উনিশ শ' বাহাত্তর সালের পর থেকে প্রকৃত প্রস্তাবে চার পাঁচজন ছা্ত্রই স্টেনগান হাতে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ চালাত। উপাচার্যবৃন্দ এই অস্ত্রধারী ছা্ত্রদের কথাতে উঠতেন, বসতেন। স্বাধীনতার পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুক্তির দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল, কিন্তু স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যলয়ের বেবাক পরিবেশটাকেই কলুষিত করে তোলা হল। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন চিন্তা, কল্পনা, নিরপেক্ষ গবেষনার পথ একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। সরকার সমর্থক ছা্ত্ররা প্রকাশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করত। দরকারবোধে তারা এগুলো ব্যবহার করতে কোন রকম কুন্ঠা বা সংকোচবোধ করত না। বর্তমানে ঢাকা জেলার জেলা জজের কোর্টে একটি লোমহর্ষক হত্যামামলার বিচার চলছে। সরকার সমর্থক দু'দল ছা্ত্রের মধ্যে মতামতের গরমিল হওয়ায় অবাধে রাতের বেলা অগ্নেয়াস্ত্র ব্যাবহার করে সাতজন সতীর্থকে হত্যা করেছে। আজ থেকে প্রায় একবছর পূর্বে হাজী মুহম্মদ মহসীন ছাত্রাবাসের টিভি কক্ষের সামনেই এই শোকাবহ ঘটনা অনুষ্ঠিত হয়। সরকারসমর্থক ছাত্ররাই যখন মতামতের গড়মিলের জন্য স্বদলীয় ছাত্রের হাতে এভাবে বেঘোরে প্রাণ হারাতে পারে, সাধারণ ছাত্র এবং শিক্ষকদের অবস্থা কি হতে পারে সহজেই অনুমান করা যায়। সরকারসমর্থক ছাত্রের মত শিক্ষকদেরও একটি বিশেষ অসুবিধা হবার কথা নয়। এঁদের অনেকে পুর্ব থেকে ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর সেবা করি আসছেন। সুতরাং এই নতুন শাসনামলেও তাঁরা বস্তু-সম্পদের দিক দিয়ে কিন্চিত লাভবান হওয়ার সাধনা করে যাচ্ছিলেন এবং নানাভাবে সরকারসমর্থক ছাত্ররা সক্রিয় সহায়তা দান করে যা্চ্ছিলেন। আর সরকার নিজস্ব প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে অপর কোন মতামত এবং প্রতিষ্ঠান যাতে মাথা তুলতে না-পারে সেজন্য সম্ভাব্য সকল উপায়ে চেষ্টা করে আসছিল। বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারি মতামতের লালনক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তুলতে যেয়ে এমন একটা অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হল, যার সংগে অধিকাংশ শিক্ষক এবং ছাত্র মিলিয়ে নিতে পারলেন না। শেখ মুজিবুর রহমানের রাস্ট্রনৈতিক চিন্তা এবং রাস্ট্রশাসন পদ্ধতিকে মুজিববাদ আখ্যা দিয়ে, তার প্রচার, প্রসার এবং বাস্তবায়নের জন্য সরকারসমর্থক ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়সমুহে এমন একটা সুসংগঠিত অভিযান পরিচালনা করলেন, কোন স্বাধীনচেতা, ন্যায়বান ছাত্র কিংবা শিক্ষক তার সংগে অন্তরের সামান্য সংযোগও অনুভব করতে পারলেন না। এই না-পারার কারণেই সৎ এবং ন্যায়পরায়ন শিক্ষকরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। তাঁরা অপরিসীম মানসিক উৎকন্ঠা নিয়ে শন্কা, ত্রাস এবং ভীতির মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হলেন। অতি শিগ্গির গোটা দেশের তাবত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই মুজিববাদী ছাত্রদের এবং তাঁদের পেছন বুদ্ধি-পরামর্শ যোগানো শিক্ষকদের প্রভাব ঘুর্ণিহাওয়ার মত অপ্রতিরোধ্য বেগে ছড়িয়ে পড়ল।
যে সমস্ত শিক্ষক চরিত্র এবং বিদ্যাবত্তার জন্য ছাত্রদের মধ্যে শ্রদ্ধা এবং সম্মানের আসনে অধিষ্টিত ছিলেন মুশকিল হল তাঁদেরই। তাঁরা তাঁদের পরিবারবর্গ নিয়ে নিতান্ত ভয়ে ভয়েই দিবস রজনী অতিবাহিত করতেন। যে-কোন সময়, যে কোন বিবাদ এসে ঘাড়ে আশ্রয় করতে পারে। সে সময় আমি নিজে বিশ্ববিদ্যালয় কম্পাউন্ডে বাস করেছি। এই সন্ত্রাসজনক পরিস্থিতির ভয়াবহতা কিছু কিছু অনুভব করেছি। যুদ্ধ শেষ হওয়ার দু'বছর পরেও দেখেছি শিক্ষকরা ফ্ল্যাটে বাইরের দিক থেকে তালা লাগিয়ে রাখতেন। কোন অচেনা লোক খোঁজ-খবর করতে গেলে বাড়ির লোকেরা জবাব দিতেন, তিনি বাসায় নেই।
যে মুষ্টিমেয় ছাত্রদল বিশ্ববিদ্যালয়ের সবকিছু শক্তহাতে নিয়ন্ত্রন করত সংখ্যায় ছিল তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনরত মোট ছাত্রছাত্রীর এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র। সরকারি পুলিশ সব সময়ে তাদের সাহায্যে মোতায়েন থাকত। ছাত্রাবাসের ভোজনক্ষে খাওয়ার জন্য তাদের কোনো অর্থ দিতে হত না। অধিকন্তু মন্বন্তরের সময় ছা্ত্রাবাসের প্রভোস্ট এবং হাউজ টিউটররে সংগে মিলেমিশে রেশনে পাওয়া চাল, ডাল কালোবাজারে বেচে দিয়ে প্রচুর অর্থ আত্নস্যাত করার সুযোগ তারা পেত। তাছাড়াও সরকারদলীয় লোকদের মধ্যে ব্যাবসা-বাণিজ্য, চাকুরি-বাকরি বন্টন করার বরাদ্দ সুযোগগুলো তো ছিলই।
বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজের ছাত্রসংসদসমূহের নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করত, ভীতি এবং ত্রাসসৃষ্টি করে ছাত্র সাধারণের কাছ থেকে ভোট আদায়ের চেষ্টা করত। তারপরেও যখন দেখা যেত নির্বাচনে তারা শতকরা বিশটি ভোটও লাভ করতে পারেনি এবং পরাজয় অবধারিত, রাতের বেলা আলো নিভিয়ে ভোটের বা্ক্সগুলো লুট করে নিয়ে যেত। তাদের অনুমোদন ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ছাত্রভর্তি হতে পারত না, ছাত্রাবাসসমূহে থাকবার জায়গা পেত না। শিক্ষকদের নিয়োগ বরখাস্ত অনেকটা তাদের খেয়াল-খুশির উপর নির্ভরশীল ছিল।
শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর একদলীয় শাসন চালু করে দেশে যে নতুন শাসনতান্রিক পদ্ধতি চালু করার কথা ঘোষনা করেছিলেন, তাতে বিশ্ববিদ্যলয়গুলোকেও ক্ষমতার অংশভোগী করে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এক শ' পনেরজন সদস্যের মধ্যে ঢাকা, রাজশাহী, জাহান্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যত্রয় এবং বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালিকা ও বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষাকে স্থান দিয়েছিলেন। জাতীয়দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের স্থান দিয়ে সরাসরি বিধিবদ্ধভাবে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে সরকারি নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসার আয়োজন সম্পুর্ণ করলেন। অর্থাৎ এখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ঘোরপ্যাচ ব্যাতিরেকে প্রত্যক্ষভাবে সরকারি শাসন বলবত করা হবে। পূর্বেকার সরকারসমূহ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃত্ব করতেন বটে, কিন্তু সে পন্থাটি ছিল সম্পুর্ণ স্বাধীন, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। সরকার প্রশাসন কিংবা পরিচালনায় প্রকাশ্যত কোন হস্তক্ষেপ করতেন না। শেখ মুজিবই প্রথম যিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে ক্ষমতার অংশীদার করলেন। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আলাদা অস্তিত্ব, আলাদা আইন-কানুন এগুলোকে তিনি ক্রমে ক্রমে ভেঙে নতুন করে সাজিয়ে, তার মধ্যে সরকারি বিরোধীতার বীজকে উপরে ফেলতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, যে আধুনিক শিক্ষাভিমানী পন্ডিত সমাজ তাঁকে অবগ্জ্জা করেন, তাঁদের অন্তরলালিত অহন্কার চূর্ণ করতে পারবেন। নতুন পদ্ধতিটা এমনভাবে রচনা করা হয়েছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পন্ডিতদেরও তাঁর আাওতার বাইরে থাকার উপায় নেই এবং শেখ মুজিবুর রহমানরে সিংহাসনের পেছনে না দাঁড়িয়ে তাঁদের গত্যান্তর থাকবে না। তৃতী্য়ত, বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের হাতের মুঠোতে পুরে তিনি দেশের মানুষ এবং বিশ্ববাসীর সামনে প্রমাণ করত পারবেন যে তিনি মন্দ অর্থে একনায়ক নন। দেশের কৃষকসমাজ থেকে শুরু করে সারস্বত্ব সমাজ পর্যন্ত তাঁকে এত অনুরোধ উপরোধ করেছেন যে, বাধ্য হয়েই তিনি দেশের কল্যান চান এবং বাংলার মানুষকে ভালবাসেন। সমস্ত দেশের মানুষের সমবেত প্রার্থনা তিনি অগ্রাহ্য করতে পারেনণি।
তাঁর দিক থেকে শেখ মুজিবুর রহমান ভূল চিন্তা করেননি। বিশ্ববিদ্যালয়কে ক্ষমতার অংশ দেয়ার সংগে সংগেই এক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রবীণ উপাচার্য এক পত্রিকার প্রতিনিধির সংগে সাক্ষাতকারে বলেই বসলেন যে শেখ মুজিবুর রহমানের মত এমন একজন বলিষ্ঠ নেতা হাজার বছরে জন্মগ্রহন করেননি। শেখ মুজিবুর রহমান যে বলিষ্ঠ নেতা সে বিষয়ে কারো কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি তা প্রকাশ করার জন্য এই সময়কে বেছে নিয়েছিলেন কেন তা অনেকের কাছেই খুব তাৎপর্যপূর্ণবহ মনে হয়েছে। বাস্তবেও তিনি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের নিয়ে কর্মচারীদের কেন্দ্রীয়দলে যোগদানের আবেদনপত্রসহ তাঁদের নিয়ে রাস্ট্রপতির সংগে দেখা করে আসলেন। সেই ছবি কাগজে ফলাও করে প্রকাশিত হল।
এই উপাচার্য ভদ্রলোককে দেশের মানুষ আত্নমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে জানতেন। অতটুকু দাস্যতা তাঁর কাছ থেকে কেউ প্রত্যাশা করেননি। তাঁর এ ধরনের কার্যকলাপের দু'রকম প্রতিক্রিয়া হল। তাঁর মত লোকের পক্ষে তথাকথিত জাতীয়দলের এ ধরনের কান্ডজ্গ্জানহীন তোষামোদ দেখে জ্ঞানীগুণী সমাজের একাংশ চিন্তিত হয়ে উঠলেন, আরেক অংশের প্রতিরোধ ক্ষমতাও দুর্বল হয়ে এল। অন্যদিকে রাস্ট্রপতির সংগে তাঁর দহরম মহরম অন্যান্য উপাচার্য এবং সরকারসমর্থক শিক্ষা-সংস্কৃতির সংগে সংযুক্ত নেতৃ্শ্রনীর মনে ঈর্ষার উদ্রেক করেছিল তাতে সন্দেহ নেই। তিনি যদি রাস্ট্রপতির সংগে অতবেশী মাখামাখি করার সুযোগ আদায় করে ফেলেন, অন্যান্যদের সুযোগ-সুবিধে মাঠে মারা যাবার সম্ভাবনা। তাই অন্যান্যরাও উঠে পড়ে লাগলেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সর্বজন শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক আবুল ফজল ছাড়া আর সকল উপাচার্যই নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী এবং শিক্ষকদের জাতীয়দলে যোগ দেয়ার জন্য ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছিলেন। এ ব্যাপারে সরকার সমর্থক ছাত্রদল উপাচার্যদের সহায়তা দিয়ে আসছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জাতীয়দলে যোগদান করার জন্য যে জয়ভীতি এবং নানামুখী চাপরে সম্মুখীন হতে হয়েছিল, তা আমি খুব কাছে থেকে নিজের চোখে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছি। প্রতিটি অধ্যক্ষ বিভাগীয় শিক্ষকদের মধ্যে আবেদনপত্র বিলি করেছিলেন এবং সরকারি প্ররোচনায় তরুণতর শিক্ষকদের সই করতে অনেক ক্ষেত্রে বাধ্য করেছিলেন। অনেক শিক্ষকই স্বত:প্রবৃত্ত হয়ে সই করতে চাননি। কিন্তু হুমকি, ভীতি এবং চাপের মুখে তাঁদের বেশীরভাগই আত্নসমর্পন করতে বাধ্য হলেন। যে সকল শিক্ষক সই করেননি, তাঁদের নাম বাকশাল কেন্দ্রীয় অফিসে পাঠিয়ে দেয়া হল। সরকারসমর্থক ছাত্রদল এই বিদ্রোহী শিক্ষকদের দেশদ্রোহী হিসেবে খুব শিগ্গির ধরে নেয়া হবে বলে হুমকি দিয়ে গুজব ছড়াতে শুরু করল। এই জোর-জুলুম, ভয়-ভীতি, সন্ত্রাসের মধ্যে চৌদ্দই আগস্ট সন্ধ্যাবেলা দেখা গেল মাত্র পনেরজন শিক্ষক জাতীয়দলে সদস্যপদের আবেদন করে সই করেননি। বাকি সকল শিক্ষকদের সই সম্বলিত আবেদনপত্র সংগৃহীত হয়ে গেছে। আগামীকাল যখন রাস্ট্রপতি আসবেন, তখন প্রায় হাজারখানেক শিক্ষকের আবেদনপত্র তাঁর সকাশে দাখেল করা হবে। তিনি শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভাষন দেবেন এবং তাঁদের কাছে তাঁর নেতৃত্বের প্রতি একনিষ্ঠ সমর্থনের প্রতিশ্রুতি চাইবেন এবং শিক্ষকরাও হাত তুলে তিনি যা বলবেন তার প্রতি সমর্থন জানাতে বাধ্যা হবেন। এই পর্যন্ত সকলে তাই করছেন।
বাংলাদেশের আগ্নেয়আত্নার জ্বালামুখ বলে কথিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় চিন্তা, ভাবনা, বুদ্ধি এবং মননশীলতার নেতৃত্বদানকারী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোন শক্তিধর মানুষকে যা দেয়নি শেখ মুজিবুর রহমানকে সেই অকুন্ঠ আনুগত্য স্বেচ্ছায় প্রদান করবে। গোটা দেশের মানুষ অবাক বিস্ময়ে এই দৃশ্য দেখার জন্য বেদনাহত চিত্তে প্রতীক্ষা করছিল। রাস্ট্রপতির বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমন উপলক্ষে জাতীয় দৈনিকগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করছিল। রেডিও ঘনঘন সংবাদ দিচ্ছিল। টেলিভিষনে উপাচার্যের বিশেষ সাক্ষ্যাৎকার দেখানো হচ্ছিল। এ উপলক্ষে কি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়কে কিভাবে সাজানো গোছানো হয়েছে আনুপূর্বিক সমস্ত বিবরণ রেডিও, টেলিভিষন প্রচার করছিল। এই দিনটিকে ভাবগম্ভীর, পবিত্র এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণরুপে দেশের মানুষরে দৃষ্টিতে চিত্রিত করার জন্য পূর্ণপ্রয়াস গ্রহণ করা হয়েছিল। সরকারি প্রচারণার ধরণটা এমন ছিল যে-কোন রকমের বাধ্যবাধকতা ছাড়া স্বত:স্ফুর্তভাবে শেখ মুজিবুর রহমানকে এই এৈতিহাসিক সংবর্ধনা প্রদাণ করছে। পূর্বের একনায়করা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে যে রকম ছা্ত্রদের পূণ্জীভূত ক্ষোভ, আক্রোশ কোন না কোনো পথে ফেটে পড়ে, খুন, জখম, রক্তারক্তি কান্ড অবধারিত ঘটে যেত এবার সে সবের কোন লক্ষণ নেই। তিনি তো আর ওৌপনিবেশিক শাসনকর্তা নন, তিনি স্বয়ং বাঙালি জাতির পিতা। সুতরাং তিনি বিশ্ববিদ্যলয়ে আগমন করছেন, তার জন্য কেন বিক্ষোভ এবং অশান্তি হবে। বরন্চ এই মহানায়ককে আগামীকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা তাঁদের মধ্যে পাবেন এ আনন্দে সকলে বিভোর হয়ে আছেন। আগামীকাল উনিশ শ'পচাঁত্তর সালের পনেরই আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের একটি স্মরণী্য় দিন হয়ে বিরাজ করবে।
-- -- 00 -- -- -- -- 00 -- -- -- -- 00 -- -- -- -- 00 -- --
চোদ্দই আগস্ট সন্ধের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। শুনলাম কার্জন হলে এবং লাইব্রেরিতে বোমা ফুটেছে। পরিবেশটা থমথমে হয়ে এসেছে। উৎসবমুখর পরিবেশ হঠাৎ যেন কেমন থিতিয়ে এসেছে। মিনিটে মিনিটে পুলিশের গাড়ি টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। সকলের চোখেমুখে আশংকা। ছাত্রদের সিংহভাগ যাঁরা এই সুবিশাল এলাহিকান্ডের নীরব নিরুপায় দর্শক ছিলেন, তাদের মনের গতিটা অনুসরন করতে চেষ্টা করলাম। তাঁদের চোখমুখ দেখে মনে হল এ রকম একটা অভাবনীয় কান্ড ঘটায় সকলে যেন মনের গভীরে খুশি হয়েছে। হাতে পায়ে শেকল, শেকলের পর শেকল পরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বারুদ এবং আগুনের ভাষায় শেষ পর্যন্ত আসন্ন মূহূর্তটিতেই কথা কয়েছে। অর্থাৎ কোন স্বেচ্ছাচারীকেই এই পবিত্র বিদ্যাপীঠ কোনদিন অতীতে বরন করেনি এবং ভবিষ্যতেও বরণ করতে প্রস্তুত নয়।
কথাগুলো ভেবে নিয়েছিলাম আমি। মনের ভেতর একটা ভয়ার্ত আশংকাও দুলে উঠেছিল। দুয়েকটা বোমা ফুটেছে এই ভয়ে শেখ মুজিবুর রহমান আগামীকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা স্থগিত রাখবেন তিনি তেমন মানুষ নন। তুনি নিশ্চিতভাবেই আসবেনই। অপার শক্তিবলে মুখরা নগরীর স্পর্ধিত জিহ্বা যিনি স্তব্ধ করে দিয়েছেন, দুয়েকা বোমা ফুটলে কি তিনি সেই ভয়ে ঘরের কোনে চুপটি করে ভেজাবেড়ালের মত বসে থাকবেন? তাঁর প্রতি সবচেয়ে বিরুপ শ্রেণীটি আগামীকাল সকালে সদলবলে নতমস্তকে বসে থাকবেন? নাটকের এই রোমান্চকর দৃশ্যে তিনি কি করে অনুপস্থিত থাকতে পারেন? হয়ত আরো বোমা ফুটবে। পুলিশ ছাত্রাবাসসমুহের কক্ষে কক্ষে খানাতল্লাসী চালাবে, সন্দেহজনক কিছু ছাত্রদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে। কিন্তু তাঁর আসা বন্ধ হবে না।
রাতে হেটে ফিরছিলাম সাতাশ নম্বর সড়কের দিকে। মনে মনে এসব কথা তোলপাড় করছিল ভয়ংকরভাবে। শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘবাহু প্রসারিত করে সমস্ত দেশটাকে কঠিণ আলিংগনে আবদ্ধ করছেন, যা কিছু বাধা দিচ্ছে, প্রতিবাদ করছে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোন কথা নেই, কোনো বাধা নেই। বাংলাদেশের কন্ঠ একটি, সেটি শেখ মুজিবুর রহমানের ---- মানুষ ওই একজন, তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। ভয়ে দুরুদুরু করছিল বুক। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পনেরজন সই করেননি, তাঁদের অনেকেই আমার চেনাজানা বন্ধু-বান্ধব। তাঁদের অবস্থার কথা চিন্তা করছিলাম। তাঁদের কি হবে? তাঁদের কি চাকরি চলে যাবে? তাঁরা কি খাবেন? এই বাজারে বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে কিভাবে জীবনধারন করবেণ? তাঁদের কি পুলিশে তুলে নিয়ে যাবে? কি হতে পারে এই রাজদ্রোহিতার পুরষ্কার?
ভয়ন্কর চাপ অনুভব করছিলাম। একা একা হাঁটছিলাম। ভয়ানক একা বোধ করছিলাম। চারপাশের লোকজনের কারো সংগে আমার সম্পর্ক নেই, যেন কোনকালে ছিলও না। একা একা আমি যেন সুড়ংগ পথে বিচরন করছি। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল আমি ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আমি দেখে আসছি, কিভাবে আমার লালিত মূল্যবোধগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। লোভীর লোভ, প্রবলের অন্যায়কে এমনভাবে রুপ ধরে জেগে উঠতে আমি কোনোদিন দেখিনি। এত অশ্রুতে ভেজা, এতা গাঢ়রক্তে রন্জিত আমাদের স্বাধীনতা আমাদেরকে এমনভাবে প্রতারিত করছে প্রতিদিন, সে কথা কার কাছে যেয়ে বোঝাই। যাদেরকে মনের কথা ব্যক্ত করতে যাব, তাঁদের অবস্থাও আমার মত। এ কেমন স্বাধীনতা, যে স্বাধীনতা আমাদের গোটা জাতীটাকে সম্পূর্ন ভিখিরীতে পরিণত করে? এমন স্বাধীনতা যে স্বাধীনতায় আমরা একটা কথাও বলতে পারব না। চোখের সামনে সত্য মিথ্যের আকার নিচ্ছে। জলজ্যান্ত মিথ্যে নধর তাজা সত্যি হিসেবে এসে প্রতিদিন হাজির হচ্ছে। শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের গোটা জাতিটাকে নিয়ে কি করতে চান? তাঁর কথায় কথায় উঠে বসে এ জাতির তো আর কোনোকিছুই অবশিষ্ট নেই। এত অ্ত্যাচার দেখেছি, এত জমাট দু:খ দেখেছি, এত কাপুরুষতা দেখেছি এ জাতি আর মানুষের পর্যায়ে নেই। ক্রমশ পশুর নিচে চলে যাচ্ছি আমরা। দুর্নীতির জাতীয়করন করে সমাজজীবনের প্রতিটি স্তর তিনি বিষিয়ে তুলেছেন। এই জাতীর যা কিছু গভীর, যা কিছু পবিত্র, উজ্জ্বল এবং গরীয়ান বিগত তিন বছরে সমস্ত কিছু কলুষিত করে ফেলতে পেরেছেন।
তাঁর বাহিনী অশ্বমেধ যগ্জ্জের মত যদিকেই গেছে সবকিছু ভেঙেচুরে তছনছ করে ফেলেছে। শেষমেষ ছিল আমাদের একটা বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা ভাবতে শিখেছি, এই বিশ্ববিদ্যালয়ই স্বাধীনতা, শান্তি, কল্যাণ, প্রগতি, সাম্য এবং হরিৎবরণ আশা-আকাঙ্খার লালনক্ষেত্র। এইখানে এই বিশ্ববি্দ্যালয়ে এমন এক শন্কাহীন স্বাধীনতা নিবাস করেন, বিরাজ করেন এমন এক সুস্থশালীনতা আমাদের জ্ঞানদায়িনী মা বিশ্ববিদ্যায়ের অঙে অঙে এমন এক প্রসন্ন পবিত্রতার স্রোত প্রবাহিত হয়, কোন রাজন্য, কোন সমরনায়ক, কোন শক্তিদর্শী মানুষ কোনদিন তা স্থুল হস্তের অবলেপে কলন্কিত করতে পারেনি। আকাশের মত উদার, বাতাসের মত নির্ভর, অনির্বার ঝর্নার উৎসের মত স্বচ্ছ এবং সুনির্মল স্বত:স্ফুর্ত স্বাধীনতা এইখানে প্রতিদিন, প্রতিদিন বসন্তের নতুন মুকুলের আবেগে অন্কুরিত হয়।এই অন্কুঠিত স্বাধীনতার পরশমনির ছোঁয়ায় প্রতিটি আপদকালে এই জাতি বারেবারে নবীন হয়ে ওঠে। এর প্রতিষ্ঠাকালের পর থেকে আমাদের জন্মভুমির ওপর দিয়ে কতই না ঝড় বয়ে গেছে। কতবার ঘোড়ার খুরে, বন্দুকের আওয়াজে কেঁপে উঠেছে আকাশ, গর্বিত মিলিটারির বুটের সদম্ভ পদবিক্ষেপে চমকে উঠেছে রাত্রির হৃদয়। কত শাসক এল, কত মানুষ প্রাণ দিল। আমাদের এই ধৈর্যশীলা জ্ঞানদায়িনী মা সংহত মর্যাদার শক্তি, সাহস, বলবীর্য সবকিছু ফুরিয়ে যাবার পরেও শিখিয়েছে কি করে প্রতীক্ষা করতে হয়। নীরব ভাষায় মৌন আকাশের কানে কানে বারেবারে জানতে চেয়ে গেছে শক্তি, ক্ষমতা, দম্ভ এসবের পরিণতি কোথায়? ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অতন্রপ্রহরীর দল, তারা কোথায়? কোথায় মি. জিন্না, কোথায় নাজিমুদ্দিন, কোথায় নুরুল আমিন? জেনারেল আইয়ুব খান, আবদুল মোনেম খান, ইয়াহিয়া খান এই সমস্ত শক্তিদর্পী মানুষেরা আজ কোথায়? তাঁরা যে আতন্ক, যে ঘৃণা, যে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে এ দেশের জনপদবাসীর জীবনধারায় ঘুর্ণিঝড়ের সুচনা করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কি আপন সন্তানদের তার আর্তি থেকে বেরিয়ে আসার প্রেরনা দেয়নি?
20-09-1975
আহমদ ছফা
collected from the book Shei Shob Lekha, 2008
compiled and edited by Nurul Anwar
Khan Brothers & Co.
মুজিবের শাসন: একজন লেখকের অনুভব - আহমদ ছফা - ৩
☼→
মুজিব
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: