ড. আহমদ আবদুল কাদের। বাংলাদেশে ইসলামি রাজনীতির একজন প্রাজ্ঞ ও বিদগ্ধ ব্যক্তি। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত সেই স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকেই। ১৯৮২ সালে তিনি ছাত্রশিবিরের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং একই বছর জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আদর্শিক বিরোধে জড়িয়ে সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর হাফেজ্জি হুজুরের সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদসহ খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন এবং
পরবর্তীতে খেলাফত মজলিস গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
বর্তমানে খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের আছেন ১৮ দলেও। ব্যক্তিগত জীবনে একজন শিক্ষক, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশে ইসলামি রাজনীতির অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ, হেফাজতে ইসলাম, চারদলীয় জোট, তৃতীয় শক্তিসহ নানা বিষয়ে কথা বলতে সাপ্তাহিক লিখনীর পক্ষ থেকে তার মুখোমুখি হয়েছিলেন সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর ও রোকন রাইয়ান।
লিখনী : অতীত থেকে শুরু করি। আপনি তো প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। সক্রিয় কর্মী থেকে একপর্যায়ে আপনি সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন।...
আহমদ আবদুল কাদের : হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। ১৯৭৭ সালে ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আমি ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। ১৯৮২ সালের মার্চে আমি ছাত্রশিবিরের সভাপতি নির্বাচিত হই। কিন্তু আগস্ট মাসে পদত্যাগ করি।
লিখনী : পদত্যাগের পর আপনি যুবশিবির নামে আরেকটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ছাত্রশিবির থেকে পদত্যাগের কারণ কী?
আহমদ আবদুল কাদের : ছাত্রশিবিরের পলিসিতে কয়েকটা বিষয় স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল- এটা কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করবে না, ইসলামের পক্ষে তারা কাজ করবে। প্রথমদিকে পাঁচ-ছয় বছর এটা মানা হলেও পরে এটা ঠিক থাকেনি। জামায়াতে ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াতে থাকে।
লিখনী : শিবির কি জামায়াতের অঙ্গসংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি?
আহমদ আবদুল কাদের : না, জামায়াত-শিবির দুটো আলাদা সংগঠন ছিলো এবং দুটোর গঠনতন্ত্র, মতাদর্শ ও কর্মপরিকল্পনাও ভিন্ন ছিল। ছাত্রশিবির স্বাধীনভাবে তাদের কর্মকা- পরিচালনা করতো। তবে জামায়াত সম্পৃক্ত কিছু নেতা এতে ছিলেন। মাঝখানে শিবিরের কিছু কর্মকাণ্ডে তারা আপত্তি প্রকাশ করে। তবুও আমরা যারা শিবিরকে স্বাধীন সংগঠন হিসেবে পরিচালনা করতে বদ্ধপরিকর ছিলাম তারা কখনও জামায়াতের সম্পৃক্ততা মেনে নিতে পারিনি। এতে জামায়াত ধীরে ধীরে আমাদের কর্মকাণ্ডে ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। আমি সভাপতি হওয়ার পর যখন কিছু কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে যাই তখন এই ক্ষিপ্ততা আরও বাড়ে।
লিখনী : আপনার প্রতি জামায়াতের ক্ষিপ্ত হওয়ার কারণ কী?
আহমদ আবদুল কাদের : ’৮১ সালে রমনা গ্রিনে একটি বড় সম্মেলন করা হয়। সেখানে অনেককে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হলেও জামায়াতের নেতাদের কাউকে ডাকা হয়নি। সে কারণে তারা আমাদের প্রতি ক্ষিপ্ত হতে শুরু করে। এখানে স্বাভাবিকভাবে ’৭১-এর প্রসঙ্গটা আসে। আমি ’৭১-এ জামায়াতের অবস্থানের ব্যাপারে আমাদের নেতাদের পর্যালোচনা করতে বলি। কারণ ৭১-এ জামায়াতের যে ভুল ছিল সেই ভুলের খেসারত ছাত্রশিবিরকেও দিতে হচ্ছিলো।
লিখনী : ’৭১-এর বিষয়ে আপনাদের এই বোধটা কেনো এলো?
আহমদ আবদুল কাদের : সেটা আমার না, শিবিরে আমার আগে যারা সভাপতি ছিলেন তাদের অনেকেই প্রশ্নটা তুলেছেন। কারণ আমরা মনে করতাম ’৭১ বিষয়ে অবস্থান পরিষ্কার না করে রাজনীতি করা সম্ভব নয়। যেহেতু এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা হয়েছে স্বাধীনতার পর এবং এটি একটি স্বাধীন ছাত্র সংগঠন। জামায়াত বা অন্যকোনো রাজনৈতিক দলের প্রভাবে যদি এটি প্রশ্নবিদ্ধ হয় তাহলে আমাদের পুরো কার্যক্রমই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যেতো। অথচ ছাত্রশিবির ততোদিনে সারা বাংলাদেশে একটি আদর্শ ছাত্র সংগঠন হিসেবে পরিচিত হয়েছিলো। এমনকি শিক্ষক-অভিভাবকরা ছাত্রদের এই সংগঠন করার ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন। সুতরাং জামায়াতের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করা আবশ্যক হয়ে পড়েছিলো।
লিখনী : ছাত্রশিবির থেকে পদত্যাগ করে আপনি যুবশিবির প্রতিষ্ঠা করলেন। যুবশিবিরের ব্যাপ্তিটা কতোটুকু ছিলো?
আহমদ আবদুল কাদের : শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত সাবেক অনেক নেতাই যুবশিবিরে ছিলেন এবং সারা দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় আমরা কমিটি গঠন করেছিলাম। শিবিরের তখনকার যারা উপরের লেবেলে ছিলেন তারাও অনেকে আমাদের সাপোর্ট দিয়েছিলেন।
লিখনী : যুবশিবির থেকে একসময় আপনি হাফেজ্জি হুজুরের সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ এবং খেলাফত আন্দোলনে যোগ দেন। সেই প্রেক্ষাপটটা কী ছিল?
আহমদ আবদুল কাদের : ‘৮৩ সালে হাফেজ্জি হুজুর আন্দোলনে নামলেন। তখনকার সম্মিলিত প্লাটফর্ম প্রয়োজন ছিল। সে কারণে সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে ১১টি দল যুক্ত হয়ে নতুন আন্দোলন তৈরি করে। বৃহত্তর ইসলামি ঐক্যের ডাকে যুবশিবিরও সেখানে ছিল।
লিখনী : ১১ দলে জোটভুক্ত হলেন, কিন্তু যুবশিবির বিলুপ্ত হলো কখন?
আহমদ আবদুল কাদের : ৮৫ সালের শেষদিকে কয়েকটি বিষয় নিয়ে খেলাফত আন্দোলনে সমস্যা দেখা দেয়। দুইভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ে দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতা। তখন পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে যায়। আমরা আরেকটা জোটের উদ্যোগ নেই। শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এটা মূলত মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেব উদ্যোগ নেন। সেটা ছিল ১৯৮৭ সাল। কমলাপুরে এক ওয়াজ মাহফিল থেকে ১৩ মার্চ ইসলামি শাসনতন্ত্রের দাবিতে শাপলা চত্বরে এক মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দেন। এ বিষয়ে আলোচনা করার জন্য মরহুম মাওলানা আবদুর রহীম সাহেবের বাসায় একটা মিটিং ডাকা হলো। মাওলানা আবদুর রহীম সাহেব সাঈদী সাহেবের সঙ্গে জামায়াতের সম্পৃক্ততার বিষয়টি উত্থাপন করলেন। তখন তিনি জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্বীকার করেননি। পরবর্তী সময়ে ফার্মগেটে অবস্থিত বায়তুশ শরফ মসজিদে বৃহত্তর পরিসরে আরও একটি সভা ডাকা হলো। সেখানে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ছাড়াও অন্যান্য যারা বিশেষভাবে উপস্থিত হন চরমোনাইর পীর হজরত মাওলানা ফজলুল করিম, চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা মসজিদের খতিব, শায়খুল হাসিদ আল্লামা আজিজুল হক, ঐক্য আন্দোলনের চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুর রহীম, বায়তুশ শরফের পীর মাওলানা আবদুল জব্বার, নোয়াপাড়ার পীর, ঐক্য আন্দোলনের সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার মাওলানা কোরবানী আলী প্রমুখ। আমিও সেই সভায় উপস্থিত ছিলাম। নেতারা সাঈদী সাহেবের সঙ্গে জামায়াত সম্পৃক্ততার বিষয়টি তুললে সাঈদী সাহেব অত্যন্ত আবেগী ভাষায় কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে জামায়াতের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করে আসবেন বলে ওয়াদা করেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হলো যে ১৩ মার্চের প্রোগ্রামের পূর্বে নেতৃস্থানীয় আলেমদের নিয়ে একটা চূড়ান্ত মিটিং করা হবে এবং কর্মসূচি নির্ধারণ করা হবে ।
হঠাৎ করে সাঈদী সাহেবের পক্ষ থেকে সমস্যা তৈরি হলো। তিনি যে বাড়িতে থাকতেন সেটা ইসলামী ব্যাংকের লোনের টাকায় করা। সেদিক থেকে তাকে ঝামেলায় যুক্ত করার হুমকির কারণে সাঈদী সাহেব পিছুটান দেন। মিটিংয়ের আগে আমি এ ব্যাপারে তার সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি বলেন, আমার মা অসুস্থ, আমাকে ওমরায় যেতে হবে। আপনারা প্রোগ্রাম করেন। আমি বললাম, আপনি উদ্যোগ নিলেন, আপনিই না থাকলে কেমন হয়? তিনি তার মতে অটল রইলেন।
এমন অবস্থায় আমরা চিন্তা করলাম মিটিং যেহেতু ডাকা হয়েছে তা হবেই। বৈঠকের দিন সাঈদী সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করার বহু চেষ্টা করা হলো। কিন্তু তাকে কোথাও পাওয়া গেলো না। শেষ পর্যন্ত তাকে ছাড়াই বৈঠক শুরু করা হলো। আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হলো যে মাওলানা সাঈদী সাহেব ছাড়াই আন্দোলন ও ঘোষিত প্রোগ্রাম হবে। চরমোনাইর পীর মাওলানা ফজলুল করিম সাহেবকে আন্দোলনের আহ্বায়ক করা হয়। সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র আন্দোলন শুরুর ঘোষণা ও ১৩ তারিখের সমাবেশের কথা ঘোষণা করা হয়। বেশ কিছু দিন যাবৎ শাসনতন্ত্র আন্দোলন জোরদারভাবে চললেও শেষ পর্যন্ত আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে । তখন আমরা যুবশিবিরের লোকেরা অনুভব করতে থাকি, একটা সুশৃঙ্খল জাতীয় সংগঠন গড়ে তোলা প্রয়োজন।
শেষ পর্যন্ত যুবশিবির আর খেলাফত আন্দোলন একটি নতুন দল করার সিদ্ধান্তে আসে। এভাবে ৮৯ সালের ৮ ডিসেম্বর খেলাফত মজলিস গঠিত হয়।
লিখনী : মাওলানা সাঈদী তখন কী করতেন?
আহমদ আবদুল কাদের : ওয়াজ মাহফিল করে বেড়াতেন। এর বেশি কিছু করতে দেখিনি।
লিখনী : আপনার এই যে দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ার, দল উপদলে যুক্ত হওয়া ও ভাঙন এবং আজ এতোদূর আসা। এই পর্যায়ে এসে কি মনে করছেন ইসলামি আন্দোলন নিয়ে যে স্বপ্ন আপনি দেখেছিলেন সেটা পূরণ হয়েছে বা কতোটুকু পূরণ করতে পেরেছেন?
আহমদ আবদুল কাদের : একটা স্বপ্ন ছিল, ইসলামের কাজ করতে হলে আলেমদের সঙ্গে আধুনিকদের সম্পৃক্ত করতে হবে। একমুখি হয়ে আন্দোলনে সফলতা আনা যাবে না। সাধারণ শ্রেণী ও আলেমদের সমন্বয় করতে হবে এবং আলেমদের রাজনীতির মাঠে নামাতে হবে। এই চেষ্টা করছি এবং করে যাচ্ছি। তবে সফলতা পুরো না আসলেও একটা যে জাগরণ সেটা কিন্তু হয়েছে।
লিখনী : আপনি জামায়াতের বিরোধিতা করে নতুন দল করেছেন। আবার বর্তমানে ১৮ দলীয় জোটে আছেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে জামায়াত আর মজলিসকে যদি আলাদা করতে বলা হয়, তাহলে আপনি কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দুটোকে আলাদা করবেন?
আহমদ আবদুল কাদের : আপনি ঐক্যজোটকে কিভাবে পার্থক্য করবেন? জমিয়তকে কিভাবে পার্থক্য করবেন? জাতীয় পার্টিকে কিভাবে পার্থক্য করবেন?
লিখনী : আমরা সামগ্রিক জোটের কথা বলছি না। জামায়াত এবং মজলিসের পার্থক্য করার কথা বলছি।
আহমদ আবদুল কাদের : আমাদের কথা হলো, মজলিস একটা দল জামায়াত একটা দল। দুই দলের পৃথক ম্যানুফেস্টো ও কর্মসূচি রয়েছে। আমরা রাজনৈতিক প্রয়োজন ও কারণে একত্রিত হয়েছি এবং আমাদের দুই দলের পলিসি ও কার্যক্রমও আলাদা।
লিখনী : কিন্তু আপনারা তো গণতান্ত্রিক দাবি আদায়ে একত্রিত হয়েছেন। এর ফলটাতো একই হয়ে যায়...।
আহমদ আবদুল কাদের : আমরা চারদলীয় জোটে ঐক্যবদ্ধ হয়েছি আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে। বিএনপিও যে ইসলামি ভাবাপন্ন এমনটা নয়। তবে মন্দের ভালো। একদল ইসলাম নিষিদ্ধ করতে চায় আরেকদল সুযোগ দেয়। এ জন্য বিএনপির সঙ্গে আমরা আছি। আওয়ামী লীগ না থাকলে জোট করতাম না।
লিখনী : তার মানে একটা সুফল চাচ্ছেন বিএনপির কাছ থেকে। সেটা কি পাচ্ছেন?
আহমদ আবদুল কাদের : আমরা চাচ্ছি এই গভর্নমেন্ট পরিবর্তন হোক।
লিখনী : পরিবর্তন হয়ে তো বিএনপি এলো, সুফলটা কিভাবে পেলেন?
আহমদ আবদুল কাদের : বিএনপির শাসন আর আওয়ামী শাসন যদি কেউ না বুঝে তাকে নিয়ে তো আর আলোচনা করতে পারবো না, অন্যভাবে বুঝাতে হবে। আসলে আমরা চেয়েছি, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে আমাদের ডিস্টার্ব কম করবে। আমরা ভালোভাবে কাজ করতে পারব। এই সুবিধাটুকু তো হয়েছে।
লিখনী : গত চারদলীয় সরকারের আমলে তো দেখেছি কেবল হুজুরদের দৌড়ানোটাই বাকি ছিল, আর কিছুই তো হয়নি। জনমনে ক্ষোভ আছেÑ কওমি সনদের স্বীকৃতি হয়নি, একটা স্বতন্ত্র ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় হয়নি, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে নতুন কোনো কাজ করা হয়নি। বরং বিএনপির সময়ই ইসলামপন্থিদের জঙ্গি হিসেবে সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত হতে হয়েছে। তারপরও বিএনপি ভালো কেন?
আহমদ আবদুল কাদের : অনেকগুলো করেনি, তবে কিছু কিছু করার চেষ্টা করেছে। কওমি মাদরাসার স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিলো।
লিখনী : হ্যাঁ শেষ পর্যন্ত দেয়নি। স্বীকৃতি নামের একটা লোক দেখানো প্রজ্ঞাপন জারি করেছিলো শুধু।
আহমদ আবদুল কাদের : আসলে এগুলোতো তারা করতে চায়নি, আমরা বাধ্য করেছি। যার ফলে শেষের দিকে এসে উদ্যোগ নেয়। আবার অনেক আলেম স্বীকৃতির বিপক্ষে ছিলেন। বাকি অন্য কাজগুলো তারা করেনি, এটা স্বীকার করি আমরা।
লিখনী : এই বিষয়গুলো জানার পরও বিএনপির সঙ্গে থাকার যৌক্তিকতা কী?
আহমদ আবদুল কাদের : না, আমরা বিএনপির সঙ্গে না থাকলে তো আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করা যাবে না।
লিখনী : তাহলে তো ইসলামি দলগুলো সেই দাবার গুটি হয়ে গেলো। এভাবে কেবল কোণঠাসার জন্য ইসলামি দল ব্যবহার হলে ইসলামি ঐক্য বা ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা কীভাবে সম্ভব হবে?
আহমদ আবদুল কাদের : হ্যাঁ, এই প্রশ্ন অনেকেই করেন। আসলে দেশের জনগণের সেন্টিমেন্ট কী? তারা আওয়ামী লীগ আর বিএনপি ছাড়া অন্য কাউকে রাজনৈতিক শক্তি মনে করে না। তবে তৃতীয় একটা শক্তির প্রয়োজন এখন আছে। সেটা কেবল সকল ইসলামি দল একত্রিত হলে সম্ভব।
লিখনী : সকল ইসলামি দল একত্রিত করা কখনোই সম্ভব না। যদি এমন হয়, একটা দল আদর্শিক সংগ্রাম এবং জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং সাধারণ জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, তখন বাকি দলগুলো সেখানে আসতে বাধ্য হবে।
আহমদ আবদুল কাদের : এটা হতে পারে, তবে এই মুহূর্তে এটা সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে কেউ যদি সেটা করে তবে বড় দুই শক্তির কোনোটার পক্ষে করা হবে।
লিখনী : সম্প্রতি আমরা যদি পাকিস্তানের দিকে দেখি, ইমরান খানের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার খুব বেশিদিনের নয়। সেখানে তিনি কিন্তু তৃতীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন এবং একটি প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে প্রাদেশিক সরকারও গঠন করেছেন।
আহমদ আবদুল কাদের : বাংলাদেশে যেভাবে পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতি চালু আছে পাকিস্তানে কিন্তু সেটা নেই। একমাত্র ভুট্টো পরিবারকে এ তালিকায় রাখা যায়। আমাদের রাজনীতি দুই পরিবারে আবদ্ধ হয়ে গেছে। এখানে অনেকেই তৃতীয় শক্তির ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন। এরশাদ চেষ্টা করেছেন, পারেননি। বামদল চেষ্টা করছে, তাদের তো জনসমর্থনই নেই। ইসলামি দল চেষ্টা করছে, তবে এটা এই মুহূর্তে সম্ভব না।
লিখনী : সম্ভব না, নাকি এর জন্য আসলে চেষ্টা করা হচ্ছে না?
আহমদ আবদুল কাদের : চেষ্টা করা হচ্ছে না সেটা বলবো না, হচ্ছে। তবে নির্বাচন সামনে রেখে সেটা উচিত হবে না।
লিখনী : এই মুহূর্তে যদি আপনাকে একটা তৃতীয় শক্তির কাঠামো এবং বাস্তবায়নের রূপরেখা কল্পনা করতে বলা হয়, আপনি কীভাবে সেটা তৈরি করবেন?
আহমদ আবদুল কাদের : এই মুহূর্তে তৃতীয় শক্তির কথা যদি বলি, সেটাকে অনেক জনমুখী আর দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে। যোগ্য ও শক্তিশালী নেতৃত্ব হতে হবে। আমরা যদি তুরস্কে দেখি, সেখানে একে পার্টি যেভাবে গড়ে উঠলো সেভাবে একটা শক্তি উঠতে পারে। তবে বাংলাদেশে আগামী দশ বছরে সেটা সম্ভব বলে মনে হয় না।
লিখনী : কিন্তু আমরা তো দেখি হেফাজতের ডাকে যেভাবে মানুষ সাড়া দিয়েছে, সেটা দেখে অনেক বামপন্থীও বলতে বাধ্য হয়েছেন- এদের মাধ্যমে তৃতীয় ধারা সৃষ্টি করা সম্ভব।
আহমদ আবদুল কাদের : হেফাজতে ইসলাম যে দাবিতে গড়ে উঠেছে সেটা নাস্তিকবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে। সেখানে আমরা বলেছিলাম আরও গণমুখি করতে। যেমন দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটা দফা, শ্রমিকদের বিষয়ে একটা দফা ইত্যাদি সংযোজন করতে। তারা এসবে একমত হননি। তবে এটাকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া দিতে পারলে বড় শক্তি সম্ভব ছিল এবং সেজন্য জাতীয় ইস্যুগুলো যদি সংযুক্ত করা হতো তাহলে এর সুফল তৃতীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত করা যেতো।
লিখনী : হেফাজতে ইসলামের ভবিষ্যৎ কী দেখছেন?
আহমদ আবদুল কাদের : ভবিষ্যৎ তো আছেই, যদিও সাময়িক হোঁচট খেয়েছে, সেটা বিষয় নয়। হেফাজত যে ত্যাগ ও কুরবানি করেছে এটার রেজাল্ট অবশ্যই আসবে। যদিও একটু সময় লাগতে পারে।
লিখনী : হেফাজত যেভাবে সম্ভাবনা নিয়ে মাঠে এসেছিল, মাঝখানে হোঁচট খাওয়ার কারণ কী?
আহমদ আবদুল কাদের : কারণ অতি উৎসাহ। এমনটা আগেও হয়েছে। ’৮৪-এ যখন হাফেজ্জি হুজুর ইসলামি গণজাগরণ তৈরি করেন তখন লালবাগে বৈঠক বসলো- কী ঘোষণা দেয়া যায়। সেখানে কিছু নেতা কেবিনেট গঠন করার কথা বললেন। এগুলো হলো আমাদের ধর্মীয় অঙ্গনে বাড়তি উৎসাহ। এমনি ভাবে হাটহাজারী মাদরাসায় উলামা সম্মেলনে আল্লামা আহমদ শফী সাহেবকে আমিরুল মুমিনিন ঘোষণা দেয়ার প্রস্তাবও করা হয়েছিল। এসব বাড়তি উৎসাহ ছেড়ে ঠা-া মাথায় চিন্তা ও দীর্ঘমেয়াদি প্ল্যান নিতে হবে।
লিখনী : হেফাজতের আমির আল্লামা শফী সাহেব মুক্ত আছেন এবং তিনি পুলিশের হয়রানির মধ্যেও নেই। অথচ দলের কিছু নেতা আত্মগোপনে। হেফাজত যদি কোনো অপরাধ করে থাকে তাহলে তো প্রধানকেই দোষী করার কথা, অন্য নেতারা আত্মগোপনে কেনো?
আহমদ আবদুল কাদের : এখানে সরকার চাচ্ছে না শফী সাহেবকে হয়রানি করতে। আর পুলিশ প্রধানত খুঁজছে মাওলানা রুহি, মুফতি ফয়জুল্লাহ, মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব ও আল্লামা নূর হোসেন কাসেমী প্রমুখ আলেমদের। মূলত শাপলা চত্বরে অবস্থানের জন্য এদের দায়ী করা হচ্ছে। ঢাকার সমাবেশের আয়োজন হয়তো এরা করেছিলো।
লিখনী : হেফাজতের বিরুদ্ধে সহিংসতার অভিযোগকে কি সত্যি মনে করেন?
আহমদ আবদুল কাদের : গভর্নমেন্ট এই নিয়ে যা করেছে সেটা পরিকল্পিত। এই যে সহিংসতা ঘটেছে এগুলো তো আওয়ামী লীগের পরিকল্পিত। মিডিয়াতে আওয়ামী ক্যাডারদের অ্যাকশনের ছবি এসেছে। ভিডিওতে দেখা গেছে গাড়ি ও বই যারা পোড়াচ্ছে সেগুলো হেফাজতের চেহারার না, এগুলো তো প্রকাশ্য। আর সরকার ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। হেফাজতের পাশে দাঁড়াবার জন্য বিএনপি আহ্বানও জানিয়েছিল। তাই তারা যেকোন মূল্যে লোকদেরকে সরাবার জন্য রাতে ক্র্যাক ডাউন করেছিল। এই ক্র্যাক ডাউনের যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্যই ভাঙচুর, আগুন দেয়া ইত্যাদি সরকারের উদ্যোগেই যুবলীগ ছাত্রলীগের মাধ্যমে করানো হয়েছিল।
লিখনী : বিএনপি সহযোগিতার কথা বলেছিল, কিন্তু তারা চত্বরে আসেনি। এই হঠকাররিতার জন্য কি বিএনপির সঙ্গ ছাড়া ইসলামি দলগুলোর উচিত নয়?
আহমদ আবদুল কাদের : এই ইস্যু এখানে আনার দরকার নেই। আগেও যেটা আমি বলেছি, আওয়ামী লীগের পতন হলে কে আসবে ক্ষমতায়Ñ বিএনপি। বিএনপির পতন হলে আওয়ামী লীগ। আর এদেশে যদি নির্বাচনের হিসেবটা অন্যান্য অনেক দেশের মতো এমন হতো, যে দল সারাদেশে যতো পার্সেন্ট ভোট পাবে সে অনুযায়ী সংসদে আসন পাবে। তাহলে আলাদা নির্বাচনের ফায়দা ছিল।
লিখনী : দেশের এই অবস্থায় কি সেনাশাসন বা বিকল্প কোনো শক্তির শাসনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন?
আহমদ আবদুল কাদের : না, সেনাশাসন কখনোই ভালো হয় না এবং শেষতক এটা স্বৈরশাসনে পরিণত হয়।
লিখনী : আমরা গণতন্ত্র দিয়ে অর্থনৈতিক এবং সামগ্রিক উন্নতির জন্য ৪২ বছর ধরে গণতন্ত্র পরখ করছি। বিকল্প কোনো শাসনব্যবস্থা দিয়ে কি উত্তরণ সম্ভব হতে পারে?
আহমদ আবদুল কাদের : এ মুহূর্তে এটার সমাধান হতে পারে গণতন্ত্রের সঠিক চর্চার মাধ্যমে। আমরা গণতন্ত্রের সঠিক চর্চাটা করছি না। যে কারণে এমনটা হচ্ছে।
লিখনী : বিরোধীদল হিসেবে বর্তমান পরিস্থিতির মোকাবিলায় যে ধরনের বেগবান আন্দোলন করা দরকার সেটা আপনারা করতে পারছেন না। কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
আহমদ আবদুল কাদের : আমরা আন্দোলন করছি প্রায় সব ইস্যুতেই। সেটা বেগবান কি না আপনারা বিবেচনা করবেন। ১৮ দলের মাধ্যমেও আমরা ১৪ দলের কর্মকা-ের প্রতিবাদ করে যাচ্ছি।
লিখনী : ইসলামি দল হিসেবে ইসলামি যে ইস্যুগুলো আছে যেমন অর্থনীতি, জাকাতব্যবস্থা, গ্রামীণ উন্নয়ন- এসব বিষয়ে আন্দোলন দেখা যাচ্ছে না।
আহমদ আবদুল কাদের : সেটা আমরা সাধ্যমতো করছি। আর ইসলামি অর্থনীতি ও সরকারিভাবে জাকাত ব্যবস্থা চালুর মতো বিষয়গুলো তো ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এগুলো করতে হবে সরকার গঠনের পর। অন্যথায় সম্ভব না।
লিখনী : হেফাজতে ইসলামের ডাকে যেভাবে জনমত নির্বিশেষে মানুষ সাড়া দিল ইসলামি কোনো দলের ডাকে মানুষ এতোটা সাড়া দেয় না। এর কারণ কী?
আহমদ আবদুল কাদের : এটার ইস্যুটা ভিন্ন। এটা ঈমানি ইস্যু। এখানে অনেক আওয়ামী লীগারও সমর্থন করেছে। কিন্তু ইসলামি রাষ্ট্র বিষয়টা আলাদা।
লিখনী : তার মানে আপনারা মানুষকে এটা বুঝাতে পারেননি, ইসলাম ও পূর্ণাঙ্গ ইসলামি রাষ্ট্রটাও ঈমানি বিষয়?
আহমদ আবদুল কাদের : হ্যাঁ, এটা সত্য। আমরা এখন পর্যন্ত জাতিকে এবং অনেক আলেম-উলামাকেও বুঝাতে ব্যর্থ হয়েছি যে, ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা জরুরি, খেলাফত ব্যবস্থা অপরিহার্য। এটা ঈমানেরই দাবি।
লিখনী : আগামী নির্বাচন আপনাদের দল কতোটুকু প্রস্তুত?
আহমদ আবদুল কাদের : নির্বাচন আসুক, তারপর বলা যাবে।
লিখনী : সরকার তো বলেছে তত্ত্বাবধায়কে ফেরা সম্ভব না। ১৮ দল এটা ছাড়া নির্বাচনে যাবে না, শেষপর্যন্ত এর রেজাল্ট কী হবে?
আহমদ আবদুল কাদের : আমরা না’র মধ্যেই আছি এখনও, এটার মধ্যেই থাকবো। অনেকে ধারণা করছে, উভয়পক্ষ একটা সমঝোতার মধ্যে আসতে পারে। এটা কতোটুকু হবে জানি না। তবে হতেও পারে।
লিখনী : বিএনপির বর্তমান অবস্থান বিশ্লেষণ করে অনেকেই একে দেউলিয়া বলছেন?
আহমদ আবদুল কাদের : রাজনৈতিকভাবে সব দলেরই কিছু দুর্বলতা থাকে। তবে জনমত বিএনপির ও ১৮ দলের পক্ষে আছে। আর যেভাবে গভর্নমেন্ট তাদের নির্যাতন করছে, একেকজনের ওপর একশোটার উপরে মামলা। জামিন হওয়ার পর জেলগেট থেকে আবার গ্রেফতার। এগুলোর কারণে একটু তো দুর্বল হতেই পারে। তবে এসব করে বিরোধীদলকে দমানো গেছে এমন উদাহরণ ইতিহাসে নেই। বরং ক্ষমতাসীনরাই পরে আরও সমস্যায় পড়ে ও শেষ পর্যন্ত পালাতে বাধ্য হয়।
লিখনী : সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আহমদ আবদুল কাদের : আপনাদেরও ধন্যবাদ। (সুত্র, সাপ্তাহিক লিখনী, ২৮/০৫/২০১৩)
0 comments: