হযরত মুহাম্মাদ (সা) -এর নবুয়াত
এমন এক সময় এলো , যখন সারা দুনিয়ার ও মানব জাতির সকল কওমের জন্য এক পয়গাম্বর অর্থাৎ হযরত মুহাম্মাদ (সা) -কে আল্লাহ তা’য়ালা আরব দেশে পয়দা করলেন এবং তাঁকে ইসলামের পূর্ণ শিক্ষা ও পূর্ণাঙ্গ বিধান দান করে তা সারেজাহানে প্রচার করার মহাকর্তব্যে নিযুক্ত করেন।
দুনিয়ার ভূগোল পর্যালোচনা করলে প্রথম দৃষ্টিতে বুঝতে পারা যায় যে , সারা দুনিয়ার পয়গাম্বরীর জন্য যমীনের বুকে আরবের চেয়ে অধিকতর উপযোগী আর কোন স্থান হতে পারে না। এ দেশটি এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের ঠিক কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। ইউরোপও এখান থেকে অত্যন্ত নিকটবর্তী । বিশেষ করে তখনকার দিনে ইউরোপের সভ্য জাতিসমূহ ইউরোপের দক্ষিণ অংশে বাস করতো এবং সে অংশটি আরব থেকে হিন্দুস্তানের মতই নিকটবর্তী ছিল।
আবার তখনকার দিনের দুনিয়ার ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যাবে যে , এ নবূয়াতের জন্য তখনকার দিনে আরব কওমের চেয়ে উপযোগী আর কোন কওম ছিলনা । আর সব বড় বড় কওম তখন দুনিয়ার বুকে নিজ নিজ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কান্ত হয়ে পড়েছিল । কিন্তু আরবরা ছিল তখনো তাজা তারূণ্যের অধিকারী কওম । সভ্যতার ক্রমোন্নতির সাথে অন্যান্য কওমের চালচলনে এসে ছিল বহুবিধ বিকৃতি ; কিন্তু আরব কওমের উপর তখনো তেমন কোন সভ্যতার প্রভাব পড়েনি , যার ফলে তারা আরাম প্রয়াসী , আয়েশ -প্রিয় ও হীন স্বভাব সম্পন্ন হতে পারে । ঈসায়ী ছয় শতকে আরব ছিল সে যুগের সভ্যতা গর্বিত জাতি সমূহের দুষ্ট প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। যে জাতির মধ্যে সভ্যতার হাওয়া লাগেনি তার মধ্যে মানবীয় গুণরাজির জৌলুস যতটা থাকা সম্ভব তা আরবদের মধ্যে ছিল। তারা ছিল বীর্যবান, নির্ভীক ও মহৎপ্রাণ ; তারা প্রতিশ্রু“তি পালন করতো , স্বাধীন চিন্তা ও স্বাধীন জীবন ভালবাসতো তারা , অপর কোন জাতির গোলামী তারা স্বীকার করতো না। আপনার ইয্যত বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ বির্সজন দিতে তারা কুন্ঠিত হতো না। তারা অত্যন্ত সরল জীবন যাপন করতো এবং ভোগ-বিলাসের প্রতি তাদের কোন আসক্তি ছিল না। নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে নানা প্রকার দুস্কৃতির অস্তিত্ব ছিল তার বিবরণ পরে জানা যাবে; কিন্তু তাদের সে দুষ্কৃতির কারণ ছিল এই যে, আড়াই হাযার বছরের মধ্যে তাদের দেশে কোন পয়গামম্বরের আবির্ভাব হয়নি , তাদের মধ্যে নৈতিক , সংস্কৃতির সাধন ও সাংস্কৃতিক শিক্ষা দানের যোগ্যতা নিয়ে কোন সংষ্কারক আসেননি। বহু শতাব্দী ধরে রুক্ষ উষর মরুর বুকে স্বাধীন জীবন যাপনের ফলে তাদের মধ্যে মূর্খতা ও জাহেলী ভাবধারা প্রসার লাভ করেছিল এবং তারা তাদের অজ্ঞতা প্রসূত চালা চলনে এতটা কঠোর ও দৃঢ় বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে , তাদেরকে সত্যিকার মানুষে পরিণত করা কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু এর সাথে সাথে তাদের মধ্যে অবশ্যি এমন এক যোগ্যতা সঞ্চিত ছিল যে , কোন প্রতিভা -দীপ্ত মানুষ তাদের জীবন সংষ্কার সাধনের জন্য এগিয়ে এলে এবং তাদেরকে কোন মহান লক্ষের নির্দেশ দিয়ে প্রবুদ্ধ করলে তারা সেই লক্ষ অর্জনের জন্য সারা দুনিয়াকে ওলট পালট করতেও পশ্চাৎপদ হতো না। সারেজাহানের পয়গাম্বরের শিক্ষার প্রসার সাধনের জন্য প্রয়োজন ছিল এমন এক তারুণ্য -দীপ্ত শক্তিশালী কওমের।
এরপর আরবী ভাষাও লক্ষণীয় । আরবী ভাষা পাঠ করলে এবং তার সাহিত্য সম্পদের পরিচয় লাভ করলে সহজেই বুঝতে পারা যায় যে , উচ্চ চিন্তাধারার প্রকাশ এবং আল্লাহর জ্ঞানের মাধুর্য সূক্ষতাপূর্ণ রহস্য বর্ণনা করে মানব-অন্তরকে প্রভাবিত করার জন্য এর চেয়ে উপযোগী আর কোনা ভাষা হতে পারেনা। এ ভাষায় ছোট ছোট সংক্ষিপ্ত কথা বা বাক্যের মাধ্যমে বিরাট বিরাট ভাব প্রকাশ করা যায় এবং তার প্রকাশভংগী এত বলিষ্ঠ যে, তীর বা বর্শার মতো তা মানুষের অন্তরকে বিদ্ধ করে । এ ভাষার মাধুর্য মানব -কর্ণে মধু বর্ষণ করে । তার মধুর সুর -লহরী মানব অন্তরকে অলক্ষে ছন্দ -পাগল করে তোলে কুরআনের মতো মহাগ্রন্থের বাহন হবার জন্য এমনি এক ভাষারই প্রয়োজন ছিল।
এখানেই আল্লাহ তা’য়ালার মহাজ্ঞানের প্রকাশ যে , তিনি তাঁর সর্বশেষ বিশ্বনবীকে প্রেরণের জন্য এ আরব ভুমিকেই মনোনীত করেছিলেন । যে পবিত্র সত্তাকে আল্লাহ তা’য়ালা এ মহাত্তম কর্তব্যের জন্য মনোনীত করেছিলেন , তিনি কেমন অতুলনীয় ছিলেন , এখন তারই বর্ণনা পেশ করব।
নবুয়াতে মুহাম্মদীর প্রমাণ
আজ থেকে চৌদ্দ শ’ বছর পশ্চাতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যাক। দুনিয়ায় তখন না ছিল তারবার্তায় ব্যবস্থা, না ছিল টেলিফোন না ছিল রেলগাড়ী , না ছিল ছাপাখানা না ছিল পত্র -পত্রিকা না ছিল বই -পত্র , না ছিল বিদেশ সফরের সুযোগ সুবিধা --যা আমরা আজকের দিনে দেখতে পাচ্ছি । এক দেশ থেকে দেশান্তরে যেতে হলে অতিক্রম করতে হতো কয়েক মাসের পথ। এমনি অবস্থায় আরব দেশ ছিল দুনিয়ার আর সব দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। তার আশে পাশে ছিল ইরান, তুরস্ক ও মিসর এবং সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা কিছুটা ছিল। কিন্তু প্রকান্ড বালুর সমুদ্র সেসব দেশ থেকে আরবকে আলাদা করে রেখেছিল । আরব সওদাগররা মাসের পর মাস উটের পিঠে পথ চলে সেসব দেশে তেজারতের জন্য যেতো কিন্তু তাদের সে সম্পর্ক কেবল পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আরব ভূমিতে তখনো কোন উচ্চাংগের সভ্যতার অস্তিত্ব ছিলনা সেখানে না ছিল বিদ্যালয় না ছিল গ্রন্থাগার , না ছিল সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে লেখা –পড়ার র্চচা। সারা দেশে গণনা করার মতো স্বল্প সংখ্যক লোক ছিল যারা কিছুটা লেখা -পড়া জানতো , কিন্তু তাও সে যুগের জ্ঞান বিজ্ঞানের পরিচয় লাভের জন্য যথেষ্ট নয়। কোন সুগঠিত সরকারের অস্তিত্ব ছিল না সেখানে। কোন আইন কানুন ছিলনা । প্রত্যেক গোত্র তার নিজ নিজ এলাকায় স্বেচ্ছাতন্ত্র চালিয়ে যেতো। সারা দেশে স্বাধীনভাবে যথেষ্ট লুট -তরায চলতো। খুন -খারাবী ও যুদ্ধ -বিগ্রহ ছিল সেখানকার নিত্য প্রচলিত ব্যাপার । মানুষের জীবনের কোন মূল্য ছিল না সেখানে যার উপর যার কোনরূপ আধিপত্য চলতো তাকে হত্যা করে সে তার সম্পতি দখল করে বসতো। তাদের ভিতরে কোন নীতিবোধ বা সভ্যতার সংস্পর্শ ছিল না। দুস্কৃতি , শরাবখোরী ও জুয়া ছিল অতি সাধারণ ব্যাপার । একে অপরের সামনে নিরাবরণ হতে তাদের দ্বিধা ছিল না। এমন কি আরব --নারীরা উলংগ অবস্থায় কা’বা শরীফ তাওয়াফ করত। হারাম ও হালালের কোন পার্থক্য ছিল না তাদের জীবনে। আরবদের আযাদী এতটা সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল যে , তারা কোন নিয়ম, কোন আইন, কোন নৈতিক পদ্ধতি মেনে চলতে তৈরী ছিল না, কোন নেতার আনুগত্য তারা কবুল করতে পারতো না। আরবদের অজ্ঞতা এমন চরম রূপ গ্রহন করেছিল যে তারা পাথরের মূর্তিকে পূজা করত। পথ চলতে কোন সুন্দর পাথর টুকরা পাওয়া গেলে তা তুলে এনে সামনে বসিয়ে তারা পূজা করত। যে শির কারুর কাছে অবনমিত হতে রাযী হতো না সামান্য পাথরের সামনে তা ঝুঁকে পড়তো এবং মনে করা হতো যে সেই পাথরই তাদের সকল মনষ্কামনা পূর্ণ করতে পারে।
এমন অবস্থায় এমন জাতির মধ্যে একটি মানুষের আবির্ভাব হল । শৈশবেই পিতা -মাতা ও পিতা মহের স্নেহের ছায়া থেকে তিনি বঞ্চিত হলেন। অতীতের সেই অবস্থার মধ্যে যেটুকু শিক্ষা লাভ করা সম্ভব ছিল তাও তাঁর ভাগ্যে জুটলো না। বড় হয়ে তিনি আরব –শিশুদের সাথে ছাগল চরাতে লাগলেন। যৌবনে তিনি আত্যনিয়োগ করলেন বাণিজ্যে । তাঁর উঠা -বসা মেলামেশা সব কিছুই হতে লাগলো সেই আরবদের সাথে , যাদের অবস্থা আগেই বলা হয়েছে। শিক্ষার নাম গন্ধ নেই , এমন কি সামান্য পড়াশুনাও তিনি জানেন না, কিন্তু তা সত্তেও তাঁর চালচলন তাঁর স্বভাব -চরিত্র তাঁর চিন্তাধারা ছিল অপর সবার চেয়ে আলাদা। তিনি কখনো মিথ্যা কথা বলেন না, কারুর সাথে দুর্বাক্য উচ্চারণ করেন না, কঠোর বাক্যের পরিবর্তে মধু বর্ষিত হয় তাঁর মুখ থেকে, আর তার প্রভাবে মানুষ মুগ্ধ হয়ে আসে তাঁর কাছে। কারুর একটি পয়সা ও তিনি অবৈধ ভাবে গ্রহণ করেন না। তাঁর বিশ্বস্ততায় মুগ্ধ মানুষ তাহাদের বহু মূল্যবান সম্পত্তি রেখে দেয় তাঁর হেফাযতে এবং তিনি প্রত্যেকের সম্পত্তি হেফাযত করে নিজের জীবনের মতো। সমগ্র কওম তাঁর সততায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ‘আল আমিন’ নামে আখ্যায়িত করে । তাঁর লজ্জাশীলতাবোধ এমন প্রখর যে শৈশব থেকে কেউ তাকে কোনদিন নিরাবরণ দেখেনি। তিনিএমন সদাচারী যে , দূরাচারী ও দুস্কৃতি পরায়ণ জাতির মধ্যে প্রতিপালিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি সর্বাবিধ অসদাচরণ ও অশোভন কার্যকলাপকে ঘৃণা করেন এবং তার প্রত্যেকটি কার্যে পাওয়া যায় পরিচ্ছন্নতার পরিচয়। চিন্তাধারার পবিত্রতার দরুন তিনি নিজ জাতির মধ্যে লুট -তরায খুন খারাবি দেখে অন্তরে গভীর দুঃখ অনুভব করেন এবং লড়াইয়ের সময়ে তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। তাঁর কোমল অন্তর প্রত্যেক মানুষের দুঃখ -বেদনার শরীক হয় । ইয়াতিম ও বিধবাকে তিনি সাহায্য করেন , ক্ষুধিতের মুখে খাদ্য তুলে দেন , মুসাফিরকে ও সাদরে ঘরে ডেকে নিয়ে খেতে দেন । তিনি কাউকে ও দুঃখ দেন না , নিজে অপরের জন্য দুঃখ বরন করেন। নির্ভুল জ্ঞানের অধিকারী তিনি , মূর্তিপূজারী কওমের মধ্যে থেকেও মূর্তি পূজাকে ঘৃণা করেন। কখনো কোন সৃষ্টির সামনে তাঁর মাথা নত হয় না। তাঁর অন্তর থেকে স্বতঃই আওয়াজ আসে যমীন - আসমানে যা কিছু দেখা যায় , তার মধ্যে কেউ নেই উপাসনা পাওয়ার যোগ্য । তাঁর দিল আপনা থেকেই বলে ওঠেঃ আল্লাহ তো এজনই মাত্র হতে পারেন এবং তিনি অদ্বিতীয় - একক। এক বর্বর জাতির মধ্যে এ মহান ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হল, যেন এক প্রস্তর স্তুপের মাঝখানে এক দীপ্তমান হীরকখন্ড , যেন ঘনঘোর অন্ধকারের মাঝখানে এক প্রদীপ্ত দীপশিখা।
প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এমনি পবিত্র পরিচ্ছন্ন উচ্চাংগের মহৎ জীবন যাপনের পর তিনি চারিদিকের ঘনিভূত ঘনঘোর দেখে হাঁপিয়ে ওঠেন , অজ্ঞতা , নীতিহীনতা , পাপাচার , দুর্ণীতি , শিরক ও পৌত্তলিকতার ভয়াবহ সমুদ্র বেষ্টন থেকে তাঁর অন্তর চায় মুক্তি , কারণ সেখানকার কোন কিছুই তাঁর মনোভাবের অনুকুল নয়। অবশেষে তিনি জনতা থেকে দূরে এক পর্বতের গুহায় গিয়ে নির্জনতা ও প্রশান্তির দুনিয়ায় কাটিয়ে দেন দিনের পর দিন । অনাহারে থেকে থেকে তিনি আরো পরিশুদ্ধি করে তোলেন তাঁর আত্মাকে , তাঁর চিত্তকে , তাঁর মস্তিষ্ককে । সেখানে তিনি ভাবেন , চিন্তা ও ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে থাকেন, সন্ধান করেন এক নতুন আলোকের যে আলোর দীপবর্তিকা ধারণ করে তিনি দূর করতে পারেন তাঁর চারিদিকের ঘনীভূত অন্ধাকার । তিনি সন্ধান করেন শক্তির উৎস , যা দিয়ে তিনি ভেঙ্গে চুরমার করে দেবেন এ বিকৃত দুনিয়াকে কায়েম করবেন মানবতার সুরু সুন্দর কাঠামো।
এ ধ্যান -তন্ময়তার মাঝখানে তাঁর জীবনে এলো এক বিপুল আত্মিক পরিবর্তন । তাঁর প্রকৃতি এতকাল ধরে সন্ধান করেছিল যে আলোক , আর অন্তরে অকস্মাৎ আবির্ভুত হল তার দীপ্ত রশ্মি । অকস্মাৎ তাঁর অন্তরে এলো এমন এক শক্তি, যার প্রকাশ তিনি আর কোনদিন অনুভব করেনি।পর্বত গুহার নির্জন পরিবেশ ছেড়ে তিনি বেরিয়ে এলেন বাইরে জনতার সামনে, আপন কওমের কাছে এসে তিনি তাদেরকে জানালেনঃ প্রস্তর মূর্তির কোন শক্তি নেই তার পূজা বর্জন কর। এ চাঁদ , এ সূর্য, এ যমীন ও আসমানের সকল শক্তি এক আল্লাহ তা’য়ালার সৃষ্টি তিনিই তোমাদের সকলের স্রষ্টা, তিনিই রিযকদাতা, জীবন -মৃত্যু সব কিছুই তার নিয়মের অধীন । সবাইকে ছেড়ে একমাত্র তাঁরই উপাসনা কর , তারই কাছে মনোবাসনার সিদ্ধি কামনা কর। চুরি ডাকাতি, লুট- তরায , শরাবখোরী , জুয়া প্রতারণা-- যা কিছু করছো তোমরা, এসব পাপ - আল্লাহ ইচ্ছার বিরোধী এসব দুস্কৃতি পরিত্যাগ কর। সত্য কথা বল , ন্যায় বিচার কর, কারুর প্রাণনাশ কর না, কারুর সম্পত্তি হরণ করনা, যা কিছু গ্রহণ কর সত্যের পথে গ্রহণ কর,যা কিছু দান কর সত্য পথে দান কর। তোমরা সবাই মানুষ,সকল মানুষ পরস্পর সমান। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব (শরাফত) তার বংশ মর্যাদার নয় --বর্ণ, রূপ ও সম্পদ নয়। আল্লাহ-পরস্তি, সৎকর্ম ও পবিত্র জীবন যাত্রাই হচ্ছে মানুষের শরাফতের নিদর্শন। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ভয় পোষণ করে সৎ ও পবিত্র জীবন যাপন করে সেই হচ্ছে সর্বোচ্চ স্তরের মানুষ । যে ব্যক্তি তার ব্যতিক্রম করে তার কোন গৌরবই নেই। মৃত্যুর পর তোমাদের সবাইকে হাযির হতে হবে স্রষ্টার সামনে চূড়ান্ত বিচার দিনের সেই সত্যিকার ন্যায়বিচারকের সামনে গ্রাহ্য হবেনা কোন সুপারিশ অথবা উৎকোচ।সেখানে প্রশ্ন উঠবেনা কোন বংশ মর্যদার । সেখানে হবে কেবল ঈমান ও সৎকর্মের হিসেব। যার কাছে এসব সম্পদ থাকবে তার বাসভূমি হবে জান্নাত এবং যার কাছে এর কোন কিছুই থাবে না তার জন্য নির্ধারিত রয়েছে হতাশা ও দোযখের শাস্তি।
তখনকার আরবের জাহেল কওম এ পুণ্যাত্মা মানুষটির উপর দুর্ব্যবহার করে তাঁকে হয়রান করেছে কেবলমাত্র এ অপরাধে যে, তিনি তাদের বাপ- দাদার আমলে প্রচলিত কার্যকলাপের নিন্দা করেছেন এবং পূর্ব পুরুষদের অনুসৃত জীবন পদ্ধতির খেলাফ শিক্ষা দান করেছেন। এ অপরাধে তারা তাঁকে অকথ্য গালি দিতে লাগল ,পাথর মেরে মেরে তাঁর জীবন দুর্বিসহ করে তুলল । তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করল। একদিন দু’দিন নয় , ক্রমাগত তের বছর ধরে তাঁর উপর চালিয়ে গেল কঠিনতম নির্যাতন, অবশেষে তাঁকে স্বদেশের পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে যেতে হল বিদেশে। দেশ ছেড়ে যেখানে তিনি আশ্রয় নিলেন, সেখানেও তাঁকে তারা কয়েক বছর ধরে পেরেশান করতে লাগল।
এত সব দুঃখ কষ্ট ও নির্যাতন তিনি কেন সহ্য করলেন ? তার একমাত্র লক্ষ ছিল তার কওমকে সত্যের সহজ সঠিক পথ নির্দেশ করা । তার জাতি তাকে বাদশাহের মর্যাদা দান করতে প্রস্তুত ছিল , তার পায়ের উপর ঢেলে দিতে চেয়েছিল সম্পদের স্তুপ । তারা চাইত কেবল তাকে সত্য প্রচার থেকে বিরত রাখতে । তিনি তাদের সকল প্রলোভনকে অকাতরে উপোকারে আপন লক্ষে অবিচল রইলেন । যে মানুষ নিজের স্বার্থের জন্য নয়, অপরের কল্যাণ সাধনের জন্য ক্রমাগত দুঃখ কষ্ট ও নির্যাতন সহ্য করে যান, তার চেয়ে বড় মহৎ অন্তঃকরণ ও সততার কল্পনা আর কারুর মধ্যে করা যায় কি ? যাদের কল্যাণের জন্য তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন তারাই তাঁকে পাথর মেরে আহত করছে আর তিনি প্রতিদানে তাদের কল্যাণই কামনা করছেন । মানুষ তো দূরের কথা ফিরেশতা ও এমনি সততার নিদর্শন দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়।
বিশেষ করে দেখা দরকার যে , এ মানুষটি যখন পর্বত গুহা থেকে এ সত্যের বাণী নিয়ে বেরিয়ে এলেন মানব সমাজের সামনে, তখন তাঁর মধ্যে ঘটে গেল কত বড় বিপ্লব । যে বাণী তিনি মানুষকে শুনাতে লাগলেন তা এমন স্বচ্ছ -সাবলীল , ভাষা ও সাহিত্যের মানদন্ডে এতই উচ্চাংগের ও অলংকার পূর্ণ যে তার আগে অথবা পরে এমন কথা কেউ কোন দিন বলেনি। কাব্য , বাগ্নিতা ও ভাষার স্বচ্ছতা নিয়ে আরবরা গর্ব করে বেড়াত । আরবের জনগণের সামনে তিনি চ্যালেঞ্জ করলেন কালামে পাকের সূরার মত একটি সূরা পেশ করতে, কিন্তু তাঁর সে চ্যালেঞ্জের সামনে সবারই মাথা নত হয়ে গেল। এ বিশেষ কালামের (কুরআন শরীফ ) ভাষা যেমন ছিল, তাঁর সাধারণ আলাপ আলোচনা ও বক্তৃতার ভাষা কিন্তু তেমন উচ্চাংগের ছিল না। আজও যখন আমরা তাঁর নিজস্ব অন্যান্য বাণীর সাথে এ কালামের তুলনা করি, তখন তার মধ্যে ধরা পড়ে একটা সুস্পষ্ট পার্থক্য ।
এ মানুষটি ---এ আরব মরুর অক্ষরজ্ঞান বর্জিত মানুষটি যে জ্ঞানগর্ভ দার্শনিক বাণী উচ্চারণ করতে শুরু করলেন, তাঁর আগে আর কোন মানুষ এমন কথা বলেনি, তাঁর পরে আজ পর্যন্ত কেউ তেমনি বলতে পারেনি; এমন কি চল্লিশ বছর বয়সের আগে পর্যন্ত তাঁর মুখে কেউ এমন কথা শুনেনি।
এ উম্মী (নিরক্ষর) মানুষটি নৈতিক-জীবন ও সামাজিক- জীবন , অর্থনীতি , রাজনীতি ও মানব -জীবনের অন্যান্য সকল দিক সম্পর্কে এমন সব বিধান রচনা করে গেছেন যে , বড় বড় বিদ্বান ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা বহু বছরের চিন্তা -গবেষণা ও সারা জীবনের পরীক্ষা -নীরিক্ষা দ্বারা বহু কষ্টে তার নিগূঢ় তাৎপর্য কিছুটা উপলব্ধি করতে পারে এবং দুনিয়ার মানবীয় অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষা -নীরিক্ষা যত বেশি করে প্রসার লাভ করছে , ততই তার নিগূঢ় তাৎপর্য মানুষের কাছে সুস্পষ্টতর হয়ে উঠছে। তেরশ' বছরের অধিক কাল অতীত হয়ে গেছে; কিন্তু আজো তাঁর রচিত বিধানের মধ্যে কোন সংশোধনের অবকাশ অনুভুত হচ্ছে না । দুনিয়ার মানব -রচিত বিধান ইতিমধ্যে হাযার হাযার বার রচিত হয়েছে ও বাতিল হয়ে গেছে ; প্রত্যেক পরীক্ষায় এসব বিধান ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে এবং প্রত্যেক বার তার মধ্যে পরিবর্তন সাধন করতে হয়েছে। কিন্তু এ নিরক্ষর মরুবাসী অপর কোন মানুষের সাহায্য ব্যতিরেকে যে বিধান মানুষের সামনে পেশ করে গেছেন , তার একটি ধারাও পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়নি।
নবুয়াতের ২৩ বছরের মধ্যে তিনি নিজস্ব চরিত্র মাধুর্য , সততা , মহত্ত্ব ও উচ্চাংগের শিক্ষার প্রভাবে দুশমন দেরকে বানিয়েছিলেন দোস্ত এবং প্রতিদ্বন্দ্বিদেরকে পনিরণত করেছিলেন সহযোগীতে । বড় বড় শক্তি তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত পরাজয় বরণ করে তাঁর পায়ে আত্মসমর্পণ করেছে। বিজয়ী হয়েও তিনি কোন দুশমনের উপর তার দুশমনির বদলা নেননি, কারুর প্রতি তিনি কঠোর আচরণ করেনি। যে ব্যক্তি তাঁর আপন চাচাকে হত্যা করে তার কলিজা চিবিয়েছিল তার উপর বিজয়ী হলেও তিনি তাকে মাফ করেছিলেন , যারা তাঁকে পাথর মেরেছিল , স্বদেশ থেকে বিতাড়িত করেছিল , তাদেরকে হাতে পেয়েও তিনি মার্জনা করেছিলেন । তিনি কারুর সাথে প্রতারণা করেননি , কখনো কোন প্রতিশ্র“তি ভংগ করেনি । লড়াইয়ের মধ্যে ও তিনি কোন নিষ্ঠুরতার পরিচয় দেননি; তাঁর কঠিনতম দুশমনও কোন দিন তাঁর বিরুদ্ধে অন্যায় আচরণ ও যুলুমের অপবাদ আনতে পারেনি। তাঁর এ অতুলনীয় সততার প্রভাবে তিনি শেষ পর্যন্ত সারা আরবের অন্তর জয় করেছিলেন । উপরের বর্ণনায় যে আরবদের অবস্থার পরিচয় পাওয়া গেল , নিজস্ব শিক্ষা ও হেদায়াতের প্রভাবে তিনি সেই আরবদেরকে বর্বরতা ও অজ্ঞতা থেকে মুক্ত করে এক উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সুসভ্য জাতিতে পরিণত করলেন। যে আরব কোন আইনের আনুগত্য স্বীকার করতে রাযী ছিল না, তাদেরকে তিনি এমন আইনানুগ করে তুললেন যে দুনিয়ার ইতিহাসে এমন আইননুসারী কওম আর দেখা যেত না। যে আরবদের মধ্যে অপরের আনুগত্য প্রবণতা মোটেই ছিলনা , তাদেরকে তিনি এক বিশাল সাম্রাজ্যের অনুগত করে দিলেন। যে মানুষের গায়ে কোন দিন নীতি বোধের হাওয়া পর্যন্ত লাগেনি তাদেরকেও তিনি এমন নৈতিক -চরিত্রসম্পন্ন করে তুললেন যে , তাদের অবস্থা পর্যালোচনা করে আজ দুনিয়া বিস্ময় বিমুগ্ধ হয়ে যায়। তখনকার দিনে যে আরবরা দুনিয়ার জাতিসমূহের মধ্যে সবচেয়ে হীন মর্যাদা সম্পন্ন ছিল , এ একটি মাত্র মানুষের প্রভাবে তেইশ বছরের মধ্যে তারা এমন প্রবল শক্তিমান হয়ে উঠলো যে, তারা ইরান, রোম ও মিসরের প্রবল প্রতাপান্বিত সম্রাটদের সিংহাসন উলটিয়ে দিল; দুনিয়াকে তারা দিল তাহযিব -তামাদ্দুন, নৈতিক জীবন ও মানবতার শিক্ষা; ইসলামের এক শিক্ষা ও এক শরীয়াত নিয়ে তারা ছড়িয়ে পড়লো এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার সুন্দরতম এলাকা পর্যন্ত।
এ’তো গেল আরব কওমের উপর ইসলামের প্রভাব। এর চেয়ে বেশী বিস্ময়করভাবে নিরর আরব-নবীর প্রভাব পড়েছিল তামাম দুনিয়ার উপর। তিনি সারা দুনিয়ার প্রচলিত চিন্তাধারা , আচরণ -পদ্ধতি ও আইন-কানুনের মধ্যে আনলেন এক অভূতপূর্ব বিপ্লব। যারা তার নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল , তাদের কথা ছেড়ে দিলের বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এই যে, যারা তার আনুগত্য স্বীকারে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, যারা তার বিরোধিতা করেছে তার সাথে দুশমনী করেছে, তারাও তার প্রভাব থেকে মুক্ত হয়নি। দুনিয়া তাওহীদের শিক্ষা ভুলে গিয়েছিল , তিনি মানুষকে আবার স্মরণ করিয়ে দিলেন সেই শিক্ষা । এবং এমন জোরের সাথে সত্যের ভেরী বাজালেন যে , আজ বুতপরস্ত ও মুশরিকদের ধর্ম পর্যন্ত তাওহীদের স্বীকৃতি দান করতে বাধ্য হচ্ছে। তিনি এমন বলিষ্ঠ নৈতিক শিক্ষা মানুষকে দিয়ে গেছেন যে, তার বিধিবদ্ধ নীতি আজ তামাম দুনিয়ার প্রচলিত নৈতিক শিক্ষায় প্রসার লাভ করেছে ও করছে। আইন, রাজনীতি , সভ্যতা ও সামাজিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে নীতি তিনি নির্ধারণ করে গেছেন, তা এমন সত্যাশ্রিত ও সর্বকালে প্রযোজ্য যে , তার বিরোধী সমালোচকরা পর্যন্ত নীরবে তা থেকে মাল-মশলা সংগ্রত করে নিয়েছে এবং এখনো নিচ্ছে।
আগেই বলেছি , এ অসাধারণ মানুষটি জন্ম নিয়েছিলেন এক জাহেল কওমের মধ্যে এক ঘনঘোর তমসাচ্ছন্ন দেশে। চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত পশু চারণ ও সওদাগরী ছাড়া আর কোন বৃত্তি তিনি অবলম্বন করেননি। কোন রকম শিক্ষা -দীক্ষা তিনি লাভ করেননি। । ভেবে দেখবার বিষয় , চল্লিশ বছর বয়সের পর তাঁর মধ্যে আকস্মিকভাবে এতটা পূর্ণতা এলো কোত্থেকে? কোত্থেকে তার মধ্যে এলো অপূর্ব জ্ঞানসম্ভার ? কোত্থেকে তিনি পেলেন এ বিপুল শক্তি ? একটিমাত্র মানুষ –কখনো তিনি অসাধারণ সিপাহসালার , কখনো এক অতুলনীয় জ্ঞানসম্পন্ন বিচারপতি , কখনো মহাশক্তিধর বিধানকর্তা , কখনো অপ্রতিদ্বন্দ্বী দার্শনিক, কখনো নৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে অতুলনীয় সংস্কারক , আবার কখনো বিস্ময়কর রাজনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন নেতা! জীবনের বহুমুখী কর্মব্যস্ততা সত্ত্বেও রাত্রিকালে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেন আল্লাহ্র ইবাদাতে , স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি ও হক আদায় করেন, গরীব ও বিপন্ন মানুষের খেদমত করেন। এক বিশাল সাম্রাজ্যের শাসন-কর্তৃত্ব লাভ করেও ফকীরের মত জীবন যাপন করেন; মাদুরের উপর শয়ন করেন , মোটা কাপড় পরিধান করেন, গরীবের মত খাদ্য গ্রহণ করেন, এমন কি কখনো অনশনে অর্ধাশনে কেটে যায় তার দিন।
এমনি বিস্ময়কর অতি -মানবীয় পূর্ণতার পরিচয় দিয়ে তিনি যদি দাবী করতেন যে , তিনি অতি মানবীয় অস্তিত্বের অধিকারী , তা হলেও কেউ তার সে দাবী অগ্রাহ্য করতে পারতো না, কিন্তু তার বদলে তিনি কি বলেছেন ? তার সে পূর্ণতাকে তিনি নিজস্ব কৃতিত্ব বলে দাবী করেননি, বরং তিনি হামেশা বলতেনঃ
আমার কাছে আপনার বলতে কিছুই নেই; এর সবকিছুর মালিক আল্লাহ এবং আল্লাহর তরফ থেকেই এসব আমি পেয়েছি , যে বাণী আমি পেশ করছি এবং যার অনুরূপ বাণী পেশ করতে সকল মানুষ ব্যর্থ হয়েছে , তা আমার নিজস্ব বাণী নয় তা আমার মস্তিষ্ক প্রসূত রচনা নয়। এ হচ্ছে আল্লাহর কালাম এবং এর সবটুকু প্রশংসা আল্লাহরই প্রাপ্য। আমার যা কিছু কার্যকলাপ, তাও আমার নিজস্ব যোগ্যতা দ্বারা সম্পন্ন হয়নি, কেবলমাত্র আল্লাহরই নির্দেশে তা সম্পন্ন হয়েছে। আল্লাহর কাছ থেকে যে ইংগিত আমি পাই অনুরূপ ভাবেই আমি কাজ করি এবং কথা বলি।
এমনি সত্যনিষ্ঠ মানুষকে আল্লাহর পয়গাম্বর না মেনে পারা যায় কি করে? তিনি এমন পূর্ণতার অধিকারী যে , তামাম দুনিয়ার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত তার মত একটি মানুষ ও খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু তার সত্যনিষ্ঠা এমন অসাধারণ যে, সেই পূর্ণতার গর্ব তাঁর ভিতরে মোটেই নেই । সেই পূর্ণতার জন্য তিনি কোন প্রশংসা অর্জন করতে চান না। সকল প্রশংসা সুস্পষ্টভাবে তাঁরই প্রতি আরোপ করেন ,যিনি তাঁকে সবকিছু দান করেছেন। কি করে তাঁকে সত্য বলে স্বীকার না করে পারা যায়? তিনি নিজে যখন তাঁর সবটুকু শ্রেষ্ঠত্বকে আল্লাহর বলে স্বীকার করেন, তখন আমরা কেন বলবঃ না , এর সবকিছু তোমার আপন মস্তিষ্কের সৃষ্টি ? মিথ্যাচারী মানুষই তো অপরের কৃতিত্বকে আপনার দিকে টেনে নেবার চেষ্ট করে; কিন্তু এ মানুষটি যেসব কৃতিত্বকে সহজেই আপনার বলে দাবী করতে পারতেন যেসব কৃতিত্ব অর্জন করার কারণ কারুর জানা ছিল না। এবং যা প্রদর্শন করে তিনি অতিমানবীয় মর্যাদা দাবী করলে কেউ তা অগ্রাহ্য করত না , সেসব কৃতিত্বকেও তিনি তার আপনার দিকে টেনে নেবার ষ্টো করেননি। তাহলে তার চেয়ে অধিকতর সত্যাশ্রয়ী মানুষ আর কে হতে পারে?
এ মানুষটি--এ অসাধারণ কৃতিত্বসম্পন্ন মানুষটি ছিলেন আমাদের নেতা তামাম জাহানের পয়গাম্বর হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সা) । তার নিজস্ব সত্যনিষ্ঠাই হচ্ছে তার পয়গাম্বরীর অকট্য প্রমাণ। তার গৌরবময় কার্যকলাপ তাঁর স্বভাব- চরিত্র , তাঁর পবিত্র জীবনের ঘটনা প্রবাহ সব কিছুই ইতিহাসে প্রমাণিত হয়েছে। যে ব্যক্তি স্বচ্ছ অনন্তঃকরণে সত্যানুসন্ধিৎসা ও ন্যায়ের মনোভাব সহকারে তাঁর সে বিবরণ পাঠ করবে , তার অন্তর স্বতঃই সাক্ষ্য দান করবে যে , তিনি নিশ্চিত রূপে আল্লাহর পয়াগম্বর। যে বাণী তিনি পেশ করেছিলেন, তা- হচ্ছে কুরআন , তা-ই আমরা পাঠ করে থাকি । যে ব্যক্তি এ অতুলনীয় কিতাব হৃদয়ংগম করে মুক্ত অন্তরে পাঠ করবে তাকে স্বীকার করতেই হবে যে, এ নিশ্চিতরূপে আল্লাহ্র প্রেরিত গ্রন্থ এবং কোন মানুষের মধ্যেই নেই এরূপ গ্রন্থ প্রণয়নের ক্ষমতা।
খতমে নবুয়াত
একথা জেনে রাখা প্রয়োজন যে, এ যুগে ইসলামের সত্য সহজ ও সঠিক পথের নির্দেশ জানার জন্য হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (সা) এর শিক্ষা ও কুরআন মাজীদ ছাড়া আর কোন মাধ্যম নেই। মুহাম্মাদ (সা) সমগ্র মানব জাতির জন্য আল্লাহর পয়গাম্বর । তাঁর মধ্যেই পয়াগম্বরীর ধারা শেষ হয়ে গেছে। আল্লাহ তা’য়ালা যেভাবে মানুষকে হেদায়াত করতে চান, তার সবকিছুর নির্দেশ তিনি পাঠিয়েছেন তাঁর আখেরী পয়গাম্বরের মাধ্যমে। এখন যে ব্যক্তি সত্যের সন্ধানী ও আল্লাহর মুসলিম বান্দাহ হতে ইচ্ছুক, তাঁর অপরিহার্য কর্তব্য হচ্ছে আল্লাহর আখেরী পয়গাম্বরের উপর ঈমান আনা, তাঁর প্রদত্ত শিক্ষা মেনে নেয়া এবং তাঁরই প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে চলা।
খতমে নবুয়াতের প্রমাণ
পয়গাম্বরীর তাৎপর্য আগেই বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সেই কথাগুলো বুঝে নিলে এবং তা নিয়ে চিন্তা করলে সহজেই জানা যাবে যে, পয়গাম্বর রোজ পয়দা হয় না, প্রত্যেক কওমের মধ্যে সবসময় পয়গাম্বরের আবির্ভাব হওয়ার প্রয়োজন নেই। পয়গাম্বরের জীবই হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে তাঁর শিক্ষা ও হেদায়াতের জীবন। যতক্ষণ তাঁর শিক্ষা ও হেদায়াত জীবন্ত থাকে ততক্ষণ তিনি জীবিত থাকেন। পূর্ববর্তী পয়গাম্বরদের মৃত্যু ঘটেছে , কারণ যে শিক্ষা তাঁরা নিয়ে এসেছিলেন দুনিয়ার মানুষ তা বিকৃত করে ফেলেছে। যেসব গ্রন্থ তাঁরা নিয়ে এসেছিলেন তার কোনটিই আজ অবিকৃত অবস্থায় নেই। তাঁদের অনুগামীরাই আজ দাবী করতে পারছেনা যে, তাদের পয়গাম্বরের দেয়া আসল কিতাব তাদের কাছে মওজুদ রয়েছে , তারাই ভুলিয়ে দিয়েছে তাদের পয়গাম্বরের দেখানো পথ! পূর্ববর্তী পয়গাম্বরদের মধ্যে একজনের ও নির্ভুল নির্ভরযোগ্য বিবরণ আজ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রত্যয় সহকারে আজ বলা যায় না কোন জামানায় তিনি পয়দা হয়েছিলেন ? কি কাজ তিনি করে গেছেন? কিভাবে তিনি জীবনযাপন করেছিলেন? কি কি কাজের শিক্ষা তিনি দিয়েছিলেন এবং কি কি কাজ থেকে মানুষকে বিরত করতে চেয়েছিলেন ? এমনি করেই হয়েছে তাঁদের সত্যিকার মৃত্যু।
পাক্ষান্তরে , হযরত মুহাম্মাদ (সা) আজো রয়েছেন জীবিত , কারণ তাঁর শিক্ষা ও হেদায়াত আজো জীবন্ত হয়ে রয়েছে । যে কুরআন তিনি দিয়ে গেছেন, তা আজো তার তার মূল শব্দ -সম্ভার সহ অবিকৃত অবস্থায় মওজুদ রয়েছে তার একটি হরফ , একটি নোকতা , একটি যের যবরের পার্থক্য ও হয়নি কোথাও । তাঁর জীবন -কাহিনী তাঁর উক্তি সমূহ ও কার্যকলাপ সব কিছুই সুরতি হয়ে আছে । তেরশ বছরের ব্যবধানে আজো ইতিহাসে তাঁর বর্ণনা এমন সুস্পষ্টভাবে আমরা দেখতে পাই , যেন তাঁকে আমরা দেখেছি প্রত্যক্ষভাবে । হযরত (সা) এর ব্যক্তির জীবন -কাহিনী যেমন সুরতি হয়ে রয়েছে , দুনিয়ার ইতিহাসে আর কোন ব্যক্তির জীবন-কাহিনী তেমন অবিকৃতভাবে সুরতি হয়নি । আমরা আমাদের জীবনের প্রতিটি কাজে , প্রতি মুহুর্তে হযরত (সা) এর জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। তাতেই প্রমাণিত হয় যে হযরত (সা) এর পর আর কোন পয়গাম্বরের প্রয়োজন নেই।
এক পয়গাম্বরের পর অপর কোন পয়গাম্বরের আবির্ভাবের কেবল মাত্র তিনটি কারণ থাকতে পারেঃ
একঃ যখন পূর্ববর্তী পয়গাম্বরের শিক্ষা হেদায়াত নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং পুনরায় তা পেশ করার প্রয়োজন হয় , দুইঃ যখন পূর্ববর্তী পয়গাম্বরের শিক্ষা অসম্পূর্ণ থাকে এবং তাতে সংশোধন ও সংযোজনের প্রয়োজন হয় , তিনঃ পূর্ববর্তী পয়গাম্বরের শিক্ষা যখন কোন বিশেষ জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং অপর জাতি বা জতিসমূহের জন্য অপর কোন পয়গাম্বরের প্রযোজন হয়।
উপরিউক্ত তিনটি কারণের কোনটিই বর্তমানে প্রযুক্ত হতে পারে না, কারণঃ
একঃ হযরত মুহাম্মাদ(সা) এর শিক্ষা ও হেদায়াত আজো জীবন্ত রয়েছে এবং সেসব মাধ্যম এখন পুরোপুরি সংরক্ষিত রয়েছে , যা থেকে প্রতি মুহুর্তে জানা যায়, হযরতের দ্বীন কি ছিল , কোন জীবন পদ্ধতির তিনি প্রচলন করেছিলেন এবং কোন কোন পদ্ধতি মিটিয়ে দেবার ও প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিলেন । যখন তাঁর শিক্ষা ও হেদায়াত আজো মিটে যায়নি , তখন আবার তা নতুন করে পেশ করার জন্য কোন নবী আসার প্রয়োজন নেই।
দুইঃ হযরত মুহাম্মাদ (সা)- এর মাধ্যমে দুনিয়াকে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা দেয়া হয়ে গেছে । এখন তার মধ্যে যেমন কিছু কম - বেশী করার প্রয়োজন নেই , তেমনি তার মধ্যে এমন কোন ঘাটতি নেই , যা পূরণ করার জন্য আর কোন নবী আসার প্রয়োজন হবে। সুতরাং দ্বিতীয় কারণটির কোন অস্তিত্ব নেই।
তিনঃ হযরত মুহাম্মাদ (সা) কোন বিশেষ কওমের জন্য পেরিত না হয়ে তামাম দুনিয়ার জন্য নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন এবং সমগ্র মানব জাতির জন্য তাঁর শিক্ষা যথেষ্ট । সুতরাং এখন কোন বিশেষ কওমের জন্য স্বতন্ত্র নবী আসার প্রয়োজন নেই। তাই তৃতীয় কারণটিও এ ক্ষেত্রে অচল।
এসব কারণে হযরত মুহাম্মাদ (সা) কে বলা হয়েছে ‘ খাতামুন্নাবীয়্যিন ’ অর্থাৎ যাঁর ভিতরে নবুয়াতের ধারার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। এখন আর দুনিয়ায় নতুন কোন নবীর আবির্ভাবের প্রয়োজন নেই; প্রয়েজন কেবল এমন মানুষের --যারা হযরত মুহাম্মাদ (সা) -এর পথে নিজেরা চলবেন ও অপরকে চালাবেন ; যাঁরা তাঁর শিক্ষাধারাকে উপলব্ধি করবেন , তদনুযায়ী আমল করবেন এবং দুনিয়ায় যে আইন ও বিধান নিয়ে হযরত মুহাম্মাদ (সা) তাশরিফ এনেছিলেন , সেই আইন ও বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করবেন।
অধ্যায় ০৪ : হযরত মুহাম্মাদ (সা) -এর নবুয়াত (প্রমান ও অন্যান্য...)
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
রিসেন্ট ব্লগ পোষ্টস
বিষয়শ্রেণী
রাইটার
প্রিয়-ক্লিক
কিছু বই
- অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
- অর্থনীতিতে রাসূল (সা) এর দশ দফা
- আদর্শ মানব মুহাম্মদ (সা)
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
- ইসলাম ও জিহাদ
- ইসলাম পরিচিতি
- ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী
- ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক
- ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
- ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
- ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী
- ইসলামী বিপ্লবের পথ
- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
- ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার
- একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণঃ তার থেকে বাঁচার উপায়
- চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান
- দায়ী’ ইলাল্লাহ - দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
- নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে
- নামায-রোজার হাকীকত
- মোরা বড় হতে চাই
- যাকাতের হাকীকত
- রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
- শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর চিন্তাধারা
- সত্যের সাক্ষ্য
- হেদায়াত
0 comments: