শিবিরের অব্যর্থ অশ্রু যা যেকোন আধুনিক অস্ত্রকে হার মানায়!

যে শিবির এতদিন শুধু মারই খেল সে শিবির কিসের বলে আজ অপ্রতিরোধ্য? তাহলে ছাত্র জীবনে তাদের কাছে যে অব্যর্থ অশ্রু দেখেছি তার ব্যবহার কি তারা আজও অব্যহত রেখেছে? অনেকেই বলে থাকেন ৮০ দশকের সেই শিবির আর নেই। তাহলে গত ৫,৬,৭ই নভেম্বর তারা যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তা কোন ভরসায়? কিসের বলে? কার ইশারায়?

প্রতিটি দলেরই কিছু গোপন কৌশল আর গোপন হাতিয়ার থাকে। সর্বদাই সেগুলোকে তারা হাইড করে রাখার চেষ্টা করে। স্কুল জীবনে গ্রাম্য পরিবেশে সর্বহারা পার্টির আসল শক্তি বন্দুকের নল দেখে দেখে বড় হয়েছি। তাদের অপকর্মে ভিত সন্ত্রস্ত নাহলেও ভবিষ্যৎ গড়ার আসায় বাবার অপারগতা সত্যেও ঢাকায় চলে আসি। রাজনীতি আর প্রেমপ্রিতি নাকরার অঙ্গিকার করেছিলাম এক শুভাকাঙ্খি এবং পিতৃতুল্য শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের কাছে।



নিজের প্রতিজ্ঞায় অটল থেকে কোনদিন প্রেমে জড়াইনি কিন্তু বছর ঘুড়তে না ঘুড়তেই শিবিরের কৌশলের কাছে পরাস্ত হয়ে ধরা দিতে বাধ্য হই তাদের নেটওয়ার্কে। আজকের গ্রামীন ফোনের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক আর অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবলের থ্রীজি কানেকশানের চেয়েও তাদের নেটওয়ার্ক ছিল শক্তিশালী। বন্দুকের গুলি মিস হত কিন্তু শিবিরের টার্গেট ছিল সর্বদাই অব্যর্থ। যার বদৌলতে জাদরেল মুক্তিযোদ্ধা বা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের নিবেদিত সৈনিকের ওৗরশজাত সন্তানকেও বশে আনা তাদের জন্য ছিল ডাল ভাতের ব্যপার। শুধুকি তাই? বড় বড় রাঘব বোয়াল সেকুলার এবং সুশীল সুশীলাদেরকেও তলে তলে শিবির প্রিতি দেখেছি!

পত্রিকার রিপোর্টে দেখলাম বুয়েটের কয়েকজন শিক্ষক শিবিরকে ১০০/৫০০ এর অঙ্কে আর্থিক সহায়তা করেছে। অথর্ব সাংবাদিকের এই নতুন(?) আবিষ্কার আর আবিষ্কারের আনন্দে পত্রিকাগুলোকে বগল বাজাতে দেখে বিস্মিত হইনি বরং হতাবাক হয়েছি কারণ সেই ৯০ এর দশকেই অনেককে ৫০০+ টাকা শিবিরের ফান্ডে জমা দিতে দেখেছি। যে শিবিরকে দেশের প্রতিটি নাগরিক চিনে, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব পেশার এমনকি বিরোধী রাজনীতিক নেতারা পর্যন্ত সহায়তা করে সেই শিবিরের আর্থিক সহায়তার ২/৪ শতটাকার স্লিপ দেখে নাদান সাংবাদিকের নাদানি আসলেই হাস্যকর।

গ্রাম এলাকায় থাকতেই ছাত্রদল, ছাত্রলীগ আর জাসদ সর্বহারাদের সম্পর্কে জানা থাকায় শহরে এসেও সাভাবিক ভাবেই ছাত্রদল, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র মৈত্রীকে চিনতে কষ্ট হয়নি। ছাত্রদল ছাত্রলীগের চেয়ে ছাত্রমৈত্রী আর ছাত্র ইউনিয়ন চেনা বেশ সহজ ছিল। ছাত্রদল এবং ছাত্রলীগ কালে ভদ্রে মিছিল বেড় করলে চিনতে পারতাম তাছাড়া ভেসভুসা প্রায় একই। সিগারেট টানা, চাঁদাবাজি করায় কেউ কারো চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। তা ঢাকা কলেজের পল অশ্রু ভুলুই হোক বা তেজগাঁ কলেজের ইরাণ, হারুন বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবির শামিম যেই হোকনা কেন? ইউনিয়ন আর মৈত্রী চেনার সহজ উপায় হল ৪/৫ জনের ছোট্ট জটলার প্রায় সকলের কাঁধেই ঝোলা ব্যাগ, কবি কবি ভাব আর কমপক্ষে একজন হলেও ছাত্রী থাকা যেন নিয়ামক। আবার সে ছাত্রী যেন তেন ছাত্রী নয় বরং একে বারে নেত্রী! আর নেত্রীকে কেন্দ্র করেই সিনিয়র জুনিয়রদের আবর্তন!

বৃহত্তর ফরীদপুর অঞ্চলের বাসিন্দা এবং অজেয় পাড়াগায়ের অপরিচিত বিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ায় শিবিরের কথা মাত্র একবার বাতাসে ভাসতে শুনেছিলাম তার বেশী কিছু নয়। ফলে তাদের সম্পর্কে তেমন জানা শুনাও ছিলনা আর কলেজে তাদের আনাগোনাও দেখিনি। কিন্তু হঠাৎ একদিন ঝাকরা চুলের নাদুস নুদুস এক ছেলে সহাস্যে ছালাম দিয়ে হাত বাড়ালে মুগ্ধ হয়ে যাই। সে ছিল শিবিরের সিটি কলেজ তৎকালিন সভাপতি মাসুদ ভাই।

যা হোক শেষ পর্যন্ত শিবিরে যোগ দিয়েছিলাম অবশ্য ততদিনে বিরোধী ছাত্র সংগঠনের রাজাকার জিকির আর গোলাবারুদের কথা শুনে শুনে কান ঝালাপালা। বিরোধী পক্ষের প্রচারে নিজের ভিতরে শিবিরের অস্ত্র আর গোলাবারুদ দেখার একটা খায়েশও জন্মেছিল। আমার মনের খবর কাউকে জানতে দেইনি বরং ওঁৎ পেতে ছিলাম শিবিরের হাতিয়ার দেখার জন্য। যেমনটা দেখেছিলাম সর্বহারাদের অস্ত্র।

ততদিনে শিবিরে যোগ দেয়ার বয়স তিন মাস হয়ে গেছে। শরতের এক শ্যাৎ শ্যাতে সন্ধায় স্থানীয় নেতা ইসলাম উদ্দিন ভাই বল্লেন আজ বাছাইকৃত কর্মীদের নিয়ে একটা টিসি হবে সেখানে আমিও নাকি আমন্ত্রীত। মোটা হলেই যে দাড়গা হওয়া যায়না তা আগেও জানতাম কিন্তু এত অল্প দিনেই শিবিরের বাছাইকৃত কর্মীর তালিকায় আমার নাম! এটা যে মোটা হওয়া ছাড়া অন্য কোন গুণের কারণে হয়নি তা আর কেউ না বুঝুক আমি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলাম।

প্রশ্ন করলাম ভাই টিসি কি? উত্তরে বল্লেন ট্রেনিং ক্যাম্প! আমারতো অবস্থা খারাপ। কয়েকবার হাত দিয়ে পরখ করে দেখলাম প্যান্ট ঠিক আছে কিনা? না বুকের মধ্যে কিছুটা ধরফড়ানি হলেও প্যান্টের তাগাও ছিড়েনি বা ভিজেও যায়নি। যাব কি যাবনার দ্বন্দ্ব ভুলে শিবিরের অস্ত্র দেখার খায়েসে, শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম না অবশ্যই যাব। কারণ ট্রেনিং ক্যাম্পে না গেলে অস্ত্র দেখব কেমনে?

এশার নামাযের পরে স্থানীয় এক বাসায় শুরু হল ট্রেনিং ক্যাম্পের কার্যক্রম। শুরুতেই দার্সে কুরআন। সারাজীবন অনেক ওয়াজ মাহফিল শুনেছি কিন্তু দার্সে কোরআন কি তা জানা ছিলনা। যাহোক শুনতে হবে ধৈর্য ধরে। এরা আবার কুরআনের নামে ব্রেন ওয়াশ করছে নাতো?

শুনলাম মোহমুগ্ধ হয়ে। সারাজীবনের ওয়াজ মাহফিলে যা শুনিনি তা শুনলাম দাড়ি গোফহীন ফুল পেন্টুল পড়া প্রায় আমার সমবয়সি কিশকায় এক ছেলের মুখে! মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে প্রতিটি হরফে, প্রতিটি পরতে কুরআনের কথা গুলো কেন যেন জীবনের সাথে ফিট হয়ে যাচিছল। দার্স শেষ হলে ভাবলাম ভালো ভালো কথার শেষে হয়ত আসল খেলা দেখাবে।

রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছিল আর একের পর এক আলোচনা চলছিল। ফাঁকে ফাঁকে চা বিস্কিটও ছিল। মুড়ি চানাচুড়ের কথা না হয় নাই বল্লাম। মধ্যরাতে দুইঘন্টার জন্য বিরতী দিল এবং ঘোষনা হল শেষ রাতে বাকী কার্যক্রম হবে অন্য জায়গায়। সবাই ঘুমালো কিন্তু আমার ঘুম আসছিল না। কান খাড়া রেখেছিলাম অন্য কিছুর আওয়াজের আশায় কিন্তু তেমন কিছু কানে আসলানা। ভাবলাম শ্যালারা মনেহয় সর্বহারাদের চেয়েও হুশিয়ার।

ঠিক রাত দুটায় সবাইকে জাগিয়ে দেয়া হল। ওযু করে সবাই প্রস্তুত, অতি সন্তর্পনে মার্চপাস্ট করে চলে গেলাম এক মসজিদের সামনে। মসজিদের কলাপসিপাল গেট খুলে গেলে আমরা ভিতরে প্রবেশ করলাম। মনে মনে ভাবলাম হায়রে শিবির! ব্যাটারা অস্ত্র দেখাবি তো দেখা তাই বলে মসজিদের ভিতরে!

আমার লক্ষ যেহেতু অস্ত্র দেখা তাই বেউকুফ সেজে রইলাম এবং তারা যা আদেশ করছে অন্যান্যের সাথে আমিও তাই করছিলাম।

সচরাচর আমরা মসজিদের যেখানে নামায পড়ি সেখানে না নিয়ে মসজিদের তিনতলায় নিয়ে যাওয়া হল। উত্তেজনায় আমার কান গড়ম হয়ে গেল। মসজিদের তৃতীয় তলায় সবাইকে কাতার বন্ধি করা হল যেমনটা নামাজে আমরা কাতার বন্ধি হই। ধিরপদে আলখাল্লা পরিহিত এক ভদ্রলোক সামনে চলে গেলেন। আরে ইনি যে মসজিদের ইমাম সাহেব। তাহলে ব্যাটা ইমামতির ছদ্দাবরনে এই কাম করে না? ঢিলে ঢালা জুব্বার আস্তিনের ভিতর থেকে এই বুঝি অস্ত্রটা বেড়িয়ে আসছে, যখন এমন অপেক্ষায় ঠিক তখনই তিনি কিবলামূখী হয়ে আল্লাহুআকবার বল্লেন। মনেমনে ভাবলাম হয়ত বিসমিল্লাহি আল্লাহুআকবার বলেই শুরু করবেন আসল খেলা।

ঠিকই তিনি যথাসময়ে আসল খেলা শুরু করলেন। আমি যেহেতু নতুন তাই প্রথমে বুঝতে না পারলেও সবার তালে তালে, তারা যেরকম করছিল আমিও সেরকম শুরু করলাম। সে এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। মনেহচ্ছিল আকাশে বজ্রপাত হচ্ছে, মসজিদের ছাদ ভেঙ্গে মেঘ খন্ডগুলো আমাদের মাথায় এসে পড়ছে! ইমাম সাহেবের তর্জন গর্জন যতই বাড়ছিল আদর্শের সৈনিকদের গোঙ্গানীও সমধিক হাড়ে বেড়েই চলছিল।

কিছুক্ষণ পরে অনুভব করলাম এবার বজ্রপাত থেমে গেছে, মাথার উপর এসে পরা শিলা খন্ড গুলো গলতে শুরু করেছে। মসজিদের জায়নামাজ ভিজে যাচ্ছে। না রক্তে নয়, অস্ত্রের আগাতেও নয় বরং কুরআনের মধুর তেলাওয়াত আর সিজদায় কন্নারত প্রতিটি কর্মীর রোনাজারীতে!! শিবিরের অস্ত্র দেখতে এসে আল্লাহর কাছে শেষ রাতে ধর্ণা দিয়ে অশ্রু বিষর্জনের যে দৃশ্য সেদিন দেখেছিলাম সে স্মৃতি ভোলার নয়। দুনিয়ার সব অস্ত্র শিবিরের শেষ রাতের সেই অশ্রুর কাছে যে একদিন পরাজিত হবে সে বিশ্বাস আমার সেদিনই জন্মে ছিল। ২) সাচ্চা ঈমানদার তো তারাই আল্লাহকে স্মরণ করা হলে যাদের হৃদয় কেঁপে ওঠে৷ আর আল্লাহর আয়াত যখন তাদের সামনে পড়া হয়, তাদের ঈমান বেড়ে যায় ২ এবং তারা নিজেদের রবের ওপর ভরসা করে৷

যার পরনায় শত বাঁধা উপেক্ষা করেও শিবির দেশের শ্রেষ্ঠ্য বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে তাদের অবস্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। মাঝখানে জোট আমলের হালুয়া রুটি তাদের অশ্রু ঝড়া চোখে সানি পরেছিল কিনা জানি না কিন্তু আজকের কঠিন ময়দানে তারা যেভাবে টিকি আছে তাতে মনে হচ্ছে তাদের অশ্রু ভেজা সেই অব্যর্থ অস্ত্রগুলোর মরিচা দূর হয়ে আবার চকচকে ঝকঝকে সাদা হয়ে রুপালী ঝিলিক ছড়াতে শুরু করেছে।

- নজিবুল্লাহ

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম