শিশুদের জন্য ইসলাম


লাকসাম থেকে টেম্পুতে চড়েছি নাথের পেটুয়া যাবো। ভাড়া নিচ্ছে ছোট্ট একটি ছেলে। বয়স আর কত হবে, ১০/১১ বছর। দেখতে বেশ সুন্দর। পরনে ময়লা পেন্ট, হাঁটু পর্যন্ত গুটানো। গায়ে একটা ছেঁড়া লাল গেঞ্জি। হাসি হাসি মুখ। জিজ্ঞেস করলাম-

: তোর নাম কিরে?
: একগাল হাসি দিয়ে বললো, কালাম। মায় কালা কই বোলায়।
: লেখাপড়া জানিস?
: স্কুলে যাই'ন। তবে বগু মাস্টরের কাছে আদর্শলিপি পাঠ দিছিলাম।
: পড়লি না কেন?
: আরে সাব, আন্নে যে কিয়া কন, মায় অঁঙ্গোরে হড়াইবো না ভাত খাওয়াইবো!

কথা বাড়ালাম না। আশপাশের লোকেরা বিরক্ত হচ্ছে। একসময় নাথের পেটুয়া এসে নেমে গেলাম। রাতে বাড়িতে কাটালাম। পরদিন আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলাম। আজও টেম্পুর যাত্রী। লাকসাম গিয়ে মেইল ট্রেনে ঢাকায় যাবো। নাথের পেটুয়া বাসস্ট্যান্ডে এসে টেম্পুতে চড়লাম। ভাগ্যচক্রে আজও কালার টেম্পুতে চড়ে বসেছি। বসতেই দেখি কালা ভাড়ার জন্য হাত বাড়িয়েছে।
: তোর নাম কালাম না?
: আন্নে আবার  আঁর নাম জানলেন কেন্নে?
: গতকাল এই গাড়িতেই তো এলাম। তোর সাথে কথা হলো না!
: না আঁর মনে নাই। কত মাইনসের লগে কতা কই, কজনের কতা মনে রাইউম।
: তোর মনে না থাকলেও আমার মনে আছে। যাক, আজ কয় টাকা পেলি?
: অনো হাই'ন। হাইঞ্জে ২৫ টেয়া হাইওম।
: এতে তুই খুশি?
: আরে সাব, আন্নে দেই আজব মানুষয়ে না। যা হাই ইয়ানইতো লাভ। এই টেঁয়াইবা হাইওম কনাই।

মনে মনে ভাবলাম, কালাম ঠিকই বলেছে। এদের মতো শিশুদের ২৫ টাকাই বা দিবে কে। বড়রাই যেখানে কাজ পায় না, বেকার ঘুরে বেড়ায়। তবুও কালাম ২৫ টাকাতো রোজগার করছে। এই ২৫ টাকা নিয়েও তো তার কত স্বপ্ন। সন্ধ্যার পর বাড়ি গিয়ে মায়ের হাতে তুলে দিবে ২৫ টাকা।

তবুও মনে প্রশ্ন একটা থেকে যায় তা হলো- এসব শিশু শ্রমিক কালামদের বঞ্চিত করা হচ্ছে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে। অথচ পবিত্র কালামে পাকে মহান আল্লাহপাক দেড় হাজার বছর আগেই বলেছেন, শিশুদের অধিকারের কথা। নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন তাদের মৌলিক অধিকারগুলো পূরণ করার। ইসলাম শিশুর জন্ম থেকে শুধু নয়, জন্মের পূর্বেই তার অধিকার নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। শিশুদের পালন ও পরিচর্যার হুকুমও দিয়েছেন। বলেছেন, শিশুদের ভালোবাসা আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় বিশেষ।

আমাদের প্রিয় নবী (সা:) বলেছেন, ‘দুগ্ধপায়ী শিশু, রুকুকারী বৃদ্ধ এবং বিচরণশীল পশু না থাকলে তোমাদের উপর মুষলধারে আযাবের ফেরেশতা নেমে আসতো।' শিশুদের লালন-পালন ও উপযুক্তভাবে গড়ে তোলার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। পবিত্র কালামে পাকে বলা হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করো না।' (আল আনআম : ১৪১)। এই কথায় শিশুর নিরাপত্তার কথাও নিশ্চিত হয়ে যায়।

শিশুরা হচ্ছে মাতা-পিতার নিকট রক্ষিত আমানত। আর এ আমানত সম্পর্কে আখেরাতে তাদের জিজ্ঞাসা করা হবে। যদি মাতা-পিতা অজ্ঞতা ও অক্ষমতার কারণে শিশুদের দেখাশোনায় মনোযোগী না হয়, তবে অবশ্যই তাদের জবাবদিহি করতে হবে। শিশুরা শৈশবে তাদের প্রকৃত বিপদ কোনটি তা উপলব্ধি করতে পারে না। এ জন্যই পিতা-মাতার দায়িত্ব হচ্ছে তাদের সন্তানদের রোগের আক্রমণ থেকে বাঁচানোর প্রয়াস নেয়া। শিশুদের চিকিৎসার ব্যাপারে এবং শিশুদের মারাত্মক রোগের হাত থেকে বাঁচার ব্যাপারে অন্যমনস্কতা প্রদর্শন থেকে ইসলাম সতর্ক করে দেয়।

একটি শিশু তার দেশ ও সমাজের জন্য একজন যোগ্য ও কল্যাণময় সদস্য রূপে যেন আত্মপ্রকাশ করতে পারে সেই উদ্দেশ্যে ইসলাম প্রতিটি শিশুর লালন পালনের রীতি-নীতিও নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।

আমাদের মহানবী (সা:) বলেছেন, ‘তোমরা শিশুদেরকে ভালোবাসো এবং তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন কর। তাদের সাথে কোন ওয়াদা করলে তা পূর্ণ কর, কেননা তারা তোমাদেরকে তাদের রিযিক সরবরাহকারী বলে জানে।' শৈশবেই শিশুকে আদব ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া অপরিহার্য করে দিয়েছে ইসলাম। যাতে শিশু প্রশংসনীয় কর্ম ও সুন্দর চরিত্রে সজ্জিত হয়ে বড় হতে পারে। ফলে শিশুরা হলো আমাদের জীবনের সবচাইতে প্রিয় বস্তু। তাদের লালন-পালনের মাধ্যমে পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব।

সুসন্তান একজন পিতার জীবনের বর্ধিত রূপ এবং সমাজের একটি ফসল। জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় এসব আইন কি আমরা পালন করছি? বিদ্যমান আইনগুলো কি বাস্তবায়িত হচ্ছে? শিশু অধিকার যাতে সত্যিকারভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় তা নিশ্চিত করার জন্য নতুন কোন আইন প্রণীত হচ্ছে কী? পাঠকবৃন্দ আপনারা আমার সাথে কন্ঠ মিলিয়ে বলবেন, না, হচ্ছে না।

‘শিশুদের জন্য হ্যাঁ বলুন' এই মুখরোচক স্লোগান নিয়ে জাতিসংঘ সম্প্রতি সারাবিশ্বে শিশুদের জন্য যে বিশ্ব আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন এর প্রাক্কালে এই প্রশ্ন আজ আমাদের ছোট-বড় সবার।

এখনো ধনী ঘরের অনেক শিশু পিতা-মাতার আদর-যত্ন থেকে বঞ্চিত। অনেক শিক্ষিত পরিবারেই দেখা যায় পিতা-মাতা অর্থ উপার্জনের জন্য দিনব্যাপী অফিস-আদালতে পড়ে থাকে। এ ব্যস্ততার মাঝে তাদের ছেলেমেয়েদের খোঁজখবর নেয়ার মোটেও সুযোগ থাকে না। যার কারণে ওসব ধনীর দুলালরা হয়ে যায় বাউন্ডেলে। অপরদিকে গরিব পরিবারের শিশুরা দু' মুঠো অন্নের জন্য গতর খেটে অকালে ঝরে পড়ছে। বঞ্চিত হচ্ছে ন্যায্য অধিকার থেকে। অথচ মে দিবস বা আন্তর্জাতিক শিশু দিবস এলে সরকারি-বেসরকারি সকল পর্যায়ে কত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কত নেতা, পাতি নেতা ইনিয়ে-বিনিয়ে কতই না বক্তৃতার মালা ছড়ায়। অথচ তাদের ঘরেই ছোট্ট শিশুটি অনাদরে বড় হচ্ছে। অনেকে শিকার হচ্ছে নির্যাতনের। এজন্য শিশুদের অব্যক্ত সাধগুলো বাস্তবায়নের জন্য পিতা-মাতা থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে পর্যন্ত সবার প্রচেষ্টা তথা সামাজিক আন্দোলন অব্যাহত যে রাখতে হবে, এতে বিন্দুমাত্র সংশয়ের লেশ মাত্র নেই। এজন্য প্রয়োজন ইসলামের পারিবারিক, সামাজিক তথা সব ধরনের নির্দেশের প্রতি সবাইকে অনুগত হওয়া। তা হলেই বাস্তবায়িত হবে শিশু অধিকার।

শরীফ আবদুল গোফরান (লেখক)

জনৈক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার এই ছেলের অধিকার কি কি? রাসূল (সা.) বললেন, তুমি তার সুন্দর একটি নাম রাখবে, তাকে ভদ্রতা শিক্ষা দিবে এবং তাকে উত্তম স্থানে লালন-পালনের জন্য হস্তান্তর করবে। (তৎকালীন সময়ে শিশুকে উন্নত ভাষা শিক্ষা দানের লক্ষ্যে শৈশবকালে উত্তম শিষ্টাচার সমৃদ্ধ গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হতো)।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম