১. আমরা সাধারণত সকল মানুষকে এবং বিশেষভাবে মুসলমানদেরকে আল্লাহর দাসত্ব গ্রহণ করার আহবান জানাই। ২. ইসলাম গ্রহণ করার কিংবা উহাকে মানিয়া লওয়ার কথা যাহারাই দাবী অথবা প্রকাশ করেন, তাহাদের সকলের প্রতি আমাদের আহবান এই যে, আপনারা আপনাদের বাস্তব জীবন হইতে মুনাফিকী ও কর্ম-বৈষম্য দূর করুন এবং মুসলমান হওয়ার দাবী করিলে খাঁটি মুসলমান হইতে ও ইসলামের পূর্ণ আদর্শবান হইতে প্রস্তুত হউন। ৩. মানব-জীবনের যে ব্যবস্হা আজ বাতিলপন্থী ও ফাসিক কাফিরদের নেতৃত্বের আমূল পরিবর্তন করিতে হইবে এবং নেতৃত্ত্ব ও কর্তৃত্ত্ব আদর্শ ও বাস্তব উভয় ক্ষেত্রেই আল্লাহর নেক বান্দাহদের হাতে সোপর্দ করিতে হইবে। উল্লিখিত তিনটি বিষয়ই যদিও সুস্পষ্ট, তবুও দীর্ঘকাল পর্যন্ত ইহার উপর ক্রমাগত ভুল ধারণা ও অবসাদ-উপেক্ষার আবর্জনা পুঞ্জীভূত হইয়াছে বলিয়া আজ কেবল অমুসলমানই নহে- মুসলমানদের নিকটও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা অপরিহার্য হইয়া পড়িয়াছে।
[পুস্তিকাটি মূলত ১৯৪৫ ইংরেজী সনের ১৯ শে এপ্রিল দারুল ইসলাম পাঠানকোটে অনুষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামীর বার্ষিক সম্মেলনে প্রদত্ত তৎকালীন আমীরে জামায়াতে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর ভাষণ ]
আমাদের এই শূষ্ক, নীরস ও স্বাদহীন আন্দোলন শেষ পর্যন্ত লোকের মনে আশাতীত কৌতুহল এবং উৎসাহের সৃস্টি করিতে সমর্থ হইয়াছে দেখিয়া আমরা আল্লাহ তা’আলার লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করিতেছি। বস্তুত আমরা যে দাওয়াত লইয়া উঠিয়াছি, বর্তমান দুনিয়ার আন্দোলনের বাজারে উহা অপেক্ষা অচল পণ্য বোধ হয় আর একটি ও নাই। উপরন্তু, আমরা যে কর্মনীত গ্রহণ করিয়াছি, তাহাতেও আন্দোলনকে তীব্র গতিতে সম্প্রসারিত করার এবং জনগণকে উহার দিকে আকৃষ্ট করিয়া তুলিবার জন্য বর্তমানকালে সাধারণত যে সব উপায় -উপকরণ গ্রহণ করা হয়, তাহার একটিও বর্তমান নাই। সভার পর সভা করা, মিছিল বাহির করা, রকমারি শ্লোগান দ্বারা আকাশ-বাতাস মুখরিত করা, পতাকা উত্তোলন করা, গরম গরম বক্তৃতা দান প্রভৃতি কোন একটি জিনিসও আমাদের কর্মনীতিতে স্থান পায় নাই। * কিন্তু এতদসত্ত্বেও লক্ষ্য করেতেছি এবং ইহা দেখিয়া খোদার শোকরে হৃদয় অবনত হইয়া আসে যে, ধীরে ধীরে বহু সংখ্যক লোক আমাদের এই দাওয়াতের দিকে আকৃষ্ট হইতেছে, আমাদের এই নীরস সম্মেলনসমূহের দূরবর্তী স্থান হইতে দলে দলে লোক যোগদান করিতেছে। আমাদের দৃষ্টিতে লোকদের আকর্ষণ নিশ্চিত সত্যের স্বাভাবিক আকর্ষণ ছাড়া আর কিছুই নহে । কারণ আমাদের নিকট প্রকৃত সত্য ভিন্ন লোকদের আকর্ষণ করিবার আর কোন জিনিসই নাই।
_________________________________________
*ঐ সময় একদিকে কংগ্রেসের অখণ্ড ভারত আন্দোলন ও অপরদিকে মুসলিম লীগের ভারত বিভাগ করিয়া পাকিস্তান কায়েমের আন্দোলনের প্রতিযোগিতা তীব্র আকার ধারন করে। ঐ সময় রাজনৈতিক হৈ-হাঙ্গামায় জামায়াত শরীক না হইয়া নীরবে দাওয়াত ও সংগঠনে আত্মনিয়োগ করে। তাই জামায়াত তখন মিছিল ও অন্যান্য রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করে নাই।
_________________________________________
সম্মেলনের উদ্দেশ্য
বস্তুত কোন প্রদর্শর্নী কিংবা আলোড়ন সৃষ্টি করিয়া লোকদেরকে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করা আমাদের সম্মেলনসমূহের কখনই উদ্দেশ্য নহে। এই সম্মেলনের মারফতে আমাদের সদস্যগণ পরস্পর পরিচিত ও সংঘবদ্ধ হইবে, তাহাদের মধ্যে কোনরূপ অপরিচিতির ব্যবধান থাকিবে না, পরস্পর গভীরভাবে মিলিত হইবে, পারস্পারিক পরামর্শ ও সহযোগিতার উপায় উদ্ভাবন করিবে এবং নিজেদের মূল কাজকে সম্মুখের দিকে অগ্রসর করিবার জন্য বিপদ, সমস্যা ও বাধা-বিপত্তিসমুহ দুর করিবার পন্থা নির্ধারণ করিবে- ইহাই হইতেছে সাধারণত আমাদের সম্মেলনসমুহের উদ্দেশ্য। এতদ্ব্যতীত আমাদের অতীতের কাজ যাচাই করা, দোষ-ত্রুটিসমূহ অনুধাবন করা এবং তাহা দূর করিবার জন্য চিন্তা করার অবসর লাভ করা ও আমাদের এই সম্মেলনের অন্যতম লক্ষ্য। উপরন্তু আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল, আমাদের আদর্শ ও চিন্তাধারার সমর্থক কিংবা আমাদের কাজ সম্পর্কে সন্দিগ্ধ লোকদেরকে প্রত্যক্ষ্যভাবে আমাদের দাওয়াত এবং কাজ বুঝিবার জন্যই এই সম্মেলনে সুযোগ করিয়া দেওয়া হয়। ফলে, আমাদের সত্যনীতি সম্পর্কে তাহাদের মন নিঃসন্দেহে সায় দিলে তাহারা আমাদের জামায়াতে যোগদান করিতে পারেন। অনেক সময় কেবল অসাক্ষাৎ ও দূরত্বের দরুনই বহু প্রকারে ভ্রান্তিবোধের সৃস্টি হয়। কাজেই তাহা দুর করিবার জন্য নৈকট্য, সাক্ষাৎ, প্রত্যক্ষ আলাপ-আলোচনা ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপন (personal Contact) ভিন্ন কার্যকর উপায় আর কিছুই হইতে পারে না। আতএব আমরা এইজন্য খোদার শোকর আদায় করিতেছি এবং যাহারা নিজেদের সময় ও অর্থ ব্যয় করিয়া কেবল আমাদের এই কথা শুনিবার জন্য আমাদের সম্মেলনে যোগদান করিয়াছেন, তাহাদেরও ধন্যবাদ দিতেছি। তাহাদের এই সত্যানুসন্ধিৎসাকে আমরা শ্রদ্ধা করি। কারণ যেখানে উৎসাহ সৃষ্টি করার সাধারণ ব্যবহৃত কোন উপাদানই বর্তমান নাই, তথায় তাহারা শুধু এই উদ্দেশ্যে আসিয়া থাকেন যে, খোদার মুষ্টিমেয় কয়েকজন বান্দাহ আল্লাহর নাম লইয়া যে কাজ শুরু করিয়াছেন, তাহা গভীর সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে যাচাই করিয়া দেখিবেন, বিচার করিবেন যে, কাজ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই জন্য কি না। এই সত্যানুসন্ধিৎসা মন ও মস্তিষ্কের নির্মলতা ও পরিচ্ছন্নতার সহিত হইলে তাহাদের এই চেষ্টাকে ব্যর্থ হইতে দিবেন না। বরং তিনি তাহাদেরকে নিশ্চয়ই সত্য পথের সন্ধান বলিয়া দিবেন তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।
এই সম্মেলনে এমন অনেক লোকই রহিয়াছেন, যাহারা আমাদের দাওয়াত, উদ্দেশ্য ও কর্মনীতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানিতে চাহেন, এই জন্য সর্বপ্রথম আমি এই বিষয়ে আলোচনা করিতে চাই।
- অধ্যায় ০১ : আমাদের দাওয়াত
- অধ্যায় ০২ : মুনাফিকীর মূলকথা
- অধ্যায় ০৩ : কর্মীয় বৈশাদৃশ্যের তত্ত্বকথা
- অধ্যায় ০৪ : নেতৃত্বে মৌলিক পরিবতর্নের আবশ্যকতা
- অধ্যায় ০৫ : নেতৃত্বের পরিবর্তন কিরূপে হইবে
- অধ্যায় ০৬ : বিরুদ্ধতা ও উহার কারণ
- অধ্যায় ০৭ : আমাদের কর্মনীতি
- অধ্যায় ০৮ : আলিম ও পীর সাহেবদের দোহাই
0 comments: