পবিত্র কুরআনের যে অংশ তের বছর যাবত মক্কায় নাযিল হয়েছিল, তা শুধু একটি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছিল। বিষয়টির মূল বক্তব্যে কোন পরিবর্তন না করে কুরআনের নিজস্ব বর্ণনাভংগীতে তা নতুন নতুন রূপে পেশ করা হয়। ফলে, প্রতিবারেই মনে হয়েছে যেন বিষয়টি প্রথম দফা আলোচিত হচ্ছে। ঐ বিষয়টি ছিল নতুন জীবন ব্যবস্থায় প্রথম ও প্রধান মৌলিক প্রশ্ন। আর সে প্রশ্নটি ছিল সৃষ্টিকর্তা, মানবগোষ্ঠী এবং এ দু’য়ের সম্পর্ক বিষয়ক বিশ্বাস।
প্রশ্নটি তুলে ধরা হয়েছিল সমস্ত মানব জাতিরই সামনে। তারা আরব দেশীয় হোক বা অন্য যে কোন এলাকার অধিবাসী, সে যুগের অথবা পরবর্তী যে কোন যুগের হোক না কেন, সকল মানুষের জন্যে একই প্রশ্ন এবং উত্তরও অভিন্ন।
মানব মনের মৌলিক জিজ্ঞাসাগুলো কখনো পরিবর্তন হয় না। সৃষ্টিজগতের মধ্যে মানুষের অবস্থান, মানব জীবনের গন্তব্যস্থল, সৃষ্টিজগতে তার মর্যাদা ও জগতের সাথে তার সম্পর্ক এবং মানুষ ও তার সৃষ্টিকর্তার মধ্যস্থিত সম্পর্কের ধরন ইত্যাদি বিষয়গুলো সকল যুগের ও সকল অঞ্চলের লোকদের জন্যেই অভিন্ন। এ মৌলিক বিষয়গুলোকে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়— কারণ, এগুলো মানুষের অস্তিত্বের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
কুরাআন নাযিলের মক্কী যুগে মানুষ ও তার চারিপার্শ্বের জগতে লুক্কায়িত রহস্যাবলী ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মানুষ কোথা থেকে এলো, তার কি পরিচয়, কি উদ্দেশ্যে সে দুনিয়াতে এসেছে, তার গন্তব্যস্থল কি, কে তাকে শূন্যতা থেকে অস্তিত্ব দান করলো এবং তার পরিণাম কি হবে, কুরআন নাযিলের প্রথম স্তরে এসব বিষয় নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে। সৃষ্টির অনেক বিষয় রয়েছে যা মানুষ দেখতে পায় ও স্পর্শ করতে পারে। আবার অনেকগুলো এমনও রয়েছে যাদের অস্তিত্ব অনুভব করা যায় কিন্তু সেগুলো দেখাও যায় না, ছোঁয়াও যায় না। কুরআন এ পর্যায়ে মানুষকে এ উভয় ধরনের সৃষ্ট বিষয় ও বস্তুনিচয়ের জ্ঞান দান করেছে। এ ছাড়া কে এ মহান বিশ্বকে সৃষ্টি করেছেন এবং কে যাবতীয় সৃষ্ট বস্তুর আকৃতি ও প্রকৃতি নির্ধারণ করেছেন, এসব বিষয়েও মক্কী স্তরেই আলোচিত হয়েছে। অনুরূপভাবেই কুরআন মানুষকে স্রষ্টা, বস্তুজগত ও মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক রাখার উপায় বলে দিয়েছে। এটাই সে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যার উপর মানুষের অস্তিত্ব নির্ভর করছে এবং সৃষ্টজগতের ক্ষয় প্রাপ্তি পর্যন্ত নির্ভর করবে।
এ জন্যই মক্কী যুগের তের বছরের মধ্যে এ গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক প্রশ্নের উত্তর বিভিন্ন আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যেহেতু, মানব জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট অপরাপর প্রশ্ন এ মৌলিক সমস্যা থেকেই উদ্ভুত।
মক্কী স্তরে কুরআন মৌলিক আকীদার বিষয়টিকেই প্রধান বিষয় হিসেবে নির্ধারিত করে নেয় এবং এ বিষয়ে উদ্ভুত অন্য কোন প্রশ্ন সম্পর্কে সে যুগে কোন কিছুই বলা হয়নি। সর্বজ্ঞ আল্লাহ তাআলা সিদ্ধান্ত করেছিলেন যে, একদল লোকের হৃদয়য়ে ঈমান পরিপূর্ণরূপে ও মযবুতভাবে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের সামনে অন্যান্য বিধান পেশ করা হবে না। কারণ, যারা পরবর্তীকালে তাঁর দ্বীনকে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করবে, তাদের অন্তরে সর্বপ্রথম মযবুত ঈমানের প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য ছিল।
আল্লাহর দ্বীনের বাণী যারা প্রচার করেন এবং এ দ্বীনের উপস্থাপিত জীবন বিধানকে রূপায়িত করতে যারা আগ্রহী তাদের বিশেষভাবে স্মরণ রাখা দরকার যে, তের বছর কাল পবিত্র কুরআন শুধু ঈমানের দাওয়াতই পেশ করেছে এবং ঐ ঈমানের ভিত্তিতে রচিত জীবন বিধানের বিস্তারিত আইন-কানুন ও বিধি-নিষেধ প্রচার মুলতবী রেখেছে।
দাওয়াতী কাজের সূচনা
আল্লাহ তাআলার অসীম জ্ঞান-ভাণ্ডার থেকেই ঠিক করা হয়েছিল যে, রাসূলূল্লাহ (সা)—এর প্রাথমিক দাওয়াতের বিষয়বস্তু ঈমান ও আকীদা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাববে। আল্লাহর রাসূল (সা) সর্বপ্রথম মানুষের নিকট যে বাণী পেশ করেন, তা হচ্ছে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন মনিব ও মাবুদ না থাকার সাক্ষ্য দান করা। সাথে সাথে তিনি মানুষের নিকট তাদের সত্যিকার মাবুদের পরিচয় দান এবং একমাত্র তাঁরই বন্দেগী করার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করার কাজেও আত্মনিয়োগ করেন।
মানুষের সীমিত জ্ঞান থেকে অনুমিত হয় যে, দাওয়াতের স্বল্প সংখ্যাক শব্দ সমষ্টি প্রাথমিক স্তরে আরবদের মন জয় করতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে আরবগণ তাদের মাতৃভাষা ভালভাবেই বুঝতে সক্ষম ছিল এবং সে জন্যেই ইলাহ ও ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ শব্দগুলোর অর্থ বুঝতে তাদের কোনই বেগ পেতে হয়নি। তারা জানতো যে, উলুহিয়াত শব্দের অর্থ হচ্ছে সার্বভৌম শক্তি এবং তারা এটাও বুঝতো যে, সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহর প্রতি আরোপ করার পরিণতি স্বরূপ পুরোহিত, গোত্রীয় সরদার এবং ধনী শাসনকর্তাদের নিকট থেকে সকল কর্তৃত্ব ছিনিয়ে তা আল্লাহর নিকট অর্পন করা হবে, আর এর বাস্তব পরিণতি হবে এই যে, মানুষের চিন্তা-ভাবনায়, ধর্মীয় আচার –অনুষ্ঠানে, সম্পদ বন্টন ও বিচারানুষ্ঠানে এবং জাতীয় জীবনের অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে; সংক্ষেপে মানুষের আত্মা ও দেহে একমাত্র আল্লাহ তাআলারই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ঘোষণা সমাজে প্রতিষ্ঠিত সকল কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ বিশেষ। তৎকালে প্রচলিত সকল রাজনীতি ও সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য সকল শক্তির আইন প্রণয়ন ও শাসন কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণারই নামান্তর। আরবের অধিবাসীদের মাতৃভাষায় উচ্চারিত ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ ঘোষণার তাৎপর্য তাদের অভ্যস্ত জীবন যাত্রার উপর এর প্রতিক্রিয়া তাদের নিকট অজ্ঞাত ছিল না। তাই তারা এ বিপ্লবী বাণীতে রাগান্বিত হয়ে উঠে এবং এ ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। একথা সকলেরই জানা রয়েছে।
দ্বীনের দাওয়াত কেন এভাবে শুরু হলো? কেনই বা আল্লাহ তাআলা তাঁর দ্বীনের এ বাণীকে প্রাথমিক স্তরেই পরীক্ষায় নিক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত করেছিলেন?
জাতীয়তাবাদ ও দ্বীনি দাওয়াত
রাসূলুল্লাহ (সা) যে সময় আল্লাহর বাণী প্রচার শুরু করেন সে সময় আরবদের ভূমি ও সম্পদ তাদের নিজেদের হাতে ছিল না বরং অন্যদের কুক্ষিগত ছিল। উত্তরাঞ্চলে সিরিয়া রোমানদের দখলে ছিল। অনুরূপভাবে দক্ষিণাঞ্চলে ইয়ামন ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। স্থানীয় আরবগণ পারস্য রাজ্যের অধীনতা স্বীকার করে ঐ অঞ্চল শাসন করছিল। শুধুমাত্র হিজায, তিহামা এবং নজদ এলাকায় আরবদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল, কিন্তু ঐ এলাকাগুলো ছিল নিছক মরুভুমি। কয়েকটি মরুদ্যান ছাড়া সমগ্র এলাকাটাই ছিল পানিবিহীন বালুকাময় প্রান্তর।
এটাও সর্বজনবিদিত যে, হযরত মুহাম্মাদ (সা)—কে তাঁর নিকটাত্মীয় এ প্রতিবেশীগণ আল আমীন ও আস সাদিক (বিশ্বস্ত ও সত্যবাদী) উপাধি দান করেছিলেন। তাঁর নবুওয়াত প্রাপ্তির পনর বছর আগেই কুরাইশ গোত্রপতিগণ তাঁকে কাবা ঘরের হাজরে আসওয়াদ পুনঃস্থাপন বিষয়ক বিতর্কে সালিস নির্বাচিত করে এবং তাঁর মীমাংসায় অত্যন্ত খুশী হয়। তিনি বনী হাশিম গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং বনী হাশিম কুরাইশদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী সম্ভ্রান্ত গোত্র হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। সুতরাং এটা স্বচ্ছন্দে বলা যেতে পারে যে, হযরত মুহাম্মাদ (সা) আরব জাতীয়তাবাদের ধুয়া তুলে সে সমাজের লোকদের অতি সহজেই ঐক্যবদ্ধ করতে পারতেন। কুরাইশগণ খুব সহজেই আরব ঐক্যের ডাকে সাড়া দিত। কারণ গোত্রীয় যুদ্ধ বিগ্রহ ও রক্তপাতের বিরামহীন ধারা তাদের অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। তিনি শতধা বিচ্ছিন্ন আরবদের ভাষাভিত্তিক ঐক্যের আহবানে একত্রিত করে রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের দখলকৃত আরব ভুমি উদ্ধার করতে পারতেন এবং একটি সম্মিলিত আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা তাঁর পক্ষে কিছুমাত্র কঠিন ছিল না।
রাসূলুল্লাহ (সা) তের বছর যাবৎ অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করে প্রবল বিরোধিতার মুখে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার পরিবর্তে জাতীয়তাবাদের আহবানে সহজেই জনগণের সমর্থন লাভ করতে পারতেন এবং সমগ্র আরবদের উপর তাঁর নেতৃত্ব স্বীকৃতি লাভ করতো।
একথাও বলা যেতে পারে যে, এভাবে তাঁর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের অধীনে সমগ্র আরব ভূমিকে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত করে নেয়ার পর তিনি জনগণকে আল্লাহ তাআলার একত্বের প্রতি ঈমান আনয়নের জন্য প্রস্তুত করতে পারতেন এবং তাঁর নিজের কর্তৃত্ব মেনে নেয়ার পর তারা সহজেই তাঁরই উপদেশ ও শিক্ষানুসারে তাদের প্রতিপালাক আল্লাহ তাআলাকে মেনে নিতেও বাধ্য হতো।
কিন্তু সকল জ্ঞানের আধার ও সকল বিষয়ে বিজ্ঞ আল্লাহ তাআলা তাঁর নবীকে ঐ পথ ধরে চলতে দেননি। বরং তাঁকে তিনি প্রকাশ্য ঘোষণার মাধ্যমে আল্লাহ ব্যতীত অপর সকলের কর্তৃত্ব অস্বীকার করার নির্দেশ দেন এবং স্বয়ং আল্লাহর রাসূল ও তাঁর স্বল্প সংখ্যক অনুচরদের ধৈর্য সহকারে তীব্র বিরোধীতার সম্মুখীন হতে নির্দেশ দেন।
প্রশ্ন হচ্ছে এসব কেন? রাসুলুল্লাহ (সা) ও তাঁর প্রিয় সাহাবীগণকে অযথা নির্যাতনের শিকারে পরিণত করা হয়নি। তিনি জানতেন যে, অন্য কোন উপায়ে উদ্দেশ্য সফল হতে পারে না। রোম ও পারস্যের নির্যাতন থেকে আরব ভূমিকে মুক্ত করে সে স্থলে আরবী নির্যাতনই প্রবর্তন করা এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল না। দেশী বা বিদেশী সকল নির্যাতনই এক ও অভিন্ন। পৃথিবী আল্লাহর এবং সেটাকে আল্লাহরই কর্তৃত্বের জন্যে পাক-পবিত্র রাখা প্রয়োজন এবং কালেমায়ে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’র বাণী ব্যতীত দুনিয়ার বুক পবিত্র হতে পারে না। মানুষ একমাত্র আল্লাহরই দাস এবং একমাত্র কালেমায়ে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র প্রভাবেই সে আল্লাহর অনুগত বান্দা হিসেবে জীবন যাপন করতে পারে। আরবী ছিল তাদের মাতৃভাষা। তাই তারা পরিস্কারভাবেই বুঝতে পেরেছিল যে, এ বাণীর অর্থ হচ্ছে ‘আল্লাহ ছাড়া কোন সার্বভৌম শক্তি নেই, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো আইন রচনা করার অধিকার নেই এবং মানুষের উপর মানুষের কোন কর্তৃত্ব বা প্রভুত্ব থাকতে পারে না।’ কেননা, সকল কর্তৃত্বের একমাত্র মালিক হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। ইসলাম ঘোষণা করেছে যে, মানুষের ঐক্যের ভিত্তি হবে ঈমান। আর ঈমানের মাপকাঠিতে আরব, রোমক ও পারসীয়ান সকলেই সমান। এ জন্যেই কালেমার বাণীকে ভিত্তি করে দ্বীনের দাওয়াত শুরু করা হয়েছিল।
অর্থনৈতিক বিপ্লব ও দ্বীনের বাণী
রাসূলুল্লাহ (সা)—এর নবুওয়াত প্রাপ্তির সময় আরব দেশে সুষম সম্পদ বন্টনের কোন উপায় ছিল না। তাই সে দেশে সুবিচারও ছিল অনুপস্থিত। স্বল্প সংখ্যক লোক সকল সম্পদ ও ব্যবসা বানিজ্য কুক্ষিগত করে সুদী কারবারের মাধ্যমে তা বাড়িয়ে চলছিল। বিপুল সংখ্যক দেশবাসী দরিদ্র ও ক্ষুধার্ত ছিল।
ধনী ব্যক্তিদেরকেই সম্ভ্রান্ত ও শ্রেষ্ঠ বিবেচনা করা হতো এবং সাধারণ মানুষ শুধু ধন-সম্পদ থেকেই বঞ্চিত ছিল না, উপরন্তু তাদের মানবীয় মর্যাদাই সে সমাজে স্বীকৃত ছিল না।
এটাও বলা যেতে পারে যে, হযরত মুহাম্মাদ(সা) সমাজের সম্পদশালী ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে একটি সামাজিক বিপ্লবের আন্দোলন পরিচালনা করে ধনীদের সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে দরিদ্রদের মধ্যে বন্টন করে দিতে পারতেন।
এটাও সকলেই স্বীকার করবেন যে, রাসূলুল্লাহ(সা)- এ জাতীয় আন্দোলন শুরু করলে আরব সমাজ দু’ভাগে বিভ্ক্ত হয়ে যেতো এবং বিপুল সংখ্যক দরিদ্র জনগণ ঐ আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করতো। কারণ, তারা গুটিকয়েক ধনবান, সম্ভ্রন্ত ও শক্তিশালী ব্যক্তির অত্যাচারে জর্জরিত ছিল। পক্ষান্তরে তাওহীদের বাণী প্রচারের ফলে সাসূলুল্লাহ (সা)—কে পদে পদে বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয় এবং এরই ফলে সমাজের খুব কম সংখ্যক মহৎ হৃদয় ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউই এ আহবানে সাড়া দেয়নি।
এটাও স্বীকার করতে হয় যে, সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকদের স্বমতে আনার পর তাদের নেতা হিসেবে হযরত মুহাম্মাদ (সা) মুষ্টিমেয় ধনীদের বিপুল সম্পদ হস্তগত করে নিতে পারতেন এবং নিজের প্রভাব ও প্রতিপত্তি খাটিয়ে তিনি নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে সমাজের লোকদের তাওহীদের প্রতিও বিশ্বাসী করে তুলতে পারতেন। রাসূলুল্লাহ (সা)—এর কর্তৃত্ব মেনে নেয়ার পর তাঁরই আদেশ-উপদেশ মুতাবিক আল্লাহ তাআলার একত্ব স্বীকার করে নিতে তারা কোনই আপত্তি উত্থাপন করতো না।
কিন্তু সর্বজ্ঞ ও নির্ভুল জ্ঞানের অধিকারী আল্লাহ তাআলা তাঁরই প্রিয় নবীকে এ পথেও পরিচালিত করেননি।
আল্লাহ তাআলাই ভাল জানেন যে, এটা সঠিক পথ নয়। তিনি জানেন যে, একমাত্র আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের মাধ্যমেই সত্যিকার সামাজিক সুবিচার আসতে পারে। গোটা সমাজকে আল্লাহ প্রদত্ত ইনসাফপূর্ণ বন্টননীতি মেনে নেয়ার জন্যে প্রস্তুত হতে হবে। সমাজের ছোট-বড়, দাতা-গ্রহীতা সকলকেই নিসন্দেহে বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহর বিধান মেনে তারা শুধু কল্যাণ লাভ করবে না, উপরন্তু আখেরাতেও পুরস্কৃত হবে। সমাজের কিছু লোক সম্পদের লোভে উন্মাদ হয়ে উঠে এবং বিপুল জনতা বিক্ষদ্ধ হয়ে জীবন যাপন করতে বাধ্য হওয়া কখনো বাঞ্ছনীয় নয়। আল্লাহর কর্তৃত্ব অস্বীকার করে যে সমাজ স্থাপিত হয় তাতে প্রতিটি বিষয়ে অস্ত্রের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ভয় ও সন্ত্রাস যে সমাজের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, সে সমাজের অধিকাংশ জনগণ ভগ্নহৃদয় ও উৎসাহ উদ্দীপনাহীন হয়ে মরার মত জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়।
নৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে আন্দোলনের সূচনা
রাসূলুল্লাহ (সা) যে যুগে তাঁর দাওয়াতী কাজ শুরু করেন, সে যুগে আরব দেশ নৈতিকতার দৃষ্টকোণ থেকে নিম্নতম স্তরে পৌছে গিয়েছিল। প্রাচীন যুগের কতিপয় গোত্রীয় প্রথা ব্যতীত সে সমাজ আর কোন নৈতিক বিধানই ছিল না।
অত্যাচার নির্যাতন ছিল ঐ সমাজের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বিখ্যাত কবি জুহাইর ইবনে আবী সালমা বর্ণনা করেছেনঃ
“যে ব্যক্তি সশস্ত্র হয়ে আত্মরক্ষা করবে না, মৃত্যুই তার অনিবার্য পরিণতি।”
“আর যে ব্যক্তি অত্যাচার করবে না, সে অবশ্যই অত্যাচারিত হবে।”
অজ্ঞতার যুগের অপর একটি প্রবাদ বাক্য নিম্নরূপঃ
“অত্যাচারী হোক কিংবা অত্যাচারিত—সকল অবস্থাতেই তোমার ভাইয়ের সাহায্য কর।”
মদপান ও জুয়া সামজিক প্রথার মধ্যে শামিল ছিল এবং এসব অভ্যাস নিয়ে মানুষ গর্ব করতো। সে যুগের সকল কবিতাই মদ ও জুয়াকেই কেন্দ্র করে রচিত হতো।
সে সমাজের সকল জায়গায় বিভিন্ন ধরনের ব্যভিচার প্রচিলত ছিল এবং প্রাচীন ও সমসাময়িক উভয় ধরনের অজ্ঞতায় নিমগ্ন লোকদের নিয়ম মুতাবেক গর্ববোধ করতো। হযরত আয়েশা (রা) নিম্নোক্ত ভাষায় তৎকালীন সমাজের বর্ণনা দিয়েছেনঃ
“জাহেলিয়াতের যুগে চার ধরনের বিয়ে প্রচলিত ছিল। এক ধরনের বিয়ে ছিল আজকের প্রচলিত বিয়ের মতই। অর্থাৎ বিবাহেচ্ছুক ব্যক্তি পাত্রীর পিতা বা তার অভিভাবকের নিকট বিয়ের প্রস্তাব পেশ করতো এবং তাকে এ উপলক্ষে কিছু উপহার প্রদান করতো। দ্বিতীয় একটি পদ্ধতি এরূপ ছিল যে, কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে বলতো, সে যেন দু’টি মাসিক ঋতুর মধ্যবর্তী সময় নিদিষ্ট একজন পর পুরুষের সাথে সহবাসের মাধ্যমে গর্ভ ধারণ করে। সে সময় স্বামী তার স্ত্রীকে ছোঁয়া থেকে বিরত থাকতো এবং স্ত্রীর গর্ভ লক্ষণ প্রকাশ হবার আগে সে স্ত্রীর সাথে কোন যৌনসম্পর্ক স্থাপন করতো না। গর্ভ লক্ষণ প্রকাশ হবার পর স্বামী নিজের ইচ্ছানুসারে স্ত্রী সহবাস করতো। এ পদ্ধতি গ্রহণ করার উদ্দেশ্য ছিল উচ্চবংশ থেকে সন্তান সংগ্রহ করা। তৃতীয় পদ্ধতিটি ছিল বহু স্বামী প্রথা (Polyandry) অর্থাৎ অনধিক দশ ব্যক্তির একটি দল একজন স্ত্রীলোকের সাথে সহবাস করতো। স্ত্রীলোকটি গর্ভসঞ্চার ও সন্তান জন্মানোর কয়েকদিন পর সে সহবাসকারী ব্যক্তিদের ডেকে জড়ো করতো। এ আহবান প্রত্যাখ্যান করার করো অধিকার ছিল না। সকলে সমবেত হলে স্ত্রীলোকটি বলতো— তোমরা তো ফলাফল জানতেই পেরেছ। আমি একটি সন্তান প্রসব করেছি। তারপর সে উপস্থিত লোকদের মধ্যে থেকে একজনকে চিহ্ণিত করে ঘোষণা করতো এ ব্যক্তি-ই এ সন্তানের পিতা। তারপর চিহ্ণিত ব্যক্তির নামানুসারে শিশুটির নামকরণ করা হতো এবং ঐ শিশু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বলেই পরগণিত হতো। শিশুটির দায়িত্ব গ্রহণে অস্বীকার করার কোন অধিকার সে ব্যক্তির থাকতো না।”
চতুর্থ পদ্ধতিটি ছিল এরূপ যে, “অনেক লোক একই স্ত্রীলোকের নিকট যেতো এবং স্ত্রীলোকটি সবাইকেই গ্রহণ করতো। প্রকৃতপক্ষে এরা ছিল বেশ্যা। এদের ঘরের দরজায় একটি বিশেষ ধরনের পতাকা থাকতো। যে কোন ব্যক্তি ইচ্ছা করলেই ওদের সাথে সহবাস করতে পারতো। ঐ জাতীয় স্ত্রীলোক গর্ভবতী হবার পর যখন সন্তান জন্ম দিত, তখন বহুলোক সমাবেত হয়ে বিশেষজ্ঞ মারফত সন্তানের আকার আকৃতি থেকে শিশুর পিতৃত্ব নিরূপন করতো। সমবেত লোকেরা যাকে এ সন্তানের পিতা বলে ঘোষণা করতো সে-ই ঐ সন্তানের দায়িত্ব গ্রহণ করতে বাধ্য হতো। এ দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় ছিল না।” (বুখারী বিবাহ অধ্যায় )
হযরত মুহাম্মাদ (সা) চারিত্রিক মানোন্নয়ন, সমাজ শুদ্ধিকরণ ও আত্মশুদ্ধির কর্মসূচী নিয়ে নৈতিক সংস্কারের একটি আন্দোলনও শুরু করতে পারতেন। প্রত্যেক সমাজ সংস্কারকের মত তাঁর ঐ সমাজের সংশোধনকামী কতিপয় সাহসী ও কর্মতৎপর ব্যক্তির সহযোগিতা লাভ করা অসম্ভব ছিল না।
সহজেই বলা যেতে পারে, এ ধরনের আন্দোলন শুরু করলে আল্লাহর রাসূল (সা) বেশ কিছু লোক জমাতে পারতেন। এ লোকগুলো উন্নত নৈতিক মানের দরুন সহজেই তাওহীদের বাণী গ্রহণ ও পরবর্তী দায়িত্ব পালনের জন্যে প্রস্তুত হতো এবং এ উপায়ে কাজ করলে কালেমায়ে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ র বাণী ততটা তীব্র বিরোধীতার মুকাবিলা করতো না।
কিন্তু সর্বজ্ঞ আল্লাহ ভালভাবেই জানতেন যে, এটা সঠিক পথ নয়। তিনি জানতেন যে একমাত্র ঈমানের ভিত্তিতেই নৈতিকতা গঠিত হয়। ঈমানই ভালমন্দের মানদণ্ডের উৎসমূল স্বরূপ এক উচ্চতর কর্তৃত্বের সন্ধান বাতলে দেয়। ঐ কর্তৃত্ব এ মূল্যবোধ গ্রহণ করার পুরস্কার ও বর্জন করার শাস্তি নিরূপণ করেন। এ কর্তৃত্বের সন্ধান জানা না থাকলে সব মূল্যবোধ এবং নৈতিক মানদণ্ডই অস্থায়ী প্রমাণিত হয়— কোন কর্তৃপক্ষের নিকট জবাবদিহির অনুভূতি অথবা ভাল কাজের পুরস্কার প্রাপ্তির আশা ও দু’টির কোন কিছুই থাকে না।
সর্বাত্মক বিপ্লব
কঠোর পরিশ্রমের পর ঈমান যখন সুদৃঢ় হলো, যে মনিবের প্রতি ঈমান আনা হয়েছিলো, বাস্তব কার্যকলাপের ভিতর দিয়ে যখন তাঁর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ পেল; মানুষ যখণ তাদের সত্যিকার স্রষ্টা— মনিব ও প্রতি পালককে চিনতে পেরে একমাত্র তাঁরই স্তবস্তুতি করতে শুরু করলো, যখন তারা সকল বিষয়ে অন্যের এমন কি নিজের কামনা-বাসনার প্রভাব থেকে মুক্তি লাভ করল; আর যখন কালেমায়ে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তাদের অন্তরে খোদিত হয়ে গেল, তখনই আল্লাহ তাআলা তাদের সকল বিষয়ে সাহায্য দান করলেন। আল্লাহর যমীন রোম ও পারস্যের অধীনতা থেকে মুক্ত হলো কিন্তু এ মুক্তি অনারবদের প্রভুত্বের স্থলে আরবদের প্রভুত্ব প্রতিষ্টার জন্য নয়, বরং আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যে। রোমান, পারসীয়ান, আরব ইত্যাদি সকল আল্লাহদ্রোহী শক্তির উচ্ছেদ সাধনই ছিল এ বিপ্লবের লক্ষ্য।
ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ফলে সকল প্রকার যুলুম-নির্যাতনের অবসান ঘটে। আল্লাহ তাআলার নির্ধারিত মানদণ্ডে ওযন করে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। আল্লাহর নামেই ন্যায় বিচারের ঝাণ্ডা উঁচু করা হয়। সে ঝাণ্ডাটিই ইসলাম নামে পরিচিত। এ ঝাণ্ডায় “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” ব্যতীত আর কোন কিছুই লেখা হয়নি।
চরিত্র উন্নত হলো, হৃদয় ও মন বিশুদ্ধ হলো এবং এর ফলে কিছুসংখ্যক ঘটনা বাদে কোথাও আল্লাহ তাআলার নির্ধারিত চরম দণ্ড দানের প্রয়োজন দেখা দিল না। কারণ, ঐ সময়ে মানুষের বিবেক নিজে নিজেই আইন মেনে চলতে উৎসাহী হয়ে ওঠে। পুলিশ ও আদালতের পরিবর্তে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, তাঁর কাছ থেকে পুরস্কার প্রাপ্তির আশা এবং তাঁর ক্রোধভাজন হওয়ার ভীতি মানুষের অন্তরে স্থান লাভ করে।
মানব গোষ্ঠী এক কলুষ মুক্ত সমাজ ব্যবস্থার নৈতিক মান ও জীবনের অন্যান্য মূল্যবোধের ক্ষেত্রে সমুচ্চ দিগন্তে উন্নত হয়।
ইতিপূর্বে মাববগোষ্ঠী কখনোও এত উচ্চ পর্যায়ের জীবনযাত্রা লাভ করেনি এবং পরবর্তীকালে ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে ঐ পর্যায়ের উন্নতি সম্ভব হয়নি।
বিপ্লব কি করে এল?
এটা এ জন্যে সম্ভব হয়েছিল যে, যারা ইসলামকে একটা জীবন বিধান, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এবং আইন কানুনের একটি ধারা হিসাবে প্রবর্তন করেছিলেন তাঁরা সর্বপ্রথমে ঈমান, চরিত্র, ইবাদাত এবং পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষার রীতি পদ্ধতির ভিতর দিয়ে এ ব্যবস্থাকে নিজেদের অন্তরে প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছিলেন। এ ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে যারা সংগ্রাম করেছিলেন তাদের সাথে যুদ্ধ জয়, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অথবা তাদেরই হাতে দ্বীনের প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কোন পার্থিব সুবিধারই ওয়াদা করা হয়নি। তাদের মাত্র একটি পুরস্কারেরই নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল। আর সে পুরস্কারটি হচ্ছে জান্নাত। ‘আল্লাহ
ছাড়া কোন মনিব নেই’ —এ বাণীর বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠা কায়েমী স্বার্থবাদী জাহেলিয়াতের ধ্বজাধারীগণের প্রবল বিরোধিতার মুখে ঈমানদারগণ যে অটল ধৈর্য ও অসীম সহিষ্ণুতার সাথে সংগ্রাম জারী রেখেছিলেন, তার বিনিময়ে তাদের প্রতি মাত্র ঐ একটি পুরস্কারেরই ওয়াদা করা হয়েছিল।
আল্লাহ তাদের পরীক্ষায় ছেড়ে দেন। তাঁরা দৃঢ়তার প্রমাণ পেশ করেন এবং ব্যক্তিগত সুখ-সম্ভোগ ভুলে যান। আল্লাহ দেখতে পেলেন যে, তাঁরা পার্থিব সুযোগ-সুবিধার জন্যে লালায়িত নন। তাঁরা নিজেদের জীবদ্দশায় এ বাণীর বিজয় ও প্রতিষ্ঠা দেখার সীমাবদ্ধ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছেন না। তাঁদের অন্তর বংশগত কৌলিণ্য, জাতীয়তা, দেশ ও গোত্রীয় অহংকার থেকে যখন মুক্ত হলো এবং আল্লাহ তাআলার বিচারে তারা পবিত্র হৃদয় বলে বিবেচিত হলেন, তখনই তিনি তাদের হাতে এক অতি-পবিত্র আমানত অর্থাৎ খেলাফতের দায়িত্ব অর্পন করলেন। তাঁরা ছলেন স্বচ্ছ (খালেস) ঈমানের অধিকারী। আর খেলাফতের দায়িত্ব পালনের জন্যে প্রাথমিক প্রয়োজন ছিল এ বস্তুটির। কারণ, আল্লাহ তাআলার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে অন্তর ও বিবেক এবং নৈতিক চাল-চালন, লেন-দেন ও উঠা-বসার জন্যে গৃহীত কর্মপন্থায়। আল্লাহ তাআলা নিশ্চিত হলেন, যে, আল্লাহর আইন-কানুন ও রীতিনীতি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের পর তাঁরা ঠিকঠিক ভাবে এ ব্যবস্থার রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। তিনি প্রমাণ পেলেন যে, তাঁরা রাজনৈতিক ক্ষমতাকে নিজেদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, গোত্রীয় অথবা জাতীয় স্বার্থে ব্যবহার করবে না, বরং আল্লাহ কাছ থেকে আমানত স্বরূপ পাওয়া এ ব্যবস্থাকে তারা আল্লাহরই সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে তাঁরই কর্তৃত্বের অধীনে ঠিক ঠিকভাবে প্রয়োগ করবেন। সত্যিকার অর্থে তাঁরা নিজেদেরকে সত্যের পতাকাবাহী হিসেবে তৈরী করে নিয়েছিলেন।
যদি তাওহীদের বাণী থেকে ইসলামী দাওয়াতের সূচানা না হতো এবং যদি আপাত দৃষ্টিতে কষ্টকর ও বিপদাপদপূর্ণ পথ ধরে আন্দোলনের কাফেলা অগ্রসর না হতো, তাহলে এ মহান জীবনাদর্শ কখনো বাস্তব জগতে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারতো না। জাতীয় স্বার্থ, জীবন যাত্রার মানোন্নয়ন অথবা সমাজ সংস্কারের নামে আন্দোলনের সূচনা হলে এবং কালেমা লাইলাহা ইল্লাল্লাহর সাথে অন্য কোন শ্লোগান মিশ্রিত হলে, এ বাঞ্ছিত জীবন বিধান কখনো বাস্তবে রূপ লাভ করতে পারতো না।
পবিত্র কুরআনের মক্কীঅ স্তর এ গৌরবময় কাজ সম্পাদন করেছে যে, মানুষের মন-মগযে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন মনিব না থাকার বিশ্বাস বদ্ধমূল করে দিয়েছে এবং মুসলমানদের এমন পথ ধরে দৃঢ় পদে অগ্রসর হতে উদ্বুদ্ধ করেছে যা বাহ্যত অত্যন্ত কঠিন মনে হয়।
সে যুগে কুরআনের যে অংশ অবর্তীর্ণ হয়েছে সে অংশে শুধুমাত্র ঈমান মযবুত করার প্রতিই গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।ঈমানের ভিত্তিতে যে জীবন বিধাণ রচিত হবে, তার বিস্তারিত বিবরণ দেয়া তখন মূলতবী রাখা হয়। দ্বীনের দাওয়াতী কাজ করতে যারা ইচ্ছুক, তাদের এ বিষয় লক্ষ্য রাখা খুবই প্রয়োজন। বস্তুত, ইসলামী জীবন বিধান এ পদ্ধতিই দাবী করে। কেননা, এ দ্বীন সম্পূর্ণরূপেই তাওহীদের প্রতি গভীর বিশ্বাসের ভিত্তিতে রচিত এবং জীবন যাপনের জন্যে প্রয়োজনীয় সকল বিধান ও আইন-কানুন সে মহান বিশ্বাস থেকেই গৃহীত হয়। এ দ্বীনকে একটি বিশাল বৃক্ষের সাথে তুলনা করা যায়। একটি বিরাট সুউচ্চ বৃক্ষ বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে শাখা প্রশাখা বিস্তার করে এবং তার মাথা আকাশের দিকে উন্নত থাকে। এত বড় বৃক্ষ স্বাভাবিকভাবেই মাটির গভীরে তার শিকড় প্রোথিত করবে এবং তার আকৃতি অনুসারে চারিদিকে বিস্তীর্ণ এলাকায় ঐ শিকড় ছড়িয়ে দেবে। এ দ্বীনের অবস্থাও হুবহু-তাই। এ জীবন বিধান মানব জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট ছোট বড় সকল বিষয়েই তার অনুশাসন রয়েছে। এ ব্যবস্থা শুধু ইহকালের বিধান দান করে না বরং পরকালের জন্যেও বিধান দিয়ে থাকে। দৃশ্য ও অদৃশ্য উভয় জগতের রহস্যই উদঘাটন করে দেয়। এটা শুধু বস্তুজগত নিয়েই পরিতৃপ্ত থাকে না বরং চিন্তা ভাবনারও সংশোধন করে। এভাবেই এটা একটা দীর্ঘ, সুদৃঢ় ও বিশাল বৃক্ষের ন্যায় এবং এর শিকড়গুলো বৃক্ষের আকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করেই মাটির গভীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।
ইসলামী জীবন বিধানের এ বিশেষ অংশটি থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, অন্তরে ঈমানের বীজ বপন করার ভিতর দিয়েই আদর্শের আন্দোলন ও প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর। সঠিক উন্নয়নের জন্য এ পন্থা অত্যন্ত জরুরী। কেননা, এরই মাধ্যমে সুউচ্চ আকাশ বিস্তৃত ইসলামী বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা সাথে মাটির গভীর অভ্যন্তরে ইতস্তত ছড়ানো শিজড়গুলোর যোগসূত্র রক্ষা করা সম্ভব।
“লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্” র প্রতি বিশ্বাস অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে গেলে জীবনের সর্বক্ষেত্রে তা বিস্তার লাভ করে এবং এটাই হয়ে দাঁড়ায় কালেমার বাস্তব ব্যাখ্যা। এভাবে মু’মীনগণ আইন প্রবর্তনের আগেই ইসলামী ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য মনের দিক থেকে প্রস্তুত থাকে এবং আইন প্রবর্তনের সাথে সাথেই ঈমানের প্রথম দাবী এবং এ মনোভাবের দরুনই বিশ্বাসীগণ আগ্রহ ও আনন্দ সহকারে ইসলামের সকল আইন-কানুন মেনে নেয়।
তাই আদেশ জারি হবার সাথে সাথে তার শির অবনত করে দেয়। আইন বাস্তবায়নের জন্যে তাদের শুধু আদেশ শোনাই যথেষ্ট। এ পথেই জাহেলী যুগের সকল অভ্যাস ও স্বভাব পরিত্যাগ করেন। কুরআন এর কয়েকটি আয়াত অথবা আল্লাহর নবীর মুখনিসৃত কয়েকটি বাক্যই সে বিপুল পরিবর্তন সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়। বর্তমান যুগের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর আইন প্রবর্তন পদ্ধতির সাথে ইসলামের উল্লিখিত তুলনা করে দেখুন। প্রতিটি স্তরেই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোকে আইন পরিয়দ, শাসনতন্ত্র,পুলিশ, সামরিক শক্তি, প্রচারযন্ত্র ও প্রেসের উপর নির্ভর করতে হয়। তবু তারা শুধু প্রকাশ্যে আইন লংঘনের ব্যপারটিকে আংশিকভাবে দমন করতে সক্ষম হয়। ফলে, বেআইনী ও নিষিদ্ধ কার্যকলাপে সমাজ পরিপূর্ণই থেকে যায়।
বাস্তবধর্মী জীবন বিধান
এ জীবন বিধানের অপর একটি দিকও লক্ষণীয়। বরং তা হচ্ছে একটি বাস্তবমুখী জীবন বিধান। ইসলাম একটি বাস্তবধর্মী জীবন বিধান। মানব জীবনের বাস্তব বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণই এর উদ্দেশ্য। তাই মানব সমাজের প্রচলিত বিষয়াদি পর্যালোচনা করে সেগুলো বহাল রাখা, সংশোধন অথবা সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করা সম্পর্কে সে রায় প্রদান করে। তাই যে সমাজ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নিয়েছে সে সমাজে ঐ সময়ে বিরাজমান পরিস্থিতি বিবেচনার পরই ইসলাম আইন প্রণয়ন করে।
ইসলাম নিছক ধ্যান-ধারণা ভিত্তিক কতগুলো সূত্র সমষ্টই নয়। তাই এ জীবন বিধান প্রবর্তনের আগে একটি মুসলিম সমাজ গড়ে উঠা অপরিহার্য। এ সমাজ বিশ্বাস করবে যে, আল্লাহ ছাড়া কারো আনুগত্য করা যেতে পারে না। এরূপ ঈমান-আকীদার অধিকারী সমাজ আল্লাহ ব্যতীত অপর সকলের কতৃত্ব ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা অস্বীকার করতে বাধ্য।
এ ধরনের একটি সমাজ জন্ম নেয়ার পর যখন বাস্তব কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং আইন ও বিধান প্রণয়নের জন্য একটি বিশেষ পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে, তখনই ইসলাম সংবিধান রচনা, আইন-কানুন প্রণয়ন ও রীতিনীতি প্রবর্তন করে। ইসলামী বিধান শুধু সে সমাজেরই উপর প্রযোজ্য যারা নীতিগতভাবে এ আইনের কর্তৃত্ব মেনে নিয়েছে এবং অনৈসলামিক আইন-কানুনকে বাতিল করেছে।
আদর্শ বাস্তবায়নে ক্ষমতার প্রয়োজনীয়তা
এ মতবাদে যারা বিশ্বাসী তাদের নিজেদের সমাজে ইসলামী জীবন বিধান প্রবর্তন ও ইসলামী আইন জারি করার ক্ষমতা থাকা দরকার। দৈনন্দিন জীবনে যেসব নিত্য-নৈমিত্তিক সমস্যাদি দেখা দেয় সেগুলোর সমাধান কল্পেও তাদের আইন রচনা করার ক্ষমতা থাকা অত্যন্ত জরুরী।
মক্কায় মুসলমানগণ নিজেদের জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রাপ্ত ছিলেন না। ঐ সমাজে তাদের কোন প্রভাবও ছিল না। আল্লাহর আইন মুতাবিক জীবন-যাপন করার উপযোগী কোন স্থায়ী সংগঠনের আকারে তখনও তারা নিজেদের গড়ে তুলতে পারেনি। সে জন্য মক্কী জীবনে মুসলমানদের উপর আল্লাহ তাআলা তাদের সমষ্টিগত উপযোগী কোন বিধান নাযিল করেননি। সে স্তরে তাদের শুধু ঈমান ও ঈমানের সাথে সংশ্লিষ্ট নৈতিক মূল-সুত্রগুলো শেখানো হয়েছিল। পরবর্তীকালে মদীনায় একটি স্বায়ত্বশাসিত রাষ্ট্র স্থাপিত হবার পর মুসলমান সমাজের প্রয়োজন পূরণ করার উপযোগী একটি পরিবেশ গড়ে উঠে এবং আইন-কানুন প্রবর্তনের ক্ষমতা হস্তগত হয়। এ অবস্থা সৃষ্টি হবার পরই মুসলমানদের উপর সাধারণ আইন-কানুন নাযিল হতে শুরু করে।
মক্কীস্তরে আল্লাহ তাআলা সকলণ আইন-কানুন নাযিল করে মদীনায় স্থানান্তরের পর বাস্তবায়নযোগ্য পূর্ণাঙ্গ একটি জীবন বিধান দান করেননি। কারণ, তা ইসলামী আদর্শের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ইসলাম আরও অধিক বাস্তবধর্মী এবং অনেক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। এ আদর্শ কাল্পনিক সমস্যার সমাধানে এগিয়ে যায় না। সে প্রথমে সমাজের বিরাজমান অবস্থা পর্যালোচনা করে এবং যদি তার মানদণ্ড মুতাবিক সমাজের অবস্থা ও পারিপার্শ্বিকতা একটি মুসলমান সমাজের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও আল্লাহর বিধানের নিকট পরিপূর্ণ আত্মসমর্পিত হয়, তাহলে ইসলামী জীবনাদর্শ ঐ সমাজের চাহিদা ও অবস্থার সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা করে।
বর্তমানে দুনিয়ার কোন একটি সমাজেও মানব রচিত বিধানের পরিবর্তে আল্লাহর শরীয়াত প্রতিষ্ঠিত দেখা যায় না এবং এ জাতীয় দায়িত্ব পালনের উপযোগী কোন রাজনৈতিক শক্তিও নেই। এ অবস্থা স্বচক্ষে দেখার পরও যারা ইসলামী আদর্শের বাস্তবরূপ ও উক্ত আদর্শ মুতাবিক একটি পূর্ণাঙ্গ শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও আইন রচনার দাবী জানায় তারা ইসলামী জীবন আদর্শের বৈশিষ্ট, প্রকৃতি ও ঐতিহ্য পরিবর্তন করে মানব রচিত অপূর্ণ জীবন বিধানের সংঘর্ষে তাদের মনে যে, পরাজয়ের মনোবৃত্তি জন্মেছে,তারই প্রভাবে তারা সংক্ষিপ্ত পথে লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। তারা ইসলামী জীবন বিধানকেও কতগুলো অবাস্তব নীতি ও নাম স্বর্বস্ব গুণাবলী সমষ্টি হিসাবে দেখতে চায়। কিন্তু অতীতে যে পদ্ধতি অবলন্বন করে ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো আল্লাহ তাআলা ঠিক সে পদ্ধতিতেই এর পুনঃ প্রতিষ্ঠা চান। প্রথমত একটি বিশেষ বিষয়ের প্রতি অটল ঈমান মানুষের মন-মগযে গভীরভাবে বদ্ধমূল হতে হবে। আর ঈমানের বিষয়টি হচ্ছে এই যে, মানুষ আল্লাহ ছাড়া আর কোন শক্তির নিকট মাথা নত করবে না এবং অন্য কোন কর্তৃপক্ষের আইন-বিধান প্রহণ করতে রাযী হবে না। এ আকীদা-বিশ্বাস মুতাবিক গড়ে উঠা মন-মগযের অধিকারী একদল লোক যখন পরিপূর্ণরূপে প্রস্তত হয়ে কোন সমাজের বাস্তব নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা লাভ করে, তখনই শুধু ঐ সমাজের প্রয়োজন অনুসারে মূল আকীদা-বিশ্বাস বহাল রেখে আইন প্রণয়ন সম্ভবপর হবে। আল্লাহ তাআলা ইসলামী জীবন বিধান বাস্তবায়নের জন্যে এ পদ্ধতি নির্ধারণ করেছেন। আর তিনি যা নিধারণ করেছেন তা লংঘন করে অন্য কোন পদ্ধতিই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
দ্বীন প্রতিষ্ঠার সঠিক উপায়
ইসলামী জীবন বিধানের প্রতি আহবানকারীদের জেনে রাখা উচিত যে, তারা মানুষকে সর্বপ্রথম ইসলামের মৌলিক আকীদ-বিশ্বাস প্রতি পরিপূর্ণ ঈমান আনয়নের জন্যে আমন্ত্রণ জানাবেন। যদিও তারা নিজেদের মুসলমান বলে দাবী করেন এবং যদিও সরকারী রেকর্ড পত্রে তাদের মুসলমান বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে, তবু ইসলামী বিধানের আহবায়কগণ প্রথমে মানুষকে বুঝিয়ে দেবেন যে, ইসলামের অর্থ হচ্ছে কালেমায়ে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কে তার সঠিক তাৎপর্যসহ গ্রহণ করা। কালেমার সঠিক তাৎপর্য হচ্ছে নিজের জীবনে সকল দিক ও বিভাগে আল্লাহ তাআলার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেয়া এবং যারা আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বিপরীত নিজেদের সার্বভৌমত্ব দাবী করে তাদের কর্তৃত্ব অস্বীকার করা। ইসলামী আতীদা-বিশ্বাসের উপরোক্ত তাৎপর্য গ্রহণ করার পর নিজেদের মন-মস্তিষ্ক, জীবনযাত্রা এবং চাল-চলনে এ বিশ্বাসের প্রতিফলন অপরিহার্য।
ইসলামী জীবন বিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন যারাই শুরু করুক না কেন তাদের এ বিষয়টিকে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। ইসলামের সর্বপ্রথম আন্দোলন এভাবেই শুরু করা হয়েছিল। কুরআন নাযিলের মক্কী স্তরে তের বছরকাল যাবত এ বিষয়টিকে দৃঢ়মূল করার কাজেই ব্যয়িত হয়েছিল। যারা ইসলামী আন্দোলনের উপরোক্ত তাৎপর্য উপলব্ধি করার পর আন্দোলেন যোগদান করে শুধু তাদের সমষ্টিকেই সত্যিকার ইসলমী সংগঠন বা ইসলামী সমাজ আখ্যা দেয়া যেতে পারে এবং একমাত্র ঐ জামায়াত বা সমাজই সমষ্টিগত জীবনে ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়িত যোগ্য। কারণ, তারা স্বেচ্ছায় তাদের পরিপূর্ণ জীবনের উপর ইসলামী আদর্শকে রূপায়িত করার এবং এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অন্য কারো সার্বভৌমত্ব গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এভাবে যখন উপরোক্ত ধরনের একটি সমাজ জন্ম লাভ করবে এবং ইসলামী শিক্ষাই সে সমাজের ভিত্তি হিসাবে গৃহীত হবে, তখনই সে সমাজ তার পারিপাশ্বিক প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামী বিধান প্রণয়ন করতে অগ্রসর হবে। ইসলামী জীবনাদর্শ প্রবর্তনের এটাই হচ্ছে বাস্তবধর্মী এবং বিজ্ঞজনোচিত কর্মপন্থা।
ইসলামী জীবনাদর্শের বৈশিষ্ট্য যারা উপলব্ধি করতে পারেননি, সেরূপ এক শ্রেণীর নিষ্ঠাবান লোক এ ব্যাপারে তাড়াহুড়া করেন। তারা বুঝেন না যে, সর্বজ্ঞ ও মহাজ্ঞানী আল্লাহ তাআলা দ্বীন প্রতিষ্ঠার যে পদ্ধতি নিদিষ্ট করে দিয়েছেন, তার মধ্যে প্রকৃত কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তাঁরা মনে করেন যে, ইসলামী আদর্শের মৌলিক নীতি ও আইন-বিধান সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করার সাথে সাথেই তাঁরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্যে অগ্রসর হবেন। প্রকৃতপক্ষে এটা তাড়াহুড়া করে কিছু করে ফেলার মনোভাব সম্পন্ন লোকদের কাল্পনিক ধারণা।
এ ধরনের ধারণা যদি রাসূল করীম (সা)-কে দেয়া হতো এবং তিনি যদি ভৌগলিক জাতীয়তা, অর্থনৈতিক বিপ্লব অথবা সংস্কারবাদী আন্দোলনের প্রতি জনগণকে আহবান করতেন তাহলে তাঁর কাজ অনেক সহক হয়ে যেতো। কিন্তু তিনি সে পথ গ্রহণ করেননি। ইসলামী জীবনাদর্শের বিস্তারিত আইন-কানুন সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করে তাদেরকে এ দিকে আকৃষ্ট করার আগে তাদের অন্তরে আল্লাহর প্রতি গভীর ঈমান আনয়ন ও অপরাপর সকল বিধান বাতিল করে দিয়ে আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের প্রতি পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করা অত্যন্ত জরুরী। আল্লাহর নিকট পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ ও অন্যান্য মানবীয় দাসত্ব গ্রহণ অস্বীকৃতির ফল স্বরূপই আল্লাহর শরীয়াতের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হবে, অন্যান্য বিধানের তুলনায় আল্লাহর বিধানের শ্রেষ্ঠত্ব বিবেচনা করে নয়। অবশ্য এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, আল্লাহ প্রদত্ত বিধান মানব রচিত বিধানের তুলনায় সর্বেতোভাবে শ্রেষ্ঠ। কারণ, এ বিধান স্বয়ং স্রষ্টার রচিত এবং স্রষ্টা ও সৃষ্টির রচিত বিধান কখনও সমপর্যায়ে আসতেই পারে না। কিন্তু বিধানের শ্রেষ্ঠত্ব ইসলামী আন্দোলনের ভিত্তি হতে পারে না। এর ভিত্তি হচ্ছে বিনা দ্বিধায় শরীয়াতে ইলাহীকে গ্রহণ ও শরীয়াত বহির্ভূত সকল ধরনের বিধানকে সরাসরি বর্জন। এটাই ইসলমামের তাৎপর্য এবং এ ছাড়া অন্য কিছুই ইসলাম নয়। ইসলামের মূল ভিত্তির প্রতি যে আকৃষ্ট হবে তাকে একটি করে ইসলাম ও অন্যান্য বিধানের বিস্তারিত পার্থক্য বুঝানোর কোন প্রয়োজনই হবে না। ঈমানের মূলকথা এটাই।
জাহেলিয়াতের মুকাবিলায় ইসলাম
তের বছরের মক্কী জীবনে কুরআন কিভাবে ঈমান-আকীদা গড়ে তুলেছিল এবার সে বিষয়ে আলোচনা করা যাক। ঈমান –আকীদার বিষয়টিকে কুরআন একটি নিছক তত্ত্ব বা আধ্যাত্মিক ধারণা হিসেবে উপস্থাপন করেনি কিংবা বিদ্বান ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের গ্রন্থ রচনার কৌশলও অবলন্বন করেনি। কুরআন সর্বদা মানুষের প্রকৃতির প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করেছে এবং তার নিজের সত্তা ও চারিপার্শ্বে ছড়ানো স্রষ্টার অসংখ্য নিদর্শনাবলীর প্রতি লক্ষ্য করার জন্যে উৎসাহ প্রদান করেছে। কুরআন মানুষের চিন্তাশক্তিকে কুসংস্কার ও গোঁড়ামী থেকে মুক্তি দিয়েছে এবং তার সুপ্ত বুদ্ধিমত্তাকে শাণিত করে তুলেছে। আর এভাবে মানুষের মরচে ধরা বোধশক্তিকে সৃষ্টি রহস্যের সূক্ষ্ম কৌশলগুলো উপলব্ধি করার যোগ্যতা দান করেছে। এটা ছিল কুরআনী শিক্ষার একটি সাধারণ দিক। তার শিক্ষার বৈপ্লবিক দিক হচ্ছে তাওহীদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজের অভ্যন্তরে যাবতীয় জাহেলিয়াত ও নির্যাতনমূলক মতাদর্শের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করা। ভ্রান্ত মতাদর্শের জগদ্দর পাথর যে সময় মানব সমাজকে পিষ্ট করছিল সে সময় নিছক নীতিকথা প্রচার ছিল অর্থহীন। তাই কুরআন দৃঢ়তার সাথে ভ্রান্ত মতাদর্শের পর্দা ছিড়ে ফেলে মিথ্যার প্রাচীর ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়ার উদ্দেশ্যে এক আপোষহীন লড়াই শুরু করে দেয়। পরবর্তীকালে যেসব জ্ঞানগর্ব তত্ত্ব,তর্কবিদ্যা ও যুক্তিশাস্ত্রের অবতারণা করা হয়েছে, সেগুলোর মাধ্যমেও কুরআনী শিক্ষা প্রচারিত হয়নি। কুরআন মানব রচিত গোটা সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই সংগ্রাম শুরু করেছিল। দুর্নীতি ও অন্যায় –অত্যাচারে জর্জরিত মানবতাকে লক্ষ্য করেই কুরআন নিজের বক্তব্য পেশ করে। কারণ, ইসলাম মূলত ঈমানভিত্তিক জীবনাদর্শ হলেও বাস্তব জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করাই তার লক্ষ্য। নিছক নীতিগত আলোচনা ও আধ্যাত্মিক ধ্যান-ধারণা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকার জন্যে কুরআন অবর্তীর্ণ হয়নি।
কুরআন একদিকে ইসলামী জামায়াতের সদস্যবৃন্দের অন্তরে ঈমানের বীজ বপন ও তার ক্রমোন্নয়নে যত্ন নেয় এবং অপর দিকে ঐ সদস্যবৃন্দের দ্বারাই জাহেলিয়াতের দুর্গে আক্রমণ চালায় এবং মুসলমানদের নিজেদের চিন্তাও চাল-চলন থেকে জাহেলিয়াতের প্রভাব সম্পূর্ণরূপে মিটিয়ে দেয়ার অভিযোন পরিচালনা করে। এক চতুর্মূখী রণ বিক্ষুদ্ধ সমাজে ঝড়-তুফানের ভিতর দিয়েই ঈমান শক্তি সঞ্চয় করে। পাণ্ডিত্যপূর্ণ তত্ত্বমূলক আলোচনা ঐরূপ শক্তি সঞ্চয় হতে পারে না। ইসলাম একটি সদা-সক্রিয়, সুসংগঠিত ও জীবন্ত আন্দোলন এবং মুসলিম সমাজ এ আন্দেলনের মূর্ত প্রতীক। আর ইসলামী জামায়াতের চিন্তাধারা, নৈতিক মানদণ্ড ও শিক্ষা-দীক্ষা ঈমানী ভাবধারার সাথে সংগতিশীল হয়ে গড়ে উঠে। ইসলামী আন্দেলনের ক্রমবিকাশ ঈমানের ক্রমোন্নয়নেরই বাস্তবরূপ এবং ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়নের এটাই হল সঠিক পদ্ধতি অর্থাৎ ঈমানী শক্তির মান ও স্তরের সাথে সঙ্গতি রক্ষা করেই ইসলামী আন্দোলন প্রসার ও বিস্তার লাভ করবে।
ইসলাম নিছক মতবাদ নয়
ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের উপরে বর্ণিত বৈপ্লবিক পদ্ধতিটি স্মরণ রাখতে হব। একটু লক্ষ্য করলেই বুঝা যাবে যে, মক্কী স্তরের দীর্ঘ সময়ে উপরোল্লিখিত পদ্ধতিতে ঈমান মযবুত করার ও ইসলামী সমাজ প্রতিষ্টার উপযোগী প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত একটি সংগঠন তৈরী করার কাজ পৃথকভাবে করা হয়নি। বরং একই সাথে ও একই সময়ে ঈমানের বীজ বপন ও ইসলামী শিক্ষার ভিত্তিতে সংগঠন কায়েম করার সূত্রপাত হয়। তাই ভবিষ্যতে যখনই ইসলামী জীবনাদর্শের পুনর্জাগরণের চেষ্টা চালানো হবে তখনই ঐ ব্যাপক পদ্ধতি অবলন্বন ব্যতীত উদ্দেশ্য সিদ্ধি সম্ভবপর হবে না।
ঈমান আকীদা মযবুত করার জন্যে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন এবং এ জন্যেই তা ক্রমে ক্রমে বাঞ্ছিত লক্ষ্যের দিক ধীর হতিতে এগিয়ে যায়। এর প্রতিটি পদক্ষেপই দৃঢ় ও সবঠিক হবে। নিছক নৈতিকতা ও তত্ত্ব বিষয়ক আলোনচায় ও স্তরে মোটেই কালক্ষেপ করা চলবে না। বরং ঈমানের বিষয়বস্তুকে কর্মজীবনে বাস্তব নমুনা হিসেবে ফুটিয়ে তুলতে হবে। প্রথমত মানুষের অন্তরে ঈমান প্রবশ করবে এবং তা এমন একটি সদা সক্রিয় জামায়াতের জন্ম দেবে যার বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ সকল দিক ও বিভাগ ‘ঈমানে’ র বাস্তবরূপ ধারণা করে পরিস্ফুট হয়ে উঠবে। এ বিপ্লবী জামায়াত কথায় ও কাজে জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনার ভিতর দিয়েই ‘ঈমানে’র জলন্ত রূপ পরিস্ফুট হয়ে উঠবে।
যারা মনে করেন, নিছক ইসলামী আদর্শের প্রশংসা কীর্তন ও ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানগর্ব তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমেই ইসলামী আদর্শ বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা লাভ করবে, তারা মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক থাকা একান্ত প্রয়োজন।
কুরআন একদিনে নাযিল হয়নি। বরং ঈমানের বীজ বপন, ঈমানের কাঠামো রচনা ও ঈমানের শক্তি বৃদ্ধির জন্যে তেরটি বছরের প্রয়োজন হয়েছিল। আল্লাহ তাআলার মরজী হলে তিনি পূর্ণ কুরআন একদিনেই নাযিল করতেন। অতপর ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানার্জন ও ঐ মতবাদকে ভাল করে উপলব্ধি করার জন্য তের বছর সময় দান করতে পারতেন।
কিন্তু আল্লাহ তাআলা এ পদ্ধতি গ্রহণ করেননি। কারণ তার ইচ্ছা ছিল অন্যরূপ। তিনি পৃথিবীর বুকে একটি নজিরবিহীন জীবন বিধান প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন একই সাথে ঐ জীবন বিধানের মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস গড়তে, আদর্শের ধারক ও বাহক একটি আন্দোলন সংগঠিত করতে এবং বাঞ্ছিত জীনাদর্শের প্রতিচ্ছকি স্বরূপ একটি সমাজ কাঠামো প্রতিষ্ঠিত করতে। তিনি আকীদা-বিশ্বাসের শক্তিপুষ্ট জামায়াত ও আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন এবং ঐ একই সাথে চেয়েছিলেন জামায়াত ও আন্দোলনের কর্মতৎপরতার ভিতর দিয়ে ঈমানকে ক্রমশ শক্তিশালী করে তুলতে। জামায়াত ও আন্দোলনের অগ্রগতির সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে ঈমানের শক্তি বৃদ্ধি এবং জামায়াত ও আন্দোলনের প্রকাশ্য তৎপরতা ঈমানের প্রতিচ্ছবি পরিস্ফুট হয়ে উঠাই আল্লাহ তাআলার নিকট পসন্দনীয় ছিল। মহাজ্ঞানী আল্লাহ তাআলার ভালভাবেই জানতেন যে, মানুষের সংশোধন ও সুষ্ঠ সমাজ গঠনের কাজ রাতারাতি সম্পন্ন হয় না। কারণ, আকীদা-বিশ্বাস গড়ে তোলার জন্যে ততটুকু সময় প্রয়োজন, যতটুকু কোন মানুষের একটি সুসংগঠিত জামায়াত গঠনের জন্যে প্রয়োজন।
এটাই ইসলামী জীবন বিধানের বৈশিষ্ট্য। কুরআন নাযিলের মক্কীস্তর এ বৈশিষ্ট্যেরই প্রমাণ পেশ করে। আমাদের অবশ্যই দ্বীনের উপরোক্ত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত হতে হবে এবং মানব রচিত অর্থহীন আদর্শগুলোর অন্তসারশুন্য চাকচিক্য দর্শনে অভিভূত হয়ে দ্বীনের বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনের প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকতে হবে। ইসলাম তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের প্রভাবেই প্রাচীনকালে মুসলিম উম্মাত নামে একটি বিরাট ও মহান উম্মাত গঠন করেছিল এবং ভবিষ্যতে ধরাপৃষ্টে যখনই মুসলিম উম্মাতের পুনর্গঠন জরুরী বিবেচিত হবে, তখন দ্বীনের বৈশিষ্ট্য ও নিজস্ব কর্মপদ্ধতির মাধ্যমেই তা করা সম্ভবপর হবে।
মানব দেহের রক্ত সঞ্চালন ক্রিয়ার মত ইসলামের মৌলিক আকীদ-বিশ্বাস সমাজের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হবে এবং সক্রিয় ইসলামী সংগঠনের দেহ-কাঠামোর অভ্যন্তরে জ্বলন্ত মশালের ন্যায় দীপ্তিমান থাকবে। ইসলামী জীবন বিধানের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও গতিধারা পরিবর্তন করে যারা তাত্ত্বিক আলোচনা ও জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে বাতিল জীবনার্শগুলোর তুলনায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেই দ্বীন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে তারা শুধু মারাত্মক ভুলই করে না, উপরন্তু তারা এক বিপজ্জনক পথে অগ্রসর হতে চায়।
ইসলামী আকীদা-বিশ্বসাসের দাবী হচ্ছে এই যে, এ বিশ্বাস জীবন্ত মানুষ সক্রিয় ও কর্মতৎপর সংগঠন ও সম্ভাবনাময় সমাজের অন্তস্থলে স্থান দখল করবে এবং জাহেলী পারিপার্শ্বিকতার বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক সংগ্রাম শুরু করে দেবে। প্রতিষ্ঠিত সমাজকে জাহেলিয়াতের প্রভাব থেকে মুক্ত করার সংগ্রাম পরিচালনার সাথে সাথে ঈমানী শক্তি ইসলাম গ্রহণকারীদের মন, মগয ও চরিত্র থেকে জাহেলি সমাজের যাবতীয় কলংক মিটিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে লড়াই চালিয়ে যাবে। কেননা, ইসলামী আন্দোলনের ধারক-বাহকগণ বাতিল ও জাহেলিয়াত প্রভাবিত সমাজেই জন্মগ্রহণ করেছেন এবং ইসলাম গ্রহণ করার পরেও তাদের জীবনে জাহেলিয়াতের কিছু প্রভাব থেকে যাওয়া বিচিত্র নয়।
ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস তার উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যের দরুন মানুষের মন –মগযে বিরাট ও ব্যাপক স্থান অধিকার করে বসে। নিছক তাত্ত্বিক আলোচনা ও ইসলামের গুণ-কীর্তনের প্রচেষ্টা এত সুদূরপ্রসারী হয় না। কারণ ইসলাম শুধু মাত্র মগযের উপর প্রভাব বিস্তার করেই ক্ষান্ত থাকে না বরং মানুষের বাস্তব কর্মজীবন এবং চরিত্রও তার বেষ্টনীর অন্তর্ভুক্ত হয়।
স্রষ্টা, সৃষ্টি, জীবন ও মানুষ সম্পর্কে ইসলাম প্রদত্ত ব্যাখ্যা শুধু ব্যাপক ও পূর্ণাঙ্গই নয়, অধিকন্তু তা বাস্তবমুখী ও ইতিবাচক। স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতির চাহিদা মতাবিক ইসলাম নিছক বুদ্ধিগ্রাহ্য ও জ্ঞানচর্চার বিষয়বস্তুতে সীমিত হয়ে থাকা পছন্দ করে না। এটা তার প্রকৃতি ও চরম উদ্দেশ্যের বিপরীত। ইসলাম সচল মানুষের জীবনযাত্রা, সক্রিয় সংগঠন ও বাস্তবধর্মী আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করতে চায়। সে বিপ্লবী মানুষের কর্মতৎপরতা, বিপ্লবী আন্দেলন ও সদা চঞ্চল সংগঠনের ভিতর দিয়ে এমনভাবে প্রসার লাভ করে যেন তার প্রদত্ত চিন্তাধারা বাস্তব কর্মজীবনের সাথে সঙ্গতিশীল হয়। এটা কখনো একটি গুণাবাচক বিশেষ্য হিসেবে থাকা পছন্দ করে না বরং নীতি ও বাস্তব কর্মসূচীর মধ্যে সর্বদাই সামঞ্জস্য রক্ষা করে।
স্পষ্টতই বুঝা যায় যে, নীতিগতভাবে প্রথম স্তরে ইসলামের পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করে পরবর্তী স্তরে বাস্তব কর্মক্ষেত্রে ইসলামী আদর্শ রূপায়ণের ধারণা শুধু ভ্রান্তই নয় বরং অত্যন্ত ক্ষতিকারক। এটা ইসলামের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও বৈশিষ্ট্যের পরিপন্থী।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
----------------------------------------------------
“লোকদেরকে ধীরে ধীরে শোনানোর সুবিধার্থ আমি অল্প অল্প করে কুরআন নাযিল করেছি এবং (বিশেষ বিশেষ সময়ে) ক্রমশ কুরআন অবতীর্ণ করেছি।” — বনী ইসরাঈল: ১০৬
উপরোক্ত আল্লাহর বাণী অনুসারে একই সময়ে দু’টো বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে। প্রথমত অল্প অল্প করে কুরআন নাযিল করা এবং দ্বিতীয়ত, লোকদের ধীরে ধীরে কুরআন শুনানো। এ ব্যবস্থা অবলন্বনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ঈমানের ভিত্তিতে একটি জীবন্ত ও সক্রিয় সংগঠন গড়ে তোলা এবং ঐ সংগঠনকে ক্রমশ পূর্ণত্বের পর্যায়ে পৌছে দেয়া। কারণ, এ জীবন বিধান বাস্তবায়িত হবার জন্যে এসেছে। নিছক উত্তম মতবাদ হিসেবে স্বীকৃতি লাভের জন্যে নয়।
আল্লাহ প্রদত্ত আদর্শ বাস্তবায়নে আল্লাহ প্রদত্ত কর্মসূচী
দ্বীনের বাণীবাহকদের একথা ভালোভাবেই বুঝে নিতে হবে যে, ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান এবং এ আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার পদ্ধতিও ঐশী বাণীর মারফত স্বয়ং আল্লাহ তাআলাই নিদিষ্ট করে দিয়েছেন। তাই সে পদ্ধতি অবলন্বন ব্যতীত দ্বীনের প্রতিষ্ঠা কিছুতেই সম্ভব নয়। তাদের আরও বুঝতে হবে যে, এ দ্বীন শুধু আকীদা-বিশ্বাস ও জীবন যাত্রা প্রণালী পরিবর্তনও তার লক্ষ্য। এ দ্বীন বিশেষ ধরনে আকীদা-বিশ্বাস গড়ে তোলে, একটি বৈশিষ্ট্যময় উম্মাত তৈরী করে এবং সাথে সাথে এক বিশেষ ধরনের চিন্তা-কর্মধারাকে ক্রমবিকাশের মাধ্যমে পূর্ণত্ব দান করে। এ দ্বীন আকীদা-বিশ্বাস ও জীবনে যখন যে পরিমাণ পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়, ঠিক সে পরিমাণেই তার প্রতিষ্ঠার জন্যে শক্তি নিয়োগ করে। তাই বাঞ্ছিত চিন্তাধারার প্রবর্তন নিদিষ্ট আকীদা-বিশ্বাস গড়ে তোলা এবং পাশাপাশি একই সাথে সম্পন্ন হয়। বরং বলা যায় এগুলো একই ফুলের পাপড়ি বিশেষ।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা জানলাম যে, দ্বীনের নিজস্ব কর্মপদ্ধতি সুনিদিষ্ট। সাথে সাথে এটাও জানা গেল যে, কর্মপদ্ধতি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও চিরস্থায়ী। এ পদ্ধতি ইসলামী দাওয়াতের বিশেষ স্তর, বিশেষ অবস্থা বা বিশেষ পরিবেশের জন্যে তৈরী হয়নি। অথবা এটা শুধুমাত্র সাহাবায়ে কেরাম (রা) –এর জন্যেই বিশেষভাবে প্রযোজ্য ছিল না। বরং এ পদ্ধতি যুগ ও কালের বন্ধনমুক্ত। যখনই দুনিয়াতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হবে,তখনই এ পদ্ধতিতেই আন্দোলন চালাতে হবে এবং অন্য কোন উপায় –পদ্ধতি অবলন্বন করে এ দ্বীনের প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
ইসলাম মানুষের আকীদা-বিশ্বাস এবং ব্যবহারিক জীবনের যাবতীয় কাজকর্মের পরিবর্তন সাধনের সাথে সাথে দৃষ্টিভংগী এবং চিন্তাধারাও পরিবর্তন করে দেয়। তার পরিবর্তন পদ্ধতিও মানব রচিত পরিবর্তন পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ শেষোক্ত পদ্ধতি অর্থহীন ও সংকীর্ণ দৃষ্টি সম্পন্ন।
আমরা আল্লাহ তাআলার নির্ধারিত পদ্ধতি গ্রহণ না করে কিছুতেই ঐশীবাণী থেকে উপকৃত হতে পারব না এবং মানবজাতির চিন্তাধারা ও অভ্যাস পরিবর্তন করতেও সক্ষম হবো না।
আমরা যখন ইসলামকে নিছক একটি মতবাদ হিসেবে অধ্যয়ন করার অথবা জ্ঞান চর্চার মজলিসে মুখরোচক আলোচ্য বিষয়ে পরিণত করার চেষ্টা করি, তখন প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ প্রদত্ত বিপ্লবী পদ্ধতি ও চিন্তাধারা থেকে তাকে পৃথক করে নেই। আর এভাবে এ আল্লাহর জীবচনাদর্শকে মানব রচিত জীবন বিধানের পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে আসি। আমাদের এ জাতীয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাস্তব ক্ষেত্রে মানব রচিত পদ্ধতিগুলোকে সংশোধন করে মানব রচিত পদ্ধতির সমমর্যাদার উন্নীত করতে চেষ্টা করি। এ ধরনের দৃষ্টিভংগী অত্যন্ত মারাত্মক এবং পরাজিত মনোবৃত্তিরই পরিণতি।
মহাসত্যের বাণী ইসলামী আন্দোলনের কর্মীগণকে চিন্তা-ভাবনার একটি বিশেষ মানদণ্ড প্রদান করে। দুনিয়ায় প্রচলিত জাহেলিয়াতের প্রভাবে আমাদের মন-মস্তিষ্কে যেসব ভ্রান্ত চিন্তা প্রবেশ করে আমাদের বুদ্ধিকে বিভ্রান্ত ও শিক্ষা সংস্কৃতিকে বিষাক্ত করে তুলেছে, সেগুলোর প্রভাব থেকে এ মানদণ্ডের সাহায্যেই তারা পরিশুদ্ধ হতে পারে। যদি আমরা আমাদের দ্বীনকে তার প্রকৃতির বিপরীত বিরাজমান জাহেলিয়াতের দৃষ্টিভংগী অনুসারে পরিবর্তন করতে উদ্যত হই, তাহলে এ দ্বীন মানব সমাজের জন্যে কল্যাণহীন হয়ে পড়বে এবং মানব সমাজ আসল দ্বীনের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে। শুধু তাই নয়, আমাদের নিজেদের পক্ষেও জাহেলী মতবাদের অনিষ্টকারিতা থেকে দূরে থাকা সম্ভব হবে না। বিষয়টি এদিক দিয়েও চরম ক্ষতিকারক।
ইসলামী আদর্শকে মানবসমাজে প্রতিষ্ঠিত করার চিন্তা –ভাবনা ও চেষ্টা-চরিত্র ইসলামী আকীদা ও জীবন বিধানের প্রতি ঈমান আনয়নের চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং তা পৃথকও নয়।
ইসলামী মতবাদ প্রচার এবং ইসলামী জীবন বিধানের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্যে মৌলিক ও লেখনীয় সাহায্যে চেষ্টা –তদবীর করা আমাদের নিকট খুবই উত্তম ও আনন্দদায়ক বিবেচিত হলেও আমাদের মনে রাখতে হবে যে, নিছক প্রচার ও গুণ-কীর্তনের দ্বারা ইসলাম কখনো পৃথিবীতে বাস্তব সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না। আমাদের বুঝতে হবে যে, উপরোক্ত পন্থা থেকে শুধুমাত্র ইসলামী আন্দেলনের কর্মীরাই উপকৃত হতে পারে এবং তাও শুধু আন্দোলনের যতটুকু অগ্রগতি হয ততটুকুই। তাই আমি আবার বলি, ইসলামের প্রতি ঈমান আনার সাথে সাথেই এ আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্যে আন্দোলন শুরু করতে হবে এবং আন্দোলন সত্যিকার ও নিখুঁতভাবে ইসলামের প্রতিচ্ছবি রূপে আত্মপ্রকাশ করবে।
আমি একথারও পুনরক্তি করতে চাই যে, ইসলামী আন্দোলন পরিচালনা পদ্ধতিও ঐশীবাণী দ্বারাই নির্ধারিত এবং এ পদ্ধতি নিখুঁত স্থায়ী এবং অত্যন্ত প্রভাবশালী। অন্য সকল পদ্ধতি অপেক্ষা এ পদ্ধতি মানব প্রকৃতির সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। এ কারণেই বাস্তব আন্দোলনে অবতীর্ণ হওয়া এবং এ সম্পর্কে মানুষের অন্তরে জীবন্ত ধারণা সৃষ্টি হওয়া এবং এ পদ্ধতি ধাপে ধাপে অনুসরণের পূর্বে ইসলাম এটাকে একটি নিদিষ্ট ও পরিপূর্ণ পদ্ধতি হিসেবে মানুষের কাছে পেশ করেছে।
ইসলামী আকীদার মুলসূত্র সম্পর্কে যদি উপরোক্ত কথা সত্য হয়, তাহলে ইসলামী সমাজের সাংগঠনিক কাঠামো এবং বিস্তারিত আইন প্রণয়ন সম্পর্কেও ঐ একই সত্য প্রযোজ্য। আমাদের চারিদিকে সুপ্রতিষ্ঠিত জাহেলিয়াত ইসলামের কোন কোন নিঃস্বার্থ কর্মীদের মনে এতটুকু প্রভাব বিস্তার করেছে যে, তারা ইসলামী বিপ্লবের স্বাভাবিক অগ্রগতির স্তরগুলো অতিদ্রুত অতিক্রম করার জন্য ব্যস্ত হয়ে নিম্নের প্রশ্নগুলো উত্থাপন করেছেন। আমরা যে, আদর্শের বাণী প্রচার করছি তার বিস্তারিত বিধানগুলো কি? এগুলো প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা কি পরিমাণ গবেষণা করেছি? এ পর্যন্ত আমরা কতগুলো বিষয় সুবিন্যস্ত করতে ও কতগুলো প্রবন্ধ রচনা করতে সক্ষম হয়েছি? নতুবা আদর্শের যুগোপযোগী ব্যবস্থাশাস্ত্র (ফিকাহ) রচিত হয়েছে কি? তাদের প্রশ্ন শুনে মনে হয়, ইসলামী আইন প্রণয়নের জন্য গবেষণা ও বিস্তারিত ব্যবস্থাশাস্ত্র (ফিকাহ)রচনা ছাড়া আর সকল কাজই সম্পন্ন হয়ে গেছে। মনে হয়, সমাজের সকলেই যেন আল্লাহর বিধান মেনে নিয়ে তদনুযায়ী জীবনযাপন করতে প্রস্তুত হয়ে গেছে এবং শুধুমাত্র আধুনিক যুগোপযোগী ব্যবস্থাশাস্ত্র রচনার জন্য একদল মুজতাহিদেরই অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটা ইসলামের প্রতি এক জঘন্য বিদ্রূপ। ইসলামে বিশ্বাসী প্রতিটি ব্যক্তিরই এ জাতীয় বিদ্রূপাত্মক আচরণ সম্পর্কে সতর্ক থাকা দরকার।
উপরোক্ত পন্থা অবলন্বন করে জাহেলিয়াত শরীয়াতে ইলাহীর বাস্তবায়ন প্রতিরোধ করে মানুষের উপর মানুষের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠাকারী ব্যবস্থাকে বহাল রাখার জন্য বাহানা তালাশ করছে মাত্র। সে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের ঈমানী শক্তিকে বিপ্লবী আন্দোলন থেকে বিরত রেখে শুধুমাত্র আদর্শের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে পরিতৃপ্ত থাকতে বলে। জাহেলিয়াত ইসলামী আদর্শের বাস্তবায়ন প্রচেষ্টার সঠিক পথ থেকে ইসলামের নামোচ্চারণকারীদের হটিয়ে দিতে চায়। আন্দোলন ও সংগ্রামের যে পথে ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস পরিপক্কতা লাভ করে, যে সংগ্রাম ও দ্বন্দ-সংঘর্ষের ভিতর দিয়ে ইসলামী ব্যব্স্থা বিকাশ লাভ করে এবং যে আন্দোলনের বিভিন্ন স্তরে বাস্তব সমস্যা ও অসুবিধাদি দূর করার জন্যে সময়োযোগী ইসলামী আইন প্রনীত হয়, সে আন্দেলন ও সংগ্রাম থেকে ঈমানদারদেরকে দূরে সরিয়ে রাখাই বাতিল মতাদর্শের লক্ষ্য।
ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠাকারীদের এসব অপকৌশল নস্যাত করে দিয়ে বাতিলকে ধূলিস্মাৎ করে দিতে হবে এবং যে সমাজ আজও মানব রচিত বিধান বাতিল করে আল্লাহর বিধান গ্রহণের জন্যে প্রস্তুত হয়নি, সে সমাজে ইসলামী ব্যবস্থা শাস্ত্রের আধুনিকীকরণের হাস্যকর প্রচেষ্টা প্রত্যাখান করতে হবে। মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীগণের সময় ও শ্রম শুন্যে প্রাসাদ নির্মাণের প্রচেষ্টায় অপচয় করানোর উদ্দেশ্যেই এসব উক্তি করা হয়। তাদেরকে অবশ্যই এসব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে হবে।
এ দ্বীন নিজের প্রতিষ্ঠার জন্যে যে কর্মপদ্ধতি নিদিষ্ট করে দিয়েছে, শুধু সেই পদ্ধতির মাধ্যমেই আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে। এ কর্মপদ্ধতির ভিতরই দ্বীনি শক্তির রহস্য লুক্কায়িত রয়েছে এবং ইসলাম প্রতিষ্ঠাকারীদের বিজয় ও সাফল্য এ পদ্ধতিরই অনিবার্য ফলশ্রুতি।
ইসলামী জীবনাদর্শ ও ইসলামের পূর্ণ প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি উভয়ই সমান গুরুত্বপূর্ণ এবং এ দুয়ের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। বাহ্যত যতই আকষণীয় হোক না কেন, অন্য কোন উপায় –পদ্ধতিতেই ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। অন্যান্য পদ্ধতি মানব রচিত আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে পারে কিন্তু আমাদের আদর্শের বেলায় এসব পদ্ধতি একেবারেই অর্থহীন। তাই ইসলামী বিপ্লবের ক্ষেত্রে তার নিজস্ব পদ্ধতি মেনে চলা দ্বীনের মৌলিক আকীদা ও জীবন ব্যবস্থা মেনে চলার মতই গুরুত্বপূর্ণ।
দ্বিতীয় অধ্যায় : মক্কী যুগের মৌলিক কুরবানী শিক্ষা
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: