আদর্শবাদী দল
প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থা সমূলে উৎপাটিত করে তার স্থলে সম্পূর্ণ ভিন্ন করে এক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হলে একটি আদর্শ বেছে নিতে হয়। এর সাথে পৃথক চিন্তাধারাও থাকে। এ চিন্তা ও আদর্শের সাথে যারা সকল দিক দিয়ে একমত পোষণ করে তারা একটি দল গঠন করে। একে বলা হয় একটি আদর্শবাদী দল। এ দল ইসলামী হতে পারে, ইসলাম বিরোধীও হতে পারে।
সমাজ বিপ্লবের জন্য সংগ্রামের পূর্বে সে আদর্শের ছাঁচে ব্যক্তি গঠন অবশ্যই করতে হয়। এ আদর্শ বাস্তবায়নকে তারা তাদের জীবনের লক্ষ্য ও মিশন হিসেবে গ্রহণ করে এবং তার জন্য তারা অকাতরে জীবন দিতেও প্রস্তুত হয়। প্রতিপক্ষের শত নির্যাতন নিষ্পেষণ তাদেরকে কিছুতেই দমিত করতে পারে না। দলের নেতা ও কর্মীদের হতে হয় নির্ভীক, সাহসী ও ধৈর্যশীল। বিশেষ করে নেতাকে হতে হয় গতিশীল, দূরদর্শী, সমসাময়িক সকল সমস্যা সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন এবং চরম সংকট মুহূর্তে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী। দলের নেতৃত্ব ও নিয়ম শৃঙ্খলার আনুগত্য হবে সকলের জন্য অনিবার্য।
যে কোন আদর্শবাদী দলের মধ্যে উপরোক্ত গুণাবলী অবশ্যই থাকতে হবে। একটি ইসলামী দলের মধ্যে উপরোক্ত গুণাবলী ছাড়াও অতিরিক্ত আরও অনেক গুণাবলীর প্রয়োজন যা আল্লাহ তাদের মধ্যে দেখতে চান।
এ দলের চরম ও পরম লক্ষ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। আর তা করতে হলে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস সংগ্রাম করে যেতে হবে। তাই এ দলের একটি ব্যক্তির প্রতিটি কথা ও কাজ এমন হতে হবে যার দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের অভিলাষই হবে তাদের সকল কর্মতৎপরতার দিগদর্শী। এ দলের আরও কিছু বৈশিষ্ট্য পরে বর্ণনা করা হবে।
জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ একটি আদর্শবাদী দল। এ দলের সূচনা হয়েছিল অবিভক্ত ভারতে ১৯৪১ সালে।
দারুল ইসলাম ট্রাস্ট গঠন ও ইসলামী আন্দোলনের লক্ষ্যে দল গঠনের পটভূমি রচনা
১৯৩৭ সালে আল্লামা ইকবাল হায়দারাবাদ থেকে পাঞ্জাবে হিজরত করার জন্যে মাওলানা মওদূদীকে আহবান জানান। আল্লামা ইকবাল তরজুমানুল কুরআনের মাধ্যমে মাওলানার গুণমুগ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। অসুস্থতা ও শারীরিক দুর্বলতার কারণে তিনি কখনো সাইয়্যেদ নাযীর নিয়াযী এবং কখনো মিয়া মুহাম্মদ শফীকে দিয়ে তরজুমানুল কুরআন পড়াতেন এবং মনোযোগ দিয়ে শুনতেন।
ঠিক এ সময়ে জনৈক অবসরপ্রাপ্ত এসডিও চৌধুরী নিয়ায আলী তাঁর ষাট-সত্তর একর জমি ইসলামের খেদমতের জন্য ওয়াকফ করেছিলেন। সেখানে বিভিন্ন ধরনের পাকা ঘর-বাড়ী তৈরি করে বিশেষ পরিকল্পনার অধীনে দ্বীনের বৃহত্তর খেদমতের অভিলাষী তিনি ছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি আল্লামা ইকবালের পরামর্শ চাইলে তিনি একমাত্র মাওলানা মওদূদীকেই এ কাজের জন্য যথাযোগ্য ব্যক্তি মনে করেন। মাওলানা মওদূদী ড. ইকবালের অনুরোধে তাঁর সাথে বিস্তারিত আলোচনার পর এ কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করতে রাজী হন এবং চিরদিনের জন্যে হায়দারাবাদ পরিত্যাগ করে ১৯৩৮ সালের ১৬ই মার্চ পূর্ব পাঞ্জাবের পাঠানকোট নামক স্থানে হিজরত করেন। অতঃপর ‘দারুল ইসলাম’ নামে একটা ট্রাস্ট গঠন করে তাঁর মহান কাজের সূচনা করেন।
দারুল ইসলাম ট্রাস্ট গঠনের পর মাওলানা তাঁর জিহাদী প্রেরণাদায়ক ভাষণে বলেনঃ
“এখন সে সময় এসে গেছে যখন আমাদেরকে মুসলমান থাকা না থাকায় চূড়ান্ত ফয়সালা করতে হবে। যদি আমরা মুসলমান থাকতে চাই, তাহলে আমাদেরকে আমাদের আপন পরিবেশ এবং তারপর গোটা দুনিয়াকে দারুল ইসলাম বানাবার সংকল্প নিয়ে ময়দানে নামতে হবে এবং তার জন্যে দেহমন বিলিয়ে দেয়ার পুরোপুরি ঝুঁকি নিতে হবে। আমরা যদি এতোটুকু হিম্মৎ ও সাহসিকতা দেখাতে না পারি, তাহলে ইসলাম থেকে চিরদিন দূরে থাকার জন্যে তৈরী থাকা উচিত। কারণ ভারতে ভৌগোলিক জাতীয়তার ভিত্তিতে যে গণতান্ত্রিক ধর্মহীন রাষ্ট্র ব্রিটিশ শাসনের গর্ভ থেকে জন্মলাভ করতে যাচ্ছে এবং সমাজতান্ত্রিক ধ্যান ধারণার স্তন্য পানে বিকশিত হচ্ছে, তা আপন প্রচেষ্টায় কায়েম করা অথবা নিষ্ক্রিয় থেকে তার প্রতিষ্ঠা বরদাশত করার পরিণাম এ হতে পারে যে, মুসলমান এক সর্বব্যাপী সংস্কৃতি এ চিন্তাধারার স্রোতে তৃণখন্ডের ন্যায় ভেসে যাবে যা আকীদাহ ও আমল উভয় দিক দিয়ে হবে সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী”।
কতিপয় “উন্মাদের” (দেওয়ানা) প্রয়োজন
এ সময়ে দুর্দান্ত কুফরী শক্তির প্রভূত্ব কর্তৃত্ব দেখার পর যে ব্যক্তি দারুল ইসলাম কায়েমের জন্য ময়দানে নেমে পড়বে সে অবশ্যই ‘দেওয়ানা’
(উন্মাদ) এবং আগুন নিয়ে খেলতে চায়। বিশ্বাস করুন, বাজি; প্রায় হেরে গেছি এবং ময়দান হাত ছাড়া হয়ে গেছে। এ অবস্থায় মুকাবেলার জন্য দাঁড়ানো উন্মাদেরই কাজ। এমন উন্মাদ, যে জেনে-বুঝে আগুনে ঝাঁপ দিতে প্রস্তুত।
এখনো ভালো করে জেনে বুঝে রাখুন যে, এর পরিণাম হবে প্রকৃতপক্ষে এই যে, যমীন ও আসমানের প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তু আপনাদের দুশমন হয়ে পড়বে এবং সকল কুফরী শক্তি ও আপনাদের কওমের মুনাফেকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আপনাদের নিষ্পেষিত করার চেষ্টা করবে। কারণ তাদের পরস্পরের মধ্যে যতোই মতবিরোধ থাকনা কেন, দারুল ইসলাম শব্দটি তাদের নিকটে সমান চ্যালেঞ্জ এবং এ ধ্যান ধারণা তারা কেউই বরদাশত করতে পারে না। এসব ভালো করে জেনে বুঝে আপন মনের পর্যালোচনা করে দেখুন যে, তার মধ্যে মুসলমান থাকার জযবা এ উন্মাদনার পর্যায়ে পৌঁছেছে কিনা, তারপর দেখুন যে, যে জিনিস প্রকাশ্য অসম্ভব বলে দেখা যাচ্ছে এবং যা লাভ করার চেষ্টায় জান ও মালের বিপুল ক্ষতি সুনিশ্চিত, তারপরও তা কুরবানী করতে প্রস্তুত কিনা।
যাদের মধ্যে এ উন্মাদনা বিদ্যমান এবং যারা তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের পথে ব্যর্থতাসহ মৃত্যুবরণ করাকে দুনিয়াবী সাফল্যের উপর অগ্রাধিকার দিতে প্রস্তুত আমাদের প্রয়োজন শুধু তাদের এবং তারাই দারুল ইসলাম আন্দোলন পরিচালনা করতে সক্ষম।
দারুল ইসলামী ট্রাস্ট ইসলামী আন্দোলনের লক্ষ্যে দল গঠনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে থাকে এবং ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে মাওলানার কথিত পঁচাত্তর জন ‘উন্মাদ’কে নিয়ে জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠিত হয়। কালক্রমে এ জামায়াতের উত্তরসূরী জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ।
এ দলের পরিচয় দিতে গিয়ে এর প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ.) বলেন-
“এ দলের সদস্যদেরকে ঈমানের দিক দিয়ে সুদৃঢ় ও অবিচল হতে হবে এবং আমলের দিক দিয়ে হতে হবে প্রশংসনীয় ও উচ্চমানের। কারণ তাদেরকে সভ্যতা সংস্কৃতির ভ্রান্ত ব্যবস্থা ও রাজনীতির বিরুদ্ধে কার্যতঃ বিদ্রোহ ঘোষণা করতে হবে এবং এ পথে আর্থিক কুরবানী থেকে শুরু করে কারাদণ্ড এমন কি ফাঁসিরও ঝুঁকি নিতে হতে পারে”।
জামায়াতের কাজ কি?
জামায়াতের কাজ কি- এ সম্পর্কে মওদূদী রহ. বলেন-
“দুনিয়াতে জামায়াতে ইসলামীর জন্য করার যে কাজ রয়েছে, সে সম্পর্কে কোন সীমিত ধারণা পোষণ করবেন না।.... তার কাজের পরিধির মধ্যে রয়েছে পূর্ণ প্রসারতাসহ গোটা মানব জীবন। ইসলাম সকল মানুষের জন্য এবং যেসব বস্তুর সাথে মানুষের সম্পর্ক, ইসলামের সাথেও সে সবের সম্পর্ক রয়েছে। অতএব ইসলামী আন্দোলন এক সর্বব্যাপী আন্দোলনের নাম”।
“যারা জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করবে তাদের প্রত্যেকের এ কথা ভালো করে বুঝে নেয়া দরকার যে, জামায়াতে ইসলামীর সামনে যে কাজ রয়েছে তা যেমন তেমন কাজ নয়। দুনিয়ার নীতি নৈতিকতা, রাজনীতি, সভ্যতা সংস্কৃতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি প্রতিটি বস্তু পরিবর্তন করে দিতে হবে। খোদাদ্রোহিতার উপর যে ব্যবস্থা দুনিয়ায় কায়েম রয়েছে তা বদলিয়ে খোদার আনুগত্যের উপর তা কায়েম করতে হবে। এ কাজে সকল শয়তানী শক্তির বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম ও প্রতিটি পদক্ষেপের পূর্বে প্রত্যেককে ভালো করে বুঝে নিতে হবে যে সে কোন্ কন্টকময় পথে পা বাড়াচ্ছে”।
এ কথাগুরো তিনি বলেন জামায়াত প্রতিষ্ঠার দিন তাঁর প্রদত্ত ভাষণে। ভাষণের শেষে তিনি বলেন-
“আমার জন্য ত এ আন্দোলন আমার জীবনের উদ্দেশ্য। আমার জীবন মরণ তারই জন্য। কেউ সম্মুখে অগ্রসর না হলে আমি হবো। কেউ সহযোগিতা না করলে আমি একাকীই এ পথে চলবো। গোটা দুনিয়া ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিরোধিতা করলে আমি একা তার বিরুদ্ধে লড়তে ভয় করবো না।
আমীর নির্বাচিত হওয়ার পর জামায়াত প্রতিষ্ঠাতা সঙ্গী সাথীদের উদ্দেশ্যে যে বিদায়ী ভাষণ দান করেন তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলোঃ
১। জামায়াত সদস্যদের কুরআন, সীরাতুন্নবী ও সীরাতে সাহাবার প্রতি বিশেষ অনুরাগ থাকা একান্ত আবশ্যক। এসব বারবার এবং গভীর মনোযোগ সহকারে পড়তে হবে।
২। এ আন্দোলনের প্রাণ হচ্ছে প্রকৃত পক্ষে তালাল্লুক বিল্লাহ (আল্লাহর সাথে সম্পর্ক)। যদি আল্লাহর সাথে আপনাদের সম্পর্ক দুর্বল হয়, তাহলে আপনারা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে এবং তা সাফল্যের সাথে চালাতে পারবেন না। অতএব নামায ছাড়াও নফল ইবাদতেরও নিয়মিত ব্যবস্থা করুন। নফল নামায, নফল রোযা এবং সদকা এমন সব জিনিস যা মানুষের মধ্যে ইখলাস ও ঐকান্তিকতা সৃষ্টি করে।
৩। জামায়াতের রুকনদের ভালোভাবে উপলব্ধি করা উচিত যে, তারা এক বিরাট দাবীসহ বিরাট কাজের জন্য ময়দানে নামছেন। যদি তাদের চরিত্র ও আচার আচরণ দাবীর তুলনায় এতোটা হীন হয় যে তা অনুভূত হয়, তাহলে তারা নিজেদেরকে ও তাদের দাবীকে হাস্যকর বানিয়ে দিবেন। এ জন্য এ দলে সম্পৃক্ত প্রত্যেককে তার দ্বিগুণ দায়িত্ব অনুভব করতে হবে। খোদার সামনে ত অবশ্য্র দায়ী থাকতে হবে এবং সেই সাথে খোদার সৃষ্টির সামনেও তার দায়িত্ব বড়ো কঠিন।
৪। যে জনপদেই আপনারা থাকুন, সেখানকার সাধারণ অধিবাসীদের তুলনায় আপনাদের চরিত্র উন্নতমানের হওয়া উচিত। বরঞ্চ চরিত্র, আমানতদারী ও দিয়ানতদারীতে দৃষ্টান্তমূলক হতে হবে। আপনাদের সামান্য পদস্খলন শুধু জামায়াতের উপরই নয় বরঞ্চ ইসলামের উপর কালিমা আরোপ করবে এবং আপনারা অনেকের গোমরাহির কারণ হয়ে পড়বেন।
৫। জামায়াতের রুকনদের ঐসব কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকা উচিত যা মুসলমানদের মধ্যে ফিরকা সৃষ্টি করে।
(ক) নিজেদের নামায সাধারণ মুসলমান থেকে পৃথকভাবে পড়বেন না।
(খ) নামাযে নিজেদের জামায়াত পৃথক করবেন না।
(গ) কোন বিতর্কে লিপ্ত হবেন না।
এভাবে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে ১৯৪১ সালের আগস্টের শেষ সপ্তাহে এ আদর্শবাদী দলটি তার যাত্রা শুরু করে। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এ দলটি অবিচ্ছিন্নভাবে তার আদর্শ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংগ্রাম করে চলেছে। এ দলটি সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করতে হলে জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস অবশ্যই পাঠ করা দরকার।
প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থা সমূলে উৎপাটিত করে তার স্থলে সম্পূর্ণ ভিন্ন করে এক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হলে একটি আদর্শ বেছে নিতে হয়। এর সাথে পৃথক চিন্তাধারাও থাকে। এ চিন্তা ও আদর্শের সাথে যারা সকল দিক দিয়ে একমত পোষণ করে তারা একটি দল গঠন করে। একে বলা হয় একটি আদর্শবাদী দল। এ দল ইসলামী হতে পারে, ইসলাম বিরোধীও হতে পারে।
সমাজ বিপ্লবের জন্য সংগ্রামের পূর্বে সে আদর্শের ছাঁচে ব্যক্তি গঠন অবশ্যই করতে হয়। এ আদর্শ বাস্তবায়নকে তারা তাদের জীবনের লক্ষ্য ও মিশন হিসেবে গ্রহণ করে এবং তার জন্য তারা অকাতরে জীবন দিতেও প্রস্তুত হয়। প্রতিপক্ষের শত নির্যাতন নিষ্পেষণ তাদেরকে কিছুতেই দমিত করতে পারে না। দলের নেতা ও কর্মীদের হতে হয় নির্ভীক, সাহসী ও ধৈর্যশীল। বিশেষ করে নেতাকে হতে হয় গতিশীল, দূরদর্শী, সমসাময়িক সকল সমস্যা সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন এবং চরম সংকট মুহূর্তে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী। দলের নেতৃত্ব ও নিয়ম শৃঙ্খলার আনুগত্য হবে সকলের জন্য অনিবার্য।
যে কোন আদর্শবাদী দলের মধ্যে উপরোক্ত গুণাবলী অবশ্যই থাকতে হবে। একটি ইসলামী দলের মধ্যে উপরোক্ত গুণাবলী ছাড়াও অতিরিক্ত আরও অনেক গুণাবলীর প্রয়োজন যা আল্লাহ তাদের মধ্যে দেখতে চান।
এ দলের চরম ও পরম লক্ষ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। আর তা করতে হলে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস সংগ্রাম করে যেতে হবে। তাই এ দলের একটি ব্যক্তির প্রতিটি কথা ও কাজ এমন হতে হবে যার দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের অভিলাষই হবে তাদের সকল কর্মতৎপরতার দিগদর্শী। এ দলের আরও কিছু বৈশিষ্ট্য পরে বর্ণনা করা হবে।
জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ একটি আদর্শবাদী দল। এ দলের সূচনা হয়েছিল অবিভক্ত ভারতে ১৯৪১ সালে।
দারুল ইসলাম ট্রাস্ট গঠন ও ইসলামী আন্দোলনের লক্ষ্যে দল গঠনের পটভূমি রচনা
১৯৩৭ সালে আল্লামা ইকবাল হায়দারাবাদ থেকে পাঞ্জাবে হিজরত করার জন্যে মাওলানা মওদূদীকে আহবান জানান। আল্লামা ইকবাল তরজুমানুল কুরআনের মাধ্যমে মাওলানার গুণমুগ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। অসুস্থতা ও শারীরিক দুর্বলতার কারণে তিনি কখনো সাইয়্যেদ নাযীর নিয়াযী এবং কখনো মিয়া মুহাম্মদ শফীকে দিয়ে তরজুমানুল কুরআন পড়াতেন এবং মনোযোগ দিয়ে শুনতেন।
ঠিক এ সময়ে জনৈক অবসরপ্রাপ্ত এসডিও চৌধুরী নিয়ায আলী তাঁর ষাট-সত্তর একর জমি ইসলামের খেদমতের জন্য ওয়াকফ করেছিলেন। সেখানে বিভিন্ন ধরনের পাকা ঘর-বাড়ী তৈরি করে বিশেষ পরিকল্পনার অধীনে দ্বীনের বৃহত্তর খেদমতের অভিলাষী তিনি ছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি আল্লামা ইকবালের পরামর্শ চাইলে তিনি একমাত্র মাওলানা মওদূদীকেই এ কাজের জন্য যথাযোগ্য ব্যক্তি মনে করেন। মাওলানা মওদূদী ড. ইকবালের অনুরোধে তাঁর সাথে বিস্তারিত আলোচনার পর এ কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করতে রাজী হন এবং চিরদিনের জন্যে হায়দারাবাদ পরিত্যাগ করে ১৯৩৮ সালের ১৬ই মার্চ পূর্ব পাঞ্জাবের পাঠানকোট নামক স্থানে হিজরত করেন। অতঃপর ‘দারুল ইসলাম’ নামে একটা ট্রাস্ট গঠন করে তাঁর মহান কাজের সূচনা করেন।
দারুল ইসলাম ট্রাস্ট গঠনের পর মাওলানা তাঁর জিহাদী প্রেরণাদায়ক ভাষণে বলেনঃ
“এখন সে সময় এসে গেছে যখন আমাদেরকে মুসলমান থাকা না থাকায় চূড়ান্ত ফয়সালা করতে হবে। যদি আমরা মুসলমান থাকতে চাই, তাহলে আমাদেরকে আমাদের আপন পরিবেশ এবং তারপর গোটা দুনিয়াকে দারুল ইসলাম বানাবার সংকল্প নিয়ে ময়দানে নামতে হবে এবং তার জন্যে দেহমন বিলিয়ে দেয়ার পুরোপুরি ঝুঁকি নিতে হবে। আমরা যদি এতোটুকু হিম্মৎ ও সাহসিকতা দেখাতে না পারি, তাহলে ইসলাম থেকে চিরদিন দূরে থাকার জন্যে তৈরী থাকা উচিত। কারণ ভারতে ভৌগোলিক জাতীয়তার ভিত্তিতে যে গণতান্ত্রিক ধর্মহীন রাষ্ট্র ব্রিটিশ শাসনের গর্ভ থেকে জন্মলাভ করতে যাচ্ছে এবং সমাজতান্ত্রিক ধ্যান ধারণার স্তন্য পানে বিকশিত হচ্ছে, তা আপন প্রচেষ্টায় কায়েম করা অথবা নিষ্ক্রিয় থেকে তার প্রতিষ্ঠা বরদাশত করার পরিণাম এ হতে পারে যে, মুসলমান এক সর্বব্যাপী সংস্কৃতি এ চিন্তাধারার স্রোতে তৃণখন্ডের ন্যায় ভেসে যাবে যা আকীদাহ ও আমল উভয় দিক দিয়ে হবে সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী”।
কতিপয় “উন্মাদের” (দেওয়ানা) প্রয়োজন
এ সময়ে দুর্দান্ত কুফরী শক্তির প্রভূত্ব কর্তৃত্ব দেখার পর যে ব্যক্তি দারুল ইসলাম কায়েমের জন্য ময়দানে নেমে পড়বে সে অবশ্যই ‘দেওয়ানা’
(উন্মাদ) এবং আগুন নিয়ে খেলতে চায়। বিশ্বাস করুন, বাজি; প্রায় হেরে গেছি এবং ময়দান হাত ছাড়া হয়ে গেছে। এ অবস্থায় মুকাবেলার জন্য দাঁড়ানো উন্মাদেরই কাজ। এমন উন্মাদ, যে জেনে-বুঝে আগুনে ঝাঁপ দিতে প্রস্তুত।
এখনো ভালো করে জেনে বুঝে রাখুন যে, এর পরিণাম হবে প্রকৃতপক্ষে এই যে, যমীন ও আসমানের প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তু আপনাদের দুশমন হয়ে পড়বে এবং সকল কুফরী শক্তি ও আপনাদের কওমের মুনাফেকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আপনাদের নিষ্পেষিত করার চেষ্টা করবে। কারণ তাদের পরস্পরের মধ্যে যতোই মতবিরোধ থাকনা কেন, দারুল ইসলাম শব্দটি তাদের নিকটে সমান চ্যালেঞ্জ এবং এ ধ্যান ধারণা তারা কেউই বরদাশত করতে পারে না। এসব ভালো করে জেনে বুঝে আপন মনের পর্যালোচনা করে দেখুন যে, তার মধ্যে মুসলমান থাকার জযবা এ উন্মাদনার পর্যায়ে পৌঁছেছে কিনা, তারপর দেখুন যে, যে জিনিস প্রকাশ্য অসম্ভব বলে দেখা যাচ্ছে এবং যা লাভ করার চেষ্টায় জান ও মালের বিপুল ক্ষতি সুনিশ্চিত, তারপরও তা কুরবানী করতে প্রস্তুত কিনা।
যাদের মধ্যে এ উন্মাদনা বিদ্যমান এবং যারা তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের পথে ব্যর্থতাসহ মৃত্যুবরণ করাকে দুনিয়াবী সাফল্যের উপর অগ্রাধিকার দিতে প্রস্তুত আমাদের প্রয়োজন শুধু তাদের এবং তারাই দারুল ইসলাম আন্দোলন পরিচালনা করতে সক্ষম।
দারুল ইসলামী ট্রাস্ট ইসলামী আন্দোলনের লক্ষ্যে দল গঠনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে থাকে এবং ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে মাওলানার কথিত পঁচাত্তর জন ‘উন্মাদ’কে নিয়ে জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠিত হয়। কালক্রমে এ জামায়াতের উত্তরসূরী জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ।
এ দলের পরিচয় দিতে গিয়ে এর প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ.) বলেন-
“এ দলের সদস্যদেরকে ঈমানের দিক দিয়ে সুদৃঢ় ও অবিচল হতে হবে এবং আমলের দিক দিয়ে হতে হবে প্রশংসনীয় ও উচ্চমানের। কারণ তাদেরকে সভ্যতা সংস্কৃতির ভ্রান্ত ব্যবস্থা ও রাজনীতির বিরুদ্ধে কার্যতঃ বিদ্রোহ ঘোষণা করতে হবে এবং এ পথে আর্থিক কুরবানী থেকে শুরু করে কারাদণ্ড এমন কি ফাঁসিরও ঝুঁকি নিতে হতে পারে”।
জামায়াতের কাজ কি?
জামায়াতের কাজ কি- এ সম্পর্কে মওদূদী রহ. বলেন-
“দুনিয়াতে জামায়াতে ইসলামীর জন্য করার যে কাজ রয়েছে, সে সম্পর্কে কোন সীমিত ধারণা পোষণ করবেন না।.... তার কাজের পরিধির মধ্যে রয়েছে পূর্ণ প্রসারতাসহ গোটা মানব জীবন। ইসলাম সকল মানুষের জন্য এবং যেসব বস্তুর সাথে মানুষের সম্পর্ক, ইসলামের সাথেও সে সবের সম্পর্ক রয়েছে। অতএব ইসলামী আন্দোলন এক সর্বব্যাপী আন্দোলনের নাম”।
“যারা জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করবে তাদের প্রত্যেকের এ কথা ভালো করে বুঝে নেয়া দরকার যে, জামায়াতে ইসলামীর সামনে যে কাজ রয়েছে তা যেমন তেমন কাজ নয়। দুনিয়ার নীতি নৈতিকতা, রাজনীতি, সভ্যতা সংস্কৃতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি প্রতিটি বস্তু পরিবর্তন করে দিতে হবে। খোদাদ্রোহিতার উপর যে ব্যবস্থা দুনিয়ায় কায়েম রয়েছে তা বদলিয়ে খোদার আনুগত্যের উপর তা কায়েম করতে হবে। এ কাজে সকল শয়তানী শক্তির বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম ও প্রতিটি পদক্ষেপের পূর্বে প্রত্যেককে ভালো করে বুঝে নিতে হবে যে সে কোন্ কন্টকময় পথে পা বাড়াচ্ছে”।
এ কথাগুরো তিনি বলেন জামায়াত প্রতিষ্ঠার দিন তাঁর প্রদত্ত ভাষণে। ভাষণের শেষে তিনি বলেন-
“আমার জন্য ত এ আন্দোলন আমার জীবনের উদ্দেশ্য। আমার জীবন মরণ তারই জন্য। কেউ সম্মুখে অগ্রসর না হলে আমি হবো। কেউ সহযোগিতা না করলে আমি একাকীই এ পথে চলবো। গোটা দুনিয়া ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিরোধিতা করলে আমি একা তার বিরুদ্ধে লড়তে ভয় করবো না।
আমীর নির্বাচিত হওয়ার পর জামায়াত প্রতিষ্ঠাতা সঙ্গী সাথীদের উদ্দেশ্যে যে বিদায়ী ভাষণ দান করেন তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলোঃ
১। জামায়াত সদস্যদের কুরআন, সীরাতুন্নবী ও সীরাতে সাহাবার প্রতি বিশেষ অনুরাগ থাকা একান্ত আবশ্যক। এসব বারবার এবং গভীর মনোযোগ সহকারে পড়তে হবে।
২। এ আন্দোলনের প্রাণ হচ্ছে প্রকৃত পক্ষে তালাল্লুক বিল্লাহ (আল্লাহর সাথে সম্পর্ক)। যদি আল্লাহর সাথে আপনাদের সম্পর্ক দুর্বল হয়, তাহলে আপনারা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে এবং তা সাফল্যের সাথে চালাতে পারবেন না। অতএব নামায ছাড়াও নফল ইবাদতেরও নিয়মিত ব্যবস্থা করুন। নফল নামায, নফল রোযা এবং সদকা এমন সব জিনিস যা মানুষের মধ্যে ইখলাস ও ঐকান্তিকতা সৃষ্টি করে।
৩। জামায়াতের রুকনদের ভালোভাবে উপলব্ধি করা উচিত যে, তারা এক বিরাট দাবীসহ বিরাট কাজের জন্য ময়দানে নামছেন। যদি তাদের চরিত্র ও আচার আচরণ দাবীর তুলনায় এতোটা হীন হয় যে তা অনুভূত হয়, তাহলে তারা নিজেদেরকে ও তাদের দাবীকে হাস্যকর বানিয়ে দিবেন। এ জন্য এ দলে সম্পৃক্ত প্রত্যেককে তার দ্বিগুণ দায়িত্ব অনুভব করতে হবে। খোদার সামনে ত অবশ্য্র দায়ী থাকতে হবে এবং সেই সাথে খোদার সৃষ্টির সামনেও তার দায়িত্ব বড়ো কঠিন।
৪। যে জনপদেই আপনারা থাকুন, সেখানকার সাধারণ অধিবাসীদের তুলনায় আপনাদের চরিত্র উন্নতমানের হওয়া উচিত। বরঞ্চ চরিত্র, আমানতদারী ও দিয়ানতদারীতে দৃষ্টান্তমূলক হতে হবে। আপনাদের সামান্য পদস্খলন শুধু জামায়াতের উপরই নয় বরঞ্চ ইসলামের উপর কালিমা আরোপ করবে এবং আপনারা অনেকের গোমরাহির কারণ হয়ে পড়বেন।
৫। জামায়াতের রুকনদের ঐসব কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকা উচিত যা মুসলমানদের মধ্যে ফিরকা সৃষ্টি করে।
(ক) নিজেদের নামায সাধারণ মুসলমান থেকে পৃথকভাবে পড়বেন না।
(খ) নামাযে নিজেদের জামায়াত পৃথক করবেন না।
(গ) কোন বিতর্কে লিপ্ত হবেন না।
এভাবে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে ১৯৪১ সালের আগস্টের শেষ সপ্তাহে এ আদর্শবাদী দলটি তার যাত্রা শুরু করে। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এ দলটি অবিচ্ছিন্নভাবে তার আদর্শ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংগ্রাম করে চলেছে। এ দলটি সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করতে হলে জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস অবশ্যই পাঠ করা দরকার।
0 comments: