৫মে রাতে হেফাজতের উপর হামলায় আহতদের কি হয়েছিল ?

৬ এপ্রিল হেফাজতে ইসলামী যখন প্রথম সমাবেশ ডাকে ঢাকায়, আমি এ সংক্রান্ত এক কাজে একটি সেক্টরে ব্যাস্ত থাকায় তাতে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়েছিলো না। পরে বন্ধুদের মুখে শুনেছিলাম ঢাকার ইসলামপ্রিয় জনগণেরা কিভাবে এই সমাবেশকে বরণ করে নিয়েছিলেন। দূর থেকে আগত ভাইয়েদের জন্য এই আনসারেরা এত তরমুজ কেটেছিলেন যে ভাইয়েরা খেয়ে শেষ করতে পারেননি। ৫ মে’তে তাই মুবারকময় সমাবেশটা হাতছাড়া করতে চাইনি। ৫ মে’র দিনটা নিঃসন্দেহে আমার জীবনের অন্যতম সেরা দিন। মতিঝিলে চাচার গাড়িতে করে পরিবারের পুরুষেরা গিয়েছিলাম। সন্ধ্যার পর বড়দের চাপে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভাইদের ছেড়ে বাসায় ফিরতে হয়েছিল। বিকেল থেকেই আসন্ন হামলার আশঙ্কা বাতাসে ছিল, ফজরে উঠে টিভি অন করতেই আশঙ্কা বাস্তবে পরিণত হলো। রাতে সেখানে না থাকার অনুশোচনা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। আকাশ একটু ফর্সা হতেই স্যামসাং ক্যামেরা হাতে নিয়ে বাসায় না জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রাতের গণহত্যার পর আন্ধকারে থাকা আরেক সত্য জানার আমার মূল যাত্রা শুরু হলো।


রক্তে ভেজা প্রান্তরে

সারারাত পাথর দিয়ে গুলির মোকাবেলা করে এক ক্লান্ত ভাই তখন উত্তরা ফিরছিলেন। তাকে ছুটি দিয়ে বাস ধরে পৌছালাম প্রেসক্লাব। তখনও সূর্যের তাপ নেই, দোকানপাট-অফিস প্রায় সবই বন্ধ। বাইতুল মোকাররমের ক্ষেত্রে সরকার গুজব ছড়িয়েছিল যে হেফাজত কর্মীরা কোরআন পুড়িয়েছে। বিষয়টা খতিয়ে দেখার জন্য মসজিদ অঙ্গনে ঢুকলাম। মসজিদের সামনের রাস্তায় পোড়া বাস, আইল্যান্ড বিধ্বস্ত। সারি সারি র‍্যাব-পুলিশের প্লাটুন সেখানে। যেই কিছু ছবি তুলেছি, অমনি র‍্যাবের কর্মকর্তা তেড়ে আসলেন।

- আপনি কে? এখানে কী?

শক্ত থাকার চেষ্টা করলাম, - জী, আমি সাংবাদিক।

-সাংবাদিক হোন আর যাই হোন, এখানে ছবি তুলতে পারবেননা। আপনার ক্যামেরাটা দেন।

মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। আমার কোন সাংবাদিক কার্ড নেই, তাই ঝামেলা বাড়াতে চাইলাম না। র‍্যাব অফিসার সবগুলো ছবি ডিলিট করে দিলেন।

সেখান থেকে সরে গেলাম। রওনা দিলাম মতিঝিলের দিকে। ব্যাস্ত পাড়াটি ভূতুড়ে রকমের নীরব। শুধু সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছনতা কর্মীদের অস্বাভাবিক রকমের ভীড়। আরেকটা বিষয় যা কারো নজর এড়াবেনা, সমগ্র রাস্তা ভেজা, বৃষ্টি হলে যেমনটি ঘটে। কিন্তু গত রাতে তো কোন বৃষ্টি হয়নি। তাহলে কেউ কি ইচ্ছা করে রাস্তা ফ্লাশ করেছে?

ঘুরতে ঘুরতে এলাম আ’লীগ পার্টি হেডকোয়ার্টারের সামনে। পালিয়ে বাঁচা এক ভাই পরবর্তীতে জানিয়েছিলেন আ’লীগের কর্মীরা সেই রাস্তায় ১২ জনকে জবাই (জী, জবাই) করে হত্যা করেছিলেন। উনিসহ শহীদরা ছিলেন ঢাকায় নতুন, নেকড়ের হামলা থেকে বাঁচতে গিয়ে ভুলক্রমে আওয়ামী হায়েনাদের খাঁচায় ঢুকে পড়েন। দেখলাম আ’লীগ নেতারা নীচের বারান্দায় সে ঘটনা নিয়ে তাচ্ছিল্য-মশকরায় লিপ্ত।











এই ভাইয়ের নাম ছিল সম্ভবত আলতাফ। চট্টগ্রামের এক অঞ্চলের শিক্ষক ছিলেন। শান্তিনগর এলাকায় তাদের বারোজনের দলের উপর আ’লীগের কর্মীরা চতুর্দিক থেকে হামলা চালায়। সে সময় তিনি স্বাস্থ্যবান ও শক্ত-সামর্থ্য ছিলেন। মাথায় বেশ কয়েকটা চাপাতির আঘাত খেয়ে শেষ শক্তি থাকা পর্যন্ত লড়ে যান তিনি। তার দলের বাকিদের কোন খবর নেই। মাথায় আঘাত পাওয়ায় কিছুদিন পর তার স্মরণশক্তি একেবারেই হ্রাস পায়। নিজের আপন ভাইকে চিনতে পারতেননা। আমি সেন্ট্রাল হস্পিটালে মাত্র একবার দেখা করা সত্ত্বেও পরে যখন গিয়েছিলাম তখন চিনতে পেরেছিলেন। আমাকে দেখে হাত হাতের মুঠোয় নিয়েছিলেন, কথা ঠিকমত বলতে পারতেননা,শুধু চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়েছিলো।এই ভাইয়ের নাম ছিল সম্ভবত আলতাফ। চট্টগ্রামের এক অঞ্চলের শিক্ষক ছিলেন। শান্তিনগর এলাকায় তাদের বারোজনের দলের উপর আ’লীগের কর্মীরা চতুর্দিক থেকে হামলা চালায়। সে সময় তিনি স্বাস্থ্যবান ও শক্ত-সামর্থ্য ছিলেন। মাথায় বেশ কয়েকটা চাপাতির আঘাত খেয়ে শেষ শক্তি থাকা পর্যন্ত লড়ে যান তিনি। তার দলের বাকিদের কোন খবর নেই। মাথায় আঘাত পাওয়ায় কিছুদিন পর তার স্মরণশক্তি একেবারেই হ্রাস পায়। নিজের আপন ভাইকে চিনতে পারতেননা। আমি সেন্ট্রাল হস্পিটালে মাত্র একবার দেখা করা সত্ত্বেও পরে যখন গিয়েছিলাম তখন চিনতে পেরেছিলেন। আমাকে দেখে হাত হাতের মুঠোয় নিয়েছিলেন, কথা ঠিকমত বলতে পারতেননা,শুধু চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়েছিলো।

গন্তব্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ

দুপুর গড়িয়ে গেল। আমার অর্জন মোটামুটি শূন্য। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে থাকা সত্ত্বেও ঢাকা মেডিকেলে কোন দিন যাওয়া হয়েছিলনা। প্রথমবারের মত সেখানে ঢুকলাম। এক কথায়, ভয়াবহ অবস্থা। এমনিতেই সেখানে রোগীর চাপ বেশী থাকে, গতরাতের আহত ভাইদের চাপে অবস্থা আরও করুণ। রক্তমাখা ব্যান্ডেজ নিয়ে অধিকাংশই শুয়ে আছেন করিডোরে আর মেঝেতে।




আরও সমস্যা হল আমাদের ভাইয়েরা সবাই এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন, সেটা পরিবর্তন করার মত কোন কাপড় তাদের নেই। পাশে নেই পরিবারের কেউ, মেঝেতে পাড়ার কম্বলটুকু দেয়ার মানুষটুকু নেই। এক ভাইয়ের পাশে শুনলাম তার ঘটনাঃ

মতিঝিলের পার্শ্ববর্তী এক পাড়ায় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। রক্তক্ষরণ হতে হতে তিনি প্রায় অজ্ঞান হয়ে যান। তাকে আবর্জনার বড় এক ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া হয়, সারা রাত সেখানেই ছিলেন। ফজরের দিকে এক দয়ালু ব্যাক্তি তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে এনে ঢামেকে ভর্তি করান। কোন মুসলিম আরেক মুসলিমের দেহ ডাস্টবিনে ফেলতে পারে?

এ ধরনের ঘটনা একটা না, ডজন ডজন। বিভিন্ন জায়গা থেকে আহতরা তখনও ঢামেকের এমারজেন্সিতে আসছিল। কিন্তু হাঁসপাতাল কর্তৃপক্ষ সরকারের চাপে সব রোগী তখন ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন। শুধু তাইনা, রাতের ঘটনায় যারা এসেছিলেন তাদের দুই দিনের মধ্যে অন্য কোন জায়গায় এডমিট হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।

এক ভাইয়ের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে এসে ঝুলছিল। তাকে দুই দিন কোন ডাক্তার ট্রিট করেননি। চোখে ইনফেকশনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে তার পরিবার আসার পর তাকে শ্যামলির চক্ষু ইন্সিটিউটে ভর্তি করা হয়।

এসময় পরিচয় হয় ইকবাল ভাই ও তার সাথীর সাথে। ঢামেকে তখন পুলিশ বসিয়ে ‘নিরাপত্তা’ জোরদার করা হয়েছিল। আমি একা থাকা কালে আমাকে ঢুকতে দিচ্ছিলনা। ইকবাল ভাই ঢামেকেই কাজ করতেন। তার সুবাদে তার সাথে নিয়ে মেডিকেলে অনেক জায়গায় ঢোকা সম্ভব হয়েছিলো। হেফাজতের ভাইদের সহায়তা করার কারণে পরবর্তীতে মেডিকেল কর্তৃপক্ষ তাকে বহিস্কার করে। তিনি প্রতি ভোরে বাসায় খাবার রান্না করে আহত ভাইদের নিকট পৌঁছে দিতেন। আহতদের বাসায় কথা বলে তাদের ঢাকায় আসতে সাহায্য করতেন। আল্লাহ এই মানুষটিকে উত্তম প্রতিদান দিন, তিনি যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা আমার পক্ষে লিখে বোঝানো সম্ভব নয়।




বাংলাদেশের নীচ মিডিয়ার আরেক রূপ সেদিন চোখের সামনে দেখেছিলাম। ঢামেকের মর্গে ঢুকে বুকটা বিদীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। ছোট ঘরে সারি করে ঈমানদারদের দেহ ফেলে রাখা হয়েছে, গুনে দেখলাম প্রায় দশ কি এগারোজন ছিলেন। আমার সাথেই মর্গে ঢুকেছিলেন নামী এক স্ংবাদস্ংস্থার সাংবাদিক। মোটামোটি একই সময়ে আমরা মর্গ থেকে বের হলাম। এ সময় সাংবাদিক সাহেবের উপর থেকে ফোন আসলো, উনার জবাব শুনতে পেলাম,

‘ঢাকা মেডিকেলের মর্গে স্যার মোট পাঁচ জনের লাশ দেখলাম……না, না, পাঁচজন।’

বাংলাদেশ নামের মগের মুল্লুকটা তারা চালায়, চুপচাপ দেখে সরে এলাম।

ঢাকায় চিকিৎসা অবরোধ

৬ মে পরবর্তী সময়ে আহত ভাইদের চিকিৎসা নিয়ে বেশ কিছু সমস্যার সৃষ্টি হল। সরকারের চাপ আসার কিছুদিন পর ঢামেক প্রায় হেফাজতশূন্য হয়ে গেল। প্রায় সকল সরকারি হাঁসপাতালের উপর একই চাপ আসলো। বাধ্য হয়ে গরীব মানুষগুলো বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে যেতে চাইলেন। সেখানে গিয়েও শোনা গেল সরকারি গোয়েন্দা এসে নাকি তাদের শাসিয়ে গেছে হেফাজতের কোন কর্মীকে ভর্তি না করা হয়। কি অবাক করা বিষয়, দেশের সরকার সর্বশক্তি প্রয়োগ করছে যাতে তার আহত নাগরিকের চিকিৎসা না করা হয়। আমরা পুলিশি হামলার কথা ভাবলেও কখনো ভাবতে পারেনি সরকার রাতের অন্ধকারে আলেম ওলামাদের উপর ম্যাসাকার চালাবে। আর আমি ভাবতে পারিনি যে এই ম্যাসাকারের পর ‘লেজিটিমেট অথোরিটি’র দাবীদার সরকার হাঁসপাতালকে নির্দেশ দিবে যে তার নিজ নাগরিককে যেন স্বাস্থ্য সেবা না দেয়া হয়।




সবদিক থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সবাই মুখ ঘুরালো জামায়াত নিয়ন্ত্রিত হাঁসপাতালগুলোর দিকে। কিন্তু সেখানেও গোয়েন্দাদের উপদ্রব। জামায়াতের যেসব ভাইয়েরা আহত হয়েছিলেন তাদের চিকিৎসা দিতেই সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছিলেন তারা, এরপর গোয়েন্দাদের চোখ এড়িয়ে হেফাজতের ভাইদের নেয়ার সুযোগও ছিল কম।কয়েকিদিনের মধ্যেই আহত বেশ কয়েকজনের শাহাদাতের খবর আসলো। আল্লাহ তাদের সীমাবদ্ধতাগুলো মাফ করুন।

দ্বিতীয় সমস্যাটা ছিল আর্থিক। ৫ মেতে আমাদের কারোরই নিজেদের জন্য হাঁসপাতালের খরচ বহনের জন্য মানসিক প্রস্তুতি ছিলোনা। বাংলাদেশের আলেমদের অধিকাংশেরই আর্থিক অবস্থা খুব ভালো নয়। এতোগুলো মানুষের চিকিৎসা খরচের অংকটা অনেক বড়। জামায়াতের ক্ষেত্রে যা হয়, কর্মীদের আর্থিক অবস্থা ভাল না হলে সংগঠন সাধারনত এক্ষেত্রে সাহায্য করে। কিন্তু হেফাজত মূলত একটা আমব্রেলা সংগঠন ছিল, আর ৫ মের অধিকাংশ মানুষই ছিলেন দলীয় সম্পৃক্ততাহীন সাধারণ ইসলামপ্রিয় জনগণ। এক গুরুতর আহত ভাইয়ের প্রতিদিন প্রায় হাজার টাকার ওষুধ লাগতো। সেসময়টা হেফাজতের বিষয়টা অনেকটা ট্যাবু হয়ে দাড়িয়েছিল, সাধারন মানুষকে দান করতে বলার সুযোগ ছিল নিতান্তই কম। শিবিরের প্রবাসী কিছু ভাইয়েরা মিলে প্রায় ২৫ হাজারের মত যোগাড় করে দিলেন।

এক ভাই সে রাতে শহীদ হয়েছিলেন যার এক স্ত্রী আর ছোট এক মেয়ে ছাড়া আর কেউ ছিলোনা। তিনিই ছিলেন পরিবারের আয়ের একমাত্র উৎস। তাকে হারিয়ে তার পরিবার খুব ভয়াবহ পরিনতির সম্মুখীন হলেন। এরকম ঘটনা ছিল আরও অনেক ভাইয়ের ক্ষেত্রে। হেফাজতের কিছু ভাইয়েরা চেষ্টা করতে লাগলেন এই সব পরিবারকে যথাসম্ভব সাপোর্ট করার জন্য। একজন মুসলিম হিসেবে আমার আপনার দায়িত্ব শহীদদের পরিবারের খোঁজ খবর নেয়া, তাদেরকে সব রকম সাপোর্ট দেয়া।

[ছবিগুলো আমার কাঁচা হাতের তোলা। অনেক ঘটনা ভুলে গেছি সেই সাথে যাতে বিরক্ত না হন তার জন্য যথাসম্ভব কাটছাট করা হল। ৫ মে গণহত্যার কিছুদিন পরই ছিল আমার ফ্লাইট। তাই সব ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল। আমি নিজে সাংবাদিক ছিলামনা, কিন্তু এক ভাইয়ের সুবাদে এক টেলিভিশন সাংবাদিক ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ ছিল । দুই বছর লিখতে বসে দেখলাম অধিকাংশ ঘটনাই ভুলে গিয়েছি। সেই সাংবাদিক ভাই আহত ভাইদের এই দুরবস্থার বিস্তারিত ভিডিও করেন, আহত ভাইদের সাক্ষাতকার নেয়া হয়। সঙ্গত কারণেই এগুলো প্রকাশ করা হয়নি, কিন্তু সত্য একদিন প্রকাশিত হবেই ইনশাআল্লাহ।]

- সাজিদ করিম

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম