কয়েকদিন আগে মনে শখ জাগল ঐতিহাসিক মুতা যুদ্ধক্ষেত্র দেখে আসার। যেই ভাবা সেই কাজ। ঐ এলাকায় অবস্থানকারী বাংলাদেশী হামিদ ভাইকে ফোন দিলাম। উনি বললেন: চলে আসেন; আমিও কয়েকদিন ফ্রি আছি।
গত ২১ জুন বৃহস্পতিবার ঐতিহাসিক মুতাযুদ্ধক্ষেত্র এলাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। এলাকাটির অবস্থান জর্ডানের রাজধানী আম্মান থেকে প্রায় দেড়শত কিলোমিটার দক্ষিণে। এলাকাটা "আল কারাক" জেলার অন্তর্গত। গাড়ীর ভিতর "মাজদ" নামে মু'তা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের সাথে পরিচয় হল। তাকে এলাকার লোকসংখ্যা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলে উত্তর পেলাম বিশাল এই জেলার লোকসংখ্যা মাত্র ৫০,০০০। অথচ, আমাদের দেশে ১ টা ইউনিয়নেই ১ লক্ষের উপরে লোকের বসবাস। বাস থেকে নামার সময় তার মোবাইল নাম্বারটা আমাকে দিয়ে বলল: মু'তা এলাকায় কোন সহযোগিতার দরকার হলে আমাকে কল দিতে পারেন।
বাস টার্মিনালে গিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটি বাস আসল। সে বাসটিতে চড়ে বসলাম। এরই মধ্যে বাস টার্মিনালে অপেক্ষমাণ কিছু সেনাবাহিনী সদস্যের সাথে পরিচিত হলাম। তাদের বাড়ী মু'তার আশে পাশেই। ছুটিতে বাড়ী যাচ্ছে। জর্ডানের সেনাবাহিনীর বিভিন্ন তথ্য আগে থেকেই জানা ছিল। জর্ডানের বহু সেনাবাহিনীর সদস্য দিনের বেলায় ডিউটি করে সন্ধ্যা বেলায় বাড়ীতে চলে আসে। হোক সে সেনাবাহিনীর অফিসার কিংবা সাধারণ একজন সদস্য। তাদের কারও ডিউটি সপ্তাহে ৫ দিন, বাকী দুইদিন ছুটি। বাড়ীতেই ছুটিগুলো কাটিয়ে দেয়। আবার কারও ডিউটি থাকে সপ্তাহে ৩ দিন। একই রকম সিস্টেম পুলিশের বেলায়ও। আমার মসজিদেরই বেশকিছু মুসল্লী সেনাবাহিনী ও পুলিশের চাকরী করে, তাদের কাছ থেকে এগুলো জানার সুযোগ হয়। আমার মসজিদে একজন মুসল্লী আছেন পুলিশের উচ্চপর্যায়ের অফিসার; উনি নাকি পুলিশদেরকে ট্রেনিং দেন।
যাহোক, আমরা আসল কোথায় ফিরে আসি। বেশ কিছু যাত্রী আগে থেকেই টার্মিনালে অপেক্ষা করার কারণে বাস ভর্তি হতে দেরী হল না।
বাস যাত্রা শুরু করল। বাস মরুভুমির পথ বেয়ে ছুটে চলছে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। গন্তব্যে পৌছতে সময় লাগবে প্রায় আড়াই ঘন্টা। মিশর ও জর্ডানে দেখেছি বাসের ভিতরে যাত্রীরা সাধারণত গল্প গুজব না করে চুপ করে বসে থাকে। গাড়ী থাকে সাধারণত নীরব। আমি গাড়িতে বসে থেকে এক ঘেয়েমি দূর করতে ল্যাপটপ বের করলাম। ফেসবুকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ফ্রেন্ডসহ বেশ কয়েকজন ফ্রেন্ডের সাথে চ্যাটিং করলাম। একটু পরেই দেখলাম অনলাইনে আছেন সোনার বাংলাদেশ ব্লগের অত্যন্ত সুপরিচিত ব্লগার "শাইখ আল মুহাজির"। তার সাথে ইতিপুর্বে কথাবার্তা কিংবা পরিচয় হয়নি। তার সাথে চ্যাটিং করলাম। বিভিন্ন ব্যাপারে আলোচনা হল। তার কাছ থেকে নিজের পক্ষ থেকেই দাওয়াত আদায় করে নিলাম। দেশে গেলে সময় ও সুযোগ মত তার সাথে সাক্ষাৎ করব ইনশাল্লাহ।
পথিমধ্যে দেখলাম রাস্তায় প্রচুর ধুলোবালি উড়ছে। বাসের ভিতরেও চলে আসছে ধুলোবালি। কিছুদুর যাওয়ার পর দেখলাম পুলিশ রাস্তা বন্ধ করে দিল যেন, ধুলোবালি বন্ধ হওয়ার পরই গাড়ী চলাচল করতে পারে।
কয়েকজনের সাথে চ্যাটিং ও ফেসবুক ব্রাউজিং এর ভিতর দিয়েই সময় চলে গেল। প্রথমে পৌঁছলাম জেলাশহর আল কারাকে। সেখান থেকে আরেকটি বাসে মাত্র ১০ মিনিটের পথ মু'তা যুদ্ধক্ষেত্র এলাকা। মু'তা এলাকায় পৌছার পর বাংলাদেশী হামিদ ভাই সংগে করে নিয়ে গেলেন তার বাসায়। তার বাসায় পৌছলাম আসর নামাজের পরে। আসরের দুই রাকাত কসর নামাজ তার বাসায়ই আদায় করলাম।
নামাজ শেষে কিছুক্ষণ ফেসবুক ও ব্লগে চোখ বুলিয়ে নিলাম। মাগরিবের আযান হলে নামাজের জন্য পার্শ্ববর্তী মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হলাম। মসজিদের পাশেই দেখলাম একটা সাইনবোর্ড। তাতে সংকেত দেয়া রয়েছে ডানদিকে মু'তার যুদ্ধক্ষেত্র। আমি হামিদ ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম এদিকেই কি যুদ্ধক্ষেত্র? উনি বললেন: এটাই যুদ্ধক্ষেত্র। আশ্চর্য হলাম এটা জেনে যে, এটা তার বাসার অতি নিকটে মাত্র পায়ে হাটা এক মিনিটের পথ। রাস্তার এ পাশে তার বাসা আর ওপাশে যুদ্ধক্ষেত্র।
যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে একটু চোখ বুলিয়ে নিলাম।নামাজের জামাত হতে আর বেশী সময় বাকী নেই।তাই,দ্রুতই চলে যেতে হল যুদ্ধক্ষেত্রের সাথেই অবস্থিত মসজিদে।নামাজের পর মসজিদের মুয়াজ্জিন হাসসানের সাথে পরিচয় হল।পরিচয় পর্ব শেষ করে যুদ্ধক্ষেত্র সম্বন্ধে বিভিন্ন তথ্য জানার চেষ্টা করলাম।তিনি বললেন:এ স্থানেই যুদ্ধ হয়েছে মুসলিম বাহিনী ও রোমানদের মাঝে।আর এখানকার সেনাপতিত্রয়কে দাফন করা হয়েছে পার্শ্ববর্তী "মাজার" নামক স্থানে।
মুয়াজ্জিন হাসসানকে জিজ্ঞাসা করলাম এ এলাকার আশেপাশে আর কোন ট্যুরিস্ট স্পট কিংবা ইসলামী ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ কোন স্থান আছে কিনা? তিনি জানালেন- পাশেই আছে মুসা (আঃ)এর শ্বশুর শুয়াইব (আঃ)এর এলাকা "মাদইয়ান"।সেই কুপও আছে যেখান থেকে মুসা (আঃ)শুয়াইব (আঃ)এর মেয়েদের ছাগলকে পানি পান করিয়েছিলেন।সেখানেও গিয়েছিলাম আলহামদুলিল্লাহ।তবে,সে কথা আরেকদিন অন্য একটা পোষ্টে বলব ইনশাল্লাহ।
পরেরদিন দুপুর বেলায় চলে গেলাম এ যুদ্ধের তিনজন সেনাপতির দাফন স্থল "মাজার" নামক শহরে।এ স্থানটি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ৩ বা ৪ কিলোমিটারের দুরত্বে।হয়ত তারা শাহাদাত বরণ করার পর তাদের লাশকে কিছুটা দুরে নিয়ে গিয়ে ওখানেই দাফন করা হয়েছে।
সেখানে যাওয়ার সময় মাইক্রোবাসে সাক্ষাৎ হল আরেকজন ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টের সাথে।তার কাছ থেকে কোন তথ্য উদ্ধার করা যায় কিনা চেষ্টা করলাম।সে বলল: মসজিদের পার্শ্ববর্তী স্থানের ইট পাথরের ধংসস্তুপের মধ্য থেকে নাকি কয়েকবছর আগে একটি তরবারী উদ্ধার করা হয়েছে।কিন্তু,অন্যদের কাছ থেকে এ সম্বন্ধে কোন তথ্য না পাওয়ায় তথ্যটা কতটুকু সত্য তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন।
"মাজার"শহরে আসলাম।প্রথমেই ঐ ছাত্র আমাদেরকে দেখিয়ে দিল হযরত আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রাঃ)এর দাফনস্থল।একটি বিল্ডিং তৈরি করে তার মধ্যে একটি রুমের ভিতরে তার কবর রেখে দেয়া হয়েছে।কবরের উপরে খোদাই করে তার নাম লেখা আছে।একজন সিকিউরিটি সার্বক্ষনিক দায়িত্বে থাকে।আর কোন লোককে সেখানে দেখলাম না।অথচ,আমাদের বাংলাদেশে এই কবরটা থাকলে হয়ত সার্বক্ষনিক কয়েকশত লোক এখানে থাকত এবং কিছু ফকীরের জমজমাট ব্যবসাও চলত।রুমের একপাশে আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রাঃ) এর জীবনী লিখে দেয়া হয়েছে একটা বোর্ডে। তিনি ছিলেন রাসুল (সাঃ) এর একজন কবি। তার বেশ কয়েকটি কবিতাও এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।
সিকিউরিটির সাথে পরিচয় হল। তাকে জানালাম, আমি অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করি। তার সাথে সম্পর্কটা সহজ হয়ে এল। এরপর আমি এগুলোর ছবি ব্লগে দেব; ইসলাম প্রিয় অনেক মুসলিম ভাইবোনেরা বিভিন্ন দেশে এসব ছবির জন্য অপেক্ষা করছেন এ কথা বলার পরে সে ছবি তুলতে আপত্তি করল না। অথচ, কোথাও দেখলাম যে, ছবি তোলা নিষিদ্ধ। হয়ত এ নিষেধাজ্ঞা শুধুমাত্র খাতা কলমে বাস্তবে তার প্রয়োগ হয় না।
এর পরে গেলাম এখান থেকে ৪/৫ শত গজ দুরে পার্শ্ববর্তী একটি মসজিদের কাছে। উক্ত মসজিদ থেকে একটু দুরেই যায়েদ বিন হারেসা ও জাফর বিন আবি তালেব (রাঃ)কে পৃথক দুটি স্থানে দাফন করা হয়েছে।প্রথমেই প্রবেশ করলাম যায়েদ বিন হারেসা (রাঃ)কে দাফন করা হয়েছে যে স্থানে সেখানে।প্রবেশ করেই দেখলাম সেখানেও একজন সিকিউরিটি গার্ড রয়েছে।সব স্থানেই সিকিউরিটি গার্ডদের সাথে সংক্ষিপ্তভাবে পরিচিত হই।কারণ,আমি অন্যান্য ট্যুরিস্টদের মত না।আমি তাদের দেশেরই একটা ইউনিভার্সিটির ছাত্র।অতএব, আমিও যেন একজন জর্ডানী। এখানে এসে সিকিউরিটির সাথে পরিচিত হওয়ার পর উনি আমাকে বসে গল্পগুজব তথা আলাপ আলোচনা করার প্রস্তাব দিলেন।কিছুক্ষনের জন্য রুমের ভিতরেই এক প্রান্তে বসে পড়লাম।
প্রথমে এই সাহাবীর কৃতিত্ব ও তার জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে তার সাথে আলোচনা হল।এরপর দুই দেশের বেশকিছু তথ্য ও উভয় দেশের লাইফ স্টাইল নিয়ে আলোচনা হল।আমাদের দেশের চেয়ে ওদের দেশের জীবনযাত্রা অনেক এক্সপেনসিভ।সে বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ২০ হাজার টাকার মত বেতন পায়।কিন্তু,তারপরেও তার পরিবার পরিচালনা ও সন্তানদের লেখাপড়া করাতে হিমশিম খেতে হয়।
এরপর আসলাম হযরত জাফর (রাঃ)এর কবরের কাছে।সেখানে এসে দেখলাম অন্য রকম কান্ড।
কয়েকজন মহিলা কবরের অত্যন্ত কাছাকাছি স্থানে বসে কুরআন তেলাওয়াত করছে।এরা সাউদী নাগরিক।তাদেরই একজন পুরুষ আত্মীয় জর্ডানে একটি ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।তার সাথেই এরা এখানে বেড়াতে এসেছে।ওই ছেলের সাথে পরিচিত হলাম।জানলাম যে,জর্ডানে তার কাছেই ওরা বেড়াতে এসেছে।হয়ত ওরা শিয়া হতে পারে।সাউদীতে হয়ত এসব করার সুযোগ পায় না।ফলে,জর্ডানে এসে সেগুলোর কাজা আদায় করে নিচ্ছে।
আরেকবার দেখলাম- দুইজন জর্ডানী কবরের পাশে লাশের মাথার দিকে বসে বলছে:- হে জাফর!আমার জন্য শাফায়াত কর। আমাকে দেখে এরা কিছুটা নড়েচড়ে বসল। আমার দিকে উৎসুক দৃষ্টিয়ে তাকিয়ে আছে।মনে করলাম শিয়া কিনা?সালাম দিলাম। উত্তর দিল। পরে পরিচিত হলাম।জানলাম তারা রাজধানী আম্মান থেকে এসেছে। তবে,তারা শিয়া কিনা এটা জিজ্ঞাসা করা সমীচিন মনে করলাম না।
এখানে যারা সিকিউরিটির দায়িত্বে আছে তাদেরকে বললাম- এই যুদ্ধে তিনজন সেনাপতিসহ রাসুল (সাঃ)এর মোট ১২ জন সাহাবী শাহাদাত বরণ করেছিলেন।বাকী ৯ জনকে কোথায় দাফন করা হয়েছে? তারা জবাব দিলেন:তাদের দাফন স্থল অজানা।
যেহেতু, যুদ্ধক্ষেত্রের অত্যন্ত নিকটে ছিলাম তাই, যুদ্ধক্ষেত্র সবসময়ই দেখেছি। দুরের প্রোগ্রাম আগে শেষ করে তারপরেই যুদ্ধক্ষেত্রের ফটোসেশন শুরু করতে হবে এ প্রস্তাব দিলেন হামিদ ভাই। যেন, আমাদের কোন স্পট মিস না হয়। সে জন্য অন্যান্য স্থান থেকে ফিরে এসে বিকাল বেলাতেই যুদ্ধক্ষেত্রের ফটোসেশন সমাধা করলাম।
ফটোসেশন শেষ করে মাগরিবের নামাজের পর যুদ্ধক্ষেত্রের পার্শ্ববর্তী রাস্তায় "মুসা" নামক একজন বেদুইনের সাথে দেখা হল। তাদের লাইফস্টাইল নিয়েও মতও বিনিময় হল। তবে, সে মনে হয় হান্ড্রেড পার্সেন্ট বেদুইন না। কেননা, সে জনসমাজ থেকে খুব দুরে থাকে না। তাকে বড়জোর গ্রাম্য বলা যেতে পারে। তাদের মধ্যে অনেক শিক্ষিতও নাকি আছে। তার বাসস্থান যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ৬/৭ কিলোমিটার দুরে। তার সাথে কথাবার্তা বললাম আর কিছু জানতে চাইলাম যুদ্ধক্ষেত্র সম্বন্ধে।
সে যুদ্ধ সম্বন্ধে বলল যে, এখানে মুসলিম বাহিনী একত্রিত হয়েছিলেন। আর রোমান বাহিনী ছিল সম্পুর্ণ শহর জুড়ে। এরপর সে একটা আশ্চর্যজনক তথ্য দিল। সে বলল: আজ থেকে কয়েক বছর আগেও সুবহে সাদিকের আগে যারা যুদ্ধক্ষেত্রের পাশে আসত তারা অনেকগুলো ঘোড়ার ছোটাছুটি ও অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনতে পেত। ঠিক যুদ্ধের সময় যেমন ঘোড়ার ছুটাছুটি ও অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনা যায় এখানেও ঠিক এমনটিই শুনতে পেত। তবে, সুবহে সাদিক হওয়ার পর আর সেটা শোনা যেত না এবং কোন ঘোড়াও পাওয়া যেত না।
প্রথমে এটাকে মানুষের অতিকথনই মনে করেছিলাম। মনে করেছিলাম যে, এটা মানুষের মুখের গালগল্প ছাড়া আর কিছুই নয়। বাস্তবতা থেকে যা অনেক দুরে। পরে, আরও কয়েকজনের কাছ থেকে একই ঘটনা শুনলাম। তাদের আত্মীয় স্বজনেরা এধরণের শব্দ শুনেছেন এবং এখনও তা বর্ণনা করে থাকেন। আজ থেকে ৪০ বছর আগে নাকি এমনটি ঘটত। পরে সেটাকে সত্য বলে ধরে নিতে আর কষ্ট হল না। এরপরে এখন আর এগুলো শোনা যায় না।
এবার আসি যুদ্ধক্ষেত্রের বর্ণনায়। যুদ্ধক্ষেত্রটার পুর্বদিকে রয়েছে বিশাল মরুভূমি। ওদিকে বেদুইনরা ছাড়া হয়ত আর কোন জনবসতি নেই। এরপরেই সাউদী আরবের এলাকা। আর দক্ষিণদিকে জনবসতি আছে। মাঠের পশ্চিম দিক দিয়ে হাইওয়ে চলে গেছে আকাবা সমুদ্র বন্দরের দিকে। মাঠের উত্তর পশ্চিম দিকে একটা প্রাচীন স্থাপত্য রয়েছে। সেখানে আগেকার ইট-পাথর দিয়ে তৈরি একটি বিল্ডিংয়ের ফাউন্ডেশনের ধ্বংসাবশেষ অবশিষ্ট রয়েছে। তার ভিতরেও মনে হচ্ছে বেশ কয়েকটি ঘরের মত আলাদা আলাদা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা রয়েছে। দক্ষিণদিকে (কিবলার দিকে) একটি মেহরাবের মত রয়েছে। ধারণা করা হয় যে, এটা হয়ত তখন মসজিদ হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছিল। কিন্তু, এগুলোর মধ্যকার পার্টিশনগুলো কি জন্য এ সম্বন্ধে কোন তথ্য উদ্ধার করতে পারলাম না। এগুলোর ইতিহাস সম্বন্ধে জর্ডানীদেরকে জিজ্ঞাসা করলে এদের জবাব ছিল- এ স্থানেই মুসলিম বাহিনী একত্রিত হয়ে অবস্থান করেছিলেন। এর বেশী কিছু ওদের জানা নেই। এগুলোর উত্তর পশ্চিম ও যুদ্ধক্ষেত্রের পাশে রাস্তার সাথেই একটি মসজিদ তৈরী করা হয়েছে। অপর দিকে রোমান বাহিনী ছিল এ মাঠের পশ্চিমে শহরের ভিতরে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
মানুষের কাছে যেগুলো শুনলাম সেগুলোর বাইরে এ যুদ্ধ সম্বন্ধে ভৌগলিক কোন তথ্য উপাত্ত কোথাও পাওয়া যায় কিনা সে সম্বন্ধে অনেককে জিজ্ঞাসা করলাম। কিন্তু, তাৎক্ষনিকভাবে তেমন কিছু পেলাম না। পার্শ্ববর্তী মু'তা ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরীতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলে তারা একটা বইয়ের সন্ধান দিলেন। সেটাতে বেশ কিছু তথ্য পেলাম।
সেখানে একটি তথ্য পেলাম রাসুল (সাঃ) এর সেনাপতি নির্বাচন সম্বন্ধে। সেটা আপনাদের সাথে শেয়ার করা প্রয়োজন মনে করছি। সেখানে বলা হয়েছে- রাসুল (সাঃ) যখন বলেছিলেন: এ যুদ্ধে সেনাপতির দায়িত্ব পালন করবে যায়েদ বিন হারেসা। যদি সে নিহত হয় তাহলে জাফর যদি সে নিহত হয় তাহলে আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রাঃ) সেনাপতির দায়িত্ব পালন করবেন।
'নু'মান" নামক একজন ইহুদী একথা জানার পর রাসুল (সাঃ) এর কাছে এসে বলল: হে আবুল কাসেম (মুহাম্মাদ সা: এর উপনাম)! যদি আপনি নবী হয়ে থাকেন, তাহলে এভাবে (অমুক নিহত হলে অমুক, অমুক নিহত হলে অমুক ) কম কিংবা বেশী যতজনের নাম উল্লেখ করবেন তারা সবাই নিহত হবে। কেননা, বনী ইসরাইলের নবীগণ যখনই কারও নাম এভাবে উল্লেখ করতেন যে, অমুক নিহত হলে অমুক তারা সবাই নিহত হতেন। যদি তারা এভাবে ১০০ জনের নামও উল্লখ করতেন তাহলে তারা ১০০ জনই নিহত হতেন।
এরপর সে যায়েদ বিন হারেসা (রাঃ) এর কাছে গিয়ে বারবার বলতে লাগল: যায়েদ! জেনে রাখ!! মুহাম্মদ (সাঃ) যদি আসলেই নবী হয়ে থাকে তাহলে, তুমি কিন্তু যুদ্ধ থেকে আর কখনও ফিরে আসবে না।
যায়েদ (রাঃ) জবাব দিলেন: আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি তিনি একজন নবী, সত্যবাদী ও পুণ্যবান ব্যক্তি। (গাযওয়াতু মু'তা-লেখক: শাওকী আবু খালীল)
এবার আসুন! আমরা এ স্থানের ক্যামেরা বন্দী বিভিন্ন দৃশ্য দেখে নিই।
ডানদিকে মু'তা যুদ্ধক্ষেত্র।
এখানে লেখা রয়েছে যে, হারেস ইবনে উমাইর আল আজদী (রাঃ) নামক একজন সাহাবীকে চিঠি দিয়ে রাসুল (সাঃ) বুসরা নামক স্থানের সম্রাটের কাছে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু, মু'তা এলাকার শাসক শুরাহবিল ইবনে আমর আল গাসসানি তাকে রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে তারপর হত্যা করে। রাসুল (সাঃ) এর আর অন্য কোন চিঠিবাহককে হত্যা করা হয়নি।রাসুল (সাঃ) এর কাছে তার নিহত হওয়ার খবর পৌঁছালে রাসুল (সাঃ) রোমানদেরকে মোকাবেলা করার জন্য সেনা অভিযান প্রেরণ করলেন। আর এটা ছিল "মু'তার যুদ্ধ"।
এখানেই নাকি মুসলিম বাহিনী একত্রিত হয়েছিলেন। (ইট পাথরের তৈরি বিল্ডিঙয়ের ধ্বংসাবশেষ বলতে এটাকে বুঝিয়েছি।)
নিচে ধ্বংসাবশেষের আরও কিছু ছবি দেখেন।
এটাকে মেহরাব মনে হচ্ছে। ধারণা করা হয় যে, এটা হয়ত তখন মসজিদ হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছিল।
মেহরাবের আরেকটা ছবি।
যুদ্ধক্ষেত্র (উত্তর দিক থেকে তোলা)
যুদ্ধক্ষেত্র (পশ্চিম দিক থেকে তোলা)
যুদ্ধক্ষেত্রের উত্তরও পশ্চিম দিক
যুদ্ধক্ষেত্র (উত্তর দিক থেকে তোলা)
যুদ্ধক্ষেত্রের দক্ষিন দিক। (পশ্চিম দিকের রাস্তা থেকে তোলা)
পশ্চিম দিকে রাস্তা থেকে তোলা।
যুদ্ধক্ষেত্রের দক্ষিণ পশ্চিম দিক থেকে তোলা।
রাস্তার দিক থেকে তোলা।
যুদ্ধক্ষেত্রের দক্ষিণ পশ্চিম দিক থেকে তোলা।
যুদ্ধক্ষেত্রের আরেকটি ছবি। ডানদিকে মসজিদ ও পুরাতন বিল্ডিঙয়ের ধ্বংসাবশেষ।
পশ্চিম দিক থেকে তোলা।
পশ্চিম দিক থেকে তোলা
উত্তর পশ্চিম দিক থেকে তোলা
যুদ্ধক্ষেত্রের পার্শ্ববর্তী মসজিদ। (সন্ধ্যাবেলা তোলা)
মসজিদের আরেকটা দৃশ্য।
যুদ্ধক্ষেত্রের দক্ষিণ দিকের রাস্তা। পশ্চিম থেকে পুর্বে চলে গেছে।
যুদ্ধক্ষেত্রের দক্ষিণ দিকের রাস্তা।
যুদ্ধক্ষেত্রের দক্ষিণ দিকের রাস্তা।
যুদ্ধক্ষেত্রের পশ্চিম দিকের রাস্তা
যুদ্ধক্ষেত্রের পশ্চিম দিকের রাস্তার মাঝখানে
যুদ্ধের তৃতীয় সেনাপতি হযরত আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রাঃ) কে দাফন করা হয়েছে এখানেই।
এখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রাঃ)
রাসুল (সাঃ) এর পালকপুত্র ও যুদ্ধের প্রথম সেনাপতি হযরত যায়েদ বিন হারেসা এবং রাসুল (সাঃ) এর আপন চাচাত ভাই ও মু'তা যুদ্ধের সেনাপতি জাফর (রাঃ) কে দাফন করা হয়েছে এখানেই।
এখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত রাসুল (সাঃ) এর পালকপুত্র ও যুদ্ধের প্রথম সেনাপতি হযরত যায়েদ বিন হারেসা(রাঃ)
এখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত রাসুল (সাঃ) এর আপন চাচাত ভাই ও মু'তার যুদ্ধের দ্বিতীয় সেনাপতি হযরত জাফর(রাঃ)। এক মহিলা কবরের পাশে কুরআন তেলাওয়াত করছে।
জাফর (রাঃ) এর কবরের আরেকটা ছবি।
কয়েকজন জর্ডানী পিচ্চির ছবি তুললাম।
যায়েদ বিন হারেসা (রাঃ) এর কবরের পার্শ্ববর্তী মসজিদ প্রাঙ্গণ
যায়েদ বিন হারেসা (রাঃ) এর কবরের পার্শ্ববর্তী মসজিদ প্রাঙ্গণের আরেকটি ছবি
যায়েদ বিন হারেসা (রাঃ) এর কবরের পার্শ্ববর্তী মসজিদের মিম্বার
আঙ্গুর গাছ
আঙ্গুর গাছ
যাইতুন গাছের ছবি
যাইতুন গাছের ছবি
ইসমাইল একেবি এর ব্লগ থেকে কপি করা হয়েছে
0 comments: