ইসলামী নৈতিকতা বলতে আমরা যা বুঝে থাকি, কুরআন ও হাদীসের শিক্ষানুযায়ী এর চারটি ক্রমিক পর্যায় রয়েছে । প্রথম ঈমান, দ্বিতীয় ইসলাম, তৃতীয় তাকওয়া এবং চতুর্থ ইহসান। বস্তুত এ চারটি পর্যায় পরস্পর এমন স্বাভাবিক শ্রেণী পরম্পরা অনুযায়ী সুসংবদ্ধ হয়ে আছে যে, প্রত্যেকটি পরবর্তী পর্যায়ই পূর্ববর্তী পর্যায় হতে উদ্ভূত এবং অনিবার্যরূপে এরই উপর প্রতিষ্ঠিত। এজন্য নিম্নবর্তী পর্যায় যতক্ষণ না দৃঢ় পরিপক্ক হবে ততক্ষণ পর্যন্ত এর উপরের পর্যায়ের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে কল্পনাও করা যায় না। এই সমগ্র ইমারতের মধ্যে ঈমান হচ্ছে প্রাথমিক ভিত্তিপ্রস্তর। এরই উপর ইসলামের স্তর রচিত হয়, তার উপর ‘তাকওয়া’এবং সকল পর্যয়ের উপরে হয় ‘ইহসানের’ প্রতিষ্ঠা। ঈমান না হলে ইসলামে তকওয়া কিংবা ‘ইহসান’ লাভ করার কোন সম্ভবনাই হতে পারে না। ঈমান দুর্বল হলে তার উপর উচ্চতর পর্যায় সমূহের দূর্বহ বোঝা চাপিয়ে দিলেও তা অতিশয় কাঁচা, শিথিল ও অন্তসারশুন্য হয়ে পড়বে । এই ঈমান সংকীর্ণ হলে যতখানি তার ব্যপ্তি হবে, ইসলাম এবং ইহসান ঠিক ততখানি সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ হবে, তাতে সন্দেহ নেই । অতএব ঈমান যতক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণরূপে বিশুদ্ধ সুদৃঢ় ও সম্প্রসারিত না হবে দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানসম্পন্ন কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তিই তার উপর ইসলাম, তাকওয়া কি ইহসান প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তাও করতে পারে না।
অনুরূপভাবে ‘তাকওয়ার’ পূর্বে ‘ইসলাম’ এবং ‘ইহসানের’ পূর্বে ‘তাকওয়া’ বিশুদ্ধকরণ সুষ্ঠতা বিধান এবং স¤প্রসারিতকরণ অপরিহার্য । কিন্তু সাধারণত আমরা এটাই দেখতে পাই যে, এই স্বাভাবিক ও নীতিগত শ্রেণী পরস্পর ার প্রতি চরম উপেক্ষা প্রদর্শন করা হয় এবং ঈমান ও ইসলামের পর্যায়ে পূর্ণতা সাধন ছাড়াই তাকওয়া ও ইহসানের আলোচনা শুরু করে দেয়া হয়। এটা অপেক্ষাও দুঃখের বিষয় এই যে, সাধারত লোকদের মনে ঈমান ইসলাম সম্পর্কে অত্যন্ত সংকীর্ণ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে রয়েছে। এজন্যই শুধু বাহ্যিক বেশ -ভুষা, ও পোশাক -পরিচ্ছদ, উঠা -বসা, চলা- ফেরা, খানা-পিনা প্রভৃতি বাহ্যিক আচার -আনুষ্ঠানসমূহ নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে করতে পারলেই তাকওয়ার, পূর্ণতা সাধন হয়ে গেলে। আর ইবাদতের মধ্যে নফল নামায, দুরূদ, অজিফা পাঠ এই ধরনের কয়েকটি বিশেষ কাজ করলেই ইহসানের উচ্চতম অধ্যায় লাভ হয় বলে ধারণা করে। অথচ এ ধরনের তাকওযা ও ইহসানের সংগে সংগে লোকদের জীবনের এমন অনেক সুস্পষ্ট সিদর্শনও পাওয়া যায় যার ভিত্তিতে অসায়াসে বলা চলে যে, তাকওয়া ও ইসলাম তো দূরের কথা, আসল ঈমানই এখন পর্যন্ততার মধ্যে পরিপক্কতা ও সুষ্টুতা লাভ করেনি।
এরূপ ভুল ধারণা ও ভূল দীক্ষা পদ্ধতি আমাদের মধ্যে যতদিন বর্তমান থাকবে ততদিন পর্যন্ত আমরা ইসলামী নৈতিকতার অপরিহার্য অধ্যায়সমূহ কখনো অতিক্রম করতে পারব বলে আশা করা যায় না। এজন্যই ঈমান, ইসলাম, তাকওয়া, ইহসান ---- এই চারটি অধ্যায় সম্পর্কে পূর্ণ সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা এবং সেই সংগে এদের স্বাভাবিক ও ক্রমিক শ্রেণী পরম্পরাও অনুধাবন করা একান্তই অপরিহার্য।
ঈমান
সর্বপ্রথম ঈমান সম্পর্কেই আলোচনা করা যাক। কারণ, এটা ইসলামী জিন্দেগীর প্রাথমিক ভিত্তিপ্রস্তর। তাওহীদ ও রিসালাত --- আল্লাহর একত্ব ও হযরত মুহাম্মাদ (সা)- কে রাসূলরূপে স্বীকার করে নেয়াই এক ব্যক্তির ইসলামের পরিসীমায় অনুপ্রবেশ লাভের জন্য যথেষ্ট। তখন তার সাথে ঠিক একজন মুসলমানেরই ন্যায় আচরণ করা আবশ্যক --- তখন তার সাথে ঠিক একজন মুসলমানেরই ন্যায় আচরণ করা আবশ্যক -- তখন এরূপ আচরণ ও ব্যবহার পাবার তার অধিকারও হয়। কিন্তু সাধারণ স্বীকারোক্তি এমনি আইনগত প্রয়োজন পুর্ণ করার জন্য যথেষ্ট হলেও ইসলামী জিন্দেগীর সমগ্র ‘ত্রিতল বিশিষ্ট উচ্চ প্রাসাদের’ ভিত্তিপ্রস্তর হওয়ার জন্যও কি এটা যথেষ্ট হতে পারে?
সাধারন লোকেরা এরূপই ধারণা করে। আর এজন্য যেখানেই এই স্বীকারোক্তিটুকু পাওয়া যায়, সেখানেই বাস্তবিকভাবে ইসলাম, তকওয়া ও ইহসানের উচ্চতলসমূহ তৈরী করার কাজ শুরু করে দেয়া হয়। ফলে সাধারনত এটা হাওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত প্রসাদেরই (?) অনুরূপ ক্ষণভঙ্গুর ও ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ে। বস্তুত একটি পরিপূর্ণ ইসলামী জিন্দেগী গঠনের জন্য সুবিস্তারিত সম্প্রসারিত, ব্যপক গভীর ও সুদৃঢ় ঈমান একান্তই অপরিহার্য। ঈমানের বিস্তার ও ব্যাপকতা হতে জীবনের কোন একটি দিক বা বিভাগও যদি বাইরে পড়ে থাকে, তবে ইসলামী জিন্দেগীর সেই দিকটিই পুনর্গঠন লাভ হতে বঞ্চিত থেকে যাবে এবং তার গভীরতায় যতটুকু অভাবই থাকবে, ইসলামী জিন্দিগীর প্রাসাদ সেখানেই দূর্বল ও শিথিল হয়ে থাকবে, এ কথায় কোনই সন্দেহ নেই।
উদাহরণ স্বরূপ “ আল্লাহর প্রতি ঈমানের” উল্লেখ করা যেতে পারে। বস্তুত আল্লাহর প্রতি ঈমান দ্বীন ইসলামের প্রাথমিক ভিত্তিপ্রস্তর। একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারা যাবে যে, আল্লাহকে স্বীকার করার উক্তিটুকু সাদাসিধে পর্যায় অতিক্রম করে বিস্তারিত ও সপ্রসারিত ক্ষেত্রে প্রবেশ করার পর এর বিভিন্ন রূপ দেখতে পাওয়া যায়। কোথাও “আল্লাহর প্রতি ঈমান” একথা বলে শেষ করা যায় যে, আল্লাহ বর্তমান অছেন। সন্দেহ নেই, পৃথিবীর তিনি সৃষ্টিকর্তা এবং তিনি এক ও অদ্বিতীয়, এটাও সত্য কথা। কোথাও আরও একটু অগ্রসর হয়ে আল্লাহকে মা’বুদ এবং তার উপাসনা করার প্রয়োজনীয়তাও মেনে নেয়া হয়। কোথাও আল্লাহর গুণ এবং তাঁর অধিকার ও ক্ষমতা সম্পর্কে বিস্তারিত ও ব্যাপক ধারণাও শুধু এতটুকু হয় যে, আলেমুল গায়েব, সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা, প্রার্থনা শ্রবণকারী, অভাব ও প্রয়োজন পূরণকারী তিনি এবং ইবাদাতের সকল খুঁটিনাটি রূপ একমাত্র তাঁর জন্যই নির্দিষ্ট করা বাঞ্ছনীয়। এখানে কেউ তার শরীক নেই। আর “ধর্মীয় ব্যাপার সমূহে” চূড়ান্ত দলীল হিসেবে আল্লাহর কিতাবকেও স্বীকার করা হয়। কিন্তু এরূপ বিভিন্ন ধারণা-বিশ্বাসের পরিণামে যে একই ধরণের জীবন ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে না, তা সুস্পষ্ট কথা । বরং যে ধরণা যতখানি সীমাবদ্ধ, কর্মজীবনে ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে ইসলামী বৈশিষ্ট্য অনিবার্যরূপে ততখানি সংকীর্ণ হয়েই দেখা দিবে এমনকি যেখানে সাধারণ ধর্মীয় ধারণানুযায়ী “আল্লাহর প্রতি ঈমান” অপেক্ষাকৃতভাব অতীব ব্যপক ও সম্প্রসারিত হবে, সেখানেও ইসলামী জিন্দেগীর বাস্তবরূপ এই হবে যে, একদিকে আল্লাহর দুশমনদের সাথে বন্ধুত্ব রক্ষা করা হবে এবং অন্যদিকে আল্লাহর “আনুগত্য” করার কাজও সেই সংগে সম্পন্ন করা হবে কিংবা ইসলামী নেজাম ও কাফেরী নেজাম মিলিয়ে একটি জগাখিচুরী তৈরী করা হবে।
এভাবে “আল্লাহর প্রতি ঈমান” এর গভীরতার মাপকাঠিও বিভিন্ন। কেউ আল্লাহকে স্বীকার করা সত্বেও সাধারণ জিনিসকেও আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয় না। কেউ আল্লাহর কোন কোন জিনিস অপরাপর জিনিস অপেক্ষা ‘অধিক প্রিয়’ বলে মনে করে। আবার অনেক জিনিসকে আল্লাহর অপেক্ষাও প্রিয়তর হিসেবে গ্রহন করে ; কেউ নিজের জান-মাল পর্যন্ত আল্লাহর জন্য কুরবানী করতে প্রস্তুত হয়। কিন্তু নিজের মনের ঝোঁক-প্রবণতা, নিজের মতবাদ ও চিন্তাধারা কিংবা নিজের খ্যাতি ও প্রসিদ্ধিকে বিন্দুমাত্র ব্যহত করতে প্রস্তুত হয় না। ঠিক এই হার অনুসারেই ইসলামী জিন্দেগীর স্থায়িত্ব ও ভঙ্গুরতা নির্ধারিত হয়ে থাকে। আর যেখানেই ঈমানের বুনিয়াদ দূর্বল থেকে যায়, ঠিক সেখানেই মানুষের ইসলামী নৈতিকতা নির্মমভাবে প্রতারিত হয়। বস্তুত ইসলামী জিন্দেগীর একটি বিরাট প্রাসাদ একমাত্র সেই তাওহীদ স্বীকাররের উপরই স্থাপিত হতে পারে যা মানুষের গোটা ব্যক্তি ও সমষ্টিগত জীবনের উপর সম্প্রসারিত হবে, যার দরুন প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজেকে এবং নিজের প্রত্যেকটি বস্তুতেই “আল্লাহর মালিকানা” বলে মনে করবে, প্রত্যেকটি মানুষ সেই এক আল্লাহকেই নিজের এবং সমগ্র পৃথিবীর একই সংগত মালিক, মাবুদ, প্রভু অনুসরনযোগ্য এবং আদেশ-নিষেধের নিরংকুশ অধিকারী বলে মেনে নিবে।
মানব জীবনের জন্য অপরিহার্য জীবনব্যবস্থার উৎস একমাত্র তাকেই স্বীকার করবে এবং আল্লাহর আনুগত্য বিমুখতা কিংবা তাঁর জীবন বিধান উপেক্ষা করা অথবা আল্লাহর নিজ সত্তা ও গুণ-গরিমা এবং অধিকার ও ক্ষমতায় অন্যের অংশীদারিত্ব যেদিক দিয়ে এবং যেরূপেই রয়েছে, তা মারাত্মক ভ্রান্তি ও গোমরাহী হবে --- এই নিগূঢ় সত্যে সুদৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। এই প্রাসাদ অত্যধিক সুদৃঢ় হওয়া ঠিক তখনই সম্ভব, যখন কোন ব্যক্তি পরিপূর্ণ চেতনা ও ইচ্ছা সহকারে তার নিজ সত্তা, যাবতীয় ধনপ্রাণ নিঃশেষে আল্লাহর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। নিজের মনগড়া ভাল-মন্দের মানদন্ড চূর্ণ করে সর্বোতভাবে ও সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর সন্তোষ ও অসন্তোষকেই একমাত্র মানদন্ড হিসেবে গ্রহণ করবে। নিজের স্বেচ্ছাচারিতা ত্যাগ করে নিজস্ব মতবাদ, চিন্তাধারা, মনোবাসনা, মানসিক ভাবধারা ও চিন্তা পদ্ধতিকে একমাত্র আল্লাহর দেয়া জ্ঞানের (কুরআনের ) আদর্শে ঢেলে গঠন করবে।
যেসব কাজ সুসম্পন্ন করার মারফতে আল্লাহর অনুগত্য করা হয় না, বরং যাতে আল্লাহর ভালবাসাকে এবং মনের মণিকোঠা হতে আল্লাহ অপেক্ষা প্রিয়তর ‘ভুত’ যেখানে যেখানে আছে, তা অতিপাতি করে খুঁজে বের করবে এবং তাকে চূর্ণ করবে। নিজের প্রেম-ভালবাসা, নিজের বন্ধুত্ব ও শত্র“তা , নিজের আগ্রহ ও ঘৃণা , নিজের সন্ধি ও যুদ্ধ -- সবকিছুকেই আল্লাহর মজীর অধীন করে দিবে ফলে মন শুধু তাই পেতে চাইবে যা আল্লাহ পসন্দ করেন না, তা হতে মন দূরে পলায়ন করতে চেষ্টা করবে। বস্তুত আল্লাহর প্রতি ঈমানের এটাই হচ্ছে নিগূঢ় অর্থ । অতএব যেখানে ঈমানই এই সকল দিক দিয়ে গভীর , ব্যাপক ও সুদৃঢ় এবং পরিপক্ক না হবে, সেখানে তাকওয়া ও ইসলাম যে হতেই পারে না তা সকলেই বুঝতে পারেন। কিন্তু জিজ্ঞেস করি , দাড়ির দৈর্ঘ এবং পেশাকের কাটছাট অথবা তাসবীহ পাঠ ও তাহাজ্জুদ নামায ইত্যাদি দ্বরা ঐরূপ ঈমানের অভাব কি কখনো পূর্ণ হতে পারে?
এই দৃষ্টিতে ঈমানের অন্যান্য দিকগুলো সম্পর্কেও চিন্তা করে দেখা যেতে পারে। মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত জীবনের সকল ক্ষেত্রে ও ব্যপারেই নবীকে একমাত্র নেতা ও পথ প্রদার্শক রূপে মেনে না নিবে এবং তাঁর নেতৃত্ব বিরেধী কিংবা এর প্রভাব মুক্ত যত নেতৃত্বই দুনিয়াতে প্রচলিত হবে তার সব গুলোকেই যতক্ষণ পর্যন্ত প্রত্যাহার না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত রাসূলের প্রতি ঈমান কিছুতেই পূর্ণ হতে পারে না। আল্লাহর কিতাব প্রদত্ত জীবনব্যবস্থা ও নীতিসমূহ ছাড়া অন্য কেন অদর্শের প্রতিষ্ঠায় সন্তুষ্ট হওয়ার এক বিন্দুভাব বর্তমান থাকলে কিংবা আল্লাহর নাযিলকৃত ব্যবস্থাকে নিজের ও সমগ্র পৃথিবীর জীবন বিধানরূপে প্রতিষ্ঠিত দেখার জন্য মনের ব্যাকুলতার কিছুমাত্র অভাব পরিলক্ষিত হলে আল্লাহর কিতাবের প্রতি ঈমান আনা হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে না, সে ঈমান বাস্তবিকই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। অনুরূপভাবে পরকালের প্রতি ঈমান ও পূর্ণতা লাভ করতে পরে না ---- যতক্ষণ না মানুষের মন অকুন্ঠভাবে পরকালকে ইহকালের উপর প্রধান্য ও গুরুত্ব দান করবে। পরকালীন কল্যাণের মূল্যমান অপক্ষা অধিকতর গ্রহণযেগ্য --- শেষোক্তটিকে প্রথমটির মোকাবিলায় প্রত্যাখ্যান যোগ্য বলে মনে করবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না পরকালে আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করার বিশ্বাস তার জীবনের প্রত্যেক পদক্ষেপেই তাকে ভাবতে ও সংযত করে তুলবে। বত্তুত এই মূল ভিত্তিসমূহই যেখানে পূর্ণ হবে না ---- সুদৃঢ় ও ব্যপক হবে না, সেখানে ইসলামী জিন্দেগীর বিরাট প্রাসাদ কিসের উপর দাঁড় করান যেতে পারে, তা কি একবারও চিন্তা করে দেখেছেন? কিন্তু কিছু সংখ্যক লোক যখন এই ভিত্তিসমূহের পূর্ণতা ব্যাপকতা ও পক্কতা সাধন ছড়াই ইসলামী নৈতিকতার প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলে মনে করল, তখন ইসলামী সমাজে মারাত্মক বিপর্যয় দেখা গেল। দেখা গেল আল্লাহর কিতাবের সম্পূর্ণ বিপরীত রায় দানকারী বিচারপতি ; শরীয়াত বিরোধী আইনের ভিত্তিতে ব্যবসায়ী ও উকিল ; কাফেরী সমাজব্যবস্থা অনুযায়ী জীবনের কাজ-কর্মসম্পন্নকারী কর্মী ; কাফেরী আদর্শের তমদ্দুন ও রাষ্ট্র ব্যবস্থানুযায়ী জীবনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টানুবর্তী নেতা ও জনতা সকলের জন্যই তাকওয়া ও ইহসানের উচ্চতম পর্যায় সমূহ হাসিল করা একেবারে সহজ হয়ে গেল । সকলেরই জন্য এর দ্বার উম্মুক্ত হয়ে গেল। আর তাদের জীবনের বাহ্যিক বেশ-ভূষা ধরণ-ধারণ ও আচার –অনুষ্ঠানে একটি বিশেষ ধরনের গঠন করা এবং কিছু নফল নামায, রোযা ও জেকের-আজকারের অভ্যাস করাই সেজন্য যথেষ্ট বলে মনে করা হলো।
ইসলাম
ঈমানের উপরোক্ত ভিত্তিসমূহ যখন বাস্তবিকই পরিপূর্ণ ও দৃঢ়রূপে স্থাপিত হয় । তখনই তার উপর ইসলামের দ্বিতীয় অধ্যায় রচনা করার কাজ শুরু হয়। বস্তুত ইসলাম হচ্ছে ঈমানেরই বাস্তব অভিব্যক্তি --- ঈমানেরই কর্মরূপ।
ঈমান ও ইসলামের পারস্পরিক সম্পর্ক ঠিক বীজ ও বৃক্ষের পারস্পরিক সম্পর্কের অনুরূপ। বীজের মধ্যে যা কিছু যেভাবে বর্তমান থাকে, তাই বৃক্ষের রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এমনকি বৃক্ষের রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে বীজের মধ্যে কি ছিল, আর কি ছিল না, তা অতি সহজেই অনুমান করা যায় । বীজ না হওয়া সত্ত্বেও বৃক্ষের অস্তিত্ব যেমন কেউ ধারণা করতে পারে না, অনুরূপভাবে এটাও ধরণা করা যায় না যে , জমি বন্ধ্যা ও অনুর্বর নয় এমন জমিতে বীজ বপন করলে বৃক্ষ অংকুরিত হবে না। প্রকৃতপক্ষে ঈমান ও ইসলামের অবস্থা ঠিক এরূপ। যেখানে সব বস্তুতই ঈমানের অস্তিত্ব থাকবে, সেখানে ব্যক্তির বাস্তব জীবনে কর্মজীবনে, নৈতিকতায়, গতিবিধিতে, রুচি ও মানসিক ঝোঁক প্রবনতা, স্বভাব প্রকৃতিতে, দুঃখ-কষ্ট ও পরিশ্রম স্বীকারের দিকে ও পথে, সময়, শক্তি এবং যোগ্যতার বিনিয়োগ জীবনের প্রতিটি দিকে ও বিভাগে, প্রতিট খুঁটিনাটি ব্যাপারেই এর বাস্তব অভিব্যক্তি ও বহিঃপ্রকাশ হবেই হবে। উল্লেখিত দিক-সমূহের মধ্যে কোন একটি দিকে যদি ইলামের পরিবতর্তে ইসলাম বিরোধী কার্যক্রম ভাবধারা প্রকাশ হতে দেখা যায়, তবে নিসন্দেহে মনে করতে হবে যে, সেই দিকটি ঈমান শুণ্য অথবা তা থকলেও একেবারে নিঃসার , নিস্তেজ ও অচেতন হয়ে রয়েছে ---- যা থাকা বা না থাকা উভয়ই সম্পূর্ণ সমান।
আর বাস্তব কর্মজীবনে যদি সম্পূর্ণ রূপে অমুসলিমদের ধারা-পদ্ধাতিতে যাপিত হয়, তবে তার মনে ঈমানের অস্তিত্ব নেই। কিংবা থাকলেও তার ক্ষেত্র অত্যন্ত অনুর্বর ও উৎপাদন শক্তিহীন হওয়ার কারণে ঈমানের বীজই তথায় অংকুরিত হতে পারে নি বলে মনে করতে হবে। যা হোক, আমি কুরআন ও হাদীস যতদূর বুঝতে পেরেছি তার উপরে নির্ভর করে বলতে পারি যে, মনের মধ্যে ঈমান বর্তমান থাকা এবং কর্মজীবনে ইসলামের বাস্তব প্রকাশ না হওয়া একেবারই অসম্ভব ও অস্বাবাবিক। (এই সময় একজন শ্রোতা দাড়িয়ে জিজ্ঞেসা করলেন যে, ঈমান ও আমলকে কি আপনি একই জিনিস বলে মনে করেন? অথবা এই দুটির মধ্যে আপনার দৃষ্টিতে কোন পার্থক্য আছে? এই প্রশ্নের উত্তরে মাওলানা মওদুদী বলেন-) এ সম্পর্কে ফিকাহ শাস্ত্রকার ও কালাম শাস্ত্রবিদদের উথাপিত বির্তক অল্প সময়ের জন্য মন হতে দুরে রেখে সরাসরি ভাবে কুরআন মজীদ হতে এই প্রশ্নের উত্তর পেতে চেষ্টা করুন। কুরআন হতে সুস্পষ্টরূপে জানতে পারা যায় যে, বিশ্বাসগত ঈমান ও বাস্তব কর্মজীবনের ইসলাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত । আল্লাহ তায়ালা কুরআন মজিদের বিভিন্ন স্থানে ঈমান ও সৎকাজের (আমলে সালেহ) একই সঙ্গে ইল্লেখ করেছেন। তারঁ সকল ভাল ভাল প্রতিশ্র“তি কেবল সেই বান্দাদের জন্য যারা বিশ্বাসের দিক দিয়ে ঈমানদার এবং বাস্তব কর্মের দিক দিয়ে পূর্ণরূপে ‘মুসলিম’ পক্ষান্তরে আল্লাহ তায়ালা যেসব লোককে ‘মুনাফিক’ বলে নির্দিষ্ট করেছেন তাদের বাস্তব কর্মের দোষ-ত্র“টির ভিত্তিতেই তাদের ঈমানের অন্তসারশুন্যতা প্রমাণ করেছেন এবং বাস্তব কর্মগত ইসলামেই প্রকৃত ঈমানের লক্ষণ বলে নির্দিষ্ট করেছেন। কিন্তুু মনে রাখাতে হবে যে, আইনগত কাউকে ‘কাফের’ ঘোষণা করা এবং মুসলিম জাতির সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন করার ব্যপার সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং সে ব্যাপারে অতিশয় সতর্কতা অবলম্বন করা অপরিহার্য। কিন্তু পৃথিবীতে শাস্ত্রীয় আইন প্রযুক্ত হতে পারে যে ঈমান ও ইসলামের উপর, এখানে আমি সেই ঈমান ও ইসলাম সম্পর্কে আলাচনা করছি না। বরং যে ঈমান আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য এবং পরকালীন ফলাফল যার ভিত্তিতেই মীমাংসিত হবে, এখানে আমি কেবল সেই ঈমান সম্পর্কে বলছি। আইনগত দৃষ্টিভংগী পরিত্যাগ করে প্রকৃত ব্যপার ও নিগূঢ় সত্যটি যদি আপনি জানতে ষ্টো করেন, তবে নিশ্চিতরূপেই দেখতে পাবেন যে, কার্যত যেখানে সামনে আত্মসমর্পণ, আত্মোৎসর্গ ও পরির্পূর্ণরূপে আত্মাহুতির অভাব রয়েছে, যেখানে নিজ মনের ইচ্ছা আল্লাহর ইচ্ছার সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়নি --- পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে, যেখানে আল্লাহর আনুগত্য করে চলার সংগে সংগে কার্যত ‘অন্য শাক্তির’ ও আনুগত্য করা হচ্ছে, যেখানে আল্লাহর দ্বীন ইসলাম কায়েম করার উদ্দেশ্যে চেষ্টা-সাধনার পরিবর্তে অন্যান্য কাজের দিকেই মনের ঝোঁক ও আন্তরিক নিষ্ঠা রয়েছে, যেখানে যেখানে আল্লাহর নির্দিষ্ট পথে চেষ্টা-সাধনা এবং দুঃখ-কষ্ট স্বীকার করা হচ্ছে না, বরং এ সবকিছুই হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে-- ভিন্ন উদ্দেশ্যে , সেখানে যে ঈমানের মৌলিক ত্রুটি রয়েছে, তাতে কোনই সন্দেহ থাকতে পারে না। আর অসম্পূর্ণ ত্রুটিপূর্ণ ঈমানের উপর তাকওয়া ও ইহসানের অধ্যায় যে রচিত হতে পরে না তা বলাই বাহুল্য।
বাহ্যিক বেশ-ভূষা ও তাকওয়া কিংবা ইহসানের কৃত্রিম অনুকরণের চেষ্টা করলেও এর প্রকৃত স্বাদ লাভ করা সম্ভব নয়। বহ্যিক বেশ-ভূষা ও কৃত্রিম আচার-অনুষ্ঠান সাধারণত অন্ত:সারশুন্য হলে এবং অন্তর্নিহিত ভাবধারার সাথে বাহ্যিক বেশ-ভূষার সামঞ্জস্য না হলে তা একটি সুশ্রী ও সুঠাম মৃতদেহের অনুরূপ হয়ে থাকে। এর বহ্যিক আকার-অকৃতি ও বেশ-ভুষা যতই সুন্দর হোক না কেন, তা প্রাণশুন্য বলে জনগণ তা দেখে প্রতারিত হতে পারে মাত্র। এই বাহ্যিক বেশ-ভূষা ও সুঠাম দেহের প্রতি কেন কাজের আশা করে থাকলে বাস্তব ঘটনাই তার ব্যার্থতা প্রমাণ করবে এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা হতে নিসন্দেহে জানতে পারা যাবে যে, একটি কুৎসিত জীবিত মানুষ একটি সুশ্রী লাশ অপেক্ষা অধিক কার্যকরী হয়ে থাকে। প্রকাশ্য বেশ-ভূষার দ্বারা নিজেকে সান্তনা দেয়া ও আত্মপ্রতারণা করা সহজ বা সম্ভব, কিন্তু বাস্তব পরীক্ষায় এর কোন মূল্যই প্রমাণিত হয় না----- আল্লাহর নিকট এর একবিন্দু মূল্য তো দূরের কথা। অতএব বাহ্যিক নয়, প্রকৃত ও আন্তরিক নিষ্ঠাপূর্ণ তাকওয়া ও ইহসান লাভ করতে হলে--- আর এটা ছাড়া দুনিয়ার বুকে আল্লাহর দ্বীনের প্রতিষ্ঠা এবং পরকালীন কল্যাণ লাভ মাত্রই সম্ভব নয়---- আমার এ কথা মনের পৃষ্ঠায় বদ্ধমূল করে নিন যে, উপরের এ দু‘টি পর্যায় কিছুতেই গড়ে উঠতে পারে না, যতক্ষণ না ঈমানের ভিত্তিমূল সুদৃঢ় হবে। আর যতক্ষণ পর্যন্ত কর্মগত ইসলাম কার্যত আল্লাহর আনুগত্য ও অনুসরণের ভিতর দিয়ে নিসন্দেহে বাস্তব প্রমাণ পাওয়া না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানের ভিত্তি মজবুত হতে পারে না।
0 comments: