অধ্যায় ০৩ : মানবজাতির ধ্বংসের মূল কারণ

উপরে বাস্তব সত্যের যে বর্ণনা দেয়া হলো, তার মধ্যেই সমগ্র জগতের নিগূঢ় রহস্য রয়েছে। অতপর অনুধাবন করার বিষয় এই যে, আমরা ও আমাদের অস্তিত্ব বিশ্বসৃষ্টির বহির্ভূত কিছুই নয় বরং আমরা এ বিরাট সৃষ্টির সামান্য অংশ মাত্র। তাই আমাদের জীবন ধারণেও বর্ণিত নিয়মাবলীর প্রকাশ্য প্রভাব স্বভাবতই বিদ্যমান থাকতে বাধ্য।

আজ আমাদের প্রত্যেকের মনে একটি জটিল প্রশ্ন অতিশয় তীব্রভাবে বারবার জাগ্রত হচ্ছে। তা এই যে, শান্তি কোথায়? মানব জীবন আজ সকল প্রকার শান্তি হতে বঞ্চিত হলো কেন? কেন আজ জাতিতে জাতিতে বিবাদ, রাজায় রাজায় ঘোর মনোমালিন্য, সবলের উৎপীড়ন ও নির্যাতনে দুর্বল আজ দুর্দশাগ্রস্ত ও নাজেহাল। বন্ধুত্ব বিশ্বাসঘাতকতায় পরিপূর্ণ, আর আমানতদারীর পরিবর্তে খেয়ানতের এতোটা প্রাবল্য কেন? কেন মানুষের প্রতি মানুষ আস্থাহীন, ধর্মের নামে ধর্ম-ধ্বংসের বিরাট কারসাজিই বা কেন? একই আদমের সন্তান হাজার গোত্রে বিভক্ত, এক গোত্রের সাথে অন্য গোত্রের ভয়ানক বিবাদ-বিসম্বাদ, মানুষের ভয়ে মানুষ সন্ত্রস্ত।

এমনিভাবে অগণিত অপকর্মে কেন আজ আমাদের সুখময় জীবনের যাত্রাপথ সকল দিক দিয়ে বিপদ-সংকুল হয়ে উঠেছে। আরও চিন্তা করার বিষয় এই যে, সৃষ্টিলোকের অন্য কোনো ক্ষেত্রে কিন্তু কোনো প্রকার অশান্তি নেই, তারকারাজ্যে শান্তি বিদ্যমান, হাওয়ায় শান্তি, জলে শান্তি, স্থলে শান্তি এক কথায় মানুষ ছাড়া প্রাকৃতিক জগতের যে কোনো স্থানে শান্তি বিরাজমান ; শুধু মানুষই শান্তির সুশীতল ছায়া হতে বঞ্চিত। তাই মানব মনে আজ এটা এক জটিল সমস্যার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর সমাধানের জন্য সমগ্র মানবজাতি অস্থির হয়ে উঠছে। আমি কিন্তু অতীব ধীরস্থিরভাবে উল্লেখিত জটিল প্রশ্নের সংক্ষেপে এ উত্তরই প্রদান করবো যে, মানুষ আজ তার শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের স্বভাবসিদ্ধ রীতিসমূহের বিরুদ্ধে চলতে গিয়েই পদে পদে অগণিত বিপদের সম্মুখীন হতে বাধ্য হয়েছে। আবার সে তার ভুল বুঝতে পেরে যখন আল্লাহর বিধানে বাধ্য হয়ে জীবনের যাত্রাপথ নির্ধারণে সচেষ্ট হবে, তখন তার হারানো শান্তি অবশ্যই ফিরে আসবে, অন্যথায় অশান্তি কখনো দূর হবে না, হতে পারে না। যেমন চলন্ত ট্রেনের দরজা ও তার পার্শ্ববর্তী রাস্তাকে যদি কেউ আপন ঘরের দরজা ও মেঝে মনে করে, তখন এ ভুল বুঝার জন্য ট্রেনের দরজা বা তৎপার্শ্ববর্তী রাস্তা কখনো তার থাকার ঘরের দরজা ও প্রাঙ্গণে পরিণত হবে না, পক্ষান্তরে, উল্লেখিত ভুল বুঝার শাস্তি স্বরূপ উক্ত অপচেষ্টাকারীর হয়তোবা পা ভাঙ্গবে, না হয় মাথা ফাটবে। এরপরও যদি উক্ত ব্যক্তি তার কৃতকর্মের ভুল বুঝতে সক্ষম না হয়, তবে ব্যাপারটা বড়ই দুঃখজনক ও লজ্জাকর হয়ে দাঁড়াবে।

এমনিভাবে যদি আপনাদের কেউ মনে করেন যে, এ বিশ্বের কোনো স্রষ্টা নেই বা মানুষই মানুষের স্রষ্টা, অথবা যদি কেউ আসল আল্লাহ ভিন্ন অন্য কোনো নকল আল্লাহ মেনে বসে, তবে তার ভুল বুঝার দোষে আসল অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটবে না। বস্তুতপক্ষে এ বিশ্বের যথার্থ মালিক আল্লাহ তা‘আলাই। তিনি চিরদিন আছেন ও থাকবেন এবং তাঁর বিশাল রাজত্বের সম্মুখে মানব সমাজ যে নগণ্য প্রজা ভিন্ন আর কিছুই নয় সে কথাটিও পুর্বের মতই অপরিবর্তনীয় থাকবে। তবে উল্লেখিত বাস্তব ব্যাপারসমূহকে অন্যরূপ ধারণা করার শাস্তি স্বরূপ আমাদেরকে জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে অগণিত বাধা ও বিপদের সম্মুখীন হতে হবে, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

আমার উল্লেখিত কথাগুলোকে আবার নতুন করে অন্তরে স্থান দেয়ার নিবেদন জানিয়ে অতপর দ্বিতীয় কথা এই বলতে চাই যে, আল্লাহ তাআলা কারো মনগড়া খোদা নন, তাঁর কর্তৃত্ব আপনাদের মেনে নেয়ার প্রতি তিনি মুখাপেক্ষীও নন, বরং তাঁর কর্তৃত্ব তদীয় আপন শক্তিতে বিদ্যমান। তিনিই এ বিশ্বের স্রষ্টা, আসমান-যমীন এবং চন্দ্র-সূর্য তাঁরই হুকুমে পরিচালিত, সৃষ্টির সমস্ত শক্তিই তাঁর মুখাপেক্ষী। আমাদের জীবন ও জীবন ধারণের সমস্ত সামগ্রী তাঁর প্রদত্ত জিনিসসমূহের অন্যতম এবং আমাদের অস্তিত্ব তাঁর কুদরাতের নমুনা স্বরূপ। এটাই হচ্ছে প্রকৃত ব্যাপার। আপনারা স্বীকার করুন আর না-ই করুন, এ প্রকৃত ব্যাপার কখনও অন্যরূপ ধারণ করতে পারে না। তবে প্রভেদ এই যে, আপনারা যদি এ স্বাভাবিক ও প্রকৃত সত্যকে জেনে নিয়ে এবং তা স্বীকার করে চরিত্র গঠনে সচেষ্ট হোন, তখন সৃষ্টি পরিচালনার জন্য স্রষ্টা কর্তৃক বর্ণিত ও স্বভাবসিদ্ধ আইন-কানুন মেনে নেয়ার দরুন আপনাদের জীবন সুখে শান্তিতে আনন্দে সফলতার সুনিশ্চিতরূপে ধন্য ও সার্থক হয়ে উঠবে। অন্যথায় চলন্ত ট্রেনের দরজাকে ঘরের দরজা মনে করে বাহরে পা রাখার দরুন কোনো নির্বোধ যাত্রীর অবস্থা যতোটা শোচনীয় হওয়া সম্ভব, আপনাদের অবস্থা ততোটা শোচনীয় ও লজ্জাষ্কর হতে বাধ্য।

এখন আপনারা হয়তো আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন যে, উল্লেখিত অবস্থানুযায়ী আমাদের বাস্তব স্বরূপ কি হতে পারে। তাই আমি সংক্ষেপে এর উত্তর প্রদান করছি। যদি আপনাদের কেউ বেতন ও খোরাকী দেয়ার শর্তে কোনো চাকর নিযুক্ত করেন তখন তার কর্তব্য কি হতে পারে? এটা নয় কি যে, সে আপনার হুকুম প্রতিপালন করবে, আপনার মর্জি অনুযায়ী প্রতিটি কাজ সম্পাদন করবে এবং এর মারফতেই চাকুরি ও আনুগত্যের প্রমাণ করবে। কেননা চাকরের কাজ চাকুরি ভিন্ন আর কি হতে পারে? আরও দেখুন, যদি আপনাদের কেহ সর্দার নেতা নিযুক্ত হন এবং তার অধীনে যদি কিছুসংখ্যক কর্মী থাকে, তবে সর্দারের আদেশানুযায়ী প্রত্যেক কাজ সমাধা করে তার প্রতি আনুগত্যের প্রমাণ দেয়া হবে তার কর্তব্য। অনুরূপভাবে আমাদের কেউ যদি কোনো সম্পত্তির মালিক হয়, তবে সে স্বভাবতই এটা চায় যে, উক্ত সম্পত্তির উপর যেনো তার ষোলআনা স্বার্থ ও ক্ষমতা বজায় থাকে, অথবা যদি কোনো রাজশক্তি আমাদের শাসক হয়, তখন বিনা বাক্যব্যয়ে বাদশাহী কানুন ও আদেশ মেনে চলার পথ নির্ধারণ করাই হবে আমাদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ। অন্যথায় বিদ্রোহী সেজে রাজ-কোপানলে পতিত হয়ে নিজেই নিজের দুঃখের কারণ সাব্যস্ত হতে হবে।

উল্লেখিত উদাহরণ দ্বারা আপনি নিজেই উপলদ্ধি করতে পারেন যে, আল্লাহর এ বিরাট রাজ্যে আপনাদের যথার্থ স্বরূপ কি হতে পারে। আল্লাহ-ই আপনাদের স্রষ্টা। কুদরাতের এমনি খেলা যে, আপনাদের কোনো কাজ তাঁর ইঙ্গিত ছাড়া সমাধা হয় না, আপনাদের লালন-পালন ও আহার্য বন্টন একমাত্র তাঁরই হাতে নিহিত। এক কথায় প্রত্যেক দিক দিয়ে তাঁর ও আপনাদের মধ্যে মনিব ও চাকরের সম্পর্ক বিদ্যমান। এ আকাশ ও পৃথিবী তাঁর সম্পত্তি এবং তাঁর সম্পত্তিতে তাঁরই হুকুম ও বিধানের প্রভুত্ব ও প্রাধান্য চলবে। এখানে নিজেদের স্বাধীনতা চালাবার ন্যায়ত কোনো অধিকারই আপনাদের নেই। তাই বেপরোয়াভাবে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে চলার ইচ্ছা করলেই বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। আপনারা এখানে প্রজা ভিন্ন আর কিছু নন। প্রজাদের মধ্যে কারো একথা বলার শক্তি নেই যে, আমি গভর্নর, আমি ডিরেক্টর, আমি স্বতন্ত্র ইত্যাদি এমনকি পার্লামেন্ট বা এসেম্বলী দ্বারা ইচ্ছাধীন আইন পাশ করে আল্লাহর বান্দাগণকে এ আইন মানানোর জন্য চাপ দেয়ার কোনো অধিকারও এখানে কারো নেই। আসল বাদশাহের প্রজা হওয়া ভিন্ন নকল ও মিথ্যা বাদশাহের প্রজা হওয়া ও তার বানানো নকল আইন মেনে চলা কখনও কোনো প্রজার জন্য সিদ্ধ বা জায়েয নয়। এ ক্ষেত্রে বাদশাহীর দাবি করা বা অন্য নকল বাদশাহকে স্বীকার করা উভয়ই প্রকৃত বাদশাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সমতুল্য। আর এজন্য শাস্তিও সুনিশ্চিত। তাঁর কুদরাতের হাত হতে মুক্তি পাওয়ার শক্তি কারো নেই। এমনকি মৃত্যুর পর আমাদের শরীরের প্রতিটি অংশ মাটিতে মিশে যাক বা আগুনে পুড়ে ভষ্মে পরিণত হোক বা পানিতে মিশে মাছের খোরাক হোক বা অন্য কোনো প্রকারে বিনষ্ট হোক, যখন হিসাবের জন্য তিনি আমাদের তলব করবেন তখন হাওয়া, যমীন, পানি ও মাটি ইত্যাদি তাঁর হুকুমের অধীন হয়ে নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য হবে। ফলত আমাদের দীর্ঘদিনের ধ্বংসপ্রাপ্ত শরীরকেও তাঁর সম্মুখে উপস্থিত করা হবে এবং রূহ ফুঁকে দিয়ে প্রশ্ন করা হবে হে আমার বান্দাহ ! আমার প্রজা হয়ে দুনিয়াতে বাদশাহীর ক্ষমতা তুমি কোথায় পেয়েছিলে? আমার রাজত্বে তোমার হুকুম চালাবার স্বাধীনতা তোমাকে কে দিয়েছিল? আমার বাদশাহীতে তোমার আইন জারি করার অধিকার কিভাবে তুমি পেয়েছিলে? আমার বান্দাহ হয়ে অন্য বান্দাদের নিকট বন্দেগী প্রাপ্তির জন্য কোন্‌ সাহসে তুমি যত্নবান হয়েছিলে? আমার দাস হয়ে কিরূপে তুমি আমার অন্য বান্দাকে দাস বানিয়ে রাখলে? আমার রাজত্বে থেকে কিরূপে তুমি অন্যের রাজত্ব ও অপরের মনগড়া আইন ও বিধান স্বীকার করলে এবং কিরূপে তুমি অন্যের রাজত্ব ও অপরের মনগড়া আইন ও বিধান স্বীকার করলে এবং কিরূপে উল্লেখিত বিদ্রোহমূলক কার্যসমূহ তুমি তোমার জন্য সংগত মনে করলে? এখন বলুন তো, আপনাদের মধ্যকার কোনো ব্যক্তি সেদিনের এ সমস্ত জটিল প্রশ্নের উত্তর প্রদানে সক্ষম হবেন কি? কিংবা কোনো উকিল বা ব্যারিষ্টার আইনের মার-প্যাঁচ দ্বারা ঐ সময় আমাদের জন্য মুক্তি পথ নির্ধারণ করতে সক্ষম হতে পারবে কি? বা কোনো সুপারিশ আপনাদেরকে উল্লেখিত বিদ্রোহের অনিবার্য ফল হতে রক্ষা করতে পারবে কি? যদি মনে করেন যে, সেদিনের শাস্তি হতে অব্যাহতির যথার্থ পথ আজ প্রকৃত সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য ও হুকুমবরদারীর মধ্যেই নিহিত, তবে আর কালবিলম্ব না করে বিশ্বজাহানের যথার্থ মালিক ও প্রতিপালকের প্রত্যেকটি আইন ও হুকুম প্রতিপালনের ভিতর দিয়েই ইহকাল ও পরকালের সত্যিকার পথ অনুসন্ধান করুন।

অত্যাচার ও অবিচারের কারন

অত্যাচারের কারণ
এখানে কেবল হক বা সত্যেরই প্রশ্ন নয়, সঙ্গে সঙ্গে আরো একটি প্রশ্ন আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হয়। তা এই যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা‘য়ালার এ অসীম কর্মময় রাজ্যে আইন প্রণয়ন ও রাজত্ব করার যথার্থ যোগ্যতা মানুষের আছে কি? আমি পূর্বে বলেছি যে, মেশিনারি কাজে অজ্ঞ ব্যক্তি মেশিন চালাতে আরম্ভ করলে তার অজ্ঞতা হেতু মেশিন নষ্ট হবেই, অজ্ঞ ব্যক্তিকে সামান্য মোটর গাড়ি চালাতে দিলে এর তিক্ত ফল আপনারা সহজেই অনুভব করতে পারবেন। এখন খুব গভীরভাবে চিন্তা করে দেখুন যে, যখন একটি লোহার মেশিন পরিচালনায় পাকা জ্ঞান ভিন্ন ঠিকভাবে তা চালানো সম্ভব নয়, তখন মানুষ যার সৃষ্টি কার্য অগণিত কৌশলে পরিপূর্ণ এবং যার জীবনের প্রশস্ত কর্মক্ষেত্র বহু বৈচিত্রময় কাজে জড়িত সেই সহস্র প্রকার জটিল মানব মেশিন পরিচালনার কঠিনতম কাজ কি করে ঐ সকল লোক কর্তৃক সম্ভব হতে পারে, যারা নিজেকেও যথার্থরূপে জানতে ও চিনতে অক্ষম? এ সকল অজ্ঞ ও আনাড়ী ব্যক্তি যখন আইন প্রণয়নের অধিকারী হয়ে মানব জীবনের ড্রাইভারি করার দায়িত্বপূর্ণ কার্যভার গ্রহণ করে, তখন তার অবস্থা অজ্ঞ মোটর ড্রাইভারের মোটর পরিচালনার ন্যায় দুঃসাধ্য ও বিপজ্জনক হতে বাধ্য। এজন্য যেখানে আল্লাহ ভিন্ন মানুষের রচিত আইন-কানুন স্বীকার করা হয়, এবং আল্লাহর আনুগত্য ছেড়ে মানুষের হুকুম প্রতিপালন করা হয়, সেখানে শান্তি কখনো প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, বরং মানুষই মানুষের অশান্তির সুনিশ্চিত কারণ সাব্যস্ত হয়ে থাকে। ফলত মানুষের অত্যাচার অবিচারে মানুষ নিপীড়িত ও নির্যাতিত হয়ে জীবনের সমস্ত সুখ-শান্তি হতে বঞ্চিত থাকে, আর আল্লাহ প্রদত্ত সমস্ত শক্তি যা মানুষের উন্নতির জন্য ব্যয় হওয়া উচিত, তা মানব জাতির ধ্বংসের জন্য ব্যয় হতে থাকে, আর কার্যত হচ্ছেও তাই। এমনিভাবে মানুষের অন্যায় কার্যের ফলে দুনিয়া জাহান্নামে পরিণত হতে চলছে। কেননা, মানুষ তার ইচ্ছাকৃত অজ্ঞতা হেতু অবুঝ বালকের ন্যায় এমন এক মেশিন চালনায় সচেষ্ট, যার সমস্ত কল-কবজা বা অংশবিশেষের যোগ্য পরিচালনায় সে কখনো অভিজ্ঞ নয়। অবশ্য মেশিন পরিচালনায় সবকিছু পুরাদস্তুর খবর রাখেন, এমন যোগ্য চালকের হাতে মেশিন পরিচালনার বিরাট দায়িত্বপূর্ণ কাজ অর্পণ করাই সবদিক দিয়ে ভালো। কারণ তখন যথাযোগ্য পরিচালনার ফলে উক্ত মেশিন হতে প্রতিনিয়ত মানুষের হিতার্থে বহু মূল্যবান ও উপকারী জিনিস বের হয়ে আসবে। অন্যথায় অযোগ্য পরিচালনার কুফল মানব জাতিকে চিরদিন ভুগতে হবে।
অবিচার কেন
একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে অজ্ঞতা ভিন্ন মানবজীবনের অকৃতকার্যতার অন্য একটি কারণও আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠে। সামান্য জ্ঞান বিশিষ্ট ব্যক্তিও একথা বুঝতে পারে যে, মানুষ কোনো এক ব্যক্তি বা গোত্র বিশেষের নাম নয়, বরং মানুষ শব্দে এ দুনিয়ার সমস্ত মানব জাতিকেই বুঝায়। কিন্তু অনুরূপভাবে সুখ-শান্তি ও সম্মানের সাথে বসবাস করার দিক দিয়েও সকলের সমান অধিকার রয়েছে। মানবীয় সুখ-শান্তি অর্থে একজনের সুখ-শান্তি নয় গোটা মানব জাতির সুখ-শান্তিকেই বুঝতে হবে। তদ্রুপ কোনো এক ব্যক্তি বা গোত্র বিশেষের মুক্তিকেও সত্যিকার মুক্তি বলা চলে না, বরং গোটা সমাজের মুক্তিকেই মুক্তি নামে অভিহিত করা হয়। উল্লেখিত কথাকে জেনে ও মেনে নেয়ার পর একটু গভীরভাবে চিন্তা করে দেখুন, গোটা মানব সমাজের মুক্তি ও উন্নতি কি করে সাধিত হতে পারে। আমার মতে এর একমাত্র পন্থা এই যে, মানুষের জীবন যাপনের জন্য অপরিহার্য আইন-বিধান রচনার ভার তাঁরই উপর অর্পিত হওয়া বাঞ্ছনীয়, যাঁর দৃষ্টিতে সমস্ত মানুষ সমান। সকলের অধিকার তিনিই সুবিচারের সাথে নির্ণয় করবেন তিনি স্বীয় স্বার্থ হতে সম্পূর্ণ মুক্ত হবেন এবং তাঁর সাথে কোনো ব্যক্তি বা শ্রেণী বিশেষের স্বার্থ জড়িত থাকবে না। সমস্ত লোক তাঁরই আদেশ পালন করবে যিনি আদেশ প্রদানে অজ্ঞতাবশত কোনো প্রকার ভুল করবেন না এবং ব্যক্তিগত স্বার্থের খাতিরে স্বাধীনতার অপব্যয়ও করবেন না। কাউকেও বন্ধু মনে করে তার পক্ষাবলম্বন করা এবং কাউকে দুশমন ভেবে তার বিপক্ষে দাঁড়ানোর বদ অভ্যাস হতেও তিনি সর্বদা মুক্ত থাকবেন। শুধু উল্লেখিত অবস্থাতেই নির্ভুল সুবিচার লাভ করার আশা করা যায় এবং মানব সমাজের সমস্ত ন্যায্য দাবি দাওয়া পূরণ হতে পারে। যুলুম বা অত্যাচার নির্মূল করার এটাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। এখন আমার জিজ্ঞাস্য এই যে, দুনিয়ায় এমন কোনো মানুষ আছেন কি যিনি সকল স্বার্থপরতা ও উল্লেখিত মানবীয় দুর্বলতাসমূহের প্রভাব হতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হতে সক্ষম? খুব সম্ভব এ প্রশ্নের উত্তরে আপনারা ‘না’ ভিন্ন ‘হাঁ’ বলতে সাহসী হবেন না। কেননা বাস্তবিক পক্ষে এটা কেবল আল্লাহ তা‘আলারই মহিমা, তাঁরই ক্ষমতা ও গুণ মাত্র। তিনি ভিন্ন অন্য কেউ উক্ত গুণাবলীর যথার্থ অধিকারী হতে পারে না। এজন্য যেখানেই মানুষের রচিত আইন-কানুন স্বীকার করা হয়, আল্লাহ ভিন্ন মানুষের প্রাধান্য বিস্তার করা হয়, সেখানেই অত্যাচার ও অবিচার বিভিন্নরূপে প্রকাশ পেতে থাকে। সেই সকল শাহী খান্দানী লোকদের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন, যারা জোরপূর্বক নিজেদের হাতে কতকগুলি বিশেষ ক্ষমতা রেখে দিয়েছে। তারা নিজেদের জন্য সম্মান, অতিরিক্ত দাবি, টাকা আদায়ের উপায় ও এমন সব ক্ষমতা নির্দিষ্ট করে রেখেছেন, যা অন্যান্যদের জন্য রাখা হয়নি। তারা অবস্থান করছে আইনের গণ্ডীর বাইরে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো দাবি-দাওয়ার প্রশ্ন উত্থাপন করা যায় না। তারা যা ইচ্ছা তাই করে, কোনো আদালত তাদের বিরুদ্ধে ‘সমন’ পর্যন্ত জারি করতে সাহস পায় না। তাদের এই সকল অন্যায় আচরণ দেখে-শুনে লোকেরা শুধু এ ধারণার বশবর্তী হয়ে সবকিছু বিনা দ্বিধায় মেনে নেয় যে, বাদশাহগণ সকল প্রকার ভুল-ভ্রান্তি হতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ও পবিত্র। অথচ দুনিয়ার প্রত্যেক লোকই একথা জানে যে, এরা সাধারণের মতই মানুষ ভিন্ন অন্য কিছু নয়। এতদসত্ত্বেও শক্তির প্রভাবে এরা খোদা সেজে উচ্চাসনে সমাসীন আর অন্যান্য দুর্বল জনসাধারণ তাদের সম্মুখে করজোড় ও কম্পিতভাবে দন্ডায়মান হয়, যেন তাদের জীবন-মরণ এবং জীবিকা ও সম্পদ তাদের হাতেই সীমাবদ্ধ। প্রজাদের শ্রমোপার্জিত টাকা-পয়সা অন্যায়ভাবে আদায় করা হয়। উক্ত টাকা-পয়সা রাজোচিত প্রাসাদ নির্মাণে ও বিলাস-সামগ্রী প্রস্তুতকরণে নির্বিবাদে ব্যয় হতে থাকে। এমন কি তাদের একটি কুকুরের জন্য এমন সব খাদ্য দ্রব্যের বন্দোবস্ত করা হয়, যা প্রজাবর্গের পাঁচজন পরিশ্রমী ব্যক্তির ভাগে অনেক সময় জোটে না। এখন চিন্তা করে দেখুন তো, এটা কি বিচার? এসব নিষ্ঠুর নিয়মাবলী কখনো এমন ন্যায় বিচারক প্রভু কর্তৃক সমর্থিত হতে পারে কি, যাঁর সামনে সমস্ত মানব জাতির দাবি-দাওয়া সমান? সেইসব ব্রাহ্মণ, পীর, নবাব, সরদার, জমিদার-জায়গীরদার এবং মহাজনের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন, যারা স্বভাবতই নিজেদেরকে জনসাধারণ অপেক্ষা উচ্চ শ্রেণীর লোক বলে ধারণা করে থাকে, তাদের শক্তির প্রাবল্যে দুনিয়ায় এমন বহু আইন প্রণীত হচ্ছে যা দ্বারা তারাই জনসাধারণ অপেক্ষা ঢের বেশি উপকার লাভ করে থাকে। তাদের ধারণা, তারাই নিস্পাপ আর অন্য সকলে দোষী ও পাপী, তারা ভদ্র আর বাকি সব অভদ্র, তারা শাসক সমস্ত মানুষ শাসিত। তাই আমরা বলতে বাধ্য হবো যে, এ সকল নিষ্ঠুর নীতি ও অন্যায় আচরণ কখনও কোনো সত্যিকার ন্যায় বিচারক কর্তৃক রচিত হতে পারে না। জাতির ঐ সকল নেতা বা পরিচালকের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন, যারা শক্তির প্রাবল্যে অন্য জাতিসমূহকে গোলাম বানিয়ে রেখেছে। তাদের এমন কোনো আইন বা শাসন পদ্ধতি নেই, যা স্বার্থপরতার ছোঁয়াচ হতে মুক্ত। তাদের ধারণা দুর্বলেরা মানুষ নয়, অথবা অতীব নিম্নশ্রেণীর লোক মাত্র। তারা প্রত্যেক দিক দিয়েই নিজেদেরকে অন্যের তুলনায় বড় করে দেখে এবং নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনে অন্যের স্বার্থ বলি দেয়াকে ন্যায্য মনে করে থাকে। তাই তাদের রচিত প্রত্যেক আইন-কানুনের পেছনে বদনামী ও দুর্নাম লেগে আছে। শুধু ইশারা স্বরূপই উল্লেখিত উদাহরণ কয়টি এখানে বর্ণনা করা হলো। বিস্তারিত বর্ণনার স্থান এটা নয়। আমি শুধু এ সত্যটি আপনাদের মনে জাগিয়ে দিতে চাই যে, যেখানে মানুষ আইন রচনা করে এবং মানব রচিত আইন কার্যকর রয়েছে, সেখানে অন্যায় ও অত্যাচার ভিন্নরূপে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। তাই কেউ আপন ন্যায্য দাবি অপেক্ষা অধিক সুযোগ পেয়ে বসেছে, আর কারো যথার্থ স্বার্থ সম্পূর্ণ অন্যায় অমানুষিকভাবে দলিত মথিত হয়েছে। এর কারন এই যে, মানুষের অন্তরে ও মস্তিষ্কে স্বভাবতই স্বজাতি ও স্বগোত্রের উপকার-উন্নতির চিন্তা অন্য জাতির উপকার অপেক্ষা বেশিভাবে জেগে থাকে, তাই অন্যের স্বার্থ বা দাবির প্রতি তারা অপেক্ষাকৃত কম সহানুভূতি সম্পন্ন হয়। এ অন্যায় অত্যাচারের যথার্থ প্রতিকারের পন্থা এই যে, মানুষের রচিত আইন-কানুন ও শাসন-পদ্ধতি ত্যাগ করত আমরা একমাত্র আল্লাহ প্রণীত আইন-কানুন ও আদেশ-নিষেধাবলী মেনে চলবো। একমাত্র তাঁরই দৃষ্টিতে সমগ্র মানব জাতি সমান মর্যাদাসম্পন্ন। ব্যবধান শুধু মানুষের কর্মতৎপরতা, যোগ্যতা, কর্মদক্ষতার ভিতর দিয়েই পরিলক্ষিত হবে, বংশ শ্রেণী বা জাতিগত কোনো প্রকার আভিজাত্য সেখানে কারো জন্য স্বীকৃত হয় না এবং হতেও পারে না।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম