সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ বংশগতির ধারা ও চক্র চালু রাখতে সন্তানের জন্ম দিয়ে চলেছে।সন্তান কে না চায়? একটা সন্তান নিস্তরঙ্গ জীবনে এনে দেয় খুশির ঝিলিক;অশান্তির সংসারে নিয়ে আসে শান্তির সুবাতাস,মায়ার বাধন ।কিন্তু সঠিক যৌনজ্ঞানের অভাবে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই সুস্থ,সবল,আখাঙ্খিত সন্তান জন্মদানের খূটিনাটি কিন্তু গুরুত্বপুর্ণ বিষয়গুলো না জানায় হীনমন্যতা,মানসিক অশান্তিতে ভুগে।আখাঙ্খিত সময়ে গর্ভধারণ না করতে পারার মিছে স্ত্রীকে দোষারোপ এমনকি বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনাও ঘটে।
ভ্রণ কিভাবে সৃষ্টি হয়ঃ
পুরুষদের অন্ডথলিতে ২ টি শুক্রাশয় থাকে।শুক্রাশয়ে শুক্রানু উৎপন্ন হয় । আর মহিলাদের ডিম্বাশয়ে উৎপন্ন হয় ডিম্বানু।
শারীরিক মিলনের সময় নিক্ষেপিত বীর্যে থাকা কোটি কোটি শুক্রানু্র মধ্যে সাধারণতঃ কেবল একটিই (যা সবচেয়ে সুস্থ সবল) ডিম্বথলি হতে নিক্ষিপ্ত ডিম্বানুর সাথে মিলিত হয়ে সৃষ্টি করে জাইগোট এবং তারপর জাইগোট মাইটোসিস বিভাজন প্রক্রিয়ায় বারবার বিভাজিত হয়ে ধাপে ধাপে সৃষ্টি করে মানব ভ্রুণ।
শারীরিক মিলনের সময় নিক্ষেপিত বীর্যে থাকা কোটি কোটি শুক্রানু্র মধ্যে সাধারণতঃ কেবল একটিই (যা সবচেয়ে সুস্থ সবল) ডিম্বথলি হতে নিক্ষিপ্ত ডিম্বানুর সাথে মিলিত হয়ে সৃষ্টি করে জাইগোট এবং তারপর জাইগোট মাইটোসিস বিভাজন প্রক্রিয়ায় বারবার বিভাজিত হয়ে ধাপে ধাপে সৃষ্টি করে মানব ভ্রুণ।
চিত্রঃ(বাঁ থেকে)১৫ দিন,১৮-২১ দিন,২৭-৩০ দিন বয়সী মানব ভ্রুণ।
চিত্রঃ(বাঁ থেকে)৩১-৩৪ দিন,৪২-৪৪ দিন,৬০-৬২ দিন বয়সী মানব ভ্রুণ।
ছেলে বা মেয়ে শিশু হবার সম্ভাবনা কি বাড়ানো সম্ভবঃ
মানুষের ডিএনএ তে ২৩ জোড়া ক্রোমোসম থাকে।এর মধ্যে ১ জোড়া ক্রোমোসম নির্ধারণ করে মানুষের যৌন পরিচয় অর্থাৎ সে ছেলে হবে না মেয়ে হবে।ছেলেদের সেক্স ক্রোমোসম হল XY আর মেয়েদের XX ।অর্থাৎ মেয়েদের ক্ষেত্রে শুধু X ক্রোমসম থাকে।কোন Y ক্রোমসম থাকে না।যৌন ক্রিয়ার সময় যদি মেয়ের ডিম্বানুর এক্স ক্রোমসমের সাথে ছেলের এক্স ক্রোমসমবাহী শুক্রানু মিলিত হয় তাহলে সন্তান হবে মেয়ে ,অন্যথা যদি ছেলের ওয়াই ক্রোমসমধারী শুক্রানু মিলিত হয় তাহলে সন্তান হবে ছেলে।
একটা মানুষের শুক্রানু নিক্ষেপর পর ৫ দিন পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে।আর ডিম্বানু সাধারণতঃ ১২ -২৪ ঘন্টা টিকে থাকে।অর্থাৎ ডিম্বানু নিষিক্ত করার জন্য এটা নিক্ষিপ্ত হবার ১২ ঘন্টার মধ্যে একে নিষিক্ত করতে হবে।কিন্তু একটা শুক্রানু নিক্ষেপের পরপরই এটা নিষিক্ত করার প্রয়োজনীয় গুনাবলী অর্জন করতে পারে না।একে Capacitation process এর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।আর তাই ডিম্বস্ফোটনের পুর্বের ৫ দিন অতি গুরুত্বপুর্ণ।
অনেকে মনে করে ডিম্বস্ফোটনের দিনই গর্ভবতী হবার জন্য সবচেয়ে উপযোগী।কিন্তু তা ঠিক নয়।কারন যেহেতু শুক্রানুকে Capacitation process এর মধ্য দিয়ে যেতে হয় এবং এতে কিছু সময় লাগে তাই ডিম্বস্ফোটনের দিন নয় বরং তার আগের ২-৩ দিনই সন্তান ধারণ ও গর্ভবতী হবার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।
Y ক্রোমসম X ক্রোমসমের তুলনায় নাজুক,দুর্বল ও নশ্বর হয়।তবে তা দ্রুত সাতাঁর কাটতে পারে।তাই ডিম্বস্ফোটনের ৩ দিন আগে শারীরিক মিলনে ছেলে ও মেয়ে সন্তান হবার সম্ভাবনা সমান হলেও ৫ দিন পুর্বের মিলনে মেয়ে শিশু জন্মানোর সম্ভাবনাই বেশি।
ডিম্বস্ফোটনঃ
ডিম্বানু থাকে ডিম্বাশয়ে।একটা মেয়ের ডিম্বাশয়ে মিলিয়ন সংখ্যক অপরিণত ডিম্বানু থাকতে পারে । ডিম্বস্ফোটনের সময় পরিণত ডিম্বানু ফেলোফিয়ান নালিকা দিয়ে ক্রমশঃ নালিকার নিচের দিকে যেতে থাকে এবং অপেক্ষারত শুক্রানুর সাথে (যদি থাকে) মিলিত হয়ে নিষিক্ত হয়।ডিম্বস্ফোটনের সময় সম্ভাব্য গর্ভধারণ প্রক্রিয়াকে সহজ করার জন্য জরায়ুর প্রাচীর পুরু হয়ে উঠে।সাধারণত একবার ডিম্বস্ফোটনের সময় একটা ডিম্বানুই নির্গত হয়।একটা ডিম্বানু ডিম্বাশয় ত্যগ করার পর সাধারণতঃ আর ১২-২৪ ঘন্টা বেঁচে থাকে।ডিম্বস্ফোটনের সময় অনেকে ডিম্বাশয়ের আশেপাশের এলাকায় মৃদু ব্যাথা অনুভব করতে পারে।একে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় mittelschmerz বলে।ডিম্বস্ফোটনের সাথে মাসিকের (Menses)কোন সম্পর্ক নেই।ডিম্বস্ফোটন না হলেও মাসিক হতে পারে আবার মাসিক ছাড়াও ডিম্বস্ফোটন ঘটতে পারে।অনিষিক্ত ডিম্বানু খন্ড বিখন্ড হয়ে পরে জরায়ুর প্রাচীর কর্তৃক শোষিত হয়ে যায়।
ডিম্বস্ফোটনের লক্ষণঃ
গর্ভাশয় হতে নির্গত তরলের প্রকৃতি পরিবর্তন(তরলে মৃদু পিছলে পদার্থ থাকবে যা প্রকৃতপক্ষে ডিম্বস্ফোটনপূর্ব ও স্ফোটনকালীন “egg whites” এর ভগ্ন অংশ) ,গর্ভাশয়ের দৃড়তার পরিবর্তন ,উদরের একপাশে ব্যাথা অনুভব করা, যৌন চাহিদা বেড়ে যাওয়া,উদর স্ফীত হয়ে উঠা এবং বিশেষতঃ শরীরের তাপমাত্রার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন (তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া) ইত্যাদি ডিম্বস্ফোটনের লক্ষন।এছাড়াও অনেকের ক্ষেত্রে ডিম্বস্ফোটনের সময় হালকা রক্তপাত হতে পারে।
চক্র ও ডিম্বস্ফোটনের সম্ভাব্য সময়ঃ
পিরিয়ডের ১ম দিন থেকে পরবর্তী পিরিয়দের ১ম দিন পর্যন্ত সময়কে একটা চক্র বলে।চক্র সাধারণতঃ ২৮-৩২ দিন হয়।তবে তা এর চেয়ে কম ও ক্ষেত্রবিশেষে বেশি (এমনকি ৪২ দিন পর্যন্ত) হতে পারে।চক্র দুই ধাপে সম্পন্ন হয়।
১। Follicular phase: চক্রের প্রথম দিন থেকে ডিম্বস্ফোটনের দিন পর্যন্ত সময়।ব্যাক্তিবিশেষে এটা ৭ দিন থেকে ৩০ দিন হতে পারে।
২। Luteal phase : ডিম্বস্ফোটনের দিন থেকে পরবর্তী পিরিয়ডের আগ পর্যন্ত সময়।এটা সাধারনত ১২-১৬ দিন স্থায়ী হয়।ডিম্বস্ফোটনের সময়ই নির্ধারন করে পরবর্তী পিরিয়ড কখন শুরু হবে ।
অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে চক্রের ফলিকুলার ফেজ অনির্দিষ্ট হলেও লুটিয়াল ফেজ অনেকটা সুনির্দিষ্ট এবং তা থেকে আমরা ডিম্বস্ফোটোনের সময় অনুমান করতে পারি।কারো চক্র যদি ৩২ দিন হয় তাহলে আমরা বলতে পারি তার ডিম্বস্ফোটন হবে ৩২-১৬=১৬ থেকে ৩২-১২=২০ তম দিনের মধ্যে।
চক্র কিভাবে কাজ করেঃ
যখন মাসিক শুরু হয় তখন ইস্ট্রোজেন লেভেল কম থাকে। হাইপোথ্যালামাস (যা হরমোনের লেভেল নিয়ন্ত্রন করে) তখন পিটুইটারি গ্ল্যান্ডকে উদ্দীপ্ত করে এবং তা তখন Follicle Stimulating Hormone (FSH) নির্গত করে যা পরিণত ডিম গঠনের জন্য ফলিকল তৈরিতে সহায়তা করে।ডিম পরিণত হলে ইস্ট্রোজেন লেভেল বেড়ে যায় যা হাইপোথ্যালামাস ও পিটুইটারি গ্ল্যান্ডকে তখন এ সংকেত পাঠায়।
এরপর ল্যুটেনাইজিং হরমোন নির্গত হয় এবং তখন পরিণত ডিম ডিম্বাশয় হতে বের হয়ে নিষিক্ত হবার জন্য ফেলফিয়ান নালিকা দিয়ে নিচের দিকে অগ্রসর হয়।আর তখন প্রোজেস্টেরন হরমোন নির্গত হয় যা ভ্রূন ধারনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং জরায়ুর প্রাচীরকে পুরু করে তোলে। ডিম্বানু পরিস্ফোটনের পর ও ১২-১৬ দিন পর্যন্ত প্রোজেস্টেরন হরমোন নির্গত হয় ।এমনকি যদি ডিম্বানু নিষিক্ত হয়েও যায় তাও প্রোজেস্টেরন হরমোন নির্গত হয় প্ল্যাসেন্টা গঠন এর আগ পর্যন্ত। ডিম্বানু নিষিক্ত হলে এর ১ সপ্তাহ পরপরই তার লক্ষন শরীরে ফুটে উঠে। ডিম্বানু নিষিক্ত না হলে তার ভগ্নাংশ শরীর হতে স্রাব আকারে বেরিয়ে যায়।প্রোজেস্টেরন হরমোন নির্গত হওয়া বন্ধ হয়ে গেলে জরায়ুর প্রাচীর ক্ষয়ে পড়তে থাকে এবং তখন মাসিক (menstrual cycle) শুরু হয়।এবং প্রতিমাসে এই ঘটনাই চক্রাকারে পুনারাবৃত্ত হতে থাকে।
জমজ সন্তানঃ
জমজ দুই ধরনের হতে পারে।
১)Fraternal
২)Identical.
Fraternal জমজ দুইটা ভিন্ন ডিম থেকে বিকাশ লাভ করে।বেশিরভাগ জমজই fraternal । আর অসময়ে আকস্মিক ও প্রারম্ভে গর্ভধারণের কারনে অনেক সময় একই ডিম বিভক্ত হয়ে Identical জমজ সৃষ্টি করে।
কিভাবে সন্তান জমজ হবার সম্ভাবনা বাড়ানো যায়ঃ
মায়ের বংশে বা পারিবারিক ইতিহাসে যদি কারো জমজ সন্তান থাকে তাহলে অনাগত সন্তান জমজ হতে পারে।পিতার পারিবারিক ইতিহাস এক্ষেত্রে গুরুত্বহীন।
ফলিক এসিড গ্রহণ করে জমজ হবার সম্ভাবনা বাড়ানো যেতে পারে। একটা অস্ট্রেলিয়ান জরিপানুসারে ফলিক এসিড যারা গ্রহন করে তাদের ক্ষেত্রে অনাগত সন্তান জমজ হবার সম্ভাবনা স্বাভাবিকের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি। এছাড়াও বিভিন্ন জরিপে দেখা যায় যেসব মহিলার ওজন,উচ্চতা বেশি;যারা সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ায় তাদের জমজ হবার সম্ভাবনা সাধারণের চেয়ে ৩ গুণ বেশি।
চিত্রঃগাছ আলু(Cassava Root-Manihot esculenta)
এছাড়াও জন্মবিরতিকরণ পিল ৬-৭ মাস গ্রহণ করে বন্ধ করার পর সন্তান ধারণ করতে চাইলে সেক্ষত্রে সন্তান জমজ হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। জন্মবিরতিকরণ পিল খেলে শরীরে অনেক যৌন হরমোন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।সেক্ষেত্রে ৬-৭ মাস পর পিল গ্রহণ স্থগিত করলে আরো ১-২ চক্র সময় লাগতে পারে হরমোন উৎপাদন ও এর কার্যক্রম স্বাভাবিক হবার জন্য।তখন অনেক সময় মহিলারা অধিক উদ্দীপনা (Hormone Stimulation) অনুভব করতে পারে।এতে অনেক সময় পিল বন্ধপরবর্তীকালীন ১ বা ২ চক্রে অদিক উদ্দীপনার কারণে ডিম্বাশয় একের অধিক ডিম্বানু নিক্ষেপ করতে পারে।ফলে fraternal জমজ হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
গাছ আলু খেলেও জমজ হবার সম্ভাবনা বাড়ে।নাইজেরিয়ার ইগবো ওরা শহরে জমজ সন্তান হবার প্রবণতা সারা পৃথিবীর চেয়ে ৪ গুণ বেশি।বিশেষজ্ঞ দল তাদের জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাস নিয়ে গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে গাছ আলু খাওয়ার জন্য তাদের জমজ হবার প্রবণতা বেশি।গাছ আলু গ্রহণে ডিম্বাশয়ে অধিক উদ্দীপনার (Hyper Stimulation) সৃষ্টি হয় যার ফলস্বরূপ জমজ সন্তান হবার প্রবণতা বাড়ে।
সোর্স : জিরোটুইনফ.কম (লেখক-আনিস)
0 comments: