যাকাতের গুরুত্ব
নামাযের পর ইসলামের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হচ্ছে যাকাত। সাধারণত নামাযের পরই রোযা উল্লেখ করা হয় বলে অনেকের মনে এ বিশ্বাস জন্মেছে যে, নামাযের পরই বুঝি রোযার স্থান। কিন্তু কালামে পাক থেকে জানা যায় যে, নামাযের পর যাকাতই হচ্ছে সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ দুটি ইসলামের প্রধান স্তম্ভ-এটা বিধ্বস্ত হয়ে গেল ইসলামের প্রাসাদও ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
‘যাকাত’ অর্থ পবিত্রতা এবং পরিচ্ছন্নতা। নিজের ধন-সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ গরীব-মিসকীন ও অভাবী লোকদের মধ্যে বন্টন করাকে ‘যাকাত’ বলা হয়। কারণ এর ফলে সমগ্র ধন-সম্পত্তি এবং সেই সাথে তার নিজের আত্মার পরিশুদ্ধি হয়ে থাকে। যে ব্যক্তি আল্লাহ প্রদত্ত ধন-সম্পদ তাঁর বান্দাদের জন্য নির্দিষ্ট অংশ ব্যয় করে না, তার সমস্ত ধন অপবিত্র এবং সেই সাথে তার নিজের মন ও আত্মা পংকিল হতে বাধ্য। কারণ, তার হৃদয়ে কৃতজ্ঞতার নামে মাত্র বর্তমান নেই। তার দিল এতদূর পূর্বক তাকে প্রয়োজনাতিরিক্ত ধন-সম্পদ দান করেছেন তাঁর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতেও তার মন কুন্ঠিত হয়। এমন ব্যক্তি দুনিয়ায় খালেছভাবে আল্লাহর জন্য কোনো কাজ করতে পারবে, তার দীন ও ঈমান রক্ষার্থে কোনোরূপ আত্মত্যাগ ও কুরবানী করতে প্রস্তুত হতে পারবে বলে মনে করা যেতে পারে কি? কাজেই একথা বলা যেতে পারে যে, যে ব্যক্তি যাকাত আদায় করে না তার দিল নাপাক, আর সেই সাথে তার সঞ্চিত ধন-মালও অপবিত্র, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
যাকাত ফরয করে আল্লাহ তাআলা প্রত্যেকটি মানুষকে এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করেছেন। যে ব্যক্তি নিজ ইচ্ছানুক্রমেই প্রয়োজনতিরিক্ত ধন-মাল হতে আল্লাহর নির্দিষ্ট হিস্যা আদায় করে এবং আল্লাহর বান্দাহদের যথাসাধ্য সাহায্য করে, বস্তুত সেই ব্যক্তিই আল্লাহর কাজ করার উপযুক্ত, ঈমানদার লোকদের মধ্যে গণ্য হওয়ার যোগ্যতা তারই রয়েছে। পক্ষান্তরে যার দিল এতদূর সংকীর্ণ যে, আল্লাহর জন্য এতটুকু কুরবানী করতে প্রস্তুত হয় না, তার দ্বারা আল্লাহর কোনো কাজই সাধিত হতে পারে না-সে ইসলামী জামায়াতে গণ্য হবার যোগ্য নয়। প্রকৃতপক্ষে তাকে মানব দেহের একটি পঁচা অংগকে যত শীঘ্র কেটে বিচ্ছিন্ন করা যায় শরীরের অন্যান্য অংগ-প্রত্যংগের পক্ষে তত মংগল। অন্যথায় সমগ্র দেহেই পচন শুরু হবে। এ জন্যই হযরত মুহাম্মদ (সা) এর ইন্তেকালের পর যখন আরবের কোনো এক গোত্রের লোক যাকাত আদায় করতে অস্বীকার করেছিল, তখন (প্রথম খলীফা) হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদের বিরুদ্ধে-কাফেরদের বিরুদ্ধে যেমন করতে হয় ঠিক তেমনি-যুদ্ধের কথা ঘোষণা করেছিলেন। অথচ তারা নামায পড়তো, আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের প্রতি তাদের ঈমানও বর্তমান ছিল। এত নিসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, যাকাত আদায় না করলে নামায-রোযা ইত্যাদি তার কোনো কাজই আল্লাহর কাছে গৃহীত হতে পারে না, আর এরূপ ব্যক্তির ঈমানদার হওয়ার দাবী করার আদৌ কোনো মূল্য নেই।
কুরআন মজীদ থেকে নিসন্দেহে জানতে পারা যায়, প্রাচীনকাল থেকে প্রত্যেক নবীর উম্মাতের প্রতিই সমানভাবে নামায ও যাকাত আদায় করার কঠোর আদেশ করা হয়েছিল-দীন ইসলামের কোনো অধ্যায়েই কোনো নবীর সময়ে কোনো মুসলমানকেই নামায ও যাকাত থেকে রেহাই দেয়া হয়নি। হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম এবং তাঁর বংশের নবীদের কথা আলোচনা করার পর কুরআন পাকে বলা হয়েছে:
وَجَعَلْنهُمْ اَئِمَّةً يَّهْدُوْنَ بِاَمرِنَا وَاَوْحَيْنَا اِلَيْهِمْ فِعْلَ الْخَيْرتِ وَاِقَامَ الصَّلوةِ وِاِيْتَآءَ الزَّكْوةِ ط وَكَانُوْا لَنََا عبِدِيْنَ ـ الانبياء ـ
আমরা তাদেরকে মানুষের নেতা বানিয়েছি, তারা আমাদেরই বিধান অনুযায়ী পরিচালিত করে-পথপ্রদর্শন করে। আমরা ওহীর সাহায্যে তাদেরকে ভালো কাজ করার, নামায কায়েম করার এবং যাকাত আদায় করার আদেশ করেছি, নামায কায়েম করার এবং যাকাত আদায় করার আদেশ করেছি, তারা ঘাঁটিভাবে আমরা ইবাদাত করতো-হুকুম পালন করতো। সূরা আল আম্বিয়া : ৭৩
হযরত ইসমাঈল (আ) সম্পর্কে বলা হয়েছে:
وَكَانَ يَامُرُ اَهْلُهُ بِالصَّلوةِ وَالزَّكوةِ ص وَكَانَ عِنْدَ رَبِّه مَرْضِيَّا ـ
তিনি তাঁর লোকদেরকে নামায এবং যাকাত আদায় করার আদেশ করতেন এবং আল্লাহর দরবারে তিনি বিশেষ মর্যাদা সম্পন্ন ছিলেন। সূরা মরিয়ম : ৫
হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তাঁর নিজের সম্পর্কে দোয়া করেছিলেন- হে আল্লাহ! এ দুনিয়ায় আমার মঙ্গল দাও, পরকালেও কল্যাণ দান কর। এর উত্তরে আল্লাহ সূরা আল আরাফের ১৫৬ আয়াতে বলেছিলেন:
عَذَابِي اُصِيْبُ بِه مَنْ اَشَآءُ وَرَحْمَتِيْ وَسِعَتْ كُلُّ شَئِ فَسَاكْتُبُهَا لِلَّذِيْنَ يَتَّقُوْنَ وَيُؤْتُوْنَ الزَّكوةَ وَالَّذِيْنَ هُمْ بِايتِنَا يُؤْمِنُوْنَ ـ
যাকে ইচ্ছা হবে, তাকে আমার আযাবে নিক্ষেপ করবো। যদিও আমার রহমত সকল জিনিসের ওপরই পরিব্যাপ্ত আছে; কিন্তু তা কেবল সেই লোকদের জন্যই নির্দিষ্ট করবো যারা আমাকে ভয় করবে এবং যাকাত আদায় করবে, আর যারা আমার বাণীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে। সূরা আরাফ : ১৫৬
হযরত মূসা আলাইহিস সালামের জাতির লোকদের দিল অত্যন্ত সংকীর্ণ ছিল। ধন-সম্পদ লাভের জন্য প্রাণ দিতেও তারা কুন্ঠিত হতো না। বর্তমানকালের ইয়াহুদীরাই তার বাস্তব উদাহরণ। এজন্য আল্লাহ তাআলা এ মহান সম্মানিত পয়গম্বরের প্রার্থনা উত্তরে স্পষ্ট ভাষায় বলে দিলেন যে, তোমার উম্মাত যথারীতি যাকাত আদায় করলে আমরা রহমত পেতে পারবে অন্যথায় পরিষ্কার জেনে রাখ, তারা আমার রহমত হতে নিশ্চয়ই বঞ্চিত হবে এবং আমার আযাব তাদেরকে পরিবেষ্টন করে নেবে। হযরত মূসা (আ) এর পরেও বনী ইসরাঈলগণকে বার বার এ সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। বার বার তাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করা হয়েছে: আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বন্দেগেী করবে না এবং রীতিমত নামায ও যাকাত আদায় করবে। (সূরা আল বাকারা, রুকূ : ১০)। শেষ পর্যন্ত তাদেরকে সুস্পষ্ট নোটিশ দেয়া হয়েছে এই বলে :
وَقَالَ اللهُ اِنِّي مَعَكُمْ لَئِنْ اَقَمْتُمُ الصًَّلوةَ وَاتَيْتُمْ الزَّكوةَ وَامْنْتُمْ بِرُسُلِىِ وَعَزَّرتُمُوْهُمْ وَاَقْرَضْتُمْ اللهَ قَرْضًا حَسَنًا لاَّكَفِّرَنَّ عَنْكُمْ سَيَّاتِكُمْ ـ المائِدة : 12
আল্লাহ বললেন, হে নবী ইসরাঈল! তোমরা যদি নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় করতে থাক, আমার রাসূলদের ওপর ঈমান আন; তাদের সাহায্য কর এবং আল্লাহকে করযে হাসানা দাও, তাহলে আমি তোমাদের সাথী এবং তোমাদের দোষ-ত্রুটিগুলো দূর করে দেব (অন্যথায় রহমত লাভের কোনো আশাই তোমরা করতে পার না)। সূরা মায়েদা : ১২
হযরত রাসূলে করীম (সা) এর পূর্বে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামই সর্বশেষ নবী ছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকেও একই সাথে নামায এবং যাকাতের হুকুম দিয়েছেন। সূরা মারিয়ামে বলা হয়েছে:
وَّجَعَلّنِى مُبرَكًا اَيْنَا مَاكُنْتُ وَاَوْضنِى بَالصَّلوةِ وَالزَّكوْةِ مَادُمْتُ حَيًا ـ مريم : 31
আল্লাহ আমাকে মহান করেছেন-যেখানেই আমি থাকি এবং যতদিন আমি জীবিত থাকবো ততদিন নামায পড়া ও যাকাত আদায় করার জন্য আমাকে নির্দেশ করেছেন। সূরা মরিয়াম : ৩১
এ থেকে নিসন্দেহে জানতে পারা যায় যে, দীন ইসলাম প্রত্যেক নবীর সময়ই নামায ও যাকাত এ দুটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়েছিল। আল্লায় বিশ্বাসী কোনো জাতিকেই এ দুটি কর্তব্য থেকে কখনও নিষ্কৃতি দেয়া হয়নি।
হযরত রাসূলে কারীম (সা) এর উপস্থাপিত শরীয়াতে এ দুটি ফরযকে কিভাবে পরস্পর যুক্ত ও অবিচ্ছেদ্য করে দেয়া হয়েছে, তা অনুধাবন যোগ্য। কুরআন পাকের প্রথমেই যে আয়াতটি উল্লেখিত রয়েছে, তা এই :
ذَلِكَ الْكِتبُ لاَرَيْبَ فِيْهِ هُدًى لِّلْمُتَّقِيْنَ ـ الَّذِيْنَ يُؤِْنُوْنَ بِالْغِيْبِ وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلوةَ وَمِمَّا رَزَقْنَهُمْ يُنْفِقُوْنَ ـ البقرة : 2-3
এ কুরআন আল্লাহর কিতাব-এতে কোনো প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই। এটা পরহেযগার, আল্লাহভীরু লোকদেরকে দুনিয়ার জীবনের সঠিক ও সোজা পথপ্রদর্শন করে। পরহেযগার তারাই যারা অদৃশ্যকে বিশ্বাস করে, নামায কায়েম করে এবং আমরা তাদেরকে যে রিযক দিয়েছি তা থেকে খরচ করে। সূরা আল বাকারা: ২-৩
اُوْآئِكَ عَلى هُدًى مِّنْ رَّبِهِمْ وَاُولئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ ـ البقرة : 5
বস্তুত এরাই রব প্রদত্ত হেদায়াত লাভ করেছে এবং এরাই সফলকাম। সূরা আল বাকারা : ৫
অর্থাৎ যাদের ঈমান নেই এবং নামায ও যাকাত আদায় করে না তারা শুধু আল্লাহর হেদায়াত থেকেই বঞ্চিত নয়, কল্যাণ ও সাফল্য তাদের ভাগ্যে জুটবে না। তারপর এ সূরা আল বাকারা পড়তে পড়তে সামনে এগিয়ে যান, কয়েক পৃষ্ঠা পরই আদেশ হয়েছে:
وَاَقِيْمُوا الصَّلوةَ وَاتُوْا الزَّكَعُوْا مَعَ الرَّكِعِيْنَ ـ البقرة : 43
নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় কর এবং রুকূ’কারীদের সাথে একত্রিত হয়ে রূকু কর (জামায়াতের সাথে নামায আদায় কর) । সূরা আল বাকারা : ৪৩
অতপর কিছুদূর অগ্রসর হয়ে এ সূরায় বলা হয়েছে:
لَيْسَ الْبِرَّ اَنْ تُوْلُّوْا وَجُوْهَكُمْ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلكِنَّ البِرَّ مَنْ امَنَ بِاللهِ وَالْيُوْمِ الاخِرِ وَالْمَلئِكَةِ وَالْكِتبِ وَالنَّبِيْنَ وَاَتَى الْمَالَ عَلى حُبِّه ذَوِى الْقُرْبى وَالْيَتمى وَالْمَّسْكِيْنَ وَاَبْنَ السَّآئِلِيْنَ وَفِى ارِّقَابِ وَاَقامَ الصَّلوةَ وَاَتَى الزَّكوةَ وَالْمُؤْفُوْنَ بَعَهْدِهِمْ اِذَا عَهدُوْا الرِّقَابِ وَاَقَامَ الصَّلوَةَ وَاَتَى الزَّكوَةَ وَالْمُؤْفُوْنَ بَعَهْدِهِمْ اِذَا عَهدُوْا وَالصَّبِرِيْنَ فِى الْبَاسَآءِ وَالضَّرَّاءِ وَحَيْنَ الْبَاسِ اُوْلئِكَ الَّذِيْنَ صَدَقُوْا وَاُوْلئِكَ هُمْ الْمُتَّقُوْنَ ـ البقرة : 177
পূর্ব কিংবা পশ্চিম হয়ে দাঁড়ালেই কোনো পূণ্য লাভ হয় না বরং যে ব্যক্তি আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতা, আসমানী কিতাব এবং পয়গাম্বরদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, আল্লাহর প্রেমে তার অভাবী আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম-মিসকীন, পথিক ও প্রার্থীকে নিজেদেরকে ধন-সম্পদ দান করে, অন্য লোকদেরকে তাদের ঋণ, দাসত্ব কিংবা কয়েদ থেকে মুক্তি লাভের ব্যাপারে সাহায্য করে এবং নামায কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে, বস্তুত একমাত্র তারাই পূণ্য লাভ করতে পারে। আর যারা প্রতিশ্রুতি পূরণ করে, বিপদ, ক্ষতি-লোকসান এবং যুদ্ধের সময় যারা ধৈর্যধারণ করে আল্লাহর সত্য পথে দৃঢ়তার সাথে দাঁড়িয়ে থাকে, তারাই পূণ্যবান। তারাই খাঁটি মুসলমান, মুত্তাকী ও পরহেযগার। সূরা আল বাকারা : ১৭৭
এরপর সূরা আল মায়েদায় এ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তাও প্রণিধানযোগ্য :
اِنَّمَا وَلَيُّكُمُ اللهُ وَرَسُوْلُهُ وَالَّذِيْنَ امَنُوْا الَّذِيْنَ يُقِيْمُوْنَ الصَّلوةَ وَيُؤْتُوْنَ الزَّكوةَ وَهُمْ رِكِعُوْنَ ـ وَمَنْ يَّتَوَلَّ اللهَ وَرَسُوْلَهُ وَالَّذِيْنَ امَنُوْا فِانَّ حِزْبَ اللهِ هُمُ الْغلِبُوْنَ ـ المائِدَة : 55-66
মুসলমান! তোমাদের প্রকৃত বন্ধু সাহায্যকারী হচ্ছে শুধু আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং ঈমানদার লোকগণ মাত্র। ঈমানদার লোক বলতে তাদেরকে বুঝায়, যারা নামায কায়েম কবে, যাকাত আদায় করে এবং আল্লাহর সামনে মাথা নত করে। অতএব যারা আল্লাহ, রাসূল এবং ঈমানদারদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে, তারা আল্লাহর দল বলে বিবেচিত হবে এবং আল্লাহর দলই নিশ্চিতরূপে বিজয়ী হবে: সূরা মায়েদা : ৫৫-৫৬
এ আয়াতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতমত, এ আয়াত থেকে জানা গিয়েছে যে, যারা নামায কায়েম করে, যাকাত আদায় করে তারাই মুসলমান। ইসলামের এ দুটি রুকন যে ব্যক্তি যথাযথরূপে আদায় করে না, তার ঈমানদার হওযার দাবী মূলত মিথ্যা। দ্বিতীয়ত, এ আয়াত থেকে একথাও প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ, রাসূল এবং ঈমানদার লোকগণ একটি দলভুক্ত। অতএব ঈমানদার ব্যক্তিগণের অন্যান্য সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করে এ পার্টিতে শামিল হতে হবে। এ দলের বাইরের কোনো ব্যক্তিকে সে পিতা হোক, ভাই হোক, পুত্র হোক, প্রতিবেশী, স্বদেশবাসী কিংবা অন্য যে কেউ হোক না কেন- কোনো মুসলমান যদি তাকে নিজের বন্ধুরূপে গ্রহণ করে এবং তার সাথে ভালোবাসা ও সহানুভূতির সম্পর্ক স্থাপন করে তাহলে আল্লাহ তাআলা যে তার প্রতি সহানুভূতিশীল হবে, এমন আশা কিছুতেই করা যেতে পারে না। সর্বশেষে এ আয়াত থেকে একথাও জানা গেল যে, ঈমানদার লোকগণ দুনিয়ায় কেবল তখনই জয়ী হতে পারে যখন তারা একনিষ্ঠ হয়ে শুধু আল্লাহ, রাসূল এবং ঈমানদার লোকদেরকেই নিজেদের পৃষ্ঠপোষক, বন্ধু সাহায্যকারী এবং সাথী হিসেবে গ্রহণ করবে।
আরও খানিকটা অগ্রসর হয়ে তাওবায় আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে কাফের ও মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং ক্রমাগত কয়েক রুকূ পর্যন্ত এ যুদ্ধ সম্পর্কে হেদায়াত দিয়েছেন। এ প্রসংগে বলা হয়েছে:
فَاِنْ تَابُوْا وَاَقَامُوْا الصَّلوةَ وَاتَوُا الزَّكوةَ فَاِخْوَانَكُمْ فِىْ الدِّيْنِ ـ
তারা যদি কুফর ও শিরক থেকে তাওবা করে খাঁটিভাবে ঈমান আনে এবং নামায কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে তবে তারা তোমাদের দীনি ভাইয়ে পরিণত হবে। সূরা আত তাওবা : ১১
অর্থাৎ শুধু কুফর ও শিরক থেকে তাওবা করা এবং ঈমান আনার কথা প্রকাশ করাই যথেষ্ঠ নয়, সে যে কুফর ও শিরক থেকে তাওবা করেছে এবং প্রকৃতপক্ষেই ঈমান এনেছে, তার প্রমাণের জন্য যথারীতি নামায আদায় করা এবং যাকাত দেয়াও অপরিহার্য। অতএব, তারা যদি তাদের এরূপ বাস্তব কাজ দ্বারা একথার প্রকাশ পেশ করে, তাহলে নিশ্চয়ই তারা তোমাদের দীনি ভই, অন্যথায় তাদেরকে ভাই মনে করা তো দূরের কথা, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও বন্ধ করা যাবে না। এ সূরায় আরও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে:
وَالْمُؤْمِنُوْنَ وَالْمُؤْمِنتُ بَعْضُهُمْ اَوْلِيْآَءُ بَعْضٍ يَامُوْرُونَ بِامُرُوْنَ بَالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلوةَ وَيُؤْتُوْنَ الزَّكوةَ وَيُطِيْعُوْنَ اللهَ وَرَسُوْلَهُ اُوْلئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللهُ ـ التوبية : 71
ঈমানদার পুরুষ এবং ঈমানদার স্ত্রীলোকেরাই প্রকৃতপক্ষে পরস্পর পরস্পরের বন্ধু ও সাহায্যকারী। এদের পরিচয় এবং বৈশিষ্ট্য এই যে, এরা নেক কাজের আদেশ দেয়, অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে, নামায কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে, আল্লাহ ও রাসূলের বিধান মেনে চলে। প্রকৃতপক্ষে এদের প্রতিই আল্লাহ রহমত বর্ষণ করবেন। সূরা আত তাওবা : ৭১
অন্য কথায় কোনো ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত ঈমান এনে কার্যত নামায ও যাকাত আদায় না করবে, ততক্ষণ সে মুসলমানদের দীনি ভাই রূপে পরিগণিত হতে পারবে না। বস্তুত ঈমান, নামায ও যাকাত এই তিনটি জিনিসের সমন্বয়্বেই ঈমানদার লোকদের জামায়াত গঠিত হয়। যারা এ কাজ যথারীতি করে, তারা এ পাক যথারীতি করে, তারা এ পাক জামায়াতের অন্তর্ভূক্ত এবং তাদেরই পরস্পরের মধ্যে বন্ধুত্ব, ভালবাসা ও সহানুভূতির সম্পর্ক স্থাপিত হবে। আর যারা এ তিনটি কাজ করে না, তারা এ জামায়াতের অন্তর্ভূক্ত নয়। তাদের নাম মুসলমানদের ন্যায় হলেও ইসলামী জামায়াতের মধ্যে শামিল হতে পারে না। এখন তাদের সাথে বন্ধত্ব, প্রেম ও ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপন করলে আল্লাহর আইন ভংগ করা এবং তাতে আল্লাহর পার্টির শৃংখলা নষ্ট করা হবে। তাহলে এসব লোক দুনিয়ায় জয়ী হয়ে থাকার আশা কি করে করতে পারে?
আরও সামনে অগ্রসর হলে সূরা হজ্জ-এ দেখা যায়, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন:
وَلَيَنْصُرَنَّ اللهُ مَنْ يَّنْصُرُهُ اِنَّ اللهَ لَقَوِي عَزِيْزٌ ـ اَلَّذِيْنَ اِنْ مَّكَّنّهُمْ فِى الاَرْضِ اَقَامُوْا الصَّلوةَ وَاَتَوُا الزَّّّّكوةَ وَاَمَرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلهِ عَاقِبَةُ الاُمُوْرِ ـ الحج ـ 40-41
যে আল্লাহর সাহায্য করবে, আল্লাহ নিশ্চয়ই তার সাহায্য করবেন। আল্লাহ তাআলা বড়ই শক্তিশালী এবং সর্বজয়ী। (আল্লাহর সাহায্য তারাই করতে পারে) যাদেরকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করলে তারা নামায আদায়ের (সামাজিক) ব্যবস্থা কায়েম করবে এবং সমাগ্রিকভাবে যাকাত আদায় করবে, লোককে সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎ ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখবে। বস্তুত সকল জিনিসের পরিণাম আল্লাহর ওপরই নির্ভর করে। সূরা আল হজ্জ : ৪০-৪১
বনী ইসরাঈলদের ইতিপূর্বে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, এ আয়াতে মুসলমানদেরকেও ঠিক সেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইতিপূর্বে বনী ইসরাঈলদেরকে বলা হয়েছিল যে, তারা যতদিন নামায কয়েম করবে ও যাকাত আদায় করবে এবং নবীদের কাজে সাহায্য করতে থাকবে অর্থাৎ আল্লাহর আইন জারি করবে, ততদিন আল্লাহ তাদের সাথী ও সাহায্যকারী থাকবেন। আর যখন এ কাজ ত্যাগ করবে, তখনই আল্লাহ তাদের প্রতি সকল সাহায্য বন্ধ করে দেবেন। ঠিক একথাই এ আয়াতে মুসলমানদেরকে বলা হয়েছে। আল্লাহ তাদেরকে পরিষ্কার বলে দিয়েছেনন যে, দুনিয়ার শক্তি লাভ করে যদি তারা নামায আদায়ের সামাজিক ব্যবস্থা এবং যাকাত আদায়ের সামগ্রিক পন্থা প্রতিষ্ঠা করে আর ভালো কাজের প্রচার ও মন্দ কাজের প্রতিরোধ করে, তাহলে আল্লাহ তাদের সাহায্যকারী হবেন। বস্তুত, আল্লাহ অপেক্ষা শক্তিমান সাহায্যকারী আর কেউ হতে পারে না। কিন্তু মুসলমান যদি নামায ও যাকাত আদায় করা পরিত্যাগ এবং দুনিয়ার শক্তি লাভ করে সৎকাজের পরিবর্তে অসৎকাজের প্রচার করে, অন্যায়কে নির্মূল না করে সৎকাজের পথ বন্ধ করতে থাকে, আল্লাহর কালেমাকে বিজয়ী করার পরিবর্তে নিজেদের প্রভুত্ব কায়েম করতে শুরু করে আর কর আদায় করে নিজেদের জন্য দুনিয়ার বুকে স্বর্গ রচনা করাকে রাজত্বের একমাত্র উদ্দেশ্য বলে মনে করে, তাহলে আল্লাহর সাহায্য তাদের ভাগ্যে কখনো জুটবে না। তারপর শয়তানই হবে তাদের সাহায্যকারী। ভাবতে অবাক লাগে, এটা কত বড় শিকার কাজ! বনী ইসরাঈল আল্লাহ প্রদত্ত এ বাণীকে অমূলক ও মৌখিক মাত্র মনে করেছিল। ফলে তার বিপরীত কাজ করতে তাদেরকে দুনিয়ার দিকে দিকে অপমানিত ও লাঞ্চিত হয়ে ঘুরে মরতে হচ্ছে। বিভিন্ন স্থান থেকে তাদেরকে বহিষ্কার করা হচ্ছে, কোথাও তারা স্থায়ীভাবে আশ্রয় লাভ করতে পারছে না। এরা দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী সম্প্রদায়, কোটি কোটি কাজেই লাগছে না। নামাযের পরিবর্তে অসৎকাজ এবং যাকাতের বদলে সুদখোরীর অভিশপ্ত পন্থাকেই অবলম্বন করে তারা একদিকে নিজেরা আল্লাহর কাছে অভিশপ্ত হচ্ছে, অপর দিকে তারা প্লেগের ইঁদুরের ন্যায় দুনিয়ার দিকে দিকে এ অভিশাপ সংক্রমিত করে ফিরছে। মুসলমানদেরকেও এ হুকুমই দেয়া হয়েছে। কিন্তু মুসলমানগণ সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নামায আদায় ও যাকাতদানের ক্ষেত্রে উদাসীন হয়েছে এবং আল্লাহ প্রদত্ত শক্তি প্রয়োগ করে সত্য প্রচার এবং মিথ্যা ও অন্যায় প্রতিরোধের দায়িত্ব পালন করা ভুলে বসেছে। আর এর তিক্ত ফলও তারা নানাভাবে ভোগ করেছে। (দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম ও মহাশক্তিধর) রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সমগ্র দুনিয়ায় তারা সকল যাকাত ত্যাগ করার কুফল তো দেখলেন। এখন এদের (বনী ইসরাঈলদের মধ্যে) এমন একটি দল সৃষ্টি হয়েছে যারা মুসলমানদের মধ্যে লজ্জাহীনতা, অশ্লীলতা, পর্দাহীনতা এবং কুৎসিত কাজের প্রবর্তন করতে বদ্ধপরিকর। তারা মুসলমানদেরকে বলছে, তোমাদের আর্থিক অসচ্ছলতা দূর করতে হলে ব্যাংক ও ইন্সুরেন্স কোম্পানী খুলে পেট ভরে সুদ খাও কিন্তু সত্য কথা এই যে, মুসলমানগণও যদি এতেই ল্পিত হয়ে থাকে, তবে তাদেরকেও ইয়াহুদীদের ন্যায় চরম লাঞ্ছনার এক কঠিন বিপদে নিক্ষেপ করা হবে এবং চিরন্তন অভিশাপে অভিশপ্ত হবে।
যাকাত কি জিনিস এতে আল্লাহ তাআলা কত বড় শক্তি নিহিত রেখেছেন, যদিও মুসলমানগণ এটাকে একটি অতি সাধারণ জিনিস বলে মনে করছে, অথচ তাতে যে কত বিরাট লাভের সম্ভবনা রয়েছে এসব বিষয়ে পরবর্তী প্রবন্ধগুলোতে আমি বিস্তারিত আলোচনা করবো, এ প্রবন্ধটিতে আমি শুধু একথাই বলতে চাচ্ছি যে, নামায ও যাকাত ইসলামের একান্তু বুনিয়াদী জিনিস। ইসলামে এ দুটির গুরুত্ব এত অধিক যে, এটা যেখানে নেই সেখানে আর যাই থাক, ইসলাম যে নেই তা সন্দেহতীত। অথচ অনেক মুসলমান আজ নামায কায়েম না করে এবং যাকাত আদায় না করেও মুসলমান হিসেবে গণ্য হতে চায় এবং তাদের তথাকথিত কিছু ধর্মগুরুও এ বিষয়ে তাদেরকে নিশ্চয়তা দান করেছে। কিন্তু কুরআন তাদের দাবীর তীব্র প্রতিবাদ করে। মানুষ যদি কালেমায় তাইয়্যেবা পড়ে তার সত্যতা প্রমাণের জন্য নামায এবং যাকাত আদায় না করে, তাহলে কুরআনের দৃষ্টিতে তার এ কলেমা পড়া একেবারেই অর্থহীন। এজন্যই হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু যাকাত দিতে অস্বীকারকারী ব্যক্তিদের কাফের মনে করে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিলেন। যারা আল্লাহ ও রাসূলকে মানে এবং নামাযও পড়ে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা জায়েয কিনা সাহাবায়ে কেরামের মনে তখন এ সন্দেহ জাগ্রত হয়েছিল। কিন্তু যখন হযত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু যাকে আল্লাহ তাআলা নবুয়াতের কাছাকাছি সম্মান দান করেছিলেন-সুদূঢ়ভাবে ঘোষণা করলেন : আল্লাহর শফথ, রাসূলে কারীম (সা) এর জীবন যারা যাকাত দিত, আজ যদি কেউ তার উট বাঁধার একটি রশিও দিতে অস্বীকার করে, তবে তার বিরুদ্ধে আমি অস্ত্র ধারণ করবো। শেষ পর্যন্ত সকল সাহাবীই একথার যৌক্তিকতা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন এবং সকলে একমত হয়ে ঘোষণা করলেন যে, যারা যাকাত দিবে না তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা অপরিহার্য। কুরআন শরীফ সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছে যে, যাকাত না দেয়া কেবল পরকালে অবিশ্বাসী মুশরিকদেরেই কাজ:
وَوَيْلٌ لِّلْمُشْرِكِيْنَ ـ الًَّذِيْنَ لاَيُؤْتُوْنَ الزَّكوَةَ وَهُمْ بِالاخِرَةِ هُمْ كفِرُوْنَ ـ
যেসব মুশরিক যাকাত দেয় না, যারা আখেরাতকে অস্বীকার করে, তাদের ধ্বংস অনিবার্য। সূরা হা-মীম-আস-সাজদা :৬-৭
পেজ-ভিউ
0 comments: