অবরোধ বাসিনী - ৪১
রায় শ্রীযুক্ত জলধর সেন বাহাদুর গত ১৩৩৫ সনে লিখিয়াছেনঃ
সেকালের পর্দ্দা-আমি যে সময়কে সেকাল বলছি, তা সত্য-ক্রেতা-দ্বাপর যুগ নয় কিন্তু-সে আমাদের যৌবনকালের কথা-এই পঞ্চাশ বৎসর পূর্ব্বের কথা। সে সময় আমরা পর্দ্দার যে রকম কঠোর, তথা হাস্যকর ব্যবস্থা দেখিয়াছিলাম, সে সকল দৃশ্য এখনও আমার চরে সম্মুখে ছবির মত জেগে আছে। তারই গুটিকয়েক দৃশ্যের সামান্য বর্ণনা দিতে চেষ্টা করিব।
সেই সময় একদিন কি জন্য যেন হাবড়া ষ্টেশনে গিয়াছিলাম। আমি তখন কলেজে পড়ি। ষ্টেশনের প্ল্যাটফরমে গিয়া দেখি কয়েকজন বরকন্দাজ যাত্রীর ভিড় সরিয়ে পথ করছে। এগুতে সাহস হোল না; হয়ত কোন রাজা মহারাজা গাড়ীতে উঠবেন, তারই জন্য তার সৈন্য সামন্তেরা নিরীহ যাত্রীদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। এই ভেবে রাজা-মহারাজার আগমন প্রতীায় একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইলাম।
তিন চার মিনিট হয়ে গেল, রাজা মহারাজা আর আসেন না। শেষে দেখি কিনা-একটা মশারি আসছেন। মশারির চার কোণা চারজন সিপাহী ধ’রে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন। আমি ত এ দৃ দেখে অবাক-এ ব্যাপার ত পূর্ব্বে কখনও দেখি নাই। আমার পাশেই এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, “এমন করে একটা মশারি যাচ্ছেন কেন?” তিনি একটু হেসে বল্লেন, “আপনি বুঝি কখন মশারির যাত্রা দেখেন নাই? দেখছেন না কত সিপাহী-সান্ত্রী যাচ্ছে। বিহার অঞ্চলের কোন এক রাজা না জমীদারের গৃহিনী ঐ মশারির মধ্যে আবরু রা করে গাড়ীতে উঠতে যাচ্ছেন। বড় মানুষের বৌ কি আপনার আমার সুমুখ আর দশজনের মত যেতে পারেন; তাঁরা যে অসূর্যøস্পশ্যা।” এই বলেই ভদ্রলোকটি হাসতে লাগলেন। আমি এই পর্দ্দার বহর দেখে হাস্য সংবরণ করতে লাগলাম না। হাঁ, এরই নাম পর্দ্দা বটে-একেবারে মশারি যাত্রা।
আর একবার কি একটা যোগ উপলক্ষে গঙ্গা-স্নানের ব্যবস্থা ছিল। লোক-সমারোহ দেখবার জন্য এবং এ বৃদ্ধ বয়সে ব’লেই ফেলি, গঙ্গাস্নান করে পাপ মোচনের জন্যও বটে, বড়বাজারে আদ্য-শ্রাদ্ধের ঘাটে গিয়াছিলাম। তখন শীতকাল, স্নানের সময় অপরাহ্নে পাঁচটা।
ঘাটে দাঁড়িয়ে লোক সমারোহ দেখছি, আর ভাবছি এই দারুণ শীতের মধ্যে কেমন করে গঙ্গাস্নান ক’রব। এমন সময় দেখি ঘেরাটোপ আগাগোড়া আবৃত একখানি পাল্কী ঘাটে এল। পাল্কীর চার কোণ ধ’রে চারজন আরদালী, আর পাল্কীর দুই দুয়ার বরাবর দুইটী দাসী। বুঝতে বাকী রহিল না যে কোন ধনাঢ্য ব্যক্তির গৃহিণী, বা কন্যা, বা পুত্রবধূ স্নান করতে এলেন। বড় মানুষের বাড়ীর মেয়েরা এমন আড়ম্বর ক’রে এসেই থাকেন, তাতে আশ্চর্য্যের কথা কিছুই নেই।
কিন্তু তারপর যা দেখলাম, সে হাস্যরসের এবং করুণ-রসের একেবারে চূড়ান্ত। আমি মনে করেছিলাম গঙ্গার জলের কিনারে পাল্কী নামানো হবে এবং আরোহিণীরা অবতরণ করে গঙ্গাস্নান করে আসবেন। কিন্তু, আমার সে কল্পনা আকাশেই থেকে গেল। দেখলাম বেহারা মায় আরদালী দাসী দুইটী-পাল্কী নিয়ে জলের মধ্যে নেমে গেল। যেখানে গিয়ে পাল্কী থামলো, সেখানে বোধ হয় বুক-সমান জল। বেহারারা তখন পাল্কীখানিকে একেবারে জলে ডুবিয়ে তৎণাৎ উপরে তুললো। এবং তারপরেই পাল্কী নিয়ে তীরে উঠে এসে, যেভাবে আগমন, সেইভাবেই প্রতিগমন। আমার হাসি এলো পাল্কীর গঙ্গাস্নান দেখে; আর মনে কষ্ট হ’তে লাগল, পাল্কীর মধ্যে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অবস্থা স্মরণ করে। এই শীতের সন্ধ্যায় পাল্কীর মধ্যে মা-লক্ষ্মীরা ভিজে কাপড়ে হি-হি করে কাঁপছেন। এদিকে তাঁদের স্নান যা হোলো, তা তো দেখতেই পেলাম। এর নাম পর্দ্দা!
সেন মহাশয় পাল্কীর “গঙ্গাস্নান” দেখিয়া হাসিয়াছেন। আমরা শৈশবে চিলমারীর ঘাটে ‘পাল্কীর ব্রপুত্র নদের স্নান’ শুনিয়া হাসিয়াছি। পরে ভাগলপুরে গিয়া পাল্কীর রেল ভ্রমণের বিষয় শুনিয়াছি।
একবার একটি ত্রয়োদশ বর্ষীয়া নব-বিবাহিতা বালিকার শ্বশুর-বাড়ী যাত্রা স্বচ েদেখিয়াছি; তাহা বেশ স্পষ্ট মনে আছে। ভাগলপুর প্রভৃতি স্থানে জুন মাসে রৌদ্র কিরূপ প্রখর হয়, তা সকলেই জানেন।
জুন মাসে দিবা ৮ ঘটিকার সময় সে বালিকা নববধূকে মোটা বেনারসী শাড়ী পরিয়া মাথায় আধ হাত ঘোমটা টানিয়া পাল্কীকে উঠিতে হইল। সেই ঘোমটার উপর আবার একটা ভারী ফুলের “সেহরা” তাহার কপালে বাঁধিয়া দেওয়া হইল। পরে পাল্কীর দ্বার বন্ধ করিয়া জরির কাজ করা লাল বানাতের ঘেরাটোপ দ্বারা পাল্কী ঢাকা হইল। সেই পাল্কী ট্রেনের ব্রেকভ্যানের খোলা গাড়ীতে তুলিয়া দেওয়া হইল। এই অবস্থায় দগ্ধ ও সিদ্ধ হইতে হইতে বালিকা চলিল, তাহার শ্বশুর-বাড়ী-যশিদী!!
অবরোধ বাসিনী - ৪২
সেদিন (৭ই জুলাই ১৯৩১ সাল) জনৈকা মহিলা নিন্মলিখিত ঘটনা দুইটি বলিলেনঃ
বহুবর্ষ পূর্ব্বে তাঁহার সম্পর্কের এক নানিজান পশ্চিম দেশে বেড়াইতে গিয়া ফিরিয়া আসিলেন। তিনি যথাসময়ে টেলিগ্রাফ যোগে তাঁহার কলিকাতায় পৌঁছিবার সময় জানাইয়াছিলেন। কিন্তু সেদিন তুফানে সমস্ত টেলিগ্রাফের তার ছিঁড়িয়া গিয়াছিল এবং কলিকাতার রাস্তায় সাঁতার-জল ছিল। সুতরাং এখানে কেহ নানিজানের টেলিগ্রাফ পায় নাই এবং হাবড়া ষ্টেশনে পাল্কী লইয়া কেহ তাঁহাকে আনিতেও যায় নাই।
এদিকে যথাসময়ে নানিজানের রিজার্ভ-করা গাড়ী হাবড়ায় পৌঁছিল; সকলে নামিলেন জিনিষপত্রও নামান হইল কিন্তু পাল্কী না থাকায় নানিজান বোরকা পরিয়া থাকা সত্ত্বেও কিছুতেই নামিতে সম্মত হইলেন না। অনেকক্ষণ সাধ্য-সাধনের পর নানাসাহেব ভারী বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “তবে তুমি এই ট্রেনেই থাক, আমরা চলিলাম।” বেগতিক দেখিয়া নানিজান মিনতি করিয়া বলিলেন, “আমি এক উপায় বলিয়া দিই, আপনারা আমাকে সেইরূপে নামান।” উপায়টী এই যে, তাঁহার সর্ব্বাঙ্গে অনেক কাপড় জড়াইয়া তাঁহাকে একটা বড় গাঁটরীর মত করিয়া বাঁধিয়া তিন চারি জনে সেই গাঁটরী ধরাধরি করিয়া টানিয়া ট্রেণ হইতে নামাইল। অতঃপর তদবস্থায় তাঁহাকে ঘোড়ার গাড়ীতে তুলিয়া দেওয়া হইল।
অবরোধ বাসিনী - ৪৩
এক বোরকাধারিণী বিবি হাতে একটা ব্যাগ সহ ট্রেণ হইতে নামিয়াছেন। তাঁহাকে অন্যান্য আসবাব সহ এক জায়গায় দাঁড় করাইয়া তাঁহার স্বামী কার্য্যান্তরে গেলেন। কোন কারণবশতঃ তাঁহার ফিরিয়া আসিতে কিছু বিলম্ব হইল। এদিকে বিবি সাহেবা দাঁড়াইয়া অশ্রু বর্ষণ করিতে লাগিলেন। তাঁহার অস্ফুট ক্রন্দনধ্বনি শুনিয়া এবং শরীরের কম্পন দেখিয়া ক্রমে লোকের ভীড়ে হইল। লোকেরা দয়া করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার সঙ্গের লোকের নাম বলুন ত, আমরা তাঁহাকে ডাকিয়া আনি।” তিনি একবার আকাশে সূর্য্যের দিকে ইসারা করেন আর একবার হাতের ব্যাগ তুলিয়া দেখান। ইহাতে উপস্থিত লোকেরা কিছু বুঝিতে না পারিয়া হাসিতে হট্টগোল বাধাইয়া দিল।
কিছুণ পরে এক ব্যক্তি হাঁফাইতে সেখানে দৌড়াইয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হইয়াছে? ভীড় কেন?” ঘটনা শুনিয়া তিনি হাসিয়া বলিলেন, “আমার নাম ‘আফতাব বেগ’, তাই আমার বিবি সূর্য্যের দিকে ইসারা করিয়া দেন আর হাতের বেগ (ব্যাগ) দেখাইয়াছেন।”
অবরোধ বাসিনী - ৪৪
জনাব শরফদ্দীন আহমদ বি• এ• (আলীগড়) আজিমাবাদী নিন্মলিখিত ঘটনাত্রয় কোন উর্দ্দু কাগজে লিখিয়াছেন। আমি তাহা অনুবাদ করিবার লোভ সম্বরণ করিতে পারিলাম না। যথাঃ
গত বৎসর পর্য্যন্ত আমি আলীগড়ে ছিলাম। যেহেতু সেখানকার ষ্টেশন একরূপ জাঁকজমকে ই• আই• আর• লাইনে অদ্বিতীয় বোধ হয়, সেই জন্য আমি প্রত্যহই পদব্রজে ভ্রমণের সময় ষ্টেশনে যাইতাম। সেখানে অন্যান্য তামাসার মধ্যে অনেকগুলি ১৩শ শতাব্দীর বোরকা আমার দৃষ্টিগোচর হইয়াছিল। আর খোদা মিথ্যা না বলান, প্রত্যেক বোরকাই কোন না কোন প্রকার কৌতুকাবহ ছিল। তন্মধ্যে মাত্র তিনটী ঘটনা এখানে বিবৃত হইল।
প্রথম ঘটনা এই যে, একদিন আমি আলীগড় ষ্টেশনে প্লাট-ফরমে পায়চারি করিতেছিলাম, সহসা পশ্চাৎদিক হইতে আমার গায়ে ধাক্কা লাগিল। মুখ ফিরাইয়া দেখিলাম যে, এক বোরকাধারিণী বিবি দাঁড়াইয়া আছেন; আর আমাকে শাসাইয়া বলিতে লাগিলেন, “মিয়া দেখে চলেন না?” তাঁহার কথায় আমার প্রবল হাসি পাইল, কারণ তিনি ত আমার পশ্চাতে ছিলেন, সুতরাং দেখিয়া চলা না চলার দায়িত্ব কাহার, তাহা সহজেই অনুমেয়। আমি তাঁহাকে কেবল এইটুকু বলিলাম, “আপনি মেহেরবাণী করিয়া বোরকার জাল চক্ষের সম্মুখে ঠিক করিয়া নিন” এবং হাসিতে হাসিতে অন্যত্র চলিলাম।
অবরোধ বাসিনী - ৪৫
দ্বিতীয় ঘটনা এই যে, একদিন আবার আমি কতিপয় বন্ধুর সহিত আলীগড় ষ্টেশনে তামাসা দেখায় মশগুল ছিলাম। এমন সময় আমাদের সন্নিকটে একটি শিশুর কান্নার শব্দ শুনিতে পাইলাম। আমরা চারিদিকে চাহিয়া দেখিলাম-কিছুই দেখিতে পাইলাম না। আবার কিছুণ পরে শুনিলাম, কোন শিশু আমাদের অতি নিকটে চেঁচাইতেছে, কিন্তু এদিক সেদিক দেখিয়া কিছুই ঠিক করিতে পারিলাম না। আমার বন্ধুরা কিছু বুঝিতে পারিলেন না; কিন্তু যেহেতু বোরকা সম্বন্ধে আমার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে, তাই আমি অনুসন্ধানে প্রবৃত হইলাম। শেষে দেখি কি, এক বোরকাধারিণী বিবি যাইতেছেন, তাঁহারই বোরকা ভিতর হইতে শিশুর রোদনের শব্দ আসিতেছে!
ঘটনা ছিল এই যে বিবি সাহেবা শিশুকে বোরকা ভিতর লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন; সে গরমে অস্থির হইয়া চীৎকার করিতেছিল! তাই কেহ শিশুকে দেখিতে পায় নাই, কেবল কান্না শুনিতে পাওয়া যাইতেছিল। আমি বন্ধুদের ঐ তামাসা দেখাইয়া দিলাম। আর হাসিতে হাসিতে আমাদের যে কি দশা হইল, তাহা আর কি বলিব?
অবরোধ বাসিনী - ৪৬
আমি পূর্ব্বের ন্যায় আবার একদা আলীগড় ষ্টেশনের প্ল্যাটফরমে পায়চারি করিতেছিলাম। সম্মুখে এক “সফেদ গোল” (শাদা দল) আসিতে দেখিলাম। নিকটে আসিলে দেখিলাম আগে আগে এক প্রবীণ ভদ্রলোক এক হাতে পানদান অপর হাতে পাখা লইয়া আসিতেছেন; তাঁহার পশ্চাতে কয়েকটী বোরকাধারিণী পরস্পরে জড়াজড়ি করিয়া মিলিত হইয়া আসিতেছেন। এই কাফেলাটী অধিক দূরে না যাইতেই এক মাল-ঠেলা গাড়ীর সম্মুখীন হইল। উহার সহিত টক্কর খাইয়া এক বিবি যেই পড়িলেন, অমনি সমস্ত পার্টি তাঁহার সহিত গড়াইল।
সন্ধ্যার সময়, গাড়ী আসিতেছিল, যাত্রীদের হাঙ্গামা ছিল-এমত স্থলে প্লাটফরমের উপর ঐরূপ আশ্চর্য্য জিনিষ পড়িয়া থাকিতে দেখিলে কে না অগ্রসর হইয়া দেখিবে? অতি শীঘ্র বেশ একটা ভীড় জমা হইল। প্রত্যেকেই ভূপতিতাদের সাহায্য করিতে ইচ্ছুক ছিল; কিন্তু স্ত্রীলোককে স্পর্শ করিবে কে? সঙ্গের বৃদ্ধ ভদ্রলোকটীর জন্য আরও দুঃখ হইতেছিল; বেচারা একা, আর এই বিপদ! শেষে আমি বলিলাম, “হযরত! আপনিই উহাদের তুলুন না; দেখুন তো বিবিদের কোথাও আঘাত লাগে নাই ত?”
বেচারা যখন তাঁহাদের তুলিতে লাগিলেন, আমি দেখিলাম যে বিবিরা আপন আপন বোরকা পরস্পরের বোরকা সহিত বাঁধিয়া লইয়াছিলেন এবং অগ্রবর্ত্তিনীর বোরকার দামন ধরিয়া সকলেই চক্ষু বুজিয়া চলিতেছিলেন। এখন আমার সম্মুখে এই সমস্যা ছিল যে অগ্রবর্ত্তিনী বিবি এই মাল-ঠেলা গাড়ী দেখিলেন না কেন, যে এ বিপদের সম্মুখীন হইতে হইল? আমি তাঁহার বোরকার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিলাম যে তাঁহার বোরকার জাল যাহা চক্ষের সম্মুখে থাকা চাই, তাহা মাথার উপর পিছন সরিয়া গিয়াছে। ইহাতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হইল যে বিবি সাহেবা কেবল আন্দাজে হাঁটিয়া আসিতেছিলেন।
এখন অবস্থা এই হইয়া দাঁড়াইল যে বেচারা “বড়ে মিয়াঁ” একজনকে উঠাইতে গেলে অপর সকলের উপর টান পড়ে-সুতরাং প্রথম বিবি আবার সেই টানে “বড়ে মিয়াঁর” হাত ছাড়া হইয়া যান। এইরূপে অনেক টানাহেঁচড়ার পরে বিবিরা উঠিয়া দাঁড়াইতে পারিলেন।
অবরোধ বাসিনী - ৪৭
কবির ভাষায় বলিতে ইচ্ছা করেঃ
“কাব্য উপন্যাস নহে, এ মম জীবন,
নাট্যশালা নহে, ইহা প্রকৃত ভবন!”
প্রায় তিন বৎসরের ঘটনা, আমাদের প্রথম মোটর বাস প্রস্তুত হইল। পূর্ব্বদিন আমাদের স্কুলের জনৈকা শিয়িত্রী, মেম সাহেবা মিস্ত্রীখানায় গিয়া বাস দেখিয়া আসিয়া সংবাদ দিলেন যে, মোটর ভয়ানক অন্ধকার•••“না বাবা! আমি কখনও মোটরে যা’ব না।” বাস আসিয়া পৌঁছিলে দেখা গেল,-বাসের পশ্চাতের দ্বারের উপর সামান্য একটু জাল আছে এবং সম্মুখ দিকে ও উপরে একটু জাল আছে। এই তিন ইঞ্চি চওড়া ও দেড় ফুট লম্বা জাল দুই টুকরা না থাকিলে বাসখানাকে সম্পূর্ণ “এয়ার টাইট” বলা যাইতে পারিত।
প্রথম দিন ছাত্রীদের নূতন মোটরে বাড়ী পৌঁছান হইল। চাকরাণী ফিরিয়া আসিয়া সংবাদ দিল-গাড়ী বড্ড গরম হয়,-মেয়েরা বাড়ী যাইবার পথে অস্থির হইয়াছিল। কেহ কেহ বমি করিযাছিল। ছোট মেয়েরা অন্ধকারে ভয় পাইয়া কাঁদিয়াছিল।
দ্বিতীয় দিন ছাত্রী আনাইবার জন্য মোটর পাঠাইবার সময় উপরোক্তা মেম সাহেবা মোটরের দ্বারের খড়খড়িটা নামাইয়া দিয়া একটা রঙীন কাপড়ের পর্দ্দা ঝুলাইয়া দিলেন। তথাপি ছাত্রীগণ স্কুলে আসিলে দেখা গেল,-দুই তিন জন অজ্ঞান হইয়াছে, দুই চারিজনে বমি করিয়াছে, কয়েক জনের মাথা ধরিয়াছে, ইত্যাদি। অপরাহ্নে মেম সাহেবা বাসের দুই পাশের দুইটী কড়খড়ি নামাইয়া দুই খণ্ড কাপড়ের পর্দ্দা দিলেন। এইরূপে তাহাদের বাড়ী পাঠাইয়া দেওয়া গেল।
সেই দিন সন্ধ্যায় আমার এক পুরাতন বন্ধু মিসেস মুখার্জ্জি আমার সহিত দেখা করিতে আসিলেন। স্কুলের বিবিধ উন্নতির সংবাদে আনন্দ প্রকাশ করিয়া বলিলেন,-“আপনাদের মোটরবাস ত বেশ সুন্দর হয়েছে। প্রথমে রাস্তায় দেখে আমি মনে করেছি যে আলমারী যাচ্ছে না কি-চারিদিকে একেবারে বন্ধ, তাই বড় আলমারী বলে ভ্রম হয়! আমার ভাইপো এসে বলেল, “ও পিসীমা! দেখ, সে Moving Black Hole (চলন্ত অন্ধকূপ) যাচ্ছে।” তাই ত, ওর ভিতর মেয়েরা বসে কি করে?”
তৃতীয় দিন অপরাহ্নে চারি পাঁচ জন ছাত্রীর মাতা দেখা করিতে আসিয়া বলিলেন, “আপকা মোটর ত খোদা কা পানাহ! আপ লাড়কীয়োঁ কো জীতে জী ক্ববর মে ভয় রহি হয়ঁ।” আমি নিতান্ত অসহায়ভাবে বলিলাম, “কি করি, এরূপ না হইলে ত আপনারাই বলিতেন, “বেপর্দ্দা গাড়ী।” তাঁহারা অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া বলিলেন, ‘তব কেয়া আপন জান মারকে পর্দ্দা করেঙ্গী? কালসে হামারী লাড়কীয়াঁ স্ড়্গুল নেহী আয়েঙ্গী।” সে দিনও দুই তিনটী বালিকা অজ্ঞান হইয়াছিল। প্রত্যেক বাড়ী হইতে চাকরাণীর মারফতে ফরিয়াদ আসিয়াছিল যে, তাহার আর মোটর বাসে আসিবে না।
সন্ধ্যার পর চারিখানা ঠিকানারহিত ডাকের চিঠি পাইলাম। ইংরাজী চিঠির লেখক স্বাক্ষর করিয়াছেন, "Muslim Brotherhood" বাকী তিনখানা উর্দ্দু ছিল-দুইখানা বেনামী আর চতুর্থখানায় পাঁচজনের স্বাক্ষর ছিল। সকল পত্রেরই বিষয় একই-সকলেই দয়া করিয়া আমাদের স্কুলের কল্যাণ কামনায় লিখিয়াছেন যে, মোটরের দুই পার্শ্বে যে পর্দ্দা দেওয়া হইয়াছে, তাহা বাতাসে উড়িয়া গাড়ী বে-পর্দ্দা করে। যদি আগামীকল্য পর্য্যন্ত মোটরে ভাল পর্দ্দার ব্যবস্থা না করা যায়, তবে তাঁহারা তাতোধিক দয়া করিয়া “খবিছ” “পলীদ” প্রভৃতি উর্দ্দু দৈনিক পত্রিকায় স্কুলের কুৎসা রটনা করিবেন এবং দেখিয়া লইবেন, এরূপ বে-পর্দ্দা গাড়ীতে কি করিয়া মেয়েরা আসে।
এ তো ভারী বিপদ,-
“না ধরিলে রাজা বধে,-ধরিলে ভুজঙ্গ!”
রাজার আদেশে এমন করিয়া আর কেহ বোধ হয় জীবন্ত সাপ ধরে নাই! অবরোধ-বন্দিনীদের পক্ষে বলিতে ইচ্ছা করিল,-
“কেন আসিলাম হায়! এ পোড়া সংসারে,
কেন জন্ম লভিলাম পর্দ্দা-নশীন ঘরে!”
রায় শ্রীযুক্ত জলধর সেন বাহাদুর গত ১৩৩৫ সনে লিখিয়াছেনঃ
সেকালের পর্দ্দা-আমি যে সময়কে সেকাল বলছি, তা সত্য-ক্রেতা-দ্বাপর যুগ নয় কিন্তু-সে আমাদের যৌবনকালের কথা-এই পঞ্চাশ বৎসর পূর্ব্বের কথা। সে সময় আমরা পর্দ্দার যে রকম কঠোর, তথা হাস্যকর ব্যবস্থা দেখিয়াছিলাম, সে সকল দৃশ্য এখনও আমার চরে সম্মুখে ছবির মত জেগে আছে। তারই গুটিকয়েক দৃশ্যের সামান্য বর্ণনা দিতে চেষ্টা করিব।
সেই সময় একদিন কি জন্য যেন হাবড়া ষ্টেশনে গিয়াছিলাম। আমি তখন কলেজে পড়ি। ষ্টেশনের প্ল্যাটফরমে গিয়া দেখি কয়েকজন বরকন্দাজ যাত্রীর ভিড় সরিয়ে পথ করছে। এগুতে সাহস হোল না; হয়ত কোন রাজা মহারাজা গাড়ীতে উঠবেন, তারই জন্য তার সৈন্য সামন্তেরা নিরীহ যাত্রীদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। এই ভেবে রাজা-মহারাজার আগমন প্রতীায় একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইলাম।
তিন চার মিনিট হয়ে গেল, রাজা মহারাজা আর আসেন না। শেষে দেখি কিনা-একটা মশারি আসছেন। মশারির চার কোণা চারজন সিপাহী ধ’রে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন। আমি ত এ দৃ দেখে অবাক-এ ব্যাপার ত পূর্ব্বে কখনও দেখি নাই। আমার পাশেই এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, “এমন করে একটা মশারি যাচ্ছেন কেন?” তিনি একটু হেসে বল্লেন, “আপনি বুঝি কখন মশারির যাত্রা দেখেন নাই? দেখছেন না কত সিপাহী-সান্ত্রী যাচ্ছে। বিহার অঞ্চলের কোন এক রাজা না জমীদারের গৃহিনী ঐ মশারির মধ্যে আবরু রা করে গাড়ীতে উঠতে যাচ্ছেন। বড় মানুষের বৌ কি আপনার আমার সুমুখ আর দশজনের মত যেতে পারেন; তাঁরা যে অসূর্যøস্পশ্যা।” এই বলেই ভদ্রলোকটি হাসতে লাগলেন। আমি এই পর্দ্দার বহর দেখে হাস্য সংবরণ করতে লাগলাম না। হাঁ, এরই নাম পর্দ্দা বটে-একেবারে মশারি যাত্রা।
আর একবার কি একটা যোগ উপলক্ষে গঙ্গা-স্নানের ব্যবস্থা ছিল। লোক-সমারোহ দেখবার জন্য এবং এ বৃদ্ধ বয়সে ব’লেই ফেলি, গঙ্গাস্নান করে পাপ মোচনের জন্যও বটে, বড়বাজারে আদ্য-শ্রাদ্ধের ঘাটে গিয়াছিলাম। তখন শীতকাল, স্নানের সময় অপরাহ্নে পাঁচটা।
ঘাটে দাঁড়িয়ে লোক সমারোহ দেখছি, আর ভাবছি এই দারুণ শীতের মধ্যে কেমন করে গঙ্গাস্নান ক’রব। এমন সময় দেখি ঘেরাটোপ আগাগোড়া আবৃত একখানি পাল্কী ঘাটে এল। পাল্কীর চার কোণ ধ’রে চারজন আরদালী, আর পাল্কীর দুই দুয়ার বরাবর দুইটী দাসী। বুঝতে বাকী রহিল না যে কোন ধনাঢ্য ব্যক্তির গৃহিণী, বা কন্যা, বা পুত্রবধূ স্নান করতে এলেন। বড় মানুষের বাড়ীর মেয়েরা এমন আড়ম্বর ক’রে এসেই থাকেন, তাতে আশ্চর্য্যের কথা কিছুই নেই।
কিন্তু তারপর যা দেখলাম, সে হাস্যরসের এবং করুণ-রসের একেবারে চূড়ান্ত। আমি মনে করেছিলাম গঙ্গার জলের কিনারে পাল্কী নামানো হবে এবং আরোহিণীরা অবতরণ করে গঙ্গাস্নান করে আসবেন। কিন্তু, আমার সে কল্পনা আকাশেই থেকে গেল। দেখলাম বেহারা মায় আরদালী দাসী দুইটী-পাল্কী নিয়ে জলের মধ্যে নেমে গেল। যেখানে গিয়ে পাল্কী থামলো, সেখানে বোধ হয় বুক-সমান জল। বেহারারা তখন পাল্কীখানিকে একেবারে জলে ডুবিয়ে তৎণাৎ উপরে তুললো। এবং তারপরেই পাল্কী নিয়ে তীরে উঠে এসে, যেভাবে আগমন, সেইভাবেই প্রতিগমন। আমার হাসি এলো পাল্কীর গঙ্গাস্নান দেখে; আর মনে কষ্ট হ’তে লাগল, পাল্কীর মধ্যে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অবস্থা স্মরণ করে। এই শীতের সন্ধ্যায় পাল্কীর মধ্যে মা-লক্ষ্মীরা ভিজে কাপড়ে হি-হি করে কাঁপছেন। এদিকে তাঁদের স্নান যা হোলো, তা তো দেখতেই পেলাম। এর নাম পর্দ্দা!
সেন মহাশয় পাল্কীর “গঙ্গাস্নান” দেখিয়া হাসিয়াছেন। আমরা শৈশবে চিলমারীর ঘাটে ‘পাল্কীর ব্রপুত্র নদের স্নান’ শুনিয়া হাসিয়াছি। পরে ভাগলপুরে গিয়া পাল্কীর রেল ভ্রমণের বিষয় শুনিয়াছি।
একবার একটি ত্রয়োদশ বর্ষীয়া নব-বিবাহিতা বালিকার শ্বশুর-বাড়ী যাত্রা স্বচ েদেখিয়াছি; তাহা বেশ স্পষ্ট মনে আছে। ভাগলপুর প্রভৃতি স্থানে জুন মাসে রৌদ্র কিরূপ প্রখর হয়, তা সকলেই জানেন।
জুন মাসে দিবা ৮ ঘটিকার সময় সে বালিকা নববধূকে মোটা বেনারসী শাড়ী পরিয়া মাথায় আধ হাত ঘোমটা টানিয়া পাল্কীকে উঠিতে হইল। সেই ঘোমটার উপর আবার একটা ভারী ফুলের “সেহরা” তাহার কপালে বাঁধিয়া দেওয়া হইল। পরে পাল্কীর দ্বার বন্ধ করিয়া জরির কাজ করা লাল বানাতের ঘেরাটোপ দ্বারা পাল্কী ঢাকা হইল। সেই পাল্কী ট্রেনের ব্রেকভ্যানের খোলা গাড়ীতে তুলিয়া দেওয়া হইল। এই অবস্থায় দগ্ধ ও সিদ্ধ হইতে হইতে বালিকা চলিল, তাহার শ্বশুর-বাড়ী-যশিদী!!
অবরোধ বাসিনী - ৪২
সেদিন (৭ই জুলাই ১৯৩১ সাল) জনৈকা মহিলা নিন্মলিখিত ঘটনা দুইটি বলিলেনঃ
বহুবর্ষ পূর্ব্বে তাঁহার সম্পর্কের এক নানিজান পশ্চিম দেশে বেড়াইতে গিয়া ফিরিয়া আসিলেন। তিনি যথাসময়ে টেলিগ্রাফ যোগে তাঁহার কলিকাতায় পৌঁছিবার সময় জানাইয়াছিলেন। কিন্তু সেদিন তুফানে সমস্ত টেলিগ্রাফের তার ছিঁড়িয়া গিয়াছিল এবং কলিকাতার রাস্তায় সাঁতার-জল ছিল। সুতরাং এখানে কেহ নানিজানের টেলিগ্রাফ পায় নাই এবং হাবড়া ষ্টেশনে পাল্কী লইয়া কেহ তাঁহাকে আনিতেও যায় নাই।
এদিকে যথাসময়ে নানিজানের রিজার্ভ-করা গাড়ী হাবড়ায় পৌঁছিল; সকলে নামিলেন জিনিষপত্রও নামান হইল কিন্তু পাল্কী না থাকায় নানিজান বোরকা পরিয়া থাকা সত্ত্বেও কিছুতেই নামিতে সম্মত হইলেন না। অনেকক্ষণ সাধ্য-সাধনের পর নানাসাহেব ভারী বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “তবে তুমি এই ট্রেনেই থাক, আমরা চলিলাম।” বেগতিক দেখিয়া নানিজান মিনতি করিয়া বলিলেন, “আমি এক উপায় বলিয়া দিই, আপনারা আমাকে সেইরূপে নামান।” উপায়টী এই যে, তাঁহার সর্ব্বাঙ্গে অনেক কাপড় জড়াইয়া তাঁহাকে একটা বড় গাঁটরীর মত করিয়া বাঁধিয়া তিন চারি জনে সেই গাঁটরী ধরাধরি করিয়া টানিয়া ট্রেণ হইতে নামাইল। অতঃপর তদবস্থায় তাঁহাকে ঘোড়ার গাড়ীতে তুলিয়া দেওয়া হইল।
অবরোধ বাসিনী - ৪৩
এক বোরকাধারিণী বিবি হাতে একটা ব্যাগ সহ ট্রেণ হইতে নামিয়াছেন। তাঁহাকে অন্যান্য আসবাব সহ এক জায়গায় দাঁড় করাইয়া তাঁহার স্বামী কার্য্যান্তরে গেলেন। কোন কারণবশতঃ তাঁহার ফিরিয়া আসিতে কিছু বিলম্ব হইল। এদিকে বিবি সাহেবা দাঁড়াইয়া অশ্রু বর্ষণ করিতে লাগিলেন। তাঁহার অস্ফুট ক্রন্দনধ্বনি শুনিয়া এবং শরীরের কম্পন দেখিয়া ক্রমে লোকের ভীড়ে হইল। লোকেরা দয়া করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার সঙ্গের লোকের নাম বলুন ত, আমরা তাঁহাকে ডাকিয়া আনি।” তিনি একবার আকাশে সূর্য্যের দিকে ইসারা করেন আর একবার হাতের ব্যাগ তুলিয়া দেখান। ইহাতে উপস্থিত লোকেরা কিছু বুঝিতে না পারিয়া হাসিতে হট্টগোল বাধাইয়া দিল।
কিছুণ পরে এক ব্যক্তি হাঁফাইতে সেখানে দৌড়াইয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হইয়াছে? ভীড় কেন?” ঘটনা শুনিয়া তিনি হাসিয়া বলিলেন, “আমার নাম ‘আফতাব বেগ’, তাই আমার বিবি সূর্য্যের দিকে ইসারা করিয়া দেন আর হাতের বেগ (ব্যাগ) দেখাইয়াছেন।”
অবরোধ বাসিনী - ৪৪
জনাব শরফদ্দীন আহমদ বি• এ• (আলীগড়) আজিমাবাদী নিন্মলিখিত ঘটনাত্রয় কোন উর্দ্দু কাগজে লিখিয়াছেন। আমি তাহা অনুবাদ করিবার লোভ সম্বরণ করিতে পারিলাম না। যথাঃ
গত বৎসর পর্য্যন্ত আমি আলীগড়ে ছিলাম। যেহেতু সেখানকার ষ্টেশন একরূপ জাঁকজমকে ই• আই• আর• লাইনে অদ্বিতীয় বোধ হয়, সেই জন্য আমি প্রত্যহই পদব্রজে ভ্রমণের সময় ষ্টেশনে যাইতাম। সেখানে অন্যান্য তামাসার মধ্যে অনেকগুলি ১৩শ শতাব্দীর বোরকা আমার দৃষ্টিগোচর হইয়াছিল। আর খোদা মিথ্যা না বলান, প্রত্যেক বোরকাই কোন না কোন প্রকার কৌতুকাবহ ছিল। তন্মধ্যে মাত্র তিনটী ঘটনা এখানে বিবৃত হইল।
প্রথম ঘটনা এই যে, একদিন আমি আলীগড় ষ্টেশনে প্লাট-ফরমে পায়চারি করিতেছিলাম, সহসা পশ্চাৎদিক হইতে আমার গায়ে ধাক্কা লাগিল। মুখ ফিরাইয়া দেখিলাম যে, এক বোরকাধারিণী বিবি দাঁড়াইয়া আছেন; আর আমাকে শাসাইয়া বলিতে লাগিলেন, “মিয়া দেখে চলেন না?” তাঁহার কথায় আমার প্রবল হাসি পাইল, কারণ তিনি ত আমার পশ্চাতে ছিলেন, সুতরাং দেখিয়া চলা না চলার দায়িত্ব কাহার, তাহা সহজেই অনুমেয়। আমি তাঁহাকে কেবল এইটুকু বলিলাম, “আপনি মেহেরবাণী করিয়া বোরকার জাল চক্ষের সম্মুখে ঠিক করিয়া নিন” এবং হাসিতে হাসিতে অন্যত্র চলিলাম।
অবরোধ বাসিনী - ৪৫
দ্বিতীয় ঘটনা এই যে, একদিন আবার আমি কতিপয় বন্ধুর সহিত আলীগড় ষ্টেশনে তামাসা দেখায় মশগুল ছিলাম। এমন সময় আমাদের সন্নিকটে একটি শিশুর কান্নার শব্দ শুনিতে পাইলাম। আমরা চারিদিকে চাহিয়া দেখিলাম-কিছুই দেখিতে পাইলাম না। আবার কিছুণ পরে শুনিলাম, কোন শিশু আমাদের অতি নিকটে চেঁচাইতেছে, কিন্তু এদিক সেদিক দেখিয়া কিছুই ঠিক করিতে পারিলাম না। আমার বন্ধুরা কিছু বুঝিতে পারিলেন না; কিন্তু যেহেতু বোরকা সম্বন্ধে আমার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে, তাই আমি অনুসন্ধানে প্রবৃত হইলাম। শেষে দেখি কি, এক বোরকাধারিণী বিবি যাইতেছেন, তাঁহারই বোরকা ভিতর হইতে শিশুর রোদনের শব্দ আসিতেছে!
ঘটনা ছিল এই যে বিবি সাহেবা শিশুকে বোরকা ভিতর লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন; সে গরমে অস্থির হইয়া চীৎকার করিতেছিল! তাই কেহ শিশুকে দেখিতে পায় নাই, কেবল কান্না শুনিতে পাওয়া যাইতেছিল। আমি বন্ধুদের ঐ তামাসা দেখাইয়া দিলাম। আর হাসিতে হাসিতে আমাদের যে কি দশা হইল, তাহা আর কি বলিব?
অবরোধ বাসিনী - ৪৬
আমি পূর্ব্বের ন্যায় আবার একদা আলীগড় ষ্টেশনের প্ল্যাটফরমে পায়চারি করিতেছিলাম। সম্মুখে এক “সফেদ গোল” (শাদা দল) আসিতে দেখিলাম। নিকটে আসিলে দেখিলাম আগে আগে এক প্রবীণ ভদ্রলোক এক হাতে পানদান অপর হাতে পাখা লইয়া আসিতেছেন; তাঁহার পশ্চাতে কয়েকটী বোরকাধারিণী পরস্পরে জড়াজড়ি করিয়া মিলিত হইয়া আসিতেছেন। এই কাফেলাটী অধিক দূরে না যাইতেই এক মাল-ঠেলা গাড়ীর সম্মুখীন হইল। উহার সহিত টক্কর খাইয়া এক বিবি যেই পড়িলেন, অমনি সমস্ত পার্টি তাঁহার সহিত গড়াইল।
সন্ধ্যার সময়, গাড়ী আসিতেছিল, যাত্রীদের হাঙ্গামা ছিল-এমত স্থলে প্লাটফরমের উপর ঐরূপ আশ্চর্য্য জিনিষ পড়িয়া থাকিতে দেখিলে কে না অগ্রসর হইয়া দেখিবে? অতি শীঘ্র বেশ একটা ভীড় জমা হইল। প্রত্যেকেই ভূপতিতাদের সাহায্য করিতে ইচ্ছুক ছিল; কিন্তু স্ত্রীলোককে স্পর্শ করিবে কে? সঙ্গের বৃদ্ধ ভদ্রলোকটীর জন্য আরও দুঃখ হইতেছিল; বেচারা একা, আর এই বিপদ! শেষে আমি বলিলাম, “হযরত! আপনিই উহাদের তুলুন না; দেখুন তো বিবিদের কোথাও আঘাত লাগে নাই ত?”
বেচারা যখন তাঁহাদের তুলিতে লাগিলেন, আমি দেখিলাম যে বিবিরা আপন আপন বোরকা পরস্পরের বোরকা সহিত বাঁধিয়া লইয়াছিলেন এবং অগ্রবর্ত্তিনীর বোরকার দামন ধরিয়া সকলেই চক্ষু বুজিয়া চলিতেছিলেন। এখন আমার সম্মুখে এই সমস্যা ছিল যে অগ্রবর্ত্তিনী বিবি এই মাল-ঠেলা গাড়ী দেখিলেন না কেন, যে এ বিপদের সম্মুখীন হইতে হইল? আমি তাঁহার বোরকার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিলাম যে তাঁহার বোরকার জাল যাহা চক্ষের সম্মুখে থাকা চাই, তাহা মাথার উপর পিছন সরিয়া গিয়াছে। ইহাতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হইল যে বিবি সাহেবা কেবল আন্দাজে হাঁটিয়া আসিতেছিলেন।
এখন অবস্থা এই হইয়া দাঁড়াইল যে বেচারা “বড়ে মিয়াঁ” একজনকে উঠাইতে গেলে অপর সকলের উপর টান পড়ে-সুতরাং প্রথম বিবি আবার সেই টানে “বড়ে মিয়াঁর” হাত ছাড়া হইয়া যান। এইরূপে অনেক টানাহেঁচড়ার পরে বিবিরা উঠিয়া দাঁড়াইতে পারিলেন।
অবরোধ বাসিনী - ৪৭
কবির ভাষায় বলিতে ইচ্ছা করেঃ
“কাব্য উপন্যাস নহে, এ মম জীবন,
নাট্যশালা নহে, ইহা প্রকৃত ভবন!”
প্রায় তিন বৎসরের ঘটনা, আমাদের প্রথম মোটর বাস প্রস্তুত হইল। পূর্ব্বদিন আমাদের স্কুলের জনৈকা শিয়িত্রী, মেম সাহেবা মিস্ত্রীখানায় গিয়া বাস দেখিয়া আসিয়া সংবাদ দিলেন যে, মোটর ভয়ানক অন্ধকার•••“না বাবা! আমি কখনও মোটরে যা’ব না।” বাস আসিয়া পৌঁছিলে দেখা গেল,-বাসের পশ্চাতের দ্বারের উপর সামান্য একটু জাল আছে এবং সম্মুখ দিকে ও উপরে একটু জাল আছে। এই তিন ইঞ্চি চওড়া ও দেড় ফুট লম্বা জাল দুই টুকরা না থাকিলে বাসখানাকে সম্পূর্ণ “এয়ার টাইট” বলা যাইতে পারিত।
প্রথম দিন ছাত্রীদের নূতন মোটরে বাড়ী পৌঁছান হইল। চাকরাণী ফিরিয়া আসিয়া সংবাদ দিল-গাড়ী বড্ড গরম হয়,-মেয়েরা বাড়ী যাইবার পথে অস্থির হইয়াছিল। কেহ কেহ বমি করিযাছিল। ছোট মেয়েরা অন্ধকারে ভয় পাইয়া কাঁদিয়াছিল।
দ্বিতীয় দিন ছাত্রী আনাইবার জন্য মোটর পাঠাইবার সময় উপরোক্তা মেম সাহেবা মোটরের দ্বারের খড়খড়িটা নামাইয়া দিয়া একটা রঙীন কাপড়ের পর্দ্দা ঝুলাইয়া দিলেন। তথাপি ছাত্রীগণ স্কুলে আসিলে দেখা গেল,-দুই তিন জন অজ্ঞান হইয়াছে, দুই চারিজনে বমি করিয়াছে, কয়েক জনের মাথা ধরিয়াছে, ইত্যাদি। অপরাহ্নে মেম সাহেবা বাসের দুই পাশের দুইটী কড়খড়ি নামাইয়া দুই খণ্ড কাপড়ের পর্দ্দা দিলেন। এইরূপে তাহাদের বাড়ী পাঠাইয়া দেওয়া গেল।
সেই দিন সন্ধ্যায় আমার এক পুরাতন বন্ধু মিসেস মুখার্জ্জি আমার সহিত দেখা করিতে আসিলেন। স্কুলের বিবিধ উন্নতির সংবাদে আনন্দ প্রকাশ করিয়া বলিলেন,-“আপনাদের মোটরবাস ত বেশ সুন্দর হয়েছে। প্রথমে রাস্তায় দেখে আমি মনে করেছি যে আলমারী যাচ্ছে না কি-চারিদিকে একেবারে বন্ধ, তাই বড় আলমারী বলে ভ্রম হয়! আমার ভাইপো এসে বলেল, “ও পিসীমা! দেখ, সে Moving Black Hole (চলন্ত অন্ধকূপ) যাচ্ছে।” তাই ত, ওর ভিতর মেয়েরা বসে কি করে?”
তৃতীয় দিন অপরাহ্নে চারি পাঁচ জন ছাত্রীর মাতা দেখা করিতে আসিয়া বলিলেন, “আপকা মোটর ত খোদা কা পানাহ! আপ লাড়কীয়োঁ কো জীতে জী ক্ববর মে ভয় রহি হয়ঁ।” আমি নিতান্ত অসহায়ভাবে বলিলাম, “কি করি, এরূপ না হইলে ত আপনারাই বলিতেন, “বেপর্দ্দা গাড়ী।” তাঁহারা অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া বলিলেন, ‘তব কেয়া আপন জান মারকে পর্দ্দা করেঙ্গী? কালসে হামারী লাড়কীয়াঁ স্ড়্গুল নেহী আয়েঙ্গী।” সে দিনও দুই তিনটী বালিকা অজ্ঞান হইয়াছিল। প্রত্যেক বাড়ী হইতে চাকরাণীর মারফতে ফরিয়াদ আসিয়াছিল যে, তাহার আর মোটর বাসে আসিবে না।
সন্ধ্যার পর চারিখানা ঠিকানারহিত ডাকের চিঠি পাইলাম। ইংরাজী চিঠির লেখক স্বাক্ষর করিয়াছেন, "Muslim Brotherhood" বাকী তিনখানা উর্দ্দু ছিল-দুইখানা বেনামী আর চতুর্থখানায় পাঁচজনের স্বাক্ষর ছিল। সকল পত্রেরই বিষয় একই-সকলেই দয়া করিয়া আমাদের স্কুলের কল্যাণ কামনায় লিখিয়াছেন যে, মোটরের দুই পার্শ্বে যে পর্দ্দা দেওয়া হইয়াছে, তাহা বাতাসে উড়িয়া গাড়ী বে-পর্দ্দা করে। যদি আগামীকল্য পর্য্যন্ত মোটরে ভাল পর্দ্দার ব্যবস্থা না করা যায়, তবে তাঁহারা তাতোধিক দয়া করিয়া “খবিছ” “পলীদ” প্রভৃতি উর্দ্দু দৈনিক পত্রিকায় স্কুলের কুৎসা রটনা করিবেন এবং দেখিয়া লইবেন, এরূপ বে-পর্দ্দা গাড়ীতে কি করিয়া মেয়েরা আসে।
এ তো ভারী বিপদ,-
“না ধরিলে রাজা বধে,-ধরিলে ভুজঙ্গ!”
রাজার আদেশে এমন করিয়া আর কেহ বোধ হয় জীবন্ত সাপ ধরে নাই! অবরোধ-বন্দিনীদের পক্ষে বলিতে ইচ্ছা করিল,-
“কেন আসিলাম হায়! এ পোড়া সংসারে,
কেন জন্ম লভিলাম পর্দ্দা-নশীন ঘরে!”
0 comments: