অধ্যায় ০৭ : ইসলামী নৈতিকতার চার পর্যায় (ইমান-ইসলাম-তাকওয়া-ইহসান)-২

তাকওয়া

তাকওয়া সম্পর্কে আলোচনা শুরু করার পূর্বে ‘তাকওয়া’ কাকে বলে তা জেনে নেয়া আবশ্যক। তাকওয়া কোনো বাহ্যিক ধরণ-ধারণ এবং বিশেষ কোনো সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের নাম নয়। তাকওয়া মূলত মানব মনের সেই অবস্থাকেই বলা হয় যা আল্লাহর গভীর ভীতি ও প্রবল দায়িত্বানুভূতির দরুন সৃষ্টি হয় এবং জীবনের প্রত্যেকটি দিকে স্বতস্ফূর্তভাবে আত্মপ্রকাশ করে। মানুষের মনে আল্লাহর ভয় হবে, নিজে আল্লাহর দাসানুদাস এই চেতনা জাগ্রত থাকবে, আল্লাহর সামনে নিজের দায়িত্ব ও জবাবদিহি করার কথা স্মরণ থাকবে এবং এই একটি পরীক্ষাগার, আল্লাহ জীবনের একটি নির্দিষ্ট আয়ুদান করে এখানে পাঠিয়েছেন, এই খেয়াল তীব্রভাবে বর্তমান থাকবে। পরকালে ভবিষ্যতের ফায়সালা এই দৃষ্টিতে হবে যে, এই নির্দিষ্ট অবসরকালের মধ্যে এই পরীক্ষাগারে নিজের শক্তি, সামর্থ্য ও যোগ্যতা কিভাবে প্রয়োগ করেছে, আল্লাহর ইচ্ছানুক্রমে যেসব দ্রব্যসামগ্রী লাভ করতে পেরেছে, তার ব্যবহার কিভাবে করেছে এবং আল্লাহর নিজস্ব বিধান অনুযায়ী জীবনকে বিভিন্ন দিক দিয়ে যেসব মানুষের সাথে বিজড়িত করেছে, তাদের সাথে কিরূপ কাজ-কর্ম ও লেন-দেন করা হয়েছে একথাটিও মনের মধ্যে জাগরুক থাকবে।

বস্তুত এরূপ অনুভূতি ও চেতনা যার মধ্যে তীব্রভাবে বর্তমান থাকবে, তার হৃদয় মন জাগ্রত হবে, তার ইসলামী চেতনা তেজস্বী হবে, আল্লাহর মর্জির বিপরীত প্রত্যেকটি বস্তুই তার মনে খটকার সৃষ্টি করবে, আল্লাহর মনোনীত প্রত্যেকটি জিনিসই তার রুচিতে অসহ্য হয়ে উঠবে, তখন সে নিজেই নিজের যাচাই করবে। তার কোন্‌ ধরনের ঝোঁক ও ভাবধারা লালিত-পালিত হচ্ছে নিজেই তার জরীপ করবে। সে কোন্‌ সব কাজ-কর্মে নিজের সময় ও শক্তি ব্যয় করছে তার হিসেব সে নিজেই করতে শুরু করবে। তখন সুস্পষ্টরূপে নিষিদ্ধ কোনো কাজ করা দূরের কথা সংশয়পূর্ণ কোনো কাজেও লিপ্ত হতে সে নিজে ইতস্তত করবে। তার অন্তর্নিহিত কর্তব্যজ্ঞানই তাকে আল্লাহর সকল নির্দেশ পূর্ণ আনুগত্যের সাথে পালন করতে বাধ্য করবে। যেখানেই আল্লাহর নির্দিষ্ট সীমালংঘন হওয়ার আশংকা হবে, সেখানেই তার অন্তর্নিহিত আল্লাহভীতি তার পদযুগলে প্রবল কম্পন সৃষ্টি করবে চলৎশক্তি রহিত করে দিবে। আল্লাহর হক ও মানুষের হক রক্ষা করা স্বতস্ফূêত রূপেই তার স্বভাবে পরিণত হবে। কোথাও সত্যের বিপরীত কোনো কথা বা কাজ তার দ্বারা না হয়ে পড়ে সেই ভয়ে তার মন সতত কম্পমান থাকবে। এরূপ অবস্থা বিশেষ কোনো ধরণে কিংবা বিশেষ কোনো পরিধির মধ্যে পরিলক্ষিত হবে না, ব্যক্তির সমগ্র চিন্তা-পদ্ধতি এবং তার সমগ্র জীবনের কর্মধারাই এর বাস্তব অভিব্যক্তি হবে। এর অনিবার্য প্রভাবে এমন এক সুসংবদ্ধ সহজ, ঋজু এবং একই ভাবধারা বিশিষ্ট ও পরম সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রকৃতি গঠিত হবে, যাতে সকল দিক দিয়েই একই প্রকারের পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা ফুটে উঠবে। পক্ষান্তরে কেবল বাহ্যিক আকার-আকৃতি ও কয়েকটি নির্দিষ্ট পথের অনুসরণ এবং নিজেকে কৃত্রিমভাবে কোনো পরিমাপযোগ্য ছাঁচে ঢেলে নেয়াকেই যেখানে তাকওয়া বলে ধরে নেয়া হয়েছে, সেখানে শিখিয়ে দেয়া কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ ধরণ ও পদ্ধতিতে ‘তাকওয়া’ পালন হতে দেখা যাবে, কিন্তু সেই সঙ্গে জীবনের অন্যান্য দিকে ও বিভাগে এমনসব চরিত্র, চিন্তা-পদ্ধতি ও কর্মনীতি পরিলক্ষিত হবে, যা ‘তাকওয়া’ তো দূরের কথা ঈমানের প্রাথমিক স্তরের সাথেও এর কোনো সামঞ্জস্য হবে না। এটাকেই হযরত ঈসা (আ) উদাহরণের ভাষায় বলেছেনঃ “এক দিকে মাছি বলে বাহির কর আর অন্যদিকে বড় বড় উট অবলীলাক্রমে গলধকরণ কর।”

প্রকৃত তাকওয়া এবং কৃত্রিম তাকওয়ার পারস্পরিক পাথর্ক্য অন্য একভাবেও বুঝতে পারা যায়। যে ব্যক্তির মধ্যে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার একটি তীব্র ও জাগ্রত রুচি অনুভূতি বর্তমান রয়েছে সে নিজেই অপবিত্রতা ও পংকিলতাকে ঘৃণা করবে তা যে আকারেই হোক না কেন এবং পবিত্রতাকে পূর্ণরূপে ও স্থায়ীভাবে গ্রহণ করবে। তার বাহ্যিক অনুষ্ঠান যথাযথভাবে প্রতিপালিত না হলেও কোনো আপত্তি থাকবে না। অপর ব্যক্তির আচরণ এর বিপরীত হবে। কারণ, পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার কোনো স্বতস্ফূর্ত চেতনা তার মধ্যে নেই বরং ময়লা ও অপবিত্রতার একটি তালিকা কোথা হতে লিখে নিয়ে সবসময়ই সঙ্গে রেখে চলে, ফলে এই ব্যক্তি তার তালিকায় উল্লেখিত ময়লাগুলো হতে নিশ্চয় আত্মরক্ষা করবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও উহা অপেক্ষা অধিক জঘন্য ও ঘৃণিত বহু প্রকার পংকিলতার মধ্যে সে অজ্ঞাতসারেই লিপ্ত হয়ে পড়বে, তা নিঃসন্দেহে। কারণ, তালিকায় অনুল্লেখিত পংকিলতা যে কোনোরূপ পংকিল বা ঘৃণিত হতে পারে এটা সে মাত্রই বুঝতে পারে না। এই পার্থক্য কেবল নীতিগত ব্যাপারেই নয়, চারদিকে যাদের তাকওয়ার একেবারে ধুম পড়ে গেছে তাদের জীবনে এই পার্থক্য সুষ্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। তারা একদিকে শরীয়াতে খুঁটিনাটি বিষয়ে খুবই কড়াকড়ি করে থাকে, এমনকি দাড়ির দৈর্ঘ্য একটি বিষেশ পরিমাপ হতে একটু কম হলেই তাকে জাহান্নামী হওয়ার ‘সুসংবাদ’ শুনিয়ে দিতে সঙ্কোচবোধ করে না এবং ফিকাহর শাস্ত্রীয় মত হতে কোথাও সমাজ বিচ্যুতিকেও তারা দীন ইসলামের সীমালংঘন করার সমান মনে করে। কিন্তু অন্যদিকে ইসলামের মূলনীতি ও বুনিয়াদী আদর্শকে তারা চরমভাবে উপেক্ষা করে চলে। গোটা জীবনের ভিত্তি তারা স্থাপিত করেছে ‘রোখছত’ অনুমতি ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদী নীতির উপর। আল্লাহর দীন ইসলাম কায়েম করার জন্য চেষ্টা-সাধনা ও সংগ্রাম করার দায়িত্ব এড়ানোর জন্য তারা বহু সুযোগের পথ আবিষ্কার করে নিয়েছে। কাফেরী রাষ্ট্রব্যবস্থার অধীনে তারা ইসলামী জিন্দেগী যাপনের প্রুæতি করার জন্যই সকল চেষ্টা ও সাধনা নিযুক্ত করে রেখেছে। শুধু তা ই নয়, তাদেরই ভুল নেতৃত্ব মুসলমানদেরকে একথা বুঝিয়েছে যে, এক ইসলাম বিরোধী সমাজব্যবস্থার অধীন থেকে বরং এর ‘খিদমত’ করেও সীমাবদ্ধ গণ্ডীর মধ্যে ধর্মীয় জীবনযাপন করা যায় এবং তাতেই দীন ইসলামের যাবতীয় নির্দেশ প্রতিপালিত হয়ে যায় অতপর ইসলামের জন্য তাদেরকে আর কোনো চেষ্টা-সাধনা বা কষ্ট স্বীকার আদৌ করতে হবে না। এটা অপেক্ষাও অধিকতর দুঃখের কথা এই যে, তাদের সামনে দীন ইসলামের মূল দাবি যেমন পেশ করা হয় এবং দীন (ইসলামী নেজাম) কায়েম করার চেষ্টা সাধনা ও আন্দোলনের দিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়, তখন তারা এর প্রতি শুধু চরম উপেক্ষাই প্রদর্শন করে না, এটা হতে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এবং অন্যান্য মুসলমানকেও তা হতে বিরত রাখার জন্যে শত রকমের কৌশলের আশ্রয় নেয়। আর এতোসব সত্ত্বেও তাদের ‘তাকওয়া’ ক্ষুন্ন হয় না ; আর ধর্মীয় মনোবৃত্তি সম্পন্ন লোকদের মনে তাদের ‘তাকওয়ার’ অন্তসারশূন্যতা সম্পর্কে সন্দেহ মাত্র জাগ্রত হয় না। এভাবেই প্রকৃত ও নিষ্ঠাপূর্ণ ‘তাকওয়া’ এবং কৃত্রিম ও অন্তসারশূন্য ‘তাকওয়ার’ পারস্পরিক পাথর্ক্য বিভিন্নরূপে সুস্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। কিন্তু তা অনুভব করার জন্য ‘তাকওয়ার’ প্রকৃত ধারণা মনের মধ্যে পূর্বেই বদ্ধমুল হওয়া অপরিহার্য।

কিন্তু পোশাক-পরিচ্ছদ, চলাচল, উঠাবসা ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের বাহিক্যরূপ যা হাদিস হতে প্রমাণিত হয়েছে তাকে আমি হীন ও অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করি, আমার পূর্বোক্ত আলোচনা হতে সেরূপ ধারণা করা মারাত্মক ভুল হবে সন্দেহ নেই। এরূপ কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না। বস্তুত আমি শুধু একথাই বুঝাতে চাই যে, প্রকৃত তাকওয়াই হচ্ছে আসল গুরুত্বপূর্ণ জিনিস, তার বাহ্যিক প্রকাশ মূখ্য নয়, গৌণ। আর প্রকৃত ‘তাকওয়ার’ মহিমা দীপ্তি যার মধ্যে স্বতস্ফূর্ত হয়ে উঠবে, তার সমগ্র জীবনই পরিপূর্ণ সামঞ্জস্যের সাথে খাঁটি ‘ইসলামী’ জীবন-রূপেই গড়ে উঠবে এবং তার চিন্তাধারায়, মতবাদে, তার হৃদয়াবেগ ও মনের ঝোঁক প্রবণতায়, তার স্বভাবগত রুচি তার সময় বন্টন ও শক্তিনিচয়ের ব্যয়-ব্যবহার তার চেষ্টা-সাধনার পথে পন্থায়, তার জীবনধারায় ও সমাজ পদ্ধতিতে, তার আয়-ব্যয়ের ব্যাপারে, তার সমগ্র পার্থিব ও বৈষয়িক জীবনের প্রত্যেকটি দিকে ও বিভাগে পূর্ণ ব্যাপকতা ও সামগ্রিকতার সাথে ইসলাম রূপায়িত হতে থাকবে। কিন্তু আসল তাকওয়া অপেক্ষা তার বাহ্যিক বেশ- ভূষাকেই যদি প্রাধান্য দেয়া হয় তার উপরই যদি অযথা গুরুত্ব আরোপ করা হয় এবং প্রকৃত তাকওয়ার বীজ বপন ও তার পরিবর্ধনের জন্য যত্ন না নিয়ে যদি কৃত্রিম উপায়ে কয়েকটি বাহ্যিক হুকুম-আহকাম পালন করানো হয়, তবে বর্ণিত রূপেই যে এর পরিণাম ফল প্রকাশিত হবে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। প্রথমোক্ত কাজ অত্যন্ত সময় সাপেক্ষ, সেই জন্য অসীম ধৈর্য্যের আবশ্যক ; ক্রমবিকাশের নীতি অনুসারেই তা বিকশিত হয়ে এবং দীর্ঘ সময়ের সাধনার পরই তা সুশোভিত হয়ে থাকে ঠিক যেমন একটি বীজ হতে বৃক্ষ সৃষ্টি এবং তাতে ফুল এবং ফল ধারণে স্বভাবতই বহু সময়ের আবশ্যক হয়। এ কারণেই স্থুল ও অস্থির স্বভাবের লোক ঐরূপ তাকওয়া লাভ করার জন্য চেষ্টা করতে সাধারণত প্রস্তুত হয় না। দ্বিতীয় প্রকার তাকওয়া, তাকওয়ার বাহ্যিক বেশ ভুষা, সহজলভ্য, অল্প সময় সাপেক্ষ। যেমন একটি কাষ্ঠখণ্ডের পত্র ও ফুল ফল বেঁধে “ফল ফুলে শোভিত একটি বৃক্ষ” দাঁড় করা হয়ত বা সহজ ; কিন্তু মূলত তা কৃত্রিম, প্রতারণামূলক এবং ক্ষণস্থায়ী। এজন্যই আজ শেষোক্ত প্রকারের তাকওয়াই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কিন্তু একটি স্বাভাবিক বৃক্ষ হতে যা কিছু লাভ করার আশা করা যায় ; একটি কৃত্রিম বৃক্ষ হতে তা কিছুতেই সম্ভব নয়, এটা সর্বজনবিদিত সত্য।



ইহসান

এখন ‘ইহসান’ সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই। পূর্বেই বলা হয়েছে, এটা ইসলামী জীবন প্রাসাদের সর্বোচ্চ মঞ্জিল সর্বোচ্চ পর্যায়। মুলতঃ ‘ইহসান’ বলা হয়ঃ আল্লাহ তাঁর রসূল এবং তাঁর ইসলামের সাথে মনের এমন গভীরতম ভালবাসা, দুশ্‌ছেদ্যবন্ধন ও আত্মহারা প্রেম পাগল ভাবধারাকে, যা একজন মুসলমানকে ‘ফানা ফিল ইসলাম’ ‘ইসলামের জন্য আত্মোৎসর্গীকৃত প্রাণ’ করে দিবে। তাকওয়ার মূল কথা হচ্ছে আল্লাহর ভয়, যা আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ হতে দূরে সরে থাকতে উদ্বুদ্ধ করে। আর ইহসানের মূলকথা হচ্ছে আল্লাহর প্রেম আল্লাহর ভালবাসা। এটা মানুষকে আল্লাহর সন্তোষ লাভ করার জন্য সক্রিয় করে তোলে। এ দু’টি জিনিসের পারস্পরিক পাথর্ক্য একটি উদাহরণ হতে বুঝা যায়। সরকারি চাকুরীজীবিদের মধ্যে এমন কিছু সংখ্যক লোক থাকে, যারা নিজ নিজ নির্দিষ্ট দায়িত্ব, কতর্বাানুভূতি ও আগ্রহ উৎসাহের সাথে যথাযথভাবে আঞ্জাম দেয়। সমগ্র নিয়ম-কানুন ও শৃঙ্খলা রক্ষা করে তারা চলে এবং সরকারের দৃষ্টিতে আপত্তিকর কোনো কাজই তারা কখনো করে না। এ ছাড়া আর এক ধরনের লোক থাকে, যারা ঐকান্তিক নিষ্ঠা, আন্তরিক ব্যগ্রতা ও তিতিক্ষা এবং আত্মোৎসর্গপূর্ণ ভাবধারার সাথেই সরকারের কল্যাণ কামনা করে। তাদের উপর যেসব কাজ ও দায়িত্ব অর্পিত হয়, তারা কেবল তাই সম্পন্ন করে না, যেসব কাজে রাষ্ট্রের কল্যাণ ও উন্নতি হতে পারে আন্তরিকতার সাথে সেইসব কাজও তারা আঞ্জাম দেবার জন্য যত্নবান হয় এবং এজন্য তারা আসল কর্তব্য ও দায়িত্ব অপেক্ষা অনেক বেশি কাজ করে থাকে। রাষ্ট্রের ক্ষতিকর কোনো ঘটনা ঘটে বসলেই তারা নিজেদের জানমাল ও সন্তান সবকিছুই উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত হয়। কোথাও আইন-শৃঙ্খলা লংঘিত হতে দেখলে তাদের মনে প্রচণ্ড আঘাত লাগে। কোথাও রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও বিদ্রোহ ঘোষণার লক্ষণ দৃষ্টিগোচর হলে তা অস্থির হয়ে পড়ে এবং তা দমন করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে। নিজে সচেতনভাবে রাষ্ট্রের ক্ষতি করা তো দূরের কথা তার স্বার্থে সামান্য আঘাত লাগতে দেয়া তাদের পক্ষে সহ্যাতীত হয়ে পড়ে এবং সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি দূর করার ব্যাপারে সাধ্যানুসারে চেষ্টার বিন্দুমাত্র ত্রুটি করে না। পৃথিবীর সর্বত্র একমাত্র তাদের রাষ্ট্রের জয়জয়কার হোক এবং সর্বত্রই এরই বিজয় পতাকা উড্ডীন হয়ে পত পত করতে থাকুক এটাই হয় এই শ্রেণীর সরকারি কর্মচারীদের মনের বাসনা। এই দু’য়ের মধ্যে প্রথমোক্ত কর্মচারীগণ হয় রাষ্ট্রের ‘মুত্তাকী’ আর শেষোক্ত কর্মচারীগণ হয় ‘মুহসীন’ উন্নতি এবং উচ্চপদ মুত্তাকীরাও লাভ করে থাকে, বরং যোগ্যতম কর্মচারীদের তালিকায় তাদেরই নাম বিশেষভাবে লিখিত থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ‘মুহসিনদের’ জন্য সরকারের নিকট যে সম্মান ও মযার্দা হয়ে থাকে, তাতে অন্য কারোই অংশ থাকতে পারে না। ইসলামে ‘মুত্তাকী’ ও ‘মুহসীনদের’ পারস্পরিক পার্থক্য উক্ত উদাহরণ হতে সুস্পষ্টরূপে বুঝতে পারা যায়। ইসলামে মুত্তাকীদেরও যথেষ্ট সম্মান রয়েছে। তারাও শ্রদ্ধাভাজন সন্দেহ নেই কিন্তু ইসলামের আসল শক্তি হচ্ছে মুহসিনগণ। আর পৃথিবীতে ইসলামের মূল উদ্দেশ্য একমাত্র ‘মুহসিনদের’ দ্বারাই সুস্পন্ন হতে পারে।
ইহসান এর নিগূঢ় তত্ত্ব জেনে নেয়ার পর প্রত্যেক পাঠকই অনুমান করতে পারেন যে, যারা আল্লাহর দীন ইসলামকে কুফরের অধীন কুফর কর্তৃক প্রভাবান্বিত দেখতে পায়, যাদের সামনে আল্লাহ নির্ধারিত সীমালংঘিত পর্যুদস্তই শুধু নয় নিঃশেষে ধ্বংস করার ব্যবস্থা করা হয়, আল্লাহর বিধান কেবল কার্যতই নয় সর্বতোভাবেই বাতিল করে দেয়া হয়, আল্লাহর পৃথিবীতে আল্লাহর পরিবর্তে আল্লাহদ্রোহীদের ‘রাজত্ব’ ও প্রভাব স্থাপিত হয়, কাফেরী ব্যবস্থার আধিপত্যে কেবল জনসমাজেই নৈতিক ও তামাদ্দুনিক বিপর্যয় উদ্‌ভুত হয় না, স্বয়ং মুসলিম জাতিও অত্যন্ত দ্রুততার সাথে নৈতিক ও বাস্তব (কর্মগত) ভুলভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে, সেখানে এসব প্রত্যক্ষ করার পরও যাদের মনে একটু ব্যাথা দুঃখ বা চিন্তা জেগে ওঠে না, এই অবস্থার পরিবর্তন সাধনের জন্য উদ্যম ও প্রয়োজনীয়তাবোধই যাদের মধ্যে জাগ্রত হয় না, বরং যারা নিজেদের মনকে এবং মুসলমান জনসাধারণকে ইসলাম বিরোধী জীবনব্যবস্থার প্রাধান্য ও প্রতিষ্ঠাকে নীতিগত ও কার্যত বরদাশত করার জন্য সান্ত্বনা দেয় ; এই শ্রেণীর লোকদেরকে ‘মুহসিন’ বলে কিরূপে মনে করা যেতে পারে, তা বুঝতে পারি না। আরো আশ্চার্যের বিষয় এই মারাত্মক অপরাধ ও গোনাহ করা সত্ত্বেও কেবল চাশত, এশরাক ও তাহাজ্জুদ প্রভৃতি নফল নামাজ পড়ার দরুন, জেকের-আজকার, মোরাকাবা-মুশাহিদা, হাদিস-কুরআনের অধ্যাপনা, খুঁটিনাটি সুন্নাত পালনের দ্বারা মানুষ ইহসানের উচ্চতর পর্যায়ে পৌছতে পারে বলে মনে করা হয়।
سرداد نداد دست در دست يزيد
“মস্তক দিয়েছি, কিন্তু ইয়াজীদের হাতে হাত মিলাতে প্রস্তুত হইনি।”
এরূপ বিপ্লবী ও ঐকান্তিক নিষ্ঠা এবং আত্মোৎসর্গীভাব কোনো লোকের মধ্যেই ওঠেনি। এজন্যই بازى اكرجه بانه سكا سرتو كهوسكا “জয়লাভ হয় তো করিনি, নিজের মস্তক তো উৎসর্গ করতে পেরেছি।” বলে নিজেকে সত্যিকারভাবে একমাত্র আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করতে পারিনি।
দুনিয়ার বৈষয়িক রাষ্ট্র এবং জাতিসমূহের মধ্যেও নিষ্ঠাবান, অনুগত এবং অবাধ্য কর্মচারীদের মধ্যে বাস্তবক্ষেত্রে যথেষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। দেশে বিদ্রোহ ঘোষিত হলে কিংবা দেশের কোনো অংশের উপর শত্রুপক্ষের আধিপত্য স্থাপিত হলে তখন যারা বিদ্রোহ ও শত্রুদের এই অন্যায় পদক্ষেপকে সংগত বলে মনে করে, অথবা এতে সন্তোষ প্রকাশ করে এবং তাদের সাথে বিজিতের ন্যায় আচরণ করতে শুরু করে, কিংবা তাদের প্রভুত্বাধীন এমন এক সমাজব্যবস্থা গঠন করে যার কর্তৃত্বের সকল চাবিকাঠি শত্রুদের নিকট থাকবে, আর কিছু ছোটখাটো ব্যাপারের আবিষ্কার ও ক্ষমতা তারা নিজেরা লাভ করবে কোনো রাষ্ট্র কিংবা জাতিই এই শ্রেণীর লোকদেরকে অনুগত বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য নাগরিকরূপে গ্রহণ করতে প্রস্তুত হয় না। জাতীয় পোশাক ও বাহ্যিক চালচলন কঠোরভাবে অনুসরণ করে চললেও এবং খুঁটিনাটি ব্যাপারে জাতীয় আইন দৃঢ়তার সাথে পালন করে চললেও এর কোনো মূল্যই দেয়া হয় না, বর্তমান যুগের কতো ঘটনাকেই এর উজ্জল উদাহরণ হিসেবে পেশ করা যেতে পারে।
বিগত মহাযুদ্ধের প্রথম অধ্যায়ে জার্মানী বহু দেশ দখল করেছিল এবং সেই বিজিত দেশসমূহের অধিবাসীদের মধ্যে অনেক লোকই তাদের সাথে সহযোগিতা করেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে এই দেশগুলো যখন জার্মান প্রভুত্ব হতে মুক্তিলাভ করলো তখন জার্মান প্রভুত্বের সাথে সহযোগিতাকারীদের প্রতি নির্মম ব্যবহার করা হয়েছিল। এসব রাষ্ট্র ও জাতির নিকট নিষ্ঠাপূর্ণ আনুগত্য যাচাই করার একটি মাত্র মাপকাঠি রয়েছে। শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ শত্রুপক্ষের প্রভুত্ব বিলুপ্তির জন্য কে কতোখানি কাজ করেছে এবং যার প্রভুত্ব সে স্বীকার করে বলে দাবী করে, তাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য কে কতোখানি চেষ্টা ও সাধনা করেছে নিষ্ঠাপূর্ণ আনুগত্য যাচাই করার এটাই হচ্ছে একমাত্র মানদণ্ড। দুনিয়ার রাষ্ট্রগুলোরই যখন এরূপ অবস্থা সকল প্রকার আনুগত্যকে এই তীব্র শাণিত মানদণ্ডে যাচাই করে নেয়াই যখন এদের রীতি দুনিয়ার কমবুদ্ধির মানুষের ন্যায় নিজের নিষ্ঠাবান আনুগত্য ও অবাধ্যতাকে পরীক্ষা করার জন্য আল্লাহর নিকট কি কোনো মানদণ্ড নেই? আল্লাহ তায়ালা কি শুধু শ্মশ্রুর দৈর্ঘ, লংগী-পায়জামার উর্ধস্থতা, তসবীহ পাঠ এবং দরূদ, অজীফা, নফল এবং মোরাকাবা প্রভৃতি কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজ-কর্ম দেখে প্রতারিত হবেন, আর নিজেরা খাঁটি ও নিষ্ঠাবান বান্দাহ বলে মনে করবেন? আল্লাহ সম্পর্কে এতো হীন ধারণা করা কি কোনরূপেই সমীচীন হতে পারে?

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম