অধ্যায় ০১ : আল কুরআন থেকে জিহাদ প্রসঙ্গে কয়েকটি আয়াত

এক: “যুদ্ধ তোমাদের জন্যে ফরয করা হলো, যদি তোমরা তা অপছন্দ কর। (বস্তুত) এমন অনেক বিষয়কে তোমরা পছন্দ কর না অথচ তা তোমাদের জন্যে কল্যাণকর এবং এমন অনেক কিছু তোমরা শ্রেয় মনে কর অথচ আসলেই তা তোমাদের জন্যে ক্ষতিকর। (এর কারণ এই যে) আল্লাহই জানেন এবং তোমরা জান না”। (সূরা আল বাকারা : ২১৬)

দুই: “হে ঈমানদারগণ, কাফেরদের ন্যায় কথাবার্তা বলো না, যাদের নিকটাত্মীয়রা যদি কখনও বিদেশে যায় বা যুদ্ধে শরীক হয় (এবং সেখানে কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়) তখন তারা বলে যে, তারা আমাদের কাছে থাকলে মারা যেত না বা নিহত হতো না। আল্লাহ এ ধরণের কথাবার্তা তাদের মনে দু:খ ও চিন্তার কারণ বানিয়ে দেন। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর পথে মারা যাও অথবা নিহত হও, তাহলে আল্লাহর যে রহমত ও মাগফেরাত তোমরা পাবে, তা এ ধরনের লোকেরা যা কিছুই সংগ্রহ-সঞ্চয় করেছ তার চেয়ে অনেক উত্তম। আর তোমরা মৃত্যুবরণ করো বা নিহত হও, সকল অবস্থায়ই তোমাদের সবাইকে আল্লাহর নিকট সমবেত হতে হবে”। (সূরা আলে ইমরান : ১৫৬-১৫৮)

এখন চিন্তা করা উচিত প্রথম আয়াতে আল্লাহর রাহে মৃত্যু বা হত্যার মোকাবেলায় তাঁর অপার করুণা ও ক্ষমার কথা বলা হয়েছে কিন্তু দ্বিতীয় আয়াতে তা বলা হয়নি এতে জিহাদের উল্লেখ নেই।

তিন: “যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, তাদেরকে মৃত মনে করো না, প্রকৃতপক্ষে তারা জীবিত। তারা তাদের প্রভুর নিকট রিযিক পাচ্ছে। আল্লাহ তাদেরকে নিজ অনুগ্রহে যা কিছু দান করেছেন তা নিয়ে তারা খুশী ও পরিতৃপ্ত। এবং যেসব ঈমানদার লোক তাদের পেছনে দুনিয়ায় রয়ে গেছে এবং এখনো তাদের সাথে এসে মিলিত হয়নি তাদের জন্যে কোনো ভয় ও চিন্তা নেই”। (সূরা আলে ইমরান : ১৬৮-১৭০)

এ সূরার ১৭১ থেকে ১৭৫ পর্যন্ত আয়াতসমূহে অনুরূপ কথা বলা হয়েছে, কুরআনে হাকীম খুললে তা দেখা যাবে।

চার : “যারা দুনিয়ার জীবনের বিনিময়ে আখেরাতকে খরিত করে, তাদের উচিত আল্লাহর রাহে লড়াই করা। যে আল্লাহর পথে যুদ্ধ করবে, সে তাতে নিহত হোক বা বিজয়ী হোক, তাকে আমরা অবশ্যই বিরাট প্রতিদান দেব।” (সূরা আন নিসা : ৭৪)

এ সূরার ৭১-৭৮ পর্যন্ত আয়াতসমূহে একই বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আল কুরআনের সূরা নিসা একবার পড়ে দেখুন। তাতে দেখবেন আল্লাহ তা’আলা মুসলমানদেরকে কিভাবে সদা হুশিয়ার থাকার জন্যে বলেছেন এবং কখনো বা পূর্ণ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে জামায়াতবদ্ধভাবে বা একাকী জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে ডাক দিয়েছেন, আপনি বুঝতে পারবেন আল্লাহ তা’আলা কি ভাষায় জিহাদের কর্তব্য পালনে অবহেলাকারী মুসলমানদেরকে তাদের নিষ্ক্রিয়তা, কাপুরুষতা ও স্বার্থপরতা জন্যে ধমক দিয়েছেন। দুর্বলের সাহায্য ও মজলুমের প্রতিরক্ষার জন্যে আল্লাহ কি করতে চান তাও এসব আয়াত থেকে বুঝা যাবে। সূরা আন নিসার আয়াতসমূহে আল্লাহ নামায-রোযার সাথে জিহাদেও যোগ করেছেন এবং জিহাদ যে ইসলামী জীবন ব্যবস্থারূপী ইমারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ খুঁটি, তাও তিনি বুঝিয়ে বলেছেন। শুধু তাই নয়, দুর্বল মুসলমানদে মনের দোদুল্যমানতা, তাদের সন্দেহ-সংশয় দূর করে আল্লাহ তাদের মনে সাহস ও বীরত্বের সঞ্চার করেছেন। এ সূরার মহান আয়াতগুলো মুসলমানদের মন এমন মৃত্যুঞ্জয়ী মনোভাব সৃষ্টি করে যারা ভিত্তিতে তারা প্রভুর নিকট থেকে নিশ্চিত প্রতিদানের আশায় মৃত্যুর মোকাবেলায় দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যায়। তাদের মনে এ দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে, ত্যাগ-কুরবানী তা যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, মহান প্রতিপালক তার উপযুক্ত প্রতিদান থেকে কাউকে বঞ্চিত করবেন না।

পাঁচ: সূরা আনফাল পুরোটাই জিহাদের দাওয়াত ও যুদ্ধের আহ্বানে ভরপুর। এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুসলমানদেরকে জিহাদে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে এবং জিহাদের বিস্তারিত বিধি-বিধান সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এজন্যে রাসূলে কারীম (সা) এর সংগী-সাথীরা এ সূরাকে যুদ্ধ-সংগীত হিসেবে ব্যবহার করেছেন। মরণপণ জিহাদ যখন শুরু হয়ে যেত, অস্ত্রের ঝনঝনায় যখন দশদিন মুখরিত হতো তখন ইসলামের মুজাহিদরা এ সূরার মর্মস্পর্শী ভাষায় তেলাওয়াত করতেন আর আল্লাহর রাহে প্রাণ বিলিয়ে দোয়ার জন্যে ব্যাকুল হয়ে যেতেন। উদাহরণ স্বরূপ পড়ুন, “আর তোমরা যতদূর সম্ভব হাতিয়ার প্রস্তুত কর এবং সদাসজ্জিত ঘোড়া তাদের মোকাবেলার জন্যে প্রস্তুত রেখো যেন এর সাহায্যে আল্লাহ বিরোধী ও তোমাদের জানা না-জানা দুশমনের ভীত-শঙ্কিত করতে পারে। আল্লাহ এদের জানেন।–(সূরা আল আনফাল)

আরো ইরশাদ হচ্ছে:

“হে নবী! মুমিনদেরকে শত্রু দমনের উদ্দেশ্যে সশস্ত্র অভিযানে উৎসাহিত করুন। তোমাদের মধ্যে যারা দৃঢ়-চিত্ত ও ধৈর্যশীল হবে, তারা বিশজন হলে দুশমনদের দু’শজনকে পরাজিত করবে এবং একশজন হলে এক হাজার কাফেরকে পরাভূত করবে। কারণ তারা অজ্ঞান”।

ছয়: সূরা আত তাওবাও একটি যুদ্ধের দাওয়াত। এ সূরা পড়লে মনে হয় যেন একটি রণভেরী। এতে যুদ্ধের নিয়ম-কানুনও রয়েছে। লক্ষ্য করুন আল্লাহ কিভাবে চুক্তি ভঙ্গকারী মুশরিকদের প্রতি লা’নত বর্ষণ করেছেন-

“তাদের বিরুদ্ধে লড়ে যাও। আল্লাহ তোমাদের হাতেই তাদের শাস্তি দেবেন এবং তাদেরকে লাঞ্চিত ও অপামানিত করবেন। তাদের মোকাবেলায় তোমাদের সাহায্য দান করবেন এবং মুমিনদের বুক ঠান্ডা করবেন।” (সূরা আত তাওবা)

এবার আহলে কিতাব (ইহুদী ও খ্রীষ্টান)-দের সম্পর্কে আল্লাহ কি বলেছেন তা লক্ষ্য করুন:

“আহলে কিতাবদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী নয় এবং আল্লাহ ও তার রাসূল যেসব বস্তুতে হারাম ঘোষণা করেছেন, সেগুলোকে হারাম মনে করে না আর মেনে নেয় না দীনে হককে, তোমরা সেসব কিতাবধারীদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাক, যতক্ষণ না তারা অধীনতা ও বশ্যতা স্বীকার করে নিজেদের হাতে জিজিয়া দানে স্বীকৃত হবে”। -(সূরা আত তাওবা)

পরের কয়েকটি আয়াতে কারীমায় সামগ্রিক বিপ্লবের নির্দেশ দেখা যায় । এ নির্দেশ আপনার কাছে মনে হবে যেন মেঘমালার গর্জন আর বিজলীর চোখ ঝলসানো চমক। শেষের দিকে রয়েছে এ আয়াতটি-

“বের হয়ে যাও (জিহাদের উদ্দেশ্যে) অস্ত্র-শস্ত্র হালকা হোক বা ভারী হোক এবং আল্লাহর পথে তোমাদের জান-মাল লাগিয়ে দিয়ে জিহাদ কর”। -(সূরা আত তাওবা)

এরপরে দেখুন যারা জিহাদের সময়ে ঘরে বসে থাকে তাদের সম্পর্কে কালামে ইলাহীতে কি বলা হয়েছে-

“রাসূলের যুদ্ধে চলে যাওয়ার পর যারা জিহাদ থেকে বিরত থেকে ঘরে বসে থাকলো এবং আল্লাহর পথে ধন-সম্পদ ব্যয় করে ও প্রাণ বিলিয়ে দিয়ে জিহাদ করা অপছন্দ করলো-বললো, তোমরা এ তীব্র গরমে বের হয়ো না, এর খুবই উৎফুল্ল হয়ে পড়েছে। হে নবী, তুমি বলে দাও যে, জাহান্নামের আগুন এর চেয়েও বেশী গরম-যদি তাদের বোধশক্তি কিছু থেকে থাকে”। -(সূরা আত তাওবা)

পরের প্রসঙ্গে রাসূলে (সা) ও তাঁর সাথী মুজাহিদীন-ই-ইসলাম, “কিন্তু রাসূল (সা) ও তাঁর সাথে যারা ছিলেন তাঁরা জান-মাল দিয়ে জিহাদ করেছেন। এবং তা-ই তাদের জন্যে কল্যাণকর এবং এরাই বিজয়ী। আল্লাহ তাদের জন্যে তৈরী করে রেখেছেন বেহশেত –যার নীচ দিয়ে প্রবহমান রয়েছে নহরাজি এবং সেখানেই তারা চিরকাল থাকবে”।

আরও দেখুন-

“নিশ্চয়ই আল্লাহ খরিদ করে দিয়েছেন মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জান-প্রাণ এ ধন-মালকে, এর বিনিময়ে তাদের জান্নাত দেবেন বলে। মুমিনরা আল্লাহর পথে আল্লাহরই সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করে। আর এ যুদ্ধে তারা যেমন আল্লাহরই দুশমনদের হত্যা করবে, তেমনি তারা নিজেরাও নিহত হবে শত্রুর হাতে। এটি হচ্ছে আল্লাহর চেয়ে বেশী ওয়াদা, তাওরাত, ইনজিল ও কুরআন। এবং আল্লাহর চেয়ে বেশী ওয়াদা রক্ষাকারী আর কে আছে? অতএব তুমি যা খরিদ করেছ তাতেই সন্তুষ্ট থাক এবং এটাই তোমরা জন্যে শ্রেষ্ঠ বিজয়”। -(সূরা আত তাওবা)

সাত: কুরআন মজীদের একটি সূরারই নামকরণ করা হয়েছে সূরা কিতাল, যার অপর নাম হচ্ছে সূরা মুহাম্মদ। সৈনিক জীবনের প্রাণ হলো দু’টি জিনিস-আনুগত্য ও শৃঙ্খলা। আল্লা তা’আলা পাক কুরআনের দু’টি আয়াতে এ দু’টি জিনিস সন্নিবেশিত করছেন। আনুগত্য প্রসঙ্গে এ সূরাতেই আল্লাহ বলেন:

“যারা ঈমানদার তারা বলে কোনো আয়াত কেন নাযিল হলো না? এরপরে যখন কোনো সুস্পষ্ট ও সুদৃঢ় আয়াত নাযিল হয় এবং তাতে জিহাদের উল্লেখ থাকে, তখন তুমি দেখাবে যাদের অন্তকরণ রোগগ্রস্ত। তারা মৃত্যুর ভয়ে বিবর্ণ হয়ে তোমরা দিকে তাকাচ্ছে। অতএব তাদের আনুগত্যের পরীক্ষা হয়ে গেল এবং কথাও জানা গেল”।

সূরা আস সফ-এ শৃঙ্খলা প্রসংগে দেখুন-

“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন যারা সারিবদ্ধভাবে সীসা নির্মিত দেয়ালের ন্যায় মজবুতভাবে আল্লাহর পথে শত্রু দমনে সশস্ত্র অভিযান করে, যুদ্ধ করে”।

আট: সূরা ফাতাহ-এ একটি যুদ্ধের বর্ণনা রয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে আল্লাহ মুমিনদের উপর সন্তুষ্ট হলেন যখন তারা একটি গাছের নীচে তোমার [মুহাম্মদ (সা)] হাতে বাইয়াত গ্রহণ করছিল। তারা জেনে নিয়েছিল যা তাদের অন্তরে ছিল। অতপর তিনি তাদের ওপর শাস্তি ও স্বস্তি নাযিল করেন। অচিরেই তারা বিজয়ী হয় এবং গণিমতের মাল তাদের হস্তগত হয় এবং আল্লাহ জবরদস্ত ও প্রজ্ঞার অধিকারী।

কুরআনে হাকীমের এ সমস্ত আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে আজকের যুগের মুসলমানদের চিন্তা করা উচিত তারা জিহাদের সওয়াব থেকে কত দূরে আছে।

এ প্রসঙ্গে হাদীসে রাসূল থেকে কিছু আলোচনা করা যায়।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম