বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, কেন্দ্রীয় কারাগার শাখা

 

জামায়াতের যে পরিমান লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে তাতে জামায়াত তার কারাগার শাখা ঘোষণা করতেই পারে। দলটির শত শত কর্মী এখন কারাগারে অবস্থান করছেন। আবার সেই অনুপাতে পর্যাপ্ত নেতৃবৃন্দকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। ফলে বেশ সমৃদ্ধ একটি কারাগার শাখা হয়ে গেল জামায়াতের।

জামায়াত তো রাজপথে আন্দোলন করার জন্য গঠিত হয়নি। জামায়াতের কাজ হলো আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পিত একদল লোক তৈরী করা এবং সেই লোকদের নিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করে জনগণকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করা। রাজপথে আন্দোলন হচ্ছে সে চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের একটি পর্যায় এবং উপায় মাত্র। লোক তৈরীর জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম জামায়াতের কর্মসূচির বিশাল একটি অংশ জুড়ে রয়েছে। দারসুল কুরআন, হাদিস, ইসলামী সাহিত্য, রাত্রী জাগরণ ইত্যাদির জন্য যে নিবিড় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প প্রয়োজন, বেশ ক'বছর যাবত জামায়াতের পক্ষে তা আয়োজন সম্ভব হয়ে উঠছে না সরকারের দমন নিপিড়নের কারণে।

বলাই বহুল্য কারাগারের প্রকোষ্ঠগুলো সেই নিবিড় প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের বিকল্প হিসেবে শতভাগ সফল, বরং তারচেয়ে বেশি। যে আত্মিক ও ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ কোনভাবেই খোলা দুনিয়ার প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে দেয়া সম্ভব নয়, কারাগারে অবলিলায় সে প্রশিক্ষণ হয়ে যায়। অধ্যাপক গোলাম আজম ইসলামী ছাত্রশিবিরের কোন এক প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে এসে বলেছিলেন, আমার হাতে যদি কারাদণ্ড দেয়ার ক্ষমতা থাকতো, শিবিরের প্রতিটি সদস্যেকে কমপক্ষে তিনমাস কারাদন্ড বাধ্যতামূলক করে দিতাম। অধ্যাপক মজিবুর রহমানের সাথে গ্রেফতার হওয়া জামায়াতের থানা আমীর মাহফুজুর রহমান ৯ মাস বিনা বিচারে জেল খেটে ঈদের কয়েকদিন আগে জামিনে বেড়িয়েছেন। তিনি বললেন, আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করলে আমি নির্দ্বিধায় বলবো, জীবনের সেরা সময়টুকু ছিল কারাগারের নয় মাস।
জীবনে এক পারা কুরআন মুখস্ত করতে পারিনি, আর কারাগারের এই ক'মাসে আমি ১৫ পাড়া কুরআন মুখস্ত করেছি (আলহামদুলিল্লাহ)। দুই মাস জেল খেটে এবারে রোজার শুরুতে বের হওয়া ছাত্র জাকির ভাই বললেন, কারাগারের এই ক'দিনে একটি রাতের জন্যও তাহাজ্জুদ নামাজ মিস হয়নি।

অতএব, কারাগারের চেয়ে চমৎকার প্রশিক্ষণ ক্যাম্প জামায়াতের জন্য আর কি হতে পারে? শিবিরের এক সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি বলছিলেন, শেখ হাসিনাকে জামায়াত ও শিবিরের পক্ষ থেকে বিশেষ ধন্যবাদ দেয়া দরকার কারণ কর্মীদের জন্য তিনি অমূল্য প্রশিক্ষণের যে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করেও শিবিরের পক্ষে এমন প্রশিক্ষণ দেয়া সহজ হতোনা।
কর্মীদের জন্য প্রশিক্ষণঃ
জামায়াতের কর্মীরা এখন কারাগারে বসে কুরআন পড়বে, হাদিস পড়বে, রসূলের জীবনী পড়বে। ইসলাম হচ্ছে মানব জীবনের ও সমাজের সকল সমস্যার সমাধান, সকল কল্যাণের উৎস। এই কথার উপর অবিচল বিশ্বাস ইসলামী আন্দোলনের একজন কর্মীর মূল সম্পত্তি। আর এই বিশ্বাস ও প্রত্যয় তৈরী হয় ইসলামের যথার্থ জ্ঞানের মাধ্যমে। জামায়াতের কর্মীরা এখন জেলখানায় বসে সেই মৌলিক উৎসগুলো থেকে নিরবিচ্ছিন্ন জ্ঞান আহরণ করতে থাকবে। সকালে অফিসে যেতে হয় বলে কর্মজীবির জন্য রাত জাগা কঠিন, এখন অখন্ড অবসরে প্রতি রাতে আল্লাহর সাথে কথা বলার মোক্ষম এক সুযোগ জামায়াত কর্মীদের জন্য। তারা দিনের বেলা সাধারণ বন্দীদের মাঝে কুরআন ও হাদিসের আলোকে দাওয়াত দেবেন, হযরত তোফায়েল ইবনে আমর আদ দাওসী রা. যেমন নিজ গোত্রে ফিরে গিয়ে শত শত লোককে ইসলামের পথে নিয়ে এসেছিলেন।

নেতাদের জন্য প্রশিক্ষণঃ
কারাগারে ঢোকার পর নেতাদের আর কোন দায়িত্ব থাকেনা। এই অবসরে তারা সমাজ ও রাষ্ট্রে দ্বীন প্রতিষ্ঠার কর্মপন্থা নিয়ে নিবিড়ভাবে ভাবতে পারবেন। এই কঠিন দায়িত্ব পালনের জন্য আল্লাহর সাথে যে বিশেষ সম্পর্ক প্রয়োজন, এই অবসরে সে সম্পর্ক ঝালাই করে নেবেন। নিজেদের সিদ্ধান্তসমূহের ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে গভীরভাবে আত্মপর্যালোচনা করতে পারবেন। খোলা দুনিয়ায় তারা সরাসরি সাধারণ মানুষের কাছে দাওয়াত পৌঁছানোর সুযোগ পাননা। এই সময়ে তারা সাধারণ দাওয়াতী কাজ করতে পারবেন।
নেতৃত্বের সুক্ষ্ম ভুলের কারণে পুরো আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়তে পারে, এমন উদহারণে ইতিহাস ভরা। ১৯২২ সালের দিকে তিউিনিসিয়া-লিবিয়া অঞ্চলে যে বিশাল সেনুসি আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, সে জনপদের লাখ লাখ মানুষ কল্যাণ ও সুপথের সন্ধান পেয়েছিল, শীর্ষ নেতার একটি অদূরদর্শী সিদ্ধান্তে, তথাকথিত উসমানীয় খিলাফত রক্ষার্থে মিত্র ইংরেজদের উপর হামলা করা, সে আন্দোলন পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেল। আর আহমদ মুখতারের মত বীর যোদ্ধাকে নিশ্চিত মৃত্যু সামনে রেখে লড়তে লড়তে জীবন দিতে হলো। আহমদ মুখতার সফল, কিন্তু আন্দোলন ব্যর্থ।

কারাগারে জামায়াত নেতৃবৃন্দ আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে তাদের সিদ্ধান্ত ও কর্মপন্থাগুলো পর্যালোচনা করতে পারবেন। জামায়াতে দীর্ঘ দিন ধরে গড়ে ওঠা এক একজন আহমদ মুখতার যেন কোন ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বিনষ্ট না হয়।

বুদ্ধি বিবেচনা পরিহার করা চলবেনাঃ
গতকালের মিছিল সংঘর্ষে যে গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে, সে ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে অনেকের। জনগণের সম্পত্তি ধ্বংস করা পৃথিবীর সব আন্দোলনের জন্য বৈধ হলেও ইসলামী আন্দোলনের জন্য বৈধ হতে পারেনা। এমনকি যুদ্ধের সময়ও, অবশ্য পুলিশের সাথে সংঘর্ষকে যুদ্ধের সাথে তুলনার কোন সুযোগ নেই, রসূল স. এর কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিল- ফলবান বৃক্ষ কর্তন করবেনা, ফসলের ক্ষেত নষ্ট করবেনা...।

সুতরাং জনগণের সম্পদ নষ্ট করা জামায়াতের আন্দোলনের বৈশিষ্ট কখোনোই হতে পারেনা। গাড়ি পোড়ানো কিংবা ভাংচুরের কোন নির্দেশ কখোনোই দেয়া হয়নি, কিন্তু পোড়ানো যাবেনা এমন শক্ত প্রশিক্ষণও জামায়াতের কর্মীরা দীর্ঘদিন পায়নি। যদিও কোন শপথের জনশক্তি এমন কাজ করেনি, তবু উত্তেজিত সে দুচারজন কর্মীর কর্মের দায় তো সকলের উপরই এসে পড়ে।
সদ্য এসএসসি পাশ রাসেলকে যখন দেখছিলাম সিগন্যাল বাতিতে আঘাত করতে তখন কড়া করে ধমক দিয়ে তাকে ফেরাতে হয়েছে। বেলাল ভাই বললেন, তিনি নিজে একটি নিশ্চিত পুড়তে যাওয়া পাইভেট কারকে রক্ষা করেছেন তার ভেতরে ছুড়ে দেয়া জলন্ত কাগজ ঝুঁকি নিয়ে বের করার মাধ্যমে।

অতএব, সর্বস্তরের কর্মীদেরকে রাজপথের আন্দোলনেও ইসলামের জীবন্ত মডেল হওয়ার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বাংলাদেশের জনগণের জীবন, সম্পদ এবং সম্মানের সবচেয়ে বড় হেফাজতকারী হচ্ছে জামায়াত, জনগণের মধ্যে এই আস্থা সৃষ্টি করাই তো জামায়াতের কাজ। তাই জনগণের সম্পত্তি রক্ষায় যে কোন উস্কানিকে হজম করতে হবে। যে পুলিশ উন্মত্ত হালাকু খা আর তোগলাই খানের মত ঝাপিয়ে পড়লো রাস্তায় লুটিয়ে পড়া জামায়াত কর্মীর উপর, অথবা নির্লজ্জ ছিচকে চোরের মত বন্দীর টাকা-পয়সা-মোবাইল কুড়িয়ে পকেটে ভরলো, তাকে সামনে পেলেও অনুরূপ আচরণ না করার উদাহরণ জামায়াতকে সৃষ্টি করতে হবে।

জামায়াতের আন্দোলন হলো জনগণকে বাঁচানোর আন্দোলন, জনগণকে সাথে নিয়ে আন্দোলন। অতএব, তাদের কোন কর্মকাণ্ড যেন তাদেরকে উল্টো জনবিচ্ছিন্ন করে না দেয়, তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সবগুলো চোঙ্গা এখন বাম রামদের হাতে, চোঙ্গাগুলো এক যোগে তারস্বরে ফুৎকার দেবে এবং প্রমাণ করতে চাইবে যে বিশ্বব্যাপি ইসলামকে যে সন্ত্রাসী হিসেবে দেখানোর চেষ্টা চলছে, জামায়াত তাদেরই প্রতিনিধি। এমন প্রচেষ্টাকে কখোনোই সফল হতে দেয়া যাবেনা।

সর্বশেষ, কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্ঠ কিংবা ক্ষমতার তখতে তাউজ, মুমিনের কোন পরাজয় নেই, হারাবার কিছু নেই। সবর কিংবা শোকর- এই হল সফলতার জন্য মুমিনের চিরন্তন অস্ত্র।


লিখেছেন : হলদে ডানা

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম