রাশিদ আল ঘানুশি একজন ইসলামি স্কলার এবং রাজনীতিবিদ। তিউনিশিয়ার ক্ষমতাসীন দল এবং সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক আন্দোলন "আননাহদা মুভমেন্টের" প্রতিষ্ঠাতা তিনি। রাশিদ আল ঘানুশিকে আন নাহদার "স্পিরিচুয়াল লিডার" বলা হয়ে থাকে। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধর্মনিরপেক্ষ, একদলীয় শাসনব্যবস্থায় বিরক্ত জনগণের কাছে ঘানুশির আননাহদা মুভমেন্ট তিউনিশিয়ার মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পায় এবং ফলশ্রুতিতে নির্বাচনে জনসমর্থন পেয়ে কোয়ালিশন করে সরকার গঠন করে আরো কয়েকটি দলের সাথে। রাশিদ ঘানুশির মুভমেন্টের নাম "আন-নাহদা", যে শব্দটির অর্থ রেঁনেসা বা পুনর্জাগরণ।
রাশিদ আল ঘানুশি দক্ষিন তিউনিশিয়ার কাবিস অঙ্গরাজ্যের আলহামা সংলগ্ন এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪১ সালে। কলেজ পর্যায়ের শিক্ষাগ্রহণ শেষে তিনি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ এগ্রিকালচারে শিক্ষাজীবন শুরু করেন ১৯৬৪ সালে।
কিন্তু মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দেল নাসের এবং তিউনিশিয়ার প্রেসিডেন্ট হাবিব বোরগুইবার সমস্যার কারণে তিনি সিরিয়ায় চলে যান। সেখানে ইউনিভার্সিটি অফ দামস্কতে দর্শনের উপরে পড়াশোনা করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি গ্রাজুয়েশন করেন। দামেস্কতে থাকার সময় তিনি সমাজতান্ত্রিক পার্টিতে যোগদান করেন। পরবর্তী জীবনে তিনি ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির দিকে ঝুঁকে পরেন।
তিউনিশিয়ার সেকুলার পাশ্চাত্যপ্রেমী প্রেসিডেন্ট হাবিব বোরগুইবার শাসনের বিপরীতে কোন রাজনৈতিক দলই ছিলনা দেশে। ঘানুশি আল-ইত্তিহাদ-আল-ইসলামি বা ইসলামিক টেনডেন্সি মুভমেন্ট নামের একটি দল প্রতিষ্ঠা করেন। যেই দলটি নিজেদের বর্ণনায় বলে এটি "নন-ভায়োলেন্ট' ইসলামের উপরে প্রতিষ্ঠিত এবং তারা আহবান জানায় অর্থনীতিকে ঢেলে সাজিয়ে একটি সমন্বয়পূরণ জীবন গঠনের জন্য। তারা বলেছিলো একদলীয় রাজনীতির অবসান করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে গ্রহণ করে নিতে তারা জনগণকে আহবান জানায়।
জুলাইয়ের শেষে ঘানুশি এবং তার সহযোগীরা গ্রেফতার হন এবং ১১ বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত করে বিজার্ত কারাগারে পাঠানো হয় এবং সেখানে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করা হয়। সেইসময় ধর্মীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ কমিউনিটিরা সহ অজস্র রাজনৈতিক সংগঠন তার পক্ষ অবলম্বন করে মুক্তির জন্য র্যালি করে। ১৯৮৪ সালে তাকে কারামুক্ত করা হয়। কিন্তু ১৯৮৭ সালে রাশিদ আল ঘানুশিকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করে আবার বন্দী করা হয়। ১৯৮৮ সালে তিনি মুক্তি পান এবং রাজনৈতিক নির্বাসনে ইউরোপে চলে যান।
[ছবি : ১৯৮০ সালে একটি ইসলামিক র্যালিতে বক্তব্য রাখছেন ঘানুশি]
ফিলিস্তিনের জন্য ইসলামিক কমিটির পক্ষে আয়োজিত কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেন ১৯৮৯ সালে। ১৯৯০ সালে কুয়েতের উপরে আক্রমনের পর তিনি সৌদির বাদশাহ ফাহাদকে জঘন্য অপরাধকারী হিসেবে অভিযুক্ত করেন আমেরিকার সৈন্যদেরকে সেখানে আমন্ত্রণ জানানোর অভিযোগে।
ইউরোপে গিয়েও ঘানুশি বোরগুইবার পরবর্তী শাসক জাইন আল আবেদিন বেন আলির বিরুদ্ধে সমালোচনা করতে থাকেন। কিন্তু জানুয়ারি ২০১১ এর পরে তিউনিশিয়ার গণমানুষের আন্দোলনে একনায়ক বেন আলির পতনের পরে তিনি দেশে ফিরে আসেন ২০ বছরের নির্বাসন ভোগের পরে। দেশে ফিরে নির্বাচনপূর্ব জনমত গঠনে তিনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ভ্রমণ করেন, বিশেষজ্ঞরা তার এই কাজটিকে সূক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তার পরিচয় বলে অভিহিত করে নির্বাচনের পরে। কেননা একনায়ক শাসনের পরে আননাহদার সমান সংগঠিত হয়ে উঠতে পারেনি আর কোন রাজনৈতিক দল।
২০১১ সালের ২২ জানুয়ারিতে আল জাজিরা টিভির সাথে একটি সাক্ষাতকারে রাশিদ ঘানুশি বলেন, তিনি জোরপূর্বক হিজবুত তাহরিরের মতন ইসলামি খিলাফত প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে একমত নন। বরং তিনি উন্নয়নমুখী উদার ইসলামিক ভিত্তির উপর দাঁড়ানো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসী, তিউনিশিয়ায় দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা সেকুলার জীবনব্যবস্থায় ভুক্তভোগী জনগনকে ২০১১ আন্দোলন করতে বাধ্য করা জনমানুষের অন্তরকে ইসলামের প্রতি নরম করবে। সৌদি আরব এবং ইরানে শাইখ রাশিদ আল ঘানুশির প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি আছে।
তিনি সকল তিউনিশিয়ানের সমতা আনয়নের ব্যাপারে জোর দেন, বিশেষ করে নারীদের। এছাড়া তিউনিশিয়ার জনগণের মত গ্রহণের জন্য একটা সরকারের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। গণতান্ত্রিক অ্যাপ্রোচ ঘানুশিকে অন্যান্য হাই-প্রোফাইল ইসলামপন্থীদের চাইতে আলাদা করেছে, যদিও তিনি মধ্যপ্রাচ্যে অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর নিজেদের পথ নিজেরাই বেছে নেয়ার উপর জোর দিয়ে থাকেন।
২০১১ সালের মে মাসে একটি সাক্ষাতকারে ঘানুশি বলেন, ফিলিস্তিনের আসল সমস্যা রয়েছে গোটা উম্মাহর হৃদয়ে। আর সেই হৃদয়ের অংশটুকু হলো মক্কা থেকে জেরুজালেমের মাটি -- যা ইসলামিক উম্মাহর হৃদয়। তিনি বলেন, এই এলাকার যেকোন বৈদেশিক হস্তক্ষেপই মুসলিম উম্মাহর অন্তর রোগাক্রান্ত হবার লক্ষণ। তিনি আরো বলেন, ইসরাইল খুব শীঘ্রই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
রাশিদ আল ঘানুশিকে বলা হয় একজন "থট লিডার" যিনি ইসলামিক পদ্ধতিকে সমনাগরিক অধিকারের সাথে সমন্বয় করেছেন। নির্বাচনের আগেই ১৯ এপ্রিল, ২০১১ তারিখে মধ্যপ্রাচ্যের 'দি মাজাল্লা' পত্রিকার সাথে সাক্ষাতকারে ঘানুশি কিছু কথা বলেন। পুরনো সেই সাক্ষাতকারের চৌম্বক অংশ তুলে ধরা হলো --
দি মাজাল্লা: একদম প্রথমে বলতে চাই, নির্বাসন কাটিয়ে দেশে ফেরার পরে তিউনিশিয়ার কী কী পরিবর্তন দেখছেন? দেশে কি নতুন কোন যুগের সূচনা হয়েছে?
রাশিদ আল ঘানুশি: পরম করুণাময় এবং অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি, আর দরুদ ও সালাম পেশ করছি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি। নিঃসন্দেহে নির্বাসন থেকে বাড়ি ফেরার পর আমার অবস্থান বদলে গেছে। আগে আমার অন্তরে আমার দেশ থাকলেও আমি সমস্যাগুলো বাইরে থেকে সমাধানের চেষ্টা করতাম। এখন আমি আমার নিজের মাটিতে এবং এর ফলে আমি দেশের সমস্যাগুলোর অনেক কাছাকাছি থাকছি ও দেখছি ভিন্নরকম করে।
দি মাজাল্লাঃ তিউনিশিয়ার গণআন্দোলনের পেছনে আন-নাহদার ভূমিকা কী ছিলো?
রাশিদ আল ঘানুশিঃ আমরা আন্দোলনের একটা অংশ। যেহেতু গত শতাব্দীর শেষ তিনি দশকে আমাদের ভোগান্তি ছিলো সর্বোচ্চ। আমাদের প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষ কারাবন্দী হয়েছিলো, যারা যুগ যুগ ধরে নানা রকম নির্যাতন সহ্য করেছে। শত শত লোক পঙ্গু হয়ে পড়েছেন এবং অনেকজন মৃত্যুবরণ করেছেন। তাদের পরিবার দেখেছিলো করেছিলো নির্মমতা, তারা এতটাই লাঞ্ছনা-গঞ্জনা পেয়েছিলো যে আমাদের তিউনিসিয়াতে আমাদের আন্দোলনকর্মীদের প্রতিটি পরিবারে কেউ না কেউ কারারুদ্ধ হয়েছিলো, নয়ত নির্বাসিত হয়েছিলো, আর নাহয় তাদের তাদের শারীরিকভাবে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছিলো। এই নির্যাতন ও জুলুমের প্রভাব পড়েছিলো একনায়ক সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের জমে থাকা ক্ষোভগুলোকে ক্রমেই বাড়িয়ে দিতে। যার ফলে, ক্ষোভে ফুঁসে থাকা এই মানুষগুলোর চেতনার বারুদে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলো জালিম সরকারের বিরুদ্ধের এই আন্দোলন। এই আন্দোলন তাই কেবল আমাদের সংগঠনের সদস্যদের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো না বরং তিউনিশিয়ার সমাজের সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ
দি মাজাল্লাঃ অতীতের দীর্ঘ তিক্ত সময়ের পরে আন্দোলনের অবস্থা কী এখন?
রাশিদ আল ঘানুশিঃ আননাহদা আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গিয়েছিলো ২০বছর ধরে ব্যাপক ধড়পাকড়ের ফলে। যারা কারাভোগ করেননি তারা নির্বাসনে ছিলেন। আন্দোলন শুরু হবার পূর্ব পর্যন্ত বিগত কয়েকবছরে কিছু সদস্য জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু তারা ছোট কারাগার থেকে বড় কারাগারে যাবার মুক্ত হয়েছিলেন। তাদেরকে পুলিশের সার্বক্ষণিক প্রহরায় রাখা হয়েছিলো। তারপরেও তারা নিজেদের জীবন শুরু করতে পেরেছিলেন এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এখন আমরা আমাদের কর্মপদ্ধতি পুনর্গঠন করছি এবং নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে আবেদন জানিয়েছি। একটা ভালো উত্তর আশা করছি।
দি মাজাল্লাঃ এখনকার তিউনিসিয়া এবং আন-নাহদার রাজনৈতিক চিত্রটি কেমন?
রাশিদ আল ঘানুশিঃ আমরা তিউনিসিয়ার রাজনীতি ও সমাজের একটা অংশ। এখন আমরা এমন একটা সময় পার করছি যখন আমাদের নতুন একটা রাজনৈতিক সিস্টেম দাঁড় করাতে হবে। একই সাথে, তিউনিসিয়ার মানুষেরা একদলীয় শাসন এবং মাফিয়ার থাবা থেকে মুক্ত হবার এই সময়ে যেটা চাইছে তা হলো—একটি জনগণের দেশ। দেশটি অনেক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং আমরা তার সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তির একটা অংশ। আমাদের সকল মানুষের অংশগ্রহণে গড়া এই আন্দোলনকে ধারণ করতে এবং জনমানুষের একটা দেশ স্থাপন করতে আমরা জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে যোগ দিতে। এটি হবে আন্দোলনের প্রথম ধাপের ফলাফল। সব মানুষের অংশগ্রহণে এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণে এই নির্বাচন ফলপ্রসূ হবে। আন্দোলনের বাইরে থাকা কেউ অথবা পূর্ববর্তী শাসকদের কোন অংশ থাকলে তা সঠিক হবেনা।
দি মাজাল্লাঃ তিউনিসিয়া এবং মিশরের এই আন্দোলন সারা বিশ্বে কেমন প্রভাব ফেলবে বলে আপনি মনে করেন?
রাশিদ আল ঘানুশিঃ তুরষ্ক থেকে শুরু করে ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া এখন গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার আলোকে চলছে। এক্ষেত্রে আরবরা পিছিয়ে ছিলো। এখন তারা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে এবংনিজেরা বদলে নিচ্ছে। কিন্তু মিশরীয়দের জন্য প্রথম ধাপটি নেয়ার কারণে তিউনিসিয়া সম্মানিত বোধ করছে। আরবের দেশগুলো এখন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দিতে এগিয়ে আসছে।
দি মাজাল্লাঃ আপনি কি মনে করেন ইসলামপন্থীরা সরকার হিসেবে ক্ষমতা পেলে পশ্চিমারা তা মেনে নেবে?
রাশিদ আল ঘানুশিঃ পশ্চিমারা প্রভু নয়।
দি মাজাল্লাঃ সমগ্র বিশ্বের অন্যান্য ইসলামিক সংগঠনগুলো যেমন হামাস, মুসলিম ব্রাদারহুড, আল-কায়েদার সাথে আপনাদের সম্পর্কের ধরণটা কেমন?
রাশিদ আল ঘানুশিঃ আমাদের বিশ্বাস এবং ধর্ম একই, তবে চিন্তাধারা এবং ভিন্ন অবস্থার কারণে আমারা পলিসিতে আলাদা হয়ে থাকতে পারি।
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া ☻ আননাহদা ওয়েবসাইট [এরাবিক] ☻ আল জাজিরা ডট কম : রাশিদ ঘানুশির সাক্ষাতকার ☻ বিবিসি -- আননাহদা মুভমেন্ট ☻দি মাজাল্লার সাথে সাক্ষাতকার
লেখক : ব্লগার সাফওয়ান
0 comments: