ভদ্র মহোদয়গন! এ পর্যন্ত আমি যা কিছু আরয করলাম, তা থেকে আপনারা জানতে পেরেছেন যে, মুসলমান হিসেবে আমাদের কি কর্তব্য ছিল আর কি করছে এবং নিজেদের কৃতকর্মের জন্য আমাদের কি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এদিক থেকে যদি আপনারা প্রকৃত বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য করেন, তাহলে স্বাভাবতই আপনাদের কাছে এ সত্যটি উদঘাটিত হবে যে, মুসলমানরা আজ ভারতবর্ষ ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেসব সমস্যাকে তাদের জাতীয় জীবনের আসল সমস্যা বলে মনে করে নিয়েছে এবং যেগুলোর সমাধানের জন্য কিছুটা পরিকল্পিত আর বেশির ভাগেই অন্যের সময়,শক্তি শ্রম ও অর্থ ব্যয় নিছক পন্ডশ্রম বৈ কিছুই নয়।
একটি সংখ্যালঘু জাতি আর একটি সংখ্যাগুরু জাতির মাঝখানে থেকে নিজেদের স্বার্থ, অস্তিত্ব ও অধিকার কি করে রক্ষা করবে, কোন সংখ্যালঘু জাতি নিজ নিজ সীমার ভেতরে সংখ্যাগুরুর ন্যায় অধিকার কেমন করে আদায় করবে, কোন পরাধীন জাতি একটি পরাক্রমশালী জাতির অধীনতা থেকে কেমন করে মুক্ত হবে, একটি দুর্বল জাতি একটি শক্তিশালী জাতির অন্যায় ও যুলুম থেকে কেমন করে আত্মরক্ষা করবে, একটি অনুন্নত জাতি কেমন করে একটি শক্তিশালী জাতির ন্যায় উন্নতি, সমৃদ্ধি ও শক্তি অর্জন করবে, এ ধরনের সমস্যা অমুসলিমদের পক্ষে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধানতম সমস্যা বিবেচিত হতে পারে এবং এগুলোর প্রতিই তাদের যাবতীয় চেষ্টা- সাধনা ও মনোযোগ কেন্দ্রীভুত হতে পারে। কিন্তু আমাদের মুসলমানদের পক্ষে এগুলো কোন স্বতন্ত্র ও স্থায়ী সমস্যাই নয়, বরং এ হচ্ছে আমাদের আসল কাজের প্রতি বিমুখতারই অনিবার্য পরিণতি। আমরা যদি সে কাজ যথাযথভাবে সম্পাদন করতাম, তাহলে আজ আর এত জটিল ও উদ্বেগজনক সমস্যার স্তুপ জমতে পারত না। এখনো যদি আমরা ঐ আবর্জনা পরিস্কার করার পরিবর্তে আমাদের যাবতীয় মনোযোগ ও শক্তি- সমর্থকে সেই আসল কর্তব্য পালনে নিয়োজিত করি, তাহলে অনতিকালের মধ্যেই শুধু আমাদের নয়, সারা দুনিয়ার পক্ষে উদ্বেগজনক সমস্যার আবর্জনা স্বাভাবিকভাবেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। কারণ, দুনিয়াকে পরিচ্ছন্ন ও পরিশুদ্ধ রাখার দায়িত্ব আমাদের উপরই ন্যাস্ত ছিল। সে দায়িত্ব পালনে গাফলতির ফলেই আজ দুনিয়াটা সমস্যার আবর্জনায় ভরে গেছে। আর দুনিয়ার সর্বাধিক জঞ্জালময় অবস্থাটা আমাদের ভাগেই পড়েছে।
পরিতাপের বিষয় যে, মুসলমাদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এ বিষয়টি বুঝাবার জন্যে আদৌ চেষ্টা করছেন না। মুসলিম জনসাধারণকে আজ সর্বত্রই এ কথা বুঝানো হচ্ছে যে, সংখ্যাগুরুর প্রশ্ন, স্বদেশের স্বাধীনতা, জাতীয় স্বার্থরক্ষা, বৈষয়িক উন্নতি ইত্যাদিই হচ্ছে তোমাদের আসল সমস্যা। পরন্তু এই ভদ্রলোকেরা এসব সমস্যার সমাধানের যে পন্থা অমুসলিমদের কাছে থেকে শিখেছেন, তাই মুসলমানদের কাছে পেশ করছেন। কিন্তু আমি আল্লাহর অস্তিত্বের উপর যতটা বিশ্বাসী ঠিক ততখানি দৃঢ়তার সাথেই বলতে পারি যে, এদ্বারা আপনাদেরকে ভুল পথে পরিচালিত করা হচ্ছে। আর এ পথে চলে আপনারা কখনো কল্যাণময় লক্ষ্যে পৌছতে পারবেন না।
আসল সমস্যা
তাই আপনাদের জীবনে প্রকৃত সমস্যা কি, এ কথা অকপটে ও পরিস্কার ভাষায় বিবৃত না করলে আপনাদের চরম অহিতাকাক্সক্ষী বলেই প্রমাণিত হবে। আমার জানা মতে আপনাদের বর্তমান, ভবিষ্যত একটি বিশেষ প্রশ্নের সাথে ওতপ্রেতভাবে জড়িত । তা হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তাঁর রাসূলের মাধ্যমে আপনাদের কাছে যে হিদায়াত পাঠিয়েছেন, যার কল্যাণে আপনারা মুসলিম নামে অভিহিত হচ্ছেন এবং যার সাথে সম্পর্কে থাকার দরুন ইচ্ছায় হোক কি অনিচ্ছায় আপনারা দুনিয়ায় ইসলামের প্রতিনিধি সাব্যস্ত হয়েছেন, তার সংগে আপনারা কিরূপ আচরণ করছেন? আপনারা যদি সত্যিকারভাবে ইসলামের আনুগত্য করেন এবং কথা ও কাজের মাধ্যমে তার সত্যতার সাক্ষ্য দেন আর আপনাদের উন্নতি ও সমৃদ্ধি এবং পরকালে সাফল্য ও কল্যাণের অধিকারী হবেন। আমাদের উপর ভয়-ভীতি, অপমান -লাঞ্ছনা এবং পরাজয় ও পরাধীনতার যে মেঘ আচ্ছন্ন হয়ে আছে, তা মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই পরিস্কার হয়ে যাবে। সত্যের প্রতি আপনাদের আহবান ও সচ্চারিত্রিক মাধুর্য লোকদের মস্তিস্ক প্রভাবিত করবে । দুনিয়াজোড়া আপনাদের প্রভাব -প্রতিপত্তি কায়েম হবে আপনাদের কাছ থেকেই ইনসাফ ও ন্যায় বিচারের প্রত্যাশা করা হবে। আপনাদের আমনতদারী ও বিশ্বস্ততার উপরই লোকেরা ভরসা করবে। আপনাদের মুখনিঃসৃত বাণীই সকল মহলে প্রবল বলে স্বীকৃতি লাভ করবে। আপনারাই হবেন যাবতীয় কল্যাণের উৎস। আপনাদের প্রতিদ্বন্দ্বী কুফরী নেতৃত্বের কোন প্রভাব- প্রতিপত্তিই আর অবশিষ্ট থাকবে না। আপনাদের সততা ন্যায়পরায়ণতার ফলে তাদের সমুদয় দর্শন এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতবাদগুলো মিথ্যা বলে প্রমাণিত হবে। তাদের শিবিরে আজ যেসব শক্তির সমাবেশ দেখা যাচ্ছে, তা ছিন্ন হয়ে ইসলামের শিবিরে এসে পড়বে।
এভাবে এমন এক দিন আসবে যখন কম্যুনিজম মস্কোতে থেকেই আত্মরক্ষার জন্যে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়বে। পুঁজিবাদপুষ্ট গণতন্ত্র ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্ক থেকেই আত্মরক্ষার চিন্তায় কম্পমান হবে। লন্ডন ও প্যারিসের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জড়বাদপুষ্ট ও নাস্তিক্যবাদ স্বয়ং ব্রাহ্মণ ও জার্মানদের মাঝেও ভক্ত খুঁজে পাবে না। আর বর্তমান যুগটি এমন একটি শিক্ষামূলক কাহিনীরূপে ইতিহাসে স্থান পাবে যে, ইসলামের ন্যায় বিশ্বগ্রাসী শক্তির ধারকগণও কোনকালে এমনি বেকুব বনে গিয়েছিল যে, হযরত মুসা (আ.) এর যষ্টি বগল তলে চেপে রেখেও লাঠি ও রশি দেখে সাপের ভয়ে কাঁপছিল।
বস্তুত ইসলামের একনিষ্ঠ অনুসারী ও সত্যিকারের সাক্ষ্যদানকারী হলেই আমাদের ভবিষ্যত এমনি উজ্জ্বল হতে পারে। কিন্তু এর বিপরীত আপনারা যদি আল্লাহর প্রেরিত হিদায়াতের উপর জেঁকে বসে থাকেন তা থেকে না আপনারা নিজেরা উপকৃত হন, আর না অন্যকে উপকৃত হতে দেন। আপনারা নিজেদের মুসলান বলে দাবী করে ইসলামের প্রতিনিধি সেজে বসেন আর নিজেদের কথা ও কাজের মাধ্যমে শিরক, জাহিলিয়াত, দুনিয়াপূজা এবং নৈতিক উচ্ছৃংখতার পথেই বেশীর ভাগ সাক্ষ্য দান করেন। আল্লাহর কিতাব তাকের উপর রেখে পথ নির্র্দেশের জন্য ধাবিত হন কুফরের ধ্বজাধারী ও গোমরাহীর উৎসের দিকে। আল্লাহর বন্দেগীর দাবী করে প্রকৃত শয়তানী ও আল্লাদ্রোহী শক্তিগুলোর দাসত্ব করেন, বন্ধুত্ব ও শত্রুতা শুধু প্রবৃত্তির লালসার জন্যেই করেন , আর উভয় ক্ষেত্রেই ইসলামকে দূরে রাখেন আর এভাবে নিজেদের জীবনকেও ইসলামের কল্যাণ থেকে দূরে রাখেন এবং দুনিয়াবাসীকেও ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার পরিবর্তে উল্টো আরো দুরে ঠেলে দেন,তবে এমতবস্তায় আপনাদের দুনিয়া ও আখিরাত কোনটাই কল্যাণময় হতে পারে না। বরং আজ আপনারা যা কিছু দেখতে পাচ্ছেন, তা হচ্ছে আল্লাহর চিরাচরিত নিয়মানুসারে এরূপ কর্মনীতির পরিণতি। আর অদূর ভবিষ্যতে এর চেয়েও মন্দ পরিণতির সম্মুখীন হওয়া মোটেই বিচিত্র নয়।
ইসলামের লেবেলটাকে খুলে দিয়ে প্রকাশ্যে কুফরকে গ্রহণ করলে হয় তো পারসীয়ান, আমেরিকান ও বৃটেনের মতো আপনাদের দুনিয়াবী যিন্দেগীটা চাকচিক্যময় হতে পারতো কিন্তু মুসলমান হয়ে অমুসলমানদের মতো জীবন যাপন করা এবং আল্লাহর দীনের ভূয়া প্রতিনিধিত্ব করে দুনিয়ার মানুষের জন্যে হিদায়াতের দ্বার রূদ্ধ করে দেয়ার এই গুরুতর অপরাধ আপনাদের দুনিয়াবী যিন্দেগীকেও সমৃদ্ধিশালী হতে দেবে না। এ অপরাধের যে শাস্তির কথা কুরআনে লিপিবদ্ধ রয়েছে এবং যার জীবন্ত উদাহরণ হিসেবে আপনাদের সামনে ইহুদী জাতি বর্তমান রয়েছে, তা কিছুতেই নড়চড় হতে পারে না। আপনারা এক জাতিত্বের লঘুতর বিপদকে (اهون البليتين) গ্রহণ করুন কিংবা মুসলিম জাতীয়তার নামে নিজেদের স্বতন্ত্র জাতীয়তার স্বীকৃতি আদায় করে যাবতীয় সুযোগ সুবিধা আদায় করে নেন, এ থেকে কোন মতেই আপনারা রেহাই পেতে পারেন না। কারণ এ শাস্তি থেকে অব্যাহতি পাবার একমাত্র পথই হচ্ছে ঐ অপরাধ থেকে বিরত থাকা।
মুসলমানদের সমস্যা ও তার সমাধান
এখন আমরা কি উদ্দেশ্যে সংঘবদ্ধ হয়েছি তাই আমি আপনাদের কাছে সংক্ষেপে ব্যক্ত করবো। যারা ইসলামকে নিজেদের দীন বলে স্বীকার করে থাকেন, তাদেরকে আমরা এই আহ্বান জানাচ্ছি যে, তাঁরা যেন এই দীনকে নিজেদের প্রকৃত জীবন বিধানে পরিণত করেন। একে যেন ব্যক্তিগতভাবে আহ্বান নিজেদের জীবনে ও সামগ্রিকভাবে নিজেদের গৃহে,খান্দানে,সমাজে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, সাহিত্য ও সাংবাদিকতায়, ব্যবসায়-বাণিজ্যে,অর্থনৈতিক কাজ কারবারে,সমিতি ও জাতীয় প্রতিষ্ঠানে এবং সাধারণভাবে জাতীয় নীতি নির্ধারণে কার্যত প্রতিষ্ঠিত করেন। আমরা তাদেরকে আরো বলছি যে, মুসলমান হিসেবে দীন ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও সত্যের সাক্ষ্যদানই আপনাদের জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য। তাই আপনাদের যাবতীয় চেষ্টা-সাধনা ও ক্রিয়া-কলাপ এই উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করেই সম্পাদিত হওয়া উচিত। যেসব কথা ও কাজে ইসলামের বিরোধিতা এবং ভুল প্রতিনিধিত্ব হওয়ার আশংকা রয়েছে, তা থেকে আপনাদের সর্বতোভাবে বিরত থাকা কর্তব্য। আপনাদের প্রতিটি কথা ও কাজকে ইসলামের মানদণ্ডে যাচাই করুন। দীন ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করা, যথার্থরূপে তার সত্যতার সাক্ষ্য দান করা এবং চূড়ান্তরূপে সত্যকে প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে ইসলামের প্রতি দুনিয়ার মানুষকে আহ্বান জানানোর জন্যে নিজেদের যাবতীয় চেষ্ঠা-সাধনাকে নিয়োজিত করুন।
অধ্যায় ০৫ : মুসলমানদের সমস্যা ও তার সমাধান
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: