নেতৃত্বের গুরুত্ব
মানব জীবনের জটিল সমস্যাবলী সম্পর্কে সামান্য মাত্র জ্ঞানও যার আছে, এই নিগূঢ় সত্য সম্পর্কে সে ভাল করেই অবহিত হবে যে, মানব সমাজের যাবতীয় ব্যাপারের কর্তৃত্ব ও চাবিকাঠি কার হাতে নিবদ্ধ --এই প্রশ্নের উপরই মানব জীবনের শান্তি, স্বস্তি, নিরাপত্তা এবং ভাঙ্গন-বিপর্যয় ও অধপতন একান্তভাবে নির্ভর করে। গাড়ি যেমন সব সময় সেই দিকেই দৌড়িয়ে থাকে যে দিকে তার পরিচালক --ড্রাইভার চালিয়ে নেয় এবং তার আরোহীগণ ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক --সেই দিকেই ভ্রমন করতে বাধ্য হয়; অনুরূপভাবে মানব সমাজের গাড়ীও ঠিক সেই দিকে অগ্রসর হয়ে থাকে যেদিকে তার নেতৃবৃন্দ ও কর্তৃত্বশীল লোকেরা নিয়ে যায়। পৃথিবীর সমগ্র উপায়-উপাদান যাদের করায়ত্ব হয়ে থাকবে; শক্তি, ক্ষমতা, ইখতিয়ারের সব চাবিকাঠি যাদের মুঠির মধ্যে থাকবে, সাধারণ জনগণের জীবন যাদের হাতে নিবদ্ধ হবে, চিন্তাধার, মতবাদ ও আদর্শের রূপায়ণ-বাস্তবায়নের জন্যে অপরিহর্য উপায়-উপাদান যাদের অর্জিত হবে, ব্যক্তিগত স্বভাব-চরিত্র পুনর্গঠন, সমষ্টিগত নীতি-ব্যবস্থার বাস্তবায়ন এবং নৈতিক মূল্য (Values) নির্ধারণের ক্ষমতা যাদের রয়েছে, তাদের অধীন জীবনযাপনকারী লোকগণ সমষ্টিগত ভাবে তার বিপরীত দিকে কিছুতেই চলতে পারেনা।
এই নেতৃবৃন্দ ও কর্তৃত্বশীল লোকগণ --যদি আল্লাহর অনুগামী, সৎ ও সত্যাশ্রয়ী হয়, তবে সেই সমাজের লোকদের জীবনের সমগ্র গ্রন্থী ও ব্যবস্থাই আল্লাহভীতি, সার্বিক কল্যাণ ও ব্যাপক সত্যের উপর গড়ে উঠবে। অসৎ ও পাপী লোকও সেখানে সৎ ও পুন্যবান হতে বাধ্য হবে । কল্যাণ ও সৎ ব্যবস্থা এবং মঙ্গলকর রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান, উৎকর্ষ ও বিকাশ লাভ করবে। অন্যায় ও পাপ নিঃশেষে মিটে না গেলেও অন্তত তা উন্নতিশীল এবং বিকশিত হতে পারবে না। কিন্তু নের্তৃত্ব, কর্তৃত্ব এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যদি আল্লাহদ্রোহী, ফাসেক, পাপী ও পাপলিপ্সু লোকদের করায়ত্ত হয়, তবে গোটা জীবনব্যবস্থায়ই স্বতস্ফুর্তভাবে আল্লাহ দ্রোহিতা জুলম, অন্যায়, অনাচার ও অসচ্চরিত্রতার পথে চলতে শুরু করবে। চিন্তাধারা আদর্শ ও মতবাদ জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-শিল্প ও রাজনীতি, অর্থনীতি, সভ্যতা ও সংস্কৃতি, সামাজিক রীতিনীতি ও আচার-অনুষ্ঠান, নৈতিক চরিত্র ও পারষ্পরিক কাজকর্ম বিচার ও আইন-সমষ্টিগতভাবে এ সবকিছুই বিপর্যস্ত হবে । অন্যায় ও পাপ ফুলে-ফলে সুশোভীত হবে। কল্যাণ, ন্যায় ও সত্য পৃথিবীর কোথাও একবিন্দু খুঁজে পাওয়া যাবে না। পৃথিবী ন্যায় ও সত্যকে স্থান দিতে, বায়ু ও পানি তার লালন-পালন করতে অস্বীকার করবে।
আল্লাহর এই পৃথিবী অত্যাচার জুলুম, শোষণ ও নিপীড়ন-নিষ্পেষণের সয়লাব স্রোতে কানায় কানায় ভরে যাবে। এরূপ পরিবেশে অন্যায়ের পথে চলা সকলের পক্ষেই সহজ হবে। ন্যায় ও সত্যের পথে চলা-চল নয় শুধু দাঁড়িয়ে থাকাও হবে অত্যন্ত কঠিন। একটি জনাকীর্ণ মিছিলের সমগ্র জনতা যেদিকে চলে সেদিকে চলার জন্য উক্ত মিছিলের অন্তর্ভুক্ত কোন ব্যক্তির পক্ষে বিশেষ শক্তি ব্যয় করতে হয় না, ভিড়ের চাপেই সে স্বতই সম্মুখের দিকে অগ্রসর হতে থাকে, কিন্তু তার বিপরীত দিকে চলার জন্য প্রবল শক্তি ব্যয় করে এক কদম পরিমান স্থান অগ্রসর হওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে। এরূপ অবস্থায় বিপরীতদিকে সামান্য চললে ভিড়ের প্রবল ও অপ্রতিরোধ্য চাপে দশ কদম পশ্চাতে সরে পড়তে বাধ্য হয় --এটা এক স্বতসিদ্ধ ও সর্বজনবিদিত সত্য। মানুষের সমষ্ঠিগত জীবনের ধারা যখন অসৎ ও পাপাশ্রয়ী লোকদের নেতৃত্ব কুফরী ও ফাসেকী পথে অগ্রসর হতে থাকে, তখন (উপরোক্ত উদাহরণের ন্যায়) স্বতন্ত্রভাবে ব্যক্তিদের পক্ষে অন্যায়ের পথে চলা তো খুবই সহজ --এতই সহজ হয় যে, সেদিকে চলার জন্য নিজের কোন শক্তি ব্যয় করতেই হয় না --কিন্তু এর সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে চলতে চাইলে নিজের দেহ-মনের সমগ্র শক্তি নিয়োজিত করেও তার পক্ষে ন্যায় পথে দৃঢ় হয়ে থাকতে পারলেও সমষ্টিগতভাবে তার জীবন মানব সমষ্টির অনিবার্য চাপে পাপ ও অন্যায়ের পথেই চলতে বাধ্য হয়।
এখানে আমি যা বলছি তা এমন কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত নয়, যার সত্যতা প্রমান করার জন্য কোন যুক্তিতর্কের আবশ্যক হতে পারে। বাস্তব ঘটনা প্রবাহই একে অনস্বীকার্য সত্যে পরিণত করেছে। কোন সুস্থ দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিই এর সত্যতা স্বীকার না করে পারে না। এই বইয়ের প্রত্যেক পাঠকই আমার উক্ত কথার সত্যতা যাচাই করতে পারেন। বিগত এক শতাব্দীকালের মধ্যে আমাদের এই দেশের লোকদের মতবাদ, চিন্তাধারা, দৃষ্টিভংগী রূচি ও স্বভাব-প্রকৃতি, চিন্তা- পদ্ধতি ও দৃষ্টিকোণ গভীরভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেছে, সভ্যতা ও চরিত্রের মানদণ্ড এবং মূল্য ও গুরুত্বের মাপকাঠি বদলে গেছে। আমাদের একটি জিনিসও অপিরিবর্তিত থাকতে পারেনি। এই বিরাট পরিবর্তন আমাদের এই দেশে আমাদেরই দৃষ্টির সম্মূখে সাধিত হলো। মূলত এর কি কারণ হতে পারে, তা কি একবারও ভেবে দেখেছেন ? আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি যে, এর একটি মাত্র কারন রয়েছে আর আপনিও যতই চিন্তা করেন, এছাড়া অন্য কোন কারণ নির্ধারণ করা আপনার পক্ষেও সম্ভব হবে না। এর একটি মাত্র কারণ রয়েছে আর আপনিও যতই চিন্তা করেণ সে কারণ শুধু এটাই যে, যেসব লোকের হাতে এদেশের সর্বময় কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব নিবদ্ধ ছিল- সমাজ পরিচালন ও দেশ শাসনের ক্ষমতা - ইখতিয়ার যাদের করায়ত্ত ছিল তারাই সমগ্র দেশের নৈতিক চরিত্র, মনোবৃত্তি, মনস্তত্ব, কাজকর্ম ও পারষ্পারিক লেন -দেন ও আদান-প্রদান এবং সমাজ - সংস্থা ও ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরুপে নিজেদের ইচ্ছা ও রুচি অনুসারেই ঢেলে গঠন করেছিলো । এই পরিবর্তনের বিরোধিতা করার জন্য যেসব শক্তি মস্তক উত্তোলন করেছিলো, তারা কতখানি সাফল্য লাভ করতে পেরেছে, আর ব্যর্থতা তাদেরকে কতখানি অভিনন্দিত করেছে, তাও একবার গভীরভাবে চিন্তা করে দেখুন। একথা কি সত্য নয় যে, পরিবর্তন বিরোধী আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে যারা নেতৃত্ব দান করেছেন, তাদেরই সন্তান অধস্তন পুরুষ শেষ পর্যন্ত পরিবর্তন স্রোতের গড্ডালিকা প্রবাহে তৃণখন্ডের ন্যায় ভেসে গেছে ?
বহির্বিশ্বের যাবতীয় বিবর্তিত রীতিনীতি, আচার – অনুষ্ঠান ও ধরন - পদ্ধতি সবকিছুই তাদের ঘরবাড়ী নিমজ্জিত করে দিয়েছে ? এটা কি কেউ অস্বীকার করতে পারে যে, অসংখ্য সম্মানিত ধর্ম নেতার বংশে আজ এমনসব লোকের জম্ম হচ্ছে, যারা আল্লাহর অস্তিত্ব এবং অহী ও নবুয়াতের প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রবল সন্দেহ পোষণ করছে ? জাতীয় জীবনের এই বিরাট বিপর্যয় এই বাস্তবতা পর্যবেক্ষনণ ও অভিজ্ঞতার পরও কি একথা অস্বীকার করা যায় যে, মানব জীবনের অসংখ্য সমস্যার মধ্যে নেতৃত্বের সমস্যাই হচ্ছে সবচেয়ে জটিল এবং সর্বধিক গুরুত্বপূর্ণ। আর সত্যকথা এই যে, এই জিনিসটির এহেন গুরুত্ব কেবল বর্তমানেই তীব্র হয়ে দেখা দেয়নি, এটা এক চিরন্তন সত্য ও চিরকালীন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার । “জনগণ নেতৃবৃন্দেরই আদর্শানুসারী হয়ে থাকে” কথাটি বহু পুরাতন। হাদীস শরীফে জাতীয় উখান - পতন, গঠন ও ভাংগনের দায়ী করা হয়েছে জাতীসমূহের আলেম, পন্ডিত. শিক্ষিত লোক এবং নেতৃবৃন্দকে। কারণ, সমাজের নের্তৃত্ব ও পথপ্রদর্শনের গুরুদায়িত্ব চিরদিনই এদের উপর অর্পিত হয়ে থাকে।
সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা দ্বীন ইসলামের মূল লক্ষ্য
সৎ ও আদর্শ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা দ্বীন ইসলামে যে কতবেশী গুরুত্বপূর্ণ, তা উপরোক্ত বিশ্লেষণ হতে খুব সহজেই অনুধাবন করতে পারা যায়। আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীন ইসলামের সর্বপ্রথম নির্দেশ এই যে , দুনিয়ার সকল মানুষ নিরংকুশভাবে একমাত্র আল্লাহর দাস হয়ে জীবনযাপন করবে এবং তাদের গলায় আল্লাহর দাসত্ব ছাড়া অন্য কারো দাসত্বের শৃঙ্খল থাকবে না । সেই সঙ্গে এর আর একটি দাবী এই যে , আল্লাহর দেয়া আইনকেই মানুষের জীবনের একমাত্র আইন হিসেবে গ্রহন করতে হবে। এর তৃতীয় দাবী এই যে , পৃথিবীর বুক হতে সকল অশান্তি ও বিপর্যয় নির্মূল করতে হবে , পাপ ও অন্যায়ের মূলোৎপাটন করতে হবে। যেহেতু দুনিয়ার উপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হওয়ার এটাই একমাত্র কারন।
অতএব এসব দূরীভূত করে তদস্থলে ন্যায়, সত্য,কল্যান ও মংগলকর ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা ও উৎকর্ষ সাধন করতে হবে,কারণ আল্লাহ তায়ালা এটাই পছন্দ করেন এবং ভালবাসেন। কিন্তু সকলেই বুঝতে পারেন যে, মনুষ্য জাতির নেতৃত্ব , কর্তৃত্ব এবং যাবতীয় সামাজিক কার্যাবলীর মূল চাবিকাঠি যতদিন কাফের ও ভ্রষ্ট নেতৃত্ববৃন্দের মুষ্টিবদ্ব হয়ে থাকবে; আর একমাত্র সত্য ব্যবস্থা - ইসলামের অনুসারী যতদিন তাদের অধীন, তাদেরই প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগে লিপ্ত হয়ে ঘরের কোণে বসে আল্লাহর ‘জিকর’ করার কাজে নিমগ্ন হয়ে থাকবে ততদিন উপরোল্লিখিত উদ্দেশ্য কখনই সফল হতে পারে না। এই লক্ষ্য স্বতই নেতৃত্বের আমূল পরিবর্তন দাবী করে এবং সকল ন্যায়নিষ্ঠ, ন্যায়পন্থী, আল্লাহর সন্তোষকামী লোকদেরকে পরস্পর মিলিত হয়ে সামগ্রিকশক্তি অর্জন করতে এবং সমগ্র শক্তি প্রয়োগ করে আল্লহ প্রদত্ত একমাত্র সত্য বিধান ইসলামকে কায়েম করতে স্পষ্টভাবে নির্দেশ দেয়। এই সত্য বিধান কায়েম করতে হলে নেতৃত্বের পদ ও কর্তৃত্বের সকল চাবিকাঠি সমাজের সর্বাপেক্ষা অধিক ঈমানদার, সৎ ও আদর্শবাদী লোকের হাতে অর্পণ করতে হবে ।
এরূপ রাষ্ট্র বিপ্লব সাধন ছাড়া দ্বীন ইসলামের মূল লক্ষ্য এবং দাবী কখনই পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। এ জন্যই সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা দ্বীন ইসলামের সত্য বিধান বাস্তবায়নে আল্লাহ প্রদত্ত ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য নির্ধারিত হয়েছে। এমনকি এই বিরাট কর্তব্য বিস্মৃত হওয়ার পর এমন কোন কাজই থাকতে পারে না, যা করে আল্লাহর কিছুমাত্র সন্তোষলাভ করা সম্ভব হতে পারে । কুরআন মজীদে জামায়াতবদ্ব হওয়া ও নেতার আদেশ শ্রবন ও পালনের উপর এতবেশী গুরুত্ব কেন আরোপ করা হয়েছে, তা বাস্তবিকই প্রনিধানযোগ্য। উপরন্তু কুরআনের বিধান মত জামায়াত হতে স্বেচ্ছায় বহিষ্কৃত ব্যক্তি হত্যার যোগ্য ---- তাওহীদের কালেমায়ে তার বিশ্বাস থাকলেও এবং নামায-রোযা পালনকারী হলেও এই দন্ড হতে সে কোনক্রমেই রক্ষা পেতে পারে না। এরই বা কারণ কি? এর মূলীভূত ও এক মাত্র কারণ কি এ নয় যে, সৎ নেতৃত্ব ও সত্যের পূর্ণঙ্গ জীবন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা ও স্থিতি সাধন দ্বীন ইসলামের চূড়ান্ত লক্ষ্য বলেই এরূপ নির্দেশ দেয়া হয়েছে? আর এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য সমষ্টিগত ও সংঘবদ্ধ শক্তি অর্জন করা একান্তই অপরিহার্য। কাজেই যে ব্যক্তিই সামগ্রিক শক্তি ও সামাজিক শৃংখলা চূর্ণ করবে তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে তার অপরাধ এতবড় ও এত মারাত্মক যে হাজার তাওহীদ স্বীকার এবং হাজার নামায-রোযা দ্বারা এর ক্ষতিপূরণ কিছুতেই পারেন না।
পরন্তু , ইসলামে জিহাদের উপর এত অধিক গুরুত্ব অরোপ কারা হয়েছে কেন, তাও বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। জিহাদ হতে বিরত থাকলে কুরআন মজিদ তাকে ‘মুনাফিক’ বলে কেন অভিহিত করে? কারণ এই যে, জিহাদ ইসলামের সত্য বিধান প্রতিষ্ঠারই নামান্তুর মাত্র, কুরআনে শরীফে মুসলমানের ঈমান পরীক্ষার জন্য জিহাদকেই চূড়ান্ত মাপকাঠি বলে ঘোষণা করা হয়েছে। অন্য কথায় কুরআনের বিধান অনুযায়ী ঈমানদার ব্যক্তি বাতিল ও কাফেরী শাসন ব্যবস্থার প্রাধান্যে কখনই সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। আর দ্বীন ইলামের সত্য ও অদর্শ জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা-সাধনা না করা এবং জান-মালের কুরবানী না দেয়া তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। আর এই কাজে এই ব্যপারে কারো কুন্ঠা ও ইতস্ততভাব প্রকাশিত হলে তার ঈমান সংশয়ের মধ্যে পড়ে যায় । ফলে অন্য হাজার ‘সাওয়াবের’ কাজও তাকে কোন কল্যাণ দান করতে সমর্থ হয় না।
এই বিষয়টির বিস্তারিত ব্যখ্যা পেশ করার স্থান এটা নয়, এখানে তার অবকাশও নেই ; কিন্তু উপরে যা কিছু বলেছি তা হতে খুব সহজেই হৃদয়ঙ্গম করা যায় যে, ইসলামের দৃষ্টিতে সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা একটি কেন্দ্রীয় ও মৌলিক উদ্দেশ্য বিশেষ এবং অধিকতর গরুত্বপূর্ণ। কাজেই এই ইসলামের প্রতি যার ঈমান অছে একমাত্র নিজের ব্যক্তিগত জীবনকেই যথসম্ভব ইসলামী আদর্শের অনুসারী করলে তার সকল কর্তব্য সম্পন্ন হয় না --- তার সকল দায়িত্ব পালন হয় না। মানব সমাজের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব ও কর্তৃত্বের অধিকার কাফের ও ফাসেকদের নিকট হতে কেড়ে নিয়ে সর্বাপেক্ষা সৎ , সত্যাশ্রয়ী ও আদর্শাবাদী লোকদের হাতে উহা তুলে দেয়ার জন্য সকল শক্তি নিযুক্ত করাও তার মূল ঈমানের ঐকান্তিক ও অনস্বীকার্য দাবী। কারণ, আল্লাহর মর্জি অনুযায়ী পৃথিবীর ব্যবস্থাপনা ও সমাজ পরিচালনা রূপ এক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ভিন্ন আদৌ সম্ভব নয়। পরন্তু, এই উদ্দেশ্য যেহেতু উচ্চতর সামগ্রিক প্রচেষ্টা ছাড়া হাসিল হতে পারে না, এজন্যই এমন একটি সৎ নীতি অনসরণ করে চলবে এবং ইসলামেকে পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত করা, স্থায়ী রাখা এবং তাকে ঠিকভাবে পরিচালিত করে যাওয়া ভিন্ন তার আর কোনই উদ্দেশ্য হবে না। সারা পৃথিবীতে একটি মাত্র লোক যদি ঈমানদার হয়, তবুও সে একাকী বলে এবং নিজেকে নিঃসম্বল মনে করে বাতিল শসনব্যবস্থার প্রভাব সন্তুষ্টচিত্তে স্বীকার করা কিংবা --- (আহওয়ানুল বালাতাইন) - ‘দু’টি বিপদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সহজতম বিপদকে গ্রহণ করার’ অবাঞ্ছিত কটু - কৌশলের আশ্রয় নিয়ে কুফরী ও ফাসেকী ব্যবস্থার অধীন নামেমাত্র ধর্মীয় জীবনযাপন করার সুবিধা ভোগ করা তার পক্ষে আদৌ বাঞ্ছনীয় নয়। বরং সেই একাকী ও নিঃসংগ ঈমানদার ব্যক্তিরও কর্তব্য হচ্ছে বিশ্বমানবকে আল্লাহর মনোনীত জীবন বিধান গ্রহণ করার আহবান জানান। তার এই আহবানের প্রতি কেউ ভ্রুক্ষেপ মাত্র না করলেও সমগ্র জীবন ভর ইসলামের সত্য ও দৃঢ় পথে দাঁড়িয়ে থাকা এবং লোকদেরকে আহবান জানান ও আহবান জানাতে জানাতেই মৃত্যু মুখে ঢলে পড়া তার কর্তব্য। নিজ মুখে সত্যভ্রষ্ট দুনিয়ার পসন্দসই কোন আমন্ত্রণ প্রচার করা এবং কাফেরদের নেতৃত্বের অধীন দুনিয়া যে দিকে ছুটে চলেছে, সেই দিকে অগ্রসর হওয়া অপেক্ষা সত্য পথে সত্যের বাণী প্রচার করতে করতে মৃত্যুবরণ করাও তার পক্ষে শ্রেয়। আর তার আমন্ত্রণে কিছু সংখ্যক লোক যদি একত্রিত হয়, তাদের নিয়ে একটি বিশেষ সংঘ গঠন করা এবং উল্লেখিত আদর্শের জন্য সমষ্টিগতভাবে চেষ্টা-সাধনা ও আন্দোলন করাই তার একান্ত কর্তব্য।
দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে আমার যতটুকু জ্ঞান আছে এবং কুরআন ও হাদীস নিগূঢ়ভাবে অধ্যয়নের ফলে যতটুকু বুদ্ধি ও স্বচ্ছ দৃষ্টি আমি লাভ করতে পেরেছি, তার ভিত্তিতে আমি এটাকেই দ্বীন ইসলামের মৌলিক দাবী বলে জানতে পেরেছি। আল্লাহর কিতাব কুরআন মজীদ আমাদের নিকট দাবী করে বলে বুঝতে পেরেছি, আর আল্লাহর প্রেরিত সকল নবীর এই যে সুন্নাত ছিল তা আমি নিঃসন্দেহে জানতে পেরেছি। আমি আমার এ মত ত্যাগ করতে মাত্রই রাজি নই। --- যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ কুরআন ও সুন্নাহর দলিল হতে আমার ভুল ধরিয়ে দিবে।
নেতৃত্বের ব্যাপারে আল্লাহর নিয়ম
আমাদের এই চুড়ান্ত উদ্দেশ্য ও চরম লক্ষ্য বুঝে নেয়ার পর এই ব্যাপারে বিশ্ব স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালার নিজস্ব নিয়মনীতি কি- তাও জেনে নেয়া আবশ্যক। কারণ, আমাদের কোন উদ্দেশ্য লাভ করতে হলে তা আল্লাহর নিয়ম অনুসারেই লাভ করা সম্ভব, তার বিপরীত নয়। আমরা যে বিশ্ব প্রকৃতির বুকে বসবাস করি, আল্লাহর তাঁর একটি নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ীই এটা সৃষ্টি করেছেন। এখানকার প্রত্যেকটি দ্রব্য ও বস্তুই সেই স্থায়ী অটল নিয়ম বিধানের অনুসারী। কেবল সদিচ্ছা ও নেক বাসনার দরুনই এখানে চেষ্টা সাফল্য লাভ করতে পারে না। মহান পবিত্র আত্মাদের (?) বরকতেই এখানে কোন বাসনা বাস্তবে রূপায়িত হতে পারে না। এই প্রাকৃতিক দুনিয়ার মানুষের চেষ্টা - সাধনা ফলপ্রসু হওয়ার আল্লাহর নির্ধারিত নিয়ম অনুসরণ করে চলা অপরিহার্য। একজন কৃষক- সে যতবড় বুজুর্গ হোক, মহৎ গুণের আধার এবং তসবীহ পাঠে যতই আত্মহারা হোকনা কেন --- যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ নির্ধারিত নিয়ম অনুসারে পরিপূর্ণ শ্রম সহকারে কৃষিকাজ সম্পন্ন না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার একটি বীজও অংকুরিত হতে পারে না। অনুরূপভাবে নেতৃত্ব বিপ্লবের সেই চরম উদ্দেশ্যও কখনো কেবল দোয়া, তাবীজ, সদিচ্ছা ও নেক বাসনার সাহায্যে লাভ করা যাবে না বরং রাষ্ট্র বিপ্লবের জন্য আল্লাহর নিয়ম অনুধাবন করা একান্ত আবশ্যক। কারণ, দুনিয়াতে নেতৃত্ব কায়েম হওয়ার এটাই হচ্ছে স্বাভাবিক নিয়ম। এরই অধীনে একজন লোক নেতৃত্ব লাভ করে এবং এ নিয়ম অনুযায়ীই এক জন লোক নেতৃত্ব হারায় বা নেতৃত্ব হতে বঞ্চিত হয় ।এই সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান ও পরিস্কার ধারণা না হলে আমাদের কর্মপন্থা এবং চলার পথ আমাদের সম্মুখে উদ্ভাসিত হবে না।
মানুষের গোটা সত্তার বিশ্লেষণ করে দেখলে নিসন্দেহে জানতে পারা যায় যে, এর মধ্যে দু’টি দিক পরস্পর বিরোধী হয়েও পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানুষের একটি দিক এই যে তার একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ও পাশবিক সত্তা রয়েছে । তার এই সত্তার উপর ঠিক সেইসব নিয়ম ও আইন জারি হয়ে আছে, যা সমগ্র বস্তুগত ও জন্তু-জানোয়ারের উপর বর্তমান । দুনিয়ার অন্যান্য সমগ্র জড় পদার্থ ও জান্তব সত্তার কার্যকারিতা ও কর্মক্ষমতা যেসব যন্ত্রপাতি ও বৈষয়িক উপায় –উপাদান এবং জড় অবস্থার উপর একান্ত নির্ভরশীল, মানুষের এই দিকটির কার্যকারিতা ও কর্মক্ষমতা ও অনুরূপ ভাবে সেই সবেরই উপর নির্ভরশীল । মানুষের এই স্বাভাবিক সত্তা তার যাবতীয় কর্মক্ষমতাকে একমাত্র প্রাকতিক নিয়মের অধীন যন্ত্রপাতি ও উপায়-উপদানের সাহায্যে এবং স্বাভাবিক জড় অবস্থায় থেকেই ব্যবহার করতে পারে । এজন্যই তার সকল কাজের উপরই বাস্তব ও কার্যকারণ পরস্পরা জগতের সমগ্র শক্ষিই বিপরীত কিংবা অনুকুল প্রভাব বিস্তার করে থাকে ।
মানুষের মধ্যে আর একটি দিক রয়েছে খুবেই উজ্জল এবং গুরুত্বপূর্ণ । তা হচ্ছে তার মানবিক দিক- তার মানুষ হওয়ার দিক, অন্য কথায় বলা যায়, মানুষের একটি নৈতিক দিক রয়েছে, যা কোনদিক দিয়েই প্রাকৃতিক সত্তার অধীনে ও অনুসারী নয় । এই নৈতিক দিক- নৈতিক সত্তাই মানুষের স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক দিকের উপর এক হিসেবে প্রভুত্ব বিস্তার করে । স্বাভাবিক ও জান্তব সত্তাকেও এটা অস্ত্র ও উপায় হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। সেই সঙ্গে বহির্বিশ্বের কার্যকারণসমূহকেও নিজের অধীন করতে এবং নিজের উদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে চেষ্টা করে । আল্লাহ তায়ালা মানুষের মধ্যে যেসব নৈতিক ও চারিত্রক গুণপণা সৃষ্টি করে দিয়েছেন, তাই হচ্ছে এর কর্মচারী বা কার্যসম্পন্নকারী শক্তি । তার উপর প্রাকৃতির নিয়মের কোন প্রভুত্বই চলে না, চলে নৈতিক নিয়ম বিধানের প্রভুত্ব।
0 comments: