দশম অধ্যায় : সুদূর প্রসারী পরিবর্তন প্রয়োজন

কিভাবে ইসলামের দাওয়াত পেশ করতে হবে


মানুষকে ইসলাম গ্রহণ করার জন্য আহবান করার সময় প্রতিপক্ষ মুসলমান হোক কিংবা অমুসলমান, আমাদের একটি বিষয় সর্বদায় মনে রাখতে হবে। এ বিয়টি ইসলামের প্রকৃতির মধ্যেই প্রচ্ছন্ন রয়েছে। ইসলামের ইতিহাস থেকেও বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। সংক্ষেপে বিষয়টি হচ্ছে এই যে, ইসলাম মানব জীবন ও বিশ্বপ্রকৃতির সম্পর্ক যে ধারণা বিশ্বাস থেকে উদ্ধুত জীবন বিধান তার সকল শাখা প্রশাখা সহ অন্যান্য জীবনাদর্শ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। জীবন সম্পর্কিত ইসলামী ধারণা-বিশ্বাস প্রাচীন ও আধুনিক সকল প্রকার জাহেলিয়াতের বিরোধী। অবশ্য জীবন বিধানের ভিত্তিতে বিস্তারিত ব্যবস্থা প্রণয়নের সময় জাহিলিয়াতের কোন কোন বিষয় ইসলামের কোন কোন বিষয়ের সাথে সাদৃশাত্মাক হতে পারে। কিন্তু যে মৌলিক ধারণা –বিশ্বাস থেকে এসব বিস্তারিত বিধান রচনা করা হয় তা বরাবরই জাহেলিয়াতের সম্পূর্ণ বিপরীত। মানুষের জ্ঞাত সকল প্রকার জীবনাদর্শই ইসলামী জীবন দর্শনের দৃষ্টিত জাহেলিয়াত।

ইসলামের প্রথম কাজ হচ্ছে তার নিজস্ব ঈমান –আকীদার ভিত্তিতে মানুষের জীবন যাত্রার পরিবর্তন সাধন করে নিজস্ব ছাঁচে গড়ে তোলা, আল্লাহ তাআলার দেয়া একটি বাস্তবমূখী জীবন বিধান অনুসারে মানব সামজের চলার পথ নির্দেশ করা। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাতকে মানব সমাজের জন্যে এক বাস্তব নমুনা হিসেবে পেশ করেছেন। তিনি বলেন—


-------------------------------------------------------------------------------------------

“তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মাত— মানব সমাজের কল্যাণ সাধনের জন্য তোমাদের উত্থিত করা হয়েছে। তোমরা নেকীর আদেশ দাও এবং অন্যায় থেকে মানুষকে বিরত রাখ। আর নিজেরা আল্লাহর উপর ঈমান রাখ।”

-------------------------------------------------------------------------------------------

(এরা হচ্ছে ঐ দল) যাদেরকে ভূপৃষ্ঠে ক্ষমতাদান করলে তারা সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয়, সৎকাজের আদেশ দান করে এবং অসৎকাজ থেকে বিরত রাখে।” — আল হজ্জ: ৪১

ইসলাম দুনিয়ায় প্রচলিত জাহেলিয়াতের সাথে কোন আপোষ রফা অথবা জাহেলিয়াতের পাশাপাশি সহঅবস্থানের নীতি গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। দুনিয়ায় যেদিন সে প্রথম অবতীর্ণ হয়েছিল সেদিনই সে জাহেলিয়াতের সাথে আপোষ বা সহঅবস্থান করতে রাযী হয়নি— আজকের দুনিয়াতেও রাযী নয় এবং ভবিষ্যতেও কখনো রাযী হবে না। জাহেলিয়াত যে যুগেরই হোক না কেন, তা জাহেলিয়াত ছাড়া আর কিছুই নয়। আর জাহেলিয়াতের অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তাআলার বন্দেগী পরিহার এবং আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধানের প্রতি বিদ্রোহ ঘোষণা করা। আল্লাহর পরিচয়হীন অন্ধকার উৎস থেকে জীবন যাপনের রীতিনীতি, আইন-কানুন ও ব্যবস্থা পত্র গ্রহণ করাই জাহেলিয়াতের ধর্ম। অপরদিকে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ এবং জাহেলিয়াত পরিত্যাগ করে আল্লাহর দেয়া জীবন বিধানের দিকে ছুটে আসার জন্য আহবান জানানোই ইসলামের প্রকৃতি।

ইসলাম কোন যুগ ও কালের গণ্ডীতে আবদ্ধ নয়— বরং সকল যুগ ও সকল কালেই এ জীবন বিধান মানুষের জন্য কল্যাণকর। মানুষকে নিয়ে আসাই ইসলামের উদ্দেশ্য। আর স্পষ্ট ভাষায় বলতে হয়, নিজেদেরই ইচ্ছা মত মানুষের বন্দেগী করতে রাযী হয়ে যাওয়াই জাহেলিয়াত। অর্থাৎ কিছু সংখ্যক শক্তিশালী লোক গায়ের জোরে আল্লাহর দেয়া বিধান পরিত্যাগ পূর্বক নিজেদের খেয়াল খুশী মোতাবিক আইন-কানুন রচনা করে সমাজের উপর চাপিয়ে দেয় এবং সমাজ তা মেনে নিয়ে আইন প্রণেতাদের বান্দা হয়ে যায়। ইসলাম বলে, সমগ্র মানব গোষ্ঠী এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর বন্দগী করবে এবং সকল আকীদা-বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা, আইন-কানুন, গ্রহণ ও বর্জনের মানদণ্ড ইত্যাদি একমাত্র আল্লাহরই নিকট থেকে গ্রহণ করেব। সৃষ্ট জীবের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে শুধু আল্লাহরই অধীন হয়ে জীবন যাপন করবে।
ইসলামের প্রকৃতিই এরূপ। দুনিয়ায় ইসলাম যে ভুমিকা পালন করছে তা থেকেই আমাদের একথার পরিস্কার পাওয়া যায়। ভবিষ্যতেও সে একই ভূমিকা পালন করবে। আমরা মুসলামান –অমুসলমান নির্বিশেষে যাদের সামনেই ইসলামের বাণী পেশ করবো।, তাদের নিকট ইসলামের উপরোক্ত ভূমিকাও অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরবো।

আকীদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে হোক অথবা জীবন –বিধানের ক্ষেত্রে ; ইসলাম জাহেলিয়াতের সাথে কোন আপোষ –রফা করতে প্রস্তুত নয়। এক সাথে এক স্থানে, হয় ইসলাম থাকবে অন্যথায় জাহেলিয়াত। অর্ধেক ইসলাম ও অর্ধেক জাহেলিয়াত মিলেমিশে থাকার কোন ব্যবস্থাই ইসলাম নেই। এ ব্যাপারে ইসলামের বক্তব্য অত্যন্ত সুষ্পষ্ট। সে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করে যে, মহাসত্য একটি অবিভাজ্য একক। যেখানে মহাসত্যের ধারক-বাহক কেহই নেই সেখানে মিথ্যা বা জাহেলিয়াত রয়েছে। সত্য ও মিথ্যা অথবা হক ও বাতিলের সংমিশ্রণ, আপোস অথবা সহ-অবস্থানের কোনই অবকাশ নেই। হয় আল্লাহর আদেশ মেনে চলতে হবে, না হয় জাহেলিয়াতের — হয় আল্লাহর শরীয়াত সমাজে বাস্তবায়িত হবে অন্যথায় মানুষের খেয়াল –খুশি ও স্বেচ্ছাচারের রাজত্ব চলবে। কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

-------------------------------------------------------------------------------------------

“(হে নবী !) আল্লাহর নাযিল করা বিধান মুতাবিক তাদের মধ্যে বিচার ফায়সালা কর এবং তাদের খেয়াল খুশির প্রতি কোন গুরুত্ব দিও না। তাদের সম্পর্কে সতর্ক থাক, অন্যথায় তারা তোমাদের আল্লাহর নাযিল করা বিধান থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে বিভ্রান্তিতে নিক্ষেপ করবে।” — মায়েদা: ৪৯

---------------------------------------------------------

“এ সত্যের প্রতি তাদের আহবান করে যাও এবং তোমাদের যেরূপ আদেশ করা হয়েছে তদনুসারে অটল হয়ে থাক এবং তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না।” —শুরা:১৫

-------------------------------------------------------------------------------------------

“যদি তারা তোমার ডাকে সাড়া না দেয় তাহলে জেনে রাখো, তারা নিজেদের খেয়াল-খুশিরই অনুসরণ করছে। যে ব্যক্তি আল্লাহর হেদায়াতের পরোয়া না করে নিজেদের খাহেশের অনুসরণ করে, তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে হতে পারে? আল্লাহ কখনো যালিমদের হেদায়াত দান করেন না।” — আল আসাস: ৫০



“(হে নবী!) আমি তোমাকে একটি স্পষ্ট শরীয়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছি। সুতরাং এ শরীয়াত মেনে চল এবং অজ্ঞ লোকদের খেয়াল-খুশির অনুকরণ করো না। আল্লাহর অসন্তুষ্টির মুখে তারা তোমার কোন উপকারেই আসবে না। অবশ্যই যালিমরা পরস্পরের বন্ধ আর আল্লাহ পরহেযগারদের পৃষ্ঠপোষক।” — আল জাসিয়া: ১৮-১৯

--------------------------------------------------------------------------------------------

“তারা কি জাহেলিয়াতের বিচার –ফায়সালা চায়। অথচ আল্লাহর প্রতি যারা ঈমান আনয়ন করেছে তাদের জন্যে আল্লাহর চেয়ে উত্তম সিদ্ধান্তকারী কে হতে পারে?” —আল মায়েদা: ৫০

এসব আয়াত থেকে বুঝা গেল যে, পথ মাত্র দু’টিই রয়েছে। তৃতীয় কোন পথ নেই। হয় আল্লাহ ও রাসূল (সা) –এর নির্দেশ মেনে নিতে হবে। অন্যথায় নফসের খাহেশ মুতাবিক জীবন যাপন করতে হবে। হয় আল্লাহর ফায়সালা মেনে নিতে হবে অন্যথায় জাহেলিয়াতের সামনে মাথা নত করতে হবে। আল্লাহর নাযিল করা বিধানকে সকল বিষয়ে মীমাংসার মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ না করার অনিবার্য পরিণতি হবে আল্লাহর নির্দেশ পরিহার ও অমান্য করা। আল্লাহর কিতাবে উপরোক্ত আয়াতগুলোর উল্লেখ থাকার ফলে এ বিষয়ে আর কোন বির্তকের অবকাশ মাত্র নেই।

ইসলামের প্রকৃত লক্ষ্য


উপরের আলোচনা থেকে পরিস্কারভাবে বুঝা গেল যে, দুনিয়ায় ইসলামের প্রধান কাজ হচ্ছে মানব সমাজের নেতৃত্ব থেকে জাহেলিয়াতের উচ্ছেদ সাধন করে নেতৃত্বের রশি নিজ হাতে গ্রহণ করা এবং ক্রমে ক্রমে তার বৈশিষ্ট্যময় স্বাতন্ত্রের অধিকারী নিজস্ব জীবন বিধান কার্যকরী করা। এ সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবতার কল্যাণ সাধন ও উন্নয়ন। স্রষ্টার নিকট নতি স্বীকার এবং মানুষ ও সৃষ্টজগতের মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপনে মাধ্যমেই এ উদ্দেশ্য পূরণ হতে পারে। এ দ্বীনের লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে আল্লাহ তাআলার বাঞ্ছিত উচ্চ মর্যাদায় পৌছে দেয়া এবং তাকে নফসের দাসত্ব থেকে মুক্ত করা। হযরত রাবী বিন আমর (রা) পারস্য সেনাপতি রুস্তমের প্রশ্নের জবাব দান প্রসঙ্গে এ লক্ষ্যের বিষয়ই উল্লেখ করেছিলেন। রুস্তম জিজ্ঞেস করেছিলো, “তোমরা এখানে কেন এসেছ?” রাবী (রা) বলেছিলেন, “আল্লাহ তাআলা এ দায়িত্ব অর্পন করেছেন যেন আমরা মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে আল্লাহর বন্দেগীতে নিয়োজিত করতে পারি। দুনিয়ার সংকীর্ণ স্বার্থের গোলামী থেকে মানুষকে বের করে নিয়ে দুনিয়া ও আখেরাতের প্রশস্ত ক্ষেত্রের সন্ধান দান করতে পারি। আর মানুষের রচিত জীবন বিধানের কঠোর বন্ধন ছিন্ন করে যেন তাদের ইসলামী ন্যায়-নীতির সুফল ভোগ করার সুযোগ করে দিতে পারি।”

মানুষ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মতবাদ ও ভাবধারার আকারে নিজের প্রবৃত্তির বাসনাকে তুলে ধরে। ইসলাম এসব অজ্ঞতাপ্রসূত মতবাদ ও ভাবধারার সমর্থন যোগানোর জন্য নাযিল হয়নি। ইসলামী দাওয়াতের সূচনাতেই এ জাতীয় মতবাদ ও দৃষ্টিভংগী বিরাজমান ছিল। আজকের দুনিয়ায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় অঞ্চলেই মানব প্রবৃত্তি রচিত মতবাদ বিরাজ করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। ইসলাম কখনো স্বার্থপর মানুষের রচিত ধ্যান-ধারণা, আইন –কানুন ও রীতিনীতির মূলোচ্ছেদ করে মানব জীবন সম্পর্কে নতুন আকীদা-বিশ্বাস গড়ে তোলার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার সমীপে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের ভিত্তিতে এক নতুন জগত সৃষ্টি করতে এসেছে। কোন কোন সময় ইসলামের বিশেষ কোন অংশকে জাহেলিয়াতের সাথে সঙ্গতিশীল মনে হয়। কিন্তু আসলে সে অংশগুলো জাহেলিয়াত অথবা জাহেলিয়াতের অংশ নয়। ছোটখাটো বিষয়ে এ ধরনের সাদৃশ্য নেহায়েতই আকস্মিক ব্যাপার। প্রকৃতপক্ষে উভয় আদর্শের উৎসমূল পরস্পর বিরোধী। ইসলামরূপী বিশাল বৃক্ষটির বীজ বপন, অংকুরোদগম ও ক্রমবিকাশের মাধ্যমে পূর্ণত্ব লাভ ঘটেছে আল্লাহর জ্ঞানের উৎস থেকে। পক্ষান্তরে জাহেলিয়াতের জন্ম হয়েছে মানুষের স্বার্থপর মানসিকতার আবর্জনাময় স্থানে।

-------------------------------------------------------------------------------------------

“ভাল জমি আল্লাহর অনুমতিক্রমে উত্তম ফসল উৎপন্ন করে। পক্ষান্তরে খারাপ জমিতে অতি সামান্যই ফসল জন্মে।” — আরাফ: ৫৮

আধুনিক কিংবা প্রাচীন যাই হোক না কেন, জাহেলিয়াত অপবিত্র ও বিভ্রান্তিকর। বিভিন্ন যুগে তার রূপ ও বেশ ভূষা পরিবর্তিত হলেও তার মূল সর্বদা-ই স্বার্থপর মানুষের খেয়াল –খুশির আবর্জনায় প্রেথিত। জাহেলিয়াত কখনো অজ্ঞতা ও ব্যক্তি স্বার্থের গণ্ডী থেকে বের হতে পারে না। খুব বেশী হলে সে মুষ্টিমেয় মানুষ, বিশেষ শ্রেণী, বিশেষ গোত্র অথবা বিশেষ জাতির স্বার্থরক্ষার আবর্তেই ঘুরপাক খেতে বাধ্য হয়। ফলে, সত্য ও ন্যায়-নীতি, সুবিচার ও শুভেচ্ছার উপর স্বার্থপরতা প্রাধান্য বিস্তার করে। কিন্তু আল্লাহর দেয়া আইন এসব স্বার্থপরতার শিকড় ছিন্ন করে দিয়ে পক্ষপাতহীন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। মানুষের অজ্ঞতা, স্বার্থপরতা ও প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। কোন দল, শ্রেণী বা গোত্রীয় স্বার্থ লিপ্সা ইসলামী আইনের নিকটবর্তী হতেও পারে না।

আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থা ও মানব রচিত বিধানের মৌলিক পার্থক্য এখানেই। তাই এ পরস্পর বিরোধী আদর্শের একত্র অবস্থান সম্পূর্ণ অসম্ভব। সুতরাং আংশিক ইসলাম ও আংশিক জাহেলিয়াতের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নতুন কোন মতবাদ সৃষ্ট করার চেষ্টা বাতুলতা মাত্র। আল্লাহ তাঁর নিজের সত্তার সাথে শিরক করার অপরাধ যেমন ক্ষমা করতে রাজী নন, তেমনিভাবে তিনি তাঁর দেয়া জীবন বিধানের সাথে অন্য কোন মানবরচিত বিধানের সংমিশ্রণও পসন্দ করেন না। এ উভয় অপরাধ তাঁর দৃষ্টিতে সমান। আর সত্য কথা এই যে, উভয় ধরনের মনোবৃত্তি একই উৎস থেকে জন্ম নেয়।

ইসলামের প্রতি মানুষেকে আহবান জানানোর সময় আমাদের মন-মগযে ইসলাম সম্পর্কে উপরোল্লিখত ধারণা ও বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে যেতে হবে। কারণ, ইসলামের দাওয়াত পেশ করার সময় আমাদের জিহবায় কোন সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ থাকা চলবে না। বরং দৃঢ় মনোবল সহকারে প্রতিপক্ষকে স্বীকার করিয়ে নিতে হবে যে, ইসলামী জীবন বিধান গ্রহণ করার পর মানব জীবন নতুন রূপ ধারণ করবে। ইসলাম তাদের আকীদা-বিশ্বাস, চাল-চলন, রীতিনীতি, আচার –ব্যবহার ও চিন্তা-ভাবনা পদ্ধতি আমূল পরিবর্তন করে দেয়। এ পরিবর্তনের ফলে তারা অপরিমিত কল্যাণ লাভ করবে। মানুষকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, ইসলাম তাদের ধ্যান-ধারণা ও আচার-ব্যবহারকে মার্জিত করে তাদেরকে মানবসূলভ উচ্চ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করবে। ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবার পর ছোটখাটো দু’একটি বিষয় ছাড়া জাহেলিয়াতের কোন কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। ঘটনা চক্রে যে দু’একটি নগণ্য ধরনের বিষয় ইসলামী আদর্শের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বিবেচিত হয় শুধু সেগুলোই টিকে থাববে মাত্র। তবে এগুলোও হুবুহু আগের মতই বহাল থাকবে না। বরং ইসলামী আদর্শের সাথে সংযুক্ত হবার ফলে এদের প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়ে যাবে। তখন ঐসব বিষয় সমাজে জাহেলিয়াত বিস্তারের সহায়তা করবে না। মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে চিন্তা-গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা যা কিছু হাসিল করেছে, ইসলাম তা বাতিল করে দেবে না। বরং এসব বিষয়ে আরও উন্নতি সাধনের চেষ্টা করবে। জনসমক্ষে বক্তব্য পেশ করার সময় ইসলামের বাণীবাহকদের সতর্কতা অবলন্বন করতে হবে যেন মানুষ ইসলামকেও একটি মানব রচিত জীবন বিধান বিবেচরনা করার ভ্রান্ত ধারণায় নিমজ্জিত না হয়। তারা যেন মনে না করে যে, বিভিন্ন যুগে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে আত্মপ্রকাশকারী মানব রচিত জীবন বিধানগুলোর মত ইসলামও একটি মানব রচিত আদর্শ মাত্র। বরং একথা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে হবে যে, ইসলাম স্থায়ী বৈশিষ্ট্যের অধিকারী একটি স্বতন্ত্র জীবন বিধান। এ জীবন বিধানের আছে নিজস্ব আকীদা-বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণা,রয়েছে তার স্বতন্ত্র জীবন যাত্রা প্রণালী। ইসলাম মানবতাকে যে কল্যাণ দান করতে চায়, তা মানবের স্বকপোলকল্পিত জীবন বিধানগুলোর তুলনায় অনেক বেশী মূল্যবান। ইসলাম মহান, উজ্জল, নির্ভেজাল ও ন্যায়নীতি ভিত্তিক জীবন বিধান। মহান আল্লাহ তাআলার অসীম জ্ঞান ভাণ্ডার হচ্ছে তার উৎস।

আমরা যখন ইসলামের সারকথা সঠিকভাবে উপলব্ধি করবো, তখন এ উপলব্ধিই আমাদের মনে পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাস ও ধৈর্য সৃষ্টি করবে। আমরা ইসলামের প্রতি মানুষকে আহবান করার সময় তাদের প্রতি পরিপূর্ণ মাত্রায় সহানুভুতিশীল হতে পারবো। আমাদের আত্মবিশ্বাস হবে এমন এক ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস যার এ বিষয়ে দৃঢ় প্রত্যয় রয়েছে যে, ইসলামই সত্য এবং ইসলাম বহির্ভূত সবকিছুই ভ্রান্ত। মানুষকে বিভ্রান্তি ও দুর্ভোগ্যজনক অবস্থায় দেখে আমাদের মনে তাদের জন্যে সহানুভুতি ও কৃপার মনোভাব সৃষ্টি হবে। মানুষকে ভুল পথে জীবন যাপন করতে দেখে তাদের জন্য আমাদের মনে করুণার উদ্রেক হবে। কারণ আমরা তাদের উদ্ধারের উপায় অবগত আছি।

ইসলামের প্রকৃতি সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি হাসিল করার পর পথভ্রষ্ট মানুষের রুচি ও ধারণারন সাথে সামঞ্জস্য স্থাপনের জন্য ইসলামী নীতির কোন রদ-বদল করার প্রয়োজন নেই। আমরা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় মানুষকে বলবো, “তোমরা যে জাহেলিয়াতে নিমজ্জিত রয়েছ তা অপবিত্র। আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে চান। তোমরা যে পরিবেশে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করছ তা অত্যন্ত বিষাক্ত ; আল্লাহ এ পরিবেশকে নির্মল করতে চান। পার্থিব ভোগ-লিপ্সা লিপ্ত তোমাদের বর্তমান জীবন। অত্যন্ত অধপতিত জীবন। আল্লাহ তাআলা তোমাদের অনেক উচ্চ মর্যাদা দান করতে ইচ্ছুক। তোমরা দিবা-রাত্র লাঞ্ছনা ও অপমানজনক আবস্থায় কাটাচ্ছ। আল্লাহ তাআলা তোমাদের জীবন যাত্রাকে সহজ-সরল ও সৌভাগ্যমণ্ডিত করতে চান। ইসলাম তোমাদের মতবাদ ও দৃষ্টিভংগী পরিবর্তন করবে এবং তোমাদের বাস্তব জীবনেও পরিবর্তন আনয়ন করবে। তোমরা ইসলামের সংস্পর্শে নতুন মূল্যবোধ লাভ করবে। তোমাদের জীবন যাত্রার মান এমন উন্নত পর্যায় পৌছে যাবে যে, তোমরা নিজেরাই বর্তমান জীবন যাত্রার অসারতা ও হীনতা উপলব্ধি করতে পারবে। তোমাদের দৈনন্দিন জীবনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসার পর দুনিয়ার হাল-হকিকতের প্রতি তোমাদের মনে ঘৃণার উদ্রেক হবে। ইসলাম তোমাদের যে সভ্যতার সাথে পরিচিত করাবে তার সংস্পর্শে আসার পর বর্তমান দুনিয়ায় প্রচলিত তথাকথিত সভ্যতার কাঠামোকে মানব সমাজে জারী রাখা অত্যন্ত কলংকজনক বিবেচনা করবে। দুর্ভাগ্যজনক কারণে তোমরা ইসলামের প্রকৃতরূপ চোখে দেখতে পাচ্ছ না। কারণ ইসলামের শত্রুগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমাজে ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়নের পথ রোধ করে দাড়িঁয়ে আছে। এসো, আমরা তোমাদের ইসলামী আদর্শের সত্যিকার রূপের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহে আমাদের অন্তর রাজ্যে ইসলামী আদর্শের পূর্ণ চিত্র অংকিত হয়ে রয়েছে। আমরা কুরআন, শরীয়াত ও ইতিহাসের গবাক্ষ পথে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ চিত্র দেখতে পেয়েছি। উজ্জল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের মনে কোন সন্দেহ নেই।”

ইসলামের বাণী পেশ করার সময় আমাদের উপরোক্ত ধরনের কথা বলতে হবে। ইসলামের প্রকৃতি ও গতিধারাই এরূপ। এভাবেই প্রথম যুগে ইসলাম মানুষের সামনে এসেছিল। আরব উপদ্বীপ, পারস্য, রোম ও যেসব ভুখণ্ডেই ইসলাম প্রবেশ করেছে, সেখানেই উপরোক্ত ভংগীতে তার দাওয়াত পেশ করা হয়েছিল।

ইসলাম অতি উচ্চস্থান থেকে মানব সমাজের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। কারণ প্রকৃতপক্ষেই তার স্থান উচ্চে। ইসলাম দরদভরা সূরে মানুষের সামনে বক্তব্য রেখেছে। কারণ তার স্বভাবেই মানবতার প্রতি দরদ রয়েছে। ইসলাম অত্যন্ত পরিস্কার ভাষায় মানুষের সকল বিষয় বুঝিয়ে দিয়েছে। তার উপস্থাপিত বাণীতে কোন অস্পষ্টতা ছিল না। যে কখনো মানুষকে এ মিথ্যা আশ্বাস দেয়নি যে, ইসলাম গ্রহণের পর তাদের জীবন পরিবর্তিত হবে না। তাদের চাল-চলন, উঠা-বসা, রীতিনীতি, ধারণা-বিশ্বাস ও মূল্যবোধ পূর্বের মতই বহাল রেখে সামান্য রদ-বদল করলেই চলবে বলে কখনো বলা হয়নি। সামজে প্রচলিত অন্যান্য মতবাদের সাথে ইসলাম কখনও নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার প্রস্তাবই পেশ করেনি। আজকাল ‘ইসলামী গণতন্ত্র’ ‘ইসলামী সমাজতন্ত্র’ ইত্যাদি নাম ব্যবহার করে অথবা প্রচলিত অর্থনীতি, রাজনীতি ও আইন-কানুন অপরিবর্তিত রেখে যারা ইসলাম প্রবর্তনের ধূয়া তুলেছে তারা প্রকৃতপক্ষে ভ্রান্ত মতাদর্শ বিশ্বাসী লোকদের খেয়াল-খশীর সাথে ইসলামের আপোষ করে নেয়ার কথাই বলছে।

প্রকৃতপক্ষে ইসলাম সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের আদর্শ। সমগ্র দুনিয়ার বিরাজমান জাহেলিয়াতের মূলোচ্ছেদ করে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য সূদুর প্রসারী ও ব্যাপক পরিবর্তনের প্রয়োজন। প্রাচীন ও আধুনিক যুগে প্রচলিত সকল ধরনের জাহেলিয়াতই ইসলামী আদর্শ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। বর্তমান যুগে মানুষ যে দুরবস্থায় জীবন যাপন করছে, তা থেকে তাদের উদ্ধার করা খুব সহজ সাধ্য কাজ নয়। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় মামুলী ধরনের রদ-বদল করে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না। লাঞ্ছিত ও দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থা থেকে মানবতার উদ্ধার সাধনের জন্য ব্যাপক ও সুদূর প্রসারী বিপ্লব প্রয়োজন। মানুষের রচিত সকল জীবনাদর্শের মূলোৎপাটন করে দুনিয়ার বুকে আল্লাহ প্রদত্ত বিধান জারী করতে হবে। মানুসকে মানুষের শাসন থেকে উদ্ধার করে বিশ্ব স্রষ্টার শাসনাধীনে আনয়ন করতে হবে। এটাই হচ্ছে মুক্তির সঠিক উপায়, একথা আজ স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করতে হবে। এ বিষয়ে মানুষের মনে কোন সন্দেহ –সংশয়ের লেশমাত্র থাকা চলবে না।

সূচনায় এ ধরনের স্পষ্ট ঘোষণার ফলে মানুষ কিছুটা অসন্তুষ্ট হতে পারে— ইসলাম সম্পর্কে তাদের মনে কিছুটা ভয় সৃষ্টি হওয়া এবং এ জন্যে তাদের কিছুটা দূরে সরে থাকাও বিচিত্র নয়। প্রকৃতপক্ষে রাসূলুল্লাহ (সা) –এর কালে এরূপ হয়েছিল। মানুষ ইসলামের বানী শুনে ভয় পেয়েছিল। কারণ তিনি তাদের আকীদা-বিশ্বাসের সমালোচনা করতেন, তাদের দেব-দেবীদের বিরোধিতা করতেন, তাদের রীতিনীতিগুলোকে বাতিল করে দেন এবং তাদের সামাজিক আচার-আচরণ পরিত্যাগ করে তিনি নিজের ও তাঁর অনুসারীদের জন্য সমাজে প্রচলিত রীতিনীতির বিরোধিতা করে নতুন ধরনের রীতিনীতি, আচার –ব্যবহার ও মূল্যবোধ বির্ধারণ করে নিয়েছিলেন।

পরিণামে কি হয়েছিল? যারা প্রথমে মহাসত্যের বাণী শুনে দূরে সরে গিয়েছিল, তারাই ফিরে এসে শান্তির নীড়ে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের পলায়ন ছিল কুরআনে বর্ণিত সিংহের ভয়ে গর্দভের পলায়নেরই মত।

-----------------------------------------------------
“তারা যেন ভয়প্রাপ্ত গর্ধভ, সিংহের ভয়ে দ্রুত ধাবমান।” —মুদ্দাস্‌সির: ৫০-৫১

এ দাওয়াতের বিরোধিতায় তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। যারা ইসলামকে মেনে নিয়েছিল তাদের জন্য মক্কায় বসবাস করা অসম্ভব করে তুলেছিল। নিত্য-নুতন অত্যাচার ও নিষ্ঠুর আচরণে তাদের জীবন দুর্বিসহ করে দিয়েছিল এবং মদীনায় হিজরাত করার পর মুসলমানদেরকে ক্রমশ শক্তিশালী হতে দেখে বিরোধী মহল আক্রমণের পর আক্রমণ চালিয়ে তাদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল।
সাফল্যের চাবিকাঠি


রাসূলুল্লাহ (সা) –এর যুগে ইসলামী আন্দোলনকে যে প্রতিকুল অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, তা আজকের তুলনায় মোটেই কম ছিল না। ইসলামের বাণী সে যুগের লোকদের নিকট অদ্ভত মনে হয়েছিল। তাই তারা সাথে সাথেই এ মতবাদকে প্রত্যাখান করেছিল। ইসলামকে মক্কার পাহাড়ী উপত্যকায় অন্তরীণ করা হয়েছিল। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আন্দোলনের তীব্র বিরোধীতা শুরু করেছিল। ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসের ঘোরতর বিরোধী অত্যাচারী শাসকবৃন্দ আরবের চতুর্দিকে জেঁকে বসেছিল। কিন্তু তবু ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে ছিল এক আকর্ষণীয় শক্তি। আজও তা পূর্বের মতই শক্তিশালী আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এ দাওয়াতের মূলশক্তি তার ঈমানের মধ্যেই লুক্কায়িত রয়েছে। এ জন্যেই ঘোরতর বিরোধিতা এবং শত্রুতার মুখেও এ দ্বীনের দাওয়াত অব্যাহত গতিতে এগিয়ে যায়। ইসলামের সহজ-সরল আলোকোজ্জল বাণীই তার শক্তির উৎস।

মানুষের প্রকৃতির সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ আকীদা-বিশ্বাসই হচ্ছে তার সাফল্যের চাবিকাঠি। অর্থনৈতিক, সামাজিক,বৈজ্ঞানিক এবং বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে মানুষ যে পরিমাণ পশ্চাদপদই থাকুক না কেন, ইসলাম তাদেরকে নিজ নিজ স্তর থেকেই ক্রমোন্নয়নের পথ দেখিয়ে উন্নতির চরম শিখরে পৌছে দেয়। তার অলৌকিক ক্ষমতা বলে ইসলাম জাহেলিয়াতের বিভ্রান্তিকর মতাদর্শ ও তার বৈষয়িক শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে এবং নিজের জীবনাদর্শ থেকে একটি বর্ণও পরিবর্তন করতে সম্মত হয় না। সে জাহেলিয়াততের সাথে কখনও কোন আপোষ করে না এবং কোন খোঁড়া যুক্তির আশ্রয় নিয়ে বাতিলের সাথে সহঅবস্থানের নীতি অবলন্বন করে না। সে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তার পরিপূর্ণ বক্তব্য সমাজের সম্মুখে এক সাথেই পেশ করে দেয় এবং তাদের জানিয়ে দেয় যে, এ দ্বীনের বাণীতে রয়েছে কল্যাণ, রহমাত ও বরকত।

আল্লাহ তাআলা মানুষের স্রষ্টা। তাই তিনি তাদের মন-মগজ ও অন্তরের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে ভালভাবেই অবগত আছেন। তিনি জানেন যে, সত্যের এ মহান বাণী বিনা দ্বিধায়,স্পষ্ট ভাষায় এবং বলিষ্ট পদ্ধতিতে মানুষের সমাজে পেশ করে দিলেই তা সরাসরি তাদের অন্তরে স্থান দখল করে নেয়।
মানুষ এক ধরনের জীবনযাত্রা ছেড়ে অন্য ধরনের জীবনযাত্রা গ্রহণ করে নেয়ার যোগ্যতা সম্পূন্ন এক সৃষ্টি এবং আংশিক পরিবর্তনের তুলনায় পরিপূর্ণ জীবনযাত্রা পরিবর্তন করে নেয় তার পক্ষে অনেক ক্ষেত্রে অধিকতর সহজ। তাই পূর্বের জীবনযাত্রার তুলনায় অধিকতর পূর্ণাঙ্গ ও পবিত্র জীবন বিধানের দিকে এগিয়ে যাওয়া মানুষের প্রকৃতির সাথে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু ইসলাম যদি জাহেলিয়াতের মধ্য থেকে মামুলী ধরনের দু’একটি বিষয় পরিবর্তন করেই সন্তুষ্ট থাকে, তাহলে মানুষের পক্ষে জাহেলিয়াত পরিত্যাগ করে ইসলামের দিকে ছুটে আসার কোন যৌক্তিকতাই থাকে না। এ অবস্থায় তো পুরাতন ব্যবস্থার উপর সন্তুষ্ট থাকাই অধিকতার সঙ্গত। কারণ পুরাতন ব্যবস্থা সমাজে প্রতিষ্ঠিত এবং মানুষ এ ব্যবস্থায় সাথে বিশেষভাবে পরিচিত। প্রয়োজনবোধে পুরাতন ব্যবস্থায় কিছুটা সংশোধন করে নেয়াও দুঃসাধ্য নয়। এমতাবস্থায় যদি পুরাতন জীবন বিধান ও নতুন জীবন বিধানের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য না থাকে, তাহলে প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থা পরিত্যাগ করে নতুন সমাজ ব্যবস্থা গ্রহণ করার কোনই স্বার্থকতা নেই।
সাফাই পেশ করার প্রয়োজন নেই


কোন কোন ইসলাম দরদী দ্বীনের সমর্থন যেসব বক্তব্য পেশ করেন, তা শুনে মনে হয় যে, ইসলাম আসামীর কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান এবং বক্তা উকিল হয়ে আসামীর পক্ষে সাফাই গেয়ে চলেছেন। তারা ইসলামের সাফাই পেশ ও পক্ষ সমর্থনের যে বর্ণনাভঙ্গী অবলন্বন করেন তা নিম্নরূপ:

“আজকাল দাবী করা হয় যে, আধুনিক জীবনাদর্শ অমুক অমুক কাজ করেছে, সে তুলনায় ইসলাম কিছুই করেনি। ভাইয়েরা আমার ! ইসলাম তো এসব কাজ বহু আগেই করেছে। আধুনিক মতবাদ তো ইসলামের চৌদ্দ শত বছর পরে এসে ঐ পুরাতন কাজগুলোর পুনরাবৃত্তি করেছে।”

কি লজ্জাকর পক্ষ সমর্থন ! ইসলাম কখনো জাহেলী ব্যবস্থা ও তার ভ্রান্ত কার্যকলাপকে নিজের গৌরব হিসেবে দাবী করতে পারে না। আধুনিক যুগের তথাকথিত সভ্যতা অনেকের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দিয়েছে এবং তাদের মন-মগযকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। প্রকৃতপক্ষে এসব নির্ভেজাল জাহেলিয়াত ইসলামের তুলনায় অত্যন্ত হেয়, অন্তসারশূন্য ও ভ্রান্ত। আধুনিক জীবনাদর্শের ছত্রছায়ায় বসবাসকারীদের জীবন যাত্রার মান কোন কোন নামধারী ইসলামী রাষ্ট্র অথবা ইসলামী জাহান—এর বাসিন্দাদের তুলনায় উন্নত বলে যে যুক্তি পেশ করা হয, তা মোটেই সুযুক্তি নয়। এসব এলাকার অধিবাসীগণ মুসলমান হবার দরুন দুর্দশাগ্রস্থ হয়নি বরং ইসলাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার দরুনই তাদের এ দশা হয়েছে। ইসলাম দাবী করে যে, সে জাহেলিয়াতের তুলনায় সকল বিষয়েই শ্রেষ্ঠ। সে জাহেলিয়াতকে বহাল রাখার জন্যে নয় বরং তার মূলোৎপাটন করার জন্যেই অবতীর্ণ হয়েছে এবং মানুষকে আধুনিক সভ্যতার যাতাকলে নিষ্পেষিত অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে এসেছে।

আধুনিক যুগের প্রচলিত মতবাদ ও চিন্তাধারার ভিতর ইসলামের সাদৃশ্য খুঁজে বেড়ানোর মত পরাজিত মনোবৃত্তি গ্রহণ করা আমাদের পক্ষে কিছুতেই সঙ্গত নয়। জাহেলিয়াতের আদর্শ প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য যে কোন অঞ্চল থেকে আসুক না কেন ; আমরা তাকে সরাসরি বাতিল ঘোষণা করব। কারণ ইসলামের তুলনায় এসব মতবাদ পশ্চাদমুখী এবং ইসলাম মানুষকে যে মর্যাদায় ভূষিত করতে চায়, তার সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী।

আমরা যখন মানব সমাজের সামনে উপরোক্ত পন্থায় ইসলামের বাণী পেশ করবো এবং তাদের নিকটেই ইসলামের পূর্ণাঙ্গ রূপ ব্যাখ্যা করবো, তখন তাদের অন্তর থেকেই জীবনাদর্শের যৌক্তিতকাআর সমর্থনে আওয়ায উঠবে এবং তারা এক ধরনের আকীদা-বিশ্বাস পরিত্যাগ করে অন্য ধরনের আকীদা-বিশ্বাস গ্রহণ ও এক ধরনের জীবন বিধান বর্জন করে নতুন ধরনের জীবনযাত্রা মেনে নেয়ার স্বার্থকতা উপলব্ধি করেত পারবে। কিন্তু আমরা মানুষকে কখনো নিম্নবর্ণিত যুক্তি দ্বারা আকৃষ্ট করতে পারবো না। যথা, “প্রতিষ্ঠিত পুরাতন ব্যবস্থা পরিত্যাগ করে একটি নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করা। অবশ্য নতুন ব্যবস্থাটি এখনো কোন ভূখণ্ডে রূপলাভ করেনি। তবে নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাত সমাজ ব্যবস্থার কতিপয় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন করবে মাত্র, এ সমান্য পরিবর্তনে তোমাদের আপত্তি থাকা উচিত নয়। বর্তমান সমাজে তোমরা যা যা করছ, নতুন সমাজেও তাই করতে থাকবে। নয়া আদর্শ শুধু তোমাদের স্বভাব, চাল –চলন ও রুচিতে কতিপয় মামুলী পরিবর্তন করার দাবী করবে।”

আপাত দৃষ্টিতে এ কৌশল অবলন্বন করে কাজ করা সহজ মনে হয়। কিন্তু এতে কোন আকর্ষণীয় শক্তি নেই। তাছাড়া উল্লেখিত দাওয়াত সত্যও নয়। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম বিনা দ্বিধায় ঘোষণা করেছে যে, সে শুধু মানব জীবন সম্পর্কিত আকীদা-বিশ্বাস ও দৃষ্টিভংগীই পরিবর্তন করে না ; শুধু সমষ্টিগত জীবন, আইন-কানুন ও বিচার ব্যবস্থাই পরিবর্তন করে না বরং অনুভুতি ও ভাবাবেগ পর্যন্ত এমনভাবে পাল্টে দেয় যে, জাহেলিয়াতের সাথে তার কোন সাদৃশ্যই থাকে না। সংক্ষেপে বলা যেতে পারে যে, মানব জীবনের ছোট –বড় সকল বিষয়ে মানুষকে মানুষের অধীনতা থেকে মুক্ত করে অদ্বিতীয় আল্লাহর বন্দেগীতে স্থানান্তর করাই ইসলামের লক্ষ্য।

--------------------------------------------------

“যার ইচ্ছা হয় সে ঈমান আনয়ন করুক — আর যার ইচ্ছা হয় সে কুফরী করুক।” — কাহাফ: ২৯

-------------------------------------------------

“তবে যারা কুফরী করে (তাদের জানা উচিত) আল্লাহ বিশ্ব-জগতের মুখাপেক্ষী নন।” আল ইমরান: ৯৭

এ বিষয়ে পরিস্কার ধারণা থাকা দরকার যে, এটা প্রকৃতপক্ষে ঈমান ও কুফর, তাওহীদ ও শিরক এবং ইসলাম ও জাহেলিয়াতের প্রশ্ন। যারা জাহেলিয়াতের জীবন যাপন করে তারা হাজার বার মুসলমানিত্বের দাবী করা সত্ত্বেও মুসলামন নয়। তারা যদি মুসলমানকে জাহেলিয়াতকে জাহেলিয়াতের সমপর্যায়ে আনয়ন করা যায় বলে নিজেদের অথবা অপরকে ধোঁকা দিতে চায়, তাহলে কারো কিছু করার নেই। কিন্তু তাদের আত্মপ্রবঞ্চনা অথবা অপরকে প্রবঞ্চনা করার দ্বারা প্রকৃত সত্য পরিবর্তিত হতে পারে না। তাদের ইসলাম প্রকৃত ইসলাম নয় এবং তারা নিজেরাও মুসলমান নয়। আজ ইসলামী আন্দোলন শুরু হলে প্রথমে এসব বিভ্রান্ত মুসলমানকে ইসলামের পথে আহবান করা এবং তাদের নতুন করে মুসলমান বানানো দরকার হবে।
আমরা মানুষের নিকট থেকে প্রতিদানের আশায় তাদের ইসলামী আদর্শ গ্রহণ করার জন্য আহবান করছি না। আমরা ক্ষমতা দখল অথবা দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করতেও চাই না। আমরা পার্থিব স্বার্থের লালসায় অন্ধ হয়ে যাইনি। আমাদের হিসাব-নিকাশ ও কৃতকর্মের প্রতিদান মানুষের নিকটে নয় বরং আল্লাহর নিকট প্রাপ্য। আমরা মানুষকে ভালবাসি এবং তাদের মঙ্গল কামনা করি। আর এ জন্যেই তাদের ইসলাম গ্রহণের দাওদাত দেই। তারা যদি আমাদের অত্যাচারের পাহাড় নিক্ষেপ করে, তবু আমরা আমাদের কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হবো না। এটাই দ্বীনের পথে আহবানকারীদের বৈশিষ্ট্য— আর এ বৈশিষ্ট্যই তার কাজের সহায়ক। আমাদের জীবনযাত্রা থেকে ইসলাম সম্পর্কে জনগণের মনে সঠিক ধারণা সৃষ্টি হওয়া দরকার। অনুরূপভাবে আমাদের চাল-চলন থেকেই জনগণ জানতে পারবে ইসলাম মুসলমানদের প্রতি কি কি দায়িত্ব অর্পণ করে এবং দায়িত্ব পালনের পুরস্কার স্বরূপ কি কি কল্যাণ আশা করা যেতে পারে। জনগণকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা ইসলামের দৃষ্টিতে নিরেট জাহেলিয়াত শরীয়াতের উৎস থেকে না আসার দরুন মানুষের স্বার্থান্ধ ও অজ্ঞতাপূর্ণ খেয়াল-খুশীরই ফল। আর যেহেতু ‘আল হক’ বা মহাসত্যের সাথে সম্পর্কহীন, সে জন্যে জাহেলিয়াত বাতিল ছাড়া আর কিছুই নয়। -----------------------------------
“সত্যের বাইরে গুমরাহী ছাড়া আর কি থাকতে পারে।”

আমরা যে ইসলামী বিশ্বাসী, তার মধ্যে এমন কোন বিষয় নেই যার জন্যে আমাদের লজ্জানুভব ও পরাজয়ের মনোভাব গ্রহণ করতে হবে। ইসলামের কোন দোষ চাপা দেয়ার জন্যে ওকালতী করারও কোনই প্রয়োজন নেই। কারণ, ইসলামে এ ধরনের কোন ত্রুটি নেই। ইসলামী জীবনাদর্শ মানুষের নিকট তুলে ধরার পরিবর্তে একে কোন বিশেষ সমাজে পাচার করারও প্রয়োজন নেই। আর প্রকাশ্য ইসলামের পরিপূর্ণ দাওয়াত ঘোষণা করার পরিবর্তে তার উপর নানা ধরনের লেবেল এঁটে দেয়ার চেষ্টা করাও বাতুলতা মাত্র।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বিরাজমান জাহেলিয়াতের মুকাবিলায় আধ্যাত্মিক ও মনস্তাত্তিক পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে কোন কোন ‘মুসলমানের’ অন্তর উপরোক্ত ধরনের নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয়েছে এবং আক্রান্ত হওয়ার ফলে তারা তাদের রোগগ্রস্ত মন দিয়ে মানব রচিত জীবন বিধানে ইসলামের সমর্থনোপযোগী বিষয়বস্তু অনুসন্ধান করে থাকে অথবা তারা জাহেলিয়াতের কীর্তিকলাপের মধ্য থেকে বিশেষ বিশেষ কাজের দিকে অংগুলি সংকেত করে বলে থাকে যে, ‘ইসলামও এক সময়ে এ ধরনের কাজ সম্পন্ন করেছে।’ যে ব্যক্তি ইসলাম ও ইসলামী শিক্ষার স্বপক্ষে সাফাই পেশ করার প্রয়োজন অনুভব করে কিংবা দুর্বল মনোভাব নিয়ে ইসলামের পক্ষে ওকালতী করে, সে ব্যক্তি কখনো এ দ্বীনের সঠিক প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে না। কারণ সে ইসলামের নির্বোধ সমর্থক। তার মন –মগয জাহেলিয়াতের নিকট পরাজিত ও জাহেলিয়াতে প্রভাবে প্রভাবান্বিত। জাহেলিয়াত প্রকৃতপক্ষে কতিপয় পরস্পর বিরোধী চিন্তা ও অসংখ্য ভুল –ভ্রান্তির সমষ্টি ছাড়া কিছুই নয়। অথবচ উল্লেখিত ব্যক্তিগণ নিজেদের অজ্ঞতার দরুণ জাহেলিয়াতের ভিতরে ইসলামের সমর্থন খুঁজতে গিয়ে জাহেলিয়াতেরই সহায়তা করে। তারা ইসলামের শত্রু— ইসলামের অনিষ্টই তারা করে থাকে ; তাদের দ্বারা দ্বীনের কোন উপকারই হয় না। পরন্তু,তারা মানুষকে বিভ্রান্ত করে।তাদের যুক্তি ও আলোচনা থেকে মনে হয় যে, ইসলাম আসামীর কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান এবং বিচারকের দণ্ডাদেশ থেকে রেহাই প্রাপ্তির জন্য ঐ ভদ্রলোকদেরকে উকিল নিযুক্ত করেছে।
আমার আমেরিকা অবস্থানকালে কিছু সংখ্যক লোক আমার সাথে উপরোক্ত যুক্তি পেশ করে তর্কে লিপ্ত হতো। আমার সাথে ইসলামের সমর্থক হিসেবে পরিচিত কয়েকজন লোকও ছিলেন। তাঁরা তর্কের সময় ইসলামের পক্ষে যুক্তি পেশ করে আত্মরক্ষার ভূমিকা গ্রহণ করতেন। আমি কিন্তু উল্টা পাশ্চাত্য দেশীয় জাহেলিয়াত, ধর্মের প্রতি তাদের দোদুল্যমান মনোভাব, তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং পাশ্চাত্য সমাজের উপর আক্রমণ চালাতাম। তাদেরকে বলতাম, “খৃস্টানদের ত্রিত্ববাদের দিকে লক্ষ্য করুন। গুনাহ বা পাপের সংজ্ঞা ও গুনাহের কাফ্‌ফরা (প্রায়শ্চিত্য) ইত্যাদির কোন একটি মতবাদও যুক্তিগ্রাহ্য বা বিবেকসম্মত নয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি, ইজারাদারী,সুদ গ্রহণের নীতি এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অন্যান্য উৎপীড়নমূলক,সুদ গ্রহণের নীতি এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অন্যান্য উৎপীড়নমূলক ব্যবস্থা মানবতা বিরোধী। এ সমাজের তথাকথিত ব্যক্তি স্বাধীনতায় সমষ্টিগত দায়িত্ববোধ ও পারস্পরিক সহানুভুতির লেশমাত্র নেই। আইনের ভাণ্ডা ছাড়া অন্য কোন কিছুরই এখানে প্রভাব নেই। এ সমাজের বস্তুবাদী দৃষ্টিভংগীর দরুন আত্মায় মৃত্যু, নর-নারীর অবাধ মেলামেশার নামে জীব-জন্তু সদৃশ যৌন আচরণ,স্ত্রী স্বাধীনতার নামে অশ্লিলতা ও বেহায়াপনার ছড়াছড়ি, অযৌক্তিক ছেলেখেলার ন্যায় বাস্তবতা বিরোধী বিয়ে ও তালাকের আইন, অপবিত্র ও ভাবাবেগ প্রসূত বর্ণবাদ ইত্যাদির কোন বিষয়ই মানবতাবোধের পরিচায়ক নয়। অপর দিকে ইসলামী জীবন বিধানের প্রতি লক্ষ্য করুন। এর বাস্তবমুখী ব্যবস্থাবলীল অন্তর্নিহিত কল্যাণকারিতা, সুখ-সমৃদ্ধি ও উচ্চ দৃষ্টিভংগীর তুলনা কোথায়? এ জীবনাদর্শ মানবতার যে উচ্চমান উপস্থাপিত করে তা সকলেরই কাম্য— প্রত্যেকেই ঐ উচ্চস্থান পৌছার জন্য যত্নবান হয় — যদিও এত উচ্চস্থানে পৌছা সম্ভবপর হয়ে উঠে না। ইসলাম বাস্তব জীবেনর আদর্শ। তাই মানুষের সামগ্রিক প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করেই সমস্যাবলীর সমাধান দান করে।”

পাশ্চাত্য জীবন যাত্রার বাস্তব সমস্যা আমরা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। ইসলামের আলোকে যখন এ সমাজ ব্যব্স্থার বিশ্নেষণ করতাম,তখন পাশ্চাত্য জীবনাদর্শের ঘোরতর সমর্থকগণও লজ্জায় মাথা হেঁট করতে বাধ্য হতো। তবু ইসলামের কিছু সংখ্যক দরদী আছেন যাঁরা পাশ্চাত্যের কলুষতাপূর্ণ সমাজের মুকাবিলায় পরাজয় বরণ করে নিয়েছেন এবং পাশ্চাত্যের দুর্গন্ধময় আবর্জনার স্তুপ ও প্রাচ্যের নোংরা বস্তুবাদের মধ্যে ইসলামী আদর্শের সাদৃশ্য খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
আহবানকারীদের সঠিক ভূমিকা


এ আলোচনার পর আমি আর একথা উল্লেখ করার প্রয়োজনবোধ করছি না যে, দ্বীনের প্রতি আহবানকারীদের কোন প্রকারেই জাহেলিয়াতের সাথে খাপ খাইয়ে চলার নীতি গ্রহণ সম্ভব নয়। জাহেলিয়াতের কোন একটি মতবাদ, কোন রীতিনীতি অথবা তার সামাজিক কাঠামোর কোন একটি মতবাদ, কোন রীতিনীতি অথবা তার সামাজিক কাঠামোর কোন একটির সাথেও আপোষ করা আমাদের জন্যে অসম্ভব। এ জন্যে জাহেলিয়াতের ধারক-বাহকগণ যদি আমাদের উপর অত্যাচারের ষ্ট্রীমরোলারও চালিয়ে দেয় তবু আমরা বিন্দুমাত্র নতি স্বীকার করতে রাযী নই।

আমাদের সর্বপ্রধান দায়িত্ব হচ্ছে জাহেলিয়াতের উচ্ছেদ সাধন করে ইসলামী মূল্যবোধ এবং ইসলামী রীতিনীতি প্রবর্তন করা। জাহেলিয়াতের সাথে সহযোগিতার মনোভাব অথবা সূচনায় কিছুদুর জাহেলিয়াতের সাথে সমতা রক্ষা করে চলার মধ্য দিয়ে এ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে পারে না। আমাদের কোন কোন শুভাকাংখী এ পথে এগিয়ে যাবার চিন্তা করেন। কিন্তু সত্য সত্যই যদি আমরা এরূপ করি, তাহলে প্রথম পদক্ষেপেই আমাদের পরাজয় স্বীকার করে নেয়া হবে মাত্র।
অবশ্য একথাও ঠিক যে, বর্তমান সমাজে প্রচলিত মতাদর্শ ও রীতিনীতি প্রবল চাপ প্রয়োগ করে আমাদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিতে চায়। বিশেষত নারীদের সম্পর্কে এ চাপ আরও বেশী প্রবল হয়ে উঠে। হতভাগ্য মুসলিম নারীসমাজ জাহেলিয়াতের প্রচণ্ড ঘুর্ণিঝড়ের সম্মুখীন হয়ে ঘুরপাক খেতে বাধ্য হয়। কিন্তু নিরেট বাস্তবতা থেকে রেহাই নেই। এগুলো হচ্ছে আমাদের এগিয়ে যাবার পথে বাস্তব প্রতিবন্ধকতা। দৃঢ়তা ও সাহসিকতা সহকারে আমাদের প্রতিকুল অবস্থার সম্মুখীন এবং প্রতিকুলতার উপর জয়ী হতে হবে। তারপর ইসলামের উচ্চ মূল্যবোধের তুলনায় জাহেলিয়াত যে গভীর অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত রয়েছে, তা তার চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে।
জাহেলিয়াতের সাথে সমতা রক্ষা করে কিছু দূর পর্যন্ত তার সাথে পথ চলার কর্মসূচী গ্রহণ করে এ মহান কাজ সম্পন্ন করা যাবে না। আবার এক্ষুণি জাহেলিয়াতের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আত্মগোপন করেও উদ্দেশ্য সিদ্ধ করা কখনও সম্ভব নয়। আমাদের জাহেলিয়াতের সাথে মেলামেশা করতে হবে, কিন্তু নিজেদের বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন রেখে। তাদের সাথে লেন-দেন করতে হবে, কিন্তু আত্মমর্যাদা বহাল রেখে। মহাসত্যের বাণী বিনা দ্বিধায় প্রচার করবো কিন্তু ভালবাসা ও প্রেম-প্রীতির সুরে। ঈমানের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করবো কিন্তু শিষ্টাচারের মাধ্যমে। আমাদের স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, আমরা জাহেলিয়াতের পরিবেশেই জীবন যাপন করছি। আমাদের চলার পথ জাহেলিয়াতের তুলনায় সহজ-সরল। তবু জাহেলিয়াতকে পরিবর্তন করে ইসলামী ব্যবস্থার প্রবর্তন অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী ও দীর্ঘমেয়াদী কাজ। আমরা মানবতাকে জাহেলিয়াতের অন্ধকার থেকে উদ্ধার করে ইসলামের।আলোকজ্জল পথে তুলে দিতে চাই। জাহেলিয়াত ও ইসলামের মধ্য রয়েছে এক প্রশস্ত ও গভীর উপত্যকা। এতদুভয়ের মিলনের জন্য মধ্যস্থলে পুল নির্মাণ সম্ভব নয়। তবে, এমন একটি পুল তৈরি করার চেষ্টা করতে হবে যেন ওপার থেকে মানুষ জাহেলিয়াত পরিত্যাগ করে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় এসে আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে। আগমনকারী কোন ইসলামী অঞ্চলের মুসলিম বাসিন্দা হোক অথবা অনৈসলামিক অঞ্চলের অমুসলিম হোক, সকলের জন্যেই অন্ধকার বিসর্জন দিয়ে আলোকিত স্থানে আসা এবং আপাদমস্তক দুর্দশার পাকে নিমজ্জিত অবস্থা থেকে নাজাত হাসিল করে ইসলামের প্রতিশ্রুত সুফল ভোগ করার জন্য ছুটে আসার পথ খুলে দিতে হবে। যারা ইসলামকে ভালভাবে হৃদয়ংগম করে ইসলামের ছত্রছায়ায় জীবনযাপনে আগ্রহী তাদের অবশ্যই জাহেলিয়াতের বন্ধন ছিন্ন করে ইসলামের দিকে ছুটে আসতে হবে। যদি আমাদের দাওয়াত কারো পসন্দ না হয়, তাহলে আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূলকে যা ঘোষণা করতে হুকুম করেছিলেন, আমরাও তাই ঘোষণা করবো —

-------------------------------------------------

“তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীন এবং আমার জন্যে আমার দ্বীন।” -কাফেরুন: ৬

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম