আপনি আবদুল মালেক?
হ্যাঁ তাই, আপনি নিজামী ভাই?
সেদিনের সে কথাগুলো ডায়েরির পাতায় লেখা না হলেও আমার মনের কোণে স্থায়ী আসন করে নিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে যখন আমরা মাত্র ক’জন কর্মী কাজ করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যেতাম তখন মফস্বল থেকে আমাদের বেশ কিছু কর্মী ঢাকায় আসছে দেখে আমরা সবাই আনন্দিত হয়েছি। আবদুল মালেক, নূরুল ইসলাম, আজিজ, ইসকান্দার ও মামুনসহ আরো অনেকে পরীক্ষায় ভালো করায় আমরা বেশ উৎসাহিত হয়েছি। আজিজ ছাড়া আর সবাই ঢাকায় আসবে এ সংবাদ পেয়ে আমরা প্রতীক্ষা করছি। ভর্তির সময় প্রায় শেষ হয়ে আসছে। আবদুল মালেক ছাড়া আমাদের সম্ভাব্য কর্মীদের সবাই এসে গেছে। আবদুল মালেকের অপেক্ষায় আমার মনটা বেশ ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। রাজশাহী ও বগুড়া অঞ্চলে কোনো ছাত্রের সাথে দেখা হলেই তার কথা জিজ্ঞেস করছি। আসবে সে সম্পর্কে নিশ্চিত খবর পেয়েছি। দেরির কারণ জানা যাচ্ছে না। অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। সেদিনের সংগঠনের দুরবস্থা,
কর্মীস্বল্পতা প্রভৃতি কারণে নতুনদের প্রতীক্ষায় আমাদের হৃদয়মন সঙ্গত কারণেই ব্যাকুল হয়ে উঠত।
যতদূর মনে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মুহূর্তে নতুন ছাত্র এবং মফস্বল থেকে আগত কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য কর্মী ছিল মাত্র দু’জন। অন্য দিকে সংগঠনটা সবেমাত্র গুছিয়ে ওঠার পথে। তখন নাজির ভাই কর্মজীবনে পদার্পণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পূর্ব-পাক দফতরে তখন আমরা মাত্র দু’জনে কাজ চালাতাম, নাজেম এবং অফিস সেক্রেটারি। কর্মীস্বল্পতার কারণে পূর্ব-পাক দফতরের দায়িত্ব সম্পাদনের সাথে সাথে আমাকে ঢাকা শহরের কর্মী হিসেবেও কাজ করতে হচ্ছে। এমন সময় নূরুদ্দীন ভাই ঢাকা শহর শাখার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়ার চেষ্টা করছেন। কর্মীস্বল্পতা ও নেতৃত্বশূন্যতার এই মুহূর্তে একযোগে এতগুলো কর্মীর ঢাকা আগমনে আমরা মনে প্রাণে যে আনন্দ অনুভব করছি তা কেবল উপলব্ধিই করা যায়, ভাষায় রূপ দেয়া যায় না।
তখন পূর্ব-পাক দফতর ছিল জয়কালী মন্দির রোডে। আমি ফজর পড়ে অফিসে যেতাম। অফিস থেকে ইকবাল হল পর্যন্ত আসা-যাওয়ার পথে ফজলুল হক হল, এস এম হল ও শহর অফিসে দায়িত্বশীল কর্মীদের সাথে সাক্ষাৎ ও আলাপ-আলোচনা হয়ে যেতো। ঢাকা শহরের কর্মী হিসেবে এর চেয়ে বেশি কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। নতুন সেশনে নতুনদের সাথে যোগাযোগের জন্য তবুও দৌড়াতে হচ্ছে। কলাভবন থেকে বিজ্ঞানভবন, বিজ্ঞানভবন থেকে কলাভবন, কখনো আবার প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেদিন পূর্ব- পাক দফতরে কাজ সেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটো বিল্ডিং পেরিয়ে রেজিস্ট্রার অফিসের পাশ দিয়ে ইকবাল হলে ফিরছি। বেলা তখন ১টা দেড়টা হবে বলেই মনে পড়ে। এই পর্যন্ত সবসময়ই আবদুল মালেকের কথাই মনে করে আসছি। হঠাৎ চার পাঁচজন ছাত্রের এক গ্রুপ রেজিস্ট্রার অফিস থেকে বেরিয়ে তারা পুরাতন পরিষদ ভবনের গেটের পাশে এসে দাঁড়াতেই অকৃত্রিম আন্তরিকতাপূর্ণ পরিবেশে সালাম ও কোলাকুলির মাধ্যমে যে তরুণ মর্দে মুমিনের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়, আবদুল মালেক শহীদ তার নাম। মুসলিম জাহানের অমূল্য রতন ভাগ্যবান এই তরুণের পূর্ণ পরিচয় লাভ করার মতো দিব্য দৃষ্টি আমার ছিল না। তথাপি সততার উজ্জ্বল প্রতীক আবদুল মালেকের মুখপানে চেয়ে সেদিন আমার মনে বিরাট আশা জেগেছিল। সংগঠনের সেই দুর্দিনে আবদুল মালেকের প্রথম দর্শনে জীবনের সকল ক্লান্তি যেন আমি ভুলে গেলাম। সংগঠনের যে শূন্যতা আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলত আবদুল মালেকের প্রতিভাদীপ্ত চেহারা দেখে সে শূন্যতা পূরণের আশা জেগেছিল কি না তা বলতে পারব না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ অনার্স ক্লাস রীতিমতো শুরু হয়েছে।
আমাদের নবাগত কর্মীরা ক্লাসের সাথে সংঘের কাজেও বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে আত্মনিয়োগ করেছে। সেপ্টেম্বরের পাক-ভারত যুদ্ধের মুহূর্তে সংঘের কর্মী-সমর্থক এমনকি সাধারণ ছাত্রদের মধ্যেও ইসলামী জোশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময় সারওয়ার ভাই ও একরাম ভাই ঢাকায় এলেন। প্রদেশব্যাপী কাজকে ছড়িয়ে দেয়ার এক সুন্দর সুযোগ এল। এখন ঢাকায় কর্মীর অভাব অনেকটা দূর হয়েছে। অন্য দিকে প্রদেশব্যাপী কাজ বৃদ্ধির চাপ বেড়ে চলেছে। সুতরাং ঢাকা শহরের কর্মী হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেলাম। এবার পূর্ব-পাক দফতরে পুরোমাত্রায় অফিসিয়াল কাজে আত্মনিয়োগ করতে হচ্ছে। তাই ঢাকায় থেকেও ঢাকার কর্মীদের সাথে সরাসরি পরিচয়ের খুব সুযোগ হচ্ছে না। শহর সভাপতির মাধ্যমেই নবাগত কর্মীদের তৎপরতা ও অগ্রগতি জানার চেষ্টা করছি। আবদুল মালেক একজন নীরব কর্মী, অনেকের কাছ থেকে তা জানা যাচ্ছে। এখন থেকে ঢাকার বৈঠকগুলোতে যোগদানের সুযোগ হচ্ছে না। মাঝে মধ্যে বড় কষ্টে সময় করে নিচ্ছি। এক বৈঠকে ইসলামী বিপ্লবের পথ এই বিষয়ের ওপর আবদুল মালেকের বক্তৃতা শুনলাম। একজন নতুন কর্মীর কাছ থেকে এ কঠিন বিষয়ে এমন সুন্দর বক্তৃতা আমার জন্য ছিল একেবারে অপ্রত্যাশিত। বিশেষ প্রয়োজনীয় মুহূর্ত ছাড়া আবদুল মালেকের সাথে আলাপ-আলোচনার সুযোগ হচ্ছে না। কারণ বিনা প্রয়োজনে ঊর্ধ্বতন সংগঠনের কর্মীদের সাথে আলাপের মাধ্যমে নিজেকে প্রদর্শন করা ছিল তার স্বভাবের সম্পূর্ণ বিপরীত কাজ।
মাত্র তিন মাসের মধ্যে আবদুল মালেক একজন দায়িত্বশীল ও নির্ভরযোগ্য কর্মী হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন। এখন তিনি ঢাকা শহর শাখার অফিস সম্পাদক। অতি অল্পদিনে শহর শাখার অফিসের চেহারা পাল্টে গেছে। শাখা ও প্রশাখার কার্যক্রমের সুষ্ঠু রেকর্ড যেমন খাতাপত্রে সুরক্ষিত হচ্ছে, তেমনি তা সুরক্ষিত হচ্ছে আবদুল মালেকের মন-মগজে। আবদুল মালেকের সহযোগিতায় ঢাকা শহর শাখার পর পর তিনজন সভাপতি যত সহজে বিরাট দায়িত্ব পালন করেছেন তেমন আরামে ও গুরুদায়িত্ব পালনের সুযোগ কোনোদিন কেউ পেয়েছে বলে আমার জানা নেই।
সত্যিই অতুলনীয় প্রতিভার অধিকারী হয়েও আবদুল মালেক একজন নীরব কর্মী। যশ ও খ্যাতির বিন্দুমাত্র মোহ ছিল না তাঁর মনে। নিজের যোগ্যতা ও প্রতিভাকে লুকিয়ে রেখে নীরবে কেবল কাজ করে যাওয়াতেই ছিল তাঁর তৃপ্তি। জিঞ্জিরায় সংঘের শিক্ষাশিবির হচ্ছে। রমজান মাসে দেড় শতাধিক কর্মীর সে শিবিরে ব্যবস্থাপনা করতে হচ্ছে ঢাকার কর্মীদেরকে। আবদুল মালেককে খাদ্য ও পানি সরবরাহ ও পরিচ্ছন্নতা প্রভৃতি কয়েকটি বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করতে হচ্ছে। কাজের ধরন দেখে মনে হচ্ছে তিনি কেবল শারীরিক পরিশ্রমই করতে জানেন। হঠাৎ কর্মীদের বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় সে ভুল ভেঙে গেল। প্রদেশব্যাপী কর্মীদের এই প্রতিযোগিতায় আবদুল মালেক তৃতীয় স্থান দখল করলেন।
এরপর ইনকিলাবের যুগ। সংঘের পক্ষ থেকে সাহিত্য সঙ্কলন বের করা হবে। কিন্তু লেখক কোথায়?
সারওয়ার ভাই অত্যন্ত পেরেশান হয়ে ফিরছিলেন। অনেক কর্মী ও শুভাকাক্সক্ষীকে চাপ দিয়ে চিঠি লিখেছি। লেখা সময় মতো আসছে না। অথচ সঙ্কলনটা সময়মতো তাড়াতাড়ি বের করতেই হবে। আমি অফিসের ঝামেলা সেরে বেশ একটু সকালেই হলে ফিরছি। হঠাৎ সারওয়ার ভাই বেশ উৎফুল্ল মনে আমার কামরায় গিয়ে হাজির হন। মালেক ও মামুনের দুটো লেখা পেয়ে তিনি যে আনন্দ পেয়েছিলেন তা প্রকাশ করার জন্য আমার কামরায় গিয়েছিলেন কি না বলতে পারি না। তবে সেদিনের আলোচনায় লেখা দুটোর প্রসঙ্গ ছাড়া অন্য কিছু স্থান পায়নি। এভাবেই একটি প্রচ্ছন্ন প্রতিভার প্রতি ধাপে ধাপে আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হতে থাকে। আলোচনার ফাঁকে একদিন হঠাৎ কে যেন মন্তব্য করল আবদুল মালেক কিছুটা নিরাশাবাদী। কাজ করা দরকার করতে হবে, কিন্তু আন্দোলনের সাফল্য এ যুগে কী করে সম্ভব? এমন চিন্তা নাকি তিনি মাঝে মাঝে করে থাকেন। মূল ব্যাপারটা জানার সিদ্ধান্ত নিলাম।
হল সংসদের নির্বাচনের পর মুহূর্তটাই এজন্য সর্বোত্তম সময় হওয়ার কথা। নির্বাচনী ফলাফলকে সামনে রেখে আবদুল মালেক তার বন্ধু বান্ধবদের সাথে আলাপ করছেন। ঘটনাক্রমে আমার কানে একটি দৃঢ় প্রত্যয়যুক্ত আওয়াজ ভেসে এল, আসলে মালেক ভাইয়ের কথাগুলো হতো সুষ্ঠু ও বাস্তবভিত্তিক। সুতরাং তাঁকে যাচাই করতে গিয়ে যারা তাড়াহুড়া করে মন্তব্য করেছেন তারা তাঁকে বুঝেই উঠতে পারেননি। হ্যাঁ, আবদুল মালেক সহজে ধরা দেয়ার মতো ছিলেন না। তাই তাকে বুঝতে হলে গভীর অন্তর্দৃষ্টির প্রয়োজন হতো, নতুবা অতি নিকটে এসে তার সাহচর্য লাভ করতে হতো।
ইসলামী আন্দোলনের একজন উদীয়মান কর্মী হিসেবে তাঁর মন ছিল মানবতার দরদে ভরপুর।
দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের অবস্থা জানাও ছিল তাঁর অন্যতম কার্যসূচি। ঈদুল আজহা উপলক্ষে কর্মীরা বাড়ি যাচ্ছে। রাতের ট্রেনে আবদুল মালেক বাড়ি যাবেন শুনেছি। দু-একদিনের মধ্যে দেখা হয়নি। সময় মতো স্টেশনে গিয়ে হাজির হলাম। আবদুল মালেককে খুঁজে পেতে বেশ সময় লেগেছে। কারণ তিনি মধ্যম শ্রেণীতে ওঠেননি। আমাকে দেখে তিনি বেশ অপ্রস্তুত হলেন। আমার স্টেশনে যাওয়া তার কাছে কেমন যেন লেগেছে। বেশ একটু জড়সড় হয়ে বলতে লাগলেন, আপনি স্টেশনে আসবেন জানলে আমি যে করেই হোক দেখা করেই আসতাম। অবশ্য একবার খোঁজ করেছি, আপনাকে পাইনি। আমি কথাগুলোর দিকে কান না দিয়ে কামরটার দিকে ভালো করে দেখছিলাম। তিল ধারণের জায়গা নেই।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হবে সারারাত। আমি চেষ্টা করলাম ইন্টারে জায়গা করে দেয়ার। টিকেটের ঝামেলাও চুকিয়ে দেয়া যেত। কিন্তু রাজি করানো সম্ভব হলো না। আবদুল মালেক অকপটে বলে ফেললেন এই লোকগুলোর সাথে আলাপ করলে আমার ভালো লাগবে। তখনো বুঝতে পারিনি কত মর্যাদাবান ব্যক্তির কাছে এই কথাগুলো শুনেছি।
একছর শেষ না হতেই আবদুল মালেক সংঘের সদস্যপদ (রুকন) লাভ করলেন। এখন তিনি সংঘের প্রথম কাতারের কর্মীদের একজন। এত দ্রুত যারা অগ্রসর হয় তাদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত তাল সামলাতে পারে না। কিন্তু আমরা আবদুল মালেকের মধ্যে এর বিন্দুমাত্র ছাপ লক্ষ্য করিনি। ইতোমধ্যে আবদুল মালেক আন্দোলন ও সংগঠনকে বোঝার দিক দিয়ে অনেকের চেয়ে অগ্রসর হয়েছেন। তাঁর চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মীর অধীনে কাজ করতে আবদুল মালেকের মনে মোটেই সঙ্কোচ নেই। আনুগত্যের ক্ষেত্রে তাঁর এ আদর্শ সংঘকর্মীদের জন্য একটি স্থায়ী উদাহরণ।
এ পর্যন্ত আবদুল মালেককে নিকট থেকে দেখার সুযোগ হয়নি। ১৯৬৫-৬৬ সেশন শেষ হয়ে আসছে।
আর মাত্র এক মাস পরই নতুন সেশন শুরু হবে। মুজিবের অনার্স এবং হাফিজুল্লাহ ভাইয়ের ফাইনাল পরীক্ষা। ঢাকা শহর শাখার কাজ তদারকের জন্য পূর্ব-পাক দফতরেও তখন সারওয়ার ভাই, একরাম ভাই পরীক্ষার্থী। এক মাসের জন্য আমাকে ঢাকার কাজ দেখাশোনা করতে হবে। মনে করলাম দিনে ঢাকার কাজ দেখাশোনা করে রাত জেগে পূর্ব-পাক দফতরের কাজ সারতে হবে। কিন্তু আবদুল মালেকের সহযোগিতায় আমাকে বেগ পেতে হয়নি মোটেই। সারাদিনের পরিবর্তে এক ঘণ্টা দুই ঘণ্টা সময় দিয়ে আমি বেঁচে গেছি। নিজ হাতে তেমন কিছুই আমাকে করতে হয়নি। সামান্য কিছু বুঝিয়ে দিয়েই আমি পূর্ব-পাক দফতরে যথারীতি আমার কাজ করেছি। আবদুল মালেকের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ও কর্মকুশলতায় প্রতিটি কাজই হয়ে যেতো। দায়িত্বানুভূতি ও স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল আবদুল মালেকের।
আন্তরিক প্রচেষ্টায় ও অদ্ভুত কর্মকুশলতায় প্রতিটি কাজই হয়ে যেতো। দায়িত্বানুভূতি ও স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল আবদুল মালেকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম দিক। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে একদিন ঢাকায় প্রবল বৃষ্টি হয়ে গেল। আগামসি লেনস্থ সংঘের পূর্ব-পাক দফতর থেকে বেরোবার উপায় ছিল না আমাদের। বস্তির লোকেরা বিশ্ববিদ্যালয় পুরাতন কলাভবন, হোসেনী দালান ও সিটি ল কলেজে আশ্রয় নিয়েছে। আমি কোনো মতে ফজলুল হক হলে গেলাম। ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে আমরা কী করতে পারি সে সম্পর্কে পরামর্শ করাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। এ প্রসঙ্গে কথা ওঠার আগেই আবদুল মালেকের মুখে খবর পেলাম ঢাকা শহর অফিসে পানি উঠেছে। বৃষ্টি একটু থেমে যেতেই তিনি অফিসে গিয়ে সব দেখে এসেছেন। অধিক পানি ওঠায় কাগজপত্রাদি সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবদুল মালেক এগুলো সব ঠিকঠাক করে এসেছেন। তাঁর দায়িত্ব সচেতনতার এ চাক্ষুষ প্রমাণটুকু আমার পক্ষে কোনদিনই ভুলে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তারপর কর্মী বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়ে একদিন নিউমার্কেট ও আরেক দিন জিন্নাহ এভিনিউয়ে রোড কালেকশন করা হলো। অল্প সময়ে কর্মীদেরকে জমায়েত করে এত বড় কাজ আঞ্জাম দেয়ার মতো আর কোনো কর্মীই ছিল না। আমার তো কাজ ছিল শুধু কাগজের টুকরায় কিছু নোট লিখে অথবা আধঘণ্টা পনের মিনিটের আলাপে মোটামুটি কিছু বুঝিয়ে দেয়া। আবদুল মালেকের সুদক্ষ পরিচালনায় সংগৃহীত অর্থের নিখুঁত হিসাব পেলাম। সিকি, আধুলি, পাই পয়সা থেকে নিয়ে কত টাকার নোট কতটি, তার হিসাবের ব্যবস্থাও তিনি করে রেখেছিলেন। এরপর তিন দিন তিন রাত একটানা পরিশ্রম করে আবদুল মালেক অল্পসংখ্যক কর্মী নিয়ে চাল বণ্টনের কাজ সমাধান করে ফেললেন।
সেদিন আবদুল মালেককে স্বচক্ষে অমানুষিক পরিশ্রম করতে দেখেছি। আর মুরব্বি সেজে পরামর্শ দিয়েছি কাজটা আর একটু সহজে কিভাবে করা যায়। এই ভাগ্যবান ব্যক্তির পরিশ্রমকে লাঘব করার জন্য সেদিন তার সাথে মিলে নিজে হাতে কিছু করতে পারলে আজ মনকে কিছু সান্ত্বনা দিতে পারতাম।
অক্টোবর থেকে ১৯৬৬-৬৭ নয়া সেশন কাজ শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে ঢাকা এবং পূর্ব-পাক সংগঠনের নেতৃত্বের অভাব প্রকট হয়ে দেখা দেবে তা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। ঢাকার তৎকালীন সভাপতি মুজিব অনার্স পরীক্ষা শেষ করে এমবিএ পড়ার উদ্দেশে করাচি চলে যাচ্ছে। ঢাকায় সিনিয়র কর্মী নেই বললেই চলে। অন্যত্র থেকে নেতৃত্বের অভাব পূরণ করা যায় কি না আলোচনা চলছে। ঢাকা শহর শাখার বার্ষিক নির্বাচন পিছিয়ে দেয়া হয়েছে প্রায় এক মাস। কেন্দ্র থেকে তাগিদ আসছে। কিন্তু আমরা কিছুই যেন ঠাওর করতে পারছি না। সারওয়ার ভাই অবশ্য চিন্তা করেছিলেন শেষ পর্যন্ত পূর্ব-পাক দফতর থেকেই কোনো একজনকে ঢাকা শহর শাখায় দিয়ে দেবার কথা। ঢাকায় তখন সদস্যসংখ্যা একেবারেই সীমিত। এর মধ্যে চিন্তা ও কাজের দিক দিয়ে আবদুল মালেকই ছিলেন অগ্রসর। একদিকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, তদুপরি সদস্য হয়েছেন মাত্র কয়েক মাস আগে। সুতরাং এত তাড়াতাড়ি তার ওপর বিরাট কোনো জিম্মাদারি চাপালে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা নষ্ট হয় কি না সে প্রশ্নটাও কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। সারওয়ার ভাইয়ের নির্দেশে আমি ঢাকায় সদস্যদের সাথে ব্যক্তিগতভাবেও সমস্যা সম্পর্কে আলাপ করলাম। এ এ সুযোগে সংগঠনের বর্তমান- ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আবদুল মালেকের চিন্তার গভীরতার সাথে আন্দোলনের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য যে বলিষ্ঠ যোগ্য ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের প্রয়োজন সে কথা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু এমন নেতৃত্ব আমাদের মধ্যে না থাকলে আমরা কাজ করবো না এমনও হতে পারে না। আমাদের মধ্য থেকে অপেক্ষাকৃত অভিজ্ঞ এবং সিনিয়র যে কোনো একজনকে সামনে রেখে আমরা কর্মীরা যদি পূর্ণ দায়িত্বানুভূতি নিয়ে কাজ করে যাই তা হলে এ অভাব অবশ্যই পূরণ হয়ে যাবে। এ ধরনের একটা বিজ্ঞচিত উক্তি শুনে আমরা অন্য চিন্তা বাদ দিয়ে আল্লাহর ওপর নির্ভর করে ঢাকা শহর শাখার নির্বাচন দিয়ে দিলাম। ফজলু ভাই নির্বাচিত হয়ে অত্যন্ত ভীত ও শঙ্কিত হলেন। মাঝে মধ্যে দু-একবার অব্যাহতি পাওয়ার চেষ্টাও করলেন। শেষ পর্যন্ত কর্মী গঠনের কাজটাও এ সেশনেই ভালো হয়েছে বলে আমার ধারণা। এ সেশনে আবদুল মালেক শাখা সম্পাদক হিসেবে সংঘের মেরুদণ্ডের ভূমিকা পালন করলেন।
১৯৬৬-৬৭ সালের নতুন সেশন শুরু হয়েছে। কিন্তু বিগত সেশনের ন্যায় কাজে যেন গতি আসছে না।
একই যোগে ঢাকা শহর পূর্ব-পাক সংগঠনের নেতৃত্বের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। মুজিব সবেমাত্র তৈরি হতেই বিদায় নিয়েছে। সারওয়ার ভাইতো উল্কার বেগে এসে উল্কার মতোই চলে গেলেন। প্রাক্তন কর্মীদের থেকে শুরু করে সংঘের সর্বস্তরের কর্মী ও শুভাকাক্সক্ষী মহল এতে বিস্মিত হলেন। সারওয়ার ভাইকে রাখার শেষ চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর আমি একরাম ভাইকে সামনে রেখে কাজ শুরু করে দিয়েছি।
সম্মেলন ও মাহে রমজানের সার্কুলার একরাম ভাইয়ের নামে ইস্যু করা হলো। ইতোমধ্যে সারওয়ার ভাই চট্টগ্রাম থেকে এসে গেলেন। তিনি এবার গঠনতান্ত্রিকভাবে কাউকে কার্যকরী সভাপতি করে বিদায় নেয়ার উদ্দেশ্যেই আসছিলেন। গত এক বছরের সাংগঠনিক জীবনে সারওয়ার ভাইয়ের সাথে খুঁটিনাটি সব বিষয়ে আমার আলাপ হতো বেশি। কিন্তু এবারে কিছুটা ব্যতিক্রম লক্ষ্য করলাম। আমাবে ডিঙিয়ে পর্দার আড়ালে কিছু একটা হচ্ছে বলে মনে হলো। সারওয়ার ভাই সংঘের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সম্পর্কে এদিক ওদিক কিছু সলাপরামর্শ করেছেন। ফজলু ভাই, ফোরকান ভাই ও মালেক ভাইয়ের ব্যক্তিগত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তিনি একটা ফয়সালা করে ফেললেন বলেই আঁচ করা গেল। পরদিন কার্যকরী পরিষদের জরুরি অধিবেশনে সারওয়ার ভাই ছুটি নিলেন। আর আমাকে কার্যকরী সভাপতি নিযুক্ত করা হলো। ব্যাপারটা ভীষণ খাপছাড়া লাগল আমার কাছে। কারণ ১৯৬৩ থেকে ৬৬ পর্যন্ত সংঘের কেরানিগিরির কাজ ছাড়া আমার অন্য কোনো ভূমিকা ছিল না। পাঁচ-দশজনের একটি কর্মী বৈঠক চালানোর অভিজ্ঞতাও হয়নি। সংঘের নিজস্ব প্রোগ্রামে মাঝে মধ্যে দারসে কুরআন ও দারসে হাদিস দেয়া ছাড়া সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে এ পর্যন্ত বক্তৃতা দেয়ার তেমন একটা সুযোগ আসেনি। এখন হঠাৎ করে প্রদেশব্যাপী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে হবে এটা কি সম্ভব? সাংগঠনিক শৃঙ্খলার খাতিরে পরিষদের সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নিলেও এটাকে নির্ভুল সিদ্ধান্ত বলে আমার মনে আস্থা আসেনি। সম্মেলনে আজমে আলা সদস্যদের অভিমত নিয়ে নতুন সভাপতির নাম ঘোষণা করবেন, সে মুহূর্তে নিশ্চিয় আমি বেঁচে যাব এমন একটা বদ্ধমূল ধারণা নিয়ে আমি কাজ চালিয়ে যেতে লাগলাম।
সম্মেলন আরম্ভ হয়েছে ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে। ৮ তারিখ পর্যন্ত প্রস্তুতির দিকে ভালোভাবেই নজর নিয়েছি। ৯ থেকে ১০ তারিখের দ্বিপ্রহর পর্যন্ত কোন কিছু করতে পারিনি। বেলা তিনটার সম্মেলন উদ্বোধন হলো। তার আগে নাজেমে আলার পরিচালনায় পূর্ব-পাক। সভাপতি হিসেবে আমাকে শপথ নিতে হলো।
বিরাট সম্মেলনের নিয়মশৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাপনার দিকে মনোযোগী হতে পারিনি। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় অনেকটা উদাসীনভাবে চারটা দিন কেটে গেল। এ ফাঁকে সম্মেলনের পরিবেশও অনেকটা নষ্ট হলো। সম্মেলন-উত্তরকালে তার প্রভাব দু-এক জায়গায় মারাত্মক আকার ধারণ করল। এ সময়টা সংগঠনের জন্য যেমন ছিল অগ্নিপরীক্ষার মুহূর্ত তেমনি আমার নিজের জন্যও। সেদিন আবদুল মালেকের আন্তরিক সহযোগিতা ও সুচিন্তিত পরামর্শ না পেলে হয়তো আমার পক্ষে আন্দোলনে টিকে থাকাও সম্ভব হতো না।
সম্মেলন শেষ হওয়ার পর পর বেশ কয়কটি জায়গা সফর করে এলাম। কর্মীদের অনেকের মন্তব্য শুনলাম। যে কয়জন নীরব কর্মীর আন্তরিক প্রচেষ্টা ও বিচক্ষণতার কারণে সম্মেলন শেষ পর্যন্ত সার্থক হয়েছিল আবদুল মালেকের নাম তাদের শীর্ষভাগে। প্রথম সফর থেকে ঢাকায় ফিরে ফজলুল হক হলে গিয়েছি। আবদুল মালেক আমার থেকে বাইরের খবর জানলেন এবং ঢাকার অবস্থা জানাতে চেষ্টা করলেন। ঢাকার কোনো এক উপশাখায় আমাকে কেন্দ্র করে মারাত্মক একটা কিছু হয়ে গেছে, আরো হতে যাচ্ছে বলে খবর পেলাম। সেদিকে কোনো কান না দিয়ে সফরের দ্বিতীয় পর্বের দিকে মনোযোগী হলাম। আমার অনুপস্থিতিতে ঢাকার পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়েছে। দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সবাই স্বীকার করছেন। ব্যাপারটা আমাদের সংগঠনিক শৃঙ্খলার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। কিন্তু একে স্থায়ীভাবে প্রতিহত করার জন্য কোনো পদক্ষেপ নিতে কেউ সাহস পাচ্ছে না। আমার কাছে ব্যাপারটা অত্যন্ত পরিষ্কার ছিল। ঢাকা এবং পূর্ব-পাক সংগঠনের নেতৃত্বকে দুর্বল এবং অসহায় মনে করে সংগঠনকে ক্ষতিগ্রস্ত করার মানসে কিছু সংখ্যক অকর্মী কর্মী সেজে এ অপচেষ্টা চালাচ্ছে। বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিয়ে এগুলো দমন করার জন্য যখন দায়িত্বশীল কর্মীদেরকে রাজি করাতে পারিনি তখন দায়িত্ব ছেড়ে সরে পড়ার মনোভাব আমার প্রবল হয়েছিল। আমার হাতে সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আগে আমি সরে পড়ি, তারপর যাদের ওপর দায়িত্ব আসবে তারা পারলে সংগঠনকে বাঁচাবেন নতুবা নিজেরাই দায়ী হবেন।
এমন বাজে চিন্তা আমার মনে একাধিকবার এসেছে। সংগঠনজীবনে এ ছিল আমার সবচেয়ে দুর্বল মুহূর্ত। আবদুল মালেকের একক হস্তক্ষেপের ফলে সেদিন দরবেশী কায়দায় এহেন শয়তানী ওয়াসওসা থেকে আমি রক্ষা পেয়েছিলাম। কাজের বিভিন্ন পর্যায়ে আবদুল মালেকের কাছ থেকে সবচেয়ে উন্নত পরামর্শ পাচ্ছি অথচ সে মজলিসে শূরায় নির্বাচিত হয়নি। কারণ সদস্য হিসেবে তিনি নতুন, সেই সাথে নীরব কর্মী হিসেবে তিনি অনেকটা অপরিচিতও। মজলিসে শূরার প্রথম সাধারণ অধিবেশনে তাকে বিশেষভাবে ডাকা হলো। এতে সংগঠনকে বির্যয়ের হাত থেকে বাঁচানোর একটা চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে তার কাছ থেকে বেশির ভাগ সহযোগিতা পেলাম। শূরায় তার ভূমিকা দেখে তাকে পরে মনোনয়ন দান করা হয়েছিল। তারপর প্রদেশব্যাপী কাজের পরিকল্পনা গ্রহণের পালা। সংগঠরে দাবি অনুযায়ী কাজ অনেক করা দরকার। কিন্তু আমিসহ পূর্ব-পাক সংগঠনের চারজন কর্মী বিএ পরীক্ষার্র্থী।
একই সময়ে আবদুল মালেকেরও ঝঁনংরফরধৎু পরীক্ষা। শূরার সদস্যরা পরীক্ষা দেখে তেমন কোনো প্রোগ্রাম না নেয়ার দিকে রায় দিচ্ছেন। আবদুল মালেকের সম্মতিক্রমে আমি ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত হলাম। শেষ পর্যন্ত সেশনের দুটো উল্লেখযোগ্য প্রোগ্রাম স্কুল কর্মীদের শিক্ষা শিবির ও বিশিষ্ট কর্মীদের শিক্ষা শিবিরের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় বেশির ভাগ ঝুঁকি নিলেন আবদুল মালেক। সংগঠনের নাজুক পরিস্থিতিকে লক্ষ্য করে মন-প্রাণ দিয়ে পরিশ্রম করে চলেছেন আবদুল মালেক। সংগঠনের প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি জানার চেষ্টা করেছেন তিনি। এ বছর ঢাকা শহর শাখার তিনটি পাঠকচক্র পর্যায়ক্রমে পরিচালনা করতে হয়েছে আমাকে। পাঠচক্রের সদস্যদের কাছ থেকে সে চক্রের অবস্থা জেনে নিচ্ছে যোগদানকারীদের অবস্থা। শাহাদাতের পূর্ব পর্যন্ত যতবার সফর থেকে এসেছি, প্রায় প্রতিবারই তিনি অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে বিভিন্ন শাখার অবস্থা জানার চেষ্টা করেছেন। প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতেও সঙ্কোচ করেননি কোনোদিন।
১৯৬৭-৬৮ সেশন শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত তিনটি শিবিরের ব্যবস্থাপক হিসেবে আবদুল মালেকের যোগ্যতার প্রচ্ছন্ন রূপটি কর্মীদের সামনে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। বিগত সেশনে তিনি প্রাদেশিক মজলিসে শূরায় নির্বাচিত হননি। এবারে তিনি কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য। দ্রুতগতিতে আন্দোলনের এত সামনে আসা তার কাছে ভালো লাগেনি। আবদুল মালেকের মনে একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম।
নিজের প্রদর্শনী (চৎড়লবপঃরড়হ) হয় এমন যে কোনো প্রোগ্রাম এবার এড়িয়ে যেতে তিনি বদ্ধপরিকর। তার এরূপ অনমনীয় মনোভাব আর কোনোদিন লক্ষ্য করিনি। ব্যাপারটা অবশ্য আমার বুঝতে বাকি রইল না। কিন্তু খুব সহজে এটাকে আমল দিতে চাইনি। কার্যকরী পরিষদের এক বৈঠকে স্কুলকর্মীদের প্রোগ্রাম দেয়ার জন্য আমি জোর করছিলাম। পরিষদ সদস্যদের সবাই চাপ দেয়ার পরও তিনি রাজি হচ্ছেন না। এ ছিল তার সঙ্ঘ জীবনের একটা ব্যতিক্রম ঘটনা। মজলিসে শূরার ফয়সালা হিসেবে পেশ করার পর অবশ্য তিনি মৌন সম্মতি জানালেন। একদিন পর হঠাৎ আমার হাতে একটা এনভেলাপ এল। খুলে দেখি ওটা তার মজলিসে শূরা থেকে ইস্তফাপত্র। আমি বিশেষ কোনো চিন্তা না করে ওটা প্রত্যাখ্যান করলাম। পরে আবার একটা বিরাট পত্র এল যা পড়ার মতো ধৈর্য আমার ছিল না। আমি সরাসরি আলাপ করতে গেলাম। ফজলুল হক হলে পুকুরপাড়ে কয় ঘণ্টা আলাপ হলো হিসাব নেই।
তিনি বলেন, ইসলামী আন্দোলনের জন্য নৈতিক ও মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন তার কিছুই আমার নেই। অথচ অনেক বেশিই আমাকে সামনে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এটা আন্দোলনের জন্য ক্ষতিকর হবে এবং আমার নিজের জন্যও। এ অভিযোগের জবাব আমি কী দিয়েছিলাম মনে নেই। তবে সরাসরি কুরআন হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে কথা না বলা পর্যন্ত তার মত পরিবর্তন করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।
পরিশেষে ইস্তফাপত্র ......করতে সম্মত হলেন তিনি। এরপর থেকে আর এরূপ মনোভাব তেমন একটা লক্ষ্য করিনি।
১৯৬৮-৬৯ এর সেশন শুরু হয়েছে। এবার আবদুল মালেক ঢাকা শহর শাখার সভাপতি। কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের নিখিল পাকিস্তান ভিত্তিতে নির্বাচিত তিন সদস্যের তিনি অন্যতম। গণ-আন্দোলনের কর্মমুখর এই বছরে বহুমুখী কার্যক্রমের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে তিনি তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। মনের দিক দিয়ে অনেক সরল ও মজবুত আবদুল মালেককে অপেক্ষাকৃত একটু বেশি কোমল মনে হচ্ছে। গত ক’বছর তার সাথে আমার সম্পর্ক অনেকটা সহকর্মী ও সহপাঠী পর্যায়ের। এবারে কিভাবে তা ছোট ভাই বড় ভাইয়ে রূপ নিলো তা বুঝে উঠতে পারিনি। এখন থেকে আবদুল মালেক প্রাদেশিক দফতরে মাসিক রিপোর্ট অথবা পরিকল্পনার কপির সাথে ছোট একটি চিঠিও দিয়ে দেন যার শেষে লেখা থাকে আপনার স্নেহের ছোট ভাই আবদুল মালেক। তার সারা জীবনের ভালোবাসাটুকু অন্তর নিংড়িয়ে দিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন কি না কে বলবে? প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ডেমরার অগণিত জানমালের ক্ষতি হয়েছে। সংঘের পক্ষ থেকে সেখানে রিলিফ ওয়ার্কে যেতে হবে। ঢাকায় কর্মীদের নিয়ে আবদুল মালেক হাজির। সেখানকার অবস্থা দেখাশোনা ও কায়িক পরিশ্রম যা কিছু করা যায় তার প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে কর্মীদের পাঠিয়ে দিলেন তিনি। কিন্তু ক্ষুধার জ্বালায় যেখানে মানুষগুলো হাহাকার করছে সেখানে খালি হাতে যেতে মালেক রাজি হচ্ছেন না। মনটা তার বেশ ভারাক্রান্ত। কোনো মতে সম্মেলন ফান্ড থেকে টাকার ব্যবস্থা করে দেয়া হলো। মালেক পাউরুটি নিয়ে ডেমরা যাবেন। আমি কাউসার হাউজে গিয়েছি। হঠাৎ এক টেলিফোন এলো। বিশেষ কোনো কথা নয়। কিছু একটা সাথে নিয়ে যেতে পারছে বলে মনটা একটু হালকা হয়েছে। এবার আমার মনটা হালকা করা দরকার। তাই নিজামী ভাই বলে ডাক দিয়েছেনÑ এই আর কি! কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের বৈঠক উপলক্ষে করাচি যেতে হবে। অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে পূর্ব পাকিস্তানি সদস্যদের সকলের যোগদান সম্ভব নয়। আমার সাথে আর যে কোনো একজনের যেতে হবে। আবদুল মালেককেই সাথে নেয়ার সিদ্ধান্ত হলো। এতে আপত্তি থাকলেও শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন। বিমানে উঠে তার থেকে দুটো নতুন জিনিস পেলাম। বিগত আন্দোলনের গতিধারা বিশ্লেষণ করে সামনের পদক্ষেপ সম্পর্কে উচ্চাঙ্গ আলাপ হলো। এর আগের ঘটনাটি ছিল শিক্ষণীয়। বিমানে উঠেই দু’জনে দু’টি পত্রিকা হাতে নিয়েছি। আমার চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী পত্রিকার প্রথম আর শেষ পাতায় চোখ বুলিয়েই এবার আবদুল মালেকের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছি। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখি তিনি পত্রিকার দুটো বিশেষ খবর নোট করছেন। মিষ্টি হাসি হেসে আমার কাছে আরো কয়েকটি মিনিট সময় চেয়ে নিলেন তিনি।
কেন্দ্রীয় মজিলেস শূরার অধিবেশন থেকে ফিরে এসেছি। প্রদেশব্যাপী ব্যাপক প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে।
নূরুল ইসলাম পরীক্ষার্থী বলে এবার সফর একাকীই করতে হচ্ছে। সফরে যাবার আগে আবদুল মালেকের সাথে দেখা করে যাই। আর ফিরে এলে তিনি আমার ..... জানার চেষ্টা করেন। এখন থেকে তার সততাদীপ্ত চাহনি আর আন্তরিকতাপূর্ণ কথা আমার মনের ওপর নতুন ধরনের প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। প্রাদেশিক মজলিসে শূরার বৈঠকের মাত্র দু-একদিন আগে হঠাৎ করে আবদুল মালেক বাড়ি যাবেন বলে শুনলাম। ব্যাপারটা কেমন যেন লাগল। আমি ডেকে জিজ্ঞেস করলাম। মনটা বেশ ভারাক্রান্ত মনে হলো তার। বাড়ি যাওয়াটা প্রয়োজন মনে করছি। কিন্তু আপনাকে না বলে বাড়ি যাচ্ছি এ কথা বলতে পারি না মালেক উত্তর করলেন। ছোটোখাট কারণে তিনি বাড়ি যেতে পারেন না। সুতরাং তাকে বাধা দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু এক দিকে তার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা ঘনিয়ে এসেছে অন্য দিকে তার অনুপস্থিতিতে মজলিসে শূরার গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশন হবে এটা আমার কল্পনা করাও ছিল অসম্ভব ।
তার কারণটা জানতে চাইলাম। কী যেন একটা স্বপ্ন দেখে তিনি বাড়ি যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়েছেন।
সংগ্রামী জীবনে আমরা স্বপ্নকে এরূপ গুরুত্ব দিতে পারি না, বাস্তবে কিছু ঘটে থাকলে সেটা স্বতন্ত্র কথা, বাড়ি গেলে বেশ সময় যাবে। বরং টেলিগ্রাম করে প্রকৃত অবস্থা জেনে নিলেই তো ভালো হয়। আমার মুখ থেকে এতটুকু কথা বের হতেই মালেকের চোখে মুখে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। পরে আমি নিজেই তাকে বাড়ি যাওয়ার জন্য কয়েকবার চাপ দিয়েছি। মালেক উত্তর দিয়েছেন, এখন না গেলে চলবে, বাড়ি থেকে চিঠি পেয়েছি। কে জানত যে শহীদ হয়েই তিনি মায়ের কাছে ফিরে যাবেন।
মজলিসে শূরার পরিকল্পনা অনুসারে ৯ আগস্ট আমার সফরসূচি শেষ হয়েছে। ১০ আগস্ট ভোরে ঢাকায় পৌঁছেছি। একটানা আড়াই মাস সফর শেষে ক্লান্ত হয়েছি বেশ। সারাদিন আর বাইরে বের হতে পারিনি।
মালেকও অন্যান্য বারের মতো প্রাদেশিক অফিসে এসে খোঁজ নেননি। মনে মনে বেশ অস্বস্তি বোধ করছিলাম। শেষ সফরে কেন যেন তাড়াতাড়ি ঢাকায় ফিরে আসার জন্য মনটা অস্থির হয়ে উঠেছিল। নীলফামারীর প্রোগ্রামটা সংক্ষেপ করে একদিন আগেই রংপুর পৌঁছে গেছি। দিনগুলো দু’হাত দিয়ে ঠেলছিলাম। ফিরার পথে গাড়িটাও যেন বেশ বিলম্বে পৌঁছল। দিন শেষে আবদুল কাদের থেকে খবর পেলাম আজ রাতে ঢাকায় রুকনদের জরুরি বৈঠক আছে। মাগরিবের নামাজ পড়ে ধীরে ধীরে রওনা হলাম। পথে বেশ একটু দেরিও হয়ে গেল। কার্জন হলে পৌঁছতেই এশার জামায়াতের একামত শুরু হলো। মালেক অজু শেষ করে মসজিদের দিকে পা বাড়াতেই আমি সামনে হাজির। সালামের জবাবটা দিয়েই কিছু সময়ের জন্য আমার দিকে অবাক দৃশ্যে তাকিয়ে রইলেন তিনি। তার স্বভাবসুলভ মিষ্টি-মধুুর হাসিভরা মুখে বললেন, আপনি আসছেন? নামাজ শুরু হয়ে গেছে। কথা বলা সম্ভব ছিল না। শুধু হাতটা মিলিয়ে জামায়াতে শামিল হলাম। একটু পরে বৈঠক শুরু হলো। শেষ হতে হতে রাত বাজল প্রায় ১টা। সুতরাং কারো সাথে ব্যক্তিগত আলোচনার সুযোগ হলো না। রুকনদের এই বৈঠকে মালেক তার শেষ হেদায়াত দিচ্ছিলেন, এ কথা আমরা কেউ তখন বুঝতে পারিনি। হ্যাঁ, এটাই ছিল মালেকের শেষ আরকান ইজতেমা। তার শেষ হেদায়াত আমি সরাসরি শুনতে পেয়ে এখন নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। শহীদি আত্মার স্মৃতিবিজড়িত এই আরকান ইজতেমার তিনটি কথা আমাদের সংগ্রামী জীবনের প্রতি পদক্ষেপের স্থায়ী পাথেয় হয়ে থাকবে। রুকনদের ভূমিকা বলিষ্ঠ ও প্রাণবন্ত হতে হবে। আন্দোলনের দাবি ও বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রুকনদের ...........-এর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে, মূল সংগঠনের দাবি পূরণের প্রাধান্যকে উপেক্ষা করে ................-এর প্রতি অহেতুক ঝোঁক প্রবণতাকে রোধ করতে হবে। কথাগুলোর প্রতি এতবেশি জোর দিচ্ছিলেন তিনি, তা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়।
হ্যাঁ, আবদুল মালেক ............এর হেদায়াত দিয়ে নিজেই তার চূড়ান্ত স্বাক্ষর রেখে গেলেন। ঈমানের দাবি পূরণ করতে গিয়ে আবদুল মালেক দ্বিধাহীন চিত্তে শাহাদাতের পিয়ালা পান করলেন। জীবনের বিনিময়ে বাতিলের মোকাবেলায় সত্য প্রতিষ্ঠার রক্তস্বাক্ষর রেখে গেলেন তিনি। মালেক আমাদের মধ্যে ছিলেন সর্বোত্তম এ কথাও সবাই জানতাম। কিন্তু আল্লাহর পথে শহীদ হওয়ার মতো এত বড় মর্যাদায় তিনি ভূষিত হবেন এটা বুঝে ওঠা কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না। আন্দোলন ও সংগঠনের হাজারো সমস্যা নিয়ে মালেকের সাথে আলাপের সুযোগ আর হলো না। ১০ তারিখ রাতের সেই মুহূর্তে আমার দিকে তিনি যেভাবে তাকিয়ে ছিলেন ১৭ তারিখের অপরাহ্নে তার জ্যোতির্ময় চেহারার দিকে আমি অনুরূপ চেয়ে আছি।
লেখক : আমীর, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও সাবেক কৃষি ও শিল্পমন্ত্রী (মতিউর রহমান নিজামী)
:ইসলামী শিক্ষা দিবস (১৫ আগষ্ট-১৯৬৯) ► আব্দুল মালেক নামের এক ছাত্রের শহীদ হবার ইতিহাস (ভিডিও ডকুমেন্টারী)
0 comments: