দিল সেই পাহাড়ের দিকে। ছেলে-ছোকরার দলও সঙ্গী হলো তাদের। গ্রামের বিভিন্ন রাস্তায় তখন মানুষের স্রোত। সবারই গতি একদিকে। সবাই এগিয়ে যাচ্ছে যেখানে উমরু দরবেশ ও আশী ক্যাম্প করে আছে।
তাঁবুর সামনে ছোট একটি কার্পেট বিছানো। তার উপর বসে আছেন উমরু দরবেশ। সংসার বিবাগী ফকিরের মত নির্লিপ্ত চেহারা। দুই চোখ বন্ধ করে ঠোঁট নেড়ে বিড় বিড় করে কিছু পাঠ করছেন। তার ডান ও বাম পাশে একটি করে দু’টি লাঠি মাটিতে পোতা। লাঠির মাথায় তেলে ভেজা কাপড় জড়ানো মশাল জ্বলছে।
গ্রামের লোকেরা সেখানে পৌঁছে উমরু দরবেশের কাছ থেকে আট দশ হাত দূরে তিনজন লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। গ্রামের লোকেরাও ওদের কাছে এসে থেমে গেল। দাঁড়িয়ে থাকা লোক তিনজনের একজন বললো, ‘আমি সামনে যাচ্ছি, হুজুরের সাথে কথা বলবো।’ সে তিন চার হাত অগ্রসর হতেই পিছনের দিকে ছিটকে পড়ে গেল। এমনভাবে ছিটকে পড়লো, মনে হলো সামনে থেকে কেউ ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে ওকে। সে তাড়াহুড়া করে উঠে বসলো এবং পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের সাথে মিশলো। ভয়ে তখনো কাঁপছে লোকটি। চোখে মুখে আতঙ্কের স্পষ্ট ছাপ। সে ভীত কণ্ঠে বললো, ‘সাবধান, কেউ সামনে যাবেন না। আমাকে কে যেন সামনে ধাক্কা দিয়েছে। নিশ্চয়ই কোন জীন হবে, যাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি না।’
অন্য দু’জন বললো, ‘রাখো তোমার জীন! তুমি একটা ভীতুর ডিম। তুমি ভয়ে পেয়ে পড়ে গিয়ে পিছনে চলে এসেছো। তুমি থাকো, আমরা সামনে যাচ্ছি।’
দু’জন এক সাথে হাত তিনেক অগ্রসর হয়েছে, অমনি আগের লোকটির মতই পিছন দিকে চিৎ হয়ে পড়ে গেল। এ অভাবিত ঘটনায় উপস্থিত সব লোকের মধ্যেই আতঙ্ক ও ভয় ছড়িয়ে পড়ল। সবার মধ্যে এ ধারনা ও বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে গেলো, হুজুরকে জ্বীনরা পাহারা দিচ্ছে। হুজুরের অনুমতি ছাড়া তারা কাউকে হুজুরের কাছে যেতে দিচ্ছে না।
তাঁবুর মধ্য থেকে বেরিয়ে এলো আশী। উপস্থিত লোকদের মনে হলো তারা বেহেশতের হুরপরী দেখছে। পরণে তার কালো রেশমী পোষাক। ফিনফিনে পাতলা ওড়না মুখের ওপর। চোখ খোলা। মাথার চুল পেছন থেকে কাঁধের ওপর দিয়ে এনে সামনে বুকের ওপর ছড়িয়ে দিয়েছে। কাপড় পড়েছে সে পর্দানসীন মেয়েদের মতই। কিন্তু সে কাপড় এতই হালকা যে, তাকে প্রায় অর্ধ উলঙ্গ বলতে হয়। এ পার্বত্য এলাকার গ্রাম্য লোকেরা এমন রূপসী মেয়ে জীবনেও দেখেনি। তারা তাকে মনে করলো জ্বীনদের মেয়ে। লোকগুলো তার আকর্ষণীয় দেহবল্লরীর দিকে বিমুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো।
মেয়েটি এগিয়ে হুজুরের সামনে গিয়ে সিজদায় পড়ে গেল। সিজদা থেকে উঠে হুজুরের মুখের কাছে নিয়ে গেল নিজের কান। হুজুরের ঠোঁট নড়ে উঠলো। ঠোঁট নড়া বন্ধ হতেই মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো।
‘তোমরা সবাই ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকো!’ আশী লোকদের বললো, ‘কেউ এক কদমও সামনে আসতে চেষ্টা করো না। খোদার দূত জিজ্ঞেস করেছেন, তোমরা এখানে কেন এসেছো? তোমরা নিজেদের জায়গায় দাঁড়িয়েই প্রশ্ন করতে পারো, কথা বলতে পারো।’
যে লোকটি হুজুরের কাছে আসতে গিয়ে প্রথম ধাক্কা খেয়েছিল, সে গলা উঁচু করে বললো, ‘হে খোদার দূত! আপনি কি ভবিষ্যতের সংবাদ বলে দিতে পারেন?
‘কি জিজ্ঞেস করবি, তাই জিজ্ঞেস কর?’ উমরু দরবেশ চোখ বন্ধ রেখেই গুরুগম্ভীর স্বরে বললেন।
‘আমরা কি এ অঞ্চলে ইসলামী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবো, যে রাজ্য সুদানী শাসন মুক্ত হবে?’ লোকটি জিজ্ঞেস করলো।
উমরু দরবেশ রাগে প্রচণ্ড জোরে মাটিতে থাপ্পড় মারলেন। আশী দৌড়ে হুজুরের কাছে গিয়ে বসলো। তারপর নিজের কান তাঁর মুখের কাছে লাগিয়ে রাখলো। উমরু দরবেশের ঠোঁট নড়ে উঠলো। আশী উঠে লোকদের বলতে লাগলো, ‘খোদার দূত বলছেন, যদি কখনো পানিতে আগুন জ্বলতে দেখো, তখন তোমরা চেষ্টা করলে এ অঞ্চলকে ইসলামী রাজ্যে পরিণত করতে পারবে, তবে সেখানে সুদানীদেরই নিয়ন্ত্রন থাকবে।’ আশী বললো, ‘কারো কাছে পানি থাকলে সে পানি এই কাপড়ের উপর ঢেলে দাও। তারপর লক্ষ্য করে দেখো সে ভেজা কাপড়ে আগুন জ্বলে কি না।’
উমরু দরবেশের সামনে ফাঁকা জায়গায় এক টুকরো কাপড় পড়েছিল। যে লোকটি একটু আগে প্রশ্ন করেছিল, তাঁর হাতে চামড়ার মশক ছিল। সে সবাইকে শুনিয়ে বললো, ‘আমার কাছে পানি আছে।’ সে সামনে এগিয়ে মশকের মুখ খুললো এবং কাপড়ের ওপর পানি ঢেলে দিল।
আশী উমরু দরবেশের ডান পাশের মশালটি মাটি থেকে উঠিয়ে তাঁর হাতে দিল। উমরু দরবেশ আকাশের দিকে মুখ করে ঠোঁট নাড়লো। তারপর ফিসফিস করে কি যেন বললো, শেষে মশালটি কাপড়ের ওপর চেপে ধরলো। দপ করে জ্বলে উঠলো কাপড় এবং সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত কাপড়ই আগুনের শিখায় রুপান্তরিত হয়ে গেলো। কেউ আশা করেনি, ভেজা কাপড় এভাবে জ্বলে উঠবে। কিন্তু তারা স্বচক্ষেই দেখলো, তাদের সামনে ভেজা কাপড় দাউ দাউ করে জ্বলছে। উপস্থিত লোকেরা বিস্মিত হয়ে ফিসফিস করে বলাবলি করতে লাগলো, ‘হায় আল্লাহ্! কি তাজ্জব ব্যাপার! আমাদের চোখের সামনেই পানিতে আগুন ধরে গেল?’
‘খোদার ইশারা এখন তোমরা বুঝে নাও।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘আর আমার পরিচয় জেনে যাও। আমি তোমাদেরই একজন! এখান থেকে মাইল পাঁচেক দূরে যে জেনান পর্বত তার পাদদেশের বস্তিতে আমার বাড়ী। আমি হাশেম দরবেশের ছেলে, আমি নবী নই, পয়গম্বরও নই। খোদার শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। আমি তোমাদের মতই তাঁর একজন নগণ্য উম্মত এবং আল্লাহর শেষ নবীর এক সাধারণ প্রেমিক। আল্লাহর ধ্যানে থাকতে থাকতে একদিন আমি তার জ্যোতির দেখা পেলাম। গায়েবী হুকুম পেলাম, ‘হে উমরু! উঠো যে জ্যোতি তোমাকে দেখালাম সে আলো তাদের দেখাও, যারা এখনও অন্ধকারে ডুবে আছে।’
তিনি এমন ভাবে কথা বলছিলেন, যেন, তাকে দিয়ে কেউ এসব কথা বলাচ্ছে। তিনি বললেন, ‘তোমরা আমার গ্রামে গিয়ে জিজ্ঞেস করো, আমি সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সেনা অফিসার ছিলাম। আমি সেই বাহিনীতে ছিলাম, যে বাহিনী সুদানের ওপর আক্রমণ করেছিল। মরুভূমির মধ্যে পানির অভাবে পড়ে আমাদের বাহিনী যখন মৃত্যুমুখী সে সময় সুদানী বাহিনী আমাদের পরাজিত করে। এ ব্যর্থতায় আমরা সব মুসলমানই দুঃখ পেয়ছিলাম। তোমরাও হয়তো আমাদের পরাজয়ের খবর শুনে ব্যথিত হয়েছিলে। কিন্তু আল্লাহ্ জাল্লে শানুহু মিশরের সৈন্যদের লাশের মধ্য থেকে আমাকে উঠালেন এবং আমাকে ইঙ্গিতে জানালেন, সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সৈন্যদের কেন পরাজয় হলো। আমার দুঃখ আনন্দে রুপান্তরিত হলো। আমি একটি গাছের শাখে খোদার নূর দেখতে পেলাম। এ জ্যোতি ছিল এক উজ্জ্বল তারকার। আকাশ থেকে ছিটকে এসে তা গাছে আটকে ছিল। সেই তারকা থেকে শব্দ এলো, ‘সামনে দ্যাখ! পিছনে দ্যাখ! ডাইনে দ্যাখ বামে দ্যাখ!
আমি সব দিকেই দেখলাম। আবার আওয়াজ এলো, ‘কোন লোক কি জীবিত দেখতে পাচ্ছো?’ আমার সব দিকেই শুধু লাশ আর লাশ দেখতে পেলাম। এরা সবাই আমারই সেনা দলের লশকর ছিল। এদের মধ্যে কয়জন আহত ও জীবিত আমার জানা ছিল না। কারণ সবাই মরার মত পড়েছিল। একটু আগেও কাউকে কাউকে পিপাসায় ছটফট করতে দেখেছি। এরা সবাই ছিল দুঃসাহসী যোদ্ধা। প্রাণপণ লড়াই করেছে সবাই, মৃত্যু কবুল করেছে, কিন্তু পরাজয় স্বীকার করেনি। তারকার আলো থেকে আবার আওয়াজ এলো, ‘তুমি কি দেখোনি তোমার তোমার তলোয়ার ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল? তুমি কি দেখোনি তোমাদের তীরের কোন গতি ছিল না? তুমি কি দেখোনি তোমাদের ঘোড়ার পা মাটিতে ভেঙ্গে পড়েছিল?’
তখন আমার মনে হলো- হ্যাঁ, সবই দেখেছি। তারকার জ্যোতি যা বলছে সবই সত্য! যুদ্ধ করতে করতে শেষের দিকে আমার তলোয়ারে আর তেমন ধার ছিল না। আমি আমার তীর দেখেছিলাম, তার গতি বাতাসের বেগে বাঁধা পেয়েছিল, যেন খরকূটো উড়ে যাচ্ছে। আমাদের ঘোড়াও পিপাসায় দুর্বল হয়ে চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। বালির প্রান্তর সূর্যের সমস্ত তাপ গ্রহণ করে আমাকে ও আমার সাথীদেরকে পুড়িয়ে ভস্ম করে দিচ্ছিল। আমিও জ্বলন্ত লাশ হয়ে পড়েছিলাম। সেই তারকার জ্যোতি থেকে আওয়াজ হলো, ‘আমি তোমাকে দ্বিতীয় জীবন দান করলাম। আমাকে জিজ্ঞেস করো আমি কেন দয়া করলাম?’ আমি জিজ্ঞেস করলে উত্তর এলো, ‘মুসলমানদের প্রতি আমার ভালবাসা আছে। মুসলমান আল্লাহর কালাম পাঠ করে, তাঁর উদ্দেশ্যে রুকু ও সিজদা করে। যাদের এ লাশ, আমিই তাদের শাস্তি যোগ্য করেছিলাম। কারণ তারা বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল। আমিই তাদের কাউকে কাউকে আবার সরল পথ দেখানোর ইচ্ছা করেছি। এ জন্যই আমি তোমাকে বেছে নিয়েছি, কারণ তুমি প্রতিদিন ভোরে কোরআন তেলাওয়াত করো। যাও! তোমাকে আলো দান করলাম। এ আলো আল্লাহর মুসলমান বান্দাদেরকে দেখাও।’
আমি ভাল মতো বুঝতে পারলাম না। আমি বললাম, ‘হে আমার প্রভুর আলো! আমাকে সম্পূর্ণ খুলে বলো, আর বলো আমার কথা কে মানবে ও কেমন করে মানবে? আমাকে বলো, আমার তলোয়ার কেন দুর্বল হয়েছিল? তীরের গতি কোথায় গিয়েছিল?’ সেই আলো থেকে উত্তর এলো, ‘সে তলোয়ার দুর্বল হয়ে যায়, যে তলোয়ারের আঘাত মায়ের উপর পড়ে, সে তীর খরকূটোর মত উড়ে যায়, যে তীর তাঁর মায়ের বুকে নিক্ষিপ্ত হয়। তুমি জানো, মা কে? যে মাটি তোমাকে জন্ম দিয়েছে আর যে মাটিতে তুমি খেলাধুলা করে বড় হয়েছো, সেই তোমার মা! যাও, সুদানের মুসলমানদের বলো, সুদান তোমাদের মাতৃভূমি, তোমাদের মা! তাকে ভালবাসো! এ মাটিই তোমাদের জান্নাত! এ জান্নাতকে দখল করার জন্য যদি বাইরের কোন মুসলমানও আসে, সে দোজখে যাবে। তুমি তো জাহান্নাম দেখেই নিয়েছ! যাও, তোমার কালেমা পড়া ভাইদের গিয়ে বলো, সুদানই তোমাদের মা! সুদানই তোমাদের জান্নাত! যাদের দিলে রহম আছে, মায়রে প্রতি দরদ আছে, তারা তোমার আলোয় আলোকিত হয়ে।’
‘হে আল্লাহর মনোনীত ব্যক্তি! তোমাকে সম্মান করা সকলের জন্য ফরজ!’ একজন বলল, ‘সুদানের বর্তমান বাদশাহ আমাদের রাসুলের অনুসারী নয় জেনেও কি তুমি আমাদেরকে তার আনুগত্য করতে বলো?’ এ লোক ছিল সেই আছাড় খাওয়া তিনজনের একজন।
‘খোদার আওয়াজ আমাকে জানিয়ে দিয়েছে, এ বাদশাহ কাফের কিন্তু শীঘ্রই তিনি মুসলমান হয়ে যাবেন।’ উমরু দরবেশ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘তিনি মানসিকভাবে মুসলমান হয়ে আছেন। তার সেনাবাহিনীর অধিকাংশই কাফের বলে তিনি এখনো মুসলমান হওয়ার ঘোষণা দিতে সাহস পাচ্ছেন না। তিনি উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করছেন। আল্লাহ্ ও তার রাসুলের পতাকা হাতে নেয়ার জন্য তিনি কিছু সাহসী ও জঙ্গি সঙ্গী খুঁজছেন। তোমরা সবাই তার হাতকে মজবুত করার জন্য ছুটে যাও! তলোয়ার, বর্শা, তীর-ধনুক যা আছে তাই নিয়ে ছুটে যাও! উট ও ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে ছুটে যাও! তোমরা দুনিয়াকে দেখিয়ে দাও, মাতৃভূমিকে তোমরা সবাই ভালবাসো। মাতৃভূমির রক্ষকের রক্ষীবাহিনী তোমরা, তোমরা সুদানের সন্তান!’
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন দরবেশ। তার সামনে পাহাড়ী অঞ্চলের বিশাল জনতা। সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিল তার কথা। প্রশান্ত সকালের শান্ত কোমল পরিবেশে দাঁড়িয়েছিল লোকগুলো। কারো মুখে কোন কথা নেই। নিরবতা ভাঙলেন দরবেশই, ‘আমি খোদার জ্যোতিকে বললাম, আমার মুখের কথা কেউ বিশ্বাস করবে না, কেউ মানবে না আমার কথা। এ কথা বললে, আমার মুসলমান ভাইয়েরাই আমাকে হত্যা করবে।’ খোদার জ্যোতি থেকে আওয়াজ এলো, ‘তোর সাথে আমার নিশানা থাকবে। বল, পানিতে কি কখনো আগুন জ্বলে? তোকে আমি পানিতে আগুন জ্বালানোর ক্ষমতা দেবো। আমি ছাড়া পানিতে কে আগুন লাগাতে পারে? যা, তোকে আমি এ শক্তি শুধু প্রমাণের জন্য দান করলাম, যেন লোকেরা তোর কথা বিশ্বাস করে।’ আমি এ কথার কোন জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলাম। আবারও জ্যোতি থেকে আওয়াজ এলো, ‘যদি তোর কথা লোকেরা তবুও মিথ্যা বলে, তবে তাদেরকে আমার কাছে ডাকবি। আমি তাদেরকে সেই তাজাল্লি দেখাবো, যে তাজাল্লি মুসাকে দেখিয়েছিলাম। তোমরা কি তুর পাহাড়ের তাজাল্লি দেখে সত্যকে মানবে?’ উমরু দরবেশ বললেন।
‘হ্যাঁ, হে খোদার দূত, আমরা মানবো।’ সে তিনজনের একজন বললো, ‘যদি তুমি আমাদের তুর পাহাড়ের জ্যোতি দেখাতে পারো তবে আমরা তোমার কথাকে খোদার আওয়াজ বলে মেনে নেবো।’
‘যাও!’ উমরু দরবেশ রাগে মাটিতে হাত মেরে বললেন, ‘তোমরা এখন চলে যাও! তোমরা সেই সময় আসবে, যখন সূর্যের কিরণ পাহাড়ের পিছনে হারিয়ে যায় আর আকাশে তারকার প্রদীপগুলো উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠে। যাও! তোমরা এখন চলে যাও!’
লোকেরা সবাই ফিরে চললো। তাদের মুখে এখন দরবেশের কথা ছাড়া আর কোন কথা নেই। ওরা তিনজন, পাঁচজন, সাতজন ছোট বড় নানা আকারের দলে ভাগ হয়ে কলরব করতে করতে গাঁয়ের পায়ে চলা বিভিন্ন পথ ধরে ফিরে যাচ্ছিল গ্রামে। তাদের অধিকাংশের অন্তরেই এখন আর কোন সন্দেহ নেই, এ লোক সত্যি কথাই বলেছে। মানুষের স্বভাবগত দুর্বলতার শিকার হয়ে ওরা ভাবতে লাগলো, হায়! এতদিন আমরা কি ভুলের মাঝেই না ছিলাম! এভাবে নিজের অজান্তেই তার নিজের বিশ্বাস ও ঈমানকে নিঃশেষ করে দিল। এতদিনের জেহাদী জোশ ঠাণ্ডা হয়ে গেল একদিনে। পাহাড়ী অঞ্চলের অশিক্ষিত সরল সহজ লোকগুলো সামান্য কয়টি রহস্যময় কথায় বিভ্রান্তির অতল তলে হারিয়ে যেতে লাগলো। অজানা কৌতূহলের মধুর শিহরণে আন্দোলিত হতে থাকলো ওদের হৃদয়গুলো।
গ্রামের নেতৃস্থানীয় এক লোক বললো, ‘সবই ঠিক আছে। তবু একটু তত্ত্ব-তালাশ করে দেখা দরকার, সে কেমন লোক। তাঁর বাড়ী তো এখান থেকে বেশী দূরে নয়।’
কয়েকজন যুবক এ কথায় লাফিয়ে উঠে বললো, ‘আপনি ঠিক বলেছেন। আমরা এখুনি তাঁর গ্রাম থেকে ঘুরে আসছি।’
নিজেদের কাজ ফেলে ওরা ছুটলো উমরু দরবেশের বাড়ী। কেউ একটু সন্দেহ প্রকাশ করলে অন্যেরা তাকে দাবিয়ে দিত। বলতো, ‘তুমি কি পানিতে আগুন ধরাতে পারবে?’ অন্য একজন বলে উঠতো, ‘ঠিক আছে, তুর পাহাড়ের তাজাল্লি দেখে কি বলবে?’
‘আগে তো জ্যোতি দেখি! তারপর বুঝবো তিনি সত্যি কথাই বলেছেন কিনা!’
জনতা উৎসুক আগ্রহে অপেক্ষা করছিল রাতে তুর পাহাড়ের তাজাল্লি দেখার জন্য। আশীকে ওরা এক বাক্যে জ্বীনদের মেয়ে স্বীকার করে নিলো।
এরা সেই সব মুসলমান, যারা সুদানের অমুসলিম শাসককে এতদিন কাঁপিয়ে রেখেছিল। সুদানের সেনাবাহিনীকে তারা পার্বত্য অঞ্চল থেকে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছিল। তারা আল্লাহ্র নিষ্ঠাবান বান্দা ও রাসূলের একনিষ্ঠ প্রেমিক ছিল। সুদানের নাগরিক হয়েও তারা তাদের পার্বত্য অঞ্চলকে মনে করতো স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র। এ জন্যই তারা সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে তাদের নেতা মানতো। কিন্তু উমরু দরবেশের সম্মোহনী আকর্ষণ ও কথার জাদু তাদেরকে বিপথগামী করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেল তাদের চিন্তাধারার গতি। বলিষ্ঠ ঈমানের অধিকারী একটি যোদ্ধা সম্প্রদায়ের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাদেরকে নিরস্ত্র করে দিল। তারা যে দিকে গেল, সে দিকেই এ অলৌকিক পীরের কথা ছড়াতে লাগলো। তারা যা দেখেছে ও শুনেছে তার চেয়ে বাড়িয়ে আকর্ষণীয় রঙ চড়িয়ে পীরের কাহিনী বলে বেড়াতে লাগলো লোকদেরকে।
‘সুদানী মুসলমান মিথ্যা ও চটকদার নিন্দার কাছে শেষে অস্ত্র সমর্পণ করলো!’ সুলতান আইয়ুবী পাহাড়ী অঞ্চলের খবর পাওয়ার পর আক্ষেপের সুরে বললেন। তিনি সুদান থেকে বহু দূরে ফিলিস্তিনের দ্বারপ্রান্তে এক পাহাড়ী উপত্যকায় তার সেনাপতি, কমান্ডার ও উপদেষ্ঠাদের মাঝে বসেছিলেন। তকিউদ্দিনের কাসেদ কিছুক্ষণ আগেই তাঁর কাছে পৌঁছেছে। তিনি তকিউদ্দিনের চিঠি পড়ে বললেন, ‘এটাকে হালকা করে দেখার উপায় নেই।’
তকিউদ্দিন লিখেছিলেন, ‘আলী বিন সুফিয়ান বণিকের বেশে সুদানে যাচ্ছেন।’ চিঠিতে তকিউদ্দিন সুলতান আইয়ুবীর কাছে জানতে চেয়েছেন, ‘সুদানের পাহাড়ী মুসলিম এলাকাতে কমান্ডো বাহিনী পাঠানো যাবে কিনা?’
তকিউদ্দিন সন্দেহ প্রকাশ করে চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, ‘কমান্ডো বাহিনী পাঠালে তা অতি গোপনে ও সাবধানে পাঠাতে হবে। কারণ ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে প্রকাশ্য যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। তাতে আমাদের ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশী। কারণ মিশরের অধিকাংশ সৈন্য আরবের মাটিতে যুদ্ধ করছে।’ চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, ‘সুদান সরকার মুসলমানদেরকে তাদের অনুগত বানানোর জন্য আমাদের যুদ্ধবন্দীদের ব্যবহার করতে চেষ্টা করছে।’
সুলতান আইয়ুবী চিঠি পড়ে তার সেনাপতি ও উপদেষ্ঠাদের বললেন, ‘সুদানের এ সব মুসলমান সুদানী বাহিনীর জন্য এক আতংকের কারণ! তোমরা তো স্বচক্ষেই দেখছো, সেখানকার যেসব সৈন্য আমাদের বাহিনীতে আছে, তারা কেমন মরণপণ করে যুদ্ধ করছে। কিন্তু শত্রুরা এখন তাদেরকে জাদুর পরশে বিভ্রান্ত করছে। তাদেরকে আরাম ও বিলাসিতার দিকে আকৃষ্ট করছে। ফলে তারা বালির মূর্তি সেজে বসেছে। তকিউদ্দিন আমাকে জানিয়েছে, খৃস্টানরা সুদানের মুসলিম এলাকায় তাদের প্রোপাগান্ডা জোরদার করেছে। মুসলমানদের ধর্মীয় চেতনায় আঘাত করতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তোমরা তো জানোই, তারা এসব কাজে খুব পটু। আমি যতদূর জানি, সুদানীদের উপদেষ্ঠা খৃস্টানরা সব সময় তাদের পাশে থেকে তাদেরকে এসব কুমন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের পরামর্শেই তারা মুসলমানদের ধর্মীয় চেতনায় আঘাত হেনে চলেছে।’
সুলতান আইয়ুবী তকিউদ্দিনের কাসেদকে আহার ও বিশ্রামের জন্য পাঠিয়ে দিলেন এবং কাতিবকে ডেকে চিঠির জওয়াব লিখাতে শুরু করলেন।
‘প্রিয় ভাই তকিউদ্দিন!
আল্লাহ্ জাল্লে শানুহু তোমার সাহায্যকারী ও সহযোগী হোন। তোমার চিঠিতে সুদানের মুসলমানদের অবস্থা তুমি স্পষ্ট করে তুলে ধরেছো। এতে তোমার অধীর ও অসহায় বোধ করার কোন কারণ নেই। তুমি তো জানো, কাফেরদের মূল টার্গেট ইসলামের ধ্বংস সাধন করা। এ জন্য তারা যুদ্ধ বিগ্রহের পাশাপাশি সামাজিক অনাচার সৃষ্টি করে চলেছে। এ মুহূর্তে আমি আলী বিন সুফিয়ানের উদ্যোগের প্রশংসা না করে পারছি না। তিনি সুদানে চলে গিয়ে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছেন। তোমাকেও ধন্যবাদ, তুমি তাকে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছো। আল্লাহ্ আলী বিন সুফিয়ানকে সাহায্য করুন। তিনি কেবল হুশিয়ার নন, নির্ভুল তথ্য সংগ্রহকারীও। তিনি পাথরের ভিতর থেকেও সংবাদ বের করে আনতে পারেন। তিনি ফিরে এসে তোমাকে বলবেন, সেখানকার প্রকৃত অবস্থা ও পরিস্থিতি কি। তিনিই তোমাকে সঠিক নির্দেশনা দিতে পারবেন। আমার পরামর্শ হচ্ছে, তুমি আলী বিন সুফিয়ানের পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ নিও।
তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করেছো, সুদানের মুসলমানদের কমান্ডো পাঠিয়ে সাহায্য করা যায় কিনা? তুমি তাতে ভয় এবং আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছো, কমান্ডো পাঠালে সুদান প্রতি আক্রমণ করতে পারে। তাতে আমাদের প্রকাশ্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হবে। তুমি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে আমার অনুমতি চেয়েছো। আমি তোমাকে সতর্ক করা প্রয়োজন মনে করছি। যদি অবস্থা বেগতিক দেখতে পাও, তবে আমার অনুমতির অপেক্ষায় থাকবে না। সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহূর্তও দেরী করবে না। তুমি হয়তো জেনেছো, সুদানের কারাগারের এক প্রহরী সুদানী এক কমান্ডারকে হত্যা করে মুসলমানদের কাছে এসে আশ্রয় নিয়েছে ও ইসলাম গ্রহণ করেছে। হয়তো তুমি এ কথাও জেনেছো, সুদানী সরকার আমাদের কয়েদীদেরকে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ষড়যন্ত্রে জড়ানোর চেষ্টা করছে। সুদানীরা আমাদের ইসহাক নামে এক কমান্ডারের স্ত্রী ও কন্যাকে ধোঁকা দিয়ে অপহরণ করার চেষ্টা করেছিল। এতেই বুঝা যায়, সুদানী মুসলমানদের মধ্যেও কিছু গাদ্দার তৈরী হয়েছে। এ অবস্থায় জরুরী ভিত্তিতে সেখানে একদল কমান্ডো পাঠানো প্রয়োজন ছিল তোমার। তারা কেউ বণিকের বেশে, কেউ মুসাফিরের বেশে প্রবেশ করতে পারতো। যাক, শেষ পর্যন্ত আলী বিন সুফিয়ানের সেখানে চলে যাওয়া অত্যন্ত বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে।
আমার স্নেহের ভাই! আমাদের কাছে সৈন্য অতি অল্প এ প্রশ্ন উঠাবার সময় এখন নয়। আমরা অন্য রণাঙ্গনের ঝুঁকি নেব, এতেও ভয়ের কোন কারণ নেই। আল কোরআনের বাণী স্মরণ করো, পৃথিবীর যে কোন স্থানে মুসলমানদের ওপর অত্যাচার ও উৎপীড়ন হলে, তাদেরকে প্রলোভন দেখিয়ে অথবা ধোঁকা দিয়ে ইসলামী আকিদা থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করলে এবং এর ফলে জাতীয় ঐক্য ও ঈমানের ওপর আঘাত অনুভুত হলে সে ক্ষেত্রে সমস্ত বিশ্বের মুসলমানদের ওপর জেহাদ ফরজ হয়ে যায়। আমি বহুবার বলেছি, ইসলামী সাম্রাজ্যের কোন সীমারেখা নেই। শরয়ী মতে ইসলামের প্রতিরক্ষার জন্য যে কোন দেশে প্রবেশে মুসলমানদের বাঁধা নেই। তুমি তো জানোই, আমি সুদানী মুসলমানদের কাছে আগেই গোপনে কিছু কমান্ডো পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। তারা এখন গ্রামের লোকদের সঙ্গে মিলেমিশে চাষাবাদের কাজ করছে। আমি সুদানী মুসলমানদেরকে অস্ত্রশস্ত্র এবং যুদ্ধের উপকরণ দিয়েও সাহায্য করেছি। যদি তুমি প্রয়োজন মনে করো তবে আরো সাহায্য পাঠাতে পারো।
সুদান সরকার বর্ডার বন্ধ করে মিশরের ওপর সামরিক অভিযান চালালে সে নিয়ে ভীত হওয়ার কিছু নেই। ঈমান দৃঢ় হলে তুমি অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়েই বিশাল বাহিনীর মোকাবেলা করতে পারবে। তুমি তো তাদের একটি আক্রমণ এরই মধ্যে কেবল প্রতিহতই নয়, ধ্বংস করে দিয়েছো। ইনশাআল্লাহ আবারও যদি তারা আক্রমণ করে তুমি তাদের ব্যর্থ ও ধ্বংস করে দিতে পারবে। তবে সাবধান! সামনাসামনি ওদের মোকাবেলা করতে যেও না। দুশমনকে তোমাদের সুবিধা মত স্থানে টেনে নিয়ে যাবে, যেখানে তোমরা অধিক ফায়দা পাবে বলে আশা করো। কমান্ডো বাহিনী বেশী ব্যবহার করবে। শত্রুদের রসদ ও খাদ্যশস্য ধ্বংস ও লুট করার চেষ্টা করবে। তোমাদের যুদ্ধের অর্ধেক সফলতা বয়ে আনবেন আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দা বাহিনী। কিন্তু আমার বিশ্বাস, সুদানীরা এত বড় বোকামী করবে না। যদি তারা খৃস্টান উপদেষ্টাদের বুদ্ধিতে কাজ করে তবে তারা যুদ্ধ করার পরিবর্তে সুদানী মুসলমানদের হাত করার চেষ্টা চালাবে। যদি মুসলমানরা তাদের অনুগত হয়ে যায় ও তাদের সাথে মিশে যায় তবে তারা সর্বক্ষেত্রেই বিপদ সৃষ্টি করতে পারবে। সে কারণে তোমাদের বিশেষ চেষ্টা ও সতর্কতা থাকবে এ ব্যাপারে। মুসলমানদের ধর্মীয় ও জাতীয় চেতনা নস্যাৎকারী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সক্রিয় হতে হবে তোমাদের। তবে তা হতে হবে গোপনে, যেন মুসলমানরা তাদের ষড়যন্ত্রের শিকার হতে না পারে।
আমি এ কথাই বারবার শতবার তোমাকে স্মরণ করিয়ে দেব, ‘মুসলমান যুদ্ধের ময়দানে কখনও পরাজিত হয় না বরং সবখানেই বিজয়ী হয়। কিন্তু মুসলমানের আবেগ ও প্রেরণায় ধ্বস নামলে তার পরিণতি হয় ভয়াবহ। তখন তার অস্ত্র ফেলে দিয়ে শত্রুর আনুগত্য করে। সব সময়ই মুসলমানদের অধপতন এ পথেই এসেছে। আজ এবং ভবিষ্যতেও এ পথেই আসবে। আমাদের শত্রুরা আমাদের জাতির মধ্যে যে চেতনার আগুন আছে তা নেভানোর চেষ্টা করছে। এভাবেই আমরা এখন আমরা দুই সেক্টরে যুদ্ধ করে চলেছি। একটা প্রকাশ্যে, অন্যটা গোপনে। আমাদের শত্রুরা বিষাক্ত তীরে কখনও আমাদের হত্যা করেতে পারেনি। কিন্তু কথার জাদু ও মিষ্টি মধুর বিভ্রান্তির মোহ দিয়ে জাতিকে বেকার ও ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে। এটা খুবই কঠিন ও দুর্বোধ্য সংগ্রাম! প্রিয় ভাই, এ ব্যাপারে খুব সাবধান থাকবে।
এখানকার অবস্থা এখন আমাদের অনুকূলে! শত্রুরা নাজেহাল হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আমি তাদেরকে আর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ দেবো না। আল্লাহর সাহায্য পেলে শীঘ্রই শুনবে, হলব আমাদের অধিকারে চলে এসেছে।
খৃস্টানরা এখন আর সামনে আসার ক্ষমতা রাখে না, হয়তো তারা আর সামনে আসবেও না। তারা আমাদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে তামাশা দেখছে। যদি তাদের শত্রু নিজেদের মধ্যে লড়াই করে শেষ হয়ে যায়, তবে তাদের সামনে আসার প্রয়োজন কি!
আল্লাহ্ তোমাকে সাহায্য করুন। আমি আশা করি, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও শাণিত ঈমান নিয়ে কাজ করে যাবে। আল্লাহ্ হাফেজ।’
যে সময় সুলতান আইয়ুবী এ চিঠি লিখে কাসেদকে দিচ্ছিলেন, ঠিক সে সময় উমরু দরবেশের তাঁবুতে বসেছিল ওই তিন লোক, যারা মানুষের ভীর হওয়ার আগেই উমরু দরবেশের ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং অগ্রসর হওয়ার নাম করে ডিগবাজী খেয়ে পড়েছিল আর ভান করছিল যেন কেউ তাদের সামনে থেকে ধাক্কা দিয়েছে। লোকজন ততক্ষণে তাদের অভিনয় ধরতে না পেরে সকলেই মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে চলে গিয়েছিল।
লোকজন চলে যেতেই উমরু দরবেশ বাইরে থেকে উঠে তাঁবুর মধ্যে চলে গেলেন। তাঁর তিন সঙ্গী জনতার সাথে বেশ কিছু দূর অগ্রসর হয়ে তারপর আবার ফিরে এলো তাঁবুতে। জনগণের দৃষ্টি এড়িয়ে তাঁবুতে ফিরেই তারা উমরু দরবেশের মুখোমুখি বসল। এ তিনজনই ওই এলাকার বাসিন্দা ছিল। সুদান সরকার থেকে তারা নিয়মিত ভাতা ও পুরস্কার পেতো।
‘আমার তো ভয় ধরে গিয়েছিল কাপড় জ্বলবে না।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘কারণ কাপড়ের নিচে দাহ্য তেল কম ছিল আর উপরে পানি একটু বেশীই পড়ে গিয়েছিল।’
‘এখনও তোমার এ বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞান হয়নি, এ তেল শুধু পানির ওপর ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিলেও জ্বলবে!’ তাদের একজন বললো, ‘আমি এটা আগেই পরীক্ষা করে নিয়েছিলাম।’
‘লোকজনের উপরে এ ভেল্কিবাজী কেমন প্রভাব ফেলেছে?’ উমরু দরবেশ প্রশ্ন করলেন।
‘আমারা অনেক দূর পর্যন্ত তাদের সাথে গিয়েছিলাম।’ একজন বললো, ‘তারা তোমার পানিতে আগুন ধরানোর কেরামতি দেখে ভড়কে গেছে। কেউ কল্পনাও করেনি, পানিতে আগুন ধরানো যায়। তোমার কথা বলার ভঙ্গিও ছিল চমৎকার। তাদের অন্তরে তোমার প্রতিটি কথাই খোদাই হয়ে গেছে। খোদার কসম, ওরা তোমার সব কথাই বিশ্বাস করেছে!’
‘ছি! বন্ধু!’ উমরু দরবেশ তাকে বাঁধা দিয়ে বিজ্ঞের মত বললেন, ‘তুমি খোদার কসম খেয়ো না। খোদার কসম খাওয়ার কোন অধিকার আমাদের নেই। এ অধিকার তো আমরা কবেই হারিয়েছি। কারণ আমরা এখন যা করছি তা সবই খোদার নির্দেশের বিপরীত।’
‘মনে হচ্ছে এখনও তোমার মুনে খোদার ভয়-বিশ্বাস রয়েই গেছে!’ তাদের একজন বললো, ‘উমরু দরবেশ, তুমি তো খোদার প্রতি ঈমান বিক্রি করেই আমাদের সাথে এসেছো।’
অপর লোকটি তার পাশে বসা আশীর উরুতে থাবা মেরে উমরু দরবেশকে বললো, ‘তুমি একটু খেয়াল করে দেখো, এ ঈমান বিক্রির বিনিময়ে কেমন অমূল্য সম্পদ তুমি পেয়ে গেছো। এ মেয়ে খৃস্টান বাদশাহর অন্দর মহলের অমূল্য হীরার টুকরো, অথচ সুদান সরকার তোমাকে এ অমূল্য সম্পদই দান করেছেন।’
উমরু দরবেশ আশীর দিকে গভীর চোখে তাকালো। আশী তাঁর দিকেই নির্ণিমেষ নয়নে তাকিয়েছিল, তাকে তাকাতে দেখেই চোখ টিপে দিলো। তার কপালে ছিল দুশ্চিন্তার ভাঁজ। উমরু দরবেশ এ ইশারা বুঝতে পারলেন। একটু হেসে তিনি বললেন, ‘আমি তা বলিনি, যে খোদার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি, তার কসম আমরা খেতে যাবো কেন? তার কসম খেয়ে তোমরাই তো বার বার তাঁর কথা স্মরণ করছো! হ্যাঁ, তবে একটি কথা তোমরা সত্যি বলেছো। আসলেই এত মূল্যবান হীরা পাওয়ার যোগ্য আমি নই। যাক, এখন ওসব বাদ দাও। ভোরের মিশন তো শেষ, এখন বলো, রাতের জন্য কি ব্যবস্থা করলে?’
‘সব কিছু ঠিকঠাক। ও নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।’ একজন বললো, ‘তুমি তো আমার কাজ সম্পর্কে জানোই। কোথাও ফাঁক রাখি না আমি। দেখলে না, এক রাতের মধ্যে গ্রামের লোকদের তোমার পিছনে কেমন করে নিয়ে এলাম? আর তাদেরকে এমন কৌশলে তোমার ভক্ত করে দিলাম যে, কেউ একটু সন্দেহ বা প্রশ্ন করারও সুযোগ পায়নি।
রাতে তুমি এ নির্বোধদের তুর পাহাড়ের তাজাল্লি দেখাবে। যেমন খোদা তাঁর নবী হযরত মুসা (আঃ) কে দেখিয়েছিলেন।’
‘নিশ্চয়ই দেখাবো। আমার তো বেশ ভালই লাগছে, এত মানুষের ভক্তি পাবো, জীবনে কি তা কোনদিন কল্পনা করেছিলাম!’
‘আরো শ্রদ্ধা ভালবাসা পাবে তুমি। শুধু দরকার একটু নিখুঁত অভিনয়। তোমাকে কি করতে হবে সব কি তোমার স্মরণ আছে? আমাদের লোকজন কিন্তু সবাই প্রস্তুত।’ অন্য একজন বললো।
‘আমাদের এখন এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত।’ তৃতীয় ব্যক্তি বললো, ‘তুমি এখন আর তাঁবু থেকে বের হয়ো না।’
‘ঠিক আছে। সন্ধ্যায় আবার দেখা হবে।’ বললেন উমরু দরবেশ। তিনজনই সেখান থেকে বের হয়ে পাহাড়ের পেছনে দিয়ে নেমে ঘুরে গ্রামের দিকে হাঁটা দিল।
সূর্য ডোবার সাথে সাথেই লোকজন আসতে শুরু করলো। সকালে উমরু দরবেশের কথা যারা শুনে গিয়েছিল এবং স্বচক্ষে পানিতে আগুন লাগার কেরামতি দেখেছিল, তারা যতদূর সম্ভব সে সংবাদ পৌঁছে দিয়েছিল মানুষের কানে কানে। ছোট্ট সে পাহাড়ী অঞ্চলের এমন কোন ঘর ছিল না, যে ঘোরে এ আশ্চর্য ঘটনা এবং খোদার দূতের আগমনের খবর পৌঁছেনি। তারা মহা উৎসাহে প্রচার করছিল, ‘আজ রাতে উমরু দরবেশ তুর পাহাড়ের সেই তাজাল্লি দেখাবেন, যেমনটি খোদা দেখিয়েছিলেন হযরত মুসা (আঃ) কে।’
সন্ধ্যা। জনতার সাথে মিশে সেখানে উপস্থিত হয়েছে সুদানের গোয়েন্দা বিভাগের বেশ ক’জন সদস্যও। তারাও জানপ্রাণ দিয়ে গুজব ছড়ানোর কাজ করেছে আজ সারাদিন। সন্ধ্যার পরে জনতার ছয়লাবের সাথে তারা উমরু দরবেশের তাঁবুর সামনে জড়ো হতে লাগলো। কিন্তু তাঁবুর পিছনে ও ডানে বামে কারো দাঁড়ানোর অনুমতি ছিল না।
উমরু দরবেশ তখনও তাঁবুর মধ্যে। বাইরে দু’টো মশাল জ্বলছে। মশালের লাঠির গোড়া মাটিতে পোঁতা।
তাঁবুর বাইরে সমবেত লোকজন খোদার দূতকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠলো। এ অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছিল তাদের কথাবার্তা ও আচরণে। হাজার হাজার জনতার কণ্ঠের মিলিত আওয়াজে গমগম করছিল পুরো এলাকাটা।
হঠাৎ তাঁবুর পর্দা একটু নড়ে উঠলো। জনতা উৎকর্ণ হয়ে তাকালো সেদিকে। তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসেছে এক অনিন্দ্য সুন্দরী মেয়ে। মেয়ে নাকি পরী ঠিক বুঝতে পারল না জনতা। কলরব থেমে গেল মুহূর্তে। কাউকে চিৎকার করে বলতে হলো না, কথা থামাও, শোরগোল করো না। তাকে দেখামাত্র লোকগুলি যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল।
সুসজ্জিত হয়ে তাঁবুর বাইরে এল আশী। পরণে তাঁর জমকালো পোষাক। জরির কাজ করা লম্বা-চওড়া কালো কাপড়ের কামিজ। কাঁধ থেকে পা পর্যন্ত সারা অঙ্গে জরি ও চকমকি পাথর বসানো। মশালের আলোয় তারকারাজির মত চমকাচ্ছিল ওগুলো। মাথায় রেশমী কাপড়ের হালকা উড়না। তাতেও জমকালো কারুকার্য করা। তার রেশমের মত কোমল মাথার চুল দুই কাঁধের ওপর দিয়ে সামনে ছড়ানো। হালকা উড়নার মধ্য দিয়ে কাঁধ ও গলার উজ্জ্বলতা চাঁদের মত জ্বলজ্বল করছিল। এমনিতেই আশী ছিল অপরূপ সুন্দরী, তার ওপর মোহিনী সাজসজ্জা এবং অঙ্গসঞ্চালনের নৈপুণ্য যাদুর মত প্রভাব ফেলল উপস্থিত দর্শকদের মাঝে। তার প্রতিটি অঙ্গসঞ্চালনেই আশ্চর্য এক মাদকতাময় আবেদন ছড়িয়ে পড়ছিল। মানুষের দেহের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ছিল বিহবলতার অচিন পরশ।
পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী এ লোকগুলোর চোখে মেয়েটিকে মনে হচ্ছিল বেহেশতের হুর। তার চালচলন ও পোষাকের জৌলুশে আটকে গেল বিমুগ্ধ হাজার চোখ। অবাক হয়ে লোকগুলো তাকিয়ে রইল তার দিকে, যেন কোন জাদুকন্যা ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের চোখের সামনে।
আশীর হাতে দেড় গজ লম্বা ও একগজ প্রস্ত একটি কার্পেটের জায়নামাজ। সে জায়নামজটি দুই মশালের মাঝখানে এনে বিছিয়ে দিল। জায়নামাজ বিছানো শেষ হলে সে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাত আকাশের দিকে বাড়িয়ে ধরে ঊর্ধ্বমুখে নিশ্চল মূর্তির মত দাঁড়িয়ে গেল। লোকগুলোর সব ক’টি চোখ সমস্ত মনোযোগ দিয়ে দেখছিল তাকে। এই ফাঁকে আস্তে সরে গেল তাঁবুর পর্দা। উমরু দরবেশ যেন শূন্যের ওপর দিয়ে ভেসে এসে সেই জায়নামাজের ওপর দাঁড়ালেন, অন্তত লোকগুলোর তাই মনে হলো। তিনিও আশীর মত দুই বাহু আস্তে আস্তে আকাশের দিকে তুলে ধরলেন। নির্বাক লোকগুলো তাকিয়ে রইলো তার দিকে। তিনি আস্তে আস্তে বিড় বিড় করে কিছু পাঠ করতে লাগলেন।
‘হে খোদার দূত।’ বললো তিনজনের একজন, ‘তোমার সকালের কথা আমাদের মনে গেঁথে আছে। তুমি বলেছিলে তুমি আমাদের তুর পাহাড়ের তাজাল্লি দেখাবে। যদি তুমি অসন্তুষ্ট না হও, তবে তোমার কাছে আমরা সেই তাজাল্লি দেখার আরজ করতে চাই।’
‘মিশর ফেরাউনের দেশ!’ উমরু দরবেশ উচ্চ স্বরে বললেন, ‘ফেরাউন মারা গেছে। কিন্তু আল্লাহ্ যাকে মিশরের বাদশাহ করেন সেই ফেরাউন হয়ে যায়। এটা মিশরের মাটি, পানি ও আবহাওয়ার প্রভাব। এ জন্যই আল্লাহ্র কালেমা পাঠকারীও ফেরাউন হয়ে যায়। হযরত মুসা (আঃ) ফেরাউনের খোদাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এবং নীল নদের পানি দুই ভাগ করে দেখিয়েছিলেন। এখন মিশর পুনরায় ফেরাউনের অধিকারে চলে গেছে। সেখানে মদের স্রোত বয়ে চলেছে। পর্দানশীন কুমারী মেয়েদের সম্ভ্রম বিনষ্ট হচ্ছে। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের অসীম রহমত, এখনো তিনি এ অঞ্চলের লোকদেরকে মিশরের নব্য ফেরাউনের শাসন থেকে মুক্ত রেখেছেন। দোজাহানের মালিক আল্লাহ্ তোমাদের ঈমানকে দৃঢ় ও অটুট রাখার স্বার্থে আমাকে পাঠিয়েছেন তুর পাহাড়ের তাজাল্লি দিয়ে। ফেরাউনের কুপ্রভাব যেন তোমাদের মনে না আসতে পারে, যাদের মনে মিশর সরকারের প্রতি দুর্বলতা সৃষ্টি হয়েছে তারা যেন তাদের সে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারে সে জন্য আমি তোমাদেরকে তুর পাহাড়ের তাজাল্লি দেখাবার ওয়াদা করেছি। নিশ্চয়ই আমি সে ওয়াদা পূরণ করবো। তোমরা অবশ্যই আল্লাহ্র নূরে-তাজাল্লি দেখার সুযোগ পাবে।’
‘কখন! কোথায়?’ ব্যগ্রতা সেই লোকের কণ্ঠে।
‘এখনই দেখতে পাবে। তবে তার আগে সবাই পশ্চিম দিকে মুখ করে হাঁটু গেড়ে বসো এবং সেজদায় লুটিয়ে পড়ে আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করো। আমার কাছে নয়, সত্যের নিশানা চাও তাঁর কাছে। তাঁর হুকুম ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না। তার যা হুকুম পৃথিবীতে শুধু তাই ঘটে। তিনিই তোমাদের আশা পূর্ণ করবেন।’
লোকজন পশ্চিমমুখী হয়ে সেজদায় লুটিয়ে পড়লো। কয়েক মিনিট কেটে গেল এভাবে। চারদিক নিঝঝুম, চুপচাপ। হাজার হাজার লোক, কিন্তু কোথাও টু শব্দটি নেই।
মিনিট পাঁচেক পর উমরু দরবেশ দরাজ কণ্ঠে বললেন, ‘এবার মাথা তোল।’ লোকগুলো মাথা তুলে আবার উমরু দরবেশের দিকে মুখ করে বসলো। উমরু দরবেশ দু’বাহু আকাশের দিকে বাড়িয়ে আবেগভরা কণ্ঠে বললেন, ‘হে খোদা, তুমি তোমার বিপথগামী বান্দাদেরকে তোমার তাজাল্লি দেখাও, যেমন তুমি হযরত মুসা (আঃ) কে তুর পাহাড়ে দেখিয়েছিলে।’
তিনি সামনে ঝুঁকে মাটি থেকে মশাল হাতে উঠিয়ে নিলেন। রাতের অন্ধকার ততক্ষনে গভীর হয়ে উঠেছে। পাহাড় ও উপত্যকার গাছপালা কালো অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেছে। শুধু দুই মশালের আলোয় আশপাশের সামান্য এলাকা আলোকিত। এ আলোয় উমরু দরবেশ ও আশীকে ছাড়া আর কাউকে দেখা যাচ্ছিল না।
উমরু দরবেশ মশাল উঁচু করে ধরলেন। তারপর পাশের পাহাড়ের চুড়ার দিকে ইশারা করে বললেন, ‘ওদিকে তাকাও, ওখানে যে পাহাড় আছে সে দিকে তাকালেই তোমরা খোদার নূর দেখতে পাবে।’
লোকগুলো তাকালো সেদিকে। না, নিরেট অন্ধকার ছাড়া সেখানে আর কিছুই নেই।
উমরু দরবেশ মশাল আরও উঁচু করে ডানে বামে দুলালেন। জোরে জোরে বলতে লাগলেন, ‘হে আল্লাহ্, তোমার নূরের তাজাল্লি দেখাও। আমাদের হৃদয়কে আলোকিত করো প্রভু। তোমার কুদরতের মহিমা দেখাও খোদা।’
তাঁর বিগলিত অনুনয় তখনো থামেনি, পাহাড়ের চূড়ায় আবছা আলোর আভাস দেখা গেল। আলো ক্রমশঃ বাড়তে বাড়তে চারদিকে আলোকিত করে তুলল। লোকজন অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো সে আলোর দিকে। আলো আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠতে লাগলো এবং ধীরে ধীরে কমতে লাগলো তার উজ্জ্বলতা। তারপর এক সময় একদম নিভে গেল। লোকগুলো হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে, যেখানে এইমাত্র হারিয়ে গেল খোদার নূর। এ বিস্ময়কর ঘটনায় জনতা এতটা হতবাক হলো যে, তারা যেন বোবা এবং পঙ্গু হয়ে গেছে।
এ সময় শোনা গেল উমরু দরবেশের কণ্ঠ, ‘যদি তোমরা খোদার এ তাজাল্লিকে তোমাদের অন্তরে ঠাঁই না দাও, তবে যে অগ্নিশিখা তোমরা দেখতে পেলে সে অগ্নিশিখা তোমাদের এ শস্য শ্যামল উপত্যকা, সবুজ অরণ্য ও এ পাহাড়ী অঞ্চলকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে মরুভূমি বানিয়ে দেবে।’ উমরু দরবেশ বললেন ‘আমিও তাকে বাঁধা দিতে পারবো না। তিনিই তোমাদেরকে এখানে ডেকেছেন। তোমরা সবাই তাঁর হুকুম মতো চলবে।’
উমরু দরবেশ তার তাঁবুর মধ্যে চলে গেলেন। আশী লোকদের ইশারা করলো চলে যাওয়ার জন্য। জনতা ধীরে ধীরে সেখান থেকে বিদায় হতে লাগলো। হাজার হাজার লোক নেমে যাচ্ছে পাহাড় থেকে। কারো মুখে কোন কথা নেই। রাস্তায়ও লোকগুলো নীরব ছিল, যেন একে অন্যের সাথে কথা বলতেও ভয় পাচ্ছে। দরবেশের কোন কথাতেই এখন আর কারো কোন সন্দেহ নেই।
তারা যখন পাহাড় ছেড়ে গ্রামে গিয়ে পৌঁছুল, হঠাৎ সামনের লোকেরা দেখতে পেল পেছন থেকে এক লোক দৌড়ে ওদের দিকে ছুটে আসছে আর চিৎকার করে বলছে, ‘ভাইসব, তোমরা একটু দাঁড়াও!’
লোকজন দাঁড়ালে সে সবার সামনে গিয়ে ওদের দিকে মুখ করে ঘুরে দাঁড়াল। সে কিছু বলবে বুঝতে পেরে থেমে গেল লোকজন। দেখলো, এ লোক আর কেউ নন, তাদের গ্রামের মসজিদের সম্মানিত ইমাম সাহেব।
আকাশ থেকে নেমে এসেছে চাঁদের হালকা আলো। সে আলোয় ইমাম সাহেব দেখতে পেলেন, গ্রামের প্রায় সব লোকই তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি দু’হাত উপরে তুলে ওদের পথ আগলে ধরে বললেন, ‘মুসলমান ভাইসব, তোমরা তোমাদের ঈমান নষ্ট করো না। এতক্ষণ তোমরা যা দেখলে তা বুঝাতে চেষ্টা করো। মুসলমান ভাইয়েরা আমার! তোমরা যা দেখলে এর সবই যাদুর খেলা! এগুলো নিছক ভেল্কিবাজি! আল্লাহ্র প্রিয় নবী ও তাঁর শেষ রাসূলের পর আর কোন নবী ও রাসূল আসবেন না এবং কেউ আসেনওনি। আল্লাহ্ এমন পাপিষ্ঠ লোককে তাঁর আলো ও তাজাল্লি দেখাতে পারেন না, যে ব্যক্তি একটি বেহায়া যুবতীকে প্রদর্শনী করে বেড়ায়। যে লোক আল্লাহ্র বিধান লঙ্ঘন করে যুবতী নারীকে হাজার হাজার মানুষের সামনে প্রদর্শন করতে পারে তার কি কোন লজ্জা ও ঈমান থাকতে পারে?’
‘এ কোন যুবতী মেয়ে মানুষ নয়, এ তো জ্বীনের পরী!’ একজন বললো।
‘জ্বীন মানুষের রূপে কোন দিন সামনে আসে না।’ ইমাম সাহেব বললেন, ‘আর জ্বীন কখনও মানুষের দাস-দাসী হতে পারে না। ভাইসব, আমি বলছি, তোমরা তোমাদের বিশ্বাস নষ্ট করো না, ঈমানকে দৃঢ় ও মজবুত রাখো। সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ফেরাউন হতে পারেন না, তিনি একজন আল্লাহ্র প্রিয় বান্দা, খাঁটি মুসলমান! তিনি নবুয়ত দাবি করেননি, তিনি তোমাদের দ্বীন ও মিল্লাতের একজন একনিষ্ঠ খাদেম ও সেবক। তিনি কাফেরদের অত্যাচার থেকে মুসলমানদের বাঁচাবার জন্য সারা জীবন শত্রুর সাথে যুদ্ধ করেছেন! এখনো তিনি যুদ্ধের ময়দানে! লড়াইয়ের ময়দানে টিকতে না পেরে তার শত্রুরা তোমাদের ঈমান নষ্ট করার জন্য এ জঘন্য পথ বেছে নিয়েছে!’
‘সম্মানিত ইমাম!’ একজন প্রশ্ন করলো, ‘আপনি কি জীবনে কোন দিন পানিতে আগুন ধরাতে দেখেছেন? বলুন, জবাব দিন।’ বেপরোয়া কণ্ঠে জানতে চাইল লোকটি।
‘আরে ওর কথায় কান দিও না।’ অন্য একজন বললো, ‘এ বেচারা তার ইমামতি ঠিক রাখার জন্য ব্যস্ত হয়ে আছে।’
‘আমরা স্বচক্ষে যা দেখলাম তা কি আপনি অবিশ্বাস করতে বলেন?’ অন্য একজন বললো, ‘আপনার কাছে এমন কি প্রমাণ আছে যে , আপনি দরবেশের কেরামতিকে অবিশ্বাস করতে বলেন?’
‘তোমরা দয়া করে সেই পাহাড়ে চলো, যেখানে তাজাল্লি দেখানো হয়েছে।’ ইমাম সাহেব বললেন, ‘আমি তোমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবো, এ স্রেফ ভেল্কিবাজী! ডাহা মিথ্যাচার ও প্রতারণা! আর যদি আমি তা প্রমাণ করতে না পারি তবে তোমরা আমাকে যে শাস্তি দাও তাই মাথা পেতে নেবো, এমনকি তোমরা যদি আমাকে সেখানেই হত্যা করতে চাও, তাতেও আপত্তি করবো না। আমার এ অনুরোধটুকু তোমরা রাখো। খোদার কসম! তোমরা ঈমান হারিয়ে বাড়ি ফিরে গেছো, এটা দেখার চেয়ে মরণই আমার ভাল।’
উপস্থিত লোকদের মনে দোটানার সৃষ্টি হলো। ইমাম সাহেবও এ এলাকারই লোক। ছোটবেলা থেকেই সবাই তাকে দেখছে। তিনি একজন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি হিসাবেই সবার কাছে পরিচিত। ফলে তাঁর কণ্ঠ ও কথায় প্রভাবিত হলো অনেকেই। কিন্তু কারো কারো মনে দরবেশের কেরামতির প্রভাবই তখনো প্রবল ছিল। এ জনতার মধ্যে শামিল ছিল সুদানী গোয়েন্দারাও। তাদেরই একজন এগিয়ে এসে বললো, ‘আমরা খোদার নূর দেখেছি। দরবেশ যা বলেছে তাতে সন্দেহের কিছু দেখছি না। তিনি আমাদের আল্লাহ্র পথে চলার জন্য ডাক দিয়েছেন। এ কাজে কেউ বাঁধা দিক তা আমরা চাই না। কেউ এমন দুঃসাহস করলে তার পরিণতি মারাত্মক হবে বলে দিলাম।’
সঙ্গে সঙ্গে আরো দু’তিনজন তাকে সমর্থন করলো এবং ইমাম সাহেবের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে তেড়ে এলো তার দিকে। ইমাম সাহেবের কথায় যারা প্রভাবিত হয়েছিল, এ প্রতিবাদ দেখে তারা চুপসে গেল। ইমাম সাহেব তাদের বুঝাতে চাইলেন, কিন্তু তারা ইমাম সাহেবকে ধাক্কা দিয়ে সামনে থেকে সরিয়ে বাড়ীর দিকে রওনা হলো। তাদের দেখাদেখি বাকীরাও ঘরের পথ ধরলো।
কিছুক্ষণ ইমাম সাহেব সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন। লোকেরা তাকে রেখে এগিয়ে গেলে বিষণ্ণ মনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন তাদের চলে যাওয়া। শেষে একাই অন্ধকারের ভেতর দিয়ে সে পাহাড়ের দিকে যাত্রা করলেন, যেখানে নূরের তাজাল্লি দেখানো হয়েছিল।
পথ চলছেন তিনি একা। অন্ধকার রাত। ভয়াবহ কংকরময় এবড়ো থেবড়ো পাহাড়ী রাস্তা। একটি জঙ্গল অতিক্রম করে তিনি এক উঁচু টিলায় পৌঁছলেন। টিলায় দাঁড়িয়ে চারদিকে নজর বুলাচ্ছেন তিনি, হঠাৎ মানুষের কণ্ঠ কানে এলো তার। আওয়াজ ভেসে আসছিল সামনের দিক থেকে, সেদিকে তাকালেন তিনি। দেখলেন দু’ব্যক্তি কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে। তারা ইমাম সাহেবের দিকেই এগিয়ে আসছিল। তিনি আর না এগিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন।
তাদের পদধ্বনি ক্রমশঃ নিকটতর হলো। লোক দু’জন তাঁর কাছে এগিয়ে এলে চাঁদের ক্ষীণ আলোয় তিনি দেখতে পেলেন, ওদের মুখ কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা। ইমাম সাহেব তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কারা?’ তারা এর কোন জবাব না দিয়ে একজন ইমাম সাহেবের সামনে দাঁড়াল, অন্যজন চলে গেল ইমাম সাহেবের পিছনে। ইমাম সাহেব কিছু বুঝে উঠার আগেই পেছনের লোকটি পিছন থেকে ইমামের গলা জড়িয়ে ধরে তাঁকে মাটিতে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করলো। ইমাম সাহেব ঘটনার ভয়াবহতা বুঝতে পেরে কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে চট করে কোমর থেকে খঞ্জর বের করে হাতে নিলেন। সামনের লোকটি থাবা দিয়ে ধরে ফেললো খঞ্জর ধরা হাতটি। ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেলো ওদের মধ্যে। ইমাম সাহেব একা এবং অসহায় অবস্থায়। তাঁর খঞ্জর ধরা হাতটি একজনের কব্জায় আবদ্ধ, অন্যজন তাঁর গলা আঁকড়ে ধরে আছে। লোকটি তার হাতের চাপ বাড়াচ্ছে। শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় ছটফট করতে লাগলেন ইমাম সাহেব। তাঁর নিঃশাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়, চাপ কমাতে না পারলে কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যাবেন তিনি। তিনি মুক্ত হবার জন্য মরিয়া হয়ে শেষ চেষ্টা চালালেন। সর্বশক্তি দিয়ে প্রচণ্ড জোরে লাফ দিয়ে উঠলেন তিনি এবং সঙ্গে সঙ্গে জোড়া পায়ে সামনের লোককে সজোরে লাথি মারলেন। লাথি লোকটির বুকে লাগলো। পিছনের লোকের হাত থেকে ছুটে গেল তার গলা এবং লোকটি পেছনের দিকে ছিটকে পড়ল। সামনের লোকটিও লাথির আঘাতে চিৎ হয়ে পড়ে গিয়েছিল। তারা উঠে বসার আগেই ইমাম সাহেব মুহূর্তে নিজেকে মুক্ত করে খঞ্জর হাতে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি একটি রক্তাক্ত লড়াইয়ের জন্য তৈরি হয়ে রুখে দাঁড়াতেই লোক দু’টি উঠে ভয়ে পালিয়ে গেল।
তাদের পালানোর কারণ ছিল, তারা দু’জনেই সে গ্রামের লোক ছিল যেখানে ইমাম সাহেব ইমামতি করতেন। মুখোশ খুলে গেলে ইমাম সাহেব তাদের চিনে ফেলতে পারেন, এ ভয়েই তারা পালাচ্ছিল। ইমাম সাহেব তাদের ডাকলেন, ভয় দেখালেন, কিন্তু তারা ফিরলো না। ইমাম সাহেব তাদের পিছু ধাওয়া না করে সেই পাহাড় চুড়ার দিকে পূনরায় যাত্রা করলেন।
উমরু দরবেশের তাঁবুতে বসেছিল সে তিনজন লোক, যারা সবসময় তার সাথে যোগাযোগ রাখতো। গ্রামবাসী সেজে যারা দিনের বেলায় তাকে সহযোগিতা করেছিল। তারা উমরু দরবেশকে বললো, ‘কেল্লা ফতে দরবেশ! তোমার অভিনয় দারুন হয়েছে। আমাদের মিশন একশো ভাগ সফল। লোকজন সে মনোভাব নিয়েই ফিরে গেছে, যেমনটি আমারা আশা করেছিলাম।’
‘তোমরাও চমৎকার খেল দেখিয়েছো!’ বললেন দরবেশ।
তারা বললো, ‘আগামীকাল রাতে এ খেল আমরা দেখাবো অন্য গ্রামে। তার পরদিন আরেক গ্রামে। সুদান ও মিশরের মুসলিম প্রধান প্রতিটি এলাকায় আমরা এখন থেকে এ খেলা দেখিয়েই যেতে থাকবো। তুর পাহাড়ের তাজাল্লি দিয়ে অন্ধ করে দেবো তাদের চোখ, তাদের অন্তর। তুমি পারবে দরবেশ, সুদান সরকারকে আমরা জানাবো তোমার এ কৃতিত্বের কথা। আজ তাহলে আসি।’
আশী ও উমরু দরবেশের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল ওরা। আশী একাকী বসে রইলো উমরু দরবেশের কাছে। ‘তুমি কি তোমার এ সফলতায় খুশী হয়েছো?’ আশী প্রশ্ন করলো।
‘আশী!’ উমরু দরবেশ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো, ‘আমি তোমাকে এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে ভয় পাই।’
‘তুমি কি চাও, আমি চিরকাল খৃস্টান ও সুদানীদের আশ্রিতা হয়েই বেঁচে থাকি?’ আশী বললো, ‘তুমি আমার মধ্যে ঈমানের আলো জ্বেলে দিয়ে এখন নিজেই আমাকে অবিশ্বাস করছো!’
‘আশী! আমি তোমাকে অবিশ্বাস করি এ কথা কখনো বলিনি। এটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা নয়, এটা কর্মকৌশলের নীতি।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘তবে শুধু মুখের কথায় নয়, বিশ্বাস প্রমাণ করতে হয় নিজের কর্ম দিয়ে।’
‘আমাকে বলো, আমাকে কি করতে হবে। আমি কি করবো? কি করলে প্রমাণ হবে আমি বিশ্বাসী। তুমি যা বলবে, আমি তাই করবো।’
‘এখন যা করছো তাই করতে থাকো।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘যখন সময় হয় তখন তোমাকে বলে দেবো, তোমাকে কি করতে হবে।’
‘এমন তো হতে পারে, তোমার বলার সুযোগই থাকবে না।’ আশী বললো, ‘তুমি তো দেখছো, তোমার আশেপাশে গুপ্তচর লেগেই আছে। যদি তুমি সামান্য সন্দেহজনক কাজ করো, এ গোয়েন্দারা তোমাকে গোপনে খুন করে ফেলবে এবং আমাকে অপহরণ করে নিয়ে যাবে। তারচে তুমি আগেই আমাকে বলে দাও, তোমার ইচ্ছাটা কি? তাহলে তোমাকে আমি সবসময় সতর্ক করতে পারবো। কারণ গোয়েন্দারা তো আমাকে তাদেরই একজন মনে করে।’
আশীর বলার ভঙ্গি এমন আন্তরিক ও অকপট ছিল যে, মেয়েটি তাকে ধোঁকা দেবে না উমরু দরবেশের মনে এ বিশ্বাস ও আস্থা সৃষ্টি হলো। তিনি বললেন, ‘তবু তোমার কর্তব্যনিষ্ঠা দেখে আমার ভয় হয়, তুমি আসলে কার?’
‘তুমিও তো কর্তব্যে খুব নিপূনতা ও সাফল্য দেখাচ্ছ। আমিও তো মনে করতে পারি, তুমি জাতিকে ধোঁকা দেয়ার পাকা সংকল্প করে বসে আছো। ঈমানের পথে চলার কোন ইচ্ছাই এখন আর তোমার মনে অবশিষ্ট নেই।’
তর্কে টিকতে না পেরে উমরু দরবেশ বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি তোমাকে আমার ইচ্ছার কথা বলবো। তবে তোমাকে এ কোথাও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, তুমি যদি তোমার অঙ্গীকার পূরণ না করে আমাকে ধোঁকা দিতে চেষ্টা করো, তবে তুমিও আর এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে না। আমি মরতে ভয় পাই না এবং প্রয়োজন হলে কাউকে খুন করতেও হাত কাঁপবে না আমার।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘আমি তো পথেই তোমাকে বলেছি, একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্ন আমি এ পথে বের হয়েছি। আমার আশা ছিল, এখানে আমার নিজের এলাকায় এসে আমার সে উদ্দেশ্য সফল করতে পারবো। কিন্তু এখানে এসে দেখতে পাচ্ছি, সুদানী গোয়েন্দারা আমাকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। আমার উদ্দেশ্য সাধনের পরিবর্তে এখন আমি আমার জাতির বুকে ছুরি বসাচ্ছি। একান্ত বাধ্য হয়েই আমি আমার আসল উদ্দেশ্য গোপন করে রেখেছি। তুমি দেখতেই পাচ্ছো, আমার কার্যকলাপ জাতির ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দিচ্ছে। যদি আমি এমন কার্যকলাপ অব্যাহত রাখি তবে সেদিন বেশী দূরে নয়, এখানকার মুসলমানরা সবাই সুদানের গোলামীর শিকলে বাঁধা পড়ে যাবে। আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে জাতীয় স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে এতদিন ওরা যেভাবে চলছিল, সে ঐতিহ্য ওরা হারিয়ে ফেলবে চিরদিনের মত।’
‘তুমি এখন কি করতে চাও?’ আশী প্রশ্ন করলো।
‘আমি ইসহাকের গ্রামে যেতে চাই।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘সেই ইসহাক, যিনি সুদানি কারাগারে কয়েদী অবস্থায় পড়ে আছেন। যার কামরায় তুমিও ছিলে একরাত।’
‘ওই লোককে আমি জীবনে কোনোদিন ভুলতে পারবো না।’ আশী বললো, ‘তোমার মত আমি তারও একজন একনিষ্ঠ ভক্ত!’
‘আমি আগে তার বাড়ীতে যেতে চাই।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘তারপরে আমি যাবো আমার গ্রামে। আমি প্রথমে চিন্তা করেছিলাম এখান থেকেই আমি নিখোঁজ হবো। তারপর লোকদের বলবো, তারা যেন সুদানীদের হাতকড়া থেকে মুক্ত হতে চেষ্টা করে।’
‘মনে হচ্ছে তুমি নিয়ম মাফিক কোন পরিকল্পনা করোনি।’ আশী বললো, ‘আমাকে যখন কোন কাজে পাঠানো হয়, তখন তারা আমাকে নিখুঁত পরিকল্পনা দিয়ে দেয়।’
‘আমি কারাগারের কঠিন শাস্তিতে অসহ্য হয়ে বের হয়ে এসেছি।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘তখন আমার একটাই চিন্তা ছিল, কারাগার থেকে কি করে বের হওয়া যায়। এর বেশী চিন্তা করার মত অবস্থা ছিল না আমার। শুধু এতটুকুই আশা ছিল, বেরোতে পারলে একটা না একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে। এখানে এসে বুঝতে পারছি, অবস্থা বড়ই জটিল। সুদানীদের ঘেরাটোপ আমার উদ্দেশ্য সাধনকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে।’
‘এখন আমাকেও একটু চিন্তা করতে দাও।’ আশী বললো, ‘যদি আমার ঈমান দৃঢ় হয়ে থাকে, যদি আমি খোদার পথের পথিক হয়ে থাকি, তবে আল্লাহ্ আমার মাথায় এমন কোন বুদ্ধি দিয়ে দিতে পারেন, যা তোমার উদ্দেশ্য সফল করার সহায়ক হবে। দেখি আমি কোন উপায় বের করতে পারি কিনা।’
‘আমাদের এখন একজন জ্ঞানী ও বিশ্বস্ত লোকের পরামর্শ প্রয়োজন। তেমন লোকের সাক্ষাৎ পেলেই কেবল এ সমস্যার সমাধান হতে পারে।’
উমরু দরবেশের তাঁবু থেকে দু’আড়াই মাইল দূরে মিশরের একটি বাণিজ্য কাফেলা এসেছে। কাফেলায় মাত্র চারজন বণিক ও ছয়টা উট। কাফেলার সরদার এক বুড়ো। তার লম্বা পাকা দাড়ি, কিন্তু সুঠাম শরীর। চেহারায় খেলা করছে প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার ব্যক্তিত্বময় অভিব্যক্তি। তার এক চোখে সবুজ রংয়ের কাপড়ের পট্টি, যেন সে চোখটি নষ্ট হয়ে গেছে। মাত্র দু’রাত আগে এ কাফেলা সুদানের সীমান্ত পার হয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছে। সুদানে গোপনে খাদ্য পাচারকারীদেরই একটি দল এ কাফেলা। অন্য স্মাগলাররাও আছে সেখানে।
সুদানে তখন খাদ্য শস্যের চরম সংকট চলছিল। সুদান সরকার তাই এসব চোরাকারবারীদের ব্যাপারে ছিল নির্লিপ্ত। সরকার এদের দেখেও দেখতো না, জেনেও জানতো না। ফলে কোন রকম সরকারী বিধি নিষেধের ভয় ছিল না চোরাকারবারীদের। এ স্মাগলারদের অধিকাংশই ছিল মিশরের গোয়েন্দা। ফলে মিশরের সীমান্ত পুলিশও ওদের কোন রকম বাঁধা দিত না। আর সুদানের সীমান্ত রক্ষীরা তো এদের পথ নিষ্কণ্টক করার জন্যই ব্যতিব্যস্ত থাকতো। ফলে এ কাফেলা বিনা বাঁধা ও ঝামেলায় সীমান্ত পার হয়ে সুদানে প্রবেশ করলো। এ কাফেলা সুদানের কোন শহর বা কোন অঞ্চল যাচ্ছে এ নিয়ে সুদানী রক্ষীদের কোন মাথাব্যথা ছিল না। তবু সতর্কতার জন্য সুদানে প্রবেশ করেই তারা মুসলিম প্রধান পাহাড়ী অঞ্চলের পথ না ধরে অন্য দিকে চলতে লাগলো।
সুদান সরকার পাহাড়ী মুসলিম এলাকায় গুপ্তচর ছড়িয়ে রেখেছিল। যেহেতু পাহাড়ী মুসলমানরা সুদান সরকারের অনুগত নয়, তাই নতুন কোন কাফেলা এলে তাদের দিকে কড়া নজর রাখার দায়িত্ব ছিল তাদের। সরকার চাচ্ছিল, খাদ্যশস্য ও বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাবে ওখানকার জনজীবন যেন দুর্বিসহ হয়ে উঠে। এ জন্য খাদ্যবাহী চোরাকারবারীরা সে এলাকায় গেলে তাদেরকে হেনস্তা করার নির্দেশ ছিল এ গুপ্তচরদের।
সরকারের এ মনোভাব জানতো কাফেলার সরদার। তাই তিনি সারা রাত পথ চলে ভোর বেলা উটগুলোকে টিলার মধ্যে লুকিয়ে ফেলতেন। সারাদিন টিলার আড়ালে থেকে রাত হলে আবার পথে নামতেন। এভাবেই পথ চলছেন তিনি। সীমান্ত পেরিয়ে চলে এসেছেন দেশের অনেক গভীরে।
দিন শেষে আবার নেমে এলো রাতের অন্ধকার। কাফেলা যাত্রা শুরু করলো এবং রাতের দ্বিপ্রহরে গিয়ে পৌঁছল তাদের সেই আকাঙ্খিত পাহাড়ী এলাকায়। এক স্থানে তাঁবু গেড়ে কাটিয়ে দিল বাকী রাতটুকু।
ভোর রাতে কাফেলা একটি গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হলো। তখনো সূর্য উঠেনি। কাফেলার সরদার এক বাড়ীর সামনে গিয়ে থামলেন ও দরজায় করাঘাত করলেন। কিছুক্ষণ পর বাড়ীর গেট খুলে এক ব্যক্তি হাতে হারিকেন নিয়ে বাইরে এলো। কাফেলার সরদার তার কানে কানে কিছু বললেন। লোকটি তাদের খোশ আমদেদ জানিয়ে বললো, ‘আপনারা সবাই জলদি ভেতরে প্রবেশ করুন, উটগুলো আমরা হেফাজত করছি।’
চারজন বণিক সে বাড়ীতে মেহমান হিসেবে প্রবেশ করলো। বাড়ীর মালিক বাড়ীর সবাইকে জাগালেন এবং কয়েকজন পড়শীকে ডেকে পাঠালেন। পড়শীরা এলে ছয়টি উট বন্টন করে দিলেন তাদের কাছে। ওরা সেগুলো নিজেদের তত্ত্বাবধানে নিয়ে যার যার বাড়ী ফিরে গেল। কাফেলার সরদার বললেন, ‘তোমরা উটের পিঠের মাল-সামান জলদি নামিয়ে লুকিয়ে ফেলো।’
ওরা উটের পিঠের মালসামান নামিয়ে দেখলো তাঁর মধ্যে তীর ও যুদ্ধাস্ত্র ছাড়া কোন খাদ্যশস্য নেই। ওরা তীর, ধনুক, তলোয়ার, বর্শা ও খঞ্জরগুলো দ্রুত লুকিয়ে ফেললো। তিন চার ড্রাম গোলা বারুদ ও পেট্রোল ছিল, সেগুলোও লুকিয়ে রাখলো গোপন জায়গায়। তারপর ফিরে এলো আগের বাড়ীতে।
‘আমি কি এখন তোমাদের সামনে খোলামেলা কিছু কথা বলতে পারি?’ কাফেলার সরদার বললেন।
‘কোন ভয় নেই, এরা সবাই আমাদের নিজস্ব লোক!’ মেজবান বললো।
কাফেলার সরদার তাঁর লম্বা দাড়ি খুলে ফেললেন এবং চোখ থেকে সবুজ পট্টি সরিয়ে দিলেন। কৃত্রিম দাড়ি সরাতেই তাঁর আসল সুন্দর করে ছাটা দাড়ি বেরিয়ে পড়লো। একদম নতুন মানুষে পরিণত হয়ে গেলেন তিনি। মালসামান লুকিয়ে রেখে যারা এসে সমবেত হয়েছিল মেহমানের কাছে তাদের এক ব্যক্তি কাফেলার সরদারকে আপন চেহারায় দেখতে পেয়ে থতমত খেয়ে গেল। সরদার হেসে বললেন, ‘আমাকে তাহলে এতক্ষণ চিন্তে পারোনি, তাই না?’
‘আলী বিন সুফিয়ান!’ লোকটি বলে উঠলো, ‘সত্যি আমি আপনাকে এতক্ষণ চিন্তে পারিনি।’ তারপর লোকটি দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে বললো, ‘আমাদের কি পরম সৌভাগ্য যে, আপনি নিজেই এসে গেছেন। এখানকার অবস্থা অত্যন্ত খারাপ! অবস্থার নাজুকতায় আমি কোন কূলকিণারা পাচ্ছিলাম না! আপনি এসে গেছেন, এবার পরিস্থিতি সামাল দিন।’
‘হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারছিলাম, এখানকার অবস্থা দ্রুত খারাপের দিকে যাবে।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘আমি যখন সংবাদ পেলাম, সুদানের কারাগারের এক প্রহরী সুদানের সামরিক বিভাগের কমান্ডারকে হত্যা করেছে, আর জানতে পারলাম, সুদান সরকার মিশরী যুদ্ধবন্দীদের আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চাইছে, তখনই বুঝেছিলাম, এখানে ভয়ংকর কোন ষড়যন্ত্র দানা বেঁধে উঠেছে।’
এ বহুরূপী লোকটি ছিল সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান। তিনি এখন যে বাড়ীতে এসে উঠেছেন, সেটিই এখানকার মিশরীয় গোয়েন্দাদের প্রধান ঘাঁটি। বাড়ীর মালিক একজন সুদানী! সুলতান আইয়ুবীর এক বিশ্বস্ত ভক্ত। এখানকার গোয়েন্দা প্রধান একটু পর আলী বিন সুফিয়ানকে শোনাল এক নতুন খবর।
‘চারদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে, খোদার এক দূত এসেছেন, যিনি পানিতে আগুন ধরাতে পারেন।’ বাড়ীর মালিক আলী বিন সুফিয়ানকে জানালেন, ‘তিনি মানুষের মাঝে আজগুবী কথা বলে বেড়াচ্ছেন। খোদা নাকি তাঁকে মৃত লাশের মধ্য থেকে উঠিয়ে এনেছেন। তিনি লোকজনদের বলে বেড়াচ্ছেন, ‘মুসলমানদের গিয়ে বলো, তারা যেন সুদানের ভক্ত ও অনুগত হয়ে যায়। কারণ সুদানের মাটি তোমাদের মা।’
তিনি উমরু দরবেশ সম্পর্কে সব কথা আলী বিন সুফিয়ানকে জানালেন।
‘আমার এটিই বড় ভয় ছিল, শত্রুরা এবার মুসলমানদের ঈমানের ওপর আঘাত হানবে।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘সে কারণেই আমি নিজে এসেছি। খৃস্টানরা ষড়যন্ত্র ও ধ্বংসাত্মক কাজের নিপূণ ওস্তাদ আর আমাদের জাতি সব সময় হুজুগে মাতাল। খৃস্টানদের কথার যাদুতে মজে যায় ওরা। আমাদের সরল সহজ মুসলমান ভাইদের মনে সন্দেহ সৃষ্টিতে দক্ষ কারিগরের মতই কাজ করে ওরা।। আমার জানা দরকার এ ফেৎনার মূল কোথায়! উমরু দরবেশকে আমি ভাল মতই চিনি। তিনি আমাদের সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটেলিয়নের কমান্ডার ছিলেন। সুদানিদের হাতে বন্দী হয়েছিলেন তিনি। এমন কথা তাঁর মুখ থেকে বলার কথা নয়। তাকে কখনো দুর্বল ঈমানের লোক মনে হয়নি। সত্যি যদি তিনি এসে থাকেন এবং এসব কথা বলে থাকেন তাহলে বুঝতে হবে তিনি সুদানীদের ফাঁদে পা দিয়েছেন অথবা এর মধ্যে কোন রহস্য আছে। যাই হোক, আমাকে এর আসল কারণ জানতে হবে।’
এ অঞ্চলে মিশরের গোয়েন্দা ও কমান্ডোদের সংখ্যা নেহাৎ কম ছিল না। আলী বিন সুফিয়ান মেজবানকে বললেন, ‘তুমি কিছু বিশ্বস্ত গোয়েন্দা ও কমান্ডোকে ডেকে আনার ব্যবস্থা করো। এ দুষ্কর্মের সমুচিত জওয়াব দিতে হবে।’
সূর্য তখন উঠি উঠি করছে। গোয়েন্দা ও কমান্ডোদের ডেকে আনার জন্য লোকজন ছুটলো এদিক-ওদিক। তারা বেরিয়ে যাওয়ার পর পরই এক অশ্বারোহী তীর বেগে ছুটে এসে সেই বাড়ীর সামনে থামলেন। আরোহী ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে যখন ভেতরে প্রবেশ করলেন, সবাই দাঁড়িয়ে গেল তাঁকে সম্মান জানাতে। এই সেই ইমাম, যিনি উমরু দরবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। লোকেরা তাঁর কথা না শুনে তাঁকে ধাক্কা দিয়ে চলে গিয়েছিল। রাতের অন্ধকারে তাঁর ওপরই আক্রমণ চালিয়েছিল দু’ব্যক্তি। ইমাম সাহেব তাদের প্রতিহত করলে তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এ বাড়ীটি যে মিশরী গোয়েন্দাদের গোপন মিলন কেন্দ্র, এ কথা তিনি জানতেন। পাহাড় থেকে ফিরে প্রথমে তিনি মসজিদে যান, সেখান থেকে বাড়ী ফিরেই চড়ে বসেন ঘোড়ার ওপর। কালবিলম্ব না করে সাথে সাথে ঘোড়া ছুটিয়ে দেন এ গ্রামের দিকে। তিনি বুঝতে পারছিলেন, উমরু দরবেশের কার্যকলাপ ভিলকিবাজী ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি এখানে ছুটে এসেছেন সে কথা জানাতে এবং কি করে এ ভিলকিবাজী ও প্রতারণা বন্ধ করা যায় তা জানতে। তাকে দেখে সবাই উঠে দাঁড়ালে আলী বিন সুফিয়ানও উঠে দাঁড়ালেন। কারণ, ইমাম সাহেব ও আলী বিন সুফিয়ান কেউ কাউকে চিনতেন না।
ইমাম সাহেবকে আলী বিন সুফিয়ানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো। আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘ইমাম সাহেব, উমরু দরবেশ সম্পর্কে সবকিছু আমাকে খুলে বলুন। এ কি আসলেই উমরু দরবেশ, নাকি তাঁর নামে অন্য কেউ এসব করে বেড়াচ্ছে?’
তিনি তাঁকে উমরু দরবেশের কার্যকলাপ সম্পর্কে বিস্তারিত জানালেন। কিভাবে উমরু দরবেশ লোকদের সম্মোহিত করছে, ভিলকিবাজির খেলা দেখিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে এসব বলে বললেন, ‘না, এ লোক উমরু দরবেশই। আমরা তাঁর গ্রামের বাড়ীতে লোক পাঠিয়ে খবর নিয়েছি এবং তাঁকে চিনে এমন লোক দিয়ে সনাক্ত করিয়েছি।’ ইমাম সাহেব আরো বললেন, ‘যদি তার এ কার্যকলাপ ও প্রচার বন্ধ করা না হয় তবে এখানকার মুসলমানরা ধ্বংস হয়ে যাবে। এ লোক নিজেকে খোদার দূত দাবি করছে। আজ রাতে উমরু দরবেশ সামনের গ্রামে ভিলকিবাজী দেখাবে।’
ইমাম সাহেব ও উপস্থিত লোকজন এর কি বিহীত করা যায় এ নিয়ে আলোচনায় বসলেন। অধিকাংশই বললেন উমরু দরবেশকে হত্যা করা হোক।’ আলী বিন সুফিয়ান এ মতের সাথে একমত হতে পারলেন না। তিনি সবাইকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘উমরু দরবেশকে হত্যা ছাড়াই সঠিক পথে আনা যাবে। আর তাঁর মুখ দিয়েই বলানো হবে, সে যা দেখিয়েছে তা সবই ভেলকিবাজী! সব মিথ্যা! কিন্তু তাঁকে হত্যা করা হলে লোকেরা তাকে আরও বেশী সত্য বলে মনে করতে থাকবে।’ আলী বিন সুফিয়ানের সাথে অন্য যে তিনজন বণিকের বেশে এসেছিলেন তারা মিশর সেনাবাহিনীর পরীক্ষিত সৈনিক ও গোয়েন্দা। আলী বিন সুফিয়ান আবার আগের চেহারায় ফিরে গেলেন। এক চোখে সবুজ কাপড়ের পট্টি বাঁধলেন আর মুখে লাগালেন লম্বা পাকা দাড়ি। সঙ্গী তিনজনকে বণিকের বেশেই তৈরী হতে বলে লোকদের ঘোড়া সাজাতে বললেন, আরও কয়েকজনকে বললেন ঘোড়া ও উটে চড়ে তার পিছু নিতে। সবাই তৈরী হলে ইমাম সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সেদিকে যাত্রা করলেন, যেখানে উমরু দরবেশ আজ রাতে তুর পাহাড়ের নূর দেখাবে বলে প্রচার করেছে।
উমরু দরবেশ পরদিন সকালে সূর্য উঠার সাথে সাথেই আশীকে নিয়ে নতুন ঠিকানায় যাত্রা করলেন। তাঁর সঙ্গী-সাথীরা সে এলাকায় আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। তারা হুজুরের আগমন বার্তা প্রচার করছিল জোরেশোরে। আশী ছাড়াও তাঁর হেফাজতের জন্য তাঁর সঙ্গে চললো সেই তিন লোক, যারা তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল।
উমরু দরবেশের আগমন বার্তা দূর-দূরান্ত পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। পথে তিনি এক গ্রামের পাশে এসে কিছুক্ষণের জন্য যাত্রা বিরতি করলেন এবং সেখানে তাঁবু টানিয়া বিশ্রাম নিলেন। তারপর দুপুরের পর পরই নির্ধারিত গ্রামে পৌঁছে উপযুক্ত স্থান বেছে নিয়ে তাঁবু খাটিয়ে রাতের প্রদর্শনীর জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন। আশীও প্রস্তুত হয়ে গেল।
তাঁবুর সামনে দু’টি মশাল জ্বালিয়ে রাখা হলো। উমরু দরবেশের সাথীরা আশপাশের গ্রামে গিয়ে খোদার দূতের মোজেযার কাহিনী প্রচার করে তিনি যে সেখানে আস্তানা গেড়েছেন সে কথা বলে বেড়াতে লাগলো। লোকজন খোদার দুতকে দেখার জন্য ছুটলো তাঁর আস্তানার দিকে। যারা গতকাল উমরু দরবেশের কেরামতি দেখেছিল তারাও দুরের পথ অতিক্রম করে সেখানে এস পৌছুলো।
সন্ধ্যা হতে তখনো বেশ বাকী। এখনো আছরের আজান হয়নি, এরই মধ্যে লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে তাঁবুর সামনের খোলা প্রান্তর। আশী তাঁর সেই চমকপ্রদ পোষাক পড়ে পরী সেজে বেরিয়ে এলো তাঁবুর বাইরে। আগের দিনের মতই শুরু হলো তাদের অভিনয়। উমরু দরবেশ দুই মশালের মাঝখানে একটি ছোট জায়নামাজ বিছিয়ে সেখানে গিয়ে বসলেন। তাঁর সামনে পড়ে আছে কিছু শুকনো কাপড়, যেমন পড়েছিল গত কালের প্রদর্শনীর সময়। এক ব্যক্তি ঠিক আগের মতই প্রশ্ন করলো, ‘আপনার কথা আমরা কেন বিশ্বাস করবো? আপনি কি আমাদের কোন মোজেযা দেখাতে পারবেন?’
উমরু দরবেশও আগের মতই অভিনয়ের স্বরে বলতে লাগলেন, কারো কাছে যদি কোন পানির পাত্র থাকে তবে সে যেন পানি দিয়ে তাঁর সামনে পড়ে থাকা কাপড়গুলো ভিজিয়ে দেয়। ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে উমরু দরবেশের খেলা দেখতে লাগলেন আলী বিন সুফিয়ান ও তার সঙ্গীরা। তিনি উমরু দরবেশকে দেখেই চিনতে পারলেন। মিশরের সেনাবাহিনীর কোন ব্যাটেলিয়নের কমান্ডারকে চিনতে না আলী বিন সুফিয়ান, তা তো হয় না! উমরু দরবেশকে চিনতে পেরে তিনি যে কেবল তাজ্জব হলেন তাই নয়, ব্যথিতও হলেন, শেষ পর্যন্ত উমরু দরবেশও বেঈমানের তালিকায় নাম লেখালো!
আলী বিন সুফিয়ানকে আগেই জানানো হয়েছিল, উমরু দরবেশ পানিতে আগুন জ্বালাতে পারেন। আলী বিন সুফিয়ান অভিজ্ঞ এবং দূরদর্শী মানুষ। তিনি জানেন, পানিতে কখনও আগুন জ্বালানো সম্ভব নয়। মনের সন্দেহ দূর করার জন্য তিনি ছোট একটি মশকে করে কিছু পানি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। উমরু দরবেশ যার কাছে পানি আছে তাঁকে কাপড়ের ওপর পানি ঢালতে আহবান জানানোর সঙ্গে সঙ্গে এক লোক দ্রুত অগ্রসর হয়ে কাপড়ের ওপর পানি ঢেলে দিল।
আলী বিন সুফিয়ানও সঙ্গে সঙ্গে সামনে অগ্রসর হয়ে মাটি থেকে একটি মশাল তুলে নিয়ে উঁচু করে ধরলেন এবং উপস্থিত লোকদের বললেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকে যে কোন একজন সামনে এসো।’ আলী বিন সুফিয়ানের তিন সঙ্গীর একজন সামনে এসে দাঁড়ালো। তিনি মশাল তার হাতে দিয়ে বললেন, ‘এ কাপড়ের ওপর মশালের শিখা স্পর্শ করো।’ লোকটি থতমত খেয়ে প্রথমে আলীর দিকে, তারপর উমরু দরবেশের দিকে এবং সবশেষে জনতার দিকে ফিরে তাকালো। আলী বিন সুফিয়ান দর্শক জনতাকে উদ্দেশ্য করে আবারও বললেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকেও যে কোন লোক এ ভেজা কাপড়ে আগুন ধরাতে পারবে।’ আলী মশাল ধরা লোকটির দিকে আবার ফিরে তাকাতেই সে মশালের শিখা কাপড়ের কাছে নিয়ে গেল। দপ করে কাপড়ে জ্বলে উঠলো আগুন। উমরু দরবেশের দলের এক লোক তেড়ে এলো আলীর দিকে। বলে উঠলো, ‘তুমি কোথাকার জাদুকর হে! তুমি জলদি সরে যাও এখান থেকে, নইলে খোদার দূতের ইশারায় তোমার ওপর গজব নেমে আসবে।’
উমরু দরবেশ চুপ করে থেকে বিস্মিত চোখে আলী বিন সুফিয়ানকে দেখছিলেন। আলী বিন সুফিয়ান তাঁর কোমরে জড়ানো কাপড় খুলে উমরু দরবেশের সামনে রেখে তাতে পানি ঢেলে বললেন, ‘যদি তুমি খোদার দূত হও তবে এ কাপড়ে আগুন ধরাও।’ তিনি মশাল উমরু দরবেশের সামনে এগিয়ে দিলেন। কিন্তু উমরু দরবেশ নির্বাক এবং নিশ্চল, যেন তিনি আলী বিন সুফিয়ানের কথা শুনতেই পাননি অথবা শুনলেও তাঁর কথা তিনি কিছুই বুঝেননি এমন একটি ভাব নিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে।
জনতার মধ্যে শুরু হলো পরস্পরের কানাকানি ও ফিসফিসানি। আলী বিন সুফিয়ানের লোকেরা বলতে লাগলো, ‘এ ব্যাটা নিশ্চয় ভন্ডপীর! নইলে এখন আগুন ধরাচ্ছে না কেন?’ ওদিকে উমরু দরবেশের সঙ্গীরাও তৎপর হয়ে উঠলো। তারা বলতে লাগলো, ‘হুজুরের ধ্যানে বিঘ্ন ঘটিয়েছে বলে নাখোশ হয়েছেন হুজুর। হুজুরের সাথে যে লোক বেয়াদবী করেছে তাঁর বিচার না করলে হুজুরের ইশারায় এখানে গজব নেমে আসবে। ধরো, পাকড়াও করো সে বেআদবকে।’ একটা বিশৃঙ্খলা ও হট্টগোল বেঁধে গেল সেখানে। প্রত্যেকেই কোন না কোন পক্ষ অবলম্বন করলো। কেউ এ দলে তো তার সঙ্গী চলে গেল অন্য দলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জনতা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল।
দূর থেকেও শোনা যাচ্ছিল ইমাম সাহেবের আওয়াজ। তিনি উচ্চ কণ্ঠে বলছিলেন, ‘এ লোক দাগাবাজ, প্রতারক! তোমরা এ ভণ্ড দরবেশকে পাকড়াও করো, দেখবে তার সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেছে।’
উভয় পক্ষের মূল বাদানুবাদকারীরাই ছিল গোয়েন্দা বিভাগের লোক। ঝগড়া এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌছুলো যে , তা এক যুদ্ধের রূপ নিল। জনগণ যখন এ বাক-বিতণ্ডায় লিপ্ত তখন আলী বিন সুফিয়ান উমরু দরবেশের সামনে গিয়ে বললেন, ‘উমরু দরবেশ!’ তিনি খুব আস্তে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঈমান বিক্রি করে কত মূল্য পাওয়া গেল?’
‘তুমি কে?’ উমরু দরবেশ জিজ্ঞেস করলেন।
‘অনেক দূর থেকে এসেছি বন্ধু!’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘তোমার সুনাম ও খ্যাতি সীমান্তের ওপার থেকে শুনেছি, তাই তোমাকে দেখতে এসেছি।’
উমরু দরবেশ সাবধানে এদিক-ওদিক তাকালেন ও অস্বস্তিবোধ করতে লাগলেন। শেষে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘সত্যি কথা বলার আগে জানতে চাই, তোমাকে কতটুকু বিশ্বাস করতে পারি?’
‘আমার দাড়ির উপর হাত দাও।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন ‘এটা কৃত্রিম দাড়ি। ঈমানের যে মূল্য তুমি পেয়েছো, তাঁর দিগুণ মূল্য পাবে আমার কাছে। এ ভেলকিবাজী ও তামাশা বন্ধ করো। আমি তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবো।’
‘আমি তো খুনীদের বেষ্টনীর মধ্যে বন্দি আছি।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘আমার নিজস্ব বলে কিছু নেই। খুনিদের ইশারায় আমি বাঁদর নাচ নাচছি শুধু।’
‘খুনি এখন দু’পক্ষেই। আমার কথা যদি না শোনো তাহলেও তুমি মারা যাবে।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘তুমি জানো না এখানে আমার কত লোক আছে। তোমার সঙ্গে কতজন আছে?’
‘আমার জানা নেই।’ জবাব দিয়েই উমরু দরবেশ প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার নাম কি?’
‘এখন বলা যাবে না বন্ধু, সময় হলে জানতে পারবে।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘আমি যে প্রশ্ন করি তাঁর উত্তর দাও! তুরের তাজাল্লিটা কি? স্পষ্ট করে বলো, তোমার নিরাপত্তার জিম্মা আমি নিচ্ছি।’
‘যখন তুমি উঠবে তখন তোমার ডান দিকে তাকাবে।’ উমরু দরবেশ বললেন, উঁচু পাহাড়ের পাশে একটি উঁচু সমতল উপত্যকা, সেখানে একটি বিরাট গাছ আছে। সন্ধ্যার আগেই সেখানে তোমার লোক লুকিয়ে রাখবে, যেমন তুমি পানিতে আগুন লাগার রহস্য জানতে পেরেছ, তুরের তাজাল্লির খবরও জানতে পারবে। কিন্তু আমাকে এ খেল দেখানোর অভিনয় করতে দিতে হবে, নতুবা তুমি কিছুই জানতে পারবে না। তোমার দায়িত্ব সেখান থেকে যেন কোন আগুনের শিখা না উঠে। আমার নিখোঁজ হওয়া ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা তো তুমি আগেই নিয়েছ। এখন আমার ভেলকিবাজী হবে, এখান থেকে নিখোঁজ হওয়া। কিন্তু ইসহাককে সুদানের কারাগার থেকে মুক্ত করার দায়িত্ব নিয়ে আমি কারাগার থেকে বের হয়ে এসেছি, তার কি হবে?’
‘সেটাও আমি দেখবো।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।
‘ঠিক আছে। এখন তাহলে উঠো আর ঘোষণা করে দাও, রাতে তুর পাহাড়ের তাজাল্লি দেখানো হবে।’
আলী বিন সুফিয়ানের পরিবর্তে যদি অন্য কেউ হতেন তবে তিনি উমরু দরবেশের এ অস্পষ্ট কথা হয়তো বুঝতেই পারতেন না। কিন্তু আলী বিন সুফিয়ান ছিলেন এ ময়দানের এক পাকা খেলোয়াড়। তিনি ইশারাতেই সব বুঝে নিতে পারতেন।
আলী বিন সুফিয়ান উঠে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, ‘তোমরা বিবাদ থামাও। খোদার এ মনোনীত ব্যক্তি বলছেন, তাঁর কাছে অলৌকিক ক্ষমতা আছে। আমি তাঁর ধ্যান নষ্ট না করলে তিনি ঠিকই ভেজা কাপড়ে আগুন ধরাতে পারতেন। তিনি ওয়াদা করেছেন, রাতে তিনি তুর পাহাড়ের তাজাল্লি দেখাবেন। আমরা দেখতে চাই আসলেই তিনি খোদার দূত কি না। তাই আমি চাই, এখন আর নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি না করে আমরা রাতের জন্য অপেক্ষা করি। যদি তিনি সত্যি তা দেখাতে পারেন আমরা তাঁর সব কথা মেনে নেবো। আর যদি না পারেন তবে বুঝতে হবে তিনি ভণ্ড, প্রতারক। তাহলে আমরা তাকে ছাড়বো না। আমার কথা তোমরা বুঝতে পারছো?’
লোকজন হ্যাঁ সূচক জবাব দিলে তিনি বললেন, ‘তাহলে এখন সবাই বাড়ী ফিরে যাও। সন্ধ্যার পর আমরা তাঁর কেরামতি দেখতে আসবো।’
আলী বিন সুফিয়ান সেখান থেকে উঠে চলে গেলেন। উমরু দরবেশের সঙ্গীরা এসে ঘিরে ধরলো তাঁকে। প্রশ্ন করলো, ‘লোকটির সঙ্গে আপনার কি কথা হলো?’
তিনি উচ্চ স্বরে বললেন, ‘এ লোকের মনে আমার কামেলিয়াত সম্পর্কে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। আমি তার সন্দেহ দূর করে দিয়েছি। বলেছি, রাতে তুর পাহাড়ের নূর দেখো। যদি দেখাতে না পারি তখন আমাকে অবিশ্বাস করার অধিকার তোমার রইলো। কিন্তু দেখাতে পারলে তোমাকে আমার মুরীদ হতে হবে। লোকটি আমার কথায় সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেছে।’
‘কিন্তু এ ব্যক্তি কে?’ একজন জিজ্ঞেস করলো, ‘এ লোক তো আমাদের ভেজা কাপড়ে আগুন জ্বালানোর রহস্য বের করে ফেলেছে!’
‘ও নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।’ উমরু দরবেশ হেসে বললেন, ‘আজ রাতেই আমি তাঁর সন্দেহের সমাধান করে দেবো।’
‘এ লোক রাতে এলে তাঁকে হত্যা করে ফেলতে হবে। এ রকম ধুরন্ধর লোককে বাঁচিয়ে রাখলে যে কোন সময় আমাদের ফেঁসে যাওয়ার ভয় আছে।’ বললো আরেকজন।
‘না! এখনই তাকে খুন করার দরকার নেই! অযথা খুনোখুনি আমাদের মিশনে ভণ্ডুল করে দিতে পারে।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘আগে তাঁকে বাগে আনার চেষ্টা করি। দেখা যাক রাতে তাঁকে গোমরাহ করা যায় কি না! আর যদি তাতেও কাজ না হয় তখন তাঁকে তাঁবুতে ডেকে আনতে হবে। সুযোগ বুঝে তোমরা তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে।’
তৃতীয় এক লোক বললো, ‘এখানে বসে কথা বলে সময় নষ্ট না করে তাঁর পিছু নেয়া দরকার! এ লোক ভয়ংকর, তাকে চোখে চোখে রাখতে হবে।’
অপর জন তার কথায় সায় দিয়ে বললো, ‘তুমি ঠিক বলেছো, চলো।’
তারা দু’জন সেখান থেকে উঠে গমনরত লোকদের দলে মিশে গেল। আলী বিন সুফিয়ানকে খুজলো তন্ন তন্ন করে, কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পেল না। লোকজনকে জিজ্ঞেস করলো, ‘লম্বা দাড়িওয়ালা এক চোখে সবুজ পট্টি বাঁধা লোকটাকে কেউ দেখেছো? ওই লোক কোথায় বলতে পারো কেউ?’ কিন্তু কেউ বলতে পারলো না, তিনি কোথায়? আলী বিন সুফিয়ান ততক্ষণে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে সেখানে থেকে বহু দূরে সরে পড়েছেন।
তাঁবুর মধ্যে এখন শুধু আশী ও উমরু দরবেশ। আশী তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এ লোকটি কে? তোমার সাথে এমন ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলছিলেন, মনে হয় তোমার সাথে আগে থেকেই পরিচয় আছে? তিনি গেলেনই বা কোথায়?’
‘শোনো আশী!’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘আজ রাতে একটা কিছু ঘটবে। আমি বলতে পারছি না কি ঘটবে। কারণ আমি লোকটাকে চিনতে পারিনি। পরিচয় জিজ্ঞেস করার পরও তিনি তাঁর পরিচয় দিলেন না। কিন্তু এ লোক কোন সাধারণ ব্যক্তি নয়। জানি না আজ রাতে আমি নিখোঁজ হবো, নাকি অপঘাতে মারা যাবো। আজই তোমার পরীক্ষার দিন। আজ রাতে তোমাকে প্রমাণ করতে হবে, তুমি প্রকৃতই মুসলিম বাপ-মায়ের সন্তান। তাঁদেরই রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে তোমার শিরায়। যদি তুমি আমাকে ধোঁকা দিতে চেষ্টা করো, তবে তুমি নির্মম মৃত্যুর শিকার হবে।’
‘আমার যা বুঝার বুঝে নিয়েছি। এখন বলো তোমাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি।’ আশী বললো, ‘আমি তোমার জন্য মরতেও প্রস্তুত। কিন্তু তোমার উদ্দেশ্য সফল না হলে মরেও যে আমি শান্তি পাবো না!’
‘কি করতে হবে আমি নিজেও জানি না। তবে একটা কাজ তোমাকে করতেই হবে।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘কখনও দলের লোকদের ভয়-ভীতি ও চাপের মুখে নতি স্বীকার করবে না। চেষ্টা করবে তাদের মনের খবর নিতে এবং সময়ের আগেই আমাকে তা জানিয়ে দিতে। কারণ আমি জানি না, আজ রাতে কি হবে। শুধু জানি, আজ আমাদের সর্বোচ্চ সতর্কতা প্রয়োজন, প্রয়োজন যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকা।’
‘তুমি আমাকে কয়েকবারই বলেছো, আমার প্রতি তোমার বিশ্বাস নেই।’ আশী বললো, ‘কিন্তু আমি তোমাকে একটিবারও বলিনি, তোমার প্রতি আমার ভরসা ও আস্থা নেই। তুমি এ চক্রের হাত থেকে মুক্ত হয়ে গেলে আমাকে কি তোমার সাথে নেবে?’
‘তুমি ফিরে যেতে চাইলে আমি বাঁধা দেবো না, তুমিই বলো, তুমি কি করতে চাও? তুমি কি ফিরে যেতে চাও?’
‘না! কখনো না।’ আশী বেদনাবিধুর কণ্ঠে বললো, ‘তার চেয়ে আমি মৃত্যুই শ্রেয় মনে করবো।’
‘আশী, তুমি তো সুখের পায়রা!’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘কষ্টকর জীবনের সাথে তোমার পরিচয় হয়নি। যখন থেকে বুদ্ধি হয়েছে তখন থেকেই তুমি দেখে আসছো রঙ তামাশার জীবন। আমি ভাবতেই পারি না, তুমি আমার সাথে যাবে! আমার সাথে গেলে তোমার ভবিষ্যৎ কি হবে ভেবে দেখেছো? তুমি অবশ্যই আমার মত ভয়ংকর জীবন পছন্দ করবে না! কারণ এ জীবনে আছে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর হাতছানি। তবে আমি তোমাকে কায়রো নিয়ে যেতে পারি। সেখানে তোমার সম্পর্কে চিন্তা করার অনেক উন্নত মাথা রয়েছে।’
‘তাঁর মানে তুমি আমাকে তোমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাও?’ আশী প্রশ্ন করলো, ‘তবে কি তুমি আমাকে তোমার সাথে রাখবে না?’
‘না, এ শর্তে তোমাকে আমি সঙ্গে নিতে রাজী নই।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘তাতে লোকে বলবে, তোমাকে পাওয়ার লোভে আমি সুদানীদের টোপ গিলেছি। ঘরে আমার স্ত্রী আছে। তার হোক নষ্ট করে তোমাকে আমি স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারবো না। আশী, আমি সৈনিক! আমার ঠিকানা যুদ্ধের ময়দান! আমি আমার স্ত্রীর মুখ দেখি না প্রায় তিন বছর। কোন ভরসায় আমি তোমাকে সঙ্গে নেব! যে তীর আমার বুকে বিদ্ধ হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে, তোমার ভালবাসা বা দোয়া আমাকে সে তীরের আঘাত থেকে বাঁচাতে পারবে না। আমার মত লোকের সঙ্গী হতে চাইলে তুমি নিরাশ হবে। এমন ভুল তুমি করো না।’
‘আমি আমার এ ঘৃণিত ও লাঞ্ছিত জীবন থেকে মুক্তি চাই।’ আশী বললো, ‘এ জন্য তোমার সাহায্যের প্রয়োজন! তার পরে কি হয় সেটা পরে দেখা যাবে। তবে এটুকু কথা দিতে পারি, আমি তোমার চলার পথের প্রতিবন্ধক হবো না।’
‘তুমি এ চক্রের হাত থেকে বাঁচতে চাইলে আমার সাহায্য ও সহযোগিতা থাকবে তোমার সাথে।’
আলী বিন সুফিয়ানকে কথাও খুঁজে না পেয়ে তাঁবুতে ফিরে চললো সুদানী সেই গোয়েন্দা দু’জন। পথে অপর সঙ্গীর সাথে দেখা হতেই সে জানতে চাইল, ‘পেলে সেই কানা বুড়োকে?’
‘না, ভাই।’ একজন আক্ষেপের সুরে বললো, ‘বলতো দেখি কি অবাক কাণ্ড! নিমিষে লোকটি হাওয়া হয়ে গেল?’
‘সত্যি অবাক ব্যাপার, আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে শেষ পর্যন্ত লোকটি কোথায় লুকিয়ে পড়লো বলতো?’
উমরু দরবেশের তাঁবু থেকে বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আলী বিন সুফিয়ানকে নিয়ে কথা বলছিল ওরা। একজন বললো, ‘এমনও তো হতে পারে, উমরু দরবেশ তার মন জয় করার পরিবর্তে নিজের মনটাই তাকে দিয়ে বসে আছে! এখন আমাদের আরও বেশী সাবধান হতে হবে। উমরু দরবেশকে চোখে চোখে রাখার জন্য আমাদের তো আগেই সতর্ক করা হয়েছে।’
‘লম্বা দাড়িওয়ালা লোকটি পানিতে আগুন ধরানোর গোপন রহস্য জানার পরও কেন উমরু দরবেশকে ছেড়ে দিল এটা একটা গুরুতর প্রশ্ন।’ একজন বললো, ‘উমরু দরবেশ তার উপর প্রভাব ফেললো, নাকি সে লোকই বশ করে গেল উমরু দরবেশকে, বিষয়টি জানতে হবে আমাদের।’
‘এটা জানা তেমন কঠিন হবে না। আশী আছে না দরবেশের সাথে! এমন ঔষধ থাকতে আর ভাবনা কি?’ তৃতীয় ব্যক্তি বললো।
‘আশীকে নিয়ে এত উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। এ মেয়েটা যে কি করছে কিছুই বুঝতে পারছি না। সে তো উমরু দরবেশের মনের কোন অবস্থাই আমাদের বলছে না!’
‘তুমি কি বলতে চাও উমরু দরবেশ কোন ষড়যন্ত্র করলে মেয়েটা তারই সহযোগী হয়ে যাবে?’
‘তা বলছি না, তবে এমনটি হতেই বা কতক্ষণ?’
‘আশী যদি সত্যিই ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়ে তবে তাকেও হত্যা করার হুকুম আছে। মেয়েটি যদি নিজেই তার মরণ ডেকে আনে তবে আমাদের কি করার আছে?’ অন্য একজন বললো।
‘কি বললে!’ এক গোয়েন্দা বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বললো, ‘তুমি এমন মহামূল্য জিনিস নষ্ট করে ফেলবে?’ সে আরও বললো, ‘না, তাকে বরং উঠিয়ে নিয়ে যাবো, আর কোন ধনীর দুলালের কাছে উপযুক্ত মূল্যে বিক্রি করে দেবো। এমন হীরা হাতে পেলে কে তা পায়ে ঠেলে!’
‘এটা কি ঠিক হবে?’
‘কেন, সুদান গিয়ে রিপোর্ট করলেই হবে, ষড়যন্ত্রের দায়ে আশীকে হত্যা করা হয়েছে এবং তাকে সেখানেই দাফন করা হয়েছে।’
তারা তিন জনেই এক অন্যের দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকালো, যেন তারা ঐকমতে পৌঁছেছে। তাদের একজন বললো, ‘আজ রাতে আবার তুরের তাজাল্লি দেখাতে হবে। তখনই বুঝা যাবে, উমরু দরবেশের মনের মতলবটা কি? রাতে আমাদের একজন আশীর কাছে পাহারায় থাকবে। এমন যেন না হয়, আমাদের সামান্য ভুলের কারণে মেয়েটা শেষ পর্যন্ত হাতছাড়া হয়ে না যায়।’
তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো, কে আশীর কাছে থাকবে আর কে কে যাবে তাজাল্লি দেখানোর কাজে। সিদ্ধান্ত হয়ে যেতেই তারা পা বাড়ালো তাঁবুর দিকে, যেখানে আশী ও উমরু দরবেশ একান্তে বসে নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করছিল।
‘চারজনই যথেষ্ট।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘আমি থাকবো উমরু দরবেশের কাছে। তোমরা তার তিন সহযোগীর কাছে। তার সহযোগীদের নিশ্চয়ই তোমরা চিনে রেখেছো?’
‘হ্যাঁ, যে তিনজন উমরু দরবেশের পক্ষে কথা বলছিল তাদের আমরা ভাল করেই চিনি। তারা এ অঞ্চলেরই মুসলমান।’
‘এ এলাকায় ওরাই সুদানীদের চর। উমরু দরবেশ ওদের দিকে ইঙ্গিত করেই বলেছেন, তিনি খুনীদের বেষ্টনীর মধ্যে পড়ে আছেন। ওদেরকে সবসময় চোখে চোখে রাখবে। প্রয়োজন হলে শেষ করে দেবে, কিন্তু জীবিত ধরে রাখাই উত্তম!’
আলী বিন সুফিয়ান ইমাম সাহেবকে নিয়ে তার মসজিদে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে বসেই নির্দেশ দিচ্ছিলেন সহকর্মীদের। পাশে বসেছিলেন ইমাম সাহেব। আছরের নামাজের অজু করবেন আলী বিন সুফিয়ান। তিনি তাঁর লম্বা দাড়ি ও চোখের পট্টি খুলে ফেললেন। অজুর জন্য উঠতে উঠতে বললেন, ‘আমার যে সন্দেহ ছিল তা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। আশা করি রাতেও আমরা সফল হবো।’
সূর্য ডোবার একটু আগে উমরু দরবেশের নির্দেশিত পাহাড়ে একজন লোককে আরোহণ করতে দেখা গেল। কেউ যেন তাকে দেখে না ফেলে সে জন্য সে অতি সাবধানে পাহাড়ে উঠছিল। অন্য দিক থেকেও সে পাহাড়ে উঠছিল আরও দু’ জন লোক। তারাও থেমে থেমে অতি সঙ্গোপনে উপরে উঠছিল। প্রথম লোকটিকে অনুসরণ করে তার পিছু পিছু উঠছিল আরো এক লোক। প্রথম লোকটি উপরে উঠে হামাগুড়ি দিয়ে একটি বড় গাছের কাছে পৌঁছলো। এদিক-ওদিক তাকিয়ে সন্তর্পণে গাছের ওপর চড়ে বসলো লোকটি। অন্য দিক থেকে যে দু’জন উঠছিল তারা একটা মস্ত বড় পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। পাথরটি গাছ থেকে বেশী দূরে ছিল না। চতুর্থ ব্যক্তিও উপরে উঠে নিরাপদ জায়গা দেখে গা ঢাকা দিল। গাছের ওপর চড়ে বসা লোকটি গাছের উপরের একটি মোটা ডালে আরাম করে বসলো। গাছের ঘন পাতার কারণে বাইরে থেকে তাকে দেখা যাচ্ছিল না। আরাম করে বসার পর লোকটি আস্তে করে পাখির মত শীষ দিল। অন্য তিনজনও প্রতিউত্তরে সে ডাকের নকল করে তাকে জানিয়ে দিল তাদের অবস্থান।
সূর্য পাহাড়ের আড়ালে নেমে গেছে। অন্ধকার হয়ে আসছে পৃথিবী। দেখতে দেখতে নেমে এলো রাত।
সন্ধ্যার পরপরই আরও তিনজন লোক একসাথে পাহাড়ের উপরে গিয়ে উঠলো। তাদের হাতে আগুন জ্বালানোর তেলের হাড়ি। কোমরে খঞ্জর।
ততক্ষণে অন্ধকার আরও ঘনীভূত হয়ে এসেছে। অন্ধকারের মধ্যেই পাহাড়ের চুড়ায় গিয়ে পৌছুলো লোক তিনজন। এখানে এ রাতের অন্ধকারে তাদের জন্য কোন বিপদ লুকিয়ে থাকতে পারে এমন কোন সন্দেহও কারো মনে জাগলো না। লুকানো চারজন নিজ নিজ জায়গা থেকেও তাদের কথা স্পষ্ট শুনতে পেলো।
লোক তিনজন তাকিয়ে আছে উমরু দরবেশের ক্যাম্পের দিকে। সেখান থেকে দূরে নিচে অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে উমরু দরবেশের ক্যাম্প। তাঁবুর সামনে বাইরে দু’টো জ্বলন্ত মশাল। মশালের আলোয় পাশের খানিকটা জায়গা আলোকিত হয়ে আছে।
‘খোদার দূত তৈরি হয়ে গেছেন।’ তিনজনের একজন বললো, ‘জিনিসপত্র নিয়ে তৈরি হয়ে যাও।’
ওরা তেলের ভাণ্ড একটি সমতল পাথরের ওপর রেখে সাথের পোটলা খুলে জিনিসপত্র গুছাতে লাগলো। একজন বললো, ‘আজ কেন যেন মনটা আমার অকারণে কাঁপছে। কেন যেন মনে হচ্ছে, আজ কোন অঘটন ঘটতে পারে। পানিতে আগুন লাগানোর ব্যাপারটায় ঝামেলা বাঁধার পর থেকেই মনটা আমার খুঁত খুঁত করছে।’
‘আমারও মনটায় খোঁচা দিচ্ছে অহেতুক ভয় ও সন্দেহ। চোখে সবুজ পট্টি বাঁধা লম্বা দাড়িওয়ালা লোকটার কথা কিছুতেই তাড়াতে পারছি না মন থেকে। কেন যেন মনে হচ্ছে লোকটা ভয়ংকর।’
অন্য লোকটি বললো, ‘চিন্তা করো না তো! আমরা তুরের তাজাল্লি দেখিয়ে সবার সব সন্দেহ দূর করে দেবো। এ নূর দেখলে লোকেরা ওই লোকটাকে আর পাত্তাই দেবে, না। চাই কি সে লোকটাও উমরু দরবেশের ভক্ত হয়ে যেতে পারে। আর যদি সে লোক বশে না আসে তাতেই বা কি আসে যায়। মাত্র একজন লোক আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এখন ওসব চিন্তা বাদ দিয়ে যার যার কাছে হাত লাগাও। সময় ঘনিয়ে আসছে।’
তাদের একজন হাড়ির মুখ খুললো। হাড়ির তেল ঢেলে দিল শক্ত পাথরের ওপর। পাথরের ওপর দিয়ে সে তেল অনেক দূর গড়িয়ে গেল, কারণ পাথর তেল শোষণ করতে পারেনি। তেল গড়িয়ে যেখানে গিয়ে শেষ হলো সেখান থেকে একটু দূরে একজন একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে দাঁড়াল। মোমবাতিটি একটি চামড়ার কৌটার ভেতর, যাতে তাঁর আলো বাইরে থেকে দেখা না যায় এবং বাতাসে তা না নিভে। আশেপাশে কোন ঘাস বা লতাপাতা নেই, সবটাই নিরেট পাথর। লোকটি মোমবাতি হাতে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। পাশের জনকে বললো, ‘ভাল করে খেয়াল রেখো। আজকে মশাল ডাইনে বামে পাঁচবার ঘুরানোর পর মোমবাতি তেলের উপর ফেলতে হবে।’
এ বিশাল পাথরটি ছিল গাছের একবারে নিচেই। খোলা জায়গার চেয়ে গাছের নিচে অন্ধকার ছিল বেশ ঘন। লোকগুলো দাঁড়িয়েছিল সে ঘন অন্ধকারের মধ্যে। কৌটার ভেতর থাকায় মোমবাতির আলো সামান্য দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে না। পাথরের আড়ালে লুকিয়ে থাকা তিনজন শুধু তাদের কথাই শুনতে পাচ্ছে, কিন্তু ওপর যে বসে আছে সে ওদের সবাইকে দেখতে পাচ্ছিল।
তিনজনই নির্ণিমেষ নয়নে তাকিয়ে আছে উমরু দরবেশের তাঁবুর দিকে। গাছের উপর বসা লোকটি পাখির মত শীষ দিল। তিন দিক থেকে ডেকে উঠল আরো তিনটি পাখী। পাখীর ডাক শুনেও লোকগুলোর মনে কোন ভাবান্তর এলো না, তারা আগের মতই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
সহসা গাছের ওপর বসা লোকটি একজনের ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। হুমড়ি খেয়ে নিচে পড়ে গেল লোকটি। অন্য দু’জন ভাবলো সঙ্গীকে ভুতে ধরেছে। ওরা ভুতের ভয়ে ছুটলো সেখান থেকে। কিন্তু দশ কদমও পার হয়নি, পাথরের আড়াল থেকে বের হয়ে এলো আরও দুই ভূত। দাঁড়াল একেবারে ওদের দু’জনের সামনে। ভয় ও আতঙ্কে চোখ কপালে উঠে গেল পলায়নপর দুই বীরের। থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো ওরা। ভূত দু’জন ওদেরকে ঝাপটে ধরলো এবং ক্ষিপ্র হাতে বেঁধে ফেললো তাদের। তাদের সাথে খঞ্জর ছিল কিন্তু তারা খঞ্জর বের করার সুযোগই পেল না।
গাছের ওপর থেকে যার ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়েছিল সে লোকটি কেবল স্বাস্থ্যবান ও শক্তিশালী ছিল না, সাহসেও সে ছিল সঙ্গীদের চেয়ে ব্যতিক্রম। ভুত-প্রেতে তাঁর কোন বিশ্বাস ছিল না। সে ঠিকই বুঝেছিল, দুপুরের মত এখানেও কোন দুশমন ওঁৎ পেতে ছিল, যে তার ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়েছে। সে কাঁধের ওপর থেকে এক ঝটকায় ফেলে দিল আক্রমণকারীকে।
আলী বিন সুফিয়ানের নির্দেশ ছিল, ‘পারলে ওদের জীবিত ধরবে। কিন্তু অবস্থা বেগতিক দেখলে হত্যা করতে দ্বিধা করবে না।’
লোকটি মুক্ত হয়েই সঙ্গে সঙ্গে ছুরি বের করলো, ‘কট’ করে আওয়াজ হলো ছুরি খোলার। বাধ্য হয়ে নিজের হাতের খঞ্জর তার বুকে আমূল বসিয়ে দিলো সে। সঙ্গে সঙ্গে মারা গেল লোকটি। একটু পর। আলীর সঙ্গীরা দু’জনকে রশি দিয়ে বেঁধে খোলা আকাশের নিচে পাথরের ওপর বসে অপেক্ষা করতে লাগলো আলী বিন সুফিয়ানের জন্য।
উমরু দরবেশের তাঁবুর সামনে লোকজন জমা হয়ে অপেক্ষা করছিল নূরের তাজাল্লি দেখার জন্য। দর্শকের মধ্যে আছেন আলী বিন সুফিয়ান। তার সাথে মিশরের একদল কমান্ডো গোয়েন্দা। সাধারণ বেশে গ্রামের লোকের সাথে মিশে গিয়েছিল ওরা। এদের মধ্যে কিছু কমান্ডো ছিল অশ্বারোহী, তাদের কাছে ভারী অস্ত্রও আছে।
জনতার মধ্যে লুকিয়ে ছিল উমরু দরবেশের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সুদানী গোয়েন্দারাও। কিন্তু তাদের সংখ্যা পাঁচ-ছয় জনের বেশী ছিল না। আলী বিন সুফিয়ান তাদের চিনে রেখেছিলেন। কিন্তু প্রতিপক্ষ আলী বিন সুফিয়ান ও ইমাম সাহেবকে ছাড়া আর কাউকে তাদের শত্রু বলে সনাক্ত করতে পারেনি। তারা বুঝতে পেরেছিল, চোখে পট্টি বাঁধা সাদা দাড়িওয়ালা লোকটি একা উমরু দরবেশকে চ্যালেঞ্জ করতে আসেনি, নিশ্চয় তার সাথে আরো লোকজন আছে। কিন্তু সে লোক কয়জন এবং কারা, এ সম্পর্কে তারা কোন ধারনাই করতে পারল না। সংঘর্ষ একটা আসন্ন, কিন্তু শত্রু কতটা প্রবল এবং কাদের সঙ্গে তাদের মোকাবেলা করতে হবে বুঝতে পারল না সুদানী গোয়েন্দা দল!
আশী তার মোহিনী পোশাক পড়ে তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এলো। আগের মতই দুই মশালের মাঝখানে বিছিয়ে দিলো মখমলের জায়নামাজ। উমরু দরবেশ তাঁবু থেকে বের হয়ে নেশাগ্রস্থের মত টলতে টলতে এসে জায়নামাজের ওপর দাঁড়ালেন। তারপরদু’বাহু প্রসারিত করে আকাশের দিকে তাকিয়ে মন্ত্র পাঠ করা শুরু করলেন। আশী তাঁর পায়ের কাছে সেজদায় লুটিয়ে পড়লো। শেষে সেজদা থেকে মাথা তুলে হাঁটু গেড়ে বসে করজোড়ে বলতে লাগলোঃ ‘হে, খোদার পবিত্র দূত! আপনাকে সম্মান করা আমাদের সবার ওপর ফরজ! মানুষের এই দল সে তুরের তাজাল্লি দেখতে এসেছে, যেমনটি আপনার খোদা হযরত মুসা (আঃ) কে তুর পাহাড়ের চূড়ায় দেখিয়েছিলেন। আর জ্বীনদের মধ্যে থেকে তুর পাহাড়ের এ তাজাল্লি দেখতে এসেছি আমি।’
‘আমি যে খোদার বাণী নিয়ে এসেছি তাতে কি এ লোকদের বিশ্বাস নেই?’ উমরু দরবেশ প্রশ্ন করলেন।
‘যদি প্রশ্ন করা অপরাধ হয় তবে আমাকে ক্ষমা করবেন। কিন্তু হে আল্লাহ্র দূত! দয়া করে তুরের তাজাল্লি দেখিয়ে আমাদের মত পাপীদের মনের সমস্ত সন্দেহ দূর করে দিন।’ এক লোক বললো। আলী বিন সুফিয়ান লোকটাকে ভাল করে দেখে নিলেন। চিনতে পারলেন লোকটাকে, উমরু দরবেশের মিশনেরই লোক।
‘হ্যাঁ, হে পবিত্র ব্যক্তি!’ আলী বিন সুফিয়ান সামনে অগ্রসর হয়ে বললেন, ‘আমরা সবাই সন্দেহের মধ্যে পড়ে আছি; আমাদের তুর পাহাড়ের তাজাল্লি দেখান এবং এ মেয়েটি যদি জ্বীনদের মেয়ে হয়ে থাকে তবে তাঁকে কিছুক্ষণের জন্য অদৃশ্য হয়ে যেতে বলুন। তাহলে আমাদের সব সন্দেহ দূর হয়ে যাবে।’
উমরু দরবেশ পাহাড়ের ওপর সেই বিরাট বৃক্ষের দিকে তাকিয়ে সবাইকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘তোমরা ওদিকে তাকাও! অন্ধকারে তোমরা কিছু দেখতে পাচ্ছো?’
‘না, কিছুই দেখতে পাচ্ছি না হুজুর!’
‘পাবে, পাবে, এখনি পাবে। আল্লাহ্র নাম স্মরণ করে তাকিয়ে থাক ওদিকে।’
তিনি মাটি থেকে একটি মশাল উঠিয়ে উঁচু করে তুলে ধরলেন এবং উচ্চ স্বরে বলতে লাগলেন, ‘হে খোদা! তোমার সহজ সরল মূর্খ বান্দারা সন্দেহের মাঝে পড়ে আছে। তুমি তাদের সেই তাজাল্লি দেখাও, যেমন হযরত মুসা (আঃ) কে তুর পাহাড়ে দেখিয়েছিলে। আর তার জ্যোতিতে তুমি ফেরাউনের তখত-তাউস জ্বালিয়ে দিয়েছিলে! তুমি সেই জ্যোতি আবার দেখাও প্রভু!’
তিনি মশাল ডানে বামে কয়েকবার ঘুরালেন, কিন্তু পাহাড়ের ওপর কোন আলো জ্বললো না। আবার তিনি মশাল নাড়লেন, কিন্তু এবারও পাহাড়ের ওপর কোন আলো বা তাজাল্লি দেখা গেল না। উমরু দরবেশ অস্থির হয়ে এদিক ওদিক তাকালেন এবং আরো একবার মশাল উপর নিচ করলেন, তবুও সামান্যতম আলোর কিরণও দেখা গেল না পাহাড় চূড়ায়।
উমরু দরবেশ তখনো জানেন না, পাহাড়ের ওপর তার এক সঙ্গী নিহত অবস্থায় পড়ে আছে আর দু’জনকে রশি দিয়ে বেঁধে রেখেছে আলীর সঙ্গীরা। উমরু দরবেশের সঙ্গীরা দেখতে পাচ্ছিল বার বার তিনি মশাল নাড়াচ্ছেন, কিন্তু তখন তাদের করার কিছু ছিল না। আলীর এক সঙ্গী তা দেখে বলে উঠলো, ‘আজ আর তুরের তাজাল্লি দেখা যাবে না দরবেশ। কষ্ট করে লাভ নেই।’ অন্যরা এ কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলো।
‘আজ সত্যি তুরের তাজাল্লি দেখা যাবে না।’ আলী বিন সুফিয়ান উচ্চস্বরে বললেন। তিনি উমরু দরবেশকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘উমরু দরবেশ! আজ যদি তুমি পাহাড় থেকে আলোর শিখা দেখাতে পারো তবে আমি চিরকাল তোমার ভক্ত হয়ে থাকবো। জলদি তোমার কেরামতি দেখাও।’
এক ব্যক্তি খঞ্জর হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল আলী বিন সুফিয়ানের দিকে। তাঁর পেটের ভেতর খঞ্জর সেঁধিয়ে দেয়ার জন্য যেই সে হাত উপরে তুলল, অমনি পেছন থেকে তার দুই বগলের নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে এমনভাবে গলা চেপে ধরলো কেউ, লোকটির দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে গেল। কে যেন তার কানে কানে বলল, ‘খঞ্জর ফেলে দাও।’ সঙ্গে সঙ্গে হাত থেকে খঞ্জর ছেড়ে দিল লোকটি।
সবাই তাকিয়ে আছে পাহাড়ের দিকে। এদিকে সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে এক ব্যক্তি তাঁবুর পিছন দিয়ে তাঁবুর ভেতর ঢুকে গেলো। আশী আগেই তাঁবুর ভেতর ঢুকে পড়েছিল, সে আশীকে বললো, ‘আশী, শীঘ্র বের হও। আমাদের গোপন রহস্য ফাঁস হয়ে গেছে। যে লোক উমরু দরবেশের সঙ্গে কথা বলছে তাকে এ অঞ্চলের মানুষ বলে মনে হয় না। সম্ভবত সে মিশর থেকে এসেছে। এ লোক ঠিকই বলছে, আজ আর তুরের তাজাল্লি দেখা যাবে না! আমাদের পাহাড়ের সঙ্গীরা হয়তো ধরা পড়ে গেছে। উত্তেজিত জনতার হাতে পড়লে আর রক্ষে নেই। ওরা আমাদের ধরতে পারলে খুন করে ফেলবে। মনে হচ্ছে উমরু দরবেশের কপালে খারাবি আছে। তাঁকে নিঃসন্দেহে ওরা হত্যা করবে। আমি পালিয়ে যাচ্ছি। যদি বাঁচতে চাও, পিছু নাও আমার। ধরতে পারলে তোমার সঙ্গে ওরা পশুর মত ব্যবহার করবে।’
‘না আমি যাবো না। কখনোই না।’ আশী হেসে বললো, ‘বন্য পশুদের নিয়ে কোন ভয় নেই আমার। উমরু দরবেশকে সঙ্গ দেয়ার যে দায়িত্ব নিয়ে আমি এসেছি, বিপদ দেখে সে দায়িত্ব ফেলে পালিয়ে যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই আমার।’
‘তুমি পাগল হয়ে গেলে!’
‘না! আমি আগে পাগল ছিলাম।’ আশী বললো, ‘এখন আমার চোখ খুলে গেছে। বিবেক ও বুদ্ধি সঠিক পথে এসে গেছে। এখন আমি সেখানেই যাবো, যেখানে উমরু দরবেশ যেতে বলেন।’
বাইরে আলী বিন সুফিয়ানের ইশারায় ইমাম সাহেব লোকদের বললেন, ‘মুসলমান ভাইয়েরা আমার! আমরা তোমাদের সেখানে নিয়ে যাবো, যেখানে তুরের তাজাল্লি দেখানো হয়। আমাদের বোকা বানিয়ে যে অভিনয় গত রাতে দেখানো হয়েছে এবং আজ দেখানোর আয়োজন করা হয়েছিল, সেখানে গেলেই তোমরা তা দেখতে পাবে।’
আলী বিন সুফিয়ানের কমান্ডো বাহিনী লোকদের মধ্য থেকে এরই মধ্যে সে তিনজনকে সরিয়ে নিয়েছিল, যারা সুদানী গোয়েন্দা। কিন্তু জনগণ এর কিছুই টের পায়নি। তাদের বুকের সাথে তখনো খঞ্জরের মাথা ঠেকানো। অন্ধকারে ওরা তখন দাঁড়িয়ে আছে তাঁবুর পেছনে, তাদের ঘিরে রেখেছে আলীর কমান্ডোরা। উমরু দরবেশ তখনও দাঁড়িয়ে ছিলেন আগের জায়গায়।
তাঁবুর মধ্যে সুদানী গোয়েন্দা আশীকে বুঝাবার চেষ্টা করছিল। বলছিল, ‘আশী, আমাদের বাঁচার আর কোন পথ নেই। দেরী করলে আমরা কেউ রক্ষা পাবো না। জেদ করার সময় এটা নয়, চলো আমরা পালিয়ে যাই।’ কিন্তু আশী কিছুতেই তার সাথে যেতে রাজি হলো না, আর আশীকে রেখে সে গোয়েন্দাও যেতে চাচ্ছিল না।
সুদানী গোয়েন্দা খুবই অবাক হলো, মেয়েটি কেন তাঁর সঙ্গে যেতে অস্বীকার করছে? যতই তাকে বুঝানো হচ্ছে, চূড়ান্ত বিপদ মাথার ওপর, কিছুতেই কেন সে তা বুঝতে পারছে না? কেন আশী প্রতিবাদ করে বার বার বলছে, ‘তুমিও মুসলমান! আমিও মুসলামান। আর এই জনতাও মুসলমান!’ কেন বলছে, ‘আমি উমরু দরবেশকে ছেড়ে কোথাও যাবো না?’ তবে কি এর মাঝে কোন ‘কিন্তু’ আছে? উমরু দরবেশ এবং আশী কে আগেই দুশমনের সাথে হাত মিলিয়েছে! এসব ভেবে গোয়েন্দার মাথা খারাপ হয়ে গেল।
বাইরে শোরগোল ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে। প্রায় নিরূপায় হয়ে সুদানী গোয়েন্দা খঞ্জর বের করে আশীকে খুন করার হুমকি দিল। সঙ্গে সঙ্গে আশী খাপ থেকে তলোয়ার বের করে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল। উমরু দরবেশই তাকে বলেছিল, ‘তলোয়ার সব সময় হাতের কাছে রাখবে। বিপদ এলে এ তলোয়ারই তোমার সম্ভ্রম ও জীবনের নিরাপত্তা দেবে।’
আশী দ্রুত তলোয়ার হাতে নিয়েই বললো, ‘আমাদের দু’জনের কেউই এখন আর বাইরে যাবো না।’
একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুরুষ গোয়েন্দার মোকাবেলায় একটি মেয়ের চ্যালেঞ্জ খুবই হাস্যকর ব্যাপার! সে বুঝতে পারছিল, ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। কিন্তু এমন মহামূল্যবান মেয়ে হাত ছাড়া হয়ে যাবে, এটাই বা কিভাবে মেনে নেয়া যায়! মহা সমস্যায় পড়ে গেল লোকটি। এখন হয় তাকে জোর করে নিয়ে পালাতে হবে নতুবা হত্যা করতে হবে। তার ধারণা ছিল, আশী তলোয়ার চালনায় তেমন পটু হবে না। লোকটি খঞ্জর হাতে তার ওপর আক্রমণ চালালো। আশী খঞ্জরের ওপর এমন জোরে তলোয়ারের আঘাত করলো যে, খঞ্জর তার হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল। হাত থেকে খসে পড়া খঞ্জর তাঁবুর খুঁটির সাথে বাড়ি খেয়ে ছিটকে ফিরে এসে পড়লো লোকটির পায়ের কাছে। ত্রস্ত হাতে সে আবার খঞ্জর উঠিয়ে নিল। আশী আবার তার খঞ্জরের ওপর আঘাত করলো আর মুখে বললো, ‘যে ওস্তাদের কাছে তুমি তলোয়ার চালাতে শিখেছো আমিও সে ওস্তাদের কাছেই প্রশিক্ষণ নিয়েছি।’
এরপর তাঁবুর সেই সংকীর্ণ পরিসরে চলতে লাগলো অসম লড়াই। একদিকে নারী, অন্য দিকে পুরুষ। এক জনের হাতে তলোয়ার, অন্য জনের হাতে খঞ্জর। এক পর্যায়ে আশীর একটি তীব্র আঘাত কৌশলে ফিরিয়ে দিয়েই অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় নিজেকে আশীর নাগালের মধ্যে নিয়ে গেল এবং তাঁকে নিয়ে গড়িয়ে মেঝেতে পড়লো সুদানী গোয়েন্দা। আশী তলোয়ার সামলে নেয়ার আগেই লোকটি তাকে কাবু করে তার বুকের ওপর চড়ে বসলো। সে আশীর কব্জিতে আঘাত করল। আশীর হাত থেকে খসে পড়লো তলোয়ার। কিন্তু লোকটি আশীকে হত্যা না করে তাঁর দুই বাহু মাটির সাথে চেপে রেখে বললো, ‘আমি তোমাকে হত্যা করবো না আশী! তুমি বুঝতে চেষ্টা করো।’
প্রচণ্ড ক্রোধে আশী তখন বাঘিনী হয়ে গেছে। সে মুখভর্তি থুতু ছুঁড়ে মারল লোকটির চেহারায়। চেহারা থেকে থুতু মোছার জন্য হাতের বাঁধন আলগা করলো লোকটি, সঙ্গে সঙ্গে সর্বশক্তি দিয়ে তার নাকের ওপর ঘুষি মারলো আশী। লোকটি সে আঘাত সামলাতে না পেরে নাক চেপে ধরে গড়িয়ে পড়লো তার গায়ের ওপর থেকে। আশী চকিতে উঠে বসে সঙ্গে সঙ্গে তলোয়ার হাতে নিল। শুয়ে থেকেই খঞ্জর হাতে নেয়ার জন্য থাবা মারলো লোকটি, আশীর তলোয়ার নেমে এলো নিচে, লোকটার হাত দেহ থেকে আলাদা হয়ে গেল। পিছনে সরে যেতে চাইল সে, কিন্তু আশী দ্বিতীয় আঘাত পড়লো তার কোমরের ওপর। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এলো তাজা রক্ত, আশী সে রক্তের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমিও মুসলমান পিতা-মাতার সন্তান, এটা তোমার ভুলে যাওয়া উচিত হয়নি।’ সে এবার তলোয়ারের মাথা চেপে ধরলো তার শাহরগে। লোকটি অস্ফুট কণ্ঠে ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠলো, ‘না, আশী, না!’
আশী বললো, ‘চুপ গাদ্দার! আমি আর তোদের খেলার পুতুল নই। আমার ভেতর লুকিয়ে ছিল যে ঈমান, সে ঈমান আবার জেগে উঠেছে। সে ঈমানের বলেই তোকে আমি পরাজিত করতে পেরেছি। জাতির কোন গাদ্দারকে ক্ষমা করার কোন প্রশ্নই উঠে না। তোর মউত এখন লাফালাফি করছে এ তলোয়ারের ডগায়।’
বাইরে তখন রচিত হচ্ছিল অন্য ইতিহাস। আলী বিন সুফিয়ান একটি মশাল তুলে নিলেন, অন্য মশালটি হাতে নিলেন মসজিদের ইমাম সাহেব। চার-পাঁচজন কমান্ডো দাঁড়িয়ে ছিল উমরু দরবেশকে ঘিরে। কমান্ডোরা তাকে হত্যা নয় বরং হত্যাকারীদের হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করছিল। সুদানী গোয়েন্দাদের আক্রমণ থেকে হেফাজতের জন্যই তাকে ঘিরে রেখেছিল ওরা।
আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছিল, তার কোন সাথীই আর মুক্ত নেই। কিন্তু বলা যায় না, দৃষ্টির অগোচরে আরো কেউ না কেউ থেকে যেতে পারে। তাই আলী বিন সুফিয়ান কয়েকজনকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন, ‘বিবাদ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই উমরু দরবেশের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে নেবে তোমরা।’
উমরু দরবেশ এক কমান্ডারকে বললেন, ‘তাঁবুর মধ্যে একটি মেয়ে আছে, তাকেও সঙ্গে নিতে হবে। মেয়েটিও মুসলমান।’
কমান্ডোরা তাঁবুর মধ্যে ঢুকলো মেয়েটিকে ডেকে আনতে, ঢুকেই তারা অবাক করা দৃশ্যের সম্মুখীন হলো। দেখতে পেল, আশী এক ব্যক্তিকে তলোয়ারের মুখে বসিয়ে রেখেছে। লোকটির চেহারা ভয়ে বিবর্ণ হয়ে আছে।
এ লোকটিকেও বন্দী করা হলো। আলী বিন সুফিয়ান উমরু দরবেশকে বললেন, ‘নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো, আমার লোকেরা যথাসময়েই ওই পাহাড়ে গিয়ে পৌঁছে ছিল। তাই সেখান থেকে কোন অগ্নিশিখা উঠতে পারেনি। সবচে উত্তম হয়, লোকদের সেখানে নিয়ে গিয়ে দেখানো, কিভাবে অগ্নিশিখা সৃষ্টি হতো। তাতে এই ভেলকিবাজী খেলায় বিশ্বাসী লোকদের ঈমান ঠিক হয়ে যাবে, আবার সঠিক বিশ্বাসে ফিরে আসবে বিভ্রান্ত লোকেরা।’
‘কিন্তু আমার মনমগজ আচ্ছন্ন করে আছে অন্য এক গুরুতর সমস্যা। সে জটিল সমস্যার দিকে সত্বর দৃষ্টি দেয়া উচিত!’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘ইসহাককে কারাগার থেকে মুক্ত করতে হবে। এ এলাকায় সুদানীদের বহু গুপ্তচর ছড়িয়ে আছে। তারা আজকের এ ঘটনার সংবাদ সুদানী সরকারকে অবহিত করার জন্য এক্ষুনি ছুটে যাবে। ফলে ইসহাককে নজরবন্দী অবস্থা থেকে কঠিন কারাগারে নিক্ষেপ করা হবে এবং অবর্ণনীয় কষ্ট দিয়ে তাকে হত্যা করে ফেলবে সুদান সরকার। আমি সুদানী সেনাপতিকে ধোঁকা দিয়ে বেরিয়ে এসেছি। এখানকার মুসলমানদের মনোভাব ও চিন্তাধারার পরিবর্তন করে সুদানীদের অনুগত করার জিম্মা নিতে রাজি হওয়ায় মুক্তি পেয়েছি আমি। এ শর্ত মেনে নেয়ার আগে আমি ইসহাকের সাথে শলাপরামর্শ করেছি। তাকে বলেছি, আমাদের মুক্তির এছাড়া আর কোন খোলা নেই। আমি যে সুদানীদের শর্ত মেনে নিয়েছিলাম তাদের ধোঁকা দেয়ার জন্য, এ ষড়যন্ত্রে ইসহাকও শরীক, এটাই ধরে নেবে ওরা। ফলে ইসহাকের জীবন এখন চরম ঝুঁকির সম্মুখীন।
আমার ইচ্ছা ছিল, এখনে এসে গোপনে আপনাদের সাথে যোগাযোগ করবো। আশা ছিল, সুদানী কারাগারে আমাদের সৈন্যরা কি অবস্থায় আছে সে খবর কায়রোতে জানানোর কোন না কোন সুযোগ পেয়েই যাবো। তারপর আমি এ অভিনয় চালিয়ে যেতে থাকবো আর আপনারা ইসহাককে পালিয়ে আসার কোন একটা ব্যবস্থা ও সুযোগ সৃষ্টি করে দেবেন।
কিন্তু এখানে এসে দেখতে পেলাম, সুদানী গোয়েন্দারা আমার চারপাশে দুর্ভেদ্য প্রাচীর দাঁড় করিয়ে রেখেছে। এখানকার গাদ্দার মুসলমানরা সারাক্ষণ চোখ রাখছে আমার প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর। আমি তাদের কঠিন আবেষ্টনীর মধ্যে পড়ে আছি। ভাগ্যক্রমে এ মেয়েটির মুসলিম পরিচয় জানা গেল।’
তিনি আশীর অতীতের সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন। তারপর আক্ষেপের সুরে বললেন, ‘চারদিকে তাকিয়ে আমি কোন আশার আলোই দেখতে পাচ্ছিলাম না। কিভাবে আমার উদ্দেশ্য সফল করবো খুঁজে পাচ্ছিলাম না তার কোন পথ। আমি খুবই দুঃখিত, আমাদের মুসলমান ভাইয়েরা এতই সরল ও সোজা যে, তারা আমার মিথ্যা অভিনয়কে অবলীলায় সত্য বলে মেনে নিলো। আমি সর্বদা সুদানী গোয়েন্দাদের দৃষ্টিতে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা থাকতাম, কি যে করবো আমি কোন দিশাই পাচ্ছিলাম না।
আল্লাহ্ আমার নিয়ত পূরণ করেছেন। তিনি আমার কাছে আপনাকে মুক্তির দূত হিসেবে প্রেরণ করেছেন। এখন দীর্ঘ ইতিহাস বর্ণনার সময় নেই। আমি সবার আগে ইসহাককে মুক্ত করতে চাই। সুদানী গোয়েন্দারা ওখানে পৌঁছার আগেই আমি সেখানে পৌঁছে যেতে চাই। আপনি দু’জন সাহসী, বীর ও হুশিয়ার কমান্ডো দিয়ে আমাকে সাহায্য করুন।’
কিভাবে ইসহাককে উদ্ধার করা যায় তিনি সে পরিকল্পনা আলী বিন সুফিয়ানকে খুলে বললেন। আলী বিন সুফিয়ান পরিকল্পনা শুনে কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে চুপ করে রইলেন। একটু পর মাথা তুলে পরিকল্পনা কিছুটা রদবদল করে বাছাই করা দু’জন কমান্ডো ও আশীকে সঙ্গে নিয়ে উমরু দরবেশকে রওনা হওয়ার অনুমতি দিলেন। বললেন, ‘আমি জনগণকে তুর পাহাড়ের তাজাল্লির আসল রহস্য উদঘাটনের জন্য পাহাড় চূড়ায় নিয়ে যাচ্ছি। তুমি ওদের নিয়ে এখুনি এখান থেকে রওনা হয়ে যাও।’ অনুমতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উমরু দরবেশ দুই কমান্ডো ও আশীকে সঙ্গে নিয়ে তাঁবুর ভেতর ঢুকে গেল এবং তাঁবুর পেছন দিয়ে বেরিয়ে দ্রুতগামী ঘোড়ায় চড়ে বসলো। ধীর পায়ে ইসহাককে মুক্ত করার জন্য চারজনের ছোট্ট কাফেলা নেমে এলো রাস্তায়। তারপর ক্ষিপ্রবেগে ঘোড়া ছুটতে শুরু করলো সুদানী কারাগারের উদ্দেশ্যে।
জনতা ক্রমেই উত্তেজিত ও ক্ষিপ্ত হচ্ছিল। অশান্ত কণ্ঠে বলাবলি করছিল, ‘কি হতে কি হয়ে গেল!’ আলী বিন সুফিয়ান উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘যদি তোমরা তুর পাহাড়ের জ্যোতির সত্যতা দেখতে চাও তবে আমার সাথে এসো। তোমরা অবশ্যই জানো, রাসুলে আকরাম (সঃ)-এর পর আর কোন নবী ও রাসুল আসবেন না। কারণ আমাদের প্রিয় নবীর আগমনের সাথে সাথে নবুয়তের সিলসিলা বন্ধ হয়ে গেছে। তারপরে আল্লাহতায়ালা আর কোন দূত পাঠাননি এবং পাঠাবেন না। আল্লাহর দূত তো কেবল নবী ও রাসুলই হতে পারেন। বাকীরা বড়জোর সে নবীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে বুজুর্গানে দ্বীন হতে পারেন। তারা মানুষকে ডাকবেন আল্লাহ্ ও রাসুলের পথে, কোরআন ও হাদীস ছাড়া আর কোন মোজেযা দেখিয়ে দ্বীনের পথে মানুষকে আহবান করার প্রয়োজন হবে না তাদের। মোজেযা বা কেরামতি দেখানোর কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করে ভণ্ড ও প্রতারকরা। উমরু দরবেশকে দরবেশকে প্রতারণার কৌশল শিখিয়ে তোমাদের কাছে পাঠিয়েছে সুদান সরকার। উদ্দেশ্য তোমাদের ঈমান ও আকিদা নষ্ট করা। তোমরা দীর্ঘদিন সুদানী সরকার ও তার সেনাবাহিনীকে এ এলাকা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছো। এ জন্য রক্ত দিয়েছে এ মাটির সন্তানেরা। ওরা বুঝতে পেরেছে, শক্তি দিয়ে তোমাদের পদানত করা সম্ভব হবে না। তাই তারা তোমাদের গোলাম বানাবার জন্য এ পদক্ষেপ নিয়েছে। তোমরা নিজের কানেই শুনেছ, তিনি বার বার বলছিলেন, সুদানীদের সহযোগী হতে। এতেই তোমাদের বুঝা উচিত ছিল, তিনি কি চান।
হে মুসলমান ভাইয়েরা আমার! তোমরা সাবধান হও! সতর্ক হও! শত্রুরা যখন কৌশল ও প্রতারণার আশ্রয় নেয়, তখন এ কথা দিবালকের মত স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তারা তোমাদের সম্মুখ যুদ্ধে মোকাবেলা করতে ভয় পায়। কারণ তোমরা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত আছো, আর ওদের ভয় এ সত্যকে। হক ও বাতিলের এ সংঘাতে তোমরা হকের পথ থেকে সরে দাঁড়াও এটাই ওদের একমাত্র লক্ষ্য।
প্রিয় ভাইয়েরা! এ দেশ ও এ দেশের মাটি তোমাদের। ইনশাল্লাহ শীঘ্রই এদেশে ইসলামী শাসন কায়েম হবে। কাফেররা তোমাদের মন থেকে ধর্মীয় ও জাতীয় অনুভুতিকে বিলীন করার যে চেষ্টা চালিয়েছে তা ব্যর্থ হয়ে গেছে। কিন্তু এটাই শেষ নয়। আজ তোমাদেরকে তুরের তাজাল্লি দেখিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে তোমাদের সামনে পাঠানো হবে খৃস্টান যুবতীদের। তাদের রূপ লাবণ্য দেখিয়ে তোমাদেরকে নির্লজ্জ বানাবার চেষ্টা করা হবে। সে ফাঁদে পড়ে তোমরা মানুষ থেকে পশুতে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। তখন তোমরা বুঝতেই পারবে না, তোমাদের সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ববোধ কোথায় বিলীন হয়ে গেছে। তোমরা তখন শ্রেষ্ঠত্বের গুণাবলী থেকে বঞ্চিত হয়ে ধীরে ধীরে পরিণত হবে কাফেরদের দাসে। সুদানের বাদশাহ মুসলমান নয়, সে কাফের! সে ইসলামের শত্রু এবং খৃস্টানদের বন্ধু! তোমরা কি খৃস্টান মেয়েদের মত তোমাদের বোন ও মেয়েদের পরপুরুষের সাথে বসে মদ পান করতে দেবে? তাদেরকে বেহায়া ও ব্যভিচারী হতে উৎসাহিত করবে? তোমরা কি চাও তোমাদের মসজিদগুলো বিরাণ হয়ে যাক? মানুষের পদতলে দলিত মথিত হোক কোরআনের ছিন্ন পাতা?’
‘কাবার প্রভুর কসম, আমরা তা চাই না।’ একজন আবেগে চিৎকার দিয়ে বললো, ‘উমরু দরবেশকে আমাদের সামনে এনে দাও। সে কেমন খোদার দূত আমরা দেখতে চাই।’
‘উমরু দরবেশ নির্দোষ, তিনি পরিস্থিতির শিকার!’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘তিনি তোমাদেরই লোক! এখন তিনি তাঁর আসল রূপে ফিরে এসেছেন।
বন্ধুরা! আল্লাহর হাজার শোকর যে, তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠ নেয়ামত দিয়ে তোমাদের ধন্য করেছেন, মুসলমান হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে তোমাদের। কাফেররা আল্লাহর সেই নেয়ামত থেকে তোমাদের বঞ্চিত করতে চায়।’
‘তুমি কে?’ দর্শকের সারি থেকে একজন উচ্চস্বরে বললো, ‘তোমাকে বেশ বিজ্ঞ ও পণ্ডিত মনে হয়। তুমি কি আমাদেরকে তার কেরামতির রহস্য দেখাতে পারবে?’
‘হ্যাঁ, তাই আমি তোমাদের দেখাচ্ছি।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন। তিনি তাঁবুর মধ্য ধেকে একটি পাত্র নিয়ে এলেন। পাত্রটি জ্বালানি তেলে ভর্তি। তিনি সেই তেল কাপড়ে মাখিয়ে মাটিতে রেখে দিলেন। তারপর তার ওপর পানি ঢাললেন। পরে সে কাপড়ের কাছে মশাল নিয়ে ছোঁয়াতেই দপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। তিনি সকলকে বললেন, ‘যে কাপড়ের ওপর পানি ঢেলে উমরু দরবেশ আগুন ধরিয়েছিল, তাতে এই তেল মাখানো ছিল।’
‘এখন তোমাদেরকে সেই লোক দেখাবো, যে লোক এ কাজের সাথে জড়িত ছিল।’ আলী বিন সুফিয়ান তার এক সঙ্গীকে ডেকে বললেন, ‘তাকে নিয়ে এসো।’
জনতার ভীড় থেকে সামান্য দূরে অন্ধকারে লোকটিকে ধরে দাঁড়িয়েছিল কয়েকজন কমান্ডো। উমরু দরবেশের সেই সঙ্গীকে আলীর সামনে হাজির করা হলো। সহসা ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শুনে জনতা পিছন ফিরে তাকালো। দেখা গেল এক লোক ঘোড়া নিয়ে তীব্র বেগে পালিয়ে যাচ্ছে সেখান থেকে। জনতা চিৎকার করে বললো, ‘একজন পালিয়ে যাচ্ছে!’
জনতার ভীড়ে তখনো সুদানী গোয়েন্দা লুকিয়ে ছিল এবং তাদেরই একজন পালিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে আলীর দুই সঙ্গী ঘোড়া নিয়ে তৎক্ষণাৎ ছুটলো তার পেছনে। ঘোড়ার খুরের আওয়াজ দূরে মিলিয়ে যেতেই শোরগোল কমে এলো। আলী বিন সুফিয়ান জনতাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘দেখো, এই সে লোক, যে উমরু দরবেশের সহযোগী হিসাবে এখানে কাজ করছিল।’
মশাল উঁচু করে ধরে তার চেহারা সকলকে দেখানো হলো। কয়েকজন সমস্বরে চিৎকার করে বললো, ‘একে তো আমরা চিনি! আমাদের এলাকারই লোক।’
অন্য একজন বললো, ‘এ লোক তো মুসলমান!’
‘হ্যাঁ, এ ব্যক্তি মুসলমান!’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘এবং এ এলাকারই লোক। কিন্তু এ লোক বিশ্বাসঘাতক, বেঈমান।’ আলী বিন সুফিয়ান এ ব্যক্তির কার্যক্রম বিস্তারিত তুলে ধরলেন জনতার সামনে।
‘একে হত্যা করা হোক।’ উত্তেজিত জনতা চিৎকার করে উঠল, ‘মারো, শেষ করে দাও এ গাদ্দারকে।’ লোকজন তার দিকে ছুটে এলো প্রচণ্ড আক্রোশে। কেউ কেউ খাপ থেকে বের করে ফেললো তলোয়ার। মশালের আলোয় দেখা গেল সে তলোয়ারের চমক।
‘থামো।’ গর্জে উঠল আলী বিন সুফিয়ানের কণ্ঠ, ‘তোমরা আইন নিজের হাতে তুলে নিও না। বিচারের পর এর যা শাস্তি তা সে পাবে। এখন তোমাদের কাজ হচ্ছে একে হেফাজত করা। আরো কাজ আছে তোমাদের। এখনো তোমরা নুরের তাজাল্লি দেখানোর রহস্য দেখোনি। আমার সাথে এসো, আমি তোমাদের সে রহস্যও খুলে দেখাবো।’
আলী বিন সুফিয়ান হাঁটা ধরলেন। সমস্ত লোক পিছু নিল তার। তিনি সবাইকে নিয়ে সে পাহাড়ে চললেন, যেখানে কমান্ডোরা একজনকে হত্যা ও অন্য দু’জনকে রশি দিয়ে বেঁধে রেখেছিল।
কার্টেসীঃ ক্রুসেড সিরিজ ওয়েবসাইট
0 comments: