আমরা একই শাখায় কাজ করেছি । কিছু তথ্য জেনে রাখুন । "কোন ধরনের ব্যক্তিকে আল্লাহ শহীদ হিসেবে পছন্দ করেন" দেখুন!!
(১)
তিনি তামীরুল মিল্লাতে ফাযিল ও ইবিতে অনার্সে পড়তেন । বাড়ি পাবনা । কাজ করতেন ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের শ্যামপুর থানায় । ৮৮ নং ওয়ার্ডের সভাপতি ছিলেন । আমি তার পাশের থানায় (মিল্লাত আবাসিক) কাজ করতাম । তাঁর থানা সভাপতি আমার সাবেক থানা সভাপতি মুহাম্মাদ গিয়াস উদ্দীন ভাই । উনি শহীদ হওয়ার সময় আমি ও তাঁর সভাপতি গিয়াস ভাই দুজনেই কারাগারে । একই রুমে । গিয়াস ভাই অত্যন্ত মুষড়ে পড়েন শাহাদাতের খবরটা শুনে ।
তিনি জেলখানায় আসার কিছুদিন আগে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন খলিল ভাইকে থানার প্রকাশনা সম্পাদকের দায়িত্ব দেবেন । সভাপতির কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে গত রমযানে ইতিকাফ করেন শেষের দিনগুলোতে । পুরো থানায় খলিল ভাইয়ের ওয়ার্ডে (৮৮) সবচেয়ে বেশী কাজ হতো ।
(২)
একবার মহানগরী থেকে "দাওয়াতী দশক" ঘোষনা করা হয় । তিনি একাই ৫২০ জন সমর্থক বৃদ্ধি করেন!!!
(Source : His previous president Rahmatullah vai)
(৩)
বর্তমান ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের বায়তুল মাল সম্পাদক হাবিবুল্লাহ বাহার ভাইও তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ । তাঁকে জেলখানায় খলিল ভাইয়ের ব্যপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম । তিনি বলেছিলেনঃ পুরো মহানগরীতে যদি তাকওয়া, মেধা, সংগঠনের এক্টিভ দশজন সদস্য বাছাই করা হয় তার মধ্যে একজন হবেন শহীদ খলিল ভাই । আসলে তিনি ছিলেন তাকওয়ার মূর্ত প্রতীক । খোদাভীতিই তাঁকে সকল ভীতি থেকে দুরে রাখত ।
আসলে আল্লাহর প্রিয় বান্দারাই শাহাদাতের অমীয় সুধা পানের সুযোগ পান । তাঁকে আল্লাহ জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন । আমীন!
{ বিশেষ জ্ঞাতব্যঃ তাঁকে গুলি করে শহীদ করে যাত্রাবাড়ি থানার ওসি (তদন্ত) অবনী শংকর কর }
হে আল্লাহ! আমরা তাঁর সাথী । তাঁর অসমাপ্ত কাজ আমাদের দ্বারা সম্পন্ন করে দিও ।
কুরআনের আন্দোলনে নিবেদিত প্রাণ শহীদ খলিলুর রহমান
২০০৯ সালে আমি শ্যামপুর থানা সভাপতি থাকাকালীন শহীদ খলিলুর রহমান ভাইকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল মুরাদপুর মাদ্রাসা ওয়ার্ডের। অল্প দিনের মধ্যেই তিনি হয়ে উঠলেন মাদ্রাসার সকল ছাত্রের প্রিয়ভাজন ব্যক্তি। কিছুদিনের মধ্যে অন্য সকল ওয়ার্ডের চাইতে সর্বোচ্চ সংখ্যক সমর্থক, কর্মী ও সাথী বৃদ্ধি করে মাদ্রাসায় সংগঠনের কাজের মজবুত অবস্থান তৈরি করলেন। তিনি যখন মাদ্রাসায় যেতেন তখন ছোট বড় সবাই তার সাথে দেখা করার জন্য ভীড় জমাতেন। মনে হতো তিনি যেন সকলের আপনের চাইতেও আপন।
একবার মহানগরী থেকে দাওয়াতী দশক ঘোষণা করা হলো। খলিলুর রহমান ভাই একাই ৫২০ জন সমর্থক বৃদ্ধি করলেন। প্রতিদিন যখন তার বেশি বেশি সমর্থক বৃদ্ধির খবর আমার কাছে আসতে লাগলো তখন ভাবলাম একজন ব্যক্তির দ্বারা এতো অল্প সময়ে এতো জনসমর্থক বৃদ্ধি করা কিভাবে সম্ভব! তখন সিদ্ধান্ত নিলাম একদিন তার সাথে দাওয়াতী কাজে বের হব।
আমাকে নিয়ে তিনি দাওয়াতী কাজের জন্য একটি খেলার মাঠে রওয়ানা দিলেন। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, মাঠে যাওয়ার পথে যতজন ছাত্রের সাথে দেখা হলো সবাইকে সালামের মাধ্যমে দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাদেরকে দাওয়াত দিলেন। এর পর আমরা খেলার মাঠে গেলে খলিল ভাই তার দওয়াতী কৌশলের মাধ্যমে মাঠের প্রায় সকল ছাত্রকে একত্রিত করলেন। এমনকি খেলা বন্ধ করে অনেক খেলোয়াড়ও জড়ো হয়ে গেলো। সবাই তার কথা শুনে যার পরনাই মুগ্ধ হয়ে গেল। সবারই অন্তর চক্ষু যেন খুলে গেল। সত্যকে উপলব্ধি করতে পারল সবাই। এক পর্যায়ে খলিল ভাই আমাকে কথা বলতে দিয়ে এক এক করে সবার সমর্থক ফরম পূরণ করে নিলেন।
সে দিন আমি বুঝতে পারলাম একজন দায়ী ইলাল্লাহ কিভাবে মানুষকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতে পারেন। এ ধরনের দায়ী ইলাল্লাহর দ্বারাই একার পক্ষে সম্ভব এক মাসে ৫২০ জন সমর্থক বৃদ্ধি করা।
শহীদ খলিলুর রহমান ভাই যে এলাকায় ছিলেন সেখানে তিনি সব ছাত্রে কাছে ছিলেন একান্ত পরিচিত, কাছের মানুষ। এলাকায় ছোট-বড় সবাই তাকে খুব ভালোবাসতেন। শিক্ষকদের কাছে যেমন তিনি ছিলেন প্রিয়, তেমনি সাংগঠনিক কাজেও ছিলেন সবার চেয়ে এগিয়ে। কোনো ওজর আপত্তি ছাড়াই মেনে নিয়েছেন সংগঠনের সকল সিদ্ধান্ত। তাকে যখনই সাংগঠনিক কোনো কাজে ফোন করতাম, তখন তিনি ‘জি ভাই, জি ভাই’ বলে যে জবাব দিতেন তা যেন এখনও আমার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
শহীদ খলিলুর রহমান ভাই যখন দাখিল পরীক্ষার্থী তখন সংগঠনের পক্ষ থেকে সাংগঠনিক কাজ কিছুটা কমিয়ে বেশি সময় পড়ার পরামর্শ দেয়া হলো। তাকে ভালো রেজাল্ট করতে হবে, তাই তার দিকে একটু খেয়াল রাখার প্রয়োজন অনুভব করলাম। কিন্তু আমরা যখন তার পড়ার টেবিলে গিয়ে তাকে পেতাম না তখন ফোন করে জানতাম তিনি আছেন কোনো সমর্থক, কর্মী কিংবা শুভাকাক্সক্ষীর বাসায় অথবা উপশাখার কোনো প্রোগ্রামে। আন্দোলনের কাজ ব্যতীত তার যেন আর কিছুই ভালো লাগতো না।
শাহাদাতের আগে খলিল ভাই ঢাকায় অবস্থান করতেন। ৮৮ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন তিনি। গেল রমজান মাসের শেষ দিকে আমি বরিশাল থেকে ঢাকায় কেন্দ্রের রিপোর্ট জমা দিতে গেলে খলিল ভাই দাওয়াত দিলেন ইফতারের জন্য। কিন্তু আমি সময় করে যেতে পারলাম না। দুইদিন পর আমি যখন শ্যামপুরে আমার ছোট ভাই আহসান উল্লাহর রুমে গেলাম তখন খলিল ভাইকে ফোন করলাম একসাথে ইফতার করার জন্য। তিনি আসবেন বললেন। কিন্তু তার জন্য অপেক্ষা করে ইফতার শুরু করার ২০ মিনিট পরে তিন আসলেন। দেরি হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানালেন পকেটে একটি খেজুর নিয়ে রাস্তায় ইফতার করে মিছিল শেষ করে এসেছেন।
একসাথে ইফতার ও নামাজ শেষ করে কোলাকুলি করে দোয়া চেয়ে বিদায় নিলেন। তখন আমি বুঝতে পারিনি যে এটি ছিল তার সাথে আমার শেষ দেখা।
দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে জানতে পারলাম এই রমজান মাসে তার ওয়ার্ডের সাথী, কর্মী ও সমর্থক বৃ্িদ্ধর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে এবং ঊর্ধ্বতন সংগঠনের যাকাতের ধার্য পরিশোধ করে রমজানের শেষ তিন দিন ইতিকাফ করেছিলেন প্রিয় ভাই খলিলুর রহমান। যে মহান রবের সন্তুষ্টির জন্য ইতিকাফ করেছিলেন রমজানের মাত্র কয়েকদিন পরেই চলে গেলেন সেই মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে।
পুলিশের গুলিতে শাহাদাত বরণকারী শহীদ খলিলুর রহমান ভাই ব্যারিস্টার হতে চেয়েছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল সমাজের দরিদ্র ছেলেমেয়েদের নিজ খরচে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। ঈদের পর বাড়ি ফিরে দরিদ্র মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা করার ভাবনাটাও বাস্তবায়ন হলো না এই মানবদরদীর। জাতি হারালো সম্ভাবনাময় এক দেশপ্রেমিককে।
জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলের প্রতিবাদে ৪৮ ঘণ্টা হরতালের দ্বিতীয় দিন ১৪ আগস্ট ঢাকার যাত্রাবাড়িতে মিছিল করার চেষ্টা করলে পেছন দিক থেকে পুলিশ সরাসরি তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। এতে খলিলুর রহমান গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এরপর তিনি উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। শরীরটা রাস্তা থেকে উপরে তুলেওছিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে যাত্রাবাড়ী থানার ওসি তদন্ত অবনী করের গাড়ি তুলে দেয়া হয় তার শরীরের ওপর।
এরপর আবারও ওঠার চেষ্টা করলে অবনি নিজেই গুলি করেন খলিলকে লক্ষ্য করে। রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন খলিল। মাথার এক পাশ দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে। উপস্থিত অনেকেই এ দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে যান। রক্ত গড়িয়ে এক সময় জমাট বেঁধে যায়। এরপর একটি সিএনজি অটোরিকসা ডেকে পুলিশ তার নিথর দেহটি তাতে তুলে দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলে।
শহীদ খলিলুর রহমানের বাড়ি পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার করমজা মল্লিকপাড়ায়। বাবা আবদুল বাতেন মল্লিক কৃষক, মা জামেলা খাতুন গৃহিণী। চার ভাই এক বোন তারা। বাবা দরিদ্র হওয়ায় ঢাকায় একটি মেস ভাড়া করে সেই মেস আবার ছাত্রদের কাছে ভাড়া দিয়ে যে আয় হতো তা দিয়ে নিজের ও চার ভাই-বোনের পড়ালেখার খরচ মেটাতেন।
ছাত্রশিবিরের সদস্য ছিলেন তিনি। তা’মিরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসায় ফাজিল দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন। এ ছাড়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজে প্রথম বর্ষেও অধ্যয়নরত ছিলেন তিনি। দাখিল পাস করেন তা’মিরুল মিল্লাত থেকেই। আলিম পাস করেন যাত্রাবাড়ী মুরাদপুর ইসলামিয়া মাদরাসা থেকে। ১৮ পারা কুরআন তার মুখস্থ ছিল। শহীদের বাবা বলেন, ‘আমার ছেলে কোনো দিন কাউকে কষ্ট দেয়নি। সে সব সময় মানুষের সেবা করেছে।’
শহীদ খলিলুর রহমানের ছোট ভাই আব্দুল্লাহ খোকন একই সাথে ঢাকায় থাকতেন। তিনি বলেন, ‘আমি আমার ভাইকে মাঝে মধ্যে বলতাম ভাই, আমি আগে শহীদ হবো নাকি তুমি? ভাই উত্তরে বলতেন, তোর চেয়ে আমি বেশি আমল করি তাই আমিই আগে শহীদ হবো। আমার ভাইয়ের দোয়া আল্লাহ কবুল করেছেন। আমি এ জন্য কোনো দুঃখ করি না। আমিও আমার ভাইয়ের পথে যেতে চাই।’
শহীদ খলিলুর রহমান ভাই ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের নিবেদিত প্রাণ একজন মুজাহিদ, যার মধ্যে ছিল না কোন কৃত্রিমতা। আনুগত্যের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অনুকরণীয়। আন্দোলনের সকল দাবি পূরণে তিনি ছিলেন সদা প্রস্তুত। আজ এ প্রিয় ভাইটি আমাদের মাঝে নেই, আছে শুধু তার অম্লান সে সব স্মৃতি যা উজ্জ্বল হয়ে থাকবে আমাদের প্রেরনার বাতিঘর হয়ে। যুগ যুগ ধরে কুরআনের মহান আন্দোলনের সুসজ্জিত বাগান হতে যে সকল ফুটন্ত গোলাপ চলে গেল মহান মাবুদের দরবারে, শহীদ খলিলুর রহমানও চলে গেলেন তাদেরই পথ ধরে। আল্লাহর কাছে তাই মোনাজাত করছি, ইয়া আল্লাহ, তুমি তাকে শাহাদাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করো। তাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে আসীন করো।
আর আমরাও যেন তার রেখে যাওয়া কাজকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে শাহাদাতের মাধ্যমে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারি। আমাদের এই আর্জি কবুল করো পাক পরোয়ার!
লেখক :মু. রহমাতউল্যাহ সেলিম( সেক্রেটারি, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, বরিশাল মহানগরী)
একটি অনুষ্ঠানে অতিথিদের কাছ থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন শহীদ |
0 comments: