মাথার ওপরে বিশাল আকাশ।
নিচে বিশাল জমিন।
আকাশ এবং জমিনের মাঝে লুকিয়ে আছে কতো যে বিস্ময়!
শাহীন অবাক হয়ে ভাবে।
বিশাল আকাশের দিকে তাকায়। তারপর বিশাল পৃথিবীর দিকে।
রহস্যময় এই পৃথিবী।
জীবন ও জগৎও ভীষণ বিস্ময়কর। যার কোনো কূল কিনারা খুঁজে পাওয়া যায় না।
মেলে না অনেক হিসাব কিতাব।
ভাবতে ভাবতে শাহীন ভাবনার আরো অনেক গভীরে নেমে যায়। তার চোখে একে একে ভেসে ওঠে কত সব দৃশ্য। জীবন যাপনের কত বিচিত্র চালচিত্র।
আকাশ এবং জমিনের মাঝে লুকিয়ে আছে কতো যে বিস্ময়!
শাহীন অবাক হয়ে ভাবে।
বিশাল আকাশের দিকে তাকায়। তারপর বিশাল পৃথিবীর দিকে।
রহস্যময় এই পৃথিবী।
জীবন ও জগৎও ভীষণ বিস্ময়কর। যার কোনো কূল কিনারা খুঁজে পাওয়া যায় না।
মেলে না অনেক হিসাব কিতাব।
ভাবতে ভাবতে শাহীন ভাবনার আরো অনেক গভীরে নেমে যায়। তার চোখে একে একে ভেসে ওঠে কত সব দৃশ্য। জীবন যাপনের কত বিচিত্র চালচিত্র।
এই যেমন এখন তার মনে পড়ছে খুব কাছ থেকে দেখা সেই পরিবারটির কথা।
বারবার তার চোখের পর্দায় ভেসে উঠছে সেই এক করুণ ছবি। সেই সাথে বারবার বেদনায় দুলে উঠছে শাহীনের হৃদয় মন। কী বীভৎস, কী ভয়ঙ্কর সময়গুলো। তার কোমল হৃদয়ে টোকা দিয়ে যায় সময়ের কাঁটাগুলো।
তার মনে পড়ে, হ্যাঁ এই তো অন্ধকারটা আরো ঘন হয়ে এলো।
লতিফা হারিকেনের চিমনি পরিষ্কার করতে করতে গলা ছেড়ে রোকেয়াকে ডাক দিলেন কয়েকবার। রোকেয়ার কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে এবার তিনি নিজেই উঠলেন। হারিকেনে কেরোসিন ভরে তারপর সেটা জ্বালিয়ে পেছনের বারান্দায় চলে এলেন।
আফজালুর রহমান তখনো শুয়ে আছেন। সন্ধ্যার প্রথম অন্ধকারের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে হেমন্তের গাঢ় কুয়াশা। মাঠের পাশেই তাদের বাড়ি। তিন দিকে ছোট ছোট বিল। দীর্ঘ এক মাইলব্যাপী মাঠ। মাঠে ক্ষেতভরা ফসল। ঘন গাছগাছালি হেমন্তের কুয়াশায় মাঠটিকে সাদা বরফের একটি মস্তবড় পর্বত বলে মনে হচ্ছে। সেই পর্বত দিয়ে যেন ভাতের বলক দেয়া ভাপ বার হচ্ছে এবং তা ক্রমশ দিগন্তকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে।
আফজাল অপলকে তাকিয়ে আছেন মাঠের দিকে। একটা হিম শিরশির শীতল হাওয়া তার শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে বারবার। তিনি কয়েকবার পাশ ফেরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। এবার পা দুটো ভেঙে প্রায় থুতনির কাছে আনলেন। হেমন্তের কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার আফজালের মুখটা ভিন্ন কোনো বর্ণের সৃষ্টি করতে পারলো না। বরং ধূসর বর্ণের পাশাপাশি আর একটা ফ্যাকাসে হলুদ এসে তার সমগ্র চেহারাকে আরো বিবর্ণ করে তুলেছে।
হারিকেনটা বারান্দায় রাখতে রাখতে লতিফা বললেন, এখন কি একটু উঠে বসবেন?
আফজাল কোনো উত্তর দিলেন না।
লতিফা আবার জিজ্ঞেস করলেন।
আফজাল এবার ঠোঁট নেড়ে কী যেন বললেন। তার কথাগুলো ইদানীং তেমন কেউ আর বুঝতে পারে না। এমনকি একমাত্র কন্যা রোকেয়াও। কিন্তু লতিফা ঠিক ঠিক বুঝে যান। বুঝতে পারেন আফজালের অসমাপ্ত কথামালার স্বরধ্বনি। বুঝতে পারেন তার সকল ইশারা ইঙ্গিত। যেমন আফজালের এখনকার উত্তরে লতিফা পরিষ্কার বুঝতে পারলেন যে, তিনি উঠবেন না। তার খুব শীত করছে। গায়ে একটা কাঁথা দিয়ে দিলে ভালো হয়।
লতিফা আফজালের মাথার বালিশটা ঠিক করে দিলেন। তারপর শরীরের ওপর একটা কাঁথা টেনে দিয়ে পেছনে ফিরলেন।
আফজাল আবার চড়–ইয়ের মতো চিঁউ চিঁউ করে কী যেন বললেন। তার অসমাপ্ত শব্দটির অর্থও বুঝে গেলেন লতিফা। তিনি আবার ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন, রোকেয়া এখনো বাসায় ফেরেনি। হাঁস-মুরগি, ছাগলগুলো সমানে চিৎকার করছে। এদেরকে কোঠায় তুলে দিয়ে আবার আসবো। একটু অপেক্ষা করুন। পান বাটতেও তো সময় লাগবে, নিয়ে আসছি। বলতে বলতে লতিফা চলে গেলেন বাড়ির ভেতর।
আফজাল কাঁথাটা গলা পর্যন্ত তুলে দিয়ে মাথাটা ডান দিকে কাত করে শুয়ে আছেন। তিনি নিঃশব্দে দেখছেন শব্দমুখর রাস্তা, পাহাড় কোলাহল। দেখছেন মাঠের ধোঁয়াটে চেহারা। আজ কি অমাবস্যা? কথাটা লতিফাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হলো তার। কিন্তু লতিফা তো আর এখানে নেই। তিনি অপলকে তাকিয়ে আছেন বাইরের দিকে। একটি কুকুর অন্ধকারের দেয়াল টপকে পাশের বাড়ির গলি দিয়ে এইমাত্র বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।
এই বাড়ির কুকুর। ওসমান ওকে নিয়ে এসেছিল কামার পাড়া থেকে। সেও অনেকদিন আগে। আদর করে ওসমান কুকুরটির নাম রেখেছিল বেড়ে। এই বেড়েকে দিয়ে সে মাঠের কাঠবিড়ালী আর ইঁদুর মেরে সাফ করে দিতো। বেড়ে ছিলো খুবই শিকারি। দৌড়াতে পারতো যেমন-তেমনি ছিল তার শরীরের শক্তি।
এখনকার এই কুকুরটিকে দেখলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে যে, এই বেড়েই ছিল সেদিনকার সেই রাগী তেজি এবং অসীম সাহসী এক শিকারি কুকুর।
আসলে বয়স এমনি এক অলঙ্ঘনীয় ব্যাপার যে তাকে কোনো ক্রমেই উপেক্ষা করা যায় না। বয়স এসে যেমন শৈশব এবং কৈশোরের অসহায়ত্বকে ঠেলে ফেলে দেয় দূরে, তেমনি আবার এই বয়সের কারণে এক সময় মানুষ হয়ে পড়ে চরম অসহায়। তখন শিশু এবং বৃদ্ধের মধ্যে আর কোনো পার্থক্য থাকে না। যেমন সেদিনের সেই নামকরা বেড়ে এখন উঠোনে প্রবেশ করে অভ্যাসবশত এবং বারান্দার নিচে শুয়ে পড়েনি চার পা একত্রিত করে।
তার চোখে যেন আর কোনো স্বপ্ন নেই। দম ফেলতেও তার এখন কষ্ট হচ্ছে। অথচ এই বেড়ের কারণে পাড়ায় চোরÑডাকাত কোনোদিন ঢুকতে পারেনি।
আফজাল তাকিয়ে আছে বেড়ের দিকে।
বেড়েও তাকিয়ে আছে আফজালের দিকে। বয়সের ভারে সে এখন ক্লান্ত। তবুও তার চোখ দুটো জ্বল জ্বল করে জ্বলছে।
আফজালের খুব পরিচিত এই কুকুরটি দীর্ঘদিন যাবৎ এভাবেই শুয়ে থাকে তার নির্দিষ্ট জায়গায়। শুয়ে থাকবে সারারাত। সকাল হলেই সে উঠে কয়েকটা আড়মোড়া ভেঙে ধীরে ধীরে চলে যাবে। আবার ফিরে আসবে সন্ধ্যায়। আফজালের বারান্দার নিচে। তার নির্দিষ্ট জায়গায়। আগের মতো আর বেড়ে দৌড়ঝাপ করতে পারে না। কারোর পায়ের শব্দে আর ঘেউ ঘেউ করে ছুটে যেতে পারে না। বয়সের কারণে তার পূর্বের সকল কাজকর্ম থেকে সে অব্যাহতি পেয়েছে। তবুও অব্যাহতি নেয়নি এই বাড়িটার মায়া থেকে। তার কি যৌবনের কোনো স্মৃতি দোলা দিয়ে যায়? সেকি অস্থির হয়ে ওঠে নিজের ভেতরে? সেকি হাসে কিংবা কাঁদে? একান্ত নির্জনে?
খুব জানতে ইচ্ছা হয় আফজালের। তারও তো এই বয়সটাই কেবল এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে। তাকে কাঁদিয়ে তুলছে তার পঙ্গুত্ব। তবুও কোনো কোনো সময় তিনি নিজেই আপন হৃদয়ের পৃথিবীতে প্রাণ খুলে বিচরণ করতে পারেন। কখনো বা সেই স্মৃতির অ্যালবামে পেয়ে যান অকল্পনীয় সব ছবির সাক্ষাৎ। মুহূর্তে চমকে ওঠেন আফজাল। ফিরে যান অসীম সমুদ্রের দিকে। যে সমুদ্রকে এক সময় তিনিই তৈরি করেছিলেন। সেই কর্মমুখর যৌবন বয়সে। নিজের খননকৃত সমুদ্রের পাড় বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে তিনি বিচিত্র সব মুখ দেখতে পান। দেখতে পানÑরাজিয়াও তাকে উপেক্ষা করে চলে যাচ্ছে অন্যের হাত ধরে।
রাজিয়া! রাজিয়া এখন কেমন আছে?
পাঁচ বছর আগেও তিনি রাজিয়াকে দেখেছিলেন ঢাকার মৌচাকে। পরনে শাদা শাড়ি। চুলে কলপ করেও তার বার্ধক্য ঢাকতে ব্যর্থ হয়েছেন। সাথে দুটো ছেলে-মেয়ে। তাদের বয়সও দশ এবং পনেরো হতে পারে। আফজাল তখনো চাকরি করেন। ভালো চাকরি। রিকসা নেবার জন্য চেষ্টা করছেন। হঠাৎ তার একটি অতি পরিচিত ডাক শুনতে পেলেন। ঘাড় ফিরিয়ে আফজাল তাকে চিনবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। ততক্ষণে তিনি আরো নিকটে চলে এসেছেন। প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললেন, আমাকে কি চেনা যাচ্ছে?
আফজাল কয়েকবার চেষ্টা করেও বর্থ হলেন। বললেন, না। আপনার পরিচয়?
আমি? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি আবার বললেন, আমি রাজিয়া।
- রাজিয়া?
-হ্যাঁ। কেন, আমাকে দেখে চেনার কোনো উপায় নেই?
সত্যিই তাই। তাকে চেনা যাচ্ছে না। বার্ধক্যের ছায়াচিহ্ন তার সমগ্র শরীরে। আফজাল একটু হাসলেন। তার হাসির ভেতর কি কোনো বিদ্রƒপ ছিল? কোনো তিরস্কার? রাজিয়া তা জানেন না। তিনি বললেন, তোমার কি একটু সময় হবে?
-কেন?
- আমরা একটু কথা বলবো। প্রায় পঁচিশ বছর পর দেখা হলো। আমার কথা বলতে খুব ইচ্ছা করছে। কোথাও একটু বসবে?
আফজাল আবার একটু হাসলেন। বললেন, আমার সময়ের কোনো অভাব নেই। তখনো সময় ছিল, এখনো আছে। তবে হোটেল বা অন্য কোথাও বসার রুচি আমার নেই। তারচেয়ে চলো আমার সাথে। পাশেই আমার বাসা।
- কোথায়?
- মালিবাগে।
রাজিয়া একটু থেমে কিছু যেন ভাবলেন। তারপর বললেন-বাসায়? বাসায় আর কে কে আছে?
-তুমি গেলেই সেটা দেখতে পাবে।
-এভাবে বাসায় যাওয়াটা কি ঠিক হবে?
- কেন নয়? মেহমান তো বাসাতেই যায়।
রাজিয়া আবার চুপ থাকলেন। তারপর একটা দম ফেলে বললেন, ঠিক আছে, তাই চলো। আমারও তেমন কোনো তাড়া নেই। রাজিয়া তার সাথের ছেলেমেয়ে দুটোকে ডেকে কাছে আনলেন। তাদের সাথে আফজালের পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন, এরা আমার নাতি-নাতনী। ছেলেটির নাম রাসেল। আর মেয়েটির নাম-নাসিমা।
-এরা তোমার নাতি-নাতনী? ওদের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আফজাল বললেন, বাহ চমৎকার! তুমি খুব সুখী মানুষ রাজিয়া।
রাজিয়া একটি রিকসা ডেকে ওদের তুলে দিয়ে বললেন, তোমরা বাসায় চলে যাও। আমি একটু পরে আসছি।
আফজাল বললেন, ওরা কি যেতে পারবে?
-খুব পারবে। কাছেইতো বাসা। মগবাজারে।
রাজিয়ার এই সাফল্যে আফজাল খুব খুশি হলেন। ভাবলেন, যাক! আর যাই হোক রাজিয়া অন্ত ভালো আছে। সংসার নাতি-নাতনী নিয়ে খুব সুখেই আছে।
বাসায় পৌঁছে আফজাল বললেন, বসো রাজিয়া, আমি একটু ভেতর থেকে আসি।
রাজিয়া বসে আছেন।
একটু পরে ফিরে এলেন আফজাল। রাজিয়া জিজ্ঞেস করলেন, বাসায় কি আর কেউ নেই?
- হ্যাঁ আছে।
- কে?
- রোকেয়া। কিন্তু সে এখনও স্কুল থেকে আসেনি।
- রোকেয়া? তোমার মেয়ে বুঝি?
- হ্যাঁ।
- ওর মা কোথায়?
- নেই।
- নেই মানে?
- দু’বছর আগে মারা গেছে।
-বলো কি? তাহলে কিভাবে তোমার সংসার চলছে।
- এই চলে যাচ্ছে একভাবে আর কি। থাক এসব কথা। এবার তোমার খবর বলো।
- কী বলবো?
- তোমার স্বামী সংসার আর নাতি-পুতিরে খবর বলো।
রাজিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, সে অনেক কথা আফজাল। তোমাকে সেসব বলা কি আর ঠিক হবে?
- কেন নয়? তবু যদি আপত্তি থাকে তবে বলো না। জানো, মানুষের এমন কিছু ব্যক্তিগত কথা থাকে যা কেবল তার নিজের জন্য। অন্য কেউ সেই গোপন দরোজা খুলে ভেতরে প্রবেশের অধিকার রাখে না।
রাজিয়া বললেন, না তেমন কিছু গোপনীয় নয়।
- তবে?
- তবে কিছুই নয়। তাহলে শোনো, আমার জীবনেও গত পঁচিশটি বছরে ঘটে গেছে একে একে বহু দুর্ঘটনা।
- দুর্ঘটনা?
-হ্যাঁ। প্রথমে আমার স্বামী অসুখে মারা গেল। তারপর গত পাঁচ বছর আগে আমার একমাত্র ছেলে রাইসুল ইউনিভার্সিটির গোলযোগে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেল। কেন পেপারে দেখেনি?
রাজিয়া আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন। আফজাল বললেন, বলো কি? তাহলে ঐ যে বললে তোমার নাতি-নাতনী।
- ওরা আমার কেউ নয়। আমার বাসায় ভাড়া থাকে। ওদেরকে আগলে আমার দুঃখভার সময়টা কাটাই আর কি!
আফজাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, খুবই মর্মান্তিক খবর শোনালে রাজিয়া। আমি ভেবেছিলাম তুমি বেশ সুখেই আছো।
- আমিওতো তোমার সম্পর্কে তাই ভাবতাম। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম তোমার ভালো থাকার বাস্তব অবস্থা। আচ্ছা বলতো, এমনটি কেন হয়?
- কেমন?
- এই যেমন ধরো আমার যদি ভাবি হয়ে যায় ঠিক তার উল্টোটি।
-এই ঘটে যাওয়া ঘটনার ওপর তো আমাদের কোনো হাত নেই রাজিয়া। বাস্তবতাকে মেনে নেয়া ছাড়া আর উপায় কি বলো? বুঝলে, মানুষ প্রকৃত অর্থে বড়ো অসহায়। এই বয়সে এসে আমি এটা বুঝেছি।
রাজিয়া বললেন, এটাকে আমরা কি আর পরিবর্তন করতে পারিনে?
- কিভাবে?
রাজিয়া একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, আমারও খুব ভয় করছে আফজাল। এই বয়সটাই তার মূল কারণ। ভাবছি, এখনো তো কিছুটা চলতে ফিরতে পারি। কিন্তু তারপর?
- তারপর আবার কী? ঢাকা শহরে বাড়ির মালিক। তোমার আর কিসের ভয়? আফজাল বললেন।
- ওটা তুমি বুঝবে না আফজাল। চুল পেকে গেছে আমার। বয়সও পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। এই বয়সে এসে মনে হচ্ছে-আমি বড্ডো একা। বড্ডো অসহায়। আমার একটি অবলম্বনের প্রয়োজন। তুমি কি আমাকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা করতে পারো?
- আমি? কিভাবে?
রাজিয়ার দৃষ্টি এবার নিচের দিকে নেমে গেল। বললো, যদি কিছু মনে না করো তাহলে বলি। তুমি তোমার মেয়েকে নিয়ে আমার বাসায় নির্দ্বিধায় উঠে আসতে পারো এবং সেটা হলে আমি খুব খুশি হবো।
- কি ভাড়াটে হিসাবে?
- না।
- তবে?
- আমাদের বস হলেও আমরা মানুষ। আর মানুষের অধিকার আছে যে কোনো বয়সে একে অপরের অসহায়ত্ব এবং অনিশ্চয়তায় একাকীত্ব থেকে মুক্তির জন্য বৈধভাবে বসবাস করার। আমরা এখনো সেটা করতে পারি। অসুবিধা কোথায়?
আফজাল এবার একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। বলো কি রাজিয়া? এটা এখন কেমন করে সম্ভব?
- কেন নয়? একবার নিজের দিকে তাকিয়ে দেখতো! তোমার বয়স হয়েছে। তবুও চাকরি করছো। সম্ভবত আর বেশি দিন চাকরি করতে পারবে না। একদিন মেয়েটিকেও বিয়ে দিয়ে পরের ঘরে পাঠাতে হবে। তখন তুমি কী করবে? অবলম্বন হিসাবে কাকে তুমি কাছে পাবে? মানুষতো আর একাকী বাঁচতে পারে না। কোনো মানুষই তো স্বয়ং সম্পূর্ণ নয়। একে অপরের সহযোগিতা ছাড়া মানুষ কিভাবে বেঁচে থাকবে?
আফজাল আবারও নীরব।
রাজিয়া বললেন, ঠিক আছে। এখনই কিছু বলতে হবে না। ভালো করে ভেবে তারপর আমাকে জানাবে। তুমি হয়তো বা সামাজিক লজ্জা বা ভয়ের কথা বলবে, কিন্তু ওটা কিছু নয়। যা কিছু অবৈধ তাই অসামাজিক। আমাদের কঠিন মুহূর্তের জন্য এই সমাজের কেউ কোনোদিন এগিয়ে আসবে না। সুতরাং আমাদের সিদ্ধান্ত আমাদেরকেই নিতে হবে।
আফজাল এবার নীরবতা ভেঙে বললেন, তা আর হয়না রাজিয়া। যেটা হবার নয় তা নিয়ে অনর্থক ভেবে লাভ কি বলো?
রাজিয়া বললেন, তোমার কথা ভেবেও কি আমাকে ক্ষমা করে দিতে পারো না?
ক্ষমার কথা নয় রাজিয়া। তোমাকে আগে যেমন দেখতাম। আজো তেমনি দেখছি। আমার কাছে তুমি বাকিটা জীবন এমনি থাকবে।
- চাকরি ছাড়ার পর তাহলে কোথায় যাবে, কী করবে?
- আমি ভেবেছি চাকরি ছাড়ার পর গ্রামে চলে যাবো। আমার একটি বিধবা বোন আছে। তাকে বাড়িতে এনে তার হাতে রোকেয়াকে তুলে দেব। আর আমি? আমাকে নিয়ে কিছুই ভাবছিনে রাজিয়া।
-এটা তোমার অভিমানের কথা।
- হতে পারে।
- তবুও একবার ভেবে দেখো আফজাল। আমিও খুব অসুস্থ। আমার একটা কিডনি নষ্ট। ব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিকসহ নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত। জানি না এভাবে আর কয়দিনইবা বেঁচে থাকতে পারবো। তোমার সংস্পর্শে এলে হয়তোবা আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে পারতাম। আমাকে জীবিত দেখতে, ভালো দেখতে, সুখী দেখতে তোমার কি একটুও ইচ্ছে হয় না?
রাজিয়ার এই কথার কোনো জবাব দিলেন না আফজাল। প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললেন, তুমি একটু হাসো। আমি চা করে আনি। কাজের মেয়েটি রোকেয়াকে স্কুল থেকে আনতে গেছে।
রাজিয়া উঠতে উঠতে বললেন, না থাক। চায়ের প্রয়োজন নেই। আমি চলে যাচ্ছি। তবে তুমি আর একবার ভেবে দেখবে। আমি আবার আসবো।
বাধা দিলেন না আফজাল। রাজিয়া চলে যাবার পর আফজালের বুকটা ব্যথায় ভরে গেল। ভাবলেন, তার সাথে দেখা না হলেই ভালো হতো। দেখা না হলে অন্তত তিনি এই সান্ত্বনা নিয়ে থাকতে পারতেন যে রাজিয়া ভালো আছে।
আফজালও কি ভালো আছেন? কতটা ভালো আছেন? রাজিয়ার সাথে দেখা হবার সপ্তাহখানেক পরেই তিনি এক্সিডেন্ট করে একটি পা হারালেন। তারপর চাকরি হারিয়ে ফিরে এলেন গ্রামে। বিধবা বোন লতিফাকে এনে রোকেয়ার যাবতীয় দায়-দায়িত্ব তুলে দিলেন তার হাতে এবং তারপর।Ñ
তারপর প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে তিনি একেবারেই অচল হয়ে পড়ে আছেন বিছানায়। পাঁচ বছর আগে দেখা হয়েছিল অসুস্থ রাজিয়ার সাথে। রাজিয়া এখন কেমন আছে? আদৌ কি সে বেঁচে আছে?
জানেন না আফজাল। তিনি কেবল অহসহায়ভাবে শুয়ে শুয়ে ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে আছেন বাইরের দিকে।
সন্ধ্যার গাঢ় অন্ধকার গ্রাস করে নিয়েছে পুরো গ্রাম। সমগ্র পৃথিবী। আজ কি অমাবস্যা? আজ কি আকাশে মেঘ জমেছে? আফজালের ভীষণ জানতে ইচ্ছে হয়। বারান্দার নিচে শুয়ে আছে বয়সী কুকুরটি। বেড়ে। গত সপ্তাহে তার সঙ্গীটি মারা গেছে। সে মারা যাবার পর থেকে বেড়ে আরো নীরব হয়ে গেছে। হয়তোবা সেও ভুলতে পারছে না সঙ্গী হারাবার শোক। বৃদ্ধ হলেও সে একটি জীব। তারও প্রাণ আছে। আর প্রাণ আছে বলেই তার ভেতরও আছে অনিঃশেষ প্রেম এবং ভালোবাসা। বেড়ে কি ঘুমুচ্ছে? তার চোখ দুটো আর তো জ্বলে উঠতে দেখা যাচ্ছে না? নাকি আফজালই তার কুকুরটিকে দেখতে পাচ্ছে না? একটা পাথরের চাঙ যেন ক্রমশ আফজালের বুকের গভীর থেকে উঠে গলার কাছে এসে আটকে গেল।
ভারী পাথরটির নাম-বেদনা।
গলার মুখ থেকে পাথরটিকে কয়েকবার তুলতে চেষ্টা করলেন আফজাল। ব্যর্থ হলেন। তার জীর্ণশীর্ণ পঙ্গু শরীরটাই এক সময় তলিয়ে গেল স্মৃতির সমুদ্রে। আর তিনি সেই অর্থে সাগরে কেবলই অসহায় শিশুর মতো পাক খেতে লাগলেন।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই আফজালের ক্লিষ্ট চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো এবং তারপর।-
তারপর আফজাল অনুভব করলেন কঙ্কালসার দেহটা নিয়ে তার বয়স এবং কাল যেন একবার শূন্যে তুলে আছাড় মারছে। আবার পরক্ষণেই অসীম সমুদ্রে তাকে ফেলে দিয়ে তারা কিনারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কৌতুকভরে দেখছে- অসহায় আফজালের ডুব-সাঁতারের নির্মম-নিষ্ঠুর খেলা।
ক্লান্তিতে ঘন-আরো ঘন হয়ে আসে তার নিঃশ্বাস। তিনি অনিশ্চিত এই যন্ত্রণাকাতর প্রহর থেকে মুক্তি পেতে যান। ছুঁতে চান একটি নির্ভরতার পাড়। কিনারে উঠতে চান। কিন্তু কিভাবে?
তা জানেন না আফজালুর রহমান।
দুই.
শাহীন শুয়ে আছে।
রাত গভীর থেকে গভীরে যাচ্ছে। কিন্তু তার চোখে কোনো ঘুম নেই।
সে ভাবছে, কেবলই ভাবছে। সে কেবল জীবন নিয়ে। জীবনের টানাপড়েন নিয়ে। জীবন-সংসার নিয়ে।
কত বিচিত্র এই জীবন!
মনে পড়ছে তার হাবীব সাহেবের কথা।
বছরের শেষ। ওদিকে শীতটাও এসে গেছে। এসে গেছে বলতে বেশ জেঁকে বসে গেছে।
চারদিকে হিম হিম ঠাণ্ডা। শিরশিরে হাওয়া। ভেজা বাতাস যেন।
হাবীব সাত সকালে বেরিয়ে পড়েছে অফিসের উদ্দেশে। পায়ে বহু পুরনো সেই স্যান্ডেল। কয়েকবার মেরামত করার পরও আর চলছে না। গায়েও কয়েক বছরের পুরনো শার্ট আর রংওঠা বহু পুরনো একটা হাফ জাম্পার। জাম্পারটা তাকে দিয়েছিল তার এক কলিগ। দয়া করে নাকি ভালবেসে সেটা ততটা বুঝে ওঠতে পারেনি হাবীব। বিষয়টাও তেমন প্রশ্নসাপেক্ষ মনে হয়নি তার কাছে। প্রয়োজন ছিল। তিনি খুশি হলে দিলেন। হাবীবও নিলেন সরল মনে। কিন্তু বাসায় সেটা পরে এলে তারিন প্রথমে উসকে দিল জিজ্ঞাসাটা, তিনি করুণা করে দেননি তো?
তারিনের কথাটা শুনার পর ঝিম ধরে উঠলো হাবীবের মাথা। সেও তখন প্রশ্নবিদ্ধ। তাইতো! আগে কেন ভেবে দেখিনি বিষয়টি! হাবীবের এমনটিই ভেবেছিল, শীতটা কাটবে ভাল।
কিন্তু এই মনোজটিলতার পর সে আর জাম্পারটি পরে অফিসে যেতে পারলো না পরদিন। এরপর কয়েকদিনও।
কলিগবন্ধুটি একটু বিস্মিত হলেন।
হাবীবের আত্মমর্যাদায় টান লাগলো কিনা, জিজ্ঞেস করতেও কুণ্ঠাবোধ করছেন। হাবীব সম্পর্কে তার কম জানা নেই। পাশাপাশি চেয়ারে বসে দশটি বছর। তার চারপাশের চেয়ারে আছেন, বেতন যদিও সবার প্রায় একই, তবুও তারা নানা সিঁড়ি বেয়ে অনেক কিছুই করে নিয়েছেন। চেহারার হাল ছুরত দেখলেও তার জৌলুস আঁচ করা যায়। কেবল পারেনি হাবীব। যে এত দিনেও কিছুই পারেনি, সে যে আগামীতেও পেরে উঠবে এমন কোনো ভরসা নেই কলিগ বন্ধুটির।
অর্থকষ্টে হাবীব ব্যথিত। তবে আনন্দিতও বটে। কারণ অনেক পচন থেকে সে এখনও সযতনে নিজেকে রক্ষা করে চলতে পেরেছে।
অভাব নিয়ে তারিনেরও কোনো অভিযোগ নেই। এটা হাবীবের জন্য একটা চরম পাওয়া। যে অসহায়ত্বের মধ্যে আছে, তাতেই সে খুশি। পাশের বাসা বা ফ্ল্যাটের কারোর সাথে তার প্রতিযোগিতা নেই, মনের কষ্ট নেই, এসব নিয়ে দৌড়ঝাঁপ নেইআজকের দিনে এটাও কি দম কথা! এ কারণে এই স্বভাবের জন্য হাবীব খুব পরিতৃপ্ত।
হেসে বললেন, কি হাবীব ভাই, জাম্পারটা পছন্দ হয়নি? হাবীব মুচকি হাসি হাসলো।
হাবীবের হাসির রহস্য বুঝে ওঠা সহজ তা সময় নয় তার জন্য।
তিনি প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, তবেকি ভাবি পছন্দ করেননি!
হাবীব আবারও মুচকি হাসলো।
তিনি এবার হয়তোবা একটু বুঝতে পারলেন, একটু জোরে হেসে বললেন, বুঝলেন, আমার ছোট ভাই। সে ব্যাংকে চাকরি করে। আমার জন্য এবার দুটো জাম্পার নিয়ে এলো। আমার তো আরও আছে। ভাবলাম একটা জাম্পার কাকে দেয়া যায়? পরক্ষণেই মনে পড়লো আপনার কথা। এই দশ বছরে আপনার মত বন্ধু আমার ভাগ্যে আর একটাও জোটেনি। আপনাকে খুব কাছের মনে হয়। এজন্য চট করে একটা জাম্পার আপনার জন্য ব্যাগে তুলে নিলাম। বিশ্বাস করুন, করুণা করে নয়, আপনার দুরবস্থার কথা ভেবে নয়Ñ কেবল ভালোবেসে, বুঝলেন, কেবল ভালোবেসেই ওটা আপনাকে দিয়েছি। আপনি পরলে আমি খুশি হব।
সেই জাম্পারÑ তার বয়সও পাঁচ বছর হয়ে গেল। প্রতি শীতেই সেটা গায়ে দেয় হাবীব। পরতে পরতে সেটা বিবর্ণ হয়ে গেছে।
তা যাক, শীতটা যে কিছুটা আটকে আছে, এটাই তার আনন্দ।
সময় মত অফিসে পৌঁছানো হাবীবের অভ্যাস। এটাকে সে নৈতিক দায়িত্ব বলেও মনে করে। তার বোধ এ ব্যাপারে পরিষ্কার। অফিসের নিয়ম-নীতি, বেতন, সবকিছু মেনে নিয়েই সে চাকরি শুরু করেছে। তবে কেন তার ব্যত্যয় ঘটবে! যেটুকু অনিয়ম করবে, সেটুকুও অন্যায়। বেতনের অতিরিক্ত যেটুকু-অর্থ গ্রহণ করবে, সেটুকু অবৈধ। অফিস সময়ে যেটুকু ফাঁকি দেবেÑসেটুকু অনৈতিক। এটা কখনো কোনো সভ্য মানুষের জন্য কাম্য হতে পারে না। উচিতও নয়।
হাবীব এ ব্যাপারে নিঃসঙ্গ। নিঃসঙ্গ হলেও অপ্রতিরোধ্য এবং নীতিতে সুদৃঢ়। তার এই সুনীতির কারণে যে তার প্রমোশন কিংবা বেতন বৃদ্ধি ঘটেছেÑতাও নয়। বরং যারা যতবেশি সুযোগ সন্ধানী ও চাটুকারÑতারা ততবেশি এগিয়ে গেছে। যায়। তারাই ক্রমশ এগিয়ে যায়। দ্রুত এগিয়ে যায়।
তা যাক। হাবীবের এসব নিয়ে যেমন দৌড় বা প্রতিযোগিতা নেই, তেমনি নেই কোনো আফসোসও। সে ভাবে, বিত্ত-বৈভব বড় কথা নয়। এটা তো এখন কত শত মানুষের আছে। কিন্তু একজন সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও ভালো মানুষ হয়ে থাকাÑ এটাই এখন বড় কথা। চ্যালেঞ্জও বটে।
সেই সুকঠিন চ্যালেঞ্জই গ্রহণ করেছে হাবীব।
বাসা থেকে দশ মিনিট হাঁটার পর গাড়ি। রিকশায় এলে দশ টাকা লাগে পথটুকু। কিন্তু দশ টাকা প্রতিদিন খরচের চেয়ে দশ মিনিট হাঁটাই হাবীবের কাছে অনেকটা সহজ। হেঁটেই সে বাস্ট্যান্ডে এসেছে।
বাসে প্রচণ্ড ভিড়। কিছুটা অপেক্ষা কররে। শাঁ শাঁ করে চলে গেল বেশ ক’টা গাড়ি। যাত্রীভর্তি। পা রাখার জায়গা নেই। এই ভিড়ের মধ্যে আবার দুটো পা সে কোথায় রাখবে?
কিন্তু আর অপেক্ষাও করা যায় না।
কারণ এখান থেকে একটা বাসে ওঠার পর আবার বাস পাল্টাতে হবে। উঠতে হবে অন্য আর একটি বাসে। তারপর আর দশ মিনিট হাঁটলে অফিসে পৌঁছুতে পারবে।
হাতে সময় কম।
ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠছে হাবীব। আর দেরি সইছে না। ভাবছে, এবার একটি বাস এলেই হয়, যত ভিড়ই হোক উঠে পড়তে হবে। নইলে অফিসে দেরি হয়ে যাবে।
একটু অপেক্ষার পর বাস একটা এলো।
তার অবস্থাও শোচনীয়। তবুও কিছু করার নেই। আল্লাহর নাম নিয়ে উঠে পড়লো হাবীব।
বাসের দরোজার মুখে কোনো রকম একটা পা রেখে আর একটা পা বাইরে ঝুলিয়ে দিল। এক হাতের পাঁচটা আঙুল দিয়েও ধরতে পারলো না হ্যান্ডেলটি। বাদুড়ঝোলার চেয়েও নাজুক অবস্থা।
এভাবে অপর গন্তব্যে গিয়ে নেমে পড়লো সে।
এরপর আবার অপেক্ষা।
আবার বাস এলো। আবারও জীবন-মরণ চার আঙুলে আর এক পায়ের পাতায় ভর করে ছুটে চললো হাবীব।
অবশেষে অফিসে যখন পৌঁছুলো তখন দেখলো, এখনো দু মিনিট সময় হাতে আছে।
কষ্টে-ক্লান্তিতে অবসন্ন সে।
চেয়ারে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে উদাস দৃষ্টিতে সামনের দেয়ালে তাকালো হাবীব। শীত বলে ফ্যান চলছে না রুমে। সুতরাং সামনের দেয়ালের ক্যালেন্ডারের পাতাটি স্থির আছে।
আজ মাসের শেষ দিন। বছরেরও। কালই দেয়াল থেকে নেমে পড়বে ক্যালেন্ডারটি। উঠবে নতুন দিনের, নতুন বছরের নতুন চকচকে ক্যালেন্ডার।
দিন যাবে, মাস যাবে। প্রতি মাসেই উল্টাবে ক্যালেন্ডারের পাতা। এভাবে একদিন শেষও হয়ে যাবে বছর। আবার দেয়ালে উঠবে নতুন ক্যালেন্ডার।
কিন্তু হাবীবের জীবন? সে জানে, ক্যালেন্ডারের মত বদলে যাবার নয় তার জীবন, তার সময়। জীবন-সে যেন অনড় পাথর।
সেই পাথর ওল্টানোর সাধ্য নেই হাবীবের। তার তেমন কোনো জাদুও আয়ত্তে নেই। তবে যে রিমোটে চাপ দিলে ভারী পাথরটির রূপ বদলে যেতে পারে, সেটা চিনলেও হাবীবের ইচ্ছা, রুচিÑকোনোটাই তার অনুকূলে নেই।
এটাকে অনেকেই ভীরু বা কাপুষের কাজ বলে মনে করে। কিন্তু হাবীবের অভিমত অন্যরকম। সে মনে করে, না ভীরুতা বা কাপুরুষতা নয়, বরং সততার সাথে টিকে থাকাটা ভীষণ ভয়ঙ্কর এক সাহসের ব্যাপার। যারা স্রোতের প্রতিকূলে এভাবে চলতে পারে, প্রকৃত অর্থে, তারাই সাহসী।
কলিগ বন্দুটিও প্রায় পনের মিনিট পর অফিসে এলো। ততক্ষণে হাবীবের অনেক কাজ করা শেষ।
চেয়ারে বসার আগে তিনি একবার এলেন হাবীবের টেবিলের সামনে। কুশল বিনিময়ের পর হঠাৎ তিনি হাবীবের চেয়ারের কাছে গিয়ে বললেন, একি হাবীব ভাই! আপনার জাম্পারের গলার একটা পাশ ছিঁড়ে যে ঝুলে পড়েছে! এটা কেমন করে হলো!
জাম্পারের গলা যে ছিঁড়ে একপাশে ঝুলে পড়েছে, সেটা একটুও খেয়াল করেনি হাবীব। দু’টি বাসের যাত্রীদের ধকলে যে এটা হয়েছে, সেটা বুঝতে একটুও বাকি থাকলো না হাবীবের।
যতক্ষণ বুঝতে পারেনি, ততক্ষণ পড়ে থাকলে খারাপ লাগেনি। এখন লাগছে।
ওটা এখন পড়ে থাকবে না খুলে ফেলবে সেটাই ভাবছে।
কলিগ হেসে বললেন, কিচ্ছু ভাববেন না হাবীব ভাই, আমি আর একটা জাম্পার আপনাকে কিনে দেব। আজই।
ছেঁড়া জাম্পারের ঝুলে পড়া অংশটিতে হাত বুলোতে বুলোতে হাবীব তাকালো তার দিকে। আবারও সেই মুচকি হাসি।
হাবীবের এই মুচকি হাসির অর্থ যে কিÑসেটা বুঝে উঠতে পারলো তার কলিগ।
শাহীন শুয়ে আছে।
রাত গভীর থেকে গভীরে যাচ্ছে। কিন্তু তার চোখে কোনো ঘুম নেই।
সে ভাবছে, কেবলই ভাবছে। সে কেবল জীবন নিয়ে। জীবনের টানাপড়েন নিয়ে। জীবন-সংসার নিয়ে।
কত বিচিত্র এই জীবন!
মনে পড়ছে তার হাবীব সাহেবের কথা।
বছরের শেষ। ওদিকে শীতটাও এসে গেছে। এসে গেছে বলতে বেশ জেঁকে বসে গেছে।
চারদিকে হিম হিম ঠাণ্ডা। শিরশিরে হাওয়া। ভেজা বাতাস যেন।
হাবীব সাত সকালে বেরিয়ে পড়েছে অফিসের উদ্দেশে। পায়ে বহু পুরনো সেই স্যান্ডেল। কয়েকবার মেরামত করার পরও আর চলছে না। গায়েও কয়েক বছরের পুরনো শার্ট আর রংওঠা বহু পুরনো একটা হাফ জাম্পার। জাম্পারটা তাকে দিয়েছিল তার এক কলিগ। দয়া করে নাকি ভালবেসে সেটা ততটা বুঝে ওঠতে পারেনি হাবীব। বিষয়টাও তেমন প্রশ্নসাপেক্ষ মনে হয়নি তার কাছে। প্রয়োজন ছিল। তিনি খুশি হলে দিলেন। হাবীবও নিলেন সরল মনে। কিন্তু বাসায় সেটা পরে এলে তারিন প্রথমে উসকে দিল জিজ্ঞাসাটা, তিনি করুণা করে দেননি তো?
তারিনের কথাটা শুনার পর ঝিম ধরে উঠলো হাবীবের মাথা। সেও তখন প্রশ্নবিদ্ধ। তাইতো! আগে কেন ভেবে দেখিনি বিষয়টি! হাবীবের এমনটিই ভেবেছিল, শীতটা কাটবে ভাল।
কিন্তু এই মনোজটিলতার পর সে আর জাম্পারটি পরে অফিসে যেতে পারলো না পরদিন। এরপর কয়েকদিনও।
কলিগবন্ধুটি একটু বিস্মিত হলেন।
হাবীবের আত্মমর্যাদায় টান লাগলো কিনা, জিজ্ঞেস করতেও কুণ্ঠাবোধ করছেন। হাবীব সম্পর্কে তার কম জানা নেই। পাশাপাশি চেয়ারে বসে দশটি বছর। তার চারপাশের চেয়ারে আছেন, বেতন যদিও সবার প্রায় একই, তবুও তারা নানা সিঁড়ি বেয়ে অনেক কিছুই করে নিয়েছেন। চেহারার হাল ছুরত দেখলেও তার জৌলুস আঁচ করা যায়। কেবল পারেনি হাবীব। যে এত দিনেও কিছুই পারেনি, সে যে আগামীতেও পেরে উঠবে এমন কোনো ভরসা নেই কলিগ বন্ধুটির।
অর্থকষ্টে হাবীব ব্যথিত। তবে আনন্দিতও বটে। কারণ অনেক পচন থেকে সে এখনও সযতনে নিজেকে রক্ষা করে চলতে পেরেছে।
অভাব নিয়ে তারিনেরও কোনো অভিযোগ নেই। এটা হাবীবের জন্য একটা চরম পাওয়া। যে অসহায়ত্বের মধ্যে আছে, তাতেই সে খুশি। পাশের বাসা বা ফ্ল্যাটের কারোর সাথে তার প্রতিযোগিতা নেই, মনের কষ্ট নেই, এসব নিয়ে দৌড়ঝাঁপ নেইআজকের দিনে এটাও কি দম কথা! এ কারণে এই স্বভাবের জন্য হাবীব খুব পরিতৃপ্ত।
হেসে বললেন, কি হাবীব ভাই, জাম্পারটা পছন্দ হয়নি? হাবীব মুচকি হাসি হাসলো।
হাবীবের হাসির রহস্য বুঝে ওঠা সহজ তা সময় নয় তার জন্য।
তিনি প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, তবেকি ভাবি পছন্দ করেননি!
হাবীব আবারও মুচকি হাসলো।
তিনি এবার হয়তোবা একটু বুঝতে পারলেন, একটু জোরে হেসে বললেন, বুঝলেন, আমার ছোট ভাই। সে ব্যাংকে চাকরি করে। আমার জন্য এবার দুটো জাম্পার নিয়ে এলো। আমার তো আরও আছে। ভাবলাম একটা জাম্পার কাকে দেয়া যায়? পরক্ষণেই মনে পড়লো আপনার কথা। এই দশ বছরে আপনার মত বন্ধু আমার ভাগ্যে আর একটাও জোটেনি। আপনাকে খুব কাছের মনে হয়। এজন্য চট করে একটা জাম্পার আপনার জন্য ব্যাগে তুলে নিলাম। বিশ্বাস করুন, করুণা করে নয়, আপনার দুরবস্থার কথা ভেবে নয়Ñ কেবল ভালোবেসে, বুঝলেন, কেবল ভালোবেসেই ওটা আপনাকে দিয়েছি। আপনি পরলে আমি খুশি হব।
সেই জাম্পারÑ তার বয়সও পাঁচ বছর হয়ে গেল। প্রতি শীতেই সেটা গায়ে দেয় হাবীব। পরতে পরতে সেটা বিবর্ণ হয়ে গেছে।
তা যাক, শীতটা যে কিছুটা আটকে আছে, এটাই তার আনন্দ।
সময় মত অফিসে পৌঁছানো হাবীবের অভ্যাস। এটাকে সে নৈতিক দায়িত্ব বলেও মনে করে। তার বোধ এ ব্যাপারে পরিষ্কার। অফিসের নিয়ম-নীতি, বেতন, সবকিছু মেনে নিয়েই সে চাকরি শুরু করেছে। তবে কেন তার ব্যত্যয় ঘটবে! যেটুকু অনিয়ম করবে, সেটুকুও অন্যায়। বেতনের অতিরিক্ত যেটুকু-অর্থ গ্রহণ করবে, সেটুকু অবৈধ। অফিস সময়ে যেটুকু ফাঁকি দেবেÑসেটুকু অনৈতিক। এটা কখনো কোনো সভ্য মানুষের জন্য কাম্য হতে পারে না। উচিতও নয়।
হাবীব এ ব্যাপারে নিঃসঙ্গ। নিঃসঙ্গ হলেও অপ্রতিরোধ্য এবং নীতিতে সুদৃঢ়। তার এই সুনীতির কারণে যে তার প্রমোশন কিংবা বেতন বৃদ্ধি ঘটেছেÑতাও নয়। বরং যারা যতবেশি সুযোগ সন্ধানী ও চাটুকারÑতারা ততবেশি এগিয়ে গেছে। যায়। তারাই ক্রমশ এগিয়ে যায়। দ্রুত এগিয়ে যায়।
তা যাক। হাবীবের এসব নিয়ে যেমন দৌড় বা প্রতিযোগিতা নেই, তেমনি নেই কোনো আফসোসও। সে ভাবে, বিত্ত-বৈভব বড় কথা নয়। এটা তো এখন কত শত মানুষের আছে। কিন্তু একজন সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও ভালো মানুষ হয়ে থাকাÑ এটাই এখন বড় কথা। চ্যালেঞ্জও বটে।
সেই সুকঠিন চ্যালেঞ্জই গ্রহণ করেছে হাবীব।
বাসা থেকে দশ মিনিট হাঁটার পর গাড়ি। রিকশায় এলে দশ টাকা লাগে পথটুকু। কিন্তু দশ টাকা প্রতিদিন খরচের চেয়ে দশ মিনিট হাঁটাই হাবীবের কাছে অনেকটা সহজ। হেঁটেই সে বাস্ট্যান্ডে এসেছে।
বাসে প্রচণ্ড ভিড়। কিছুটা অপেক্ষা কররে। শাঁ শাঁ করে চলে গেল বেশ ক’টা গাড়ি। যাত্রীভর্তি। পা রাখার জায়গা নেই। এই ভিড়ের মধ্যে আবার দুটো পা সে কোথায় রাখবে?
কিন্তু আর অপেক্ষাও করা যায় না।
কারণ এখান থেকে একটা বাসে ওঠার পর আবার বাস পাল্টাতে হবে। উঠতে হবে অন্য আর একটি বাসে। তারপর আর দশ মিনিট হাঁটলে অফিসে পৌঁছুতে পারবে।
হাতে সময় কম।
ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠছে হাবীব। আর দেরি সইছে না। ভাবছে, এবার একটি বাস এলেই হয়, যত ভিড়ই হোক উঠে পড়তে হবে। নইলে অফিসে দেরি হয়ে যাবে।
একটু অপেক্ষার পর বাস একটা এলো।
তার অবস্থাও শোচনীয়। তবুও কিছু করার নেই। আল্লাহর নাম নিয়ে উঠে পড়লো হাবীব।
বাসের দরোজার মুখে কোনো রকম একটা পা রেখে আর একটা পা বাইরে ঝুলিয়ে দিল। এক হাতের পাঁচটা আঙুল দিয়েও ধরতে পারলো না হ্যান্ডেলটি। বাদুড়ঝোলার চেয়েও নাজুক অবস্থা।
এভাবে অপর গন্তব্যে গিয়ে নেমে পড়লো সে।
এরপর আবার অপেক্ষা।
আবার বাস এলো। আবারও জীবন-মরণ চার আঙুলে আর এক পায়ের পাতায় ভর করে ছুটে চললো হাবীব।
অবশেষে অফিসে যখন পৌঁছুলো তখন দেখলো, এখনো দু মিনিট সময় হাতে আছে।
কষ্টে-ক্লান্তিতে অবসন্ন সে।
চেয়ারে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে উদাস দৃষ্টিতে সামনের দেয়ালে তাকালো হাবীব। শীত বলে ফ্যান চলছে না রুমে। সুতরাং সামনের দেয়ালের ক্যালেন্ডারের পাতাটি স্থির আছে।
আজ মাসের শেষ দিন। বছরেরও। কালই দেয়াল থেকে নেমে পড়বে ক্যালেন্ডারটি। উঠবে নতুন দিনের, নতুন বছরের নতুন চকচকে ক্যালেন্ডার।
দিন যাবে, মাস যাবে। প্রতি মাসেই উল্টাবে ক্যালেন্ডারের পাতা। এভাবে একদিন শেষও হয়ে যাবে বছর। আবার দেয়ালে উঠবে নতুন ক্যালেন্ডার।
কিন্তু হাবীবের জীবন? সে জানে, ক্যালেন্ডারের মত বদলে যাবার নয় তার জীবন, তার সময়। জীবন-সে যেন অনড় পাথর।
সেই পাথর ওল্টানোর সাধ্য নেই হাবীবের। তার তেমন কোনো জাদুও আয়ত্তে নেই। তবে যে রিমোটে চাপ দিলে ভারী পাথরটির রূপ বদলে যেতে পারে, সেটা চিনলেও হাবীবের ইচ্ছা, রুচিÑকোনোটাই তার অনুকূলে নেই।
এটাকে অনেকেই ভীরু বা কাপুষের কাজ বলে মনে করে। কিন্তু হাবীবের অভিমত অন্যরকম। সে মনে করে, না ভীরুতা বা কাপুরুষতা নয়, বরং সততার সাথে টিকে থাকাটা ভীষণ ভয়ঙ্কর এক সাহসের ব্যাপার। যারা স্রোতের প্রতিকূলে এভাবে চলতে পারে, প্রকৃত অর্থে, তারাই সাহসী।
কলিগ বন্দুটিও প্রায় পনের মিনিট পর অফিসে এলো। ততক্ষণে হাবীবের অনেক কাজ করা শেষ।
চেয়ারে বসার আগে তিনি একবার এলেন হাবীবের টেবিলের সামনে। কুশল বিনিময়ের পর হঠাৎ তিনি হাবীবের চেয়ারের কাছে গিয়ে বললেন, একি হাবীব ভাই! আপনার জাম্পারের গলার একটা পাশ ছিঁড়ে যে ঝুলে পড়েছে! এটা কেমন করে হলো!
জাম্পারের গলা যে ছিঁড়ে একপাশে ঝুলে পড়েছে, সেটা একটুও খেয়াল করেনি হাবীব। দু’টি বাসের যাত্রীদের ধকলে যে এটা হয়েছে, সেটা বুঝতে একটুও বাকি থাকলো না হাবীবের।
যতক্ষণ বুঝতে পারেনি, ততক্ষণ পড়ে থাকলে খারাপ লাগেনি। এখন লাগছে।
ওটা এখন পড়ে থাকবে না খুলে ফেলবে সেটাই ভাবছে।
কলিগ হেসে বললেন, কিচ্ছু ভাববেন না হাবীব ভাই, আমি আর একটা জাম্পার আপনাকে কিনে দেব। আজই।
ছেঁড়া জাম্পারের ঝুলে পড়া অংশটিতে হাত বুলোতে বুলোতে হাবীব তাকালো তার দিকে। আবারও সেই মুচকি হাসি।
হাবীবের এই মুচকি হাসির অর্থ যে কিÑসেটা বুঝে উঠতে পারলো তার কলিগ।
তিন.
বিশাল জগৎ সংসারে কত লোকের বসবাস।
কত বিচিত্র তাদের জীবন-যাপন। কেউ পাঁচ তলায় আবার কেউ বা গাছ তলায়।
ঘটে, জগতে এমটাই ঘটে। ঘটতে থাকে। তার ভেতর থেকেই উঠে আসে একেকটি জীবনচরিত। যাদেরকে ভোলা যায় না কখনো। ভোলা যায় না তাদের জীবন সংগ্রামের কথা। কারণ ঐ সংগ্রামের মধ্যেইতো রয়ে গেছে প্রকৃত শিক্ষা। আজ ও আগামীর জন্য।
শাহীনের আজ কিছুই ভালো লাগছে না। জীবনটা এত জটিল এবং কঠিন কেন। ভাবতে থাকে শাহীন। তার চোখে ঝিলিক দিয়ে ওঠে কামাল চাচার কথা।
কামাল চাচা! সেই এক জীবন বটে!Ñ
তার কথা আজ শাহীনের খুব বেশি করে মনে পড়ছে।
কেন পড়বে না! এমন সংগ্রামী জীবনের কথা কেউ কি ভুলতে পারে।
শাহীনও পারে না। তার মনে পড়ে কামাল চাচার দুমড়ানো-মুচড়ানো সেই ছবিটার কথা। জীবনের কথা।Ñ
কামাল উদ্দীন অফিসে পৌঁছুতেই তার শরীরের ভেতর কেমন যেন শিরশির করে উঠলো।
পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে পিওনের চাকরি নিয়েছিল কামাল জীবনের প্রথম বয়সে। সেই শুরু।
কতটা বছর চলে গেছে এর মধ্যে।
কতটা সময় গড়িয়ে গেছে কামালের জীবনের ওপর দিয়ে। এই অফিসেই। একই পদে। এতো বছরের চাকরি জীবনে সে কতো মানুষকে দেখেছে। কতো বিচিত্র চরিত্রের মানুষের সাথে দেখা হয়েছে। ভালো-মন্দ সব রকমের বসকেই সে দেখেছে। কাউকে দেখেছে নির্মম-নিষ্ঠুর, আবার কাউকে দেখেছে দয়ালু, সৎ ও ভালো মানুষ হিসেবে। আল্লাহর পৃথিবীতে হাজার রকমের মানুষ। হাজার রকমের স্বভাব তাদের।
এসব নিয়ে এখন আর সে ভাবছে না।
অফিসে প্রবেশ করে কামাল আজ দেখছে তার ব্যবহারের কেটলি, কাপ, চামচ এবং ছোট্ট বাক্সটিকে। তার দৃষ্টির সীমায় রয়েছে সেই পুরনো চেয়ার, টেবিল, সেই দেয়াল, বসের আলমিরা এবং দেয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডার।
দেখতে দেখতে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে কামালের। কম দামি মোটা লেন্সের চশমার ভেতর তার ক্রমাগত ঝরে পড়া গরম অশ্র“তে ভিজে ওঠে দুই চোয়াল। ক্যালেন্ডারে হাত রেখে কামাল হু হু করে কেঁদে ওঠে।
কাল নতুন বছরের প্রথম দিন।
আজকের দিনটি ক্যালেন্ডারের শেষ দিন।
আগামীকাল এই দেয়ালে নতুন ক্যালেন্ডার উঠবে। নেমে যাবে পুরনো ক্যালেন্ডার।
ক্যালেন্ডারের মতোই কামালের জীবনটা। শুধু কামাল কেন, সকল মানুষের অবস্থা এমনি। আসা এবং যাওয়া। এটাইতো পৃথিবীর নিয়ম।
নিয়ম হলেও এটা মেনে নেয়া বড়ো কষ্টের। বড়ো যন্ত্রণার। এই অভিজ্ঞতা যার নেই, সে কী করে বুঝবে আত্মযন্ত্রণার বিষের দাহ?
কামাল চোখ মুছে পেছনে ফিরতেই রহমত আলী বললো, কেমন আছো কামাল মিয়া? রহমত আলীর বয়স চল্লিশের ওপর। কামাল তার চেয়েও অন্তত পনের বছরের বড়ো। রহমত আলী পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে কেরানির চাকরি করে। কেরানি হলেও তো কামালের ওপর।
কামালের বয়সের আর কেউ এই সেকশনে নেই। তবু তাকে সবাই তুমি করে কথা বলে। তবু ভালো নামের শেষে একটা মিয়া যোগ করেছে। হাজার হোক পিওন বলে কথা। তাদের আবার সম্মান কী? অফিসের অন্যদের ব্যবহারে কামালের মনে হয়েছে, পিওনরা কোনো মানুষের মধ্যেই পড়ে না। তাদের না আছে সুখ দুঃখ, না আছে অনুভূতি, না আছে বোধশক্তি।
এসবে কামালের এখন আর কষ্ট লাগে না। দুর্ব্যবহার হজম করতে করতে অপমানের অনুভূতিটাও কেমন ভোঁতা হয়ে গেছে। রহমত অন্যদিন যেভাবে হুকুমের সুরে কথা বলে, আজকের স্বরটা অবশ্য তারচেয়ে অনেক কোমল।
রহমতের কথায় কামাল চোখ তুলে তাকালো। কামালের চোখ দুটো তখনো ভেজা ভেজা। রহমত সেটা বুঝতে পারলো। বললো, মনটা আজ খুব খারাপ বুঝি?
না স্যার, খারাপ হবে কেন? আর মনটা খারাপ করেই বা কী লাভ?
হ্যাঁ তাই। একদিন তো আমাকেও এ অফিস থেকে চলে যেতে হবে। কেউ কি আর চিরকাল চাকরি করতে পারে?
কামাল কাঁপাগলায় বললো, ঠিকই তো। আজ অফিস থেকে বিদায় নিতে হবে। তারপর একদিন তো চিরকালের মতো পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো।
চেয়ারে বসতে রহমত বললো, এদিকে এসো কামাল মিয়া, তোমার সাথে একটু গল্প করি। আর সময় হবে কিনা কে জানে?
রহমতের টেবিলের সামনে এসে কামাল দাঁড়ালো। রহমত চেয়ার দেখিয়ে বললো, বসো।
কামাল বললো, না স্যার। এতোকাল যখন বসতে পারিনি, তখন আজ আর নাই বা বসলাম।
বসলে কোনো অসুবিধা নেই। তুমি বসো।
কামাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, বসবো না স্যার। কি বলবেন, বলুন। আপনার জন্য কি চা আনবো?
রহমত যেন একটু ধাক্কা খেল। বললো, না। চায়ের দরকার নেই।
তবে?
রহমতের চোখে মুখেও এক ধরনের বেদনা ও বিষণœতার ছাপ। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রহমতের দিকে।
গতকাল সেকশন ইনচার্জ করিম সাহেবকে রহমত বলেছিল, কামাল মিয়া তো আগামীকাল অবসর নিচ্ছে। আমাদের সেকশনে সে বহুকাল আছে। তার বিদায়ের সময় আমাদের কিছু করা উচিত।
রহমানের কথার প্রতি ভ্রƒক্ষেপও করলো না করিম সাহেব। মানুষের জন্য মানুষের এই সামান্য মানবতাবোধটুকুর আশা করেছিল রহমত। করিম সাহেবের কাছে কথাটি বলে রহমত যে ধাক্কাটি খেল, তা সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না। অপমানটি যেন কামালের জন্য নয়, তার নিজের জন্যই এই অপমানের কাঁটা। বলতে গিয়েও কথাটি আর বললো না রহমত। ভাবলো, কামাল মিয়া তাহলে আরও বেশি কষ্ট পাবে। প্রসঙ্গ পালটিয়ে রহমত বললো, কামাল মিয়া, জানো তো কাল আমাদের বিভাগের বার্ষিক ক্রীড়া উৎসব?
হ্যাঁ জানি।
তুমি আসবে তো?
কামাল মাথা নিচু করে একটা দম ছাড়লো। একটু সময় নিয়ে বললো, আপনাদের খেলার মাঠে আমার যাবার কি কোনো দরকার আছে? তাছাড়া আজই তো আমার শেষ দিন।
শেষ দিন তাতে কী হয়েছে? কাল বছরের প্রথম। আমাদের ক্রীড়া উৎসবও কাল। আমি চাই তুমি আসবে। আমরা সকলে মিলেমিশে দিনটি আনন্দে কাটিয়ে দেব। কি আসবে তো?
রহমত পরিবেশটাকে একটু হালকা করার জন্য বললো, বুঝলে কামাল মিয়া, আমি ঠিক করেছিÑ কাল মাঠে একটি মানুষ একাকী দৌড়াবে এবং তাকে পুরস্কৃত করা হবে। এ ব্যাপারে আমি আজ সবার সাথে আলাপ করবো। আশা করি আমার এ প্রস্তাবটা কেউ ফেলবে না। খেলাটি কেমন হবে বলোতো?
কামাল বললো, আপনার এমন অদ্ভুত বুদ্ধিটা কেমন করে মাথায় এলো স্যার? কে দৌড়াবে মাঠে?
রহমত বললো, দৌড়াবে তুমি।
আমি? এই বৃদ্ধ বয়সে একাকী মাঠে দৌড়াবো এটা কোন ধরনের খেলা স্যার?
রহমত বললো, এটা কোন ঠাট্টা নয় কামাল মিয়া। তুমি মনে কষ্ট নিও না। এই খেলাটি এমন এক খেলা-যা মানুষকে তার নিজের দিকে ফিরিয়ে দেয়। একটা মাঠে মাত্র একটি মানুষ দৌড়াচ্ছে, ভাবোতো ব্যাপারটি কেমন? জানো, আমার আব্বাও ছিল তোমার মতো একজন পিওন। সে যেদিন অবসর নিয়েছিল, সেই দিনটিও ছিল বছরের শেষ দিন। আমার আব্বাকে দেখেছিলাম, একটি মাঠে সে একাকী দৌড়াচ্ছে। দৌড়াতে দৌড়াতে এক সময়…
রহমতের দুুুচোখ ছল ছল করে উঠলো। চোখ মুছে বললো, তারপরও আব্বা বেঁচে ছিল দশ বছর। আব্বার দৌড় কিন্তু থামেনি। তার মৃত্যুর আগ পর্যন্তও আমাদের জন্য তাকে দৌড়াতে দেখেছি। বুঝলে কামাল মিয়া, একবার দৌড় শুরু করলে আর থামা যায় না। তুমিও থামতে পারবে না। না, ইচ্ছে করলেও পারবে না।
রহমতের মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কামাল। ভাবলো, সত্যিইতো তার জীবনে কোনো ছুটি নেই। যে দৌড় সে পনের বছর থেকে শুরু করেছে, সে দৌড় এখনও আছে। আগামীতেও থাকবে। তা না হলে তিনটে ছেলেমেয়েকে নিয়ে সে কিভাবে চলবে?
আজ বছরের শেষ দিন।
আজ কামালের চাকরিজীবনেরও শেষ দিন।
কোনো কাজে আজ তার মন বসছে না। সে কেবলই ভাবছে, এই অফিস, আসবাবপত্র, এই সকল মানুষের মায়াকে ছিন্ন করে তাকে চলে যেতে হচ্ছে। আগামীকাল সে এখানে এলেও আজকের দিনটির মতো অন্তত নিজের মতো করে বসতে পারবে না। এসব ভাবতে ভাবতে কামালের হৃদয়ে একটি বেদনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
ধীরে ধীরে অফিস টাইম শেষ হতে চলেছে। যার যার মতো একে একে সবাই অফিস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। সাহেব কয়েকবার কামালকে ডেকেছে। এটা ওটা চেয়েছে তার কাছে। বেলা দুটোর আগেই সে অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু কামাল যে চলে যাচ্ছে, একথা একবারও তার মনে পড়লো না! কামালের মনমরা দেখেও করিম সাহেব বোধ হয় কিছু বুঝতে পারেননি। তাকে একবার অন্তত একটি সান্ত্বনার কথা বলতে পারতেন। কিন্তু তিনি বললেন না।
ব্যাপারটিতে কামাল খুব কষ্ট পেল। এতকাল যেখানে চাকরি করলো, একটা জীবন যেখানে সে শেষ করে দিল, সেখানে এ ধরনের অমানবিক আচরণের আশা কামাল করেনি।
পীড়িত হলেও কামাল পিওন। তার দুঃখ আর মর্মবেদনা বোঝার জন্য কেবা আর থাকতে পারে?
কামাল ভারাক্রান্ত মনে জীবনের শেষ কাজগুলো করে যাচ্ছে। টেবিলের বিক্ষিপ্ত ফাইলপত্র গুছিয়ে রাখছে। এবার তারও বিদায়ের পালা।
পেছন থেকে আবার রহমতের গলা শোনা গেল, কি কামাল মিয়া, কাজ কি শেষ হলো? কাজতো কখনো শেষ হবে না। খামোখা দেরি করে লাভ কি বলো, চলো বেরিয়ে পড়ি।
কামাল রহমতের দিকে তাকালো। তার মুখে কোনো কথা নেই। সে যেন সকল ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। রহমত আবার জিজ্ঞেস করলো, কি যাবে নাকি? চলো আজ এক সাথে যাই।
কামাল কি ভেবে বললো, থাক স্যার। আপনি আপনার মতো যান। আমার মতো আমাকে যেতে দিন।
রহমত একটা দম ছেড়ে বললো, বুঝলে কামাল মিয়া, যদি তুমি না হয়ে বড় ধরনের কোনো কর্মকর্তার আজ অবসর গ্রহণের দিন হতো, তাহলে দেখতে অফিসের চেহারাই আজ বদলে যেতো। কী যেতো না? একেই বলে ভাগ্য।
রহমত একটু থেমে আবার বললো, করিম সাহেব বোধ হয় তোমাকে কিছুই বলেনি। লোকটা আস্ত চামার। আমি তাকে তোমার কথা আজও বললাম, দেখলাম তার মধ্যে কোনো মনুষ্যত্ব নেই। ছোটলোক আর কাকে বলে! থাক সে কথা। তুমি আজ চলে যাচ্ছো, আমার মনটা খুব খারাপ। আমি গরিব মানুষ। তোমাকে তো তেমন কিছু দিতে পারবো না, এই নাও আমার সামান্য উপহার। রহমত একটি ফুলের তোড়া আর একটি প্যাকেট এগিয়ে ধরলো কামালের দিকে।
কামাল রহমতের হাতে ধরা ফুল এবং প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেল। তার দুচোখ ছল ছল করে উঠলো। বললো, এগুলোর কোনো দরকার ছিল না স্যার।
রহমত হাসতে হাসতে বললো, নাও, ধর। এটা খুব সামান্য উপহার। আমার পক্ষ থেকে। আর শোনো, কাল তোমাকে যে খেলার মাঠে আসতে বলেছিলাম, তার আর দরকার নেই। এই বয়সে অতো ঝামেলা তোমার ভালো লাগবে না।
কামালকে আসতে নিষেধ করার ব্যাপারটি বলতে গিয়েও আর খুলে বলতে পারলো না রহমত। বললে কামাল আরও বেশি কষ্ট পাবে। মানুষ সম্পর্কে তাহলে তার ধারণা আরও খারাপ হয়ে যাবে। কী দরকার, এই দুঃসময়ে লোকটির মন ভেঙে দেবার।
কামাল রহমতের হাত থেকে ফুলের তোড়া এবং প্যাকেটটি নিয়ে রাস্তায় নামলো।
কাল থেকে সকাল হলেই আর ঊর্ধ্বশ্বাসে অফিসের জন্য ছুটতে হবে না। বাদুড়ঝোলা হয়ে আর বাসে চড়তে হবে না। কাল থেকে তার ছুটি।
ব্যস্ত রাজপথের ফুটপাথ ধরে হাঁটছে কামাল। হাঁটছে আর ভাবছে সত্যিই কি আমি অবসর নিতে পেরেছি? সত্যিই কি আমি ছুটি পাচ্ছি?
পরক্ষণেই সে আবার মনে মনে বলে, কিসের ছুটি? কাল সকালেই তো আবার আমাকে ছুটতে হবে রুটি-রুজির সন্ধানে। ছেলেমেয়েগুলো ছোট। তাদেরকে মানুষ করতে হলে, তাদের বাঁচিয়ে রাখতে গেলে আমাকে ছুটতে হবে। দৌড়–তে হবে। রহমত তো ঠিকই বলেছে, দৌড় একবার শুরু করলে আর থামা যায় না। এ দৌড় বড় কষ্টের দৌড়। এ দৌড় খুব সাংঘাতিকÑবিপজ্জনক দৌড়।
হাঁটতে হাঁটতে কতোদূর হেঁটেছে কামালের তা খেয়াল নেই। আজ যেন তার বাসায় ফেরারও কোনো তাড়া নেই। কেবলই হাঁটছে।
আকাশটা মেঘে ছেয়ে গেছে।
চারদিকে ঘনঘোর অন্ধকার। হয়তোবা এখুনি ঝড়বৃষ্টি নেমে আসবে। রাস্তার লোকজন আর গাড়িগুলো শাঁ শাঁ গতিতে যার যার গন্তব্যের দিকে চলে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে।
সবাই খুব ব্যস্ত।
সবাই যেন দৌড়ের প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
হঠাৎ প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়ে গেল। মুঠো মুঠো ধুলোবালি উড়ে এসে ভরে গেল কামালের দুচোখ। সে আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। চোখের ধুলোবালি পরিষ্কার করতে গিয়ে তার হাত থেকে অকস্মাৎ ছিটকে পড়ে গেল রহমতের দেয়া ফুল আর প্যাকেটটি।
ও দুটোকে তুলবার আর ইচ্ছা হলো না কামালের। তার রোগাটে দুর্বল শরীরটা টলছে। তবুও প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যে যন্ত্রণাকাতর চোখ দুটো এঁটে ধরে সর্বশক্তি দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে সামনে দৌড় দিল কামাল।
ক্রমাগত সামনে।
বিশাল জগৎ সংসারে কত লোকের বসবাস।
কত বিচিত্র তাদের জীবন-যাপন। কেউ পাঁচ তলায় আবার কেউ বা গাছ তলায়।
ঘটে, জগতে এমটাই ঘটে। ঘটতে থাকে। তার ভেতর থেকেই উঠে আসে একেকটি জীবনচরিত। যাদেরকে ভোলা যায় না কখনো। ভোলা যায় না তাদের জীবন সংগ্রামের কথা। কারণ ঐ সংগ্রামের মধ্যেইতো রয়ে গেছে প্রকৃত শিক্ষা। আজ ও আগামীর জন্য।
শাহীনের আজ কিছুই ভালো লাগছে না। জীবনটা এত জটিল এবং কঠিন কেন। ভাবতে থাকে শাহীন। তার চোখে ঝিলিক দিয়ে ওঠে কামাল চাচার কথা।
কামাল চাচা! সেই এক জীবন বটে!Ñ
তার কথা আজ শাহীনের খুব বেশি করে মনে পড়ছে।
কেন পড়বে না! এমন সংগ্রামী জীবনের কথা কেউ কি ভুলতে পারে।
শাহীনও পারে না। তার মনে পড়ে কামাল চাচার দুমড়ানো-মুচড়ানো সেই ছবিটার কথা। জীবনের কথা।Ñ
কামাল উদ্দীন অফিসে পৌঁছুতেই তার শরীরের ভেতর কেমন যেন শিরশির করে উঠলো।
পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে পিওনের চাকরি নিয়েছিল কামাল জীবনের প্রথম বয়সে। সেই শুরু।
কতটা বছর চলে গেছে এর মধ্যে।
কতটা সময় গড়িয়ে গেছে কামালের জীবনের ওপর দিয়ে। এই অফিসেই। একই পদে। এতো বছরের চাকরি জীবনে সে কতো মানুষকে দেখেছে। কতো বিচিত্র চরিত্রের মানুষের সাথে দেখা হয়েছে। ভালো-মন্দ সব রকমের বসকেই সে দেখেছে। কাউকে দেখেছে নির্মম-নিষ্ঠুর, আবার কাউকে দেখেছে দয়ালু, সৎ ও ভালো মানুষ হিসেবে। আল্লাহর পৃথিবীতে হাজার রকমের মানুষ। হাজার রকমের স্বভাব তাদের।
এসব নিয়ে এখন আর সে ভাবছে না।
অফিসে প্রবেশ করে কামাল আজ দেখছে তার ব্যবহারের কেটলি, কাপ, চামচ এবং ছোট্ট বাক্সটিকে। তার দৃষ্টির সীমায় রয়েছে সেই পুরনো চেয়ার, টেবিল, সেই দেয়াল, বসের আলমিরা এবং দেয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডার।
দেখতে দেখতে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে কামালের। কম দামি মোটা লেন্সের চশমার ভেতর তার ক্রমাগত ঝরে পড়া গরম অশ্র“তে ভিজে ওঠে দুই চোয়াল। ক্যালেন্ডারে হাত রেখে কামাল হু হু করে কেঁদে ওঠে।
কাল নতুন বছরের প্রথম দিন।
আজকের দিনটি ক্যালেন্ডারের শেষ দিন।
আগামীকাল এই দেয়ালে নতুন ক্যালেন্ডার উঠবে। নেমে যাবে পুরনো ক্যালেন্ডার।
ক্যালেন্ডারের মতোই কামালের জীবনটা। শুধু কামাল কেন, সকল মানুষের অবস্থা এমনি। আসা এবং যাওয়া। এটাইতো পৃথিবীর নিয়ম।
নিয়ম হলেও এটা মেনে নেয়া বড়ো কষ্টের। বড়ো যন্ত্রণার। এই অভিজ্ঞতা যার নেই, সে কী করে বুঝবে আত্মযন্ত্রণার বিষের দাহ?
কামাল চোখ মুছে পেছনে ফিরতেই রহমত আলী বললো, কেমন আছো কামাল মিয়া? রহমত আলীর বয়স চল্লিশের ওপর। কামাল তার চেয়েও অন্তত পনের বছরের বড়ো। রহমত আলী পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে কেরানির চাকরি করে। কেরানি হলেও তো কামালের ওপর।
কামালের বয়সের আর কেউ এই সেকশনে নেই। তবু তাকে সবাই তুমি করে কথা বলে। তবু ভালো নামের শেষে একটা মিয়া যোগ করেছে। হাজার হোক পিওন বলে কথা। তাদের আবার সম্মান কী? অফিসের অন্যদের ব্যবহারে কামালের মনে হয়েছে, পিওনরা কোনো মানুষের মধ্যেই পড়ে না। তাদের না আছে সুখ দুঃখ, না আছে অনুভূতি, না আছে বোধশক্তি।
এসবে কামালের এখন আর কষ্ট লাগে না। দুর্ব্যবহার হজম করতে করতে অপমানের অনুভূতিটাও কেমন ভোঁতা হয়ে গেছে। রহমত অন্যদিন যেভাবে হুকুমের সুরে কথা বলে, আজকের স্বরটা অবশ্য তারচেয়ে অনেক কোমল।
রহমতের কথায় কামাল চোখ তুলে তাকালো। কামালের চোখ দুটো তখনো ভেজা ভেজা। রহমত সেটা বুঝতে পারলো। বললো, মনটা আজ খুব খারাপ বুঝি?
না স্যার, খারাপ হবে কেন? আর মনটা খারাপ করেই বা কী লাভ?
হ্যাঁ তাই। একদিন তো আমাকেও এ অফিস থেকে চলে যেতে হবে। কেউ কি আর চিরকাল চাকরি করতে পারে?
কামাল কাঁপাগলায় বললো, ঠিকই তো। আজ অফিস থেকে বিদায় নিতে হবে। তারপর একদিন তো চিরকালের মতো পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো।
চেয়ারে বসতে রহমত বললো, এদিকে এসো কামাল মিয়া, তোমার সাথে একটু গল্প করি। আর সময় হবে কিনা কে জানে?
রহমতের টেবিলের সামনে এসে কামাল দাঁড়ালো। রহমত চেয়ার দেখিয়ে বললো, বসো।
কামাল বললো, না স্যার। এতোকাল যখন বসতে পারিনি, তখন আজ আর নাই বা বসলাম।
বসলে কোনো অসুবিধা নেই। তুমি বসো।
কামাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, বসবো না স্যার। কি বলবেন, বলুন। আপনার জন্য কি চা আনবো?
রহমত যেন একটু ধাক্কা খেল। বললো, না। চায়ের দরকার নেই।
তবে?
রহমতের চোখে মুখেও এক ধরনের বেদনা ও বিষণœতার ছাপ। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রহমতের দিকে।
গতকাল সেকশন ইনচার্জ করিম সাহেবকে রহমত বলেছিল, কামাল মিয়া তো আগামীকাল অবসর নিচ্ছে। আমাদের সেকশনে সে বহুকাল আছে। তার বিদায়ের সময় আমাদের কিছু করা উচিত।
রহমানের কথার প্রতি ভ্রƒক্ষেপও করলো না করিম সাহেব। মানুষের জন্য মানুষের এই সামান্য মানবতাবোধটুকুর আশা করেছিল রহমত। করিম সাহেবের কাছে কথাটি বলে রহমত যে ধাক্কাটি খেল, তা সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না। অপমানটি যেন কামালের জন্য নয়, তার নিজের জন্যই এই অপমানের কাঁটা। বলতে গিয়েও কথাটি আর বললো না রহমত। ভাবলো, কামাল মিয়া তাহলে আরও বেশি কষ্ট পাবে। প্রসঙ্গ পালটিয়ে রহমত বললো, কামাল মিয়া, জানো তো কাল আমাদের বিভাগের বার্ষিক ক্রীড়া উৎসব?
হ্যাঁ জানি।
তুমি আসবে তো?
কামাল মাথা নিচু করে একটা দম ছাড়লো। একটু সময় নিয়ে বললো, আপনাদের খেলার মাঠে আমার যাবার কি কোনো দরকার আছে? তাছাড়া আজই তো আমার শেষ দিন।
শেষ দিন তাতে কী হয়েছে? কাল বছরের প্রথম। আমাদের ক্রীড়া উৎসবও কাল। আমি চাই তুমি আসবে। আমরা সকলে মিলেমিশে দিনটি আনন্দে কাটিয়ে দেব। কি আসবে তো?
রহমত পরিবেশটাকে একটু হালকা করার জন্য বললো, বুঝলে কামাল মিয়া, আমি ঠিক করেছিÑ কাল মাঠে একটি মানুষ একাকী দৌড়াবে এবং তাকে পুরস্কৃত করা হবে। এ ব্যাপারে আমি আজ সবার সাথে আলাপ করবো। আশা করি আমার এ প্রস্তাবটা কেউ ফেলবে না। খেলাটি কেমন হবে বলোতো?
কামাল বললো, আপনার এমন অদ্ভুত বুদ্ধিটা কেমন করে মাথায় এলো স্যার? কে দৌড়াবে মাঠে?
রহমত বললো, দৌড়াবে তুমি।
আমি? এই বৃদ্ধ বয়সে একাকী মাঠে দৌড়াবো এটা কোন ধরনের খেলা স্যার?
রহমত বললো, এটা কোন ঠাট্টা নয় কামাল মিয়া। তুমি মনে কষ্ট নিও না। এই খেলাটি এমন এক খেলা-যা মানুষকে তার নিজের দিকে ফিরিয়ে দেয়। একটা মাঠে মাত্র একটি মানুষ দৌড়াচ্ছে, ভাবোতো ব্যাপারটি কেমন? জানো, আমার আব্বাও ছিল তোমার মতো একজন পিওন। সে যেদিন অবসর নিয়েছিল, সেই দিনটিও ছিল বছরের শেষ দিন। আমার আব্বাকে দেখেছিলাম, একটি মাঠে সে একাকী দৌড়াচ্ছে। দৌড়াতে দৌড়াতে এক সময়…
রহমতের দুুুচোখ ছল ছল করে উঠলো। চোখ মুছে বললো, তারপরও আব্বা বেঁচে ছিল দশ বছর। আব্বার দৌড় কিন্তু থামেনি। তার মৃত্যুর আগ পর্যন্তও আমাদের জন্য তাকে দৌড়াতে দেখেছি। বুঝলে কামাল মিয়া, একবার দৌড় শুরু করলে আর থামা যায় না। তুমিও থামতে পারবে না। না, ইচ্ছে করলেও পারবে না।
রহমতের মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কামাল। ভাবলো, সত্যিইতো তার জীবনে কোনো ছুটি নেই। যে দৌড় সে পনের বছর থেকে শুরু করেছে, সে দৌড় এখনও আছে। আগামীতেও থাকবে। তা না হলে তিনটে ছেলেমেয়েকে নিয়ে সে কিভাবে চলবে?
আজ বছরের শেষ দিন।
আজ কামালের চাকরিজীবনেরও শেষ দিন।
কোনো কাজে আজ তার মন বসছে না। সে কেবলই ভাবছে, এই অফিস, আসবাবপত্র, এই সকল মানুষের মায়াকে ছিন্ন করে তাকে চলে যেতে হচ্ছে। আগামীকাল সে এখানে এলেও আজকের দিনটির মতো অন্তত নিজের মতো করে বসতে পারবে না। এসব ভাবতে ভাবতে কামালের হৃদয়ে একটি বেদনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
ধীরে ধীরে অফিস টাইম শেষ হতে চলেছে। যার যার মতো একে একে সবাই অফিস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। সাহেব কয়েকবার কামালকে ডেকেছে। এটা ওটা চেয়েছে তার কাছে। বেলা দুটোর আগেই সে অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু কামাল যে চলে যাচ্ছে, একথা একবারও তার মনে পড়লো না! কামালের মনমরা দেখেও করিম সাহেব বোধ হয় কিছু বুঝতে পারেননি। তাকে একবার অন্তত একটি সান্ত্বনার কথা বলতে পারতেন। কিন্তু তিনি বললেন না।
ব্যাপারটিতে কামাল খুব কষ্ট পেল। এতকাল যেখানে চাকরি করলো, একটা জীবন যেখানে সে শেষ করে দিল, সেখানে এ ধরনের অমানবিক আচরণের আশা কামাল করেনি।
পীড়িত হলেও কামাল পিওন। তার দুঃখ আর মর্মবেদনা বোঝার জন্য কেবা আর থাকতে পারে?
কামাল ভারাক্রান্ত মনে জীবনের শেষ কাজগুলো করে যাচ্ছে। টেবিলের বিক্ষিপ্ত ফাইলপত্র গুছিয়ে রাখছে। এবার তারও বিদায়ের পালা।
পেছন থেকে আবার রহমতের গলা শোনা গেল, কি কামাল মিয়া, কাজ কি শেষ হলো? কাজতো কখনো শেষ হবে না। খামোখা দেরি করে লাভ কি বলো, চলো বেরিয়ে পড়ি।
কামাল রহমতের দিকে তাকালো। তার মুখে কোনো কথা নেই। সে যেন সকল ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। রহমত আবার জিজ্ঞেস করলো, কি যাবে নাকি? চলো আজ এক সাথে যাই।
কামাল কি ভেবে বললো, থাক স্যার। আপনি আপনার মতো যান। আমার মতো আমাকে যেতে দিন।
রহমত একটা দম ছেড়ে বললো, বুঝলে কামাল মিয়া, যদি তুমি না হয়ে বড় ধরনের কোনো কর্মকর্তার আজ অবসর গ্রহণের দিন হতো, তাহলে দেখতে অফিসের চেহারাই আজ বদলে যেতো। কী যেতো না? একেই বলে ভাগ্য।
রহমত একটু থেমে আবার বললো, করিম সাহেব বোধ হয় তোমাকে কিছুই বলেনি। লোকটা আস্ত চামার। আমি তাকে তোমার কথা আজও বললাম, দেখলাম তার মধ্যে কোনো মনুষ্যত্ব নেই। ছোটলোক আর কাকে বলে! থাক সে কথা। তুমি আজ চলে যাচ্ছো, আমার মনটা খুব খারাপ। আমি গরিব মানুষ। তোমাকে তো তেমন কিছু দিতে পারবো না, এই নাও আমার সামান্য উপহার। রহমত একটি ফুলের তোড়া আর একটি প্যাকেট এগিয়ে ধরলো কামালের দিকে।
কামাল রহমতের হাতে ধরা ফুল এবং প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেল। তার দুচোখ ছল ছল করে উঠলো। বললো, এগুলোর কোনো দরকার ছিল না স্যার।
রহমত হাসতে হাসতে বললো, নাও, ধর। এটা খুব সামান্য উপহার। আমার পক্ষ থেকে। আর শোনো, কাল তোমাকে যে খেলার মাঠে আসতে বলেছিলাম, তার আর দরকার নেই। এই বয়সে অতো ঝামেলা তোমার ভালো লাগবে না।
কামালকে আসতে নিষেধ করার ব্যাপারটি বলতে গিয়েও আর খুলে বলতে পারলো না রহমত। বললে কামাল আরও বেশি কষ্ট পাবে। মানুষ সম্পর্কে তাহলে তার ধারণা আরও খারাপ হয়ে যাবে। কী দরকার, এই দুঃসময়ে লোকটির মন ভেঙে দেবার।
কামাল রহমতের হাত থেকে ফুলের তোড়া এবং প্যাকেটটি নিয়ে রাস্তায় নামলো।
কাল থেকে সকাল হলেই আর ঊর্ধ্বশ্বাসে অফিসের জন্য ছুটতে হবে না। বাদুড়ঝোলা হয়ে আর বাসে চড়তে হবে না। কাল থেকে তার ছুটি।
ব্যস্ত রাজপথের ফুটপাথ ধরে হাঁটছে কামাল। হাঁটছে আর ভাবছে সত্যিই কি আমি অবসর নিতে পেরেছি? সত্যিই কি আমি ছুটি পাচ্ছি?
পরক্ষণেই সে আবার মনে মনে বলে, কিসের ছুটি? কাল সকালেই তো আবার আমাকে ছুটতে হবে রুটি-রুজির সন্ধানে। ছেলেমেয়েগুলো ছোট। তাদেরকে মানুষ করতে হলে, তাদের বাঁচিয়ে রাখতে গেলে আমাকে ছুটতে হবে। দৌড়–তে হবে। রহমত তো ঠিকই বলেছে, দৌড় একবার শুরু করলে আর থামা যায় না। এ দৌড় বড় কষ্টের দৌড়। এ দৌড় খুব সাংঘাতিকÑবিপজ্জনক দৌড়।
হাঁটতে হাঁটতে কতোদূর হেঁটেছে কামালের তা খেয়াল নেই। আজ যেন তার বাসায় ফেরারও কোনো তাড়া নেই। কেবলই হাঁটছে।
আকাশটা মেঘে ছেয়ে গেছে।
চারদিকে ঘনঘোর অন্ধকার। হয়তোবা এখুনি ঝড়বৃষ্টি নেমে আসবে। রাস্তার লোকজন আর গাড়িগুলো শাঁ শাঁ গতিতে যার যার গন্তব্যের দিকে চলে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে।
সবাই খুব ব্যস্ত।
সবাই যেন দৌড়ের প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
হঠাৎ প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়ে গেল। মুঠো মুঠো ধুলোবালি উড়ে এসে ভরে গেল কামালের দুচোখ। সে আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। চোখের ধুলোবালি পরিষ্কার করতে গিয়ে তার হাত থেকে অকস্মাৎ ছিটকে পড়ে গেল রহমতের দেয়া ফুল আর প্যাকেটটি।
ও দুটোকে তুলবার আর ইচ্ছা হলো না কামালের। তার রোগাটে দুর্বল শরীরটা টলছে। তবুও প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যে যন্ত্রণাকাতর চোখ দুটো এঁটে ধরে সর্বশক্তি দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে সামনে দৌড় দিল কামাল।
ক্রমাগত সামনে।
চার.
সত্যিইতো দৌড় একবার শুরু করলে আর সেই দৌড় আমৃত্যু থামে না।
থামানো যায় না।
জীবনের বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে থাকে অন্তহীন সমস্যার সিঁড়ি। যে সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে দৌড়াতেই হয়।
এটাই জীবনের নিয়ম। দৌড়াতে দৌড়াতে একদিন ফুরিয়ে আসে জীবনের পথ। তখন কেবল ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকার পালা। হিসাব মিলানোর পালা।
না, মেলে না হিসাব।
রাত বাড়তে থাকে।
জোছনার আলোতে চারদিক আলোকিত। মোড়ল বাড়ির পশ্চিম পাশে পুকুরঘাট। ঘাটের পাড়ে আম আর নারকেল গাছ। গভীর রাতে মাঝে মাঝে পুকুরে একরকম ভৌতিক শব্দ হয়। মনে হয় কেউ যেন গোছল করছে। গা ছম ছম করা এক ধরনের ভয় করিম সাহেবের শরীরের ওপর দিয়ে হেঁটে যায়।
বাড়ির পেছন বারান্দায় করিম সাহেব শুয়ে আছেন। বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট ছাড়াও নানাবিধ রোগে তিনি ভুগছেন। বয়স বেশি হলে অবশ্য সবাই কোনো না কোনো ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। কিন্তু করিম সাহেবের অসুস্থতার মাত্রাটা একটু বেশি। সারা বছরই এটা ওটা লেগেই থাকে।
রাতে তার প্রায়ই ঘুম আসে না। নিদ্রাহীন চোখে তিনি হাজারো স্মৃতির ভিড়ে তলিয়ে যেতে থাকেন।
বাড়ির পুব পাশে বিরাট খোলা মাঠ। মাঠের বাম পাশে একটি ছোট বিল। বিলে প্রচুর পরিমাণে আমন ধান হয়। বর্ষাকালে মাছও পাওয়া যায়।
করিম সাহেব পেছনের বারান্দায় শুয়ে শুয়ে জোছনা রাতে পুকুর, মাঠ এবং বিলের সবটাই পরিষ্কার দেখতে পান। এই ভরা পূর্ণিমায় মাঠের আল পর্যন্ত দেখা যায়। দেখা যায় শিয়াল কিংবা খরগোশ হেঁটে গেলেও। তিনি নিদ্রাহীন চোখে তাকিয়ে থাকেন মাঠের দিকে।
পুকুরে কেউ যেন গোছল শেষে কাপড় থাবা দিচ্ছে। এত রাতে কারোর গোছল করার কথা নয়!
করিম সাহেব বালিশের ওপর নিজের মাথাটা জোরে চেপে ধরলেন। ওপরের কানের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে তিনি গোছলের শব্দ শোনা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চেষ্টা করলেন। তবুও শব্দটি ঢিমেতালে এসে তার কানে প্রবেশ করছে। তিনি এবার তার দৃষ্টি এবং মনোযোগ মাঠের দিকে স্থির করে রাখলেন। বারান্দা থেকে পুবের মাঠ পেরিয়ে বড় রাস্তা পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। জোছনা রাতে সবই কেমন রূপোর টাকার মতো চকচক করছে।
বড় রাস্তাটি তৈরি হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। এই রাস্তা দিয়ে ঘোড়া দাবড়িয়ে এক সময় ছুটে আসতো অত্যাচারী নীলকর। আসতো খাজনা আদায়ের জন্য বেপরোয়া জমিদার। তাদের হাতে চাবুক থাকতো। সঙ্গী সাথীদের হাতে থাকতো শেকল এবং মোটা রশি। তাদের ঘোড়ার খুরের শব্দে গ্রামবাসীরা ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠতো। সেসব অত্যাচারের দৃশ্য করিম সাহেব নিজের চোখে কিছু দেখেছেন। যা দেখেছেন-তার চেয়েও বেশি শুনেছেন পিতার কাছে। এখনও মাঝে মাঝে সেসব বীভৎস দৃশ্য তার চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে।
রাতে করিম সাহেব একাকী জেগে থাকেন। শুয়ে শুয়ে ভাবেন। পেছনের হারানো স্মৃতি রোমন্থন করেন। সেসব স্মৃতির কোনোটা আনন্দের। আবার কোনোটা এতই বেদনার যে তিনি এখনও মনে করে শিউরে ওঠেন।
করিম সাহেব পাঁচদিন হলো-রক্ত আমাশয়ে ভুগছেন। ওষুধে কোনো কাজ হচ্ছে না। শরীরটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। সেই সাথে মনের জোর এবং সাহসও কমে গেছে। শরীরের সাথে মনের সম্পর্ক নিবিড়। একটার অভাবে আর একটা চলতে পারে না।
তার মনে পড়লো-পিতা রহিম বক্সও ঠিক এই রক্ত আমাশয়ে ভুগে মারা গিয়েছিলেন। মরবার সময় তার গায়ে মাংস পর্যন্ত ছিল না। কঙ্কালসার লোকটি এমনি জোছনাপ্লাবিত রাতে অসম্ভব কষ্ট পেয়ে বিদায় নিয়েছিলেন।
করিম সাহেব তার পিতার মৃত্যুর করুণ দৃশ্য চোখের সামনে ভাসতে দেখেন। তিনি নিজের শরীরের চামড়া টেনে টেনে পরীক্ষা করেন। দেহটি কেমন যেন ঢিলেঢালা হয়ে গেছে। তিনি মনে করবার চেষ্টা করেন-আব্বা যেন কত বছরে মারা গিয়েছিলেন! সম্ভবত ষাট। আমার তো আটান্ন চলছে!
তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে শুলেন। কিন্তু মৃত্যুভয় থেকে মুক্তি পেলেন না। আসলে মৃত্যু ভয়-এমন একটা ভয়-যা সমস্ত আনন্দ স্বপ্ন এবং বেদনা-বিষাদকেও অতিক্রম করে যায়।
করিম সাহেব ভয় পান।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাঠের দিকে তাকান। দেখেন-পুব মাঠের খেজুরবাগান থেকে একটি আলো বার হয়ে তাদের বাড়ির দিকে আসছে। ধীরে ধীরে। শ্লথ গতিতে। তিনি রাতে এ ধরনের আলোকে মাঠে চলাফেরা করতে দেখেন। দেখেন-আলোগুলো বিলের দিকে যায়। তারপর তারা সারা বিল জুড়ে দীর্ঘক্ষণ ছুটোছুটি করে।
কিন্তু আজকের আলোটি তাদের বাড়ির দিকে আসছে কেন?
করিম সাহেব ঘাবড়ে গিয়ে চোখ বন্ধ করেন।
চোখ বন্ধ অবস্থায় তিনি শুনতে পান-উঠোন দিয়ে কেউ যেন হেঁটে যাচ্ছে। থপ থপ পায়ের শব্দ। বেশ ভারী। তিনি চোখ না মেলেই অভ্যাসবশত জিজ্ঞেস করলেন, কে, কে যায়?
কেউ জবাব দিল না।
কারোর কোনো গলার আওয়াজ না পেয়ে তিনি চিন্তিত হলেন। ভাবলেন, দিনকাল যা পড়েছে! চোর-ডাকাত কেউ নয়তো? তিনি সাহস করে চোখ খুললেন।
না। কেউ নেই।
তবে যেন কেমন একটা থমথমে আওয়াজ সারা উঠোনে পায়চারি করছে। করিম সাহেব কী করবেনÑ ভাবতে পারছেন না। তিনি রীতিমত ঘেমে উঠেছেন। কোনো রকম আড়ষ্টস্বরে ডাকলেন-খোকনের মা….
কুলসুম বেগমের বয়সও পঞ্চাশের কাছাকাছি। করিম সাহেবের মাথার কাছে তিনি আড়াআড়িভাবে বিছানা পেড়ে শুয়ে থাকেন। তার ঘুম খুবই ঘন-গভীর। রাতে জেগে থাকার অভ্যাস নেই। তবে ইদানীং স্বামীর প্রয়োজনেই তাকে রাতে একাধিকবার ঘুম থেকে জাগতে হয়। ওষুধ-পথ্য কিংবা পানি-পান এগিয়ে দিতে হয়। এ জন্য রাতে সতর্ক থাকারও চেষ্টা করেন।
করিম সাহেবের ডাকে কুলসুম বেগম জেগে উঠলেন। বললেন, কী হয়েছে? ঘুমাননি? কোনো কিছু লাগবে?
এইমাত্র ঘটে যাওয়া বিষয়টির কথা বলতে গিয়েও আর বলেননি। বললে কুলসুম বেগমও আর ঘুমাতে পারবেন না। তিনি কিছুক্ষণ-চুপ থেকে বললেন, একটু পানি খাবো।
কুলসুম বেগম উঠে বসলেন। হারিকেনের ফিতা তুলে আলোটা বাড়িয়ে দিলেন। তারপর শিয়রে রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ভরে তাকে দিয়ে বললেন, পানিটুকু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়–ন। রাত তো শেষ হয়ে গেল।
কী আর করবো বলো! পোড়া চোখে যে ঘুম আসে না। তুমি বরং আমাকে একটা পান বানিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।
এই শেষ রাতে আর পান খেতে হবে না। আপনি শুয়ে পড়–ন। আমি আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। দেখবেন ঘুম এসে যাবে। এভাবে রাত জাগলে তো শরীর আরও খারাপ হয়ে পড়বে। বলে কুলসুম বেগম স্বামীর মাথায় হাত বুলোতে লাগলেন। চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললেন, চোখ বন্ধ করুন তো!
কুলসুম বেগমের সেবা এবং আন্তরিকতায় করিম সাহেব এক ধরনের নির্ভরতা খুঁজে পান। স্ত্রীর ডান হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন, খোকনের মা!
জি।
তোমার কি মনে পড়ে?
কী! কিসের কথা বলছেন?
সেই যে আব্বার মৃত্যুর দৃশ্য!
কুলসুম বেগম কিছুটা অবাক হলেন। মাঝে মাঝে রাতে করিম সাহেব কিসব দুঃস্বপ্ন দেখেন। ভয়ও পান। তারপর তাকে ডাকেন। আজ আবার ভয় পাননি তো? তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ আব্বার মৃত্যুর কথা বলছেন কেন? কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছেন নাকি?
করিম সাহেব কেমন ধরা গলায় বললেন, না। মানে এমনিই। হঠাৎ করে মনে হলো কি না! তা, বলো না-তোমার কি মনে পড়ে?
কুলসুম বেগম অপ্রস্তুত হলেন। তবুও বললেন, তখন আপনার বয়স ছিল পনের বছর।
হ্যাঁ, তাইতো! দেখ আজকাল কেমন সব গোলমাল হয়ে যায়।
তা এ বয়সে এমন এক আধটু হয়েই থাকে। ওসব কিছু না। এখন ঘুমিয়ে পড়–ন তো!
করিম সাহেব ঘুমুতে চেষ্টা করেন। কিন্তু ঘুম আসে না। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে কান্নারত এন্তাজের চেহারা। তার ছেলে তাকে আজ মেরেছে। ছেলের বউ যা তা বলে গাল দিচ্ছে। এন্তাজের চোখের পানি এখনো যেন টুপটাপ ঝরে পড়ছে। একটা অজানা আতঙ্কে করিম সাহেব শিউরে ওঠেন। তিনি বলেন, খোকনের মা!
কুমসুম বেগম ঘুম কাতুরে মানুষ। স্বামীর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছেন।
করিম সাহেব আবার ডাকলেন, খোকনের মা!
জি। বলে কুলসুম বেগম পুনরায় স্বামীর কথার প্রতি মনোযোগী হলেন। বললেন, ঘুম আসছে না?
না।
কিছু ভাবছেন বুঝি?
ঠিক ভাবনা নয়, দুশ্চিন্তা।
কিসের দুশ্চিন্তা?
তিনি এন্তাজের কথা বললেন। দুপুরে ঘটে যাওয়া এ ঘটনাটি পাড়ার সবাই জানে। এন্তাজের ছেলেকে এবং ছেলের বউকে সবাই গাল মন্দ করেছে। সামান্য-তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে কেউ কি আব্বাকে মারতে পারে? সবাই ছি-ছি করেছে।
কুলসুম বেগম বললেন, ওসব নিয়ে ভাববেন না তো। এন্তাজের ছেলেটাতো মানুষ না। বউটাও তেমন। আমাদের সময়ে দেখেছি বউ-ঝিরা শ্বশুর শাশুড়িকে কত শ্রদ্ধ এবং সমীহ করে চলতো। আদরের সাথে তাদের সেবা যতœ করতো। যুগ পাল্টে গেছে। এখনকার বউরা-তাদের শ্বশুর-শাশুড়িকে দেখতেই পারে না। সমাজ-সংসারে যেন মুরুব্বিদের কোনো কদর নেই। সম্মানও নেই। একটু একটু পোলাপানরাও কেমন যেন হয়ে গেছে। তারা বেশি দূরে দূরে থাকতে চায়। দাদা-দাদীদেরকে এড়িয়ে চলতে চায়। তবু কি আর করা যাবে, বলুন! ইচ্ছে করলেই তো আর এসব থেকে আমরা মুক্তি পাবো না। সুতরাং হায়াত আছে যতদিন-ততদিন তো সয়েই যেতে হবে।
করিম সাহেব স্ত্রীর কথা শুনতে শুনতে আরও বিষণœ হয়ে গেলেন। কুলসুম বেগমের হাত দুটো নিজের বুকে চেপে ধরে বললেন, আমারও আশঙ্কা হয় যদি আমাদের ভাগ্যেও তেমন দুর্দিন আসে! যা দিনকাল পড়েছে! মান-সম্মান নিয়ে মরাও ভাগ্যের ব্যাপার। তুমি-আমিতো এখনো অনেক সচল। নিজের হাতে আমার এবং সংসারের যাবতীয় কাজ করে যাচ্ছো। তবু দেখেছো-বউমা আগে যেমন খোঁজ খবর নিত, এখন আর তেমন নেয় না। শাহাদাতের ছেলে মেয়েগুলোও আর কাছে ঘেঁষতে চায় না। এসব দেখে সত্যি বলতে আমিও অবাক হচ্ছি। এন্তাজের মতো যদি আমরাও কোনোদিন অপমানিত হই?
কী যে বলেন না! যতসব আজে বাজে চিন্তা। শাহাদাত তো আমাদের সবসময় দেখাশুনা করছে। এত অভাবের মধ্যেও সে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে-যাতে আমাদের কোনো অসুবিধা না হয়। শাহাদাতের মতো এমন সোনার টুকরো ছেলে ক’জনের ভাগ্যে জোটে, বলুন! আর ছেলের বউ এবং বাচ্চাদের কথা বাদ দিন। আজ কালকার ছেলে-মেয়েরা একটু আলাদা। কুলসুম বেগম বললেন।
ওটাইতো চিন্তার বিষয়। আমরা কী যুগে জন্মেছিলাম। আর এখন-এ কোন অন্ধকার যুগে এসে ঠেকেছি। জানি না-আরও কতকিছু দেখে যেতে হবে। সয়ে যেতে হবে। এক সময় কত সালিস, কত বিচার-আচার করেছি। মানুষ শ্রদ্ধার সাথে কথা শুনতো এবং মানতো। আর এখন-এখন আমাদের কথা মূল্যহীন। এমনকি আমাদের উপস্থিতিটাও যেন এদের কাছে অসহ্যের। Ñবলে করিম সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
আমাদের যুগ-আর বর্তমান যুগের মধ্যে অনেক পার্থক্য। Ñবলে কুলসুম বেগম উঠে বসলেন। বললেন, রাত শেষ হতে গেল। এবার চোখ বন্ধ করুন তো। আমারও খুব ঘুম পাচ্ছে। আমি শুতে যাচ্ছি। বলে কুলসুম বেগম নিজের বিছানায় চলে গেলেন।
কী সেই পার্থক্য?
করিম সাহেব নিজের কাছেই প্রশ্ন করেন। জবাব পান না। কেবল বুঝতে পারন-একটা ক্ষয়িষ্ণু পর্বতের চূড়ায় বর্তমান প্রজন্ম কানামাছি খেলছে। তারা ভুলে গেছে, বয়স এবং অর্থ চিরদিনই পরিবর্তনশীল। তারা জানে না, এখন যে বয়সে তারা বয়স্কদেরকে অপমান করছে, অবমূল্যায়ন এবং অশ্রদ্ধা করছে সেই বয়সটি আমরা পেরিয়ে এসেছি-কিন্তু অপমানে, ভয়ে আমাদের পিতা-মাতারা কোনোদিন কুঁকড়ে যাননি। দুশ্চিন্তায় রাতের ঘুম তাদের হারাম হয়নি। আমরা-তেমন প্রাচুর্যের মধ্যে না থাকলেও সুখে ছিলাম। আর এরা প্রাচুর্যের মধ্যে থাকলেও সুখে নেই। এটাই কি কালের বিচার?
করিম সাহেবের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ভাবেন- কী এক যন্ত্রণাকাতর দুঃসময়ের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছি। কী রকম ভয়ঙ্করভাবে আমরা বেঁচে আছি। কিন্তু এভাবে আর কতদিন?
রাত বাড়তে থাকে।
বাড়তে বাড়তে এক সময় শেষের দিকে যায়। হঠাৎ একটা দমকা বাতাসে সজনে গাছের পুরনো পাতাগুলি ঝুরঝুর করে ঝরে পড়লো। বারান্দায় শুয়ে ঝরা পাতার মর্মান্তিক দৃশ্যের দিকে করিম সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। পাতাগুলি ঝরে গেছে। আবার আজ যা পুরনো হবে কাল তা ঝরে যাবে।
করিম সাহেবের কানে ঝরা পাতার মর্মরধ্বনি বারবার আছাড় খেয়ে পড়ছে। তিনি দেখেন-পুব মাঠ থেকে সেই আলোটি হাঁটতে হাঁটতে আবার তাদের বাড়ির দিকে আসছে। করিম সাহেব আর বাইরে তাকাতে পারছেন না। চোখ বন্ধ করে, বালিশের ওপর মাথা চেপে রেখে দু’হাতে কান এঁটে ধরলেন। তবুও মর্মান্তিক শব্দ এবং দৃশ্যগুলি নিষ্ঠুরভাবে তার কানে প্রবেশ করে তীরের ফলার মতো বিঁধে যাচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণায় তিনি ছটফট করছেন। উঠোন দিয়ে কেউ যেন হেঁটে যাচ্ছে।
থপ থপ পায়ের শব্দ ভেসে আসছে। করিম সাহেব অবচেতন মনে একটা নির্ভরতা খুঁজে পান। চোখ বন্ধ করেই জিজ্ঞেস করেন-
কে? কে যায়?
করিম সাহেবের প্রশ্নের জবাবে একটি খনখনে আওয়াজ খুব মৃদু অথচ ভয়ঙ্করভাবে ভেসে এলোÑ আমি, আমি মৃত্যু।
সত্যিইতো দৌড় একবার শুরু করলে আর সেই দৌড় আমৃত্যু থামে না।
থামানো যায় না।
জীবনের বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে থাকে অন্তহীন সমস্যার সিঁড়ি। যে সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে দৌড়াতেই হয়।
এটাই জীবনের নিয়ম। দৌড়াতে দৌড়াতে একদিন ফুরিয়ে আসে জীবনের পথ। তখন কেবল ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকার পালা। হিসাব মিলানোর পালা।
না, মেলে না হিসাব।
রাত বাড়তে থাকে।
জোছনার আলোতে চারদিক আলোকিত। মোড়ল বাড়ির পশ্চিম পাশে পুকুরঘাট। ঘাটের পাড়ে আম আর নারকেল গাছ। গভীর রাতে মাঝে মাঝে পুকুরে একরকম ভৌতিক শব্দ হয়। মনে হয় কেউ যেন গোছল করছে। গা ছম ছম করা এক ধরনের ভয় করিম সাহেবের শরীরের ওপর দিয়ে হেঁটে যায়।
বাড়ির পেছন বারান্দায় করিম সাহেব শুয়ে আছেন। বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট ছাড়াও নানাবিধ রোগে তিনি ভুগছেন। বয়স বেশি হলে অবশ্য সবাই কোনো না কোনো ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। কিন্তু করিম সাহেবের অসুস্থতার মাত্রাটা একটু বেশি। সারা বছরই এটা ওটা লেগেই থাকে।
রাতে তার প্রায়ই ঘুম আসে না। নিদ্রাহীন চোখে তিনি হাজারো স্মৃতির ভিড়ে তলিয়ে যেতে থাকেন।
বাড়ির পুব পাশে বিরাট খোলা মাঠ। মাঠের বাম পাশে একটি ছোট বিল। বিলে প্রচুর পরিমাণে আমন ধান হয়। বর্ষাকালে মাছও পাওয়া যায়।
করিম সাহেব পেছনের বারান্দায় শুয়ে শুয়ে জোছনা রাতে পুকুর, মাঠ এবং বিলের সবটাই পরিষ্কার দেখতে পান। এই ভরা পূর্ণিমায় মাঠের আল পর্যন্ত দেখা যায়। দেখা যায় শিয়াল কিংবা খরগোশ হেঁটে গেলেও। তিনি নিদ্রাহীন চোখে তাকিয়ে থাকেন মাঠের দিকে।
পুকুরে কেউ যেন গোছল শেষে কাপড় থাবা দিচ্ছে। এত রাতে কারোর গোছল করার কথা নয়!
করিম সাহেব বালিশের ওপর নিজের মাথাটা জোরে চেপে ধরলেন। ওপরের কানের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে তিনি গোছলের শব্দ শোনা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চেষ্টা করলেন। তবুও শব্দটি ঢিমেতালে এসে তার কানে প্রবেশ করছে। তিনি এবার তার দৃষ্টি এবং মনোযোগ মাঠের দিকে স্থির করে রাখলেন। বারান্দা থেকে পুবের মাঠ পেরিয়ে বড় রাস্তা পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। জোছনা রাতে সবই কেমন রূপোর টাকার মতো চকচক করছে।
বড় রাস্তাটি তৈরি হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। এই রাস্তা দিয়ে ঘোড়া দাবড়িয়ে এক সময় ছুটে আসতো অত্যাচারী নীলকর। আসতো খাজনা আদায়ের জন্য বেপরোয়া জমিদার। তাদের হাতে চাবুক থাকতো। সঙ্গী সাথীদের হাতে থাকতো শেকল এবং মোটা রশি। তাদের ঘোড়ার খুরের শব্দে গ্রামবাসীরা ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠতো। সেসব অত্যাচারের দৃশ্য করিম সাহেব নিজের চোখে কিছু দেখেছেন। যা দেখেছেন-তার চেয়েও বেশি শুনেছেন পিতার কাছে। এখনও মাঝে মাঝে সেসব বীভৎস দৃশ্য তার চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে।
রাতে করিম সাহেব একাকী জেগে থাকেন। শুয়ে শুয়ে ভাবেন। পেছনের হারানো স্মৃতি রোমন্থন করেন। সেসব স্মৃতির কোনোটা আনন্দের। আবার কোনোটা এতই বেদনার যে তিনি এখনও মনে করে শিউরে ওঠেন।
করিম সাহেব পাঁচদিন হলো-রক্ত আমাশয়ে ভুগছেন। ওষুধে কোনো কাজ হচ্ছে না। শরীরটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। সেই সাথে মনের জোর এবং সাহসও কমে গেছে। শরীরের সাথে মনের সম্পর্ক নিবিড়। একটার অভাবে আর একটা চলতে পারে না।
তার মনে পড়লো-পিতা রহিম বক্সও ঠিক এই রক্ত আমাশয়ে ভুগে মারা গিয়েছিলেন। মরবার সময় তার গায়ে মাংস পর্যন্ত ছিল না। কঙ্কালসার লোকটি এমনি জোছনাপ্লাবিত রাতে অসম্ভব কষ্ট পেয়ে বিদায় নিয়েছিলেন।
করিম সাহেব তার পিতার মৃত্যুর করুণ দৃশ্য চোখের সামনে ভাসতে দেখেন। তিনি নিজের শরীরের চামড়া টেনে টেনে পরীক্ষা করেন। দেহটি কেমন যেন ঢিলেঢালা হয়ে গেছে। তিনি মনে করবার চেষ্টা করেন-আব্বা যেন কত বছরে মারা গিয়েছিলেন! সম্ভবত ষাট। আমার তো আটান্ন চলছে!
তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে শুলেন। কিন্তু মৃত্যুভয় থেকে মুক্তি পেলেন না। আসলে মৃত্যু ভয়-এমন একটা ভয়-যা সমস্ত আনন্দ স্বপ্ন এবং বেদনা-বিষাদকেও অতিক্রম করে যায়।
করিম সাহেব ভয় পান।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাঠের দিকে তাকান। দেখেন-পুব মাঠের খেজুরবাগান থেকে একটি আলো বার হয়ে তাদের বাড়ির দিকে আসছে। ধীরে ধীরে। শ্লথ গতিতে। তিনি রাতে এ ধরনের আলোকে মাঠে চলাফেরা করতে দেখেন। দেখেন-আলোগুলো বিলের দিকে যায়। তারপর তারা সারা বিল জুড়ে দীর্ঘক্ষণ ছুটোছুটি করে।
কিন্তু আজকের আলোটি তাদের বাড়ির দিকে আসছে কেন?
করিম সাহেব ঘাবড়ে গিয়ে চোখ বন্ধ করেন।
চোখ বন্ধ অবস্থায় তিনি শুনতে পান-উঠোন দিয়ে কেউ যেন হেঁটে যাচ্ছে। থপ থপ পায়ের শব্দ। বেশ ভারী। তিনি চোখ না মেলেই অভ্যাসবশত জিজ্ঞেস করলেন, কে, কে যায়?
কেউ জবাব দিল না।
কারোর কোনো গলার আওয়াজ না পেয়ে তিনি চিন্তিত হলেন। ভাবলেন, দিনকাল যা পড়েছে! চোর-ডাকাত কেউ নয়তো? তিনি সাহস করে চোখ খুললেন।
না। কেউ নেই।
তবে যেন কেমন একটা থমথমে আওয়াজ সারা উঠোনে পায়চারি করছে। করিম সাহেব কী করবেনÑ ভাবতে পারছেন না। তিনি রীতিমত ঘেমে উঠেছেন। কোনো রকম আড়ষ্টস্বরে ডাকলেন-খোকনের মা….
কুলসুম বেগমের বয়সও পঞ্চাশের কাছাকাছি। করিম সাহেবের মাথার কাছে তিনি আড়াআড়িভাবে বিছানা পেড়ে শুয়ে থাকেন। তার ঘুম খুবই ঘন-গভীর। রাতে জেগে থাকার অভ্যাস নেই। তবে ইদানীং স্বামীর প্রয়োজনেই তাকে রাতে একাধিকবার ঘুম থেকে জাগতে হয়। ওষুধ-পথ্য কিংবা পানি-পান এগিয়ে দিতে হয়। এ জন্য রাতে সতর্ক থাকারও চেষ্টা করেন।
করিম সাহেবের ডাকে কুলসুম বেগম জেগে উঠলেন। বললেন, কী হয়েছে? ঘুমাননি? কোনো কিছু লাগবে?
এইমাত্র ঘটে যাওয়া বিষয়টির কথা বলতে গিয়েও আর বলেননি। বললে কুলসুম বেগমও আর ঘুমাতে পারবেন না। তিনি কিছুক্ষণ-চুপ থেকে বললেন, একটু পানি খাবো।
কুলসুম বেগম উঠে বসলেন। হারিকেনের ফিতা তুলে আলোটা বাড়িয়ে দিলেন। তারপর শিয়রে রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ভরে তাকে দিয়ে বললেন, পানিটুকু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়–ন। রাত তো শেষ হয়ে গেল।
কী আর করবো বলো! পোড়া চোখে যে ঘুম আসে না। তুমি বরং আমাকে একটা পান বানিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।
এই শেষ রাতে আর পান খেতে হবে না। আপনি শুয়ে পড়–ন। আমি আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। দেখবেন ঘুম এসে যাবে। এভাবে রাত জাগলে তো শরীর আরও খারাপ হয়ে পড়বে। বলে কুলসুম বেগম স্বামীর মাথায় হাত বুলোতে লাগলেন। চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললেন, চোখ বন্ধ করুন তো!
কুলসুম বেগমের সেবা এবং আন্তরিকতায় করিম সাহেব এক ধরনের নির্ভরতা খুঁজে পান। স্ত্রীর ডান হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন, খোকনের মা!
জি।
তোমার কি মনে পড়ে?
কী! কিসের কথা বলছেন?
সেই যে আব্বার মৃত্যুর দৃশ্য!
কুলসুম বেগম কিছুটা অবাক হলেন। মাঝে মাঝে রাতে করিম সাহেব কিসব দুঃস্বপ্ন দেখেন। ভয়ও পান। তারপর তাকে ডাকেন। আজ আবার ভয় পাননি তো? তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ আব্বার মৃত্যুর কথা বলছেন কেন? কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছেন নাকি?
করিম সাহেব কেমন ধরা গলায় বললেন, না। মানে এমনিই। হঠাৎ করে মনে হলো কি না! তা, বলো না-তোমার কি মনে পড়ে?
কুলসুম বেগম অপ্রস্তুত হলেন। তবুও বললেন, তখন আপনার বয়স ছিল পনের বছর।
হ্যাঁ, তাইতো! দেখ আজকাল কেমন সব গোলমাল হয়ে যায়।
তা এ বয়সে এমন এক আধটু হয়েই থাকে। ওসব কিছু না। এখন ঘুমিয়ে পড়–ন তো!
করিম সাহেব ঘুমুতে চেষ্টা করেন। কিন্তু ঘুম আসে না। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে কান্নারত এন্তাজের চেহারা। তার ছেলে তাকে আজ মেরেছে। ছেলের বউ যা তা বলে গাল দিচ্ছে। এন্তাজের চোখের পানি এখনো যেন টুপটাপ ঝরে পড়ছে। একটা অজানা আতঙ্কে করিম সাহেব শিউরে ওঠেন। তিনি বলেন, খোকনের মা!
কুমসুম বেগম ঘুম কাতুরে মানুষ। স্বামীর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছেন।
করিম সাহেব আবার ডাকলেন, খোকনের মা!
জি। বলে কুলসুম বেগম পুনরায় স্বামীর কথার প্রতি মনোযোগী হলেন। বললেন, ঘুম আসছে না?
না।
কিছু ভাবছেন বুঝি?
ঠিক ভাবনা নয়, দুশ্চিন্তা।
কিসের দুশ্চিন্তা?
তিনি এন্তাজের কথা বললেন। দুপুরে ঘটে যাওয়া এ ঘটনাটি পাড়ার সবাই জানে। এন্তাজের ছেলেকে এবং ছেলের বউকে সবাই গাল মন্দ করেছে। সামান্য-তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে কেউ কি আব্বাকে মারতে পারে? সবাই ছি-ছি করেছে।
কুলসুম বেগম বললেন, ওসব নিয়ে ভাববেন না তো। এন্তাজের ছেলেটাতো মানুষ না। বউটাও তেমন। আমাদের সময়ে দেখেছি বউ-ঝিরা শ্বশুর শাশুড়িকে কত শ্রদ্ধ এবং সমীহ করে চলতো। আদরের সাথে তাদের সেবা যতœ করতো। যুগ পাল্টে গেছে। এখনকার বউরা-তাদের শ্বশুর-শাশুড়িকে দেখতেই পারে না। সমাজ-সংসারে যেন মুরুব্বিদের কোনো কদর নেই। সম্মানও নেই। একটু একটু পোলাপানরাও কেমন যেন হয়ে গেছে। তারা বেশি দূরে দূরে থাকতে চায়। দাদা-দাদীদেরকে এড়িয়ে চলতে চায়। তবু কি আর করা যাবে, বলুন! ইচ্ছে করলেই তো আর এসব থেকে আমরা মুক্তি পাবো না। সুতরাং হায়াত আছে যতদিন-ততদিন তো সয়েই যেতে হবে।
করিম সাহেব স্ত্রীর কথা শুনতে শুনতে আরও বিষণœ হয়ে গেলেন। কুলসুম বেগমের হাত দুটো নিজের বুকে চেপে ধরে বললেন, আমারও আশঙ্কা হয় যদি আমাদের ভাগ্যেও তেমন দুর্দিন আসে! যা দিনকাল পড়েছে! মান-সম্মান নিয়ে মরাও ভাগ্যের ব্যাপার। তুমি-আমিতো এখনো অনেক সচল। নিজের হাতে আমার এবং সংসারের যাবতীয় কাজ করে যাচ্ছো। তবু দেখেছো-বউমা আগে যেমন খোঁজ খবর নিত, এখন আর তেমন নেয় না। শাহাদাতের ছেলে মেয়েগুলোও আর কাছে ঘেঁষতে চায় না। এসব দেখে সত্যি বলতে আমিও অবাক হচ্ছি। এন্তাজের মতো যদি আমরাও কোনোদিন অপমানিত হই?
কী যে বলেন না! যতসব আজে বাজে চিন্তা। শাহাদাত তো আমাদের সবসময় দেখাশুনা করছে। এত অভাবের মধ্যেও সে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে-যাতে আমাদের কোনো অসুবিধা না হয়। শাহাদাতের মতো এমন সোনার টুকরো ছেলে ক’জনের ভাগ্যে জোটে, বলুন! আর ছেলের বউ এবং বাচ্চাদের কথা বাদ দিন। আজ কালকার ছেলে-মেয়েরা একটু আলাদা। কুলসুম বেগম বললেন।
ওটাইতো চিন্তার বিষয়। আমরা কী যুগে জন্মেছিলাম। আর এখন-এ কোন অন্ধকার যুগে এসে ঠেকেছি। জানি না-আরও কতকিছু দেখে যেতে হবে। সয়ে যেতে হবে। এক সময় কত সালিস, কত বিচার-আচার করেছি। মানুষ শ্রদ্ধার সাথে কথা শুনতো এবং মানতো। আর এখন-এখন আমাদের কথা মূল্যহীন। এমনকি আমাদের উপস্থিতিটাও যেন এদের কাছে অসহ্যের। Ñবলে করিম সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
আমাদের যুগ-আর বর্তমান যুগের মধ্যে অনেক পার্থক্য। Ñবলে কুলসুম বেগম উঠে বসলেন। বললেন, রাত শেষ হতে গেল। এবার চোখ বন্ধ করুন তো। আমারও খুব ঘুম পাচ্ছে। আমি শুতে যাচ্ছি। বলে কুলসুম বেগম নিজের বিছানায় চলে গেলেন।
কী সেই পার্থক্য?
করিম সাহেব নিজের কাছেই প্রশ্ন করেন। জবাব পান না। কেবল বুঝতে পারন-একটা ক্ষয়িষ্ণু পর্বতের চূড়ায় বর্তমান প্রজন্ম কানামাছি খেলছে। তারা ভুলে গেছে, বয়স এবং অর্থ চিরদিনই পরিবর্তনশীল। তারা জানে না, এখন যে বয়সে তারা বয়স্কদেরকে অপমান করছে, অবমূল্যায়ন এবং অশ্রদ্ধা করছে সেই বয়সটি আমরা পেরিয়ে এসেছি-কিন্তু অপমানে, ভয়ে আমাদের পিতা-মাতারা কোনোদিন কুঁকড়ে যাননি। দুশ্চিন্তায় রাতের ঘুম তাদের হারাম হয়নি। আমরা-তেমন প্রাচুর্যের মধ্যে না থাকলেও সুখে ছিলাম। আর এরা প্রাচুর্যের মধ্যে থাকলেও সুখে নেই। এটাই কি কালের বিচার?
করিম সাহেবের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ভাবেন- কী এক যন্ত্রণাকাতর দুঃসময়ের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছি। কী রকম ভয়ঙ্করভাবে আমরা বেঁচে আছি। কিন্তু এভাবে আর কতদিন?
রাত বাড়তে থাকে।
বাড়তে বাড়তে এক সময় শেষের দিকে যায়। হঠাৎ একটা দমকা বাতাসে সজনে গাছের পুরনো পাতাগুলি ঝুরঝুর করে ঝরে পড়লো। বারান্দায় শুয়ে ঝরা পাতার মর্মান্তিক দৃশ্যের দিকে করিম সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। পাতাগুলি ঝরে গেছে। আবার আজ যা পুরনো হবে কাল তা ঝরে যাবে।
করিম সাহেবের কানে ঝরা পাতার মর্মরধ্বনি বারবার আছাড় খেয়ে পড়ছে। তিনি দেখেন-পুব মাঠ থেকে সেই আলোটি হাঁটতে হাঁটতে আবার তাদের বাড়ির দিকে আসছে। করিম সাহেব আর বাইরে তাকাতে পারছেন না। চোখ বন্ধ করে, বালিশের ওপর মাথা চেপে রেখে দু’হাতে কান এঁটে ধরলেন। তবুও মর্মান্তিক শব্দ এবং দৃশ্যগুলি নিষ্ঠুরভাবে তার কানে প্রবেশ করে তীরের ফলার মতো বিঁধে যাচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণায় তিনি ছটফট করছেন। উঠোন দিয়ে কেউ যেন হেঁটে যাচ্ছে।
থপ থপ পায়ের শব্দ ভেসে আসছে। করিম সাহেব অবচেতন মনে একটা নির্ভরতা খুঁজে পান। চোখ বন্ধ করেই জিজ্ঞেস করেন-
কে? কে যায়?
করিম সাহেবের প্রশ্নের জবাবে একটি খনখনে আওয়াজ খুব মৃদু অথচ ভয়ঙ্করভাবে ভেসে এলোÑ আমি, আমি মৃত্যু।
পাঁচ.
মৃত্যু!-
মৃত্যুই শেষ কথা। শেষ পরিণতি।
কিন্তু মৃত্যুই সব কিছু না। মৃত্যুর মাঝেও বেঁচে থাকা যায়। জীবনকে ধন্য করা যায়। সংসার সমাজ ও দেশের কল্যাণে রেখে যাওয়া যায় সীমাহীন অবদান।
নবাব সিরাজ উদদৌলা, তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ, ঈশা খাঁÑকত যে নাম, কত যে মৃত্যুহীন প্রাণ!Ñ
শাহীনের চোখে সমাজের শত বেদনা ও বঞ্চনার পরও ভেসে ওঠে তাঁদের কথা।
সত্যিইতো!
জীবনকে সত্যিকারভাবে গড়ে তুলতে পারলে সমাজের জন্য যেমন মঙ্গলজনক তেমনি নিজের জন্যও কল্যাণকর।
সমাজ-সংসারে অভাব আছে, দুঃখ কষ্ট আছে, যন্ত্রণা আছে, পাওয়া-না পাওয়ার বেদনা আছেতবুও তার মধ্য থেকে জীবনকে অর্থবহ করে তোলাই একমত্র কাম্য।
শাহীন স্বপ্ন দেখে।
স্বপ্ন দেখে একটি শোষণহীন, সুন্দর ও সবুজ সমাজের।
তার এই স্বপ্নটি আকাশের মত বিশাল। জমিনের মত প্রশস্ত।
সে স্বপ্ন দেখে কিভাবে মেরুদণ্ড টান টান করে এই সমাজে দাঁড়ানো যায়। স্বপ্ন দেখে সমাজের সকল অন্যায়, অবিচার, জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়ন নির্মূল করে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ ও সমাজ কিভাবে গড়া যায়।
স্বপ্নটি তার ভেতর বিচরণ করতে থাকে।
সর্বক্ষণ।
সবুজ স্বপ্ন দেখতে দেখতেই কেটে যায় তার দিন ও রাত।
ঘুমুতে পারে না শাহীন!
মৃত্যু!-
মৃত্যুই শেষ কথা। শেষ পরিণতি।
কিন্তু মৃত্যুই সব কিছু না। মৃত্যুর মাঝেও বেঁচে থাকা যায়। জীবনকে ধন্য করা যায়। সংসার সমাজ ও দেশের কল্যাণে রেখে যাওয়া যায় সীমাহীন অবদান।
নবাব সিরাজ উদদৌলা, তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ, ঈশা খাঁÑকত যে নাম, কত যে মৃত্যুহীন প্রাণ!Ñ
শাহীনের চোখে সমাজের শত বেদনা ও বঞ্চনার পরও ভেসে ওঠে তাঁদের কথা।
সত্যিইতো!
জীবনকে সত্যিকারভাবে গড়ে তুলতে পারলে সমাজের জন্য যেমন মঙ্গলজনক তেমনি নিজের জন্যও কল্যাণকর।
সমাজ-সংসারে অভাব আছে, দুঃখ কষ্ট আছে, যন্ত্রণা আছে, পাওয়া-না পাওয়ার বেদনা আছেতবুও তার মধ্য থেকে জীবনকে অর্থবহ করে তোলাই একমত্র কাম্য।
শাহীন স্বপ্ন দেখে।
স্বপ্ন দেখে একটি শোষণহীন, সুন্দর ও সবুজ সমাজের।
তার এই স্বপ্নটি আকাশের মত বিশাল। জমিনের মত প্রশস্ত।
সে স্বপ্ন দেখে কিভাবে মেরুদণ্ড টান টান করে এই সমাজে দাঁড়ানো যায়। স্বপ্ন দেখে সমাজের সকল অন্যায়, অবিচার, জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়ন নির্মূল করে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ ও সমাজ কিভাবে গড়া যায়।
স্বপ্নটি তার ভেতর বিচরণ করতে থাকে।
সর্বক্ষণ।
সবুজ স্বপ্ন দেখতে দেখতেই কেটে যায় তার দিন ও রাত।
ঘুমুতে পারে না শাহীন!
-মোশাররফ হোসেন খান..
0 comments: