সীমান্ত হত্যা : ভারতীয় খুনি বাহিনী বিএসএফ নতুন বছরের প্রথম দিনেই সীমান্তের মাটি বাংলাদেশী দরিদ্র নাগরিকদের রক্তে রঞ্জিত করেছে। শুধু সংখ্যা দিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যাযজ্ঞের ব্যাপকতা বোঝা যাবে না। আধিপত্যবাদী নীতি, বিকৃত মানসিকতা ও রক্তপিপাসায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে দখলদার পাকিস্তানি সেনাদের ঘৃণিত উত্তরসূরিতে পরিণত হয়েছে। ওদের মতোই বাংলাদেশের ভেতরে বিএসএফ আগ্রাসী বাহিনীরূপে প্রবেশ করতে পারলে নিশ্চিতভাবেই ৪২ বছর আগের অবিরাম রক্তঝরা সেই নয় মাসের আরও বীভত্স রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করতাম।
কাশ্মীরের কুনান পোশপোরা (Kunan Poshpora) নামের এক পাহাড়ি গ্রামে একটি ঘটনায় শিশু, তরুণী, বৃদ্ধা নির্বিশেষে শতাধিক নারীকে গণধর্ষণের রেকর্ডও আছে ভারতীয় দখলদার বাহিনীর। আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এদেশেরই একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী গণমানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি শাসকদের যাবতীয় জুলুমের দোসরে পরিণত হয়েছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, বাংলাদেশে আজ তাদের চেয়েও বৃহত্ একটি গোষ্ঠী ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনের অংশীদারে পরিণত হয়েছে। সেই দালালদের প্রতিনিধিত্বকারী ক্ষমতাসীন শাসকশ্রেণী সীমান্তে বাংলাদেশীদের অব্যাহত হত্যাযজ্ঞে কোনোরকম দুঃখবোধ করার পরিবর্তে প্রকারান্তরে নির্লজ্জভাবে সমর্থন দিয়ে চলেছে।
১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধীদের সঙ্গে চরিত্রগতভাবে এদের কোনো তফাত্ নেই। নতুন বছরের প্রথম দুই দিনে ঠাকুরগাঁও এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে আমাদের চারজন নিরীহ, নিরস্ত্র বাংলাদেশীকে বিএসএফ ব্রাশফায়ারে হত্যা করলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর তার পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। তিনি মিডিয়াকে সগর্বে জানিয়েছেন যে, গত মাসের দিল্লি সফরকালে বিএসএফকে বাংলাদেশী হত্যার লাইসেন্স নাকি তিনিই দিয়ে এসেছেন। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী যে বর্তমানে বাংলাদেশের প্রবল ক্ষমতাধর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হুকুম তামিল করছে, এই চমকপ্রদ তথ্য আমাদের জন্য গৌরবজনক হতে পারতো, যদি বাংলাদেশের জনগণের এভাবে প্রাণসংহার না হতো। বাস্তবতা হলো, সাবেক আমলা ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর প্রভু রাষ্ট্রের রাজধানীতে নির্দেশ দিতে নয়, নির্দেশ গ্রহণ করতে গিয়েছিলেন। ইংরেজি নববর্ষে বিএসএফ হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে তাকে ১৯৭১ সালের দালালের ভূমিকা পালনের আগাম নির্দেশ দেয়ার প্রেক্ষাপটেই তিনি স্বদেশে ফিরে এসব বোলচাল ঝাড়ছেন।
উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই আমলা প্রাণপণে ইসলামাবাদের সেবা করেছেন। বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ঢাকায় সাম্প্রতিক গণসংযোগের বক্তৃতায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে রাজাকার বলায় তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে শালীনতা বিসর্জন দিয়ে যথেষ্ট অশোভন কথাবার্তা বলেছেন। কিন্তু সীমান্তহত্যা প্রসঙ্গে সর্বশেষ সাফাই তার রাজাকার চরিত্রেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের দালাল সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে ভাষায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তাবত্ মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের পক্ষ টেনে কথা বলতেন, আজ সেই ভাষাতেই মহীউদ্দীন খান আলমগীর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর তাঁবেদারি করছেন। তবে মানতেই হবে তিনি একজন করিতকর্মা লোক। ৪২ বছরের ব্যবধানে একই ব্যক্তির ঐতিহাসিকভাবে দুই শত্রু দেশ পাকিস্তান এবং ভারতের শাসকদের একইভাবে মনোরঞ্জন করা যেই-সেই লোকের কম্ম নয়। বেশ ক’বছর আগে সংসদে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এক অসাধারণ উক্তি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ এমন এক আজব যন্ত্র সেখানে একদিক দিয়ে রাজাকার প্রবেশ করলে সে উল্টো দিক দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে বের হয়। জনশ্রুতি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডজন খানেক সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রির নেপথ্যের অন্যতম কারিগর মহীউদ্দীন খান আলমগীরের অতীত ও বর্তমান বিবেচনায় সালাহউদ্দিন কাদের তত্ত্ব না মেনে আর উপায় কী?
প্রতি বছরের প্রারম্ভেই বিএসএফ তার নিষ্ঠুরতা দিয়ে আমাদের চমকে দেয়। ২০১০ সালের ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রাম সীমান্তে ১৫ বছরের কিশোরী ফেলানীকে গুলি করে মেরে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রেখেছিল এই বিএসএফ নামক দানবেরা। ফেলানীর লাশের সেই ঝুলন্ত চিত্র দেশ-বিদেশের মিডিয়ায় ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। আর ক’দিন পর তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মেহেদির রঙে হাত রাঙাতে না পারলেও আপন রক্ত দিয়ে শরীর রঞ্জিত করতে পেরেছিল দরিদ্র পরিবারের হতভাগী মেয়েটি। বিএসএফের এসব হত্যা, নির্যাতন নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সে সময় ভারতীয় ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার সঞ্জয় ভট্টাচার্য তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দাবি করেছিলেন, সীমান্তে ক্রিমিনালদের মারা হচ্ছে। প্রায় একই সময়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আরও তাকলাগানো মন্তব্য করেছিলেন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর বক্তব্য ছিল, সীমান্তে যা কিছু ঘটছে তা নিয়ে সরকার মোটেও চিন্তিত নয়। সব কাজ ফেলে রেখে শুধু এদিকে দৃষ্টি দেয়ার প্রয়োজন আছে বলেও তার সরকার মনে করে না।
জনগণের জানমাল রক্ষায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সোল এজেন্সির দাবিদার সরকারের দায়িত্ব পালনের কী অসাধারণ নমুনা! অথচ পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে সে দেশের নাগরিক হত্যার প্রতিবাদে বিএসএফের বিরুদ্ধে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল হয়েছে। কুচবিহার জেলার তুফানগঞ্জে বিএসএফ ও গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষ বাধলে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে বছিরন বিবি (৪০) ও আসিফ শেখ (৭ মাসের শিশু) নিহত হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে তৃণমূল কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট যৌথভাবে হরতালের ডাক দেয়। শুধু তা-ই নয়, উত্তর ২৪ পরগণার স্বরূপ থানার বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী বাসিন্দারাও বিএসএফের অত্যাচার-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে। এদেশে শেখ হাসিনা, দীপু মনিদের মতো মমতা দিদি’র গুণগ্রাহীরা তার কাছ থেকে দেশপ্রেম ও জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধের পাঠ কেন গ্রহণ করতে পারেন না, সেটাই বুঝতে পারি না।
মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শেষদিকে ড. মালেক নামে এক ব্যক্তিকে গভর্নর বানিয়ে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পদলেহনের জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া খান তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে দালালদের সমন্বয়ে এক প্রাদেশিক সরকার গঠন করেছিলেন। ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিমান বঙ্গভবনে বোমাবর্ষণ করলে সেই কুলাঙ্গার গভর্নর সাঙ্গপাঙ্গ সমেত ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের দালালগোষ্ঠী ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, আজ প্রভু পরিবর্তন হয়ে নব্য দালালদের সৃষ্টি হয়েছে এবং নতুন রূপের তাঁবেদার সরকার এদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে। একাত্তরের সেই দালালদের ভাষা এবং এদের বক্তব্যের মধ্যেও তাই কোনো ফারাক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সর্বাত্মক প্রতিরোধ ছাড়া সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী বাহিনী এবং একবিংশ শতাব্দীর মীরজাফরদের পরাভূত করা যাবে না।
১৯৭১ সালের সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার জায়গায় এখন ষোলো কোটি মানুষ বাংলাদেশের নাগরিক। দিল্লিপন্থী রাজাকারদের সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পেলেও এই বিপুল জনগোষ্ঠী দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে সাহসিকতার সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তুললে সেই জোয়ারে আমাদের দুর্ভাগা কন্যা, ফেলানীর হত্যাকারী ও তাদের দোসররা ইনশাআল্লাহ, খড়কুটার মতো ভেসে যাবে। ১৯৭৬ সালে জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়ানো, অশক্ত রোগাক্রান্ত মওলানা ভাসানী ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফারাক্কা লংমার্চে নেতৃত্ব দিয়ে জাতিকে নবচেতনায় জাগ্রত করেছিলেন। তাঁর বিপ্লবী কাফেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে প্রবল বর্ষণের মধ্যে শেষ হয়েছিল। এ মাসের ২ তারিখে সেই চাঁপাইনবাবগঞ্জের রাধানগর সীমান্তে বিএসএফ বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করে জোড়া খুন করেছে। যারা নিয়মিতভাবে প্রতি সপ্তাহে আমার লেখা পড়েন, সেই লেখা নিজেদের মধ্যে শেয়ার করেন, কষ্ট করে অসংখ্য মন্তব্য লেখেন, আমার দেশ-কে ভালোবাসেন, তাদের প্রতি মওলানা ভাসানীর দৃষ্টান্ত অনুসরণের আহ্বান জানাই। আসুন না, দেশের সকল প্রান্ত থেকে আমরা আগুয়ান হই ভারতীয় সীমান্ত নামক আমার স্বজনের হত্যা ভূমির (Killing field) দিকে। আমার এই আহ্বান বাস্তবে পরিণত হলে ন্যায়ের লড়াইয়ে ধাবমান, ঈমানের শক্তিতে বলীয়ান মানুষের সেই জোয়ারকে প্রতিহত করবে এমন সাধ্য কার আছে? মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআন শরীফে কি বলেন নাই, আমি সেই জাতিকে সাহায্য করি যে জাতি নিজেকে সাহায্য করে। আমরা নিষ্ক্রিয় হয়ে নিরাপদে ঘরে বসে থাকলে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবার কোনো অধিকার আর থাকে না। সীমান্ত ছেড়ে এবার দেশের ভেতরে দৃষ্টি দিই।
জ্বালানিতে লুটপাট : মহাজোট সরকারের চার বছর অতিক্রান্ত হলো। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ সময়টি দুর্নীতির সর্বব্যাপী বিস্তার, মানবাধিকারের বেপরোয়া হরণ এবং অপশাসনের এক কালো অধ্যায়রূপেই বিবেচিত হবে। জনগণের কষ্টের কোনো তোয়াক্কাই করেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জনমতেরও তিনি কোনো ধার ধারেননি। আগামী নির্বাচন নিয়েও সম্ভবত তার কোনো উত্কণ্ঠা নেই। যদি থাকতো, তাহলে চার বছরের শেষ দিনে এভাবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর মতো অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না। এই চার বছরে তিনি পাঁচবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছেন। ২০০৬ সালে বিএনপি যেদিন সরকারের মেয়াদান্তে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়, সেদিন ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রল ও অকটেনের লিটারপ্রতি দাম ছিল যথাক্রমে ৩৩, ৩৩, ৫৬ এবং ৫৮ টাকা। সে সময়ের তুলনায় আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সে হিসাবে বর্তমানে অভ্যন্তরীণ বাজারে উপরিউক্ত চার ধরনের জ্বালানি তেলের দাম সর্বোচ্চ ৪৩, ৪৩, ৭৩ এবং ৭৫ টাকা হওয়া উচিত ছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম গড়ে ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও গণবিরোধী সরকার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়িয়েছে ১০৬ শতাংশ এবং পেট্রল ও অকটেনের ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির হার যথাক্রমে ৭১ ও ৬৯ শতাংশ।
সাধারণ জনগণের পকেট কেটে যে বিপুল পরিমাণে অতিরিক্ত টাকা নেয়া হচ্ছে, সেটা যাচ্ছে কুইক-রেন্টালের লুটপাটের ঘাটতি মেটাতে। মহাজোট সরকারের মূল্যবৃদ্ধির অপর একটি কৌশল লক্ষ্য করা দরকার। চার ধরনের জ্বালানি তেলের মধ্যে কেরোসিন প্রধানত দরিদ্র জনগোষ্ঠী ব্যবহার করে, ডিজেল পরিবহনে ব্যবহৃত হয় এবং অকটেন ও পেট্রল ধনিকশ্রেণীর গাড়ির জ্বালানি। আশ্চর্যজনকভাবে গরিবের জ্বালানি কেরোসিনের দাম সর্বোচ্চ ১০৬ শতাংশ এবং বিত্তবানের বিলাসবহুল গাড়ির তেল অকটেন সর্বনিম্ন ৬৯ শতাংশ হারে বাড়ানো হয়েছে। অথচ এই সরকার অহর্নিশ নিজেকে দরিদ্রবান্ধব বলে গলাবাজি করে থাকে। এ প্রসঙ্গে আমার স্বল্প সময়ের জ্বালানি উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকালীন একটি ঘটনার বর্ণনা দেশবাসীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করছি।
২০০৬ সালের শুষ্ক মৌসুমে ভারত ফারাক্কা পয়েন্টে চুক্তি মোতাবেক পানি না ছাড়ার কারণে যমুনা নদীতে নাব্য সঙ্কট ভয়াবহ রূপ নেয়। বিআইডব্লিউটিএ-কে তাগাদা দিলেও তাদের পক্ষে অতিরিক্ত ড্রেজিং করে বাঘাবাড়ীর কাছে চ্যানেল চালু রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে জ্বালানি তেলবাহী অনেকগুলো ট্যাংকার ডুবোচরে আটকে যায়। সে সময় ভরা সেচ মৌসুম থাকায় উত্তরবঙ্গে ডিজেলের চাহিদাও সর্বাধিক ছিল। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি যে, প্রয়োজনীয় তেল খুলনার দৌলতপুরে পাঠানো হবে এবং সেখান থেকে সড়কপথে উত্তরবঙ্গে সরবরাহ লাইন চালু থাকবে। সমস্যা হলো, এতটা ঘুরপথে জ্বালানি পাঠাতে লিটারপ্রতি প্রায় ২ টাকা অতিরিক্ত পরিবহন খরচ হবে। লোকসানি প্রতিষ্ঠান বিপিসি’র জন্য এই ব্যয় বোঝার ওপর শাকের আঁটি বিবেচনায় আমরা সাময়িকভাবে উত্তরবঙ্গে জ্বালানির দাম প্রতি লিটারে মাত্র ১ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিই। জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণে চট্টগ্রাম থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের দূরত্ব বিবেচনায় নেয়ার পদ্ধতি বিপিসিতে দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের কাছে যুক্তির কোনো মূল্য কোনোদিনই ছিল না। তারা প্রচারণা শুরু করলেন, উত্তরবঙ্গের প্রতি অবিচার হচ্ছে। মুহূর্তমাত্র কালক্ষয় না করে সংসদে আওয়ামী লীগের সদস্যরা আমার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধারে নেমে গেলেন। ভাবখানা এমন, মূল্যবৃদ্ধির ওই এক টাকা আমার পকেটে যাবে। এমন হৈ চৈ শুরু করলেন যে, দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েও চারদলীয় সরকারের ত্রাহি মধুসূধন অবস্থা। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তখন বিদেশ সফরে ছিলেন। সন্ধ্যা পার হয়ে গেলেও অফিসে বসে কাজ করছিলাম। বিরোধী দলকে সামলাতে না পেরে ব্যারিস্টার মওদুদ সংসদ থেকেই আমাকে ফোন করলেন। তিনি পরামর্শ দিলেন, আমি যেন মিডিয়াকে বলি এক টাকা দাম বাড়ানোর কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। আমার বক্তব্য ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এমন মিথ্যে কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।
নিজে যেখানে মিডিয়াকে দাম বাড়ানোর কথা বলেছি, সেখানে পিঠ বাঁচাতে উল্টো কথা বলার চেয়ে পদত্যাগের প্রস্তাব দিলে তত্কালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ সেদিন যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছিলেন। যা-ই হোক, তখনই মিডিয়াকে আবার ডেকে সাময়িকভাবে লিটারপ্রতি এক টাকা মূল্য বৃদ্ধির অত্যন্ত যৌক্তিক সিদ্ধান্ত বাতিলের কথা জানানোর পরই কেবল সংসদের পরিস্থিতি শান্ত হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিদেশ থেকে ফিরে এসে এ ব্যাপারে অবশ্য আমাকে আর কোনো কথা বলেননি। তবে অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান বিপিসির স্বার্থে আমার দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে সঠিক বলেছিলেন। আজ অবাক হয়ে দেখি, যে দল সে সময় এক টাকা নিয়ে তুলকালাম বাধিয়েছিল, তারাই বিগত ১৯ মাসের মধ্যে পাঁচবার তেলের দাম বাড়িয়ে ৩৩ টাকার ডিজেল ৬৮তে উঠিয়েছে। সেই দলেরই প্রবীণ অর্থমন্ত্রী জ্বালানি তেলের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে বিরোধী দল জনস্বার্থে ন্যায্য হরতাল ডাকলে তাদের উন্মাদ বলে গালাগাল করছেন।
আরও একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। আমার ষোলো মাসের দায়িত্ব পালনকালে সর্বদা সাধারণ জনগণের ক্রয়ক্ষমতার কথা বিবেচনা করেই জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ করেছি। অকটেন এবং পেট্রল যেহেতু সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণী ব্যবহার করে, তাই আমার সর্বদা ঝোঁক ছিল ওগুলোর দাম অধিক হারে বাড়ানোর। এভিয়েশন ফুয়েল বাদ দিলে কেরোসিন একেবারেই গরিবের জ্বালানি। আর ডিজেলের সঙ্গে সরাসরি কৃষিপণ্য, উত্পাদন খরচ এবং পণ্য পরিবহন ব্যয় জড়িত। আমার চেষ্টাই থাকতো উচ্চবিত্তের ওপর যথাসম্ভব করের বোঝা বাড়িয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের সাশ্রয় করার। বর্তমান সরকারের মতো ডিজেল ও কেরোসিনের দাম অধিক মাত্রায় বৃদ্ধি করে তুলনামূলকভাবে পেট্রল এবং অকটেনের দাম কম বাড়ানোর নীতি আমরা কল্পনাতেই আনতে পারতাম না। জ্বালানি তেলের সর্বশেষ মূল্যবৃদ্ধিতে অত্যন্ত অন্যায় নীতি নিয়ে ক্ষমতাসীনরা তাদের গণবিরোধী চরিত্রের প্রমাণ দিয়েছে।
উপসংহার : বর্তমান শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ চাইলে জনগণকেই প্রতিরোধে নামতে হবে। উচ্চ দ্রব্যমূল্যের যাঁতাকলে সাধারণ নাগরিক আজ নিষ্পেষিত হচ্ছে। গত পাঁচ বছর ধরে আল্লাহতায়ালার অসীম অনুগ্রহে এবং কৃষকের হাড়ভাঙা খাটুনির ফলে ধানের উত্পাদন অব্যাহতভাবে বেড়েছে। ফলে চালের দাম তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল রয়েছে। কিন্তু অন্য সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। চার বছরে এসব পণ্যের দাম তিনগুণ বেড়েছে। অর্থনীতির এই ভারসাম্যহীন অবস্থায় কৃষকসহ সাধারণ নাগরিকের নাভিশ্বাস উঠেছে। বাংলাদেশের কৃষকদের সিংহভাগই ধানের উত্পাদনের ওপর নির্ভরশীল। ধান ছাড়া সব পণ্যের চড়া দামের ফলে সেই কৃষকরা উপর্যুপরি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। ধান বিক্রি করে তারা সংসারের অন্যান্য ব্যয় নির্বাহ করতে পারছেন না। এবার ভরা বোরো মৌসুমে ডিজেলের এই বিপুল মূল্যবৃদ্ধি তাদের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘার সমতুল্য। অথচ চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সেচের কথা বিবেচনায় নিয়ে এই সময়টা পার করেই কেবল আমরা জ্বালানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতাম। এবারের জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপকতা এবং সময় দেখে আমার মনে হচ্ছে, শেখ হাসিনা জনগণের ক্ষোভকে একেবারেই আমলে নিচ্ছেন না। ক’দিন আগে ঘটা করে ঢাকায় বিপুল অর্থ অপচয় করে নির্মিত অসম্পূর্ণ হাতিরঝিল প্রকল্প উদ্বোধনের পর তিনি সেটিকে রাজধানীবাসীর জন্য নববর্ষের উপহাররূপে বর্ণনা করেছিলেন। সে ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তেলের মূল্যবৃদ্ধিকেও প্রধানমন্ত্রী সমগ্র দেশবাসীর জন্য নববর্ষের উপহার মনে করছেন কি-না, সেটা তিনিই ভালো জানেন। তবে গণতান্ত্রিক চেতনার আলোকে তার এই সিদ্ধান্তে জনমতের প্রতি চরম অবজ্ঞা ফুটে উঠেছে।
এ বছরই মহাজোট সরকারের বৈধ মেয়াদ সমাপ্ত হওয়ার কথা। অবস্থাদৃষ্টে আমার কাছে অন্তত মনে হচ্ছে যে, মেয়াদ শেষ হলেও তিনি গায়ের জোরেই অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চান। জনসমর্থন নিয়ে তাই একেবারেই মাথা ঘামাচ্ছেন না। বিচারপতি নামের কলঙ্ক খায়রুল হক মহাজোট নেত্রীর ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার বাসনা পূরণের প্রাথমিক কাজ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের মাধ্যমে ইতোমধ্যেই সম্পন্ন করেছেন। দেশ-বিদেশের সমালোচনা এবং দিল্লির ছাড়া অন্য কোনো আন্তর্জাতিক চাপের যে শেখ হাসিনা পরোয়া করেন না, সেটা প্রফেসর ইউনূস ইস্যুতেই দেখা গেছে। বিএনপিতে অনুপ্রবেশকারী ভারতপন্থীরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে যতই দিল্লির ভরসায় বসে থাকুন না কেন, শেষ পর্যন্ত তাদের নিরাশ হতে হবে বলেই আমার ধারণা।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সাধারণ জনগণের অধিক মাত্রায় কার্যকর অংশগ্রহণের মাধ্যমেই কেবল নব্য ফ্যাসিবাদকে পরাভূত করা যেতে পারে। আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত শাসকশ্রেণী মেয়াদের বাকি সময়ে ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর দমন-পীড়নের মাত্রা তীব্র করেই ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সেই চণ্ডনীতি উপেক্ষা করে জনগণ একবার পথে নামলে কোনো স্বৈরাচারই টিকতে পারে না। আমাদের দেশেই অতীতে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান, জেনারেল এরশাদ গণঅভ্যুত্থানের মুখেই ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। আসুন, পূর্বপুরুষদের সেই দেশপ্রেম ও সাহস হৃদয়ে ধারণ করে আজকের লুটেরা, জালিম শাসকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে অবতীর্ণ হই।
আমার প্রিয় কবি সুকান্ত’র ‘বিদ্রোহের গান’ কবিতা থেকে খানিকটা অংশ উদ্ধৃত করে লেখায় ইতি টানছি।
বেজে উঠলে কি সময়ের ঘড়ি?
এসো তবে আজ বিদ্রোহ করি,
আমরা সবাই যে যার প্রহরী
উঠুক ডাক।
..............................
..............................
খ্যাতির মুখেতে পদাঘাত করি,
গড়ি, আমরা যে বিদ্রোহ গড়ি,
ছিঁড়ি দু’হাতের শৃঙ্খল দড়ি,
মৃত্যুপণ।
দিক থেকে দিকে বিদ্রোহ ছোটে,
বসে থাকবার বেলা নাই মোটে,
রক্তে রক্তে লাল হয়ে ওঠে,
পূর্বকোণ
0 comments: