অধ্যায় ০২ : পর্দার উদ্দেশ্য ও নারী পুরুষের কর্মবন্টন

ইসলামে যে পর্দার বিধান দেয়া হয়েছে, তৎসম্পর্কে একটু তলিয়ে চিন্তা করলে আমরা তার তিনটি উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে পারিঃ

প্রথমত,

নারী ও পুরুষের নৈতিক চরিত্রের হেফাযত করা এবং নর নারীর অবাধ মেলামেশার ফলে সমাজে যেসব ত্রুটি বিচ্যুতির উদ্ভব হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সে সবের প্রতিরোধ করা।

দ্বিতীয়ত,

নারী ও পুরুষের কর্মক্ষেত্রকে পৃথক করা, যেন প্রকৃতি নারীর ওপর যে গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত করেছে, তা সে নির্বিঘ্নে ও সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারে।

তৃতীয়ত,

পারিবারিক ব্যবস্থাকে সুরক্ষিত ও সুদৃঢ় করা। কারণ জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে আর যত ব্যবস্থাই রয়েছে তার ভেতর পারিবারিক ব্যবস্থা শুধু অন্যতমই নয়; বরং এ হচ্ছে গোটা জীবন ব্যবস্থার মূল বুনিয়াদ। তাই যে দেশে বা যে সমাজে পর্দাকে বিসর্জন দিয়ে পারিবারিক ব্যবস্থাকে সুরক্ষিত করার প্রচেষ্টা চলেছে, সেখানে মেয়েদেরকে শুধু পুরুষদের দাসী ও পদসেবিকাই বানানো হয়েছে এবং তাদেরকে সমস্ত ন্যায্য অধিকার প্রদানের নামে পর্দার বাঁধন থেকে আযাদ করে দেয়া হয়েছে। সেখানে পারিবারিক ব্যবস্থায় দেখা দিয়েছে গুরুতর বিশৃংখলা। এ ইসলাম নারীকে তার ন্যায্য অধিকার প্রদানের সংগে সংগে পারিবারিক ব্যবস্থাকেও সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করেছে। কাজেই যে পর্যন্ত নারীর অধিকার সংরক্ষণের জন্যে পর্দার ব্যবস্থা না থাকবে, সে পর্যন্ত ইসলামের উদ্দেশ্য মোটেই সফল হতে পারেনা।

আমি আমার মা-বোনদেরকে ইসলামের উপরোক্ত উদ্দেশ্যাবলী সম্পর্কে শান্ত মস্তিষ্কে ধীর স্থীরভাবে চিন্তা করতে অনুরোধ জানাচ্ছি। অবশ্য যদি কেউ নৈতিক চরিত্রের প্রশ্নটিকে বিশেষ গুরুত্বর্পূণ বিষয় বলে মনে না করেন ,তবে তার সে ব্যাধির কোন প্রতিষেধক আমার কাছে নেই। কিন্ত যিনি নৈতিকতাকে জীবনের অমূল্য সম্পদ বলে মনে করেন, তাঁর একথা গভীরভাবে চিন্তা করে দেখা উচিত যে, যে সমাজে মেয়েরা চোখ ঝলসানো -পোশাক পরিচ্ছেদ ও অলংকারাদিতে সুসজ্জিতা হয়ে প্রকাশ্যে নিজেদের রূপ যৌবনের প্রদর্শনী করে বেড়ায় এবং সর্বত্র পুরুষদের সাথে অবাধ মেলামেশা করার সুযোগ পায়, সেখানে তাদের চারিত্রিক মেরুদন্ড ধ্বংসের কবল থেকে কিরূপে রক্ষা করা যেতে পারে? আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, আমাদের দেশে নারী-পুরুষের মধ্যে যারা নিয়মিত খবরের কাগজ পড়ে থাকেন, তারা অনায়াসেই আমার এই উক্তির যথার্থতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন। সুতরাং এ বিষয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনা করা নিষ্প্রয়োজন।

কেউ কেউ বলে থাকেন, আমাদের সমাজ জীবনে যেসব অনাচার অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তার মূলে নাকি রয়েছে পর্দাপ্রথা এবং পর্দার ব্যবস্থা না থাকলে মেয়েদের সম্পর্কে পুরুষদের নাকি মনে সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হত। যারা এরূপ ধারণা পোষণ করেন, তারা যে নিতান্তই ভ্রান্তির মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছেন, তা আমি দৃঢ়তার সাথেই বলতে চাই। কারণ, যে সমাজে পর্দা প্রথাকে বিসর্জন দিয়ে নারীকে সম্পূর্ণ ‘আযাদ’ করে দেয়া হয়েছে, সেখানে পুরুষের মনে সম্ভ্রম বোধ জাগা তো দূরের কথা, বরং নারীর মহান মর্যাদাকেই সেখানে নগ্নতা ও উলংগতার চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে পৌঁছানো হয়েছে। এমনকি, তাতেও যেখানে মানুষের যৌন লালসা নিবৃত্ত হয়নি, সেখানে প্রকাশ্য ব্যভিচারকেই উৎসাহ দেয়া হয়েছে। এর অনিবার্য প্রতিক্রিয়াস্বরূপ সমাজের বিভিন্ন স্তরে কিরূপ ভাঙন ও বিপর্যয়ের সৃষ্টি হতে পারে, তা আপনারা বৃটেন, আমেরিকা এবং তাদের অনুসারী তথাকথিত প্রগতিশীল দেশগুলোর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকেই সম্যক অনুধাবন করতে পারেন। আমার মা-বোনদের নিকট জিজ্ঞাস্য যে, পর্দা প্রথাকে বিসর্জন দিয়ে এহেন প্রগতিই কি তারা কামনা করেন?

বস্তুত এটা শুধু নৈতিক প্রশ্নই নয়; বরং এর সংগে আমাদের গোটা তাহযীব-তামাদ্দুন জড়িত রয়েছে। অধুনা দেশে নারী-পুরুষের মিলিত আচার অনুষ্ঠানের মাত্রা যত বেড়ে চলেছে, মেয়েদের পোশক-পরিচ্ছদ ও প্রসাধনী দ্রব্যের ব্যয় বাহুল্য ততই উর্ধমূখী হচ্ছে। এর ফলে একদিকে হালাল উপায়ে অর্থোপার্জনের প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে ,অপরদিকে সুদ, ঘুষ আত্মসাৎ, চোরাকারবারী প্রভৃতি সমাজধ্বংসী পাপাচারেরও ব্যাপক প্রচলন হচ্ছে।

বলাবাহুল্য এই সমস্ত হারামখুরীর অভিশাপেই আজ আমাদের সামাজিক কাঠামো ঘুণে ধরা কাঠের ন্যায় দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং এর ফলে আজ দেশে আইনেরশাসনও সঠিকভাবে চালানো সম্ভব হচ্ছে না। আমি আপনাদেরকে জিজ্ঞেস করতে চাই, যারা নিজেদের ব্যক্তিগত লালসা -বাসনার ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম -শৃংখলা মেনে চলতে অভ্যস্ত নয়, সামাজিক ব্যাপারে তারা কিরূপে নিয়ম-শৃংখলার অনুবর্তী হয়ে চলবে? আর যে ব্যক্তি নিজের পারিবারিক জীবনেই কোন বিধি-বিধানের অনুবর্তী হতে পারে না, রাষ্ট্রীয় জীবনে তার কাছ থেকে আইনের আনুগত্যের আশা করাটা নিতান্তই বাতুলতা নয় কি?

নারী ও পুরুষের কর্মবন্টন

বস্তুত নারী ও পুরুষের কর্মক্ষেত্রকে খোদ প্রকৃতিই স্বতন্ত্র করে দিয়েছে। প্রকৃতি মাতৃত্বের পবিত্র দায়িত্ব সম্পূর্ণ নারীর উপর সোপর্দ করেছে এবং সেই সংগে দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত স্থান কোথায়, তাও বাতলিয়ে দিয়েছে। অনুরূপভাবে পিতৃত্বের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে পুরুষের ওপর এবং সেই সংগে মাতৃত্বের মতো গুরুদায়িত্বের বিনিময়ে তাকে আর যেসব কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তাও প্রকৃতি সুস্পষ্টরূপে নির্ধারণ করে দিয়েছে। পরন্তু এ উভয় প্রকার দায়িত্ব পালনের জন্য নারী ও পুরুষের দৈহিক গঠন, শক্তি সামর্থ ও ঝোঁক প্রবণতায়ও বিশেষ পার্থক্য সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রকৃতি যাকে মাতৃত্বের জন্য সৃষ্টি করেছে, তাকে ধৈর্য, মায়া মমতা, স্নেহ ভালবাসা প্রভৃতি কতকগুলো বিশেষ ধরনের গুণে গুণান্বিত করেছে। নারীর ভেতরে এসব গুণের সমন্বয় না হলে তার পক্ষে মানব শিশুর লালন পালন করা সম্ভবপর হত কি? বস্তুত মাতৃত্বের মহান দায়িত্ব যার ওপর অর্পণ করা হয়েছে; তার পক্ষে এমন কোন কাজ করা সম্ভব নয়, যার জন্যে রুক্ষতা ও কঠোরতার প্রয়োজন। এ কাজ শুধু তার দ্বারাই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে পারে ,যাকে এর উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে এবং সেই সংগে পিতৃত্বের মতো কঠোর দায়িত্ব থেকেও অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।

আজকে যারা সমান অধিকারের নামে নারী ও পুরুষের এই প্রকৃতিগত পার্থক্যকে মিটিয়ে দিতে চান, তাদেরকে আমি অনুরোধ করবো, আপনারা এ পথে কোন পদক্ষেপ নেয়ার আগে মনে করে নিন যে, এ যুগে পৃথিবীর আদতেই মাতৃত্বের কোন প্রয়োজন নেই। আমি দৃঢ়তার সংগেই বলতে চাই যে, আপনারা যদি এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত পারেন, তাহলে আনবিক ও উদযান বোমার প্রয়োগ ছাড়াই অল্প দিনের মধ্যেই মানবতার চূড়ান্ত সমাধি রচিত হবে। পক্ষান্তরে আপনারা যদি এরূপ সিদ্ধান্ত করতে না পারেন এবং নারীকে তার মাতৃসুলভ দায়িত্ব পালনের সংগে সংগে পরুষের মতো রাজনীতি, ব্যবসায় বাণিজ্য, শিল্পকার্য, যুদ্ধপরিচালনা ইত্যাদি ব্যাপারেও অংশ গ্রহণ করতে বাধ্য করেন, তাহলে তার প্রতি নিসন্দেহে চরম অবিচার করা হবে।

আমি আপনাদেরকে ন্যায়নীতির খাতিরে একটু ধীর স্থীরভাবে চিন্তা করতে অনুরোধ জানাচ্ছি। নারীর ওপর প্রকৃতি যে দায়িত্ব ন্যস্ত করেছে, তা নিসন্দেহে মানবতার অর্ধেক সেবা এবং এই সেবাকার্য সে সাফল্যের সংগেই সাধন করে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে পুরুষের নিকট থেকে সে বিন্দুমাত্র ও সহযোগিতা পচ্ছে না, অথচ অবশিষ্ট অর্ধেকের অর্ধেক দায়িত্ব ও আবার আপনারা নারীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন। এর ফল এ দাঁড়াবে যে, নারীকে পালন করতে হবে মোট দায়িত্বের তিন চতুর্থাংশ এবং পুরুষের ওপর বর্তিবে মাত্র এক-চতুর্থাংশ। আমি আপনাদেরকে বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করতে চাই নারীর প্রতি এ কি আপনাদের সুবিচার?
অবশ্য মেয়েরা এ যুলুম অবিচারকে মেনে নিচ্ছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে এ যুলুমের বোঝাকে স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নেয়ার জন্য লড়াই করছে তার মূল কারণ হচ্ছে এই যে, তারা পুরুষদের কাছে যথার্থ সমাদর পাচ্ছে না। ঘর সংসার ও মাতৃত্বের মতো কঠিন দায়িত্ব সঠিকরূপে পালন করা সত্ত্বেও আজ তারা সমাজে উপেক্ষিত, অপাংক্তেয়। সন্তানবতী ও গৃহিনী মেয়েদেরকে আপনারা ঘৃণা করেন এবং স্বামী ও সন্তান-সন্ততির এত সেবা -যত্ন করা সত্ত্বেও আপনারা তাদের যথার্থ কদর করছেন না। অথচ এই সমস্ত কার্যে তাদের যে বিপুল ত্যাগ স্বীকার করতে হয় তা পুরুষদের সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও যুদ্ধ বিগ্রহ সংক্রান্ত দায়িত্বের চাইতে কোন অংশেই কম নয়। বস্তুত এসব কারণেই মেয়েরা আজ অনন্যোপায় হয়ে দ্বিগুণ দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হচ্ছে। তারা পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে যে, পুরুষ-সুলভ কার্যে অগ্রসর না হলে সমাজে তাদের যথাযোগ্য মর্যাদা নেই।


0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম