অধ্যায় ০৩ : মৌলিক মানবীয় চরিত্রের বিশ্লেষণ

মানুষের উত্থান -পতন নৈতিক চরিত্রের উপর নির্ভরশীল

উল্লেখিত দু’টি দিক মানুষের মধ্যে ওতপ্রোতভাবে বিজড়িত রয়েছে । সমষ্টিগতভাবে তার সাফল্য ও ব্যর্থতা এবং তার উত্থান ও পতন বৈষয়িক বা বস্তুনিষ্ঠ ও শক্তি নিরপেক্ষ হতে পারে, আর না নৈতিক শক্তির মুখাপেক্ষীহীন হয়ে কিছু সময় বাঁচতে পারে । তার উন্নতির লাভ হলে উভয় শক্তির ভিত্তিতেই হবে, আর পতন হলেও ঠিক তখনি হবে, যখন এই উভয়বিধ শক্তি হতেই সে বঞ্চিত হয়ে যাবে। অথবা এটা অন্যান্যের তুলনায় অপক্ষাকৃত দৃর্বল ও নিস্তেজ হয়ে পড়বে । কিন্তু একটু গভীর ও সূক্ষ দৃষ্টিতে চিন্তা করলে নিঃসন্দেহ বুঝতে পারা যাবে যে, মানব জীবনের মূল সিদ্ধান্তকারী গুরুত্ব রয়েছে নৈতিক শক্তির –বৈষয়িক বা বস্তুনিষ্ঠ শক্তি নয়। বৈষয়িক বস্তুনিষ্ঠ উপায়-উপদান লাভ, স্বাভাবিক পন্থাসমূহের আনুকুল্য সাফল্য লাভের জন্য অপরিহায্য শর্ত এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কাজেই মানুষ যতদিন এই কার্যকারণ পরস্পরা জগতে বসবাস করবে, এই শর্ত কোন কোনরূপেই উপেক্ষিত হতে পারে না। কিন্তু এতদসত্ত্বেও যে মূল জিনিসটি মানুষের পতন ঘটায়, উত্থান দান করে এবং তার ভাগ্য নির্ধারণের ব্যাপারে যে জিনিসটির সর্বাপেক্ষা অধিক প্রভাব রয়েছে, তা একমাত্র নৈতিক শিক্ষা ভিন্ন আর কিছুই নয় ।

এটা সুষ্পষ্ট যে মানুষকে এর দেহসত্তা বা এর পাশবিক দিকটার জন্য কখনও মানুষ বলে অভিহিত করা হয় না, বরং মানুষকে মানুষ বলা হয় এর নৈতিক গুণ -গরিমার কারণে। মানুষের একটি দেহ আছে, স্বতন্ত্র একটি সত্তা আছে, তা কতকখানি স্থান দখল করে থাকে, সে শ্বাস – প্রশ্বাস গ্রহণ করে, কিংবা বংশ বৃদ্ধি করে ; কিন্তু শুধু এই কারণে মানুষ দুনিয়ার অন্যান্য বস্তু ও জন্তু হতে স্বতন্ত্র মর্যাদালাভের অধিকারী হতে পারে না। মানুষ নৈতিক গুণসম্পন্ন জীব, তার নৈতিক স্বাধীনতা ও নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। ঠিক এই জন্যই মানুষকে দুনিয়ার সমগ্র জীব জন্তু ও বস্তুর উপর বিশিষ্ট মর্যাদা দান করা হয়েছে । শুধু তা-ই নয়, মানুষকে ‘দুনিয়ার বুকে আল্লাহর খলীফা’ হওয়ার মহান মর্যাদায়ও অভিষিক্ত করা হয়েছে। অতএব মানবতার মূল প্রাণবস্তু সর্বাপেক্ষা প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যখন মানুষের নৈতিকতা, তখন মানুষের জীবনের গঠন –ভাঙ্গন ও উন্নতি- অবনতির ব্যাপারে চুড়ান্ত সিদ্ধ্ন্তকারী গুরুত্ব ও যে সে নৈতিক চরিত্রই রয়েছে তা কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না । বস্তুত মানুষের উত্থান -পতনের উপর তার নৈতিক নিয়ম –বিধান প্রত্যক্ষ প্রভাব বিদ্যমান।

এই নিগূঢ় তত্ত অনুধাবন করার পর আমরা যখন নৈতিক চরিত্রের গভীরতর বিশ্লেষন করি, তখন নীতিগতভাবে এর দু’টি প্রধান দিক আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়- একটি হচ্ছে মৌলিক মানবীয় চরিত্র, অপরটি হচ্ছে ইসলামী নৈতিক চরিত্র।


মৌলিক মানবীয় চরিত্রের বিশ্লেষণ

মৌলিক মানবীয় চরিত্র বলতে বুঝায় সেসব গুণবৈশিষ্ট্য যার উপর মানুষের নৈতিক সত্তার ভিত্তি স্থাপিত হয়। দুনিয়ায় মানুষের সাফল্য লাভের জন্য অপরিহার্য যবতীয় গুণ-গরিমাই অন্তর্ভূক্ত । মানুষ কোন সৎ উদ্দেশ্যের জন্য কাজ করুক, কি ভুল ও অসৎ উদ্দেশ্যে -সকল অবস্থায় তা একান্তই অপরিহার্য । মানুষ আল্লাহ, অহী, রাসূল এবং পরকাল বিশ্বাস করে কি করে না, তার হৃদয় কলুষমুক্ত কিনা, সদুদ্দেশ্যে কাজ করে অসুদুদ্দেশ্যে উল্লেখিত চরিত্রের ক্ষেত্রে সে প্রশ্ন একে বারেই অবান্তর । কারো মধ্যে ঈমান থাকুক কি না থাকুক, তাদের জীবন পবিত্র হোক কি অপবিত্র, তার চেষ্টা- সাধনার উদ্দেশ্য সৎ হোক কি অসৎ এসব প্রশ্নের উর্ধে থেকে পার্থিব জগতে সাফল্য লাভের জন্য অপরিহার্য গুণগুলো কেউ আয়ত্ত করলেই সে নিশ্চন্তরূপে সাফল্যমন্ডিত হবে এবং ঐসব গুণের দিক দিয়ে পশ্চাদপদ, প্রতিদন্দ্বিতায় তারা প্রথম ব্যক্তির পশ্চাতে পড়ে থাকবে। ঈমানদার কাফের , নেককার , বদকার কুসংসকারাচ্ছন্ন, বিপর্যয়কারী প্রভৃতি যে যাই হোক না কেন, তারমধ্যে যদি ইচ্ছাশক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণ শক্তি, প্রবল বাসনা উচ্চাসা ও সাহস, সহিষ্ণুতাও দৃঢ়তা তিতিক্ষা ও কৃচ্ছসাধনা, বীরত্ব ও বীর্যবত্তা, সহনশীলতা ও পরিশ্রম প্রিয়তা, উদ্দেশ্যের আকর্ষন এবং সে জন্য সবকিছুরই উৎসর্গ করার প্রবণতা, সতর্কততা, দূরদৃষ্টি ও অন্তরদৃষ্টি বোধশক্তি ও বিচার ক্ষমতা, পরিস্থিতি যাচাই করা এবং তদনুযায়ী নিজকে ঢেলে গঠন করা ও অনুকুল কর্মনীতি গ্রহণ করার যোগ্যতা নিজের হৃদয়াবেগ, ইচ্ছা বাসনা, স্বপ্ন সাধ ও উত্তেজনার সংযমশক্তি এবং অন্যান্য মানুষকে আকৃষ্ট করা, তাদের হৃদয়মনে প্রভাব বিস্তার করা ও তাদেরকে কাজে নিযুক্ত করার দুর্বার বিচক্ষণতা যদি কারো মধ্যে পুরোপরি ভাবে বর্তমান থাকে, তবে এই দুনিয়ায় তার জয় সুনিশ্চিত।

সেই সঙ্গে এমনগুণও কিছু না কিছু থাকা অপরিহার্য , যা মনুষ্যত্বের মুল --যাকে সৌজন্য ও ভদ্রতামূলক স্বভাব - প্রকৃতি বলা যায় এরই দৌলতে এক একজন লোকের সম্মান - মর্যাদা, মানব সমাজে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। আত্মসম্মান জ্ঞান, বদান্যাতা দয়া- অনুগ্রহ, সহানুভুতি, সুবিচার, নিরপেক্ষতা, ঔদার্য ও হৃদয়মানের প্রসারতা, বিশালতা দৃষ্টির উদারতা, সত্যবাদিতা ও সত্যপ্রিয়তা, বিশ্বাসপরায়ণতা, ন্যায়- নিষ্ঠা, ওয়াদাপূর্ণ করা, বুদ্ধিমত্তা, সভ্যতা, ভ্যবতা, পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা এবং মন আত্মার সংযম শক্তি প্রভৃতি এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

কোন জাতির বা মানব গোষ্ঠীর অধিকাংশ লোকের মধ্যে যদি উল্লেখিত গুনাবলীর সমাবেশ হয়, তবে মানবতার প্রকৃত মূলধনই তার অর্জিত হয়েছে বলে মনে করতে হবে এবং এর ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী সমাজ সংস্থা গঠন করা তার পক্ষে অতীব সহজসাধ্য হবে। কিন্তু এই মূলধন সমাবিষ্ট হয়ে কার্যত একটি সদৃঢ় ও ক্ষমতাসম্পন্ন সামাজিক রূপলাভ করতে পারে না- যতক্ষণ পর্যন্ত না তার সাথে আরো কিছু নৈতিক গুণ এসে মিলিত হবে। উদাহরণ স্বরূপবলা যায়, সমাজের সমগ্র কিংবা অধিকাংশ মানুষই একটি সামগ্রিক লক্ষ্যকে নিজেদের চরম লক্ষ্যরূপে গ্রহণ করবে। সেই লক্ষ্যকে তার ব্যক্তিগত স্বার্থ-এমনকি, নিজের ধন-প্রাণ ও সম্পদ সন্তান হতেও অধিক ভালবাসবে, তাদের পরস্পরের মধ্যে প্রেম ভালবাসা ও সহানুভূতির মনোভাব প্রবল হবে, তাদের মধ্যে পরস্পর মিলেমিশে কাজ করার মনোভাব থাকবে ।

সুসংগঠিত ও সংঘ বদ্ধভাবে নির্র্দিষ্ঠ উদ্দেশ্যে চেষ্টা - সাধনার জন্য যতখানি আত্মদান। অপরিহার্য, তা করতে তারা প্রতিনিয়ত প্রস্তুত থাকবে। ভাল ও মন্দ নেতার মধ্যে পার্থক্য করার মত বুদ্ধি- বিবেচনা তাদের থাকতে হবে - যেন যোগ্যতম ব্যক্তি তাদের নেতা নিযুক্ত হতে পারে। তাদের নেতৃবৃন্দের মধ্যে অপরিসীম দূরদৃষ্টি ও গভীর ঐকান্তিক নিষ্ঠা এবং এছাড়া নেতৃত্বের জন্য অপরিহায্য অন্যান্য গুনাবলীও বর্তমান থাকা দরকার । সামাজের সকল লোককে নিজেদের নেতৃবৃন্দের আদেশ পালন ও অনুগমনে অভ্যস্থ হতে হবে। তাদের উপর জনগণের বিপুল আস্থা থাকতে হবে এবং নেতৃবৃন্দের নির্দেশে নিজেদের সমগ্র হৃদয়, মন, দেহের শক্তি এবং যাবতীয় বৈষয়িক উপায় - উপদান; লক্ষ্যস্থলে উপনীত হওয়ার জন্য যে কোন কাজের সামগ্রিক জনমত এত সজাগ - সচেতন ও তীব্র হতে হবে যে সামগ্রিক কল্যাণের বিপরীত ক্ষতিকারক কোন জিনিসকেই নিজেদের মধ্যে এক মুহূর্তের তরেও টিকতে দেবে না। বস্তুত এগুলোই হচ্ছে মৌলিক মানবীয় চরিত্র। এগুলোকে আমি “মৌলিক মানবীয় চরিত্র বলে এজন্য অভিহিত করছি যে, মূলত এ নৈতিক গুণগুলোই হচ্ছে মানুষের নৈতিক শক্তি ও প্রতিভার মূল উৎস । মানুষের মধ্যে এই গুণাবলীর তীব্র প্রভাব বিদ্যামান না থাকলে কোন উদ্দেশ্যের জন্যই কোন সার্থক সাধনা করা তার পক্ষে আদৌ সম্ভব হয় না। এই গুণগুলোকে ইস্পাতের সাথে তুলানা করা যেতে পারে। ইস্পাতের মধ্যে দৃঢ়তা, অক্ষয়তা ও তীব্রতা রয়েছে, এরই সাহায্যে একটি হাতিয়ার অধিকতর শাণিত ও কার্যকারী হতে পারে। অতপর তা ন্যায় কাজে ব্যবহৃত হবে কি অন্যায় কাজে - সে প্রশ্ন অপ্রাসংগিক। যার সৎ উদ্দেশ্য রয়েছে এবং সে জন্য কাজ করতে চাহে, ইস্পাত নির্মিত অস্ত্রই তার জন্য বিশেষ উপকারি হতে পারে, পঁচা কাঠ নির্মিত অস্ত্র নয়। কারণ, আঘাত সহ্য করার মত কোন ক্ষমতাই তাতে নেই। ঠিক এই কথাটি নবী করীম (সাঃ) হাদীস শরীফে এরশাদ করছেন , “তোমাদের মধ্যে ইসলাম পূর্ব জাহেলী যুগের উত্তম লোকগণ ইসলামী যুগেও উত্তম ও শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত হবে।” অর্থাৎ জাহেলী যুগে যাদের মধ্যে যোগ্যতা ও বলিষ্ঠ কর্মক্ষমতা এবং প্রতিভা বর্তমান ছিল ইসলামের মধ্যে এসে তারাই যোগ্যতম কর্মী প্রতিপন্ন হয়েছিল। তাদের কর্মক্ষমতা উপযুক্ত ক্ষেত্রে স্বতস্ফুর্ত হয়েছে । পার্থক্য শুধূ এতটুকু যে, পূর্বে তাদের প্রতিভা ও কর্মক্ষমতা ভুল পথে ব্যবহার হতো, এখন ইসলাম তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করেছে। কিস্তু অকর্মণ্য ও হীনবীর্য লোক না জাহেলিয়াতের যুগে কোন কার্য সম্পাদন করতে পেরেছে না ইসলামের কোন বৃহত্তম খেদমত আঞ্জাম দিতে সমর্থ হয়েছ।

আরব দেশে নবী করীমের (সাঃ) যে বিরাট অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ হয়েছিল এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে তার সর্বগ্রাসী প্রভাব সিন্ধু নদ শুরু করে . আটলান্টিক মহাসাগরের বেলাভূমি পর্যন্ত - দুনিয়ার একটি বিরাট অংশের উপর বিস্তারিত হয়েছিল তার মূল কারণ এটাই ছিল যে, আরব দেশের সর্বপেক্ষা উত্তম ও প্রতিভা সম্পন্ন মানুষ তাঁর আদর্শানুগামী হয়েছিল। তাদের মধ্যে উক্ত রূপ চরিত্রের বিরাট শক্তি নিহিত ছিল। মনে করা যেতে পারে, আরবের অকর্মণ্য, অপদার্থ, বীর্যহীন, ইচ্ছাশক্তি বিবর্জিত, বিশ্বাস- অযোগ্য লোকদের একটি বিরাট ভীড় যদি নবী কারীমর (সাঃ) চারপাশে জমায়েত হতো, তবে অনুরূপ ফল কখনোই লাভ করা সম্ভব হতো না । একথা একেবারেই স্বতসিদ্ধ।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম