১৯৫৫ সনের ২রা মার্চ মুলতান মেডিকেল কলেজে অনুষ্ঠিত তৎকালীন পাকিস্তান আন্তকলেজ বিতর্ক প্রতিযোগিতা হয়েছিল। বিতর্কের বিষয়বস্তু ছিল “পর্দা কি প্রগতির অন্তরায়!” এ প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার লাভ করেছেন মুলতান কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী সাইয়েদা পারভীন রেজভী। তিনি পর্দার আড়াল থেকে বক্তৃতা করতে চেয়েছিলেন। অনুমতি না পেয়ে গায়ে চাদর জড়িয়ে তার বক্তব্য পেশ করেছেন। তিনি বিভিন্ন অকাট্য যুক্তি-প্রমাণাদির সাহায্যে প্রমাণ করেছেন যে, পর্দা কোন মতেই প্রগতির অন্তরায় তো নয়ই বরং মানুষের সার্বিক প্রগতিতে পর্দার বিশেষ ভুমিকা রয়েছে। বিচারকদের শতকরা নিরানব্বই ভাগ রায় তাঁর পক্ষে হয়েছে। তাঁর সে বক্তৃতাই পুস্তিকাকারে প্রকাশ করা হলো। আমরা আশা করি এতে আমাদের এ সম্পর্কিত বিভ্রান্তির নিরসন হবে।
পর্দার বিধান
পর্দা কি আমাদের জাতীয় ও রাষ্টীয় প্রগতির অন্তরায়? এ প্রশ্নের মীমাংসার পূর্বে একটি কথা উত্তমরূপে জেনে নেয়া আবশ্যক যে, প্রকৃতরুপে পর্দা কাকে বলে? কেননা এতদ্ব্যতীত আমরা পর্দার উদ্দেশ্য, প্রয়োজনীয়তা এবং তার উপকারিতা অপকারিতা সম্যকরূপে উপলব্ধি করতে সক্ষম হব না। অতপর আমাদেরকে এ-ও সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, আমরা মূলত কোন্ ধরনের প্রগ্রতি অর্জন করতে চাই? কারণ এ বিষয়ে কোন সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত ব্যতিরেকে পর্দা তার অন্তরায় কি না তা যথার্থরূপে অনুধাবন করা সম্ভব হবে না।
পর্দা আরবী ‘হিজাব’ শব্দের বাংলা ও উর্দূ তরজমা । কুরআন মজীদের যে আয়াতে মুসলমানদের আল্লাহ তা’য়ালা রাসূলে করীম (সা)-এর ঘরে নিঃসংকোচে ও বেপরোয়াভাবে যাতায়াত করতে নিষেধ করেছেন, তাতে এ ‘হিজাব’ শব্দই উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেছেন যে, যদি ঘরের স্ত্রীলোকদের নিকট থেকে তোমাদের কোন জিনিস নেয়ার প্রয়োজন হয়, তাহলে তা হিজাবের আড়াল থেকে চেয়ো।
কুরআনের এ নির্দেশ থেকেই ইসলামী সমাজে পর্দার সূচনা হয়। অতপর এ প্রসংগে আর যত আয়াতই নাযিল হয়েছে, তার সমষ্টিকে আহকামে ‘হিজাব’ বা পর্দার বিধান বলা হয়েছে। সূরায়ে নূর ও সূরায়ে আহযাবে এ সম্পর্কিত নির্দেশাবলী বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। ওসব আয়াতে বলা হয়েছে যে, মহিলারা যেন তাদের মর্যাদা সহকারে আপন ঘরেই বসবাস করে এবং জাহেলী যুগের মেয়েদের মতো বাইরে নিজেদের রূপ সৌন্দর্যের প্রদর্শনী করে না বেড়ায়। তাদের যদি ঘরের বাইরে যাবার প্রয়োজন হয়, তবে আগেই যেন চাদর (কাপড়) দ্বারা তারা নিজেদের দেহকে আবৃত করে নেয় এবং ঝংকারদায়ক অলংকারাদি পরিধান করে ঘরের বাইরে না যায়। ঘরের ভেতরেও যেন তারা মোহাররম (যার সংগে বিয়ে নিষিদ্ধ) পুরুষ ও গায়রে মোহাররম পুরুষের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে এবং ঘরের চাকর ও মেয়েদের ব্যতীত অন্য কারো সামনে যেন জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরে না বেরোয়।
অতপর মোহাররম পুরুষদের সামনে বের হওয়া সম্পর্কে ও এ শর্ত আরোপ করা হয়েছে যে, তারা বেরোবার পূর্বে যেন কাপড়ের আঁচল দ্বারা তাদের মাথাকে আবৃত করে নেয় এবং নিজেদের সতর লুকিয়ে রাখে। অনুরূপভাবে পুরুষদেরকেও তাদের মা- বোনদের নিকট যাবার পূর্বে অনুমতি গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেন অসতর্ক মুহুর্তে মা-বোনদের দেহের গোপনীয় অংশের প্রতি তাদের দৃষ্টি পড়তে না পারে।
কুরআন মজীদে উল্লেখিত এই সমস্ত নির্দেশকেই আমরা পর্দা বলে অভিহিত করে থাকি। রাসূলে করীম (সঃ) এর ব্যাখ্যা করে বলেছেন, মহিলাদের সতর হচ্ছে মুখমন্ডল, হাতের কব্জা ও পায়ের পাতা ব্যতীত দেহের অবশিষ্টাংশ। এই সতরকে মোহররম পুরুষ এমন কি পিতা, ভাই প্রভৃতির সামনেও ঢেকে রাখতে হবে। মেয়েরা এমন কোন মিহি কাপড় পরিধান করতে পারবে না যাতে তাদের দেহের গোপনীয় অংশ বাইরে থেকে দৃষ্টিগোচর হতে পারে। তাছাড়া তাদেরকে মোহররম পুরুষ ছাড়া অন্য কারো সাথে ওঠা বসা কিংবা ভ্রমণ করতে রাসূলে করীম (সা) স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করেছেন।
কেবল তাই নয়, রাসূলে করীম (স) মহিলাদেরকে সুগন্ধি মেখেও ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করেছেন। এমনকি তিনি মসজিদে জামায়াতের সাথে সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে মহিলাদের জন্য পৃথক স্থান পর্যন্ত নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। নারী ও পুরুষকে মিলিতভাবে একই কামরায় বা একই স্থানে সালাত আদায়ের তিনি কখনো অনুমতি প্রদান করেননি। এমন কি সালাত শেষে খোদ নবী করীম (স) ও তাঁর সহাবাগণ মহিলাদেরকে মসজিদ থেকে আগে বের হওয়ার সুযোগ দিতেন এবং যতক্ষন পর্যন্ত তারা মসজিদ থেকে সম্পূর্ণরূপে বের না হতেন ততক্ষণ পুরুষরা তাঁদের কামরার ভেতরেই অপেক্ষা করতেন।
পর্দার এই সমস্ত বিধান সম্পর্কে যদি কারো মনে সংশয় থাকে, তা’হলে তিনি কুরআনের সূরায়ে নূর ও সূরায়ে আহযাব এবং হাদীসের বিশুদ্ধ ও প্রামাণ্য গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করে দেখতে পারেন। বর্তমান সময়ে আমরা যাকে পর্দা বলে অভিহিত করে থাকি, তার বাহ্যিক রূপে কিছুটা পরিবর্তন সাধিত হয়েছে বটে, কিন্তু মূলনীতি ও অন্তর্নিহিত ভাবধারার দিক দিয়ে রাসূলে করীম (স) কর্তৃক মদীনার ইসলামী সমাজে প্রবর্তিত পর্দা ব্যবস্থারই অনুরূপ রয়ে গেছে। অবশ্য আল্লাহ ও রাসূলের নামে আপনাদের মুখ বন্ধ করা আমার অভিপ্রায় নয়, কিন্তু এ কথা আমি নিতান্ত সততার খাতিরেই বলতে বাধ্য যে, অধুনা আমাদের মধ্যে ‘পর্দা প্রগতির অন্তরায়’ বলে যে ধূয়া উঠেছে, তা আমাদের দু’মুখো ও মুনাফেকী মনোবৃত্তিরই পরিচায়ক। কেননা এ ধরনের শ্লোগান আল্লাহ তাঁর রাসূলের নির্দেশের বিরুদ্ধে অনাস্থা জ্ঞাপনেরই নামান্তর। এর পরিস্কার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, আল্লাহ এবং রাসূল পর্দার ব্যবস্থা করে আমাদের উন্নতি ও প্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছেন (নাউযুবিল্লাহ)।
বস্তুত পর্দা সম্পর্কে আমাদের মনে যদি এই বিশ্বাসই বদ্ধমূল হয়ে থাকে, তাহলে নিজেদেরকে মুসলিম বলে পরিচয় দেয়ারই বা আমাদের কি অধিকার আছে? আর যে আল্লাহ এবং রাসূল আমাদের ওপর এমনি একটি ‘যুলুমমূলক’ ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেই বা আমরা অনাস্থা জ্ঞাপন করি না কেন? বস্তুত এসব প্রশ্নকে এড়িয়ে গিয়ে এ কথা কেউ প্রমাণ করতে পারবে না যে, আল্লাহ এবং রাসূল মূলতই পর্দার কোন নির্দেশ দেননি। কারণ একটু পূর্বেই আমি কুরআন ও হাদীস থেকে উদ্ধৃতি পেশ করে অকাট্যরূপে প্রমাণ করেছি এটা কোন মনগড়া জিনিস নয়- বরং এ আল্লাহ এবং তদীয় রাসূলেরই প্রদত্ত বিধান ।
এ বিষয়ে আরো বিস্তারিতরূপে কারো জানার আগ্রহ থাকলে তিনি কুরআন-হাদীস থেকেই সরাসরি জ্ঞান লাভ করতে পারেন। আর হাদীসের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে যদি কেউ পর্দার বিধান সম্পর্কে সংশয় পোষণ করতে চান, তাহলে তিনি কুরআন মজীদ থেকেই তার সংশয় নিরসন করতে পারেন। কুরআনে এ সম্পর্কে এত সুস্পষ্ট ও খোলাখুলিভাবে আলোচনা করা হয়েছে যে, তাকে কূটতর্কের বেড়াজাল দিয়ে কোন প্রকারেই আড়াল করে রাখা সম্ভব নয়।
2 comments:
কখনোই না । পর্দা হলো সর্বাধুনিকতা । সভ্যতা । পর্দাহীনতাই বরং প্রগতির বিরোধধী । কারন এটা মুর্খ্যতার রিপ্রেজেন্টিটিভ।
আই রেসপেক্ট হিজাবী সিস্টার্স..