নৈতিক চরিত্রের দ্বিতীয় প্রকার যাকে আমি ইসলামি নৈতিকতা বলে অভিহিত করেছি এ সম্পর্কেও আলোচনা করতে হবে।
মূলত এটা মৌলিক মানবীয় চরিত্র হতে স্বতন্ত্র ও ভিন্নতর কোন জিনিস নয়, বরং তার বিশুদ্ধকারী ও পরিপূরক মাত্র। ইসলাম সর্বপ্রথম মানুষের মৌলিক মানবীয় চরিত্রকে সঠিক ও নির্ভূল কেন্দ্রের সাথে যুক্ত করে দেয়। অতপর এটা সম্পূর্ণ রূপে কল্যাণকর ও মঙ্গলময় পরিণতি হয়। মৌলিক মানবীয় চরিত্র একেবারে প্রাথমিক অবস্থায় বস্তুনিরপেক্ষ নিছক একটি শক্তি মাত্র। এই অবস্থায় তা ভালও হতে পারে, মন্দও হতে পারে , কল্যাণকরও হতে পারে, অকল্যাণের হাতিয়ারও হতে পারে। যেমন, একখানি তরবারি একটি তীর শাণিত অস্ত্র মাত্র।এটা একটি দস্যুর মুষ্টিবদ্ধ হলে যুলুম-পীড়নের একটি মাত্মক হাতিয়ারে পরিণত হবে। আর আল্লাহর পথে জিহাদকারীর হাতে পড়ে এটা হতে পারে সকল কল্যাণ ও মঙ্গলের নিয়ামক। অনুরূপ ভাবে মৌলিক মানবীয় চরিত্র কারো মধ্যে শুধু বর্তমান থাকাই তার কল্যাণকর হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। বরং নৈতিক শক্তি সঠিক পথে নিয়োজিত হওয়ার উপরই তা একান্তভাবে নির্ভর করে। ইসলাম একে সঠিক পথে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে মাত্র। ইসলামের তাওহীদী দাওয়াতের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে আল্লাহর সন্তোষ লাভ করা।
এই দাওয়াত গ্রহনকারী লোকদের পার্থিব জীবনের সমগ্র চেষ্টা-সাধনা ও শ্রম মেহনতকে আল্লাহর সন্তোষ লাভের জন্যই নিয়োজিত হতে হবে। (ওয়া ইলাইকা নাসআ ওয়া নাহফিদু) “হে আল্লাহ! আমাদের সকল চেষ্টা-সাধনা এবং সকল দুঃখ ও শ্রম স্বীকারের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে তোমার সন্তোষ লাভে। ” ইসলামের দওয়াত গ্রহণকারী ব্যক্তির চিন্তা ও কর্মের সকল তৎপরতা আল্লাহ নির্ধারিত সীমার মধ্যে আবদ্ধ হবে। (ইয়্যাক না’বুদু ওয়া ইলাইকা নাস আ) “হে আল্লাহ! আমরা তোমারই দাসত্ব করি এবং তোমার জন্য আমরা নামায ও সিজদায় ভুলুণ্ঠিত হই” ।
ইসলাম মানুষের সমগ্র জীবন ও অন্তর্নিহিত শক্তি নিজেকে এভাবেই নিয়ন্ত্রিত ও সংশোধিত করে। এই মৌলিক সংশোধনের ফলে উপরোল্লিখিত সকল বুনিয়াদি মানবীয় চরিত্রই সঠিক পথে নিযুক্ত ও পরিচালিত হয় এবং তা ব্যক্তিস্বার্থ, বংশ পরিবার কিংবা জাতি ও দেশের শ্রেষ্ঠত্ব বিধানের জন্য অযথা ব্যয়িত না হয়ে একান্তভাবেই সত্যের বিজয় সম্পাদনের জন্যই সংগতরূপে ব্যয় হতে থাকে। এর ফলেই তা একটি নিছক শক্তি মাত্র হতে উন্নীত হয়ে সমগ্র পৃথিবীর জন্য একটি কল্যাণ ও রহমতের বিরাট উৎসে পরিণত হয়। দ্বিতীয়ত, ইসলাম মৌলিক মানবীয় চরিত্রকে সুদৃঢ় করে দেয় এবং চরম প্রান্তসীমা পর্যন্ত এর ক্ষেত্র ও পরিধি সম্প্রসারিত করে। উদাহরণ স্বরূপ ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার উল্লেখ করা যেতে পারে। সর্বাপেক্ষা অধিক ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণু ব্যক্তির মধ্যেও যে ধৈর্য ক্ষমতা দেখতে পাওয়া যায়, তা যদি নিছক বৈষয়িক স্বার্থের জন্য হয় এবং শিরক ও বস্তুবাদী চিন্তার মূল হতে রস গ্রহণ করে, তবে তার একটি সীমা আছে, যে পর্যন্ত পৌঁছিয়ে তা নিঃশেষ হয়ে যায়। অতপর উহা কেঁপে উঠে , নিস্তেজ ও নিস্প্রভ হয়ে পড়ে। কিন্তু যে ধৈর্য ও তিতিক্ষা তাওহীদের উৎস মূল হতে ‘রস’ গ্রহণ করে এবং যা পর্থিব স্বার্থ লাভের জন্য নয় --- একান্তভাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের উদ্দেশ্যেই নিয়োজিত ---- তা ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও তিতিক্ষার এক অতল স্পর্শ মহাসাগরে পরিণত হবে। দুনিয়ার সমগ্র দুঃখ-কাষ্ট ও বিপদ- মুসিবত মিলিত হয়েও তাকে শূন্য ও শুষ্ক করতে সমর্থ হয় না। এজন্যই ‘অমুসলিমদের’ ধৈর্য খুবই সংকীর্ণ ও নগন্য হয়ে থাকে। যুদ্ধের মাঠে তারা হয়ত গোলাগুলির প্রবল আক্রমনের সামনে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে প্রতিরোধ করেছে। কিন্তু পর মূহুর্তেই নিজেদের পাশবিক লালসা চরিতার্থ করার সুযোগ আসা মাত্রই কামাতুর বৃত্তির সামান্য উত্তেজনার আঘাতে তা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু ধৈর্য ও সহিষ্ণুতাকে জীবনের বিশাল ক্ষেত্রে বিস্তারিত করে দেয় এবং সামান্য ও নির্দিষ্ট কয়েকটি দুঃখ - কষ্টও বিপদ -মুসিবত প্রতিরোধের ব্যাপারেই নয়, সকল প্রকার লোভ- লালসা, ভয়, আতঙ্ক ও আশাংকা এবং প্রত্যেকটি পাশবিক বৃত্তির মোকাবিলা স্থিতিলাভের জন্য এটা একটি বিরাট শক্তির কাজ করে ।
বস্তুত ইসলাম মনুষের সমগ্র জীবনকে একটি অচল-অটল ধৈর্যপূর্ণ পর্বত প্রায় সহিষ্ণু জীবনে পরিণত করে। জীবনের প্রত্যেকটি পদক্ষেপের সঠিক পন্থা অবলম্বন করাই হয় এহেন ইসলামী জীবনের মূলনীতি তাতে সীমাহীন দঃখ - দুর্দশা, বিপদ- মুসিবত, ক্ষতি - লোকসান বরদাশত করতে হলে ও এই জীবনে এর কোন সুফল পাওয়া না গেলেও জীবনের গতি ধারায় একবিন্দু পরিমাণ বক্রতা সৃষ্টি করা সম্ভব হবে না। অভাবিত পূর্ব সুযোগ –সুবিধা লাভ, উন্নতি এবং আশা -ভরসার শ্যামল সবুজ বাগিচা দেখতে পেলেও নয়। পরকালের নিশ্চিত সুফেলের সন্দেহাতীত আশায় দুনিয়ার সমগ্র জীবনে অন্যায় ও পাপ হতে বিরত থাকা এবং পুণ্য, মঙ্গল ও কল্যাণের পথে দৃঢ়তার সাথে অগ্রসর হওয়ারই নাম হচ্ছে ইসলামী সহিষ্ণতা ইসলামী সবর ।
পরন্তু, কাফেরদের জীবনের খুব সংকীর্ণতম পরিবেশের মধ্যে ততধিক সংকীর্ণ ধারণা অনুযায়ী সহিষ্ণতার যে রূপ দেখতে পাওয়া যায়, মুসলামানদের জীবনে তাও অনিবার্যরূপে পরিলক্ষিত হবে। এই উদাহরণের ভিত্তিতে অন্যান্য সমগ্র মৌলিক মানবীয় চরিত্র সম্পর্কের ধারণা করা যেতে পারে এবং বিশুদ্ধ ও নির্ভুল চিন্তা ও আদর্শ ভিত্তিক না হওয়ার দরুণ কাফেরদের জীবন কত দর্বল এবং সংকীর্ণ হয়ে থাকে তাও নিসন্দেহে অনুধাবন করা যেতে পারে। কিন্তু ইসলাম সেইসবকে বিশুদ্ধ ও সুষ্ঠু ভিত্তিতে স্থাপিত করে অধিকতর মজবুত এবং বিস্তৃত ও বিশাল অর্থদান করে। তৃতীয়ত, ইসলাম মৌলিক মানবীয় চরিত্রের প্রাথমিক পর্যায়ের উপর মহান উন্নত নৈতিকতার একটি অতি জাকজমকপূর্ণ পর্যয় রচনা করে দেয় । এর ফলে মানুষ সৌজন্য ও মাহাত্মের এক চুড়ান্ত ও উচ্চ পর্যায়ে আরোহণ করে থাকে ।
ইসলাম মানুষের হৃদয়মনকে স্বার্থপরতা, আত্মম্বরিতা, অত্যাচার, নির্লজ্জতা ও অসংলগ্নতা উশৃঙ্খলতা হতে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করে দেয় এবং তাতে আল্লাহর ভয়, তাকওয়া, আত্মশুদ্ধি, সত্যপ্রিয়তা জাগিয়ে তোলে । তার মধ্যে নৈতিক দায়িত্ববোধ অত্যন্ত তীব্র ও সচেতন করে তোলে । আত্মসংযম তাকে সর্বতোভাবে অভ্যস্ত নিখিল সৃষ্টি জগতের প্রতি তাকে দয়াবান, সৌজন্যশীল, অনুগ্রহ সম্পন্ন , সহানুভুতিপূর্ণ, বিশ্বাসভাজন, স্বার্থহীন, সদিচ্ছাপূরণ, নিষ্কলুষ নির্মল ও নিরপেক্ষ, সুবিচারক এবং সর্বক্ষণের জন্য সত্যবাদী ও সত্যপ্রিয় করে দেয় ।
তার মধ্যে এমন এক উচ্চ পবিত্র প্রকৃতি লালিত - পালিত হতে থাকে, যার নিকট সবসময় মঙ্গলেরই আশা করা যেতে পারে - অণ্যায় এবং পাপের কোন আশংকা তার দিক হতে থাকতে পারে না। উপরন্তু ইসলাম মানুষকে কেবল ব্যক্তিগতভাবে সৎ বানিয়েই ক্ষ্যান্ত হয় না। -তা যথেষ্টও মনে করে না। রাসূলের বাণী অনুযায়ী তাকে , কল্যানের দ্বার উৎঘাটন এবং অকল্যাণের পথ রোধকারীও বানিয়ে দেয় । অন্য কথায় গঠনমূলক দষ্টিতে ইসলাম তার উপর ন্যায়র প্রচার ও প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায়ের প্রতিরোধ ও মূলোৎপাটনের বিরাট কর্তব্য পালণের দায়িত্ব অর্পণ করে। এরূপ স্বভাব - প্রকৃতি লাভ করতে পারলে এবং কার্যত ইসলামের বিরাট মহান মিশনের জন্য সাধনা করলে এর সর্বাত্মক বিজয়াভিযানের মোকাবিলা করা কোন পার্থিব শক্তিরই সাধ্যায়ত্ত হবে না।
0 comments: