দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
দাওয়াতের প্রাথমিক অবস্থার সংক্ষিপ্ত আলোচনাঃ
আল্লাহ তায়ালা আরবের বিখ্যাত কেন্দ্রীয় শহর মক্কায় তাঁর এ বান্দা (মুহাম্মদ সঃ) –কে নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য নিযক্তি করেন এবং তাঁর নিজ শহর ও নিজ গোত্র কোরাইশদের মধ্যেই এ দাওয়াতী কাজের সূচনা করতে নির্দেশ দেন। এ কাজের সূচনাতেই যে সব হেদায়েতের প্রজোজন ছিলো তা তাকেঁ প্রদান করা হয় এবং সেগুলো ছিলো প্রধান তিন প্রকারের বিষয়বস্তু সমন্বিতঃ
একঃ এ বিরাট গুরুদায়িত্ব পালন করার জন্যে নবী নিজেকে নিজে কিভাবে তৈরি করবেন এবং তিনি কোন্ পন্থা ও পদ্ধতিতে কাজ করবেন সেসব বিষয়ে তাকেঁ শিক্ষা দেয়া হয়।
দুইঃ প্রকৃত তত্ত্ব ও রহস্য সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্য এবং নিগূঢ় সত্য সম্পর্কে সমাজে সাধঅরণভাবে প্রাচলিত ভুল ধারণা সমূহের প্রতিবাদ করা হয়, যেসব ভুল ধারণার কারণে তাদের জীবন যাত্রা অত্যন্ত ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হয়েছিলো।
তিনঃ প্রকৃত জীবন-যাপন পন্থার প্রতি আহ্বান এবং খোদায়ী হেদায়াতের সে সব মৌলিক চরিত্র-নীতির বিশ্লেষণ, যেগুলোর অনুসরণে বিশ্বামানবতার চিরন্তন কল্যাণ ও সৌভাগ্য নিহিত রয়েছে।
দাওয়াতের সূচনা হিসেবে প্রাথমিক পর্যায়ের এসব পথ নির্দেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংক্ষপ্তি বাণীতে সমন্বিত ছিলো স্বচ্ছ ঝরঝর-অত্যন্ত মিষ্টি মধুর, অতিশয় প্রভাব বিস্তারকারী এবং যাদের লক্ষ্য করে তা বলা হচ্ছিল-তাদের রুচি অনুযায়ী উন্নত সাহিত্যিক ভুষণে সজ্জিত। ফলে তা শ্রোতাদের হৃদয়-মনে তীর শলাকারমতো বিদ্ধ হতো; সুমধুর ভাব সামঞ্জস্যের কারণে লোকেরা আত্মহারা হয়ে তা উচ্চারণ ও আবুতি করতে শুরু করতো।
সর্বোপরি তাতে স্থানীয় ভাবধারার বিশেষ প্রভাব বিদ্যমান ছিলো। যদিও আলোচনা করা হতো চিরন্তন সত্যের কিন্তু তার সত্যতা প্রমাণের জন্যে যুক্তি-প্রমাণ, সাক্ষ্য ও উদাহরণ গৃহীত হতো নিকটস্থ পারিপার্শ্বিক সমাজ তেকেই, যে সবের সাথে শ্রোতৃমণ্ডলীর ছিলো নিগূঢ় পরিচিতি। তাদেরই ইতিহাস,তাদের জাতীয় ঐতিহ্য, তাদেরই দৈনন্দিন পর্যবেক্ষণাধীন নিদর্শণ সমূহ এবং তাদেরই আকীদা বিশ্বাস, নৈতিক চরিত্র এবং সামজিক ক্রটিবিচ্যুতি সম্পর্কে তাতে আলোচনা হতো, যাতে করে তারা এর দ্বারা তীব্রভাবে প্রভাবিত হয়।
দাওয়াতের এ প্রাথমিক অধ্যায় প্রায় তিন চার বছর পযন্ত দীর্ঘায়িত হয়। (এর মধ্যে তিন বছর ছিলো গোপন দাওয়াতের পর্যায়)। এ অধ্যায় নবী করীমের (সঃ) দাওয়াতের প্রতিক্রিয়া তিন ভাবে প্রকাশিত হয়ঃ
১) কতিপয় সৎ ও সত্যপন্থী লোক এ দাওয়াত কবুল করে মুসলিম উম্মায় সংঘবদ্ধ হবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যায়।
২) একটা বিরাট সংখ্যাক লোক মূর্খতা কিংবা স্বার্থপরতা অথবা বংশানুক্রমিক প্রচলিত প্রথার অন্ধ-প্রেমে মশগুল হয়ে তার বিরোধিতা করতে বদ্ধপরিকর হয়।
৩) কুরাইশ ও মক্কার পরিসীমা অতিত্রম করে এ নতুন দাওয়াতের আওয়ায অপেক্ষাকৃত বিশাল ক্ষেত্রে পদার্পণ করে।
এরপর থেকেই আরম্ভ হয় এ দাওয়াতের দ্বিতীয় অধ্যায়। এ অধ্যায়ে ইসলামী আন্দোলনের সাথে প্রাচীন জাহেলিয়অতের এক তীব্র প্রাণান্তকর দ্বন্দ্বের সূচনা হয়, যার জের আট ন’বছর কাল পর্যন্ত চলতে থাকে। শুধু মক্কাতে নয়, শুধু কুরাইশ গোত্রে নয়, আরবের অধিকাংশ অঞ্চলেই প্রাচীন জাহেলিয়াতের সমর্থকরা এ আন্দোলনকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। এ আন্দোলনকে নিস্তেজ ও নিস্তনাবুদ করে দেবার জন্যে তারা সর্বোতভাবে চেষ্টা করতে শুরু করে। মিথ্যা প্রোপাগাণ্ড, অপবাদ, দোষারোপ, সন্দেহ-সংশয় ও নানাবিধ কুট প্রশ্নের তীব্র আক্রমণ চালাতে থাকে। জনগণের অন্তরে বিবিধ-প্রকার প্রচারণ ও প্ররোচনা সৃস্টি করতে থাকে। অপরিচিত লোকদেরকে নবী করীম (সঃ) –এর কথা শোনা থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করে। ইসলাম গ্রহণকারীদের উপর চরম পাশবিক অত্যাচার নির্যাতন চালাতে থাকে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে তাঁদের সাথে যাবতীয় সর্ম্পক ছিন্ন করে। এভাবে তাঁদের উপর এতো অবর্ণনীয় নির্যাতন-নিষ্পেষণ চালানো হয় যে, তাদের অনেক লোকই নিজেদের ঘর বাড়ী পরিত্যাগ করে দু’দুবার হাবশায় হিজরত করতে বাধ্য হয় এবং শেষ পর্যন্ত তৃতীয়বার তাঁদের সকলকেই মদীনায় হিজরত করতে হয় কিন্তু এ তীব্র বিরোধিতা ও ক্রমবর্ধমান প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এ আন্দোলন ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হতে থাকে। মক্কায় এমন কোন বংশ ও পরিবার ছিল না, যেখান থেকে অন্তত এক ব্যক্তিও ইসলাম গ্রহণ করেনি। ইসলামের অধিকাংশ দুশমনের কঠিন দুশমনীর কারণ এ ছিলো যে, তাদের নিজেদেরই ভাই, ভাতিজা, পুত্র, জামাই, কন্যা, বোন এবং ভগ্নিপতির ইসলামী দাওয়াত শুধু কবুলই করেনি; বরং তারা ইসলামের আত্মোৎসর্গী, সাহায্যকারী হয়ে গিয়েছিলো। তাদের নিজেদের কলিজার টুকরো সন্তানরাই তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামী হয়ে উঠেছিলো। সর্বোপরি মজার ব্যাপার ছিলো যে, যারাই প্রাচীন জাহেলিয়াতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে এ নতুন আন্দোলনে যোগদান করছিলো, তারা জাহেলী সমাজেও সর্বাপেক্ষা উত্তম লোক হিসাবে স্বীকৃতি ছিলো। আর এ আন্দোলনে যোগদানের ফলে তারা এত বেশী সৎ ও সত্যপন্হী এবং পবিত্র নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হয়ে উঠেছিলো যে,এ বিপ্লবী কাজটাই বিশ্ববাসীর দৃস্টিতে এ আন্দোলনের শ্রেষ্ঠত্ব ও বিশিষ্টতা সুস্পষ্ট করে তুললো। এ সুদীর্ঘ ও কঠিন দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম চলাকালে আল্লাহ তায়ালা সময়, সুযোগ ও প্রয়োজনমতো তাঁর নবীর প্রতি এমন সব আবেগময়ী ভাষণ নাযিল করতে থাকেন, যেগুলোতে বর্তমান ছিলো দরিয়ার উচ্ছ্বসিত শ্রোতবেগ, সয়লাবের দুর্নিবার শক্তি আর আগুনের তীক্ষ্ম তেজস্বীতা। এসব ভাষণে একদিকে ঈমানদারদেরকে তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব ও কর্তব্যসমুহের কথা বলে দেয়া হয়। তাদের মধ্যে জামায়াতী যিন্দেগীর চেতনা পয়দা করা হয় এবং তাদেরকে তাক য়া, চারিত্রিকমাহাত্ন্য, পবিত্র স্বভাব ও পবিত্র জীবন যাপনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সত্য দীন প্রচারের কর্মপন্থা তাদেরকে শিখিয়ে দেয়া হয়। সাফল্যের ওয়াদা ও জান্নাতের সুসংবাদ দ্বারা তাদের সাহস যোগানো হয়। ধৈর্য্য, দৃঢ়তা ও উচ্চ সাহসিকতার সাথে আল্লাহর পথে জেহাদ ও সংগ্রাম করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করা হয় । ত্যাগ, কোরবানী ও আত্মোৎসগের্র এমন দুর্বার জজবা তাদের মধ্যে সৃষ্টি করে দেয়া হয় যে, যাবতীয় বিপদ মুসীবত ও বিরুদ্ধতার গগণচুম্বী তরঙ্গমালার সঙ্গে মুকাবিলা করার জন্যে তারা তৈরী হয়ে যায়। অন্যদিকে বিরুদ্ধবাদী, সত্যবিমুখ ও গাফলতের ঘুমোঘোরে নিমজ্জিত লোকদের সেসব জাতির ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ করে সতর্ক করা হয়, যাদের ইতিহাস সম্পর্কে তাদের ভালভাবে জনা ছিলো। দিনরাত যেসব ধ্বংসাবশেষ অঞ্চলের উপর দিয়ে সফর ব্যাপদেশে তারা যাতায়াত করতো সেসব নিদর্শনের উল্লেখ করে তারেদকে উপদেশ দেয়া হয়। আসমান ও জমিনের যেসব সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী দিনরাত চোখের সামনে প্রতিভাত হতো, যেগুলো তাদের যিন্দেগীতে তারা প্রতিটি মুহূর্তে অবলোকন করতো ও অনুভব করতো, সেসব প্রকাম্য নিদর্শনাবলী দ্বারাই তৌহিদ ও আখিরাতের প্রমাণ পেশ করা হয়। শিরক, সেচ্ছাচারিতা, পরকালের প্রতি অস্বীকৃতি এবং পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণের ভ্রান্তি মন-মগজে প্রভাব বিস্তারকারী সুস্পষ্ট দলীল ও যুক্তি দ্বারা প্রমাণ করা হয়। অতঃপর তাদের যাবতীয় সন্দেহ সংশয় বিদূরিত করা হয়। তাদের প্রতিটি প্রশ্নের যুক্তিসঙ্গত জবাব দেয়া হয়। যেসব জটিল সমস্যায় মন জর্জরিত ছিল অথবা অন্যদের মনকে সংশায়িত করছিল সেগুলোর সুস্পষ্ট সমাধান পেশ করা হয়। চতুর্দিক থেকে অন্দ জাহেলিয়াতকে এমনভাবে অবরুদ্ধ করা হয় যে, বুদ্ধি ও বিবেকের জগতে অবস্থানের জন্যে তার বিন্দু পরিমান স্থঅন থাকল না। এর সাথে তাদেরকে আল্লাহর গজব ও অভিশাপ, কিয়ামতের ভয়ঙ্কর রূপ এবং জাহান্নামের কঠিন আযাব সম্পর্কে বয় প্রদর্শন করা হয়। তাদের খারাপ চরিত্র, ভ্রান্ত জীবন-যাপন পদ্ধতি, জাহেলী রসম রেওয়ায, সত্য বিরোধিতা এবং মুমিনদেরকে নির্যাতনের কারণে তাদেরকে র্ভৎসনা ও তিরস্কার করা হয়। নৈতিক চরিত্র ও সমাব্যবস্থার যেসব বড় বড় মূলনীতি আল্লাহর মনোনীত সত্যভিত্তিক সভ্যতার ভিত্তি সেগুলো বিস্তারিত ভাবে তাদের সামনে পেশ করে দেয়া হয়।
এ অধ্যয়টি এককভাবে বিভিন্ন মনযিল দ্বারা সমন্বিত, যার প্রতিটি মনযিলেই দাওয়াতী কাজ অত্যন্ত ব্যাপক ও প্রশস্ত হয়ে উঠে। চেষ্টা সাধনা এবং বিরুদ্ধতাও তীব্রতর হতে থাকে। আন্দোলন বিভিন্ন মতাবলম্বী ও পরস্পর বিরোধী কর্মতৎপর অসংখ্য দল উপদলের সম্মুখীন হয়। তদনুযায়ী আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত বাণী সমুহের বিষয় বৈচিত্রও ব্যাপকতর হতে থাকে। ইসলামী দাওয়াতের এ বিরাট দায়িত্ব পালনের জন্যে নবী (স)-কে যে বিস্তারিত পথ নির্দেশ প্রদান করা হয় তার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে সহজেই বুঝতে পারা যায় যে, মক্কার ঘোর বিরোধীতার যুগে কোন মহান চারিত্রিক শক্তি সম্মুখে অগ্রসর হবার পথ পরিস্কার করে এবং কোন প্রভাবশালী এ আন্দোলনে অংশ গ্রহণকারী লোকদেরকে সকল শক্তির সাথে টক্কর লাগাতে এবং সকল মুসীবত অকাতরে সহ্য করতে উদ্বুদ্ব্দ করে। নিম্নে এক একটি করে সেসব পথ নির্দেশ আমরা বর্ণনা করছিঃ
দাওয়াত দানে হিকমত ও মাওয়েযাগত পদ্ধতি
‘হে নবী তোমার রবের পথে লোকদেরকে ডাকো ‘হেকমত’ এবং মাওয়েযায়ে হাসানার মাধ্যমে’। (আন নহল ১২৫)
এখানে বলা হচ্ছে দ্বীনের দাওয়াত দানে দুটো পদ্ধতি খুব কড়াকড়ি ভাবে মেনে চলতে হবে। এক, হিকমাত। দুই, মাওয়েযায়ে হাসান।
“দাওয়াতে হিকমাত প্রয়োগের মানে হচ্ছে-বেওকুফদের মতে বোকামীর সাথ যেনো দাওয়াত দেয়া না হয়। বরং বুদ্ধিমত্তার সাথে শ্রোতার মানসিকতা ও সামর্থ এবং তার ধারণ ক্ষমতা বুঝে উপযুক্ত স্থান, সময় ও সুযোগ অনুযায়ী কথা বলতে হবে। সব ধরনের লোকদেরকে একই ডাণ্ডা দিয়ে সোজা করার চেষ্টা করা ঠিক নয়। যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের কাছে দাওয়াত নিয়ে যাওয়া হবে-প্রথমে তার রেগ নির্ণয় করতে হবে। অতঃপর এমন সব যুক্তি ও প্রমাণের সাহয্যে তার চিকিৎসা করতে হবে-যা তার মন-মানসিকতার গভীর থেকে সমস্ত রোগের উৎস মূর উপড়ে ফেলতে সমর্থ হবে।
‘মাওয়েযায়ে হাসানা’ বা উত্তম উপদেশের দুটি অর্থ রয়েছে। এক শ্রোতাকে শুধুমাত্র যুক্তি প্রমাণ দিয়ে বুঝিয়ে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টাকে যথেষ্ট মনে করা যাবে না ;বরং তার অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলতে হবে। অন্যায় ও ভ্রান্তিকে শুধুমাত্র যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করে দিলেই চলবে না; বরং মানুষের মধ্যে জন্মগত ভাবে অন্যায়ের প্রতি যে র্ঘণঅ ও নফরত রয়েছে তাকে জাগ্রত করে তুলতে হবে এবং গেসুলোর অশুভ পরিণতি সম্পর্কে তাকে সতর্ক করে দিতে হবে। হেদায়াত ও আমলে সালেহর সৌন্দর্য ও বিশুদ্ধতা যুক্তি ও বুদ্ধিগত প্রমাণই যথেষ্ট নয়-সাথে সাথে এগুলোর প্রতি শ্রোতার আকর্ষণ ও মহব্বত পয়দা করে দিতে হবে। দুই সহানুভূতি, আন্তরিকতা ও একান্ত দরদের সাথে উপদেশ দান করতে হবে। শ্রোতা যেনো কখনো এমনটি মনে করতে না পারে যে, উপদেশদানকারী তাকে ক্ষুদ্র জ্ঞান করছে এবং নিজেকে বিরাট কিছু মনে করে তার সাথে বিদ্রুপ করছে। বরং এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যেনো শ্রোতা অনুভব করতে পারে যে-তার সংশোধনের জন্য উপদেশ দানকারীর অন্তরে সত্যিই দরদ ও সানুভূতিপূর্ণ আকুতি রয়েছে এবং প্রকৃত পক্ষে তিনি তার কল্যাণ কামান করেছেন”।
কথা ও আলোচনা ধরন তর্ক বহছ ও জ্ঞান বুদ্ধির দাপট দেখানোর প্রয়োজন হবে না। একাজে উগ্র আলোচনা, অপবাদ দেয়া ও চোট লাগানো থেকে বিরত থাকতে হবে। আলোচনা বা কথা বলার উদ্দেশ্যে যেনো প্রতিদ্বন্দ্বীকে জব্দ করা কিংবা নিজের বাচালতার ঢাকঢোল পেটানো না হয়। বরং দাওয়াতী কাজে আলোচনা ও কথা-বার্তা হতে হবে সুমধুর। দাওয়াত দানকারীর চরিত্র হতে হবে উচ্চমানের ভদ্রতা ও শালীনতাপূর্ণ। নিজের কথাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যুক্তিপূর্ণ ও প্রানাকর্ষিত দলিল প্রমাণ দিয়ে। কোনো অবস্থাতেই শ্রোতাদের মনে জিদ, গোস্বা ও উগ্রতা পয়দা হতে দেয়া যাবে না। অত্যন্ত সরল সোজাভাবে তাকে নিজের বক্তব্য-বুঝানোর চেষ্টা করতে হবে। যখন অনুভূত হবে, শ্রোতা বক্রতর্কে অগ্রসর হচ্ছে তখন তখনই তার সাথে আলোচনা বন্ধ করে দিতে হবে। যেনো সে ভ্রান্ত পথে আরো অধিক অগ্রসর হতে না পারে।
সত্যপথের ডাকার জন্যে প্রয়োজন ঠাণ্ডা মাথা ও পরিবেশগত উত্তমপন্থাঃ
‘হে মুহাম্মদ! আমার বান্দাদের বলে দাও, তারা যেনো সর্বোত্তম ভাবে কথা বলে। আসলে শয়তান তাদের মধ্যে ঝগড়া ফাসাদ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। প্রকৃতপক্ষে শয়তান মানুষের প্রকাশ্য দুশমন। তোমাদের রব তোমাদের অবস্থা সম্পর্কে সর্বাধিক জানেন । তিনি ইচ্ছে করলে তোমাদেরকে অনুগ্রহ করতে পারেন। আর তিনি চাইলে তোমাদের আযাবাও দিতে পারেন। আর হে নবী, আমরা তোমাকে লোকদের উপর উকীল বানিয়ে পাঠাইনি’। (বনী ইসরাঈল :৫৩-৫৪)
অর্থাৎ-ঈমানদার লোকেরা কাফির মুশরিক এবং তাদের দ্বীনের বিরুদ্ধেবাদীদের সাথে আলোচনা ও কথা বলার সময় মিথ্যা, অতিরঞ্জিত ও দ্রুত কথা বলবে না। বিরুদ্ধবাদীরা যতই অন্যায় অপসন্দনীয় কথা বলুকনা কেনো মুসলমানদেরকে কোনো অবস্থাতেই কোনো না-হক ও অন্যায় কথা মুখ দিয়ে বের করা যাবে না এবং রাগের মাথায় কোনো বাজে কথার প্রতি উত্তরে বাজে কথা বলা যাবে না। তাদের ঠাণ্ডা মাথায় পরিবেশ অনুযায়ী তুলাদণ্ডে মেপে কথা বলতে হবে। তাদের প্রতিটি কথা ন্যায় ও সত্য এবং তাদের মহান দাওয়াতের মর্যাদাসূচক।
আর কখনো যদি বিরুদ্ধবাদীদের কথার জবাব দিতে গিয়ে তোমাদের মধ্যে ক্রোধাগ্নি প্রজ্জ্বলিত হচ্ছে বলে অনুভব করো এবং মেজাজ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে মনে করো- তখনই বুঝে নেবে যে, এ হচ্ছে শয়তানের কাজ। সে তোমাকে উস্কিয়ে দিচ্ছে যেনো দাওয়াতে দ্বীনের কাজটা বিনষ্ট হয়ে যায়। সে চায় তোমরাও তোমাদের বিরুদ্ধবাদীদের মত সংস্কার সংশোধনের কাজ ত্যাগ করে সেরূপ ঝগড়া ফাসাদে লিপ্ত হয়ে যাও যেরূপ ঝগড়া ফাসাদে সে গোটা মানব জাতিকে লিপ্ত রাখতে চায়।
ঈমানদার লোকদের মুখ দিয়ে এমন দাবী কখনো বেরোতে পারবে না যে আমরা বেহেশতী আর অমুক লোক বা লোকেরা দোযখী। এ কাজের ফায়সালা তো আল্লাহর হাতে। স্বয়ং নবীর কাজও দাওয়াত দান পর্যন্ত সীমিত। লোকদের ভাগ্যের চাবিকাঠি তাঁর হাতে অর্পণ করা হয়নি যে, তিনি কারো জন্যে রহমতের আর কারো জন্যে আযাবের ফায়সালা করে দেবেন।
দাওয়াত দানকারীর মর্যাদা ও দায়িত্বঃ
‘দেখো তোমাদের কাছে তোমাদের রবের নিকট থেকে অন্তর্দৃষ্টির আলো এসে পৌঁছেছে। এমন যে লোক নিজের দৃষ্টি শক্তির সাহায্যে কাজ করবে সে নিজেরই কল্যাণ সাধন করবে। আর যে অন্ধত্ব গ্রহণ করবে সে নিজেই ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আমি তোমাদের উপর পাহারাদার নই’। (আনয়াম-১০৪)
‘আমি তোমাদের উপর পাহারাদার নই’ মানে আমার দায়িত্ব তো শুধু এতটুকু যে তোমাদের কাছে সে রৌশনী পেশ করে দেবো যা তোমাদের পরওয়ারদেগারের নিকট থেকে এসেছে। অতঃপর চোখ খুলে দেখা না দেখা তো তোমাদের কাজ। যারা চোখ বন্ধ করে রাখবে জোর পূর্বক তাদের চোখ খুলে দেবো এবং তারা যা দেখবে না তাদেরকে তা দেখিয়ে ছাড়বো-এমন দায়িত্ব আমাকে দেয় হয়নি।
‘হে নবী! আপনার রবের নিকট থেকে অবতীর্ণ অহীর অনুসরণ করুন। তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই। মুশরিকদের জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন না। যদি আল্লাহর ইচ্ছা হতো (এরা শিরক না করার) তবে এরা শিরক করতো না। আমি আপনাকে এদের উপর পাহারাদার নিযুক্ত করিনি। আপনি তাদের উপর কোনো হাবিলদারও নন’। (আনয়াম ১০৬-১০৭।)
এ কথার তাৎপর্য যে, আপনাকে দা’য়ী ও প্রচাররক বানানো হয়েছে, কোতোয়াল বানানো হয়নি। তাদের পিছে লেগে থাকার কোনো প্রয়োজন আপনার নেই। আপনার দায়িত্ব হচ্ছে লোকদের সামনে এ রৌশনী আপনি পেশ করে দেবেন, সাধ্যানুযায়ী সত্য প্রকাশের হক আদায় করতে কোনো ক্রটি করবেন না। অতঃপর কেউ যদি এ সত্য কবুল করতে না চায়-তবে তা না করুক। লোকদের সত্যপন্থী বানিয় ছাড়ার দায়িত্ব আপনাকে অর্পন করা হয়নি। আর এমন কথা আপনার দায়িত্ব ও জবাবদিহির অন্তর্ভুক্তও নয় যে, আপনার নবুওয়াতের সীমানায় কোনো বাতিল পন্থীর অস্তিত্ব থাকতে পারবে না। সুতরাং এ চিন্তায় আপনার মনকে পেরেশান করে তুলবেন না যে, অন্ধ লোকদেরকে কী করে দৃষ্টি শক্তি দেয়া যাবে যারা চোখ খুলে দেখতে চায় না-তাদেরকে কি করে দেখানো যাবে। যদি আল্লাহর ইচ্ছাই এ রকম হতো যে দুনিয়ায় কোনো বাতিল পন্থীর অস্তিত্ব থাকতে পারবে না তবে একাজ আপনার দ্বারা করানো আল্লাহর কি প্রয়োজন ছিল? তাঁর একটা তাকভীনি () ইশারাই কি সমস্ত মানুষকে সত্যপন্থী বানাতে পারতো না? কিন্তু শুরু থেকেই সেখানে উদ্দেশ্য এরূপ নয়। উদ্দেশ্য তো হচ্ছে মানুষকে হক ও বাতিল নির্বাচনের আযাদী দেয়া হবে। অতঃপর হকের রৌশনী তার সামনে পেশ করে তাকে পরীক্ষা করা হবে এ দুয়ের মাঝে সে কোনটা নির্বাচন করে। তাই আপনার জন্যে সঠিক কর্মপন্থা হচ্ছে যে রৌশনী আপনাকে দেখিয়ে দেয়া হলো, তার আলোকে আপনি সঠিক সোজা পথে চলতে থাকুন এবং যারা এ দাওয়াত কবুল করে নেবে তাদেরকে বুকে মিলিয়ে নিন এবং কখনো তাদের সঙ্গদান ত্যাগ করবেন না। পার্থিব দৃষ্টিতে তারা যতই নগণ্য মূল্যহীন হোক না কেনো। আর যারা এ দাওয়াত কবুল করবে না তাদের পিছে লেগে থাকবেন না। যে অশুভ পরিণতির দিকে তারা নিজেরাই যেতে চায়, যাওয়ার জন্যে চরম গোঁড়ামী অবলম্বন করে তাদেরকে সেদিকে যাবার জন্যে ছেড়ে দিন।
দ্বীন প্রচারের সহজ পন্থা
‘আর হে নবী! আমি তোমাকে সহজ পন্থার সুবিধে দিচ্ছি। কাজেই তুমি উপদেশ দিয়ে যাও। যদি উপদেশ ফলপ্রসু হয়’।
অর্থাৎ হে নবী! দ্বীন প্রচারের ব্যাপারে আমি তোমাকে কোনো অসুবিধেয় ফেলতে চাইনে। বধিরদেরকে শুনানো আর অন্ধদেরকে পথ দেখানোর দায়িত্ব তোমার নয়। তোমাকে একটা সহজ পন্থা দিয়ে দিচ্ছি। তা হচ্ছে, তুমি উপদেশ দান করতে থাকো যতক্ষণ তুমি অনুভব করতে থাকবে যে, কেউ না কেউ এর দ্বারা উপকৃত হতে প্রস্তুত নয়। বাকী থাকলো এ কথা যে, এর দ্বারা উপকৃত হতে কে প্রস্তুত আর কে প্রস্তুত নয়? বস্তুত সাধারণ দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমেই এ প্রশ্নের জবাব প্রকাশিত হয়ে যাবে। তাই সাধারণ তাবলীগ ও প্রচার কাজ অবশ্যই জারি রাখতে হবে। কিন্তু এর উদ্দেশ্য হবে আল্লাহর বান্দাদের মধ্য থেকে ঐ সমস্ত লোকদেরকে খুঁজে বের করা যারা এ নসীহতের দ্বারা উপকৃত হয়ে সঠিক পথ অবলম্বন করবে। বস্তুত এ সমস্ত লোকেরাই তোমার আন্তরিক লক্ষ্যস্থল হবার অধিকারী, আর শুধুমাত্র এ লোকদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রতিই তোমার দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। এদের ছেড়ে ঐ সমস্ত লোকদের পিছে ব্যস্ত হবার কোনো প্রয়োজন নেই, অভিজ্ঞতার আলোকে যাদের সম্পর্কে জানতে পারবে যে, তারা এ নসীহত কবুল করতে ইচ্ছুক নয়।
দ্বীন প্রচারের দৃষ্টিকোণ গুরুত্বপূর্ণ লোক কারা
‘আর হে নবী! যারা রাতদিন তাদের পরওয়ারদিগারকে ডাকতে থাকে আর তাঁর সন্তোষ অনুসন্ধান নিরত থাকে, তুমি তাদেরকে দূরে সরিয়ে দিওনা। তোমার উপর তাদের হিসাবের কোনো দায়-দায়িত্ব নেই আর তাদের উপরও তোমার হিসাবের কোনো যিম্মাদারী নেই। তা সত্ত্বেও যদি তুমি তাদেরকে দূরে সরিয়ে দাও, তবে তুমি যালেমদের মধ্যে গণ্য হবে’। (আনয়াম-৫২)
প্রথম দিকে যারা হুজুর (সঃ)-এর প্রতি ঈমান এনছিলেন তাদের বহুসংখ্যক লোক দরিদ্র ও শ্রমজীবি ছিলেন। হুজুর (সঃ)-এর প্রতি কুরাইশদের বড় বড় সরদার ও স্বচ্ছল অবস্থার লোকদের অন্যান্য প্রশ্নের মধ্যে এ প্রশ্নটিও ছিল যে-তাঁর চতুরপার্শ্বে তো কেবল আমাদের কওমের দাস, মুক্তদাস ও নিম্নশ্রেণীর লোকেরাই একত্রিত হয়েছে। তারা টিপ্পনী কেটে বলতো-এ লোকের সঙ্গী-সাথী ও মিছিলে কেমন সম্মানিত লোকেরা! বেলাল, আম্মার, সোহাইব, খাব্বাব বাস্ এ লোকদেরকেই আল্লাহ আমাদের মধ্য থেকে মনোনীত করার মত খুঁজে পেলেন। অতপর তারা ঈমানদারদের অসচ্ছল অবস্থঅ নিয়ে বিদ্রূপ করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং ঈমান আনার পূর্বে তাদের কারো কোন চারিত্রিক দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়ে থাকলে তা নিয়েও তারা বিদ্রূপের ঢেউ তুলতো যে, কালকে পর্যন্ত যার চরিত্র এমন ছিল, এমন এমন কাজ যে করেছে সেও দেখি এ মনোনীত দলের অন্তর্ভুক্ত। সূরা আনয়ামেরই ৫৩ আয়াতে তাদের একথার উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছেঃ এরাই কি সেসব লোক, আমাদের মধ্য থেকে যাদের প্রতি আল্লাহর কৃপা ও অনুগ্রহ হয়েছে? এ আয়াতে এসব কথারই জবাব দেয়া হয়েছে। আয়াতটির তাৎপর্য হচ্ছে, যেসব লোক সত্যানুসন্ধিৎসু হয়ে তোমার নিকট আসে- বড় বড় লোকদেরকে খাতির করতে গিয়ে তারেকে দূরে ঠেলে দিওনা। ইসলাম কবুল করার পূর্বে কেউ কোনো অপরাধ করে থাকলেও তার দায়-দায়িত্ব তো তোমার উপর বর্তাবে না।
হযরত ইবনে উম্মে মাকতুমের ঘটনা
হুজুর (সঃ) -এর মজলিসে একবার মক্কার কতিপয় সরদার, সমাজপতি উপবিষ্ট ছিল। হুজুর (সঃ) তাদের ইসলাম কবুল করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করছিলেন।১ এরি মধ্যে ইবনে উম্মে মাকতুম নামক একজন অন্ধ হুজুর (সঃ)-এর খেদমতে হাজির হয়ে ইসলাম সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলেন। এ সময় ব্যাঘাত সৃষ্টি করাটা হুজুর (সঃ)-এর অপসন্দ হওয়ায় তিনি তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করলেন না। এ ঘটনার প্রেক্ষিতেই আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সূরা আবাসা নাযিল হয়ঃ
‘বেজার হলো এবং মুখ ফিরিয়ে নিল। কারণ সে অন্ধ তাঁর নিকট এসেছে’। (আবাসা ১-২)
ভাষণের সূচনাভঙ্গি দেখে বাহ্যত মনে হয়, অন্ধ ব্যক্তির প্রতি অনাগ্রহ এবং বড় বড় সরদারদের প্রতি আগ্রহ ও মনোযোগ প্রদর্শন করায় নবী করীম (সঃ)-এর প্রতি এ সূরায় শাসন ও তিরস্কার করা হয়েছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে গোটা সূরাটির প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে জানা যায় যে, এ সূরায় মূলতঃ কাফের কুরাইশ সরদারের প্রতি চরম অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে-যারা অহংকার ও আত্মম্ভরিতা এবং সত্য বিমুখতার কারণে নবী করীম (সঃ)-এর সত্য দাওয়াতকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছিল। আর হুজুর (সঃ) –কে দ্বীন প্রচারের সঠিক পন্থা শিক্ষা দেয়ার সাথে রেসালাতের দায়িত্ব পালনের প্রাথমিক অবস্থায় তিনি যেসব পন্থা অবলম্বন করছিলেন-তার ভ্রান্তিও বুঝিয়ে দেয়া হলো। তিনি যে একজন অন্ধ ব্যক্তির প্রতি অনাগ্রহ এবং কুরইশ সরদারদের প্রতি মনোযোগ আরোপ করেছিলেন-তার কারণ এ নয় যে-তিনি এসব বড় লোককে সম্মানিত ও মর্যাদাবান এবং বেচারা অন্ধ ব্যক্কিকে নগণ্য ভাবছিলেন। এর কারণ এও নয় যে, মায়যাল্লাহ তাঁর মধ্যে কোনো প্রকার নৈতিক বক্রতা বিদ্যমান ছিল-যার কারণ আল্লাহ তায়ালা এখানে তাঁকে শাসন ও তিনস্কার করেছেন। না এ ব্যাপার এসব কিছুই নয়; বরং প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে যে, কোনো আদর্শের আহবায়ক বা দা’য়ী যখন তাঁর দাওয়তী কাজের সূচনা করেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তার লক্ষ্য তাকে যেনো সমাজের প্রভাবশালী লোকেরা এ দাওয়াত কবুল করে নেয়; যার ফলে প্র্রচার কাজ সহজতর হয়ে যায়। নতুবা সাধারণ প্রভাব-প্রতিপত্তিহীন, দুর্বল ও অক্ষম লোকদের মধ্যেও যদি দাওয়ত ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েও যায়-তবু মূল ব্যাপারে তেমন কোনো পার্থক্য সূচিত হয় না। দাওয়াতের সূচনাকালে হুজুর (সঃ) প্রায় এ রকম কর্মনীতিই গ্রহণ করেছিলেন। ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও দ্বীনি দাওয়াতের উৎকর্য়ের প্রতি গভীর আন্তরিকতাই ছিল এর মূল কারণ। বড় লোকের সম্মান প্রদর্শন এবং ছোট লোকদের ঘৃণা করা তাঁর লক্ষ্য ছিল না। কিন্তু আল্লাহ তায়ালঅ তাঁকে বুঝিয়ে দিলেন যে, ইসলামী দাওয়াতের সঠিক ও নির্ভুল পন্থা এটা নয়। বরং এ দাওয়াতের দৃষ্টিকোণ থেকে ঐসব লোকেরাই গুরুত্বের অধিকারী যারা সত্যানুসন্ধিৎসু-তারা যতই দুর্বল, প্রভাব-প্রতিপত্তিহীন ও অক্ষমই হোক না কেনো। পক্ষান্তরে যাদের মধ্যে সত্যানুরাগ নেই, সমাজে তারা যতই উচ্চমর্যাদার অধিকারী হোক না কেনো-এ আন্দোলনের দৃষ্টিতে তারা একেবারেই গুরুত্বহীন। সুতরাং ইসলামের আহ্বান্আপনি সকলের নিকটই পৌঁছাবেন বটে; কিন্তু আপনার লক্ষ্য ও আগ্রহের অধিকারী হবে সেসব লোক-যাদের মধ্যে এ মহাসত্য গ্রহণের সম্মতি পাওয়া যাবে। আর যারা নিজেদের অহংকার ও আত্মম্ভরিতার কারণে মনে করে যে, তারা আপনার মুখাপেক্ষী নয়; বরং আপনিই তাদের মুক্ষাপেক্ষী কেবল এসব দাম্ভিক ও অহংকারী লোকদের নিকটই দাওয়াত পেশ করতে থাকা আপনার এ সুমহান দাওয়াতের উচ্চ মর্যাদার পক্ষে নিতান্তই অপমানকর। তার প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেনঃ
‘হে নবী! তুমি কেমন করে জানবে! সে হয়তো পরিশুদ্ধ হতো কিংবা উপদেশ গ্রহণ করতো এবং উপদেশদান তার জন্যে কল্যাণকর হতো। যেলোক বেপরোয়া ভাব দেখায়, তুমি তার প্রতি লক্ষ্যারোপ করছো। অথচ সে যদি পরিশুদ্ধ না হয়, তবে তোমার উপর তার দায়িত্ব কি? আর যেলোক তোমার নিকট দৌড়ে আসে আর সে ভয়ও করে, তুমি তো তার প্রতি অনীহা প্রদর্শন করছো। কক্ষণও নয়। এটা তো একটা উপদেশ। যার ইচ্ছা সে এটা গ্রহণ করবে’।
এ সময় দ্বীন প্রচারের ব্যাপারে নবী করীম (সঃ) যে মূল তত্ত্বটাকে উপেক্ষা করছিলেন; এখানে তারই উল্লেখ করা হয়েছে এবং একথা বুজানোর জন্যেই আল্লাহ তায়ালা প্রথমে ইবনে উম্মে মাকতুমের সাথে নবী করীম (সঃ) –এর কৃত আচরণের তিরস্কার করেছেন। অতঃপর সত্য দ্বীনের প্রচারকদের নিকট প্রকৃত গুরুত্ব কোন জিনিসের হওয়া উচিত আর কোন জিনিসের নয়-তাই বুঝিয়ে দিয়েছেন। এক ব্যক্তির পরিচয় হচ্ছেঃ এই তার বাহ্যিক অবস্থা সুস্পষ্ট ভাবে বলে দেয় যে, সে সত্যানুসন্ধিৎসু, বাতিলের অনুসরণ করে খোদার রোষে নিপতিত হবার ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত। তাই সত্য পথের জ্ঞান লাভ করার জন্যে সে নিজেই নবীল নিকট এসে উপস্থিত হয়ে যায়। পক্ষান্তরে আর এক ব্যক্তির পরিচয় হচ্ছেঃ তার বাহ্যিক চাল-চলন ও আচরণই বলে দেয় যে, তার মধ্যে সত্যের প্রতি কোনো প্রকার অনুরাগ নেই। তাকে সত্য পথের পথনির্দেশ দেয়া হোক এমন প্রয়োজন থেকে সে নিজেকে অনেক উর্ধ্বে মনে করে। এ দুপ্রকার লোকের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে তাতে লক্ষ্যণীয় বিষয় এটা নয় যে, কোন ব্যক্তি ঈমান আনলে দ্বীনের অনেক ফায়দা হতে পারে আর কারো ঈমান আনায় দ্বীনের উল্লেখযোগ্যা ফায়দা হতে পারে না। বরং লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে কোন ব্যক্তি হেদায়ত কবুল করে নিজেকে শোধরানোর জন্যে প্রস্তুত আর কোন ব্যক্তি এ অমূল্য সম্পদের মর্যাদাদানে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত এবং এর মর্যাদা সম্পর্কে বিলকুল অনবহিত। প্রথম ব্যক্তি যদি অন্ধ, খঞ্জ, শক্তিহীন, নিঃস্ব-দরিদ্রও হয়ে এবং বাহ্যিক দৃষ্টিতে দ্বীনের উৎকর্ষ লাভের ব্যাপারে বড় কোনো দায়িত্ব পালনেও যদি যোগ্য বলে বিবেচিত না হয়; তা সত্ত্বেও সত্য প্রচারকের জন্যে সেই হবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তার প্রতিই তাঁকে লক্ষ্যারোপ করতে হবে। কারণ এ দাওয়াতের মূল উদ্দেশ্যই তো হচ্ছে খোদার বান্দাদের সংশোধন। আর এ ব্যক্তির অবস্থা দৃষ্টে পরিস্কার বুঝা যায় যে, তাকে যদি নসীহত করা হয় তবে সে নিজেকে সংশোধন ও পরিবর্ত করে নেবে। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় প্রকারের মানুষ সমাজে যতোই প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী হোক না কেনো সত্য দ্বীনের প্রচারককে তার পিছে পিছে দৌড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ তার বাহ্য আচরণ থেকে একথা সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, পরিশুদ্ধি ও পবিত্রতা গ্রহণে তার কোনো প্রকার ইচ্ছা ও আগ্রহ নেই। সুতরাং তাকে সংশোধন করার চেষ্টা করা সময়ই নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই নয়। সে যদি নিজেকে শোধরাতে না চায়-তাতে সে নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে সত্য দ্বীন প্রচারকের কোনো দায়-দায়িত্ব নেই।
এখানে যে অন্ধ ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে, তিনি হচ্ছেন-প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রাঃ) হাফেয ইবনে আবদুল বার ‘আল ইসতিয়ার’ গ্রন্থে এবং হাফেজ ইবনে হাজার ‘আল ইসাবা’ গ্রন্থে লিখেছেন, তিনি ছিলেন হযরত খাদিজার (রাঃ) ফুফাতো ভাই। তার মা উম্মে মাকতুম এবং হযরত খাদীজার পিতা খুয়াইলিদ পরস্পর ভাই-বোন ছিলেন। হুজর (সঃ)-এর সাথে তাঁর এই আত্মীয়তার সম্পর্ক জানার পর তাকে তিনি দরিদ্র কিংবা কম মর্যাদার লোক মনে করে বিরক্তির সাথে তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সম্মুখে উপস্থিত বড় লোকদের প্রতি লক্ষ্যারোপ করেছেন বলে সন্দেহ করার কোনোই অবকাশ নেই। কারণ, সম্পর্কের দিক থেকে তিনি তো নবী করীম (সঃ)-এর ভাই (ম্যালক) ছিলেন। বংশীয় লোক ছিলেন তিনি। কোনো প্রকার মর্যাদাহীন লোক তিনি ছিলেন না। বস্তুতঃ যে কারণে নবী করীম (সঃ) তার প্রতি উক্তরূপ আচরণ গ্রহণ করেছিলেন, তা কুরআনের ( ) (অন্ধ ব্যক্তি) শব্দ দ্বারা পরিস্কারভাবে বুঝা যায়। নবী করীম (সঃ) -এর অনাগ্রহ প্রকাশের মূল কারণ স্বরূপই স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এখানে এ শব্দটা ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ এমুহূর্তে হুজুর (সঃ) -এর মনোভাব এরূপ ছিলো যে, এ সময় যে লোকগুলোকে আমি ইসলামের দিকে আনবার চেষ্টা করছি, তাদের একজন লোকও যদি হেদায়াত কবুল করে তবে তা ইসলামের শক্তিশালী হয়ে উঠার বড় কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। পক্ষান্তরে ইবনে উম্মে মাকতুম একজন অন্ধ ব্যক্তি। নিজ অক্ষমতার কারণে তিনি ইসলামের জন্যে ততোটা কল্যাণকর হতে পারেন না-যতোটা এ সরদারদের মধ্যে থেকে কেউ ইসলাম কবুল করলে আশা করা যায়। কাজেই এ সময়কার কথাবার্তায় ব্যাঘাত ঘটানো তার ঠিক নয়। তিনি যা কিছু জানতে ও বুঝতে চান তা পরেও কোনো একসময় জেনে নিতে পারেন।
0 comments: