মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচনাবলী

মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বইসমূহ

মেঘনাদবধকাব্য
হেকটরবধকাব্য
চতুর্দশপদী কবিতাবলী
বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ
তিলোত্তমাসম্ভবকাব্য
ব্রজাঙ্গণাকাব্য
মায়াকানন
পদ্মাবতীকাব্য
বিরাঙ্গণাকাব্য
নানাকবিতা
কৃষ্ণকুমারী



কবির কয়েকটি কবিতা


বঙ্গভাষা

হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;-
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি।
অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মনঃ,
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি;-
কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল-কানন!
স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে-
``ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে!''
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে॥


উপক্রম

যথাবিধি বন্দি কবি, আনন্দে আসরে,
কহে, জোড় করি কর, গৌড় সুভাজনে;---
সেই আমি, ডুবি পূর্বে ভারত-সাগরে,
তুলিল যে তিলোত্তমা-মুকুতা যৌবনে;---
কবি-গুরু বাল্মীকির প্রসাদে তত্পরে,
গম্ভীরে বাজায়ে বীণা, গাইল, কেমনে,
নাশিলা সুমিত্রা-পুত্র, লঙ্কার সমরে,
দেব-দৈত্য-নরাতঙ্ক--- রক্ষেন্দ্র-নন্দনে;
কল্পনা দূতীর সাথে ভ্রমি ব্রজ-ধামে
শুনিল যে গোপিনীর হাহাকার ধ্বনি,
(বিরহে বিহ্বলা বালা হারা হয়ে শ্যামে;)---
বিরহ-লেখন পরে লিখিল লেখনী
যার, বীর জায়া-পক্ষে বীর পতি-গ্রামে,
সেই আমি, শুন, যত গৌড়-চূড়ামণি!---

ইতালি, বিখ্যাত দেশ, কাব্যের কানন,
বহুবিধ পিক যথা গায় মধুস্বরে,
সঙ্গীত-সুধার রস করি বরিষণ,
বাসন্ত আমোদে আমোদ মন পূরি নিরন্তরে;---
সে দেশে জনম পূর্বে করিলা গ্রহণ
ফ্রাঞ্চিস্কো পেতরাকা কবি; বাকদেবীর বরে
বড়ই যশস্বী সাধু, কবি-কুল-ধন,
রসনা অমৃতে সিক্ত, স্বর্ণ বীণা করে।
কাব্যের খনিতে পেয়ে এই ক্ষুদ্র মণি,
স্বমন্দিরে প্রদানিলা বাণীর চরণে
কবীন্দ্র: প্রসন্নভাবে গ্রহিলা জননী
(মনোনীত বর দিয়া) এ উপকরণে।
ভারতে ভারতী-পদ উপযুক্ত গণি,
উপহাররূপে আজি অরপি রতনে॥


যশের মন্দির

সুবর্ণ-দেউল আমি দেখিনু স্বপনে
অতি-তুঙ্গ শৃঙ্গ শিরে! সে শৃঙ্গের তলে,
বড় অপ্রশস্ত সিঁড়ি গড়া মায়া-বলে,
বহুবিধ রোধে রুদ্ধ উর্দ্ধগামী জনে!
তবুও উঠিতে তথা--- সে দুর্গম স্থলে---
করিছে কঠোর চেষ্টা কষ্ট সহি মনে
বহু প্রাণী। বহু প্রাণী কাঁদিছে বিকেলে,
না পারি লভিতে যত্নে সে রত্ন-ভবনে।
ব্যথিল হৃদয় মোর দেখি তা সবারে।---
শিয়রে দাঁড়ায়ে পরে কহিলা ভারতী,
মৃদু হাসি; ``ওরে বাছা, না দিলে শকতি
আমি, ও দেউলে কার সাধ্য উঠিবারে?
যশের মন্দির ওই; ওথা যার গতি,
অশক্ত আপনি যম ছুঁইতে রে তারে!''


কবি

কে কবি--- কবে কে মোরে? ঘটকালি করি,
শবদে শবদে বিয়া দেয় যেই জন,
সেই কি সে যম-দমী? তার শিরোপরি
শোভে কি অক্ষয় শোভা যশের রতন?
সেই কবি মোর মতে, কল্পনা সুন্দরী
যার মনঃ-কমলেতে পাতেন আসন,
অস্তগামি-ভানু-প্রভা-সদৃশ বিতরি
ভাবের সংসারে তার সুবর্ণ-কিরণ।
আনন্দ, আক্ষেপ ক্রোধ, যার আজ্ঞা মানে
অরণ্যে কুসুম ফোটে যার ইচ্ছা-বলে;
নন্দন-কানন হতে যে সুজন আনে
পারিজাত কুসুমের রম্য পরিমলে;
মরুভূমে--- তুষ্ট হয়ে যাহার ধেয়ানে
বহে জলবতী নদী মৃদু কলকলে!



মিত্রাক্ষর

বড়ই নিষ্ঠুর আমি ভাবি তারে মনে,
লো ভাষা, পীড়িতে তোমা গড়িল যে আগে
মিত্রাক্ষররূপ বেড়ি ! কত ব্যথা লাগে
পর' যবে এ নিগড় কোমল চরণে--
স্মরিলে হৃদয় মোর জ্বলি উঠে রাগে
ছিল না কি ভাবধন, কহ, লো ললনে,
মনের ভাণ্ডারে তার, যে মিথ্যা সোহাগে
ভুলাতে তোমারে দিল এ তুচ্ছ ভূষণে ?
কি কাজ রঞ্জনে রাঙি কমলের দলে ?
নিজরূপে শশিকলা উজ্জ্বল আকাশে !
কি কাজ পবিত্রি' মন্ত্রে জাহ্নবীর জলে ?
কি কাজ সুগন্ধ ঢালি পারিজাত-বাসে ?
প্রকৃত কবিতা রূপী কবিতার বলে,--
চীন-নারী-সম পদ কেন লৌহ ফাঁসে ?


"এতক্ষণে" --অরিন্দম কহিলা বিষাদে
"জানিনা কেমনে আসি লক্ষণ পশিল
রক্ষঃপুরে ! হায়, তাত, উচিত কি তব
একাজ, নিকষা সতী তোমার জননী,
সহোদর রক্ষশ্রেষ্ঠ ? --শূলী-শম্ভূনিভ
কুম্ভকর্ণ ? ভ্রাতৃপুত্র বাসব বিজয়ী ?
নিজগৃহপথ, তাত, দেখাও তস্করে ?
চণ্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে ?
কিন্তু নাহি গঞ্জি তোমা, গুরুজন তুমি
পিতৃতুল্য | ছাড় দ্বার, যাব অস্ত্রাগারে,
পাঠাইব রামানুজে শমন-ভবনে,
লঙ্কার কলঙ্ক আজি ভঞ্জিব আহবে |"
উত্তরিলা বিভীষণ;--"বৃথা এ সাধনা,
ধীমান্ ! রাঘবদাস আমি ; কি প্রকারে
তাঁহার বিপক্ষ কাজ করিব, রক্ষিতে
অনুরোধ ?" উত্তরিলা কাতরে রাবণি ;--
"হে পিতৃব্য, তব বাক্যে ইচ্ছি মরিবারে !
রাঘবের দাস তুমি ? কেমনে ও মুখে
আনিলে ও কথা, তাত, কহ তা দাসেরে !
স্থপিলা বিধুরে বিধি স্থানুর ললাটে ;
পড়ি কি ভূতলে শশী যান গড়াগড়ি
ধুলায় ? হে রক্ষোরথি, ভুলিলে কেমনে
কে তুমি ? জনম তব কোন্ মহাকুলে ?
কেবা সে অধম রাম ? স্বচ্ছ সরোবরে
করে ফেলি রাজ হংস পঙ্কজ কাননে ;
যায় কি সে কভু, পঙ্কিল সলিলে,
শৈবালদলের ধাম ? মৃগেন্দ্র কেশরী
কবে, হে বীর-কেশরী, সম্ভাষে শৃগালে
মিত্রভাবে ? অজ্ঞ দাস, বিজ্ঞতম তুমি,
অবিদিত নহে কিছু তোমার চরণে |
ক্ষুদ্রমতি নর, শূর, লক্ষণ ; নহিলে
অস্ত্রহীন যোধে কি সে সম্বোধে সংগ্রামে ?
কহ, মহারথি, একি মহারথিপ্রথা ?
নাহি শিশু লঙ্কাপুরে, শুনি না হাসিবে
এ কথা ! ছাড়হ পথ ; আসিব ফিরিয়া
এখনি ! দেখিব আজি, কোন্ দেববলে,
বিমুখে সমরে মোরে সৌমিত্রি কুমতি !
দেব-দৈত্য-নর-রণে, স্বচক্ষে দেখেছ,
রক্ষঃশ্রেষ্ঠ, পরাক্রম দাসের ! কি দেখি
ডরিবে এ দাস হেন দুর্বল মানবে ?
নিকুম্ভিলা-যজ্ঞাগারে প্রগল্ ভে পশিল
দম্ভী ; আজ্ঞা কর দাসে, শাস্তি নরাধমে |
তব জন্মপুরে, তাত, পদার্পণ করে
বনবাসী ! হে বিধাতঃ, নন্দন-কাননে
ভ্রমে দুরাচার দৈত্য ? প্রফুল্ল কমলে
কীটবাস ? কহ, তাত, সহিব কেমনে
হেন অপমান আমি,--ভ্রাতৃ পুত্র তব ?
তুমিও, হে রক্ষোমণি, সহিছ কেমনে ?"
মহামন্ত্রবলে যথা নম্রশিরঃ ফণী,
মলিনবদন লাজে, উত্তরিলা রথী
রাবণ-অনুজ, লক্ষি রাবণ-আত্মজে ;--
"নহি দোষী আমি, বত্স; বৃথা ভর্ত্স মোরে
তুমি ! নিজ কর্ম দোষে হায় মজাইলা
এ কনক-লঙ্কা রাজা, মজিলা আপনি !
বিরত সতত পাপে দেবকুল ; এবে
পাপপূর্ণ লঙ্কা পুরী ; প্রলয়ে যেমতি
বসুধা, ডুবিছে লঙ্কা এ কাল-সলিলে !
রাঘবের পদাশ্রয়ে রক্ষার্থে আশ্রয়ী
তেঁই আমি ! পরদোষে কে চাহে মজিতে ?"
রুষিলা বাসবত্রাস ! গম্ভীরে যেমতি
নিশীথে অম্বরে মন্দ্রে জীমূতেন্দ্র কোপি,
কহিলা বীরেন্দ্র বলী ;--"ধর্মপথগামী,
হে রাক্ষসরাজানুজ, বিখ্যাত জগতে
তুমি ;--কোন্ ধর্মমতে, কহ দাসে, শুনি,
জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতৃত্ব, জাতি,--এ সকলে দিলা
জলাঞ্জলি ? শাস্ত্রে বলে, গুণবান্ যদি
পরজন, গুণহীন স্বজন, তথাপি
নির্গুণ স্বজন শ্রেয়ঃ, পরঃ পরঃ সদা !
এ শিক্ষা হে রক্ষোবর, কোথায় শিখিলে ?
কিন্তু বৃথা গঞ্জি তোমা ! হেন সহবাসে,
হে পিতৃব্য, বর্বরত কেন না শিখিবে ?
গতি যার নীচ সহ, নীচ সে দুর্মতি |"



কপোতাক্ষ নদ

সতত, হে মদ, তুমি পড় মোর মনে |
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে ;
সতত ( যেমতি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া-যন্ত্রধ্বনি ) তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে!---
বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?
দুগ্ধ-স্রোতোরূপী তুমি জন্ম-ভূমি-স্তনে!
আর কি হে হবে দেখা?---যত দিন যাবে,
প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে
বারি-রূপ কর তুমি ; এ মিনতি, গাবে
বঙ্গজ-জনের কানে, সখে, সখা-রীতে
নাম তার, এ প্রবাসে মজি প্রেম-ভাবে
লইছে যে তব নাম বঙ্গের সঙ্গীতে!



সমাধি-লিপি

দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে
( জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম ) মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!
যশোরে সাগরদাঁড়ী কবতক্ষ-তীরে
জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী!


মাতৃভাষা

নিজাগারে ছিল মোর অমূল্য রতন
অগণ্য ; তা সবে আমি অবহেলা করি,
অর্থলোভে দেশে দেশে করিনু ভ্রমণ,
বন্দরে বন্দরে যথা বাণিজ্যের তরী |
কাটাইনু কতকাল সুখ পরিহরি,
এই ব্রতে, যথা তপোবনে তপোধন,
অশন, শয়ন ত্যাজে, ইষ্টদেবে স্মরি,
তাঁহার সেবায় সদা সঁপি কায় মন |
বঙ্গকুল-লক্ষ্মী মোরে নিশার স্বপনে
কহিলা--- "হে বত্স, দেখি তোমার ভকতি,
সুপ্রসন্ন তব প্রতি দেবী সরস্বতী!
নিজ গৃহে ধন তব, তবে কি কারণে
ভিখারী তুমি হে আজি, কহ ধন-পতি?
কেন নিরানন্দ তুমি আনন্দ-সদনে?"


কে তুমি,---বিজন বনে ভ্রম হে, একাকী,
বিভূতি-ভূষিত অঙ্গ? কি কৌতুকে, কহ,
বৈশ্বানর, লুকাইছ ভস্মের মাঝারে?
মেঘের আড়ালে যেন পূর্ণশশী আজি?
ফাটে বুক জটাজুট হেরি তব শিরে,
মঞ্জুকেশি! স্বর্ণশয্যা ত্যজি জাগি আমি
বিরাগে, যখন ভাবি, নিত্য নিশাযোগে
শয়ন, বারাঙ্গ তব, হায় রে, ভূতলে!
উপাদেয় রাজভোগ যোগাইলে দাসী,
কাঁদি ফিরাইয়া মুখ, পড়ে যাবে মনে
তোমার আহার নিত্য ফল মূল, বলি!
সুবর্ণ-মন্দিরে পশি নিরানন্দ গতি,
কেন না---নিবাস তব বঞ্জুল মঞ্জুলে!
হে সুন্দর, শীঘ্র আসি কহ মোরে শুনি---
কোন্ দুঃখে ভব-সুখে বিমুখ হইলা
এ নব যৌবনে তুমি? কোন্ অভিমানে
রাজবেশ ত্যজিলা হে উদাসীর বেশে?
হেমাঙ্গ মৈনাক-সম, হে তেজস্বি কহ,
কার ভয়ে ভ্রম তুমি এ বন সাগরে
একাকী, আবরি তেজঃ, ক্ষীণ, ক্ষুন্ন খেদে?
তোমার মনের কথা কহ আসি মোরে |---
যদি পরাভূত তুমি রিপুর বিক্রমে,
কহ শিঘ্র ; দিব সেনা ভব-বিজয়িনী,
রথ, গজ, অশ্ব, রথী---অতুল জগতে!
বৈজয়ন্ত-ধামে নিত্য শচিকান্ত বলী
ত্রস্ত অস্ত্র-ভয়ে যার, হেন ভীম রথী
যুঝিবে তোমার হেতু---আমি আদেশিলে!
চন্দ্রলোকে, সূর্যলোকে,---যে লোকে ত্রিলোকে
লুকাইবে অরি তব, বাঁধি আনি তারে
দিব তব পদে, শূর! চামুণ্ডা আপনি,
(ইচ্ছা যদি কর তুমি) দাসীর সাধনে,
(কুলদেবী তিনি, দেব,) ভীমখণ্ডা হাতে,
ধাইবেন হুহুঙ্কারে নাচিতে সংগ্রামে---
দেব-দৈত্য-নর-ত্রাস!---যদি অর্থ চাহ,
কহ শীঘ্র ; ---অলঙ্কার ভান্ডার খুলিব
তুষিতে তোমার মনঃ ; নতুবা কুহকে
শুষি রত্নাকরে, লুটি দিব রত্ন-জালে!
মণিযোনি খনি যত, দিব হে তোমারে!
প্রেম-উদাসীন যদি তুমি, গুণমণি,
কহ, কোন্ যুবতীর---(আহা, ভগ্যবতী
রামাকুলে সে রমণী!)---কহ শীঘ্র করি,---
কোন্ যুবতীর নব যৌবনের মধু
বাঞ্ছা তব? অনিমেষে রূপ তার ধরি,
(কামরূপা আমি, নাথ,) সেবিব তোমারে!
আনি পারিজাত ফুল, নিত্য সাজাইব
শয্যা তব! সঙ্গে মোর সহস্র সঙ্গিনী,
নৃত্য গীত রঙ্গে রত | অপ্সরা, কিন্নরী,
বিদ্যাধরী,---ইন্দ্রাণীর কিঙ্করী যেমতি,
তেমতি আমারে সেবে দশ শত দাসী |
সুবর্ণ-নির্মিত গৃহে আমার বসতি---
মুক্তাময় মাঝ তার ; সোপান খচিত
মরকতে ; স্তম্ভে হীরা ; পদ্মরাগ মণি ;
গবাক্ষে দ্বিরদ-রদ, রতন কপাটে!
সুকল স্বরলহরী উথলে চৌদিকে
দিবানিশি ; গায় পাখী সুমধুর স্বরে ;
সুমধুরতর স্বরে গায় বীণাবাণী
বামাকুল! শত শত কুসুম-কাননে
লুটি পরিমল, বায়ু অনুক্ষণ বহে!
খেলে উত্স ; চলে জল কল কল কলে!
কিন্তু বৃথা এ বর্ণনা | এস, গুণনিধি,
দেখ আসি,---এ মিনতি দাসীর ও পদে!
কায়, মনঃ, প্রাণ আমি সঁপিব তোমারে!
ভঞ্জ আসি রাজভোগ দাসীর আলয়ে ;
নহে কহ, প্রাণেশ্বর! অম্লান বদনে,
এ বেশ ভূষণ ত্যজি, উদাসিনী-বেশে
সাজি, পূজি, উদাসীন, পাদ-পদ্ম তব!
রতন কাঁচলি খুলি, ফেলি তারে দূরে,
আবরি বাকলে স্তন ; ঘুচাইয়া বেণী,
মণ্ডি জটাজূটে শিরঃ ; ভুলি রত্নরাজী,
বিপিন-জনিত ফুলে বাঁধি হে কবরী!
মুছিয়া চন্দন, লেপি ভস্ম কলেবরে |
পরি রুদ্রাক্ষের মালা, মুক্তামালা ছিঁড়ি
গলদেশে! প্রেম-মন্ত্র দিও কর্ণ-মূলে ;
গুরুর দক্ষিণা-রূপে প্রেম-গুরু-পদে
দিব এ যৌবন-ধন প্রেম-কুতূহলে!
প্রেমাধীনা নারীকুল ডরে কি হে দিতে
জলাঞ্জলি, মঞ্জুকেশি, কুল, মান, ধনে
প্রেম-লাভ লোভে কভু?---বিরলে লিখিয়া
লেখন, রাখিনু, সখে, এই তরুতলে |
নিত্য তোমা হেরি হেথা ; নিত্য ভ্রম তুমি
এই স্থলে | দেখ চেয়ে ; ওই যে শোভিছে
শমী,---লতাবৃতা, মরি, ঘোনটায় যেন,
লজ্জাবতী!---দাঁড়াইয়া উহার আড়ালে,
গতিহীনা লজ্জাভয়ে, কত যে চেয়েছি
তব পানে, নরবর---হায়! সূর্যমুখী
চাহে যথা স্থির-আঁখি সে সূর্যের পানে!---
কি আর কহিব তার? যত ক্ষণ তুমি
থাকিতে বসিয়া, নাথ ; থাকিত দাঁড়ায়ে
প্রেমের নিগড়ে বদ্ধা এ তোমার দাসী!
গেলে তুমি শূণ্যাসনে বসিতাম কাঁদি!
হায় রে, লইয়া ধূলা, সে স্থল হইতে
যথায় রাখিতে পদ, মাখিতাম ভালে,
হব্য-ভস্ম তপস্বিনী মাখে ভালে যথা!
কিন্তু বৃথা কহি কথা! পড়িও নৃমণি,
পড়িও এ লিপিখানি, এ মিনতি পদে!
যদিও ও হৃদয়ে দয়া উদয়ে, যাইও
গোদাবরী-পূর্বকূলে ; বসিব সেখানে
মুদিত কুমুদীরূপে আজি সায়ংকালে ;
তুষিও দাসীরে আসি শশধর-বেশে!
লয়ে তরি সহচরী থাকিবেক তীরে ;
সহজে পাইবে পার | নিবিড় সে পারে
কানন, বিজন দেশ | এস, গুণনিধি!
দেখিব প্রেমের স্বপ্ন জাগি হে দুজনে!
যদি আজ্ঞা দেহ, এবে পরিচয় দিব
সংক্ষেপে | বিখ্যাত, নাথ, লঙ্কা, রক্ষঃপুরী
স্বর্ণময়ী, রাজা তথা রাজ-কুল-পতি
রাবণ, ভগিনী তাঁর দাসী ; লোকমুখে
যদি না শুনিয়া থাক, নাম সূর্পনখা |
কত যে বয়স তার ; কি রূপ বিধাতা
দিয়েছেন, আশু আসি দেখ, নরমণি!
আইস মলয়-রূপে ; গন্ধহীন যদি
এ কুসুম, ফিরে তবে যাইও তখনি!
আইস ভ্রমর-রূপে ; না যোগায় যদি
মধু এ যৌবন-ফুল, যাইও উড়িয়া
গুঞ্জরি বিরাগ-রাগে! কি আর কহিব?
মলয় ভ্রমর, দেব, আসি সাধে দোহে
বৃন্তাসনে মালতীরে! এস, সখে, তুমি ;---
এই নিবেদন করে সূর্পনখা পদে |
শুন নিবেদন পুনঃ | এত দূর লিখি
লেখন, সখীর মুখে শুনিনু হরষে,
রাজরথী দশরথ অযোধ্যাধিপতি,
পুত্র তুমি, হে কন্দর্প-গর্ব্ব-খর্ব্ব-কারি,
তাঁহার ; অগ্রজ সহ পশিয়াছ বনে
পিতৃ-সত্য-রক্ষা-হেতু | কি আশ্চর্য্য! মরি,---
বালাই লইয়া তব, মরি, রঘুমণি,
দয়ার সাগর তুমি! তা না হলে কভু
রাজ্য-ভোগ ত্যজিতে কি ভাতৃ-প্রেম-বশে?
দয়ার সাগর তুমি | কর দয়া মোরে,
প্রেম-ভিখারিনী আমি তোমার চরণে!
চল শীঘ্র যাই দোঁহে স্বর্ণ লঙ্কাধামে |
সম পাত্র মানি তোমা, পরম আদরে,
অর্পিবেন শুভ ক্ষণে রক্ষঃ-কুল-পতি
দাসীরে কমল-পদে | কিনিয়া, নৃমণি,
অযোধ্যা-সদৃশ রাজ্য শতেক যৌতুকে,
হবে রাজা ; দাসী-ভাবে সেবিবে এ দাসী!
এস শীঘ্র, প্রাণেশ্বর ; আর কথা যত
নিবেদিব পাদ-পদ্মে বসিয়া বিরলে |
ক্ষম অশ্রু-চিহ্ন পত্রে ; আনন্দে বহিছে
অশ্রু-ধারা! লিখেছে কি বিধাতা এ ভালে
হেন সুখ, প্রাণসখে? আসি ত্বরা করি,
প্রশ্নের উত্তর, নাথ, দেহ এ দাসীরে |


0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম