অধ্যায় ০২ : দলীয় গুণাবলী

ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসাঃ
এ ধরণের দলের মধ্যে সর্বপ্রথম যে গুণটি থাকতে হবে তা হচ্ছে, তার অর্ন্তভূক্ত প্রত্যেক ব্যক্তিকে পরস্পরের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। প্রাসাদের প্রত্যেকটা ইট মজবুতভাবে একটার সাথে আরেকটা মিশে থাকলে তবে প্রাসাদটি মজবুত হয়। সিমেন্ট এ ইটগুলোকে পরস্পরের সাথে মিশিয়ে রাখে। তেমনিভাবে কোন দলের সদস্যদের দিল পরস্পরের সাথে একসূত্রে গ্রথিত থাকলে তবেই তা ইস্পাত প্রাচীরে পরিণত হয়। আর এ দিলগুলোকে একসূত্রে গ্রথিত করতে পারে আন্তরিক ভালোবাসা, পারস্পারিক কল্যাণাকাঙ্খা, সহানুভূতি ও পরস্পরের জন্য ত্যাগ স্বীকার। ঘৃণাকারী দিল কখনো পরস্পরে মিলেমিশে থাকতে পারে না। মোনাফেকী ধরণের মেলামেশা কখনো সত্যিকার ঐক্য সৃষ্টি করতে পারে না। স্বার্থবাদী ঐক্য মোনাফেকীর পথ প্রশস্ত করে। আর নিছক একটি শুষ্ক-নিরস ব্যবসায়িক সম্পর্ক কোন সৌহার্দ ও সহযোগিতার ভিত্তিতে পরিণত হতে পারে না। কোন পার্থিব স্বার্থ এ ধরণের সম্পর্কহীন লোকদেরকে একত্রিত করলেও তারা নিছক বিক্ষিপ্ত হবার জন্যই একত্রিত হয় এবং কোন মহৎ কাজ সম্পাদনের পরিবর্তে নিজেদের মধ্যে হানাহানী করেই শেষ হয়ে যায়। যখন একদল নিঃস্বার্থ চিন্তার অধিকারী ও জীবনোদ্দেশ্যের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগী লোক একত্রিত হয় অতঃপর চিন্তার এই নিঃস্বার্থতা ও উদ্দেশ্যের প্রতি এ অনুরাগ তাদের নিজেদের মধ্যে আন্তরিকতা ও ভালোবাসার সৃষ্টি করে কেবল মাত্র তখনই একটি মজবুত ও শক্তিশালী দলের সৃষ্টি হতে পারে। এ ধরণের দল আসলে ইস্পাত প্রাচীরের ন্যায় অটুট হয়। শয়তান এর মধ্যে ফাটল ধরাবার কোন পথই পায় না। আর বাহির থেকে বিরোধীতার তুফান এনে এর বিরুদ্ধে দাঁড় করালেও একে স্থানচ্যুত করতে পারে না।
পারস্পরিক পরামর্শঃ
দ্বিতীয় প্রয়োজনীয় গুণ হচ্ছে, এ দলকে পারস্পারিক পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করতে হবে এবং পরামর্শের নিয়ম-নীতি পুরোপুরি মেনে চলতে হবে। যে দলের প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের ইচ্ছামতো চলে এহেন স্বেচ্ছাচারী দল আসলে কোন দল হয় না বরং নিছক একটি জনমন্ডলী। এহেন জনমন্ডলী কোন কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হয় না। অনুরুপভাবে যে দলের এক ব্যক্তি বা কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তির একটি গ্রুপ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে বসে এবং বাদ বাকি সবাই তার ইঙ্গিতে পরিচালিত হয় এহেন দলও বেশী দিন টিকে থাকতে পারে না। একমাত্র পরামর্শের মাধ্যমে প্রতিটি বিষয়ের ভালো-মন্দ দিকগুলো পর্যালোচনা করে একটি ভালো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে বরং এর মাধ্যমে আরো দুটি ফায়দাও হাসিল হয়।
এক. যে কাজের পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমগ্র দলের পরামর্শ কার্যকরী থাকে সমগ্র দল মানসিক নিশ্চিন্ততার সাথে তা সম্পাদন করার চেষ্টা করে সেক্ষেত্রে একথা কেউ চিন্তা করে না যে, ওপর থেকে কোন বস্তু তার উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
দুই. এভাবে সমগ্র দল সমস্যা ও ঘটনাবলী অনুধাবন করার শিক্ষা লাভ করে। প্রত্যেক ব্যক্তি দল ও তার কাজের প্রতি আগ্রহ পোষণ করে এবং তার পথেকে গৃহীত সিদ্ধান্ত সমূহকে নিজের সিদ্ধান্ত মনে করে। কিন্তু এজন্যে শর্ত হচ্ছে, পরামর্শের নিয়ম-নীতি পালণ করে চলতে হবে। আর পরামর্শের নিয়মনীতি হচ্ছে ঃ প্রত্যেক ব্যক্তি ঈমানদারীর সাথে নিজের মত পেশ করবে এবং মনে মধ্যে কোন কথা লুকিয়ে রাখবে না। আলোচনায় কোন প্রকার জিদ, হঠধর্মিতা ও বিদ্বেষের আশ্রয় নেবে না। এবং সংখ্যাধিক্যের মাধ্যমে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে যাওয়ার পর ভিন্ন মতের অধিকারীরা নিজেদের মত পরিবর্তন না করলেও দলীয় সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করার জন্যে সানন্দে অগ্রসর হবে। এ তিনটি বিষয়ের প্রতি ল্ক্ষ্য না রাখলে পরামর্শের সমস্ত ফায়দাই নষ্ট হয়ে যায়। বরং এটিই পরিশেষে দলের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টি করে।
সংগঠন ও শৃঙ্খলাঃ
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ গুণ হচ্ছে, সংগঠন, শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, পারস্পারিক সহযোগিতা ও একটি টিমের ন্যায় কাজ করা। একটি দল তার সব রকমের গুণাবলী সত্ত্বেও কেবলমাত্র নিজের সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনাসমূহ কার্যকরী করতে সক্ষম না হওয়ার কারণে ব্যর্থ হয়ে যায়। আর এটি হয় সংগঠন, শৃঙ্খলা ও সহযোগিতার অভাবের ফলশ্রুতি। ধ্বংসমূলক কাজ নিছক হৈ-হাঙ্গামার সাহায্যেও সমাধা হতে পারে। কিন্তু কোন গঠনমূলক কাজ সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়া সম্পাদিত হতে পারে না। সমগ্র দলের একযোগে দল কর্তৃক গৃহীত নিয়ম-নীতির অনুসারী হওয়ার নামই হচ্ছে সংঘদ্ধ প্রচেষ্টা। দলের মধ্যে যে ব্যক্তিকে কোন পর্যায়ে কর্তৃত্বশীল করা হয় তার নির্দেশাবলী মেনে চলতে হবে। দলের প্রত্যেক ব্যক্তিকে কর্তব্যনিষ্ঠ হতে হবে এবং তার ওপর যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে যথাসময়ে নিষ্ঠার সাথে তা সম্পাদন করার চেষ্টা করতে হবে। যে কর্মীদের ওপর সম্মিলিতভাবে কাজ করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয় তাদের পরস্পরের মধ্যে পূর্ণ সহযোগীতা থাকতে হবে। দলের মেশিন এমন পর্যায়ে সক্রিয় হতে হবে যে, একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হবার সাথে সাথেই তাকে কার্যকরী করার জন্যে তার সকল কল-কব্জা চালু হয়ে যাবে। দুনিয়ায় এ ধরণের দলই কোন কাজ সম্পন্ন করতে পারে। অন্যথায় যেসব দল কল-কব্জা সংগ্রহ করে কিন্তু সেগুলো যথাস্থানে সংযোজিত করে যথারীতি মেশিনের মত চালাবার ব্যবস্থা করেনি তাদের থাকা না থাকা সমান হয়ে দাঁড়ায়।
সংস্কারের উদ্দেশ্যে সমালোচনাঃ
সর্বশেষ ও সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ গুণ হচ্ছে, দলের মধ্যে সংস্কারের উদ্দেশ্যে সমালোচনা করার যোগ্যতাও দলের থাকতে হবে। অন্ধ অনুসারী ও সরলমনা ভক্তবৃন্দ যতই সঠিক স্থান থেকে কাজ শুরু করুক না কেন এবং যতই নির্ভুল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সামনে রেখে অগ্রসর হোক না কেন, অবশেষে তারা সমগ্র কাজ বিকৃত করে যেতে থাকে। কারণ মানবিক কাজে দুর্বলতার প্রকাশ স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু যেখানে দুর্বলতার প্রতি নজর রাখার কেউ থাকে না অর্থাৎ তা চিহ্নিত করা দোষরুপে বিবেচিত হয় না, সেখানে গাফলতি বা অক্ষমতা পূর্ণ নিরবতার কারণে সব রকমের দুর্বলতা, নিরুদ্বেগ ও নিশ্চিন্ততার আশ্রয়স্থলে পরিণত হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে তা দ্বিগুণ চর্তুগুণে বৃদ্ধি পেতে থাকে। দলের সুস্থ-সবল অবয়ব ও রোগমুক্ত দেহের জন্যে সমালোচনার অভাবের চাইতে ক্ষতিকর আর কিছু নেই। আর সমালোচনামূলক চিন্তাকে দাবিয়ে দেয়ার চাইতে দলের জন্যে বড় অকল্যাণাকাঙ্খা আর কিছুই হতে পারে না। এ সমালোচনার মাধ্যমেই দোষ-ত্রুটি যথাসময়ে প্রকাশিত হয় এবং তার সংশোধনের চেষ্টা চালানো যায়। কিন্তু সমালোচনার অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে এই যে, তা দোষ দেখাবার উদ্দেশ্যে হতে পারবে না বরং পূর্ণ আন্তরিকতা সহকারে সংশোধনের উদ্দেশ্যে হতে হবে। এবং এই সঙ্গে দ্বিতীয় সমান গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে এই যে, সমালোচনাকারীকে যথার্থ সমালোচনার পদ্ধতিতে সমালোচনা করতে হবে। একজন দোষ সন্ধানকারী সদুদ্দেশ্য প্রনোদিত সমালোচকের বেয়াড়া, বেকায়দা, অসময়োচিত ও বাজে সমালোচনাও দলকে ঠিক একই পর্যায়ের ক্ষতির সম্মুখীন করতে পারে।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম