আমাদের বিবেক নিঃসন্দেহে এ সাক্ষ্য প্রদান করে যে, এ দুনিয়ায় ছোট-বড় যে কোনো কাজ সম্পাদনের দায়িত্বভার দুজনের হাতে অর্পণ করে আদৌ কোনো সুফল পাওয়া যায় না ; তাই একই মাদ্রাসা বা স্কুলে দু’ প্রধান শিক্ষক, একদল সৈন্যের দু’জন সেনাপতি এবং একই রাজত্বে দু’ রাজার কর্তৃত্ব পরিচালনার সংবাদ আমাদের গোচরীভূত হয় না এবং স্বভাবত তাহা হতেও পারে না। আমাদের জীবন পথের ছোট-খাট ব্যাপারের মধ্য দিয়েও আমরা এই অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সক্ষম হই যে, সুশৃংখলার সাথে কোনো একটি কাজ সম্পাদন করার উদ্দেশ্যে তার দায়িত্বভার একজনের হাতেই অর্পণ করা আবশ্যক।
উল্লেখিত সরল ও সোজা কথাটিকে স্মৃতিপটে জাগরূক রেখে একবার বিস্তৃত সৃষ্টিলোক, এ জমি যাতে আমরা বসবাস করি, এ চন্দ্র যা রাতের বেলা আমাদের দৃষ্টিপথে উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেয়, এ সূর্য যা প্রতিদিন উদয় হয় ও অস্ত যায়, এ অগণিত তারকারাজি যা ঘূর্ণায়মান অবস্থায় আকাশে পরিদৃশ্যমান হয়, এই সমস্তের ঘূর্ণনের মধ্যে একটি সুশৃংখলিত নীতি বিদ্যমান রয়েছে। তাই রাত বা দিনের আগমন কখনো আপন আপন নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে দৃষ্ট হয় না। চাঁদ কখনো পৃথিবীর সাথে ধাক্কা খায় না। সূর্য কখনো আপন গন্তব্য পথ ছেড়ে এক কদমও এদিক ওদিক যায় না। এ অসংখ্য ভ্রাম্যমাণ তারকারাজি যার মধ্যকার কোনো কোনো তারকা আমাদের এই পৃথিবী অপেক্ষা বহুগুণে বড় প্রত্যেকটি ঘড়ির যন্ত্রপাতির ন্যায় এক বিরাট শৃংখলায় আবদ্ধ এবং এক নির্ধারিত ব্যবস্থানুযায়ী আপন নির্দিষ্ট পথে গতিশীল। কেউ আপন পথ হতে এক চুল পরিমাণও টলতে সমর্থ নয়। এসবের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের ভিতর সামান্য পরিমাণ ব্যতিক্রম ঘটলে এ পৃথিবীর সমস্ত কারখানায়ই উলট-পালট হতে বাধ্য এবং অসাবধানতা বা অনিয়মতার ফল স্বরূপ ট্রেনের সংঘর্ষের ন্যায় ভ্রাম্যমাণ তারকারাজিতেও বিরাট সংঘর্ষের সৃষ্টি হতো।
এই তো গেলো আকাশ রাজ্যের কথা। এখন একবার এ পৃথিবী ও আমাদের আপন অস্তিত্বের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন। এ ধূলির ধরায় আমাদের জীবন ধারণের সব বিচিত্র কর্মকাণ্ড ও কতকগুলি বিধি ব্যবস্থার সীমার মধ্যে আবদ্ধ। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি প্রত্যেক জিনিসকে আপন সীমায় বেঁধে রেখেছে। উক্ত শক্তির অভাবে মুহূর্তের মধ্যে সৃষ্টির সমস্ত কলকারখানা নষ্ট হয়ে যাবে। এ কারখানার প্রত্যেকটি কল-কবজা বিশেষ শৃংখলার ভিতর দিয়েই আপন কর্তব্য সম্পাদন করছে। বাতাস আপন কর্তব্য কর্মে অবিরাম নিযুক্ত রয়েছে। পানিও তার নির্দিষ্ট নীতি অনুসরণ করছে। আলোর করণীয় কাজও যথারীতি সম্পন্ন হচ্ছে। এভাবে বছরের ঋতুগুলোও আপন আপন কতর্বø প্রতিপালনে রত। মাটি, পাথর, বিদ্যুৎ, বাষ্প, গাছ ও জন্তু-জানোয়ার ইত্যাদি কারো নিজ সীমার বাইরে চলার শক্তি নেই। এ কারখানার প্রত্যেক যন্ত্রই নিজের নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থেকে একে অন্যের সাথে মিলিতভাবে কাজ করছে এবং এ বিশ্বের সবকিছুর অস্তিত্বের পশ্চাতে উক্ত সম্মিলিত চেষ্টার ফল বিদ্যমান রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ একটি ক্ষুদ্র বীজকে গ্রহণ করুন। তা আমরা জমিতে বপন করি। উক্ত বীজ কখনো একদিনে বিরাট গাছে পরিণত হয় না, বরং আকাশ ও পৃথিবীর সম্মিলিত শক্তি এর পিছনে রয়েছে। ভূমি একে আদ্রতা ও উর্বরতার দিক দিয়ে সাহায্য প্রদান করছে। সূর্য এটাকে আলো-তাপ দিচ্ছে, পানি, বাতাস এবং রাত ও দিন একে সম্পূর্ণ জরুরি সাহায্য দান করছে। এ বিশেষ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বহুদিন, মাস, বছর ও কাল অতিবাহিত হওয়ার পর উল্লেখিত ক্ষুদ্র বীজটি এক বিরাট ফলন্ত গাছে পরিণত হয়। আমাদের জীবন ধারণের সহায়ক অগণিত ফসল ও ফল-মূল প্রাপ্তির পিছনে বহু শক্তির সম্মিলিত চেষ্টা নিহিত রয়েছে। অনুরূপভাবে আমাদের বেঁচে থাকার পিছনেও আকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় শক্তির সম্মিলিত চেষ্টার ফল বিদ্যমান। কেবলমাত্র বাতাসও যদি উক্ত শক্তিসমূহ হতে বিলীন হয়, তবে আমরা মুহূর্তের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যাবো ; যদি বাতাস ও উত্তাপের সাথে পানি সম্মিলিতভাবে কাজে যোগদান না করে, তবে আমরা এক ফোঁটা বৃষ্টিও লাভ করতে পারি না। মাটি ও পানির মিলিত চেষ্টা না হলে আমাদের বাগান শুকিয়ে যাবে, কৃষি কাজ বন্ধ হবে এবং থাকার ঘর নির্মিত হতে পারবে না। বারুদের ঘর্ষণ দ্বারা দিয়াশলাইয়ের কাঠি হতে আগুন সৃষ্টি না হলে আমাদের উনান জ্বলবে না এবং বহু কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। লোহা ও আগুন সংমিশ্রণ ভিন্ন একখানা ছোট চাকু পর্যন্ত নির্মাণ করা অসম্ভব। মোটকথা এ বিরাট বিশ্ব শুধু এজন্যই টিকে আছে যে, এ সুবৃহৎ রাজত্বের প্রত্যেকটি বিভাগ বিশেষ শৃংখলার সাথে অন্য বিভাগের সাথে মিলিত হয়ে আপন কর্তৃব্য কাজ সম্পাদন করছে ; কোনো বিভাগের কোনো কর্মীর এমন কোনো শক্তি নেই, যার দ্বারা সে আপন কর্তব্য কাজে অলসতা প্রদর্শন করতে পারে বা সম্মিলিতভাবে কাজ সমাধার পথে বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
আমার উল্লেখিত কথায় বিশ্ব-প্রকৃতির স্বাভাবিক অবস্থার একটা বর্ণনা প্রদান করা হলো। অতিরঞ্জিত বিষয় বা মিথ্যার কোনো আশ্রয় এখানে গ্রহণ করা হয়নি। আশা করি এ সম্পর্কে আপনারা আমার সাথে একমত হবেন।
অতপর আমার জিজ্ঞাসা এই যে, এ বৃহৎ শৃংখলাও এ বিস্ময়কর উন্নত শক্তির মধ্যে এতো সুন্দর সামঞ্জস্যের যথার্থ কারণ কি থাকতে পারে? লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সৃষ্টির অস্তিত্ব বিদ্যমান রয়েছে, হাজার হাজার যুগ ধরে যমীনের উপর উদি্ভদ ও প্রাণীর উৎপত্তি হচ্ছে, তারপর পৃথিবীর বুকে দেখা দিয়েছে মানুষ জাতির অস্তিত্ব, তাও বহু যুগযুগান্তরের কথা। কিন্তু এ সুদীর্ঘ সময়ের মধ্যে চাঁদ কখনো আকাশের বক্ষ হতে ভূমিতে পতিত হয়নি, সূর্য ও পৃথিবীতে কখনো সংঘর্ষ বাঁধেনি, রাত দিন কখনো আপন সীমা অতিক্রম করে পরস্পর মিলিত হয়ে যায়নি। বাতাস ও পানিতে কখনো ঝগড়া বাঁধেনি। পানি ও মাটির পারস্পরিক সম্পর্কও নষ্ট হয়নি, উত্তাপ ও অগ্নির আত্মীয়তায়ও কোনো প্রকার বিঘ্ন ঘটেনি। এখন গভীরভাবে চিন্তা করা আবশ্যক যে, এ রাজত্বের প্রতিটি বিভাগ ও ক্ষেত্র এতোটা সুশৃংখলিত ও সুনিয়ন্ত্রিত কেন? কেন এখানে কোনো প্রকার বিপর্যয় সৃষ্টি হয়নি? উত্তরে আপনার ভিতরকার মানুষটি নিঃসন্দেহে বলে উঠবে যে, উপরোক্ত সমস্ত কারখানার স্রষ্টা ও অধিকারী হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। এ এক আল্লাহর আদেশই সকলের উপর কাজ করছে এবং এ বিরাট শক্তি সমস্ত কিছুকে এক শৃংখলায় বেঁধে রেখেছে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, বহু খোদা তো দূরের কথা মাত্র দুই খোদা হলেও শৃংখলাপূর্ণ ব্যবস্থাপনা ও নিয়ম-শৃংখলা কখনো ঠিক থাকতো না থাকতে পারতো না। কারণ, সামান্য একটি মাদ্রাসা বা স্কুল পরিচালনার ভার দুই হেড মাওলানা বা দুই হেড মাষ্টারের হাতে অর্পণ করে যখন সুফল পাওয়া যায় না, তখন আকাশ ও পৃথিবীর এই বিশাল রাজত্ব কি করে দুই আল্লাহ্র কর্তৃত্বে পরিচালিত হতে পারে?
উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা প্রকৃত অবস্থা এই জানা যায় যে, এ বিরাট বিশ্বের অস্তিত্ব কখনো আপনা হতে গড়ে উঠেনি, বরং এর পেছনে রয়েছে এক স্রষ্টা যিনি এক ও অদ্বিতীয়, মহাশক্তিশালী সুবিচারক। তাঁর শাসন যমীন হতে আসমান পর্যন্ত বিস্তৃত। সৃষ্টির প্রত্যেকটি জিনিস তাঁর আদেশের অনুগত, মানব জাতির জীবন ধারণ ও তার উপাদানসমূহ একমাত্র তাঁর হাতেই নিবদ্ধ। বিশ্বের এ সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা পরিস্কাররূপে এ সাক্ষ্য প্রদান করে যে, দুই শাসনকর্তার হুকুম ও শাসন এখানে কখনো চলতে পারে না। কারণ একাধিক শক্তির কর্তৃত্ব ও অধিকার অনিবার্যরূপে যেখানে সেখানে বিশৃংখলা ও ঝগড়ার সৃষ্টি করে থাকে। আবার শাসন পরিচালনার জন্য শুধু শক্তিই যথেষ্ট নয়, গভীর জ্ঞান ও প্রশস্ত দৃষ্টিরও বিশেষ আবশ্যকতা রয়েছে। এর দ্বারাই সৃষ্টির বিভিন্ন বিভাগের যাবতীয় উন্নতির চিন্তা খুব অল্প সময়ের মধ্যে সমাধান করে শাসনকার্য পরিচালনা করা হয়। যদি সর্বশক্তিমান এক আল্লাহ ভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বহু স্রষ্টা হতো এবং এ দুনিয়ার বিভিন্ন অংশে ও বিভিন্ন কাজে এদের স্বাধীনতা থাকতো, তাহলে আকাশ ও পৃৃথিবীর এ বিরাট কারখানা নিশ্চিতরূপে অচল হয়ে পড়তো। কারণ, আপনারা জানেন যে, একটি মামুলি মেশিন পরিচালনার ভার সুনিপুণ মিস্ত্রি বা ইঞ্জিনিয়ারের হাতে অর্পণ না করলে কখনো সুফল পাওয়া যায় না যেতে পারে না। তাই আমাদের বিবেক স্বভাবতই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, বিশ্বরাজ্যের এ নিখুঁত ও সুনিয়ন্ত্রিত পরিচালনার মালিক ও বাদশাহ হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ তায়ালা তাঁর কাজে কোনো অংশীদার নেই।
উল্লেখিত কথার দলিল স্বরূপ আরো বহু অবস্থার বর্ণনা দেয়া হয়। তবে প্রকৃত ব্যাপার এই যে, আল্লাহ তাআলার রাজত্বে তিনি ভিন্ন কারো কর্তৃত্ব চালানোর কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। কেননা যে সৃষ্টির অস্তিত্ব আল্লাহর কুদরতি ইঙ্গিতে গড়ে উঠেছে ও বজায় রয়েছে এবং যার সাহায্য ও দান ভিন্ন একটি মুহুর্তের জন্য সে চলতে অক্ষম, সে সৃষ্টির কোনো বস্তু বা ব্যক্তি কি আল্লাহর কর্তৃত্বে কোনোরূপ অংশীদার হতে পারে? আপনারা কখনো কোনো চাকরকে প্রভুত্ব খাটানোর ব্যাপারে আপন প্রভুর শরীক হতে দেখেছেন কি? ক্রীতদাস বা বেতনভোগী চাকরকে মালিক বা মনিব কখনো তাঁর সম্পত্তি ও স্বাধীনতার অংশীদার করেন কি? উপরোক্ত কথার সারমর্ম উপলদ্ধি করার পর একটু চিন্তা করলে আপনাদের বিবেক অনায়াসে এ সাক্ষ্য প্রদান করবে যে, আল্লাহর এ রাজ্যে তাঁর বর্ণিত মত ও পথ ভিন্ন কেউ অন্য কোনো স্বাধীন মত পোষণ ও প্রকাশ করার ন্যায়ত কোনো অধিকার রাখে না। এতদসত্ত্বেও যদি কেউ বেপরোয়াভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসে, তবে তা হবে প্রাকৃতিক নিয়ম, বাস্তবতার জ্ঞান ও সত্যের সম্পূর্ণ বিপরীত কাজ।
0 comments: