শাহাদাতের অমিয় সূধা পান করতে কেন এই তীব্র আকাঙক্ষা?

পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া কারো ঈমান গ্রহণযোগ্য নয়, তাই যুগে যুগে আল্লাহ নবী-রাসুল থেকে শুরু করে ঈমানের দাবীদারদের ঈমান পরীক্ষা করে ছেড়েছেন । এ অমোঘ বিধান সবার বেলায় সমানভাবেই প্রযোজ্য হয়েছে। কেননা তিনি স্বয়ং কুরআনের সুরা আনকাবুতের ৩য় আয়াতেই বলেছেন:
وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ
‘’আমি অতীতের ঈমানের দাবীদারদের পরীক্ষা করেছি, সুতরাং এখনো যারা ঈমানের দাবী করবে আমাকে তাদের সবাইকে পরীক্ষা করে দেখতেই হবে যে, তাঁরা তাদের ঈমানের দাবীতে সত্যিকার দাবীদার নাকি মিথ্যাবাদী’’ ।


 তিনি যাকে ঈমানের দাবীতে কামিয়াব পেয়েছেন তাঁর ঈমান তিনি কবুল করেছেন; তাঁদের কাউকে নবী হিসেবে সুউচ্চ মর্যাদা দানে ভুষিত করেছেন, আবার কাউকে সাহাবী হিসেবে, কাউকে আবার তাবেয়ী হিসেবে, আবার কাউকে মুসলিম মিল্লাতের মুজতাহিদ ইমাম হিসেবে সম্মানিত করেছেন। কেননা শুধু দাবী করলেই যদি মানুষকে সবকিছু দিয়ে দেয়া হত তাহলে বিনা প্রমাণে একজন অন্যজনের রক্ত ও সম্পদ দাবী করত। সুতরাং মানুষের মধ্যে দাবীদারের সংখ্যা প্রচুর। তাই বলা হল, সাক্ষী ছাড়া দাবী গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ
“বলুন, যদি তোমরা আল্লাহ্কে ভালবাস তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহ্ও তোমাদেরকে ভালবাসেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ্ হলেন ক্ষমাকারী, দয়ালু”। (সূরা আল-ইমরানঃ ৩১) এই আয়াত শুনে সকলেই পিছিয়ে পড়ল। যারা কথায়, কাজে ও আচার-আচরণে রাসূল (সা)-এর অনুসরণ করে শুধু তারাই রয়ে গেল। এবার তাদের সত্যতা যাচাই করার প্রয়োজন হল। যারা আল্লাহ্র পথে জেহাদ করবে এবং কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারে ভীত হবে না প্রকৃত তারাই আল্লাহকে এবং তাঁর রাসূলকে ভালবাসে। সুতরাং যারা কথায় ও কাজে রাসূল (সা)-এর সুন্নাতের অনুরণের দাবী করে; কিন্তু আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে প্রস্তুত নয় তাদের অধিকাংশই কেটে পড়ল। প্রকৃত মুজাহিদগণ সামননে আসল। তাদেরকে বলা হল, আল্লাহর প্রতি এবং রাসূলের প্রতি ভালবাসা পোষণকারীদের জান ও মাল তাদের নিজেদের নয়। কেননা আল্লাহ্ তাআলা তাদের জান-মাল জান্নাতের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন। সুতরাং তোমাদের সাথে যেই বিষয়ে চুক্তি হয়েছে, তা সোপর্দ করে দাও। কেননা ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তিতে উভয় পক্ষের উপরই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করা জরুরী। ক্রেতা মূল্য পরিশোধ করবে আর বিক্রেতা পণ্য সোপর্দ করে দিবে।
তাদেরকে তোমরা মৃত মনে করো না:
কারণ দুনিয়ার স্বাদ ও সম্পদ ক্ষণস্থায়ী; কিন্তু পার্থিব জীবনের কৃতকর্মের ফলাফল সুদূর প্রসারী। যারা সামান্য স্বাদ ও স্বার্থের বিনিময়ে স্থায়ী সুখ-শান্তিকে বিক্রয় করে দেয় তাদেরকে মূর্খদের কাতারেই গণ্য করা হয়। সুতরাং মুজাহিদরা স্বেচ্ছায় ও সন্তুষ্ট চিত্তে ক্রেতার (আল্লাহর) সাথে বাইআতুর রিযওয়ানের চুক্তি সম্পাদন করল এবং বললঃ আল্লাহর শপথ! আমরা কখনই এই বাইত (চুক্তি) ভঙ্গ করব না। সুতরাং যখন চুক্তিটি সম্পাদিত ও পূর্ণ হল এবং মুজাহিদগণ পণ্য সোপদ করল তখন তাদেরকে বলা হল এখন তোমাদের জান ও মাল আল্লাহর মালিকানায় চলে গেছে । তবে এখন তা পূর্বের চেয়ে অধিক পরিপূর্ণ ও সবল অবস্থায় এবং বৃদ্ধিসহকারে তোমাদের নিকটই ফেরত দেয়া হচ্ছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
وَلاَ تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُواْ فِى سَبِيلِ اللهِ أَمْوَاتاً بَلْ أَحْيَاءٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ
“আর যারা আল্লাহ্র রাহে নিহত হয়, তাদেরকে তুমি কখনো মৃত মনে করো না। বরং তারা নিজেদের পালনকর্তার নিকট জীবিত ও জীবিকাপ্রাপ্ত”। (সূরা আল-ইমরানঃ ১৬৯) তাদেরকে আরও বলা হল, লাভ করার জন্য তোমাদের কাছ থেকে তোমাদের জান ও মাল ক্রয় করা হয় নি; বরং এই ক্রয়-বিক্রয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে যাতে তোমাদের থেকে সাহসিকতা ও দানশীলতা প্রকাশ পায় এবং মূল্য এবং পণ্য উভয়টিই তোমাদের কাছে ফেরত দেয়া যায়।
তারা বড়ই লাভবান ব্যবসা করেছে:
প্রিয় পাঠক! আপনি জাবের (রাঃ)এর ঘটনাটি নিয়ে চিন্তা করুন। রাসূল (সা) তাঁর কাছ থেকে একটি উট ক্রয় করেছিলেন। তিনি জাবেরকে উটের পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করলেন, তার সাথে আরও বাড়িয়ে দিলেন এবং পরিশেষে তাঁর উট তাঁকেই ফেরত দিলেন। প্রিয় পাঠক! আপনি সেই সাথে জাবের (রাঃ)এর পিতা আব্দুল্লাহ-এর ঘটনাও স্মরণ করুন। আল্লাহ্ তাঁর সাথে কিরূপ আচরণ করেছেন, তাও স্মরণ করুন। জাবের (রাঃ)এর পিতা আব্দুল্লাহ্ উহুদ যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। রাসূল (সা) জাবেরকে বললেনঃ হে জাবের! আল্লাহ্ তা’আলা তোমার পিতাকে জীবিত করেছেন। তাঁর সাথে সরাসরি এবং খোলাখুলি কথা বলেছেন। আল্লাহ্ তাআলা তাঁকে বলেছেনঃ তুমি চাও। যা চাইবে তাই তোমাকে দেয়া হবে। সুতরাং তিনি বলেছিলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে পুনরায় জীবিত করে দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিন। আমি দ্বিতীয়বার আপনার রাস্তায় জিহাদ করে শহীদ হব’।
সেই মহান আল্লাহ্ অতীব পবিত্র, যার দয়ার সাগর এত বিশাল যে, সৃষ্টির জ্ঞান দ্বারা তা উপলদ্ধি করা অসম্ভব। তিনি মুমিন মুজাহিদ বান্দার পণ্য তাকেই ফেরত দেন, মূল্যও ফেরত দেন, চুক্তি পরিপূর্ণ করার তাওফীকও দেন, পণ্যের দোষ থাকলে কিনে নেন এবং ভালভাবে মূল্য পরিশোধ করেন। বান্দার নফসকে নিজরে মালের বিনিময়ে ক্রয় করেন। অতঃপর পণ্য ও মূল্য উভয়টিই ফেরত দিয়ে বান্দার এবং চুক্তিপত্রের প্রশংসা করেন। অথচ তাঁর তাওফীক ও ইচ্ছাতেই চুক্তি অনুযায়ী বান্দার আমল সংঘটিত হয়।
জান্নাত তাদের একমাত্র ঠিকানা:
আল্লাহ্ তাআলা এবং দারুস্ সালাম তথা জান্নাতের দিকে আহবানকারী (মুহাম্মাদ (সা)) গর্বিত আত্মাসমূহ এবং উচ্চ আকাঙ্খা পোষণকারীদেরকে সজাগ করেছেন। ঈমানের আহবানকারী (মুহাম্মাদ) উন্মুক্ত কর্ণের এবং জীবনন্ত প্রাণের অধিকারীদেরকে শুনিয়ে দিয়েছেন। এই শ্রবণ থেকেই আবরারদের (সৎকর্মশীলদের) মনিঞ্জলের দিকে তাদের যাত্রা শুরু হয়েছে। দারুল কারার তথা জান্নাত তাদের একমাত্র ঠিকানা। সেখানে না পৌঁছা পর্যন্ত তাদের সফর চলতেই থাকবে। রাসূল (সা) বলেনঃ
انْتَدَبَ اللَّهُ لِمَنْ خَرَجَ فِي سَبِيلِهِ لا يُخْرِجُهُ إِلاَّ إِيمَانٌ بِي وَتَصْدِيقٌ بِرُسُلِي أَنْ أُرْجِعَهُ بِمَا نَالَ مِنْ أَجْرٍ أَوْ غَنِيمَةٍ، أَوْ أُدْخِلَهُ الْجَنَّةَ. وَلَوْلا أَنْ أَشُقَّ عَلَى أُمَّتِي مَا قَعَدْتُ خَلْفَ سَرِيَّةٍ، وَلَوَدِدْتُ أَنِّي أُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، ثُمَّ أُحْيَا، ثُمَّ أُقْتَلُ، ثُمَّ أُحْيَا، ثُمَّ أُقْتَلُ
“আল্লাহ তাআলা ঐ ব্যক্তির যিম্মাদার হবেন, যে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করার উদ্দেশ্যে বের হয়। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ তার বের হওয়া কেবল আমার প্রতি ঈমান ও আমার রাসূলদেরকে সত্যায়নের কারণেই। তার সাথে আমার এই অঙ্গীকার রয়েছে যে, হয়ত আমি তাকে বিনিময় প্রদান করব অথবা গনীমতের মালামালসহ ঘরে ফিরিয়ে আনব অথবা শাহাদাতের মাধ্যমে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবো। রাসূল (সা) বলেনঃ আমার উম্মাতের উপর যদি কষ্ট না মনে করতাম, তাহলে কোন যুদ্ধ হতেই আমি পিছিয়ে থাকতামনা। আমার ভাল লাগে যে, আমি আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হই। অতঃপর জীবিত হয়ে আবার শহীদ হই। অতঃপর জীবিত হয়ে আবার শহীদ হই”। তিনি আরও বলেনঃ
مَثَلُ الْمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِمَنْ يُجَاهِدُ فِي سَبِيلِهِ كَمَثَلِ الصَّائِمِ الْقَائِمِ. وَتَوَكَّلَ اللَّهُ لِلْمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِهِ بِأَنْ يَتَوَفَّاهُ أَنْ يُدْخِلَهُ الْجَنَّةَ أَوْ يَرْجِعَهُ سَالِمًا مَعَ أَجْرٍ أَوْ غَنِيمَةٍ
“যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে, আল্লাহই ভাল জানেন কে তাঁর পথে জিহাদ করে, সে এমন এক রোজাদারের ন্যায় যে অবিরাম রোজা রাখে ও নামায আদায় করে। আল্লাহ তাআলা তাঁর পথে জিহাদকারীর ব্যাপারে এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন যে, সে মৃত্যু বরণ করলে তাকে জান্নাত দান করবেন অথবা নিরাপদে পুরস্কার ও গণীমতসহ ঘরে ফিরিয়ে আনবেন। রাসূল (সা) আরও বলেনঃ
لَغَدْوَةٌ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَوْ رَوْحَةٌ خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيهَا
“আল্লাহর রাস্তায় একটা সকাল অথবা একটা বিকাল ব্যয় করা দুনিয়া এবং এর মধ্যস্থিত সকল কিছু থেকে উত্তম”। তিনি আরও বলেনঃ তোমরা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ কর। কেনন্ াআল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা বেহেশতের অন্যতম একটি দরজা। এর মাধ্যমে আল্লাহ্ তাআলা বান্দাকে দুশ্চিন্তা ও পেরেশানী হতে মুক্ত করেন। রাসূল (সা) আরও বলেনঃ
‘আমি ঐ ব্যক্তির যিম্মাদার’:
‘আমি ঐ ব্যক্তির যিম্মাদার, যে আমার প্রতি ঈমান আনয়ন করেছে, আনুগত্য করেছে এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে। তার জন্য রয়েছে জান্নাতের এক পার্শ্বে একটি ঘর, জান্নাতের মাঝখানে একটি ঘর এবং জান্নাতের উপরে একটি ঘর। যে উপরোক্ত আমল করবে তথা রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়ন করেবে, আনুগত্য করেবে এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেবে, কোন কল্যাণই তার হাত ছাড়া হবে না এবং কোন অকল্যাণেরই তার ভয় থাকবে না। সে যেখানে ইচ্ছা সেখানেই মৃত্যু বরণ করুক। রাসূল (সা) আরও বলেনঃ
مَنْ قَاتَلَ فِى سَبِيلِ اللَّهِ فُوَاقَ نَاقَةٍ فَقَدْ وَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ
“একটি উটনী দোহন করতে যতটুকু সময় লাগে যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় ঠিক ততটুকু সময় জিহাদ করবে, তার জন্য জান্নাত আবশ্যক হয়ে যাবে”। রাসূল (সা) বলেনঃ
إِنَّ فِي الْجَنَّةِ مِائَةَ دَرَجَةٍ أَعَدَّهَا اللَّهُ لِلْمُجَاهِدِينَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، مَا بَيْنَ الدَّرَجَتَيْنِ كَمَا بَيْنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ، فَإِذَا سَأَلْتُمُ اللَّهَ فَاسْأَلُوهُ الْفِرْدَوْسَ، فَإِنَّهُ أَوْسَطُ الْجَنَّةِ، وَأَعْلَى الْجَنَّةِ، أُرَاهُ فَوْقَهُ عَرْشُ الرَّحْمَنِ، وَمِنْهُ تَفَجَّرُ أَنْهَارُ الْجَنَّةِ
“জান্নাতের একশটি স্তর রয়েছে। আল্লাহ তাআলা তা মুজাহিদদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন। প্রত্যেক দু’ স্তরের মধ্যকার ব্যবধান হচ্ছে আসমান ও যমিনের ব্যবধানের সমান। সুতরাং যখন তোমরা আল্লাহর কাছে জান্নাত চাইবে তখন তোমরা জান্নাতুল ফিরদাউস চাও। কেননা এটি হচ্ছে জান্নাতের সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম জান্নাত। বর্ণনাকারীর ধারণাঃ রাসূল (সা) তারপর বলেছেনঃ উহার উপর আল্লাহর আরশ এবং তা থেকে জান্নাতের নদীসমূহ প্রবাহিত হয়েছে”।
রাসূল (সা) আরও বলেনঃ যে ব্যক্তি কোন মুজাহিদকে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে, ঋণদারকে ঋণ পরিশোধ করতে এবং চুক্তিবদ্ধ কোন দাসকে দাসত্বের বন্ধন মুক্ত হতে সাহায্য করবে, আল্লাহ্ তাঁকে সেই দিন স্বীয় ছাড়া দান করবেন, যেই দিন তাঁর ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবে না।
রাসূল (সা) আরও বলেনঃ مَنِ اغْبَرَّتْ قَدَمَاهُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، حَرَّمَهُ اللَّهُ عَلَى النَّار
“যে ব্যক্তির দু’পা আল্লাহর রাস্তায় ধুলিমাখা হবে তাকে আল্লাহ তাআলা জাহান্নামের জন্য হারাম করে দিবেন”।
একদিন এবং এক রাত পাহারা দেওয়াই উত্তম:
রাসূল (সা) আরও বলেনঃ
لاَ يَجْتَمِعُ شُحٌ وَإِيمَانٌ فى قَلْبِ رَجُلٍ وَاحِدٍ، وَلاَ يَجْتَمِعُ غُبَارٌ فى سَبِيلِ اللهِ وَدُخَانُ جَهنَّمَ فِى وَجْهِ عَبْدٍ
“কৃপণতা ও ঈমান একই ব্যক্তির অন্তরে একত্রিত হতে পারে না এবং আল্লাহর রাস্তার ধুলাবালি ও জাহান্নামের ধোঁয়া একই ব্যক্তির চেহারায় একত্রিত হতে পারে না”। রাসূল (সা) আরও বলেনঃ
رِبَاطُ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ خَيْرٌ مِنْ صِيَامِ شَهْرٍ وَقِيَامِهِ، وَإِنْ مَاتَ، جَرَى عَلَيْهِ عَمَلُهُ الَّذِى كان يَعْمَلُهُ
، وَأُجْرىَ عَلَيْهِ رِزْقُه وَأَمِنَ الفَتَّان
“আল্লাহর রাস্তায় একদিন এবং এক রাত পাহারা দেয়া একমাস দিনের বেলায় রোজা রাখা এবং রাতের বেলায় কিয়াম করা হতেও উত্তম। পাহারা দেয়া অবস্থায় সে যদি মারা যায়, তাহলে সে জীবিত থাকতে যে আমল করত তার জন্য সেই আমলের ছাওয়াব লেখা হতে থাকবে, তাঁকে রিযিক দেয়া হতে থাকবে এবং সে ফিতনা হতে নিরাপদ থাকবে”।
কোন একজন লোক ভ্রমণকালে সারা রাত ঘোড়ায় আরোহন করে মুসলমানদেরকে সন্ধ্যা হতে সকাল পর্যন্ত পাহারা দিল। শুধু নামায আদায়ের জন্য কিংবা পেশাব-পায়খানার প্রয়োজন ছাড়া সারা রাত সে ঘোড়া থেকে অবতরণ করেনি। তাকে লক্ষ্য করে নবী (সা) বলেছেনঃ তোমার জন্য বেহেশত আবশ্যক হয়ে গেছে। আজকের পরে যদি তুমি আর কোন আমল নাও কর, তাহলে তোমার কোন অসুবিধা হবে না। ইমাম আবু দাউদ (রঃ) নবী (সা) থেকে আরও বর্ণনা করেন যে,
مَنْ لَمْ يَغْزُ، أَوْ يُجَهِّزْ غَازِيَاً، أَوْ يُخَلِّفْ غَازِيَاً فى أَهْلِهِ بِخَيْرٍ، أَصَابَهُ اللهُ بِقَارِعَةٍ قَبْلَ يَوْمِ القِيَامَةِ
“যে ব্যক্তি জিহাদ করবে না অথবা কোন মুজাহিদের হাতিয়ার প্রস্তুত করে দিবে না কিংবা কোন মুজাহিদের পরিবার-পরিজনকে ভালভাবে দেখা-শুনা করবে না, কিয়ামতের পূর্বে আল্লাহ্ তাআলা তাঁকে অবশ্যই কোন না কোন মুসিবতে আক্রান্ত করবেন’’। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ وَلاَ تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إلَى التَّهْلُكَةِ
“নিজের জীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না”। (সূরা বাকারাঃ ১৯৫) আবু আইয়্যুব আনসারী (রঃ) এই আয়াতের ব্যখ্যায় বলেনঃ ‘তোমরা আল্লাহর রাস্থায় জিহাদ ছেড়ে দিয়ে নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না’। নবী (সা) থেকে সহীহ সূত্রে আরও বর্ণিত হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম তিন ব্যক্তির মাধ্যমে জাহান্নামের আগুন প্রজ্বলিত করা হবে। রিয়াকারী আলেম। অর্থাৎ যে ব্যক্তি মানুষের সুনাম ও প্রশংসা অর্জনের আশায় ইলম অর্জন করবে। (২) যে ব্যক্তি মানুষকে শুনানোর জন্য দান করবে এবং (৩) যে ব্যক্তি শুধু মানুষকে বীরত্ব প্রদর্শনের নিয়তে জিহাদ করে শহীদ হবে। ‘যাদুল মাআদ ফী হাদয়ী খাইরিল ইবাদ’ থেকে সংকলিত ।
শাহাদাতের মৃত্যু মুমিন জীবনের আসল সফলতা
একজন মুমিনের নিকট ঈমানের অপরিহার্য দাবী শাহাদাতের মৃত্যু। সৃষ্টির আদি থেকে এ যাবৎ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণহীন ধারাবাহিকতা, সত্য ও মিথ্যার চিরন্তন সংঘাত, কল্যাণ ও অকল্যাণের রশি টানাটানি, আলো ও আঁধারের বৈপরীত্য। তার জীবনের একান্ত – ব্যক্তিগত ও গোপনীয় বিষয়; হৃদয়ের আবেগ অনুভূতির প্রকাশ, সামাজিক তৎপরতায় অংশগ্রহণ, অর্থনৈতিক লেনদেন, রাজনৈতিক প্রতিপত্তি, সাংস্কৃতিক মননশীলতা, অবসর ও বিনোদন, শয়ন ও জাগরণ সব কিছুই বিল্পবী ঘোষণা দেবে শাহাদাতের চূড়ান্ত- প্রত্যাশা, মুমিনের জীবন চলার প্রতিটি কদম, তাদের প্রতিটি স্পর্শ, চাহনীর প্রতিটি পলক, জিহ্বার প্রতিটি বুলি, ব্যয়ের প্রতিটি কপর্দক, সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত, রক্তের প্রতিটি ফোঁটা এবং হৃদয়ের সবগুলো অনুভূতি শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করার জন্য থাকে সতত নিবেদিত। এ আল্লাহ তায়ালার এক অপূর্ব ও অশ্রুত নিয়ামত, যারা লাভ করেছে তারাই ধন্য হয়েছে।
শাহাদাহ শব্দটির অর্থ:
শাহাদাত বা শাহাদাহ শব্দটি অতি ব্যাপক ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি আরবী শব্দ, এর সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষন দরকার, মূল শব্দ ‘শাহদ’ থেকে এর উৎপত্তি। আর এ শব্দ থেকেই নির্গত হয়েছে শহীদ/শাহিদ, শুহূদ-মাশহূদ-মুশাহাদাহ বা তাশাহহুদ প্রভৃতি শব্দ। এগুলো খুবই প্রচলিত শব্দ। শাহাদাত শব্দের অর্থ হলো সাক্ষ্য। এ থেকে শহীদ ও শাহেদ শব্দ এসেছে। শাহেদ মানে যে দেখেছে বা সাক্ষ্য দিয়েছে। সাক্ষী সেই দেয় যে নিজে স্বচক্ষে দেখে। আশ-শাহিদ মানে আমি দেখার জন্য ঐ স্থানে উপস্থিত ছিলাম, আমি নিজে দেখেছি, এভাবেই দেখা, সাক্ষ্য দেয়া অর্থে শাহাদাত শব্দ ব্যবহার করা হয়।
ইমাম রাগিব ইসপাহানী এবং অন্যান্য আরবী ভাষাতত্ত্ববিদ শব্দটির অর্থ মোটামুটি একইরূপ লিখেছেন। কেউ লিখেছেন শহদ মানে উপস্থিত হয়ে স্বচক্ষে দেখে কিংবা অন্যের দৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করে সাক্ষ্য দেয়া। আবার কেউ বলেছেন- শাহাদাত হচ্ছে এমন জ্ঞান বা জ্ঞানের বিবরণ যা চোখে দেখে বা অন্যের দৃষ্টির মাধ্যমে অর্জিত হয়। কুরআনে শাহাদাত শব্দের ব্যবহার: আল্লাহর রাহে জীবন উৎসর্গ করার ক্ষেত্রে প্রেরণাদাত্রী মহাগ্রন্থ আল কুরআনের ভূমিকা অপরিসীম। শাহাদাত শব্দটি তাই ব্যবহৃত হয়েছে বিভিন্নভাবে। আমরা এখানে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত কয়েকটি আয়াত নিম্নে উপস্থাপন করছিঃ
ক) আদর্শের সাক্ষ্য (নমূনা) অর্থে:
“হে নবী। আমরা তোমাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষী, সুসংবাদদাতা এবং ভয় প্রদর্শনকারী হিসেবে।” (আল-আহযাবঃ ৪৫) يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا ।
“আর এভাবেই আমরা তোমাদেরকে একটি মধ্যপন্থী উম্মাহ করেছি, যাতে করে তোমরা মানব জাতির উপর সাক্ষী হতে পারো।” وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِّتَكُونُواْ شُهَدَاء عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا (বাকারা ১৪৩)। “যেন রাসূল তোমাদের উপর সাক্ষী হতে পারেন, এবং তোমরা গোটা মানব জাতির উপর সাক্ষী হতে পারো।”
وَجَاهِدُوا فِي اللَّهِ حَقَّ جِهَادِهِ هُوَ اجْتَبَاكُمْ وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ (আল-হাজ্জ ৭৮)
খ) আল্লাহর পথে নিহত হবার অর্থেঃ
إِن يَمْسَسْكُمْ قَرْحٌ فَقَدْ مَسَّ الْقَوْمَ قَرْحٌ مِّثْلُهُ وَتِلْكَ الأيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ النَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللّهُ الَّذِينَ آمَنُواْ وَيَتَّخِذَ مِنكُمْ شُهَدَاء “তোমাদের উপর এ দুরাবস্থা এ জন্য চাপানো হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা এভাবে জেনে নিতে চান তোমাদের মধ্যে কারা সাচ্চা ঈমানদার এবং এইজন্যে যে তিনি তোমাদের কিছু লোককে শহীদ হিসেবে গ্রহণ করতে চান।” (আলে-ইমরানঃ ১৪০) । وَمَن يُطِعِ اللّهَ وَالرَّسُولَ فَأُوْلَـئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللّهُ عَلَيْهِم مِّنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاء وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ أُولَـئِكَ رَفِيقًا “যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের আনুগত্য করবে সে ঐসব লোকদের সংগী হবে যাদের নিয়ামত দান করা হয়েছে, তারা হলো-নবী, সিদ্দীক, শহীদ এবং সালেহ, আর তাদের সান্নিধ্যই হলো উত্তম।” (আন-নিসাঃ ৬৯)
গ) উপস্থিত থেকে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা অর্থেঃ
وَلْيَشْهَدْ عَذَابَهُمَا طَائِفَةٌ مِّنَ الْمُؤْمِنِينَ “আর তাদেরকে শাস্থি দেয়ার সময় একদল ঈমানদার লোক যেন উপস্থিত থেকে প্রত্যক্ষ করে।”(নূরঃ ২)
ঘ) জ্ঞান, অবগতি ও জানা অর্থেঃ
وَاتَّقِينَ اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدًا …“আল্লাহ প্রতিটি জিনিসের উপর সাক্ষ্য অর্থাৎ প্রতিটি বিষয়ে তিনি অবগত, তার জ্ঞানের বাইরে কোনো কিছু নেই।” (আহযাবঃ ৫৫)
ঙ) আদালতের সাক্ষ্য অর্থেঃ
وَالَّذِينَ يَرْمُونَ الْمُحْصَنَاتِ ثُمَّ لَمْ يَأْتُوا بِأَرْبَعَةِ شُهَدَاء فَاجْلِدُوهُمْ ثَمَانِينَ جَلْدَةً وَلَا تَقْبَلُوا لَهُمْ شَهَادَةً أَبَدًا وَأُوْلَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ “আর যারা পবিত্র চরিত্রের নারীদের সম্পর্কে মিথ্যা দোষারোপ করবে অতপর (দাবীর সপক্ষে) চারজন সাক্ষী উপসি’ত করতে পারবে না তাদের আশিটি কড়া মারো এবং এ ধরণের লোকদের সাক্ষ্য আর কখনো গ্রহণ করোনা।” (আন-নূরঃ ৪) ।

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُونُواْ قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاء لِلّهِ وَلَوْ عَلَى أَنفُسِكُمْ أَوِ الْوَالِدَيْنِ وَالأَقْرَبِينَ إِن يَكُنْ غَنِيًّا أَوْ فَقَيرًا
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা ন্যায় বিচারের ধারক হও এবং আল্লাহর জন্যে সাক্ষী হও, তোমাদের এই সুবিচার ও সাক্ষ্য যদি তোমাদের নিজেদের, তোমাদের পিতামাতার এবং তোমাদের আত্মীয় স্বজনদের বিপক্ষেও যায়।” (আন-নিসাঃ ১৩৫) । এমনিভাবে আল-কুরআনের বহু জায়গায় শাহাদাত শব্দের প্রয়োগ হয়েছে।
শাহাদাত ঈমানের অপরিহার্য দাবী:
মুমিনের নিকট “শাহাদাত” ঈমানের অপরিহার্য দাবী। শাহাদাতের কামনা যদি কোন মুমিন জীবনে থাকে তাহলে সে আল্লাাহর পথে লড়াইয়ে কোন সময় গাফেল হতে পারে না। কারণ জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ ছাড়া শাহাদাতের দ্বিতীয় কোন পথ নেই। একজন ভাল ছাত্র যেমন ভাবে ফলাফলের প্রমাণ দেবার জন্য পরীক্ষা কামনা করে তেমনি একজন মুমিন শাহাদাতের মাধ্যমে বিজয়ী হবার জন্য বাতিলের বিরুদ্ধে হকের সংগ্রামে আপোষহীনভাবে লড়াই করে যাবে। আন্দোলনের কর্মকাণ্ডে বাতিলের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যদি সে উৎসাহ পায় মৃত্যু অথবা অন্যান্য প্রতিকূলতা তাকে গাফেল করে না রাখে তাহলে বুঝতে হবে শাহাদাতের কামনা তার মধ্যে উপস্থিত রয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহর পথে লড়াই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, فَلْيُقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللّهِ الَّذِينَ يَشْرُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا بِالآخِرَةِ وَمَن يُقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللّهِ فَيُقْتَلْ أَو يَغْلِبْ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا “আল্লাহর পথে লড়াই করা কর্তব্য সেই সব লোকেরই যারা পরকালের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবন বিক্রয় করে দেয়, আল্লাহর পথে যে লড়াই করে ও নিহত হয়, কিংবা বিজয়ী হয়, তাকে আমরা অবশ্যই বিরাট ফল দান করব।” (আন-নিসাঃ ৭৪)
শাহাদাতের মর্যাদা:
একজন মু’মিনের শাহাদাতের তামান্নায় সততঃ উজ্জীবিত, শাহাদাতের এই অমিয় সূধা পান করতে কেন এই তীব্র আকাঙক্ষা? কেন জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও তার এই পরম চাওয়া-পাওয়ার শাহাদাত চাই-ই? সব রকম নেকীর উপর আরেকটা নেকী থাকে। সকল কুরবাণীর উপরই কুরবাণী আছে। সকল ত্যাগের উপরই ত্যাগ আছে। কিন’ আল্লাহর পথে শহীদ হবার চেয়ে বড় কোন নেকী, এর চেয়ে বড় কোন ত্যাগ ও কুরবাণী হতে পারে না, এটাই মানব জীবনের সকল নেকী ও পুণ্যের চূড়ান্ত শিখর। এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা শহীদকে অকল্পনীয় উচ্চ মর্যাদা ও সম্মান দান করেন, শাহাদাতের এই দরজা নবুয়্যতের দরজার চেয়ে বড় না হলেও শহীদ হবার জন্য স্বয়ং নবীও তীব্র আকাঙক্ষা পোষণ করেন। এ সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্যেই আল্লাহ পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় এবং বহু সংখ্যক হাদীসে বর্ণিত আছে শহীদদের মহা পুরস্কার ও সম্মান মর্যাদার কথা।
শাহাদাতের এ মর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা) কী বলেনঃ
১। শহীদরা অমর:
ইহলৌকিক এ জীবন থেকে শহীদরা বিদায় নিয়েও পৃথিবীতে তারা অমরত্ব লাভ করেন। আর পরজগতে যাওয়ার সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালা তাদের জীবিত করে নিজের মেহমান হিসেবে জান্নাতে থাকতে দেন। আলে-ইমরানের ১৬৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,
مَّا كَانَ اللّهُ لِيَذَرَ الْمُؤْمِنِينَ عَلَى مَآ أَنتُمْ عَلَيْهِ حَتَّىَ يَمِيزَ الْخَبِيثَ مِنَ الطَّيِّبِ وَمَا كَانَ اللّهُ لِيُطْلِعَكُمْ عَلَى الْغَيْبِ
وَلَكِنَّ اللّهَ يَجْتَبِي مِن رُّسُلِهِ مَن يَشَاء
“আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদের মৃত বলো না, প্রকৃত পক্ষে তারা জীবন-, কিন’ তাদের জীবন সম্পর্কে তোমরা অনুভব করতে পারো না।” (আল-বাকারাঃ ১৫৪) ।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, “তাদের প্রাণ সবুজ পাখীর মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। আল্লাহর আরশের সাথে ঝুলন- রয়েছে তাদের আবাস। ভ্রমণ করে বেড়ায় তারা গোটা জান্নাত, অতঃপর ফিরে আসে আবার নিজ নিজ আবাসে।” (মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ) ।
২। শহীদরা নিহত হবার কষ্ট অনুভব করেনা:
আপন মালিককে সন’ষ্ট করার জন্য যারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে, দয়াময় মালিক তাদের শাহাদাতের আঘাতকে ব্যথাহীন বেদনাহীন করে দেন। শহীদ করার জন্য যতো বড় আঘাতই তাদের উপর হানা হোক না কেন, তাতে তাদের কোন কষ্ট হয় না। তারা পায় না কোন যন্ত্রণা। প্রিয় রাসূল (সা) বলেছেনঃ “শাহাদাত লাভকারী ব্যক্তি নিহত হবার কষ্ট অনুভব করে না। তবে তোমাদের কেউ পিঁপড়ার কামড়ে যতোটুকু কষ্ট অনুভব করে, কেবল ততোটুকুই অনুভব করে মাত্র।” (তিরমিযী- আবু হোরায়রা)
৩। শহীদের লাশ পঁচেনা:
মুয়াত্তায়ে ইমাম মালিকের সূত্রে কুরতুবীতে আলোচিত হয়েছে এভাবেঃ হযরত ইবনে জামুহ (রা) এবং আবদুল্লাহ্‌ ইবন আমর (রা) উভয় আনসার সাহাবীই উহূদের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। তাদের উভয়কে একই কবরে সামাধিস’ করা হয়। এর চল্লিশ বছর পর একবার প্রবল বেগে পানি প্রবাহিত হওয়ায় তাদের কবর ভেঙ্গে যায়। পানির প্রবল চাপ দেখে যখন অন্যত্র সমাধিস’ করার জন্য তাদের কবর খনন করা হলো তখন তাদের ঠিক সে অবস’ায় পাওয়া গেল যে অবস’ায় তাদেরকে দাফন করা হয়েছিল। মুয়াবিয়া (রা) তার শাসনামলে মদীনায় কূপ খনন করতে মনস্থ করলেন। কূপ খননের আওতায় উহুদ যুদ্ধের শহীদের কবর পড়ে গেল। মুয়াবিয়া (রা) ঘোষণা দিলেন তোমরা তোমাদের আত্মীয় স্বজনের মৃত দেহ অন্যত্র নিয়ে যাও। এ ঘোষণার পর শবদেহ উঠিয়ে ফেলা হলো। দেখা গেল তারা যে অবস্থায় নিহত হয়েছিলেন ঠিক সেই অবস্থায়ই রয়েছেন। খনন কাজের কোন এক পর্যায়ে হযরত হামজার (রা) পায়ে কোদালের আঘাত লেগে গেলে সাথে সাথে তা থেকে রক্ত ক্ষরণ শুরু হয়। এ ঘটনা ঘটে উহুদ যুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পর।
বাস্তব এসব ঘটনা দ্বারা একথাই প্রমাণিত হয় যে আল্লাহ তায়ালা শহীদদের লাশ পচতে দেন না।
৪। কিয়ামতের দিন শহীদরা তাজা রক্ত নিয়ে উঠবে:
যে ব্যক্তি যুদ্ধ ক্ষেত্রে শাহাদাত বরণ করেন তাকে রক্ত ভেজা কাপড়ে রক্তাক্ত দেখে কোন প্রকার গোসল ছাড়াই দাফন করা হয়। তাকে নতুন কাপড়ের কফিন পরানো হয় না। শাহাদাতের সময় তার দেহে যে কাপড় থাকে সে কাপড়েই তাকে দাফন করা হয়। শহীদদের ব্যাপারে ইসলামের বিধান এটাই। এবং এ অবস’ায়ই তারা হাশরের ময়দানে উঠবে। ক্ষতস’ান থেকে তখনও রক্ত বের হতে থাকবে। রসুলে খোদা (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস-ায় আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে কিয়ামতের দিন সেই আঘাত নিয়েই সে উঠবে আর তার ক্ষতস’ান থেকে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকবে এবং রং হবে রক্তের মতই, কিন’ গন্ধ হবে মিশকের মত।” (বুখারী ও মুসলিমঃ আবু হোরায়রা (রা)। অন্য হাদীসে উল্লেখ রয়েছে, নবী পাক (সা) বলেন, “কসম সেই সত্তার মুহাম্মদের প্রাণ যার হাতের মুঠোয়, কেউ আল্লাহর পথে কোনো আঘাত পেলে কিয়ামতের দিন সে আঘাত নিয়ে হাজির হবে। আর সে আঘাতের অবস’া হবে ঠিক মিশকের মতো” (বুখারী ও মুসলিম)। এটা শহীদদের কত বড় সৌভাগ্য যে, সে দিন তারা রক্তাক্ত দেহ এবং রক্ত ভেজা কাপড় চোপড় নিয়ে হাশরে আল্লাহর দরবারে হাযির হবে।
৫। কবর আযাব থেকে রেহাই এবং সুপারিশ করার অধিকার লাভ:
মহান আল্লাহ শহীদদের জন্যে অসংখ্য পুরস্কারের ব্যবস’া রেখেছেন। তাদের জন্যে নির্ধারিত ক্ষমা, মর্যাদা ও বিরাট পুরস্কারের কথা শুনে কার না ঈর্ষা হবে? আমার প্রিয় রাসূল (সা) বলেছেন, আল্লাহর নিকট শহীদদের জন্যে ছয়টি পুরস্কার রয়েছে। সেগুলো হচ্ছেঃ
ক) প্রথম রক্ত বিন্দু ঝরতেই তাকে মাফ করে দেয়া হয় এবং তার আবাসস্থল জান্নাত চাক্ষুষ দেখানো হয়।
খ) তাকে কবরের আযাব থেকে রেহাই দেয়া হয়।
গ) সে ভয়ানক আতঙ্ক থেকে নিরাপদ থাকে।
ঘ) তাকে সম্মানের টুপি পরিয়ে দেয়া হবে, যার এক একটি ‘ইয়াকুত’ পৃথিবী এবং পৃথিবীর মধ্যে যা কিছু আছে তা থেকেও উত্তম।
ঙ) তাকে উপঢৌকন স্বরূপ আয়তনয়না হূর প্রদান করা হবে এবং
চ) তাকে সত্তর জন আত্মীয় স্বজনের জন্যে সুপারিশ করার ক্ষমতা প্রদান করা হবে (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মেকদাদ ইবনে মা’দীকরব)। আবু আইয়ুব আনসারী (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলে করীম (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি শত্রুর সম্মুখীন হলো এবং তার মুকাবেলায় অটল অবিচল এমনকি এমন অবস্থায় নিহত হয়ে গেল তাকে কবরে কোন প্রকার চিন-ার সম্মুখীন হতে হবে না।” (তাবরানী)
৬। শহীদের জন্য রিয্‌কে হাসানা ও সনে-াষজনক জান্নাত:
শহীদের বিভিন্ন নিয়ামত এবং অনুগ্রহ রাজির ব্যাপারে আল কুরআনে বহু প্রমাণ মেলে। তাদের সুসংবাদের কোন শেষ নেই। আল্লাহ বলেন, “যে সব লোক আল্লাহর পথে হিজরত করেছে, পরে নিহত হয়েছে কিংবা মরে গেছে আল্লাহ তাদেরকে রিযকে হাসানা দান করবেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ উৎকৃষ্টতম রিযকদাতা। তিনি তাদের এমন স’ানে পৌঁছাবেন যাতে তারা সন’ষ্ট হয়ে যাবে।” (আল-হজ্জঃ ৫৮-৫৯) । তিনি আরো বলেন,
وَلَئِن قُتِلْتُمْ فِي سَبِيلِ اللّهِ أَوْ مُتُّمْ لَمَغْفِرَةٌ مِّنَ اللّهِ وَرَحْمَةٌ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُونَ “তোমরা যদি আল্লাহর পথে নিহত হও কিংবা মরে যাও তবে আল্লাহর যে রহমত ও দান তোমাদের নসীব হবে, তা এইসব লোকেরা যা কিছু সঞ্চয় করেছে তা থেকে অনেক উত্তম।” (আলে ইমরানঃ ১৫৭) যারা শাহাদাতের জযবা নিয়ে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে অতপর এ সংগ্রামে তারা শহীদ হোক কিংবা গাজী হিসেবে মৃত্যু বরণ করুক উভয় অবস্থাতেই আল্লাহর নিকট থেকে তারা সমান প্রতিদান পাবে বলে এ আয়াতগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে।
৭। শহীদদের জন্যে রয়েছে মহা পুরস্কার:
মুজাহিদরা খোদাদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে শহীদ কিংবা গাজী উভয় অবস্থাতেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাদের জন্য মহা পুরস্কারের কথা ঘোষণা করেছেন। এই মহা পুরস্কার তারাই লাভ করবে যারা আখিরাতের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবনকে বিক্রি করে দেবার মতো সৎ সাহস রাখে। আল্লাহ ঘোষণা করেন- “সেইসব লোকদেরই আল্লাহর পথে লড়াই করা কর্তব্য যারা পরকালের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবনকে বিক্রয় করে দেয়, যারা আল্লাহর পথে লড়াই করে এবং নিহত কিংবা বিজয়ী হয়। আমরা তাকে অবশ্যই বিরাট পুরস্কার দান করবো।” (আন-নিসাঃ ৭৪)
সূরা আলে ইমরানে শহীদদের প্রাপ্য পুরস্কারসমূহ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন-
أُوْلَـئِكَ جَزَآؤُهُم مَّغْفِرَةٌ مِّن رَّبِّهِمْ وَجَنَّاتٌ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَنِعْمَ أَجْرُ الْعَامِلِينَ “তাদের সকল অপরাধ আমি ক্ষমা করে দেব। আর এমন জান্নাত তাদের দান করবো যার তলদেশে রয়েছে সদা প্রবাহমান ঝর্নাধারা; এ হচ্ছে আল্লাহর নিকট তাদের পুরস্কার আর আল্লাহর নিকট রয়েছে সর্বোত্তম পুরস্কার।” (আলে-ইমরানঃ ১৩৬)
৮। আল্লাহর সান্নিধ্য এবং যা খুশী তাই পাবার অধিকার লাভ:
কুরআন মজীদে বলা হয়েছে কোন দৃষ্টিই আল্লাহর দর্শন লাভ করতে সক্ষম নয়। কোন নবীও আল্লাহকে দেখতে পাননি কিন’ শহীদরা মৃত্যুর পর পরই আল্লাহর দর্শন লাভ করেন। ওহুদ যুদ্ধে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হারাম শাহাদাত লাভ করেন। যুদ্ধের পর রাসূল করীম (সা) শহীদের পুত্র প্রখ্যাত সাহাবী হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহকে সান-্বনা দিতে গিয়ে বলেন- “হে জাবির, আমি কি তোমাকে তোমার পিতার সঙ্গে আাল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাক্ষাতের সুসংবাদ দেব না? জাবির বললেন অবশ্যই দিন হে আল্লাহর রাসূল। তখন তিনি বলেন ঃ আল্লাহ্‌ কখনো অন-রালবিহীন মুখোমুখি কথা বলেন নি। তিনি বলেনঃ হে আমার গোলাম তোমার যা খুশী আমার নিকট চাও। আমি তোমায় দান করবো।” তিনি জবাবে বলেছেন, “হে আমার মনিব। আমাকে জীবিত করে আবার পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিন আবার আপনার পথে শহীদ হয়ে আসি।” তখন আল্লাহ তাকে বলেন, “আমার এ ফয়সালা তো পূর্বেই জানিয়ে দিয়েছি যে, মৃত লোকেরা ফিরে যাবে না।” তখন তোমার পিতা আরজ করেন, “আমার মনিব তবে অন-ত আমাকে যে সম্মান ও মর্যাদা আপনি দান করেছেন, তার সুসংবাদ পৃথিবীবাসীদের জানিয়ে দিন।” তখন আল্লাহ নিুাকে্ত আয়াতটি নাযিল করেন।
“যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদের মৃত মনে করো না, তারা জীবিত।” (জামে আত্‌-তিরমিযী, সুনানে নাসায়ী, জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্‌)
৯। শহীদ পরিবারের গৌরব:
তিরমিযী, ইবনে মাজাহ হাদীস গ্রনে’ মেকদাম ইবনে মাদীকরব বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সা) বলেছেন, “একজন শহীদকে তার সত্তর জন আত্মীয় স্বজনের জন্য সুপারিশ করার অধিকার দেয়া হবে।” তাই আল্লাহ তায়ালা যদি কারো সন-ানকে শাহাদাতের মর্যাদা প্রদান করেন তবে তারা শহীদের পিতামাতা হবার গৌরব অর্জন করেন। তাদের জন্য এর চেয়েও খুশীর বিষয় হলো তারা তাদের শহীদ সন-ানের সুপারিশ লাভের আশা পোষণ করতে পারেন। একজন শহীদ যেমন তার বংশে, পরিবারে এক শাশ্বত ঐতিহ্য সৃষ্টি করে যান তেমনি আবার তার অনুসারীদেরকে ছাড়াও তার আপন বংশের লোকদেরকে চিরদিন জিহাদের জন্য অনুপ্রাণিত করে থাকেন। সুতরাং মুমিনদের দৃষ্টিতে শহীদ পরিবার অত্যন- সম্মানীয় এক আদর্শ পরিবার। শহীদের পিতা-মাতা মুমিনদের নিকট শ্রদ্ধাস্পদ, শহীদের সন-ান, স্ত্রী, ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজনকে সকল মুমিন নিজেদেরই আত্মীয়-স্বজন মনে করে। এসব দিক থেকেই শহীদ পরিবার গৌরবান্বিত।
১০। শাহাদাত উচ্চ মর্যাদার মডেল:
শহীদের অফুরন্ত মর্যাদার আরেক বিশেষ দিক হচ্ছে আল কুরআনে শহীদদেরকে উচ্চ মর্যাদার এক বিশেষ মডেল হিসেবে নির্ণয় করা হয়েছে। যেমন কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং রাসূলের আনুগত্য করবে, সে ঐসব লোকদের সংগী হবে, যাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা নিয়ামত দান করেছেন। তারা হচ্ছেন নবী, সিদ্দীক, শহীদ এবং সালেহ লোকগণ। ……..প্রকৃত অবস্থা জানার জন্যে আল্লাহর জ্ঞানই যথেষ্ট।” (নিসাঃ ৬৯-৭০) । এ আয়াতে পরকালীন উচ্চ মর্যাদার কয়েকটি স্থরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে – অর্থাৎ (১) নবীগণের স-র, (২) সিদ্দীকগণের স-র, (৩) শহীদগণের স-র, (৪) সালেহ বান্দাদের স-র।
রাসূল (সা) নিজেও কিছু সংখ্যক লোককে উপরোক্ত লোকদের সাথীত্ব লাভে সক্ষম হবার সুসংবাদ দিয়ে গেছেন। যেমনঃ এক বার এক ব্যক্তি নবী পাকের (সা) নিকট এসে বললো, “ওগো আল্লাহর রাসূল, আমি সাক্ষ্য দিয়েছি আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কোন ইলাহ্‌ নেই এবং আপনি আল্লাহর রাসূল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করি, আমার মালের যাকাত পরিশোধ করি এবং রমযান মাসের রোযা রাখি।” তার বক্তব্য শুনে নবী পাক (সা) বললেন, “তুমি যা বললে এর উপর কায়েম থেকে যে মারা যাবে কিয়ামতের দিন সে নবী, সিদ্দীক ও শহীদগণের সাথে থাকবে” (মুসনাদে আহমদ, আমর ইবনে মুররাহ আল জুহহানী)। এখন আমাদের কাছে একথা পরিষ্কার হলো, শাহাদাত এমন একটি উচ্চ মর্যাদা, যে পর্যায়ে উপনীত হওয়া প্রকৃত ঈমানদার মাত্রেরই কাম্য। সিদ্দীক ও শহীদের চাইতে উচ্চ মর্যাদায় উপনীত হবার আর কোন অবকাশই নেই। সুতরাং শাহাদাত উচ্চ মর্যাদার মডেল।
এ সকল সম্মান ও মর্যাদার কারণেই সাহাবায়ে কিরামগণ শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করার জন্য ছিলেন সর্বদা ব্যাকুল, পাগলপারা। একটি ঘটনাই তার উজ্জ্বল নমুনা, একবার রাবী আবিবকর ইবনে আবী মুসা আশয়ারী (রা) বললেন, “তারা দু’জনেই যুদ্ধের সময় উপসি’ত ছিলেন- রাসূল (সা) বললেন, নিশ্চয়ই জান্নাতের দরজাগুলো তলোয়ারের ছায়াতলে।” একজন লোক দাঁড়িয়ে গেল যার কাপড়-চোপড় তেমন ছিল না, বললো, “হে আবী মুসা, রাসূল (সা) কি বললেন শুনলেন তো? তিনি বললেন, হ্যাঁ শুনলাম। তো তারপর লোকটি বন্ধুদের কাছে গিয়ে বললেন, তোমাদেরকে সালাম দিয়ে যাচ্ছি। আর আসবো না।” তারপর তার তলোয়ারের খাপটা ভেঙ্গে ফেলে দিলেন। এরপর তলোয়ার নিয়ে দুশমনদের দিকে চললেন, তাদেরকে মারতে থাকলেন যে পর্যন- না তিনি নিহত হলেন। শাহাদাতের মর্যাদা পাওয়ার খাঁটি কামনা যারা করবে তাদের জন্য রাসূল (সা) সুসংবাদ দিয়েছেন, “তারা বিছানায় মারা গেলেও আল্লাহ্‌ তাদেরকে সে মর্যাদা দান করবেন।”
শাহাদাতের মর্যাদায় বুখারীর হাদীস:
حَدَّثَنَا يَعْقُوبُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ، حَدَّثَنَا ابْنُ عُلَيَّةَ، عَنْ أَيُّوبَ، عَنْ حُمَيْدِ بْنِ هِلاَلٍ، عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ خَطَبَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ ‏ “‏ أَخَذَ الرَّايَةَ زَيْدٌ فَأُصِيبَ، ثُمَّ أَخَذَهَا جَعْفَرٌ فَأُصِيبَ، ثُمَّ أَخَذَهَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ رَوَاحَةَ فَأُصِيبَ، ثُمَّ أَخَذَهَا خَالِدُ بْنُ الْوَلِيدِ عَنْ غَيْرِ إِمْرَةٍ فَفُتِحَ عَلَيْهِ، وَمَا يَسُرُّنِي ـ أَوْ قَالَ مَا يَسُرُّهُمْ ـ أَنَّهُمْ عِنْدَنَا ‏”‏‏.‏ وَقَالَ وَإِنَّ عَيْنَيْهِ لَتَذْرِفَانِ‏.‏
তরজমা: ইয়াকূব বিন ইবরাহীম (র) আনাস বিন মালিক (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) খুতবা দিতে গিয়ে বললেন, (মোতার যুদ্ধ) যায়িদ (বিন সাবিত (রা) পতাকা ধারণ করেছেন এবং শাহাদাত বরণ করেছেন, এরপর (জাফর ইব্ন আবূ তালিব (রা) পতাকা ধারণ করেছেন এবং শাহাদাত বরণ করেছেন। তারপর আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা) পতাকা ধারণ করেছেন এবং শাহাদাত বরণ করেছেন। এরপর খালিদ ইব্ন অলীদ (রা) মনোনয়ন ছাড়াই পতাকা ধারণ করেছেন, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মাধ্যমে বিজয় দান করেছেন আর বললেন, এ আমার নিকট পছন্দনীয় নয় অথবা রাবী বলেন, তাদের কাছে পছন্দনীয় নয় যে, তারা দুনিয়ায় আমার নিকট অবস্থান করতো। রাবী বলেন, (রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ কথা যখন বলেছিলেন) আর তাঁর চক্ষু যুগল হতে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছিল।
উপসংহার:
শাহাদাতের রক্ত আল্লাহ বৃথা যেতে দেন না। এটাই আল্লাহর বিনিময়। শহীদের উত্তরসূরীরা যখন সংগঠিতভাবে শাহাদাতের তামান্নায় উজ্জীবিত হয়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় তখন তাদের সাহায্য করা আল্লাহর দায়িত্ব হয়ে পড়ে। স্বয়ং আল্লাহ্‌ বলেন, “মুমিনদের সাহায্য করা আমার দায়িত্ব।” বিংশ শতকের কর্মক্লান- সূর্য যখন পাশ্চাত্যের আকাশে বিদায়ের পটে, আমরা বিশ্ববাসী উৎসুক চোখে মহাসাগরের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে সুর্যাস্থের দৃশ্য অবলোকন করছি। পাশ্চাত্য সভ্যতার অহংকার বিশাল টাইটানিক সব কিছুসহ কালের অতল গহ্বরে বিলীন প্রায় অবস্থায় ক্যাপ্টেন টি.সি. ইলিয়ট বিশ্ববাসীকে জরুরী মেসেজ দিয়ে বলেছেন, “আমাদের জন্য প্রার্থনা কর, বাঁচাও আমাদেরকে, আমরা মৃত্যুর দ্বারে।” গোটা মুসলিম বিশ্বও আজ যেন সন্দেহ, অবিশ্বাস, ভোগবাদ, নেশা ও যৌনাচারের এ ভয়াল সমুদ্র থেকে গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে ঘোষণা করছে কোরআনের সেই অমিয় বাণী- “হে মনিব, তুমি আমাদের এই জালিম অধ্যুষিত এলাকা থেকে বের করে নাও।”
এই মজলুম, দিশেহারা পথিককে অপসংস্কৃতির গড্ডালিকা প্রবাহের ডাষ্টবিন থেকে তুলে এনে হেরার রাজতোরণ দেখানোর দায়িত্ব নিতে হবে এমন একদল মর্দেমুমিনকে যারা ঈমানের চেতনায় তেজদীপ্ত এবং শাহাদাতের উদ্দীপনায় সদা উদ্বেলিত। আর যারা বাতিলের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে উমার ফারুক, উসমান, হামযা, জাফর বিন আবু তালিব, আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা, হুসাইন, মুসাইয়্যিব, সাইয়্যেদ আহমদ ব্রেলভী, তিতুমীর, সালাহ উদ্দীন, ইবনে কাশিম, হাসানুল বান্নাহ, আব্দুল কাদের আওদাহ, সাইয়্যেদ কুতুব, আবদুল মালেক, সাব্বির, হামিদ, আইয়ুব, জব্বার ও কাদের মুল্লাহর-এর মত ভুবন কাঁপানো সে ঘোষণা সদম্ভে উচ্চারণ করতে পারে। আল্লাহ্‌ তায়ালা কোরআন পাকে যেমন উল্লেখ করেন- “হে প্রভূ, আমরা তোমার উপর ঈমান আনলাম, আর শহীদদের কাতারে আমাদের নাম লিখে দাও।”
আমরা জানিনা এ তালিকায় আগামী কাল কার নাম লিখা হবে, হতে পারে কালকের সে সৌভাগ্যবান লোকটি মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, হতে পারে আরো কেউ। জামান ভাই ইতিমধ্যে তো বলেই দিয়েছেন যে, ‘’তিনি জুমাবারে শাহাদাতের তামান্না রাখেন এবং তাঁকে যেন গোসল দেওয়া না হয়, তিনি শাহাদাতের তাজা রক্ত নিয়েই কিয়ামতের দিন উঠতে চান’’ বিশ্বজাহানের মালিকের কাছে সিজদাবনত চিত্তে আমাদেরও মুনাজাত, হে আল্লাহ! এই দিক ভ্রান্ত জাতির কণ্ঠে সত্যের অবিনাশী গান তুলে দিতে আমরাও শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করতে প্রস্থুত। আল্লাহ্‌ আমাদের সবাইকে কবুল করুন।

 আমীন,
-মাওলানা মোহাম্মদ আবুল হোসাইন খান

বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও ইমাম ইস্ট লন্ডন মসজিদ

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম