অবরোধ বাসিনী - ১১
গত ১৯২৪ সনে আমি আরায় গিয়াছিলাম। আমার দুই নাতিনীর বিবাহ এক সঙ্গে হইতেছিল, সেই বিবাহের নিমন্ত্রণে গিয়াছিলাম। নাতিনীদের ডাক নাম মজু ও সবু। বেচারীরা তখন “মাইয়াখানায়” ছিল। কলিকাতায় ত বিবাহের মাত্র ৫/৬ দিন পূর্ব্বে “মাইয়াখানা” নামক বন্দীখানায় মেয়েকে রাখে। কিন্তু বেহার অঞ্চলে ৬/৭ মাস পর্য্যন্ত এইরূপ নির্জ্জন কারাবাসে রাখিয়া মেয়েদের আধমরা করে।
আমি মজুর জেলখানায় গিয়া অধিকক্ষণ বসিতে পারি না-সে রুদ্ধ গৃহে আমার দম আটকাইয়া আসে। শেষে এক দিন একটা জানালা একটু খুলিয়া দিলাম। দুই মিনিট পরেই এক মাতব্বর বিবি, “দুলহিনকো হাওয়া লাগেগী” বলিয়া জানালা বন্ধ করিয়া দিলেন। আমি আর তিষ্ঠিতে না পারিয়া উঠিয়া আসিলাম। আমি সবুদের জেলখানায় গিয়া মোটেই বসিতে পারিতাম না। কিন্তু সে বেচারীর ছয় মাস হইতে সেই রুদ্ধ কারাগারে ছিল। শেষে সবুর হিষ্টিরিয়া রোগ হইয়া গেল। এইরূপে আমাদের অবরোধে বাস করিতে অভ্যস্ত করা হয়।
অবরোধ বাসিনী - ১২
পশ্চিম দেশের এক হিন্দু বধূ তাহার শাশুড়ী ও স্বামীর সহিত গঙ্গাস্নানে গিয়াছিল। স্নান শেষ করিয়া ফিরিবার সময় তাহার শ্বাশুড়ী ও স্বামীকে ভীড়ের মধ্যে দেখিতে পাইল না। অবশেষে সে এক ভদ্রলোকের পিছু পিছু চলিল। কতক্ষণ পরে পুলিশের হল্লা।-সেই ভদ্রলোককে ধরিয়া কনষ্টেবল বলে, “তুমি অমুকের বউ ভাগাইয়া লইয়া যাইতেছ।” তিনি আচস্বিতে ফিরিয়া দেখেন, আরে! এ কাহার বউ পিছন হইতে তাঁহার কাছার খুঁটি ধরিয়া আসিতেছে। প্রশ্ন করায় বধূ বলিল, সে সর্ব্বক্ষণ মাথায় ঘোমটা দিয়া থাকে-নিজের স্বামীকে সে কখনও ভাল করিয়া দেখে নাই। স্বামীর পরিধানে হলদে পাড়ের ধূতি ছিল, তাহাই সে দেখিয়াছে। এই ভদ্রলোকের ধূতির পাড় হলদে দেখিয়া সে তাঁহার সঙ্গ লইয়াছে!
অবরোধ বাসিনী - ১৩
আজিকার (২৮ শে জুন ১৯২৯) ঘটনা শুনুন। স্কুলের একটী মেয়ের বাপ লম্বা চওড়া চিঠি লিখিয়াছেন যে, মোটর বাস তাঁহার গলির ভিতর যায় না বলিয়া তাঁহার মেয়েকে “বোরকা” পড়িয়া মামার (চাকরাণীর) সহিত হাঁটিয়া বাড়ী আসিতে হয়। গতকলা গলিতে এক ব্যক্তি চায়ের পাত্র হাতে লইয়া যাইতেছিল, তাহার ধাক্কা লাগিয়া হীরার (তাঁহার মেয়ের) কাপড়ে চা পড়িয়া গিয়া কাপড় নষ্ট হইয়াছে। আমি চিঠিখানা আমাদে জনৈকা শিক্ষয়িত্রীর হাতে দিয়া ইহার তদন্ত করিতে বলিলাম। তিনি ফিরিয়া আসিয়া উর্দ্দু ভাষায় যাহা বলিলেন, তাহার অনুবাদ এইঃ
“অনুসন্ধানে জানিলাম হীরার বোরকায় চক্ষু নাই। (হীরাকে বোরকা মে আঁখ নেহী হায়)! অন্য মেয়েরা বলিল, তাহারা গাড়ী হইতে দেখে, মামা প্রায় হীরাকে কোলের নিকট লইয়া হাঁটাইয়া লইয়া যায়। বোরকায় চক্ষু না থাকায় হীরা ঠিকমত হাঁটিতে পারে না-সেদিন একটা বিড়ালের গায়ে পড়িয়া গিয়াছিল,-কখনও হোঁচট খায়। গতকল্য হীরাই সে চায়ের পাত্রবাহী লোকের গায়ে ধাক্কা দিয়া তাহার চা ফেলিয়া দিয়াছে।”*
দেখুন দেখি, হীরার বয়স মাত্র ৯ বৎসর-এতটুকু বালিকাকে “অন্ধ বোরকা” পরিয়া পথ চলিতে হইবে! ইহা না করিলে অবরোধের সন্মান রক্ষা হয় না!
=======================
* এখনই আষাঢ় মাসের “মাসিক মোহাম্মদী”তে শ্রীমতী আমিনা খাতুনের লিখিত প্রবন্ধের একস্থলে দেখিলাম,-“কতক্ষণের জন্য নাক, মুখ, চোখ বন্ধ করিয়া বেড়ান (এইরূপ পর্দ্দায় পরপুরুষের ঘাড়ে পড়া সম্ভবপর)-উহা ইসলামের বাহিরের পর্দ্দা।”
অবরোধ বাসিনী - ১৪
প্রায় ২১/২২ বৎসর পূর্ব্বেকাল ঘটনা। আমার দূর-সম্পর্কীয়া এক মামীশাশুড়ী ভাগলপুল হইতে পাটনা যাইতেছিলেন; সঙ্গে মাত্র একজন পরিচারিকা ছিল। কিউল ষ্টেশনে ট্রেণ বদল করিতে হয়। মামানী সাহেবা অপর ট্রেণে উঠিবার সময় তাঁহার প্রকাণ্ড বোরকায় জড়াইয়া ট্রেণ ও প্লাটফরমের মাঝখানে পড়িয়া গেলেন। ষ্টেশনে সে সময় মামানীর চাকরাণী ছাড়া অপর কোন স্ত্রীলোক ছিল না। কুলিরা তাড়াতাড়ি তাঁহাকে ধরিয়া তুলিতে অগ্রসর হওয়ায় চাকরাণী দোহাই দিয়া নিষেধ করিল-“খবরদার! কেহ বিবি সাহেবার গায়ে হাত দিও না।” সে একা অনেক টানাটানি করিয়া কিছুতেই তাঁহাকে তুলিতে পারিল না। প্রায় আধ ঘন্টা পর্য্যন্ত অপেক্ষা করার পর ট্রেণ ছাড়িয়া দিল!
ট্রেণের সংঘর্ষে মামানী সাহেবা পিষিয়া ভিন্নভিন্ন হইয়া গেলেন,-কোথায় তাঁহার “বোরকা”-আর কোথায় তিনি! ষ্টেশন ভরা লোক সবিস্ময়ে দাঁড়াইয়া এই লোমহর্ষক ব্যাপার দেখিল,-কেহ তাঁহার সাহায্য করিতে অনুমতি পাইল না। পরে তাঁহার চুর্ণপ্রায় দেহ একটা গুদামে রাখা হইল; তাঁহার চাকরাণী প্রাণপণে বিনাইয়া কাঁদিল, আর তাঁহাকে বাতাস করিতে থাকিল। এই অবস্থায় ১১ (এগার) ঘণ্টা অতিবাহিত হইবার পর তিনি দেহত্যাগ করিলেন! কি ভীষণ মৃত্যু!
অবরোধ বাসিনী - ১৫
হুগলীতে এক বড়লোকের বাড়ীতে বিবাহ উপলক্ষে এক কামরায় অনেক বিবি জড় হইয়াছেন। রাত্রি ১২টার সময় বোধ হইল, কেহ বাহির হইতে কামরায় দরজা ঠেলিতেছে, জোরে, আস্তে-নানা প্রকার দরজা ঠেলিতেছে। বিবিরা সকলে জাগিয়া উঠিয়া থরথর কাঁপিতে লাগিলেন-নিশ্চয় চোর দ্বার ভাঙ্গিয়া গৃহে প্রবেশ করিবে। আর বিবিদের দেখিয়া ফেলিবে! তখন এক জাঁহাবাজ বিবি সমস্ত অলঙ্কার পরিয়া ফেলিলেন, অবশিষ্ট পুটলী বাঁধিয়া চাপা দিয়া ঢাকিয়া রাখিলেন। পরে বোরকা পড়িয়া দ্বার খুলিলেন। দ্বারের বাহিরে ছিল,-একটা কুকুরী! তাহার বাচ্চা দু’টী ঘটনাবশতঃ কামরার ভিতর ছিল, আর সে ছিল বাহিরে। বাচ্চার নিকট আসিবার জন্য সেই কুকুরী দরজা ঠেলিতেছিল।
অবরোধ বাসিনী - ১৬
বেহার শরীফের এক বড়লোক দার্জ্জীলিং যাইতেছিলেন, তাঁহার সঙ্গে এক ডজন ‘মানব-বোঝা” (ঐঁসধহ-খঁমমধমব) অর্থাৎ মাসী পিসী প্রভৃতি ৭ জন মহিলা এবং ৬ হইতে ১৬ বৎসর বয়সের ৫জন বালিকা। তাঁহারা যথাক্রমে ট্রেণ ও ষ্টীমার বদল করিবার সময় সর্ব্বত্রই পাল্কীর ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। মণিহারী ঘাট, সক্রিগলি ঘাট ইত্যাদিতে পাল্কী ছিল। বিবিদের পাল্কীতে পুরিয়া ষ্টীমারের ডেকে রাখা হইত। আবার ট্রেণে উঠিবার সময় তাঁহাদিগকে পাল্কী সহ মালগাড়ীতে দেওয়া হইত। কিন্তু ই• বি• রেলওয়ে লাইনে আর পাল্কী পাওয়া গেল না। তখন তাঁহার ট্রেণের রিজার্ভ করা সেকেণ্ড কাসের গাড়ীতে বসিতে বাধ্য হইলেন।
শিলিগুড়ি ষ্টেশনেও পাল্কী বেহারা পাওয়া গেল না। এত বড় বিপদ-বিবিরা দার্জ্জালিঙ্গের ট্রেণে উঠিবেন কি করিয়া? অতঃপর দুইটা চাদর চারিজন লোকে দুই দিকে ধরিল,-সেই চাদরের বেড়ার মধ্যে বিবিরা চলিলেন। হতভাগা পর্দ্দাধারী চাকরেরা ঠিক তাল রাখিয়া পার্ব্বত্য বন্ধুর পথে হাঁটিতে পারিতেছিল না। কখনও ডাইনের পর্দ্দা আগে যায়, বামের পর্দ্দা পিছনে থাকে; কখনও বামের পর্দ্দা অগ্রসর হয়, আর ডাইনের পর্দ্দা পশ্চাতে। বেচারী বিবিরা হাঁটিতে আরও অপটু-তাঁহার পর্দ্দা ছাড়িয়া কখনও আগে যান, কখনও পিছে রহিয়া যান! কাহারও জুতা খসিয়া রহিয়া গেল-কাহারও দোপাট্টা উড়িয়া গেল!
অবরোধ বাসিনী - ১৭
প্রায় ১৪ বৎসর পূর্ব্বে আমাদের স্কুলে একজন লক্ষ্ণৌ নিবাসী শিক্ষয়িত্রী ছিলেন, নাম আখতর জাঁহা। তাঁহার তিনটি কন্যাও এই স্কুলে পড়িত। একদিন তিনি একালের মেয়েদের নির্লজ্জতার বিষয় আলোচনা প্রসঙ্গে নিজের মেয়েদের বেহায়াপনার কথা বলিয়া দুঃখ প্রকাশ করিলেন। কথায় কথায় নিজের বধূ-জীবনের একটা গল্প বলিলেনঃ “এগারো বৎসর বয়সে তাঁহার বিবাহ হইয়াছিল। শ্বশুরবাড়ী গিয়া তাঁহাকে এক নির্জ্জন কক্ষে থাকিতে হইত। তাঁহার এক ছোট ননদ দিনে তিন চার বার আসিয়া তাঁহাকে প্রয়োজন মত বাথ-রুমে পৌঁছাইয়া দিত। একদিন কি কারণে সে অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত তাঁহার সংবাদ লয় নাই। এদিকে বেচারী প্রকৃতির তাড়নায় অধীরা হইয়া পড়িলেন। লক্ষ্ণৌ-এ মেয়েকে বড় বড় তামার পানদান যৌতুক দেওয়া হয়। তাঁহার মস্ত পানদানটা সেই কক্ষেই ছিল। তিনি পানদান খুলিয়া সুপারীর ডিবেটা বাহির করিয়া সুপারীগুলি একটা রুমালে ঢালিয়া ফেলিলেন। পরে তিনি সেই ডিবেটা যে জিনিষ দ্বারা পূর্ণ করিয়া খাটের নীচে রাখিলেন, তাহা লিখিতব্য নহে! সন্ধ্যার সময় তাঁহার পিত্রালয়ের চাকরাণী বিছানা বাড়িতে আসিলে তিনি তাহার গলা ধরিয়া কাঁদিয়া ডিবের দুর্দ্দশার কথা বলিলেন। সে তাঁহাকে সান্ত্বনা দিয়া বলিল, “থাক, তুমি কেঁদ না; আমি কালই ডিবেটা কালাই (ঞরহহরহম) করাইয়া আনিয়া দিব। সুপারী এখন রুমালের বাঁধা থাকুক।”
অবরোধ বাসিনী - ১৮
লাহোরের জনৈক ভুক্তভোগী ডাক্তার সাহেবের রোগিনী দর্শনের বর্ণনা এইঃ
সচরাচর ডাক্তার আসিলে দুইজন চাকরাণী রোগিণীর পালঙ্কের শিয়রে ও পায়ের দিকে একটা মোটা বড় দোলাই ধরিয়া দাঁড়ায়। ডাক্তার সেই দোলাইয়ের একটু ফাঁকের ভিতর হাত দিয়া রোগিণীর নাড়ী পরীক্ষা করেন।*
এক বেগম সাহেবা নিউমোনিয়া রোগে ভুগিতেছিলেন। আমি বলিলাম ফেফড়ার অবস্থা দেখা দরকার; আমি পিঠের দিক হইতে দেখিয়া লইব। হুকুম হইল, “ষ্টেথিসকোপের নল যেখানে বলেন, চাকরাণী রাখিয়া দিবে!” সকলেই জানেন, ফেফড়া বিভিন্ন স্থান হইতে পরীক্ষা করিলে পর রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হয়। কিন্তু আমি অগত্যা কর্ত্তার হুকুমে রাজী হইলাম। চাকরাণী নলটা দোলাইয়ের ভিতরে বেগম সাহেবার কোমরে নেফার (পায়জামার উপরাংশের) কিছু উপরে রাখিল। কিছুণ পরে আমি আশ্চর্য্য হইলাম যে কোন শব্দ শুনিতে পাই না কেন? দুঃসাহসে ভর দিয়া দোলাই একটু উঠাইয়া দেখিলাম,-দেখি কি নলটা কোমরে লাগান হইয়াছে! আমি বিরক্ত হইয়া উঠিয়া আসিলাম।**
-----------------------------------------
* আমাকে জনৈকা নন-পর্দ্দা মহিলা জিজ্ঞেস করিয়াছিলেন (লেডী ডাক্তারের অভাবে পুরুষ), “ডাক্তারকে জিহবা দেখাইতে হইলে আপনি কি করিবেন? দোলাই ফুটা করিয়া তাহার ভিতর হতে জিহবা বাহির করিয়া দেখাইবেন নাকি?” আমি পাঠিকা ভগিনীদিগকে ঐ প্রশ্নের এবং আমার নিন্মোক্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে অনুরোধ করি। ডাক্তারকে চোখ, দাঁত এবং কান দেখাইতে হইলে তাহারা কি উপায়ে দেখাইবেন?
** ডাক্তার সাহেবের নিজের ভাষায় শুনুনঃ “লা হাওল বেলা কুওৎ! মঁয় দিক হো কর উঠ আয়া। আর নওয়াব সাহেব পুছতে হেঁ কে কেয়া পাতা লাগা? মঁয় কেয়া খাক বাতাতা কে কেয়া পাতা লাগা?”
অবরোধ বাসিনী - ১৯
জনৈক রেলপথে ভ্রমণকারীর বৃত্তান্তের সারাংশ এইঃ ষ্টেশনে টিকিট কেটে মনে মনে একটা হিসেব করলাম। তিনখানা ইন্টার কাসের দরুন দেড় মণ জিনিষ নিতে পারবো, কিন্তু আমাদের জিনিষপত্তর ওজন করিলে পাঁচ মণের কম কিছুতেই হবে না। অনেক ভেবে-চিন্তে লগেজ না করাই ঠিক করলাম। মেয়েদের গাড়ীতে জিনিষপত্তর তুলে দিলে আর কে চেক করতে আসবে?
খোকা জিজ্ঞেস করলে,-তোমার সঙ্গে কোন জ্যান্ত লগেজ আছে নাকি?
আবার আছে না কি! একেবারে এক জোড়া! একে বুড়ী, তায় আবার থুড়থুড়ি।
খোকা বল্লে-তবেই সেরেছে।
যখন ঘুম ভাঙল, তখন বেশ রাত হয়েছে।
অনুমানে বুঝলাম, একটা বড় ষ্টেশনে গাড়ী থেমে আছে। হঠাৎ মনে হ’ল, বহরমপুর হবে হয়ত। দরজাটা খুলে নামতে যাব, এমন সময় মনে হ’ল যেন শুনতে পেলাম, আমারই নাম ধরে কারা ডাকাডাকি করছে-“ও টুনু-টুনু, এতো ভারী বিপদে আজ পড়লাম, -টুনুরে!”
একে মেয়েলী গলা, তার ওপর আবার করুণ। আমি ব্যস্ত হয়ে তাড়াতাড়ি নেমে পড়লাম। দেখলাম, দুই বুড়ী মাটিতে দাঁড়িয়ে মহা কান্নাকাটি শুরু করেছে, আর জিনিসপত্তর গুলোও সব নামানো হয়েছে। চারদিকে তিন চার জন কুলী ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
আমার মেজাজ গরম হয়ে উঠল। টি•টি•সি অর্থাৎ চেকারগুলো যে রাত্রিবেলা মেয়েদের গাড়ী চেক ক’রে-মালপত্তর সব নামিয়ে দেবে এতো কম অন্যায় কথা নয়। আমি কুলীগুলোকে খুব বকে দিলাম, জিনিষ-পত্তর আবার গাড়ীতে তুলে দিতে বল্লাম। আর একবার কুলীগুলোকে এক চোট বকে দিলাম, এবং টি• টি• সি•দের নামে যে রিপোর্ট করতে হবে, সে রকমও অনেক কথা বল্লাম।
ঠাকুরমা কেঁদে বল্লেন, “আরে টুনু, আমরা যে এসে পড়েছি।”
অবশেষে একটা কুলী সাহস করে বল্লে, “বাবু ঘাট আ গিয়া।”
আমি ঠাকুরমাকে বল্লাম,-তাহলে টি• টি• সি• চেক করে নামিয়ে দেয়নি-ঘাটে পড়েছে; সে কথা আমাকে আগে বল্লেই হত, এ জন্য কান্নাকাটি কেন?
অবরোধ বাসিনী - ২০
জনৈকা পাঞ্জাবী বেগম সাহেবা নিন্মলিখিত গল্প কোন উর্দ্দু কাগজে লিখিয়াছেনঃ
আমরা একটা গ্রামে কিছুকাল ছিলাম। একবার তত্রত্য কোন সম্ভ্রান্ত লোকের বাড়ীতে আমাদের নিমন্ত্রণ ছিল। সেখানে গিয়া কুমারী মেয়েদের প্রতি যে অত্যধিক জুলুম হইতে দেখিলাম, তাহাতে আমি প্রাণে বড় আঘাত পাইলাম।
আমরা যথাসময় তথায় পৌঁছিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, বাড়ীর মেয়েরা কোথায়? শুনিতে পাইলাম তাহারা সকলে রান্নাঘরে বসিয়া আছে। আমি তাহাদের সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহিলে, কেবল একা আমাকে সেইখানে ডাকিয়া লইয়া হইল। রান্নাঘরে ভয়ানক গরম, আর স্থানও অতিশয় অল্প। কিন্তু উপায়ান্তর না দেখিয়া সেইখানে বসিয়া সেই “মজলুম” কিন্তু মিষ্টভাষিণী বালিকাদের সহিত কথাবার্ত্তা কহিতে লাগিলাম।
একজন দয়াবতী বিবি আমাদের প্রতি কৃপাপরবশ হইয়া বলিলেন, “তোমরা সাবধানে লুকাইয়া উপরে চলিয়া যাও।”
আমি মনে করিলাম, সম্ভ্ববতঃ পুরুষমানুষদের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা আছে, তাই সাবধানে লুকাইয়া যাইতে বলিলেন। কিন্তু পরে জানিলাম, এ পর্দ্দা সাধারণ অভ্যাগতা মহিলাদের বিরুদ্ধে ছিল। উক্ত বিবি সাহেবার হুকুমে দুইজন মেয়েমানুষ মোটা চাদর ধরিয়া পর্দ্দা করিল, আমরা সেই চাদরে অন্তরাল হইতে উপরে চলিয়া গেলাম।
উপরে গিয়া আমি আরও বিপদে পড়িলাম। আমি মনে করিয়াছিলাম, ছাদের উপর আরামে বসিবার কোন কামরা হইবে, অথবা কমপক্ষে বর্ষাতি চালা হইবে। কিন্তু সেখানে কিছুই ছিল না। একে ত প্রখর রৌদ্র, দ্বিতীয়তঃ বসিবারও কিছু ছিল না। সমস্ত ছাদ জুড়িয়া অর্দ্ধ শুষ্ক ঘুঁটে ছড়ান ছিল; তাহার দুর্গন্ধে প্রাণ ওষ্ঠাগত হইতেছিল। বহু কষ্টে একজন চাকরাণী একটা খাটিয়া আনিয়া দিল, আমরা অগত্যা তাহাতেই বসিলাম। নীচে বাজনা বাজিতেছিল, উৎসব হইতেছিল। কিন্তু অভাগিনী অনূঢ়া বালিকা কয়টি অপরাধিণীর ন্যায় রৌদ্রে বসিয়া ঘুঁটের দুর্গন্ধে হাঁপাইতেছিল। কেহই ইহাদের আরামের জন্য একটুকু খেয়াল করিতেছিল না।
গত ১৯২৪ সনে আমি আরায় গিয়াছিলাম। আমার দুই নাতিনীর বিবাহ এক সঙ্গে হইতেছিল, সেই বিবাহের নিমন্ত্রণে গিয়াছিলাম। নাতিনীদের ডাক নাম মজু ও সবু। বেচারীরা তখন “মাইয়াখানায়” ছিল। কলিকাতায় ত বিবাহের মাত্র ৫/৬ দিন পূর্ব্বে “মাইয়াখানা” নামক বন্দীখানায় মেয়েকে রাখে। কিন্তু বেহার অঞ্চলে ৬/৭ মাস পর্য্যন্ত এইরূপ নির্জ্জন কারাবাসে রাখিয়া মেয়েদের আধমরা করে।
আমি মজুর জেলখানায় গিয়া অধিকক্ষণ বসিতে পারি না-সে রুদ্ধ গৃহে আমার দম আটকাইয়া আসে। শেষে এক দিন একটা জানালা একটু খুলিয়া দিলাম। দুই মিনিট পরেই এক মাতব্বর বিবি, “দুলহিনকো হাওয়া লাগেগী” বলিয়া জানালা বন্ধ করিয়া দিলেন। আমি আর তিষ্ঠিতে না পারিয়া উঠিয়া আসিলাম। আমি সবুদের জেলখানায় গিয়া মোটেই বসিতে পারিতাম না। কিন্তু সে বেচারীর ছয় মাস হইতে সেই রুদ্ধ কারাগারে ছিল। শেষে সবুর হিষ্টিরিয়া রোগ হইয়া গেল। এইরূপে আমাদের অবরোধে বাস করিতে অভ্যস্ত করা হয়।
অবরোধ বাসিনী - ১২
পশ্চিম দেশের এক হিন্দু বধূ তাহার শাশুড়ী ও স্বামীর সহিত গঙ্গাস্নানে গিয়াছিল। স্নান শেষ করিয়া ফিরিবার সময় তাহার শ্বাশুড়ী ও স্বামীকে ভীড়ের মধ্যে দেখিতে পাইল না। অবশেষে সে এক ভদ্রলোকের পিছু পিছু চলিল। কতক্ষণ পরে পুলিশের হল্লা।-সেই ভদ্রলোককে ধরিয়া কনষ্টেবল বলে, “তুমি অমুকের বউ ভাগাইয়া লইয়া যাইতেছ।” তিনি আচস্বিতে ফিরিয়া দেখেন, আরে! এ কাহার বউ পিছন হইতে তাঁহার কাছার খুঁটি ধরিয়া আসিতেছে। প্রশ্ন করায় বধূ বলিল, সে সর্ব্বক্ষণ মাথায় ঘোমটা দিয়া থাকে-নিজের স্বামীকে সে কখনও ভাল করিয়া দেখে নাই। স্বামীর পরিধানে হলদে পাড়ের ধূতি ছিল, তাহাই সে দেখিয়াছে। এই ভদ্রলোকের ধূতির পাড় হলদে দেখিয়া সে তাঁহার সঙ্গ লইয়াছে!
অবরোধ বাসিনী - ১৩
আজিকার (২৮ শে জুন ১৯২৯) ঘটনা শুনুন। স্কুলের একটী মেয়ের বাপ লম্বা চওড়া চিঠি লিখিয়াছেন যে, মোটর বাস তাঁহার গলির ভিতর যায় না বলিয়া তাঁহার মেয়েকে “বোরকা” পড়িয়া মামার (চাকরাণীর) সহিত হাঁটিয়া বাড়ী আসিতে হয়। গতকলা গলিতে এক ব্যক্তি চায়ের পাত্র হাতে লইয়া যাইতেছিল, তাহার ধাক্কা লাগিয়া হীরার (তাঁহার মেয়ের) কাপড়ে চা পড়িয়া গিয়া কাপড় নষ্ট হইয়াছে। আমি চিঠিখানা আমাদে জনৈকা শিক্ষয়িত্রীর হাতে দিয়া ইহার তদন্ত করিতে বলিলাম। তিনি ফিরিয়া আসিয়া উর্দ্দু ভাষায় যাহা বলিলেন, তাহার অনুবাদ এইঃ
“অনুসন্ধানে জানিলাম হীরার বোরকায় চক্ষু নাই। (হীরাকে বোরকা মে আঁখ নেহী হায়)! অন্য মেয়েরা বলিল, তাহারা গাড়ী হইতে দেখে, মামা প্রায় হীরাকে কোলের নিকট লইয়া হাঁটাইয়া লইয়া যায়। বোরকায় চক্ষু না থাকায় হীরা ঠিকমত হাঁটিতে পারে না-সেদিন একটা বিড়ালের গায়ে পড়িয়া গিয়াছিল,-কখনও হোঁচট খায়। গতকল্য হীরাই সে চায়ের পাত্রবাহী লোকের গায়ে ধাক্কা দিয়া তাহার চা ফেলিয়া দিয়াছে।”*
দেখুন দেখি, হীরার বয়স মাত্র ৯ বৎসর-এতটুকু বালিকাকে “অন্ধ বোরকা” পরিয়া পথ চলিতে হইবে! ইহা না করিলে অবরোধের সন্মান রক্ষা হয় না!
=======================
* এখনই আষাঢ় মাসের “মাসিক মোহাম্মদী”তে শ্রীমতী আমিনা খাতুনের লিখিত প্রবন্ধের একস্থলে দেখিলাম,-“কতক্ষণের জন্য নাক, মুখ, চোখ বন্ধ করিয়া বেড়ান (এইরূপ পর্দ্দায় পরপুরুষের ঘাড়ে পড়া সম্ভবপর)-উহা ইসলামের বাহিরের পর্দ্দা।”
অবরোধ বাসিনী - ১৪
প্রায় ২১/২২ বৎসর পূর্ব্বেকাল ঘটনা। আমার দূর-সম্পর্কীয়া এক মামীশাশুড়ী ভাগলপুল হইতে পাটনা যাইতেছিলেন; সঙ্গে মাত্র একজন পরিচারিকা ছিল। কিউল ষ্টেশনে ট্রেণ বদল করিতে হয়। মামানী সাহেবা অপর ট্রেণে উঠিবার সময় তাঁহার প্রকাণ্ড বোরকায় জড়াইয়া ট্রেণ ও প্লাটফরমের মাঝখানে পড়িয়া গেলেন। ষ্টেশনে সে সময় মামানীর চাকরাণী ছাড়া অপর কোন স্ত্রীলোক ছিল না। কুলিরা তাড়াতাড়ি তাঁহাকে ধরিয়া তুলিতে অগ্রসর হওয়ায় চাকরাণী দোহাই দিয়া নিষেধ করিল-“খবরদার! কেহ বিবি সাহেবার গায়ে হাত দিও না।” সে একা অনেক টানাটানি করিয়া কিছুতেই তাঁহাকে তুলিতে পারিল না। প্রায় আধ ঘন্টা পর্য্যন্ত অপেক্ষা করার পর ট্রেণ ছাড়িয়া দিল!
ট্রেণের সংঘর্ষে মামানী সাহেবা পিষিয়া ভিন্নভিন্ন হইয়া গেলেন,-কোথায় তাঁহার “বোরকা”-আর কোথায় তিনি! ষ্টেশন ভরা লোক সবিস্ময়ে দাঁড়াইয়া এই লোমহর্ষক ব্যাপার দেখিল,-কেহ তাঁহার সাহায্য করিতে অনুমতি পাইল না। পরে তাঁহার চুর্ণপ্রায় দেহ একটা গুদামে রাখা হইল; তাঁহার চাকরাণী প্রাণপণে বিনাইয়া কাঁদিল, আর তাঁহাকে বাতাস করিতে থাকিল। এই অবস্থায় ১১ (এগার) ঘণ্টা অতিবাহিত হইবার পর তিনি দেহত্যাগ করিলেন! কি ভীষণ মৃত্যু!
অবরোধ বাসিনী - ১৫
হুগলীতে এক বড়লোকের বাড়ীতে বিবাহ উপলক্ষে এক কামরায় অনেক বিবি জড় হইয়াছেন। রাত্রি ১২টার সময় বোধ হইল, কেহ বাহির হইতে কামরায় দরজা ঠেলিতেছে, জোরে, আস্তে-নানা প্রকার দরজা ঠেলিতেছে। বিবিরা সকলে জাগিয়া উঠিয়া থরথর কাঁপিতে লাগিলেন-নিশ্চয় চোর দ্বার ভাঙ্গিয়া গৃহে প্রবেশ করিবে। আর বিবিদের দেখিয়া ফেলিবে! তখন এক জাঁহাবাজ বিবি সমস্ত অলঙ্কার পরিয়া ফেলিলেন, অবশিষ্ট পুটলী বাঁধিয়া চাপা দিয়া ঢাকিয়া রাখিলেন। পরে বোরকা পড়িয়া দ্বার খুলিলেন। দ্বারের বাহিরে ছিল,-একটা কুকুরী! তাহার বাচ্চা দু’টী ঘটনাবশতঃ কামরার ভিতর ছিল, আর সে ছিল বাহিরে। বাচ্চার নিকট আসিবার জন্য সেই কুকুরী দরজা ঠেলিতেছিল।
অবরোধ বাসিনী - ১৬
বেহার শরীফের এক বড়লোক দার্জ্জীলিং যাইতেছিলেন, তাঁহার সঙ্গে এক ডজন ‘মানব-বোঝা” (ঐঁসধহ-খঁমমধমব) অর্থাৎ মাসী পিসী প্রভৃতি ৭ জন মহিলা এবং ৬ হইতে ১৬ বৎসর বয়সের ৫জন বালিকা। তাঁহারা যথাক্রমে ট্রেণ ও ষ্টীমার বদল করিবার সময় সর্ব্বত্রই পাল্কীর ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। মণিহারী ঘাট, সক্রিগলি ঘাট ইত্যাদিতে পাল্কী ছিল। বিবিদের পাল্কীতে পুরিয়া ষ্টীমারের ডেকে রাখা হইত। আবার ট্রেণে উঠিবার সময় তাঁহাদিগকে পাল্কী সহ মালগাড়ীতে দেওয়া হইত। কিন্তু ই• বি• রেলওয়ে লাইনে আর পাল্কী পাওয়া গেল না। তখন তাঁহার ট্রেণের রিজার্ভ করা সেকেণ্ড কাসের গাড়ীতে বসিতে বাধ্য হইলেন।
শিলিগুড়ি ষ্টেশনেও পাল্কী বেহারা পাওয়া গেল না। এত বড় বিপদ-বিবিরা দার্জ্জালিঙ্গের ট্রেণে উঠিবেন কি করিয়া? অতঃপর দুইটা চাদর চারিজন লোকে দুই দিকে ধরিল,-সেই চাদরের বেড়ার মধ্যে বিবিরা চলিলেন। হতভাগা পর্দ্দাধারী চাকরেরা ঠিক তাল রাখিয়া পার্ব্বত্য বন্ধুর পথে হাঁটিতে পারিতেছিল না। কখনও ডাইনের পর্দ্দা আগে যায়, বামের পর্দ্দা পিছনে থাকে; কখনও বামের পর্দ্দা অগ্রসর হয়, আর ডাইনের পর্দ্দা পশ্চাতে। বেচারী বিবিরা হাঁটিতে আরও অপটু-তাঁহার পর্দ্দা ছাড়িয়া কখনও আগে যান, কখনও পিছে রহিয়া যান! কাহারও জুতা খসিয়া রহিয়া গেল-কাহারও দোপাট্টা উড়িয়া গেল!
অবরোধ বাসিনী - ১৭
প্রায় ১৪ বৎসর পূর্ব্বে আমাদের স্কুলে একজন লক্ষ্ণৌ নিবাসী শিক্ষয়িত্রী ছিলেন, নাম আখতর জাঁহা। তাঁহার তিনটি কন্যাও এই স্কুলে পড়িত। একদিন তিনি একালের মেয়েদের নির্লজ্জতার বিষয় আলোচনা প্রসঙ্গে নিজের মেয়েদের বেহায়াপনার কথা বলিয়া দুঃখ প্রকাশ করিলেন। কথায় কথায় নিজের বধূ-জীবনের একটা গল্প বলিলেনঃ “এগারো বৎসর বয়সে তাঁহার বিবাহ হইয়াছিল। শ্বশুরবাড়ী গিয়া তাঁহাকে এক নির্জ্জন কক্ষে থাকিতে হইত। তাঁহার এক ছোট ননদ দিনে তিন চার বার আসিয়া তাঁহাকে প্রয়োজন মত বাথ-রুমে পৌঁছাইয়া দিত। একদিন কি কারণে সে অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত তাঁহার সংবাদ লয় নাই। এদিকে বেচারী প্রকৃতির তাড়নায় অধীরা হইয়া পড়িলেন। লক্ষ্ণৌ-এ মেয়েকে বড় বড় তামার পানদান যৌতুক দেওয়া হয়। তাঁহার মস্ত পানদানটা সেই কক্ষেই ছিল। তিনি পানদান খুলিয়া সুপারীর ডিবেটা বাহির করিয়া সুপারীগুলি একটা রুমালে ঢালিয়া ফেলিলেন। পরে তিনি সেই ডিবেটা যে জিনিষ দ্বারা পূর্ণ করিয়া খাটের নীচে রাখিলেন, তাহা লিখিতব্য নহে! সন্ধ্যার সময় তাঁহার পিত্রালয়ের চাকরাণী বিছানা বাড়িতে আসিলে তিনি তাহার গলা ধরিয়া কাঁদিয়া ডিবের দুর্দ্দশার কথা বলিলেন। সে তাঁহাকে সান্ত্বনা দিয়া বলিল, “থাক, তুমি কেঁদ না; আমি কালই ডিবেটা কালাই (ঞরহহরহম) করাইয়া আনিয়া দিব। সুপারী এখন রুমালের বাঁধা থাকুক।”
অবরোধ বাসিনী - ১৮
লাহোরের জনৈক ভুক্তভোগী ডাক্তার সাহেবের রোগিনী দর্শনের বর্ণনা এইঃ
সচরাচর ডাক্তার আসিলে দুইজন চাকরাণী রোগিণীর পালঙ্কের শিয়রে ও পায়ের দিকে একটা মোটা বড় দোলাই ধরিয়া দাঁড়ায়। ডাক্তার সেই দোলাইয়ের একটু ফাঁকের ভিতর হাত দিয়া রোগিণীর নাড়ী পরীক্ষা করেন।*
এক বেগম সাহেবা নিউমোনিয়া রোগে ভুগিতেছিলেন। আমি বলিলাম ফেফড়ার অবস্থা দেখা দরকার; আমি পিঠের দিক হইতে দেখিয়া লইব। হুকুম হইল, “ষ্টেথিসকোপের নল যেখানে বলেন, চাকরাণী রাখিয়া দিবে!” সকলেই জানেন, ফেফড়া বিভিন্ন স্থান হইতে পরীক্ষা করিলে পর রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হয়। কিন্তু আমি অগত্যা কর্ত্তার হুকুমে রাজী হইলাম। চাকরাণী নলটা দোলাইয়ের ভিতরে বেগম সাহেবার কোমরে নেফার (পায়জামার উপরাংশের) কিছু উপরে রাখিল। কিছুণ পরে আমি আশ্চর্য্য হইলাম যে কোন শব্দ শুনিতে পাই না কেন? দুঃসাহসে ভর দিয়া দোলাই একটু উঠাইয়া দেখিলাম,-দেখি কি নলটা কোমরে লাগান হইয়াছে! আমি বিরক্ত হইয়া উঠিয়া আসিলাম।**
-----------------------------------------
* আমাকে জনৈকা নন-পর্দ্দা মহিলা জিজ্ঞেস করিয়াছিলেন (লেডী ডাক্তারের অভাবে পুরুষ), “ডাক্তারকে জিহবা দেখাইতে হইলে আপনি কি করিবেন? দোলাই ফুটা করিয়া তাহার ভিতর হতে জিহবা বাহির করিয়া দেখাইবেন নাকি?” আমি পাঠিকা ভগিনীদিগকে ঐ প্রশ্নের এবং আমার নিন্মোক্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে অনুরোধ করি। ডাক্তারকে চোখ, দাঁত এবং কান দেখাইতে হইলে তাহারা কি উপায়ে দেখাইবেন?
** ডাক্তার সাহেবের নিজের ভাষায় শুনুনঃ “লা হাওল বেলা কুওৎ! মঁয় দিক হো কর উঠ আয়া। আর নওয়াব সাহেব পুছতে হেঁ কে কেয়া পাতা লাগা? মঁয় কেয়া খাক বাতাতা কে কেয়া পাতা লাগা?”
অবরোধ বাসিনী - ১৯
জনৈক রেলপথে ভ্রমণকারীর বৃত্তান্তের সারাংশ এইঃ ষ্টেশনে টিকিট কেটে মনে মনে একটা হিসেব করলাম। তিনখানা ইন্টার কাসের দরুন দেড় মণ জিনিষ নিতে পারবো, কিন্তু আমাদের জিনিষপত্তর ওজন করিলে পাঁচ মণের কম কিছুতেই হবে না। অনেক ভেবে-চিন্তে লগেজ না করাই ঠিক করলাম। মেয়েদের গাড়ীতে জিনিষপত্তর তুলে দিলে আর কে চেক করতে আসবে?
খোকা জিজ্ঞেস করলে,-তোমার সঙ্গে কোন জ্যান্ত লগেজ আছে নাকি?
আবার আছে না কি! একেবারে এক জোড়া! একে বুড়ী, তায় আবার থুড়থুড়ি।
খোকা বল্লে-তবেই সেরেছে।
যখন ঘুম ভাঙল, তখন বেশ রাত হয়েছে।
অনুমানে বুঝলাম, একটা বড় ষ্টেশনে গাড়ী থেমে আছে। হঠাৎ মনে হ’ল, বহরমপুর হবে হয়ত। দরজাটা খুলে নামতে যাব, এমন সময় মনে হ’ল যেন শুনতে পেলাম, আমারই নাম ধরে কারা ডাকাডাকি করছে-“ও টুনু-টুনু, এতো ভারী বিপদে আজ পড়লাম, -টুনুরে!”
একে মেয়েলী গলা, তার ওপর আবার করুণ। আমি ব্যস্ত হয়ে তাড়াতাড়ি নেমে পড়লাম। দেখলাম, দুই বুড়ী মাটিতে দাঁড়িয়ে মহা কান্নাকাটি শুরু করেছে, আর জিনিসপত্তর গুলোও সব নামানো হয়েছে। চারদিকে তিন চার জন কুলী ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
আমার মেজাজ গরম হয়ে উঠল। টি•টি•সি অর্থাৎ চেকারগুলো যে রাত্রিবেলা মেয়েদের গাড়ী চেক ক’রে-মালপত্তর সব নামিয়ে দেবে এতো কম অন্যায় কথা নয়। আমি কুলীগুলোকে খুব বকে দিলাম, জিনিষ-পত্তর আবার গাড়ীতে তুলে দিতে বল্লাম। আর একবার কুলীগুলোকে এক চোট বকে দিলাম, এবং টি• টি• সি•দের নামে যে রিপোর্ট করতে হবে, সে রকমও অনেক কথা বল্লাম।
ঠাকুরমা কেঁদে বল্লেন, “আরে টুনু, আমরা যে এসে পড়েছি।”
অবশেষে একটা কুলী সাহস করে বল্লে, “বাবু ঘাট আ গিয়া।”
আমি ঠাকুরমাকে বল্লাম,-তাহলে টি• টি• সি• চেক করে নামিয়ে দেয়নি-ঘাটে পড়েছে; সে কথা আমাকে আগে বল্লেই হত, এ জন্য কান্নাকাটি কেন?
অবরোধ বাসিনী - ২০
জনৈকা পাঞ্জাবী বেগম সাহেবা নিন্মলিখিত গল্প কোন উর্দ্দু কাগজে লিখিয়াছেনঃ
আমরা একটা গ্রামে কিছুকাল ছিলাম। একবার তত্রত্য কোন সম্ভ্রান্ত লোকের বাড়ীতে আমাদের নিমন্ত্রণ ছিল। সেখানে গিয়া কুমারী মেয়েদের প্রতি যে অত্যধিক জুলুম হইতে দেখিলাম, তাহাতে আমি প্রাণে বড় আঘাত পাইলাম।
আমরা যথাসময় তথায় পৌঁছিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, বাড়ীর মেয়েরা কোথায়? শুনিতে পাইলাম তাহারা সকলে রান্নাঘরে বসিয়া আছে। আমি তাহাদের সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহিলে, কেবল একা আমাকে সেইখানে ডাকিয়া লইয়া হইল। রান্নাঘরে ভয়ানক গরম, আর স্থানও অতিশয় অল্প। কিন্তু উপায়ান্তর না দেখিয়া সেইখানে বসিয়া সেই “মজলুম” কিন্তু মিষ্টভাষিণী বালিকাদের সহিত কথাবার্ত্তা কহিতে লাগিলাম।
একজন দয়াবতী বিবি আমাদের প্রতি কৃপাপরবশ হইয়া বলিলেন, “তোমরা সাবধানে লুকাইয়া উপরে চলিয়া যাও।”
আমি মনে করিলাম, সম্ভ্ববতঃ পুরুষমানুষদের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা আছে, তাই সাবধানে লুকাইয়া যাইতে বলিলেন। কিন্তু পরে জানিলাম, এ পর্দ্দা সাধারণ অভ্যাগতা মহিলাদের বিরুদ্ধে ছিল। উক্ত বিবি সাহেবার হুকুমে দুইজন মেয়েমানুষ মোটা চাদর ধরিয়া পর্দ্দা করিল, আমরা সেই চাদরে অন্তরাল হইতে উপরে চলিয়া গেলাম।
উপরে গিয়া আমি আরও বিপদে পড়িলাম। আমি মনে করিয়াছিলাম, ছাদের উপর আরামে বসিবার কোন কামরা হইবে, অথবা কমপক্ষে বর্ষাতি চালা হইবে। কিন্তু সেখানে কিছুই ছিল না। একে ত প্রখর রৌদ্র, দ্বিতীয়তঃ বসিবারও কিছু ছিল না। সমস্ত ছাদ জুড়িয়া অর্দ্ধ শুষ্ক ঘুঁটে ছড়ান ছিল; তাহার দুর্গন্ধে প্রাণ ওষ্ঠাগত হইতেছিল। বহু কষ্টে একজন চাকরাণী একটা খাটিয়া আনিয়া দিল, আমরা অগত্যা তাহাতেই বসিলাম। নীচে বাজনা বাজিতেছিল, উৎসব হইতেছিল। কিন্তু অভাগিনী অনূঢ়া বালিকা কয়টি অপরাধিণীর ন্যায় রৌদ্রে বসিয়া ঘুঁটের দুর্গন্ধে হাঁপাইতেছিল। কেহই ইহাদের আরামের জন্য একটুকু খেয়াল করিতেছিল না।
0 comments: