৭২) যারা ঈমান এনেছে, হিজরাত করেছে এবং আল্লাহর পথে নিজের জানমালের ঝুকি নিয়ে জিহাদ করেছে আর যারা হিজরাতকারীদেরকে আশ্রয় দিয়েছে ও সাহায্য করেছে, আসলে তারাই পরস্পরের বন্ধু ও অভিভাবক৷ আর যারা ঈমান এনেছে ঠিকই কিন্তু হিজরাত করে (দারুল ইসলামে) আসেনি তারা হিজরাত করে না আসা পর্যন্ত তাদের সাথে তোমাদের বন্ধুত্বের ও অভিভাবকত্বের কোন সম্পর্ক নেই৷ ৫০ তবে হাঁ দীনের ব্যাপারে যদি তারা তোমাদের কাছে সাহায্য চায় তাহলে তাদেরকে সাহায্য করা তোমাদের জন্য ফরয৷ কিন্তু এমন কোন সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয় যাদের সাথে তোমাদের চুক্তি রয়েছে৷ ৫১ তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ তা দেখেন৷
___________________________
*৫০ . এ আয়াতটি ইসলামের সাংবিধান আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা৷ এখানে একটি মূলনীতি নির্ধারিত হয়েছে৷ সেটি হচ্ছে, অভিভাবকত্বের সম্পর্ক এমন সব মুসলমানদের মধ্যে স্থাপিত হবে যারা দারুল ইসলামের বাসিন্দা অথবা বাইর থেকে হিজরত করে দারুল ইসলামে এসেছে৷ আর যেসব মুসলমান ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানার বাইরে বাস করে তাদের সাথে অবশ্যি ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকবে কিন্তু অভিভাকত্বের সম্পর্ক থাকবে না৷ অনুরূপভাবে যেসব মুসলমান হিজরত করে দারুল ইসলামে আসবে না বরং দারুল কুফরের প্রজা হিসেবে দারুল ইসলামে আসবে তাদের সাথে ও সম্পর্ক থাকবে না৷ অভিভাকত্ব শব্দটিকে এখানে মূলে ওয়ালায়াত শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে৷ আরবীতে ওয়ালায়াত ,অভিভাকত্ব বলতে সাহায্য সহায়তা, সমর্থন, পৃষ্ঠপোষকতা, মৈত্রী ,বন্ধুত্ব, নিকট আত্মীয়তা, অভিভাবকত্ব এবং এ সবের সাথে সামঞ্জস্যশীল অর্থ বুঝায়৷ এ আয়াতের পূর্বাপর আলোচনায় সুষ্পষ্টভাবে এ থেকে এমন ধরনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বুঝানো হয়েছে যা একটি রাষ্ট্রের তার নাগরিকদের সাথে, নাগরিকদের নিজেদের রাস্ট্রের সাথে এবং নাগরিকদের নিজেদের মধ্যে বিরাজ করে৷ কাজেই এ আয়াতটি "সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক অভিভাকত্ব"কে ইসলামী রাস্ট্রের ভুখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেয়৷ এ সীমানার বাইরে মুসলমানদেরকে এ বিশেষ সম্পর্কের বাইরে রাখে৷ এ
অভিভাবকত্ব না থাকার আইনগত ফলাফল অত্যন্ত ব্যাপক৷এখানে এগুলোর বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই৷ উদাহরণ হিসেবে শুধুমাত্র এতটুকু ইংগিত করাই যথেষ্ট হবে যে, এ অভিভাবকত্বহীনতার ভিত্তিতে এ দারুল কুফর ও দারুল ইসলামের মুলমানরা পরস্পরের উত্তরাধিকারী হতে পারে না৷ এবং তারা একজন অন্যজনের আইনগত অভিভাবকত্ব হতে পারে না, পরস্পরের মধ্যে বিয়ে -শাদী করতে পারে না এবং দুরুল কুফরের সাথে নাগরিকত্বের সম্পর্ক ছিন্ন করেনি এমন কোন মুসলমানকে ইসলামী রাষ্ট্র নিজেদের কোন দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত করতে পারে না৷*১
*১.এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে হলে পড়ুন লেখকের "রাসায়েল ও মাসায়েল" ২য় খণ্ডের "দারুল ইসলাম ও দারুল কুফরে" মুসলমানদের মধ্যে উত্তারাধিকার ও বিয়ে -শাদির সম্পর্ক নিবন্ধনটি ৷
তাছাড়া এ আয়াতটি ইসলামী রাষ্ট্রের বিদেশ নীতির ওপরও উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করে৷ এর দৃষ্টিতে ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে যেসব মুসলমান অবস্থান করে তাদের দায়িত্বই ইসলামী রাষ্ট্রের ওপর বর্তায়৷ বাইরের মুসলমানদের কোন দায়িত্ব ইসলামী রাষ্ট্রের ওপর বার্তায় না৷ একথাটিই নবী (সা) তার নিম্নোক্ত হাদীসে বলেছেনঃ -----------অর্থাৎ "আমার ওপর এমন কোন মুসলমানদের সাহায্য সমর্থন ও হেফাজতের দায়িত্ব নেই যে মুশরিকদের মধ্যে বসবাস করে" ৷ এভাবে সাধারণত যেসব বিবাদের কারণে আন্তর্জাতিক জটিলতা দেখা দেয় ইসলামী আইন তার শিকট কেটে দিয়েছে৷ কারণ যখনই কোন সরকার নিজের রাষ্ট্রীয় সীমানার বাইরে অবস্থানকারী কিছু সংখ্যালঘুর দায়িত্ব নিজের মাথায় নিয়ে নেয় তখনই এর কারণে এমন সব জটিলতা দেখা দেয় বার বার যুদ্ধের পরও যার কোন মীমাংসা হয় না৷
_______________________________________________________
*৫১ . এ আয়াতে দারুল ইসলামের বাইরে অবস্থানকারী মুসলমানদের রাজনৈতিক অভিভাবকত্বের সম্পর্ক মুক্ত গন্য করা হয়েছিল৷ এখন এ আয়াতটি বলছে যে, তারা এ সম্পর্কের বাইরে অবস্থান করা সত্ত্বেও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কের বাইরে অবস্থান করেছে না৷ যদি কোথাও তাদের ওপর জুলুম হতে থাকে এবং ইসলামী ভ্রাতৃ সমাজের সাথে সম্পর্কের কারণে তারা দুরুল ইসলামের সরকারের ও তার অধিবাসীদের কাছে সাহায্য চায় তাহলে নিজদের এ মজলুম ভাইদের সাহায্য করা তাদের জন্য ফরয হয়ে যাবে৷ কিন্তু এরপর আরো বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে , চোখ বন্ধ করে এসব দীনী ভাইদের সাহায্য করা যাবে না৷বরং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আরোপিত দায়িত্ব ও নৈতিক সীমারেখার প্রতি নজর রেখেই এ দায়িত্ব পালন করা যাবে৷ জুলমকারী জাতির সাথে যদি সীমারেখার রাষ্ট্রের চুক্তিমূলক সম্পর্ক থাকে তাহলে এ অবস্থায় এ চুক্তির নৈতিক দায়িত্ব ক্ষুন্ন করে মজলুম মুসলমানদের কোন সাহায্য করা যাবে না৷
আয়াতে চুক্তির জন্যে ----(মীসাক)শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে৷ এর মূল হচ্ছে -----'ওসুক'৷ এর মানে আস্থা ও নির্ভরতা৷ এমন প্রত্যেকটি জিনিসকে "মীসাক" বলা হবে যার ভিত্তিতে কোন জাতির সাথে আমাদের সুস্পষ্ট যুদ্ধ নয় চুক্তি না থাকলেও তারা প্রচলিত পদ্ধতি অনুযায়ী আমাদেরও তাদের মধ্যে কোন যুদ্ধ নেই এ ব্যাপারে যথার্থ আস্থাশীল হতে পারে৷
তারপর আয়াতে বলা হয়েছে -----------অর্থাৎ তোমাদের ও তাদের মধ্যে চুক্তি থাকে এ থেকে পরিস্কার জানা যাচ্ছে ,ইসলামী রাষ্ট্রের সরকার কোন অমুসলিম সরকারের সাথে যে চুক্তি স্থাপন করে তা শুধুমাত্র দুটি সরকারের মধ্যকার সম্পর্ক নয় বরং দুটি জাতির সম্পর্কও এবং মুসলমান সরকারের সাথে সাথে মুসলিম জাতি ও তার সদস্যরাও এর নৈতিক দায়িত্বের অন্তরভুক্ত হয়ে যায়৷ মুসলিম সরকার অন্য দেশ বা জাতির সাথে যে চুক্তি সম্পাদন করে ইসলামী শরীয়াত তার নৈতিক দায়িত্ব থেকে মুসলিম জাতি বা তার ব্যক্তিবর্গকে মুক্ত থাকার আদৌ বৈধ গণ্য করে না৷ তবে দারুল ইসলাম সরকারের চুক্তিগুলো মেনে চলার দায়িত্ব একমাত্র তাদের ওপর বর্তাবে যারা এ রাষ্ট্রের কর্মসীমার মধ্যে অবস্থান করবে৷ এ সীমার বাইরে বসবাসকারী সারা দুনিয়ার মুসলমানরা কোনক্রমেই এ দায়িত্বে শামিল হবে না৷ এ কারণেই হোদাইবিয়ায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কার কাফেরদের সাথে যে চুক্তি করেছিলেন হযরত আবু বুসাইর ও আবু জানদাল এবং অন্যান্য মুসলমানদের ওপর তার কোন দায়িত্ব অর্পিত হয়নি, যারা মদীনার দারুল ইসলামের প্রজা ছিলেন না৷
.
_______________________________________________________
৭ ৩) যারা সত্য অস্বীকার করেছে তারা পরষ্পরের সাহায্য সহযোগীতা করে৷ যদি তোমরা এটা না করো তাহলে পৃথিবীতে ফিতনা সৃষ্টি হবে ও বড় বিপর্যয় দেখা দেবে৷ ৫২
_______________________________________________________
৫২ . সবচেয়ে কাছের বাক্যটির সাথে যদি এ বাক্যটির সম্পর্ক মেনে নেয়া হয় তাহলে এর অর্থ হবে, যেভাবে কাফেররা পরস্পর সাহায্য -সমর্থন করে, তোমরা ঈমানদাররা যদি সেভাবে পরস্পরের সাহায্য -সমর্থন না করো তাহলে পৃথিবীতে বিরাট ফিতনা ও বিপর্যয় সৃষ্টি হয়ে যাবে৷ আর যদি ৭২ আয়াত থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত যতগুলো হেদায়াত দেয়া হয়েছে তার সবগুলোর সাথে যদি এর সম্পর্ক মেনে নেয়া হয় তাহলে এ উক্তির অর্থ হবেঃ যদি দারুল ইসলামের মুসলমানরা পরষ্পরের অলী ও অভিভাবক না হয়, হিজরত করে যেসব মুসলমান দারুল ইসলামের আসেনি এবং যেসব মুলমান দারুল কুফলে বসবাস করছে তাদেরকে যদি দারুল ইসলামের অধিবাসীরা নিজেদের রাজনৈতিক অভিভাবকত্ব বহির্ভূত মনে না করে, যদি বাইরের মজলুম মুসলমানদের সাহায্য চাওয়ার পর তাদের সাহায্য না করা হয়, আর যদি এ সংগে যে জাতির সাথে মুসরমানদের চুক্তি থাকে তাদের বিরুদ্ধে সাহায্যের আবেদনকারী মুসলমানদের সাহায্য না করার নীতিও না মেনে চলা হয় এবংযদি মুসলমানরা কাফেরদের সাথে সহযোগিতায় সম্পর্ক খতম না করে, তাহলে পৃথিবীতে বিরাট ফিতনা ও বিপর্যয় সৃষ্টি হবে৷
_______________________________________________________
৭ ৪) যারা ঈমান এনেছে, আল্লাহর পথে বাড়ি-ঘর ত্যাগ করেছে এবং জিহাদ করেছে আর যারা আশ্রয় দিয়েছে এবং সাহায্য -সহায়তা করেছে তারাই সাচ্চা মুমিন৷ তাদের জন্যে রয়েছে ভূলের ক্ষমা ও সর্বোত্তম রিযিক৷
.
_______________________________________________________
৭৫) আর যারা পরে ঈমান এনেছে ও হিজরত করে এসেছে এবং ৫৩ অবশ্যি আল্লাহ সব জিনিস জানেন৷
_______________________________________________________
৫৩ . এর মানে হচ্ছে, ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ভিত্তেতে তাদের পরষ্পরের উত্তরাধিকার বন্টন করা হবে না৷ বংশধারা ও বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে যেসব অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় দীনী ভাইরা পরষ্পরের ব্যাপারে সেসব অধিকারও লাভ করবে না৷ এসব ব্যাপারে ইসলামি সম্পর্কের পরিবর্তে আত্মীয়তার সম্পর্কই আইনগত অধিকারের ভিত্তির কাজ করবে৷ হিজরতের পর নবী (সা)মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন কায়েম করেছিলেন তার ফলে এ দীনী ভাইরা পরষ্পরের ওয়ারিসও হবে বলে কেউ কেউ ভাবতে শুরু করেছিলেন৷ তাদের এ ভাবনা যে ঠিক নয় তা বুঝাবার জন্যে আল্লাহ একথা বলছেন৷
0 comments: