অধ্যায় ০৫ : নেতৃত্ব সম্পর্কে আল্লাহর নীতির সারকথা

নেতৃত্ব সম্পর্কে আল্লাহর নীতির সারকথা

দুনিয়ার নেতৃত্ব কর্তৃত্ব দানের ব্যাপারে সৃষ্টির প্রথম প্রভাত হতেই আল্লাহ তায়ালার একটি স্থায়ী নিয়ম ও রীতি চলে এসেছে এবং মানব জাতি বর্তমান প্রকৃতির উপর যতদিন জীবিত থাকবে ততদিন তা একই ধারায় জারী থাকবে, তাতে সন্দেহ নেই।

এখানে প্রসংগত সেই নিয়মের সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ করা আবশ্যক। পৃথিবীর বুকে ইসলামী নৈতিকতা ও মৌলিক মানবীয় চরিত্রে ভূষিত এবং জাগতিক কার্যকারণ ও জড় উপায়-উপাদান প্রয়োগকারী কোন সুসংগঠিত দল যখন বর্তমান থাকে, তখন আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার নেতৃত্বর চাবিকাঠি এমন একটি দলের হাতে ন্যাস্ত করেন যে দল অন্তত মৌলিক মানবীয় চরিত্রে ভূষিত এবং জাগতিক উপায়-উপাদান সমূহ ব্যবহার করার দিক দিয়ে অন্যান্য তুলনায় অধিকতর অগ্রসর । করণ, আল্লাহ তায়ালা তার এই পৃথিবীর শৃংখলা বিধান করতে দৃঢ় সংকল্প । এই শৃংখলা বিধানের দায়িত্ব ঠিক সেই মানব গোষ্ঠীকেই দান করেন, যারা সমসমায়িক দলসমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা যোগ্যতম প্রমাণিত হবে। বস্তুত দুনিয়ার নেতৃত্বদান সম্পর্কে এটাই হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার স্থায়ী নীতি । কিন্তু পৃথিবীতে এমন কোন সুসংগঠিত দল যদি বাস্তবিকই বর্তমান থাকে, যা ইসলামী নৈতিকতা ও মৌলিক মানবীয় চরিত্র উভয় দিক দিয়েই অবশিষ্ট সকল মানুষ অপেক্ষা শ্রেষ্ট ও বিশিষ্ট প্রমাণিত হবে এবং জাগতিক উপায় – উপাদান ও জড় শক্তি প্রয়োগেও কিছুমাত্র পশ্চাৎপদ হবে না তবে তখন পৃথিবীর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের চাবিকাঠি অন্য কোন দলের হাতে অর্পিত হওয়া একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার । শুধু অসম্ভবই নয় তা অস্বাভাবিকও বটে, তা মানুষের জন্য নির্ধারিত আল্লাহর স্থায়ী নিয়ম –নীতিরও সম্পূর্ণ বিপরিত । আল্লাহ তায়ালা সত্যপন্থী ও নিষ্ঠাবান ঈমানদার লোকেদের জন্য তার কিতাবে যে প্রতিশ্রুতি উল্লেখ করেছেন, এটা তারও খেলাফ হয়ে পড়ে ।

দুনিয়ার বুকে সৎ সত্যাশ্রয়ী ও ন্যায়পন্থী, আল্লাহর মর্জী অনুযায়ী বিশ্ব পরিচালনায় যোগ্যতাসম্পন্ন একটি একনিষ্ঠ মানব দল বর্তমান থাকা সত্তেও তিনি দুনিয়ার কর্তৃত্ব তার হাতে অর্পণ না করে কাফের বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ও আল্লাহদ্রোহী লোকদের হাতে ন্যস্ত করবেন - একথা কিরূপে ধারণা করা যেতে পারে ? কিন্তু বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে যে, এরূপ অনিবার্য পরিণাম ঠিক তখনি লাভ করা যেতে পারে যখন উল্লেখিত গুনাবলী সমন্বিত একটি দল বাস্তবিকই দুনিয়াতে বর্তমানে থাকবে।

এক ব্যক্তির সৎ হাওয়া এবং বিচ্ছিন্নভাবে অসংখ্য সৎ ব্যক্তির বর্তমান থাকায় দুনিয়ার নেতৃত্বলাভের আল্লাহর নীতিতে বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম সৃষ্টি হতে পারে না- সেই ব্যক্তিগণ যতবড় অলী আল্লাহ - পয়গম্বরই হোক না কেন । আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার নেতৃত্বদানের যে ওয়াদা করেছেন, তা বিক্ষিপ্ত ও অসংঘবদ্ধ কয়েকজন ব্যক্তি সম্বর্কে নয় ; এমন একটি দলকে এটা দান করার প্রশ্রি“তি তিনি দিয়েছেন যা কার্যত ও বাস্তব ক্ষেত্রে নিজকে (খায়রু ইম্মাহ)“সর্বোত্তম জাতি” ও (উম্মাতাওয়াসাতা) “মধ্যম পন্থানুসারী জাতি” বলে প্রমান করতে পারবে। একথা স্মরন রাখতে হবে যে উক্তরূপে গুণে ভুষিত একটি দলের শুধু বর্তমান থাকাই নের্তত্ব ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটার জন্য যথেষ্ট নয়, তা এমন নয় যে এদিকে এরূপ একটি দল অস্তিত্ব লাভ করবে, আর ওদিকে সঙ্গে সঙ্গেই আকাশ হতে কিছু সংখ্যক ফেরশতা অবতরণ করে ফাসেক –কাফেরদেরকে নেতৃত্বর গদি হতে বিচ্যুত করে দিবে এবং এই দলকে তদস্থলে আসীন করবে ।

এরূপ অস্বাভাবিক নিয়ম মানব সমাজে কখনই কোন পরিবর্তন সুচিত হতে পারে না । নেতৃত্ব ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন সৃষ্টি করতে হলে জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে ও বিভাগে, প্রত্যেক কদমে পদক্ষেপে কাফের ও ফাসেক ও ফাসেকী শক্তির সাথে দ্ব›দ্ব ও প্রত্যক্ষ মোকাবিলা করতে হবে । বস্তুত এটা এমন একটি অনিবার্য শর্ত যা নবীদের উপরও প্রযোজ্য হয়েছে । অন্য কারো এই শর্ত পূরণ না করে সমাজে নেতৃত্বে কোনরূপ পরিবতর্ন সৃষ্টি করতে পারার তো কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না।


মৌলিক মনবীয় চরিত্র ও ইসলামী নৈতিক শক্তির তারতম্য

জাগতিক জড়শক্তি এবং নৈতিক শক্তির তারতম্য সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের গভীরতর অধ্যয়নের পর আল্লাহর এই সুন্নাত বা রীতি আমি বুঝতে পেরেছি যে, সেখানে নৈতিক শক্তি বলতে কেবল মাত্র মৌলিক মানবীয় চরিত্রই হবে, সেখানে জাগতিক উপায়-উপাদান ও জড়শক্তির গুরুত্ব অপরিসীম।

এমনকি, একটি বৈষয়িক জড়শক্তি যদি বিপুল পরিমাণে বর্তমান থাকে তবে সামান্য নৈতিক শক্তির সাহায্যেই সে সারাটি দুনিয়া গ্রাস করতে পারে। আর অপর দল নৈতিক শক্তিতে শ্রেষ্ঠতর হয়েও কেবলমাত্র বৈষয়িক শক্তির অভাব হেতু সে পাশ্চাৎপদ হয়ে থাকবে। কিন্তু যেখানে নৈতিক শক্তি বলতে ইসলামী নৈতিকতা ও মৌলিক মানবীয় চরিত্র উভয়ের প্রবল শক্তির সমন্বয় হবে, সেখানে বৈষয়িক জড়শক্তির সাংঘাতিক পরিমাণে অভাব হলেও নৈতিক শক্তিই জয়লাভ করবে এবং নিছক মৌলিক মানবীয় চরিত্র ও বৈষয়িক জড়শক্তির ভিত্তিতে যে শক্তিসমূহ মস্তক উত্তোলন করবে তা নিশ্চিতরূপেই পরাজিত হবে। সুস্পষ্টরূপে বুঝার জন্য একটি হিসাবের অবতারণা করা যেতে পারে ।

মৌলিক মানবীয় চরিত্রের সাথে যদি একশত ভাগ বৈষিয়িক জড়শক্তি অপরিহার্য হয় তবে ইসলামী নৈতিকতা ও মৌলিক মানবীয় চরিত্রের পূর্ণ সমন্বয় হাওয়ার পর মাত্র ২৫ ভাগ বৈষয়িক জড়শক্তি উদ্দেশ্য লাভের জন্য যথেষ্ট হবে। অবশিষ্ট ৭৫ ভাগ জড়শক্তির অভাব কেবল ইসলামী নৈতিকতাই পূরণ করে দেবে।

উপরন্তু নবী করীম (সা) এবং তার আসহাবেদের সমপরিমান ইসলামী নৈতিকতা হতে মাত্র শতকরা পাঁচ ভাগ জড়শক্তিই উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য যথেষ্ট হতে পারে। এই নিগূঢ় তত্ত¡ ও সত্য বলা হয়েছে কুরআন মজীদের নিম্নলিখিত আয়াতেঃ -----“তোমাদের মধ্যে যদি বিশজন পরম ধৈর্যশীল লোক হয় তবে তারা দু’শ’জনের উপর জয়ী হতে পারেবে।” এই শেষোক্ত কথাটিকে নিছক ‘অন্ধভক্তি ভিত্তিক ধারণা’ মনে করা ভুল হবে। আর আমি যেকোন মোজেযা বা কেরামতির কথা বলছি, তাও মনে করবেন না। বস্তুত এটা পরিষ্ফুট হতে পারে। এর কারণ যদি বর্তমান থাকে, তবে তা নিশ্চয়ই বাস্তবে রূপায়িত হবে। কিন্তু ইসলামী নৈতিকতা –যার মধ্যে মৌলিক মানবীয় চরিত্রও ওতপোতভাবে বিজড়িত রয়েছে –বৈষয়িক জড়শক্তির শতকরা ৭৫ভাগ বরং ৫০ ভাগ অভাব কিরূপে পূরূণ করে ; তা একটি নিগূঢ় রহস্য বটে। কাজেই সামনের দিকে অগ্রসর হাওয়ার পূর্বে এর বিশ্লেষণ হাওয়া একান্ত আবশ্যক।

এই রহস্য হৃদয়ংগম করার জন্য সমসাময়িককালের আন্তর্জাতিক পরস্থিতির উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করাই যথেষ্ট । বিগত মহাযুদ্ধের সর্বাত্মক বিপর্যয়ের চুড়ান্ত পর্যায়ে জাপান ও জার্মানীর পরাজয় ঘটে। মৌলিক মানবীয় চরিত্রের দিক দিয়ে এই বিপর্যয়ের সংশ্লিষ্ট উভয় দলই প্রায় সমান । বরং সত্য কথা এই যে, কোন দিক দিয়ে জার্মান ও জাপান মিত্র পক্ষের মোকাবিলার আধিকতর মৌলিক মানবীয় চরিত্রের প্রমাণও উপস্থিত করেছে। জড়বিজ্ঞান ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এবং এর বাস্তব প্রয়োজনের ব্যাপারেও উভয় পক্ষেই সমান ছিল। বরং সত্য কথা এই যে এই ক্ষেত্রে জার্মানীর শ্রেষ্ঠত্ব সর্বজন বিদিত। কিন্তু এতদসত্বেও কেবল একটি ব্যাপরেই এক পক্ষ অপর পক্ষ হতে অনেকটা অগ্রসর –আর তা হচ্ছে বৈষয়িক কার্যকারণের আনুকূল্য । এই জনশক্তির অপরাপর সকল পক্ষ অপেক্ষাই অনেকগুণ বেশী ।

বৈষয়িক জড় উপায় –উপাদান তার সর্বাপেক্ষা অধিক রয়েছে । এর ভৌগলিক অবস্থাও গুরুত্বপূর্ণ এবং এর ঐতিহাসিক কার্যকারণ অপরাপর পক্ষের তুলনায় বহুগুন বেশী অনুকুল পরিস্থিতির উদ্ভব করে নিয়েছিল । ঠিক এজন্য মিত্রপক্ষ বিজয় মাল্যে ভূষিত হয়। আর এজন্যই যে জাতির জনসংখ্যা অপর্যাপ্ত , বৈষয়িক জড় উপায় উপাদান যার নিকট কম, তার পক্ষে অধিক জনসংখ্যা সমন্বিত ও বিপুল জাগতিক উপায়-উপাদান বিশিষ্ট জাতির মোকাবিলায় মস্তকোত্তলন করে দন্ডায়মান হাওয়া প্রায় অসম্ভব বলে মনে হয়। মৌলিক মানবীয় চরিত্র প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ভিত্তিতে উত্থিত জাতি হয় জাতীয়তাবাদী হবে এবং পৃথিবীর অন্যান্য অংশও অধিকার করতে প্রয়াসী হবে, নতুবা তা এক সার্বজনীন আদর্শ ও নিয়ম বিধানের সমর্থক হবে এবং তা গ্রহণ করার জন্য দুনিয়ার অন্যান্য জাতি সমূহকেও আহ্বান জানাবে। সে জাতির এ দু’টির যে কোন এক অবস্থা নিশ্চয়ই হবে ।

প্রথম অবস্থা হলো বৈষয়িক জড়শক্তি ও জাগতিক উপায়-উপানের দিক দিয়ে অন্যান্য জাতি অপেক্ষা তার শ্রেষ্ঠ ও অগ্রসর হওয়া ভিন্ন প্রতিদ্ব›িদ্বতায় জয়লাভ করার দ্বিতীয় কোন পন্থা আদৌ থাকতে পারে না । কারণ এই যে , যেসব জাতিকে সে প্রভত্ব ও ক্ষমতা লিপ্সার অগ্নিযজ্ঞে আত্মাহুতি দিতে কৃতসংকল্প হয়েছে তারা অত্যন্ত তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষী মনোভাব নিয়ে তার প্রতিরোধ করবে এবং তার পথরোধ করতে নিজেদের সমগ্র শক্তি নিয়োজিত করবে । কাজেই তখন আক্রমনকারী জাতির পরাজয়ের সম্ভবনা অনেক বেশি । কিন্তু উক্ত জাতির যদি দ্বিতীয় অবস্থা হয়- যদি উহা কোন সার্বজনীন আদর্শের নিশান বরদার হয়, ও মস্তিষ্ক প্রভাবান্বিত হওয়ার বিপুল সম্ভবনা রয়েছে। তখন জাতিকে প্রতিবন্ধকতার পথ হতে অপসৃত করতে খুব বেশী শক্তি প্রয়োগ করার আবশ্যক হবে না।

কিন্তু এখানে ভুললে চলবে না যে, মুষ্টিমেয় কয়েকটি মনোমুগ্ধকর নীতি - আদর্শই কখনো মানুষের মন ও মস্তিষ্ক প্রভাবান্বিত করতে পারে না । সে জন্য সত্যিকার সদিচ্ছা, সহানুভূতি, হিতাকাঙ্খা, সততা, সত্যবাদিতা , নিঃস্বার্থতা, উদারতা , বদান্যতা, সৌজন্য ও ভদ্রতা, এবং নিরপেক্ষ সুবিচার নীতি একান্ত অপরিহার্য। শুধু তাই নয়, এই মহৎ গুণগুলোকে যুদ্ধ-সন্ধি, জয়- পরাজয়, বন্ধুতা শত্রুতা এই সকল প্রতিকূল পরিস্থতিতেই কঠিন পরীক্ষায় অত্যন্ত খাঁটি অকৃত্রিম ও নিষ্কলুষ প্রমাণিত হতে হবে । কিন্তু এরূপ ভাবধারার প্রত্যক সম্পর্ক রয়েছে উন্নত চরিত্রের উচ্চতম ধাপের সাথে এবং তার স্থান মৌলিক মানবীয় চরিত্রের অনেক ঊর্ধে।

ঠিক এ কারণেই নিছক মৌলিক মানবীয় চরিত্র ও বৈষয়িক শক্তির ভিত্তিতে উত্থিতে জাতি প্রকাশ্যভাবে জাতীয়তাবাদীই হোক কি গোপন জাতীয়তাবাদের সাথে কিছুটা সার্বজনীন আদর্শের প্রচার ও সমর্থন করার ছদ্মবেশ ধারণ করুক –একান্ত ব্যক্তিগত কিংবা শ্রেণীগত অথবা জাতীয় স্বার্থ লাভ করাই হয় তার যাবতীয় চেষ্টা –সাধানা ও দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের চুড়ান্ত উদ্দেশ্য ।

বর্তমান সময় আমেরিকা , বৃটেন, রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতিতে ঠিক এই ভাবধারাই সুষ্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই ধরনের যুদ্ধ -সংগ্রামের ক্ষেত্রে অতি স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যেকটি জাতি প্রতিপক্ষের সামনে এক দুর্জয় দুর্গের ন্যায় হয়ে দাঁড়ায় এবং তার প্রতিরোধে স্বীয় সমগ্র নৈতিক ও বৈষয়িক শক্তি প্রয়োগ করে। তখন আক্রমাণকারী জাতির শ্রেষ্ঠতর জড়শক্তির আক্রমণে শক্র পক্ষকে সে নিজ দেশের চতুর্সীমার মধ্যে কিছূতেই প্রবেশ করতে দিবে না। কিন্তুু এই সময় এরূপ পরিবেশের মধ্যে এমন একটা মানবগোষ্ঠী যদি বর্তমান থাকে প্রথমত তা একটি জাতির লেকদের সমন্বয়ে গঠিত হয়ে থাকলেও কোন দোষ নেই---- যদি তা একই জাতি হিসেবে না উঠে একটি আদর্শবাদী জামায়াত হিসেবে দন্ডায়মান হয়, যা সকল প্রকার ব্যক্তিগত, শ্রেণীগত ও জাতীয় স্বার্থপরতার বহু ঊর্ধে থেকে বিশ্বমানবতাকে আমন্ত্রণ জানাবে যার সমগ্র চেষ্টা -সাধনার চরম লক্ষ্য হবে নির্দিষ্ট কতকগুলো আদর্শের অনুসরণের মধ্য দিয়ে বিশ্বমানবতার মুক্তিসাধন এবং সেই আদর্শে ও নীতিসমূহের ভিত্তিতে মানবজীবনের গোটা ব্যবস্থার পুনপ্রতিষ্ঠা সাধন। ঐসব নীতি ও আদর্শের অনুসরনের মধ্য দিয়ে বিশ্বমানবতার মুক্তিসাধন এবং সেই আদর্শ ও নীতিসমূহের ভিত্তিতে মানব জীবনের গোটা ব্যবস্থার পুনপ্রতিষ্ঠা সাধন।

ঐসব নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে এই দল যে জাতি গঠন করবে, তাতে জাতীয়, ভৌগলিক, শ্রেণীগত ও বংশীয় বা গোত্রীয় বৈষম্যের নাম গন্ধও থাকবে না। সকল মানুষই তাতে সমান মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে প্রবেশ করতে পারবে এবং সকলেই সমান সুযোগ- সুবিধা লাভ করতে পরবে। এই নবপ্রতিষ্ঠিত জাতির মধ্যে নেতৃত্ব পথ নির্দেশকারী মর্যাদা কেবল সেই ব্যক্তি বা সেই মানব সমষ্টিই লাভ করতে পারবে, যারা সেই আদর্শ ও নীতির অনুসরন করে চলার দিক দিয়ে সর্বাপেক্ষা অগ্রসর ও শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত হবে। তখন তার বংশ মর্যদা বা আঞ্চলিক জাতীয়তার কোন তারতম্য বিচার করা হবে না এমনকি, এই নতুন সমাজে, এতদুর ও হতে পারে যে, বিজিত জাতির লোক ঈমান এনে নিজেকে অন্যান্যের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ আদর্শানুসরণ এবং যোগ্যতার প্রসার করতে পারলে বিজয়ী তার সকল চেষ্টা ও যুদ্ধসংগ্রাম লব্ধ যাবতীয় ‘ফল’ তার পদতলে এনে ঢেলে দিবে এবং তাকে ‘নেতা’ রূপে স্বীকার করে নিজে ‘অনুসারী’ হয়ে কাজ করতে প্রস্তুত হবে।

এমন একটি আদর্শবাদী দল যখন নিজেদের আদর্শ প্রচার করতে শুরু করে, তখন এই আদর্শের বিরোধী লোকগণ তাদের প্রতিরোধ করতে উদ্যত হয়। ফলে উভয় দলের মধ্যে দ্ব›দ্ব শুরু হয়ে যায়। কিন্তু এই দ্বন্দ্বের তীব্রতা যতই বৃদ্ধি পায় আদর্শবাদী দল বিরুদ্ধবাদীদেও মেকাবিলার ততই উন্নত চরিত্র ও মহান মানবিক গুন মহাত্মের চরম পরাকাষ্টা প্রদর্শন করতে থাকে । সে তার কর্মনীতি দ্বারা প্রমান করে যে, মানব সমষ্টি-তথা গোটা সৃষ্টিজগতের কল্যাণ সাধন ভিন্ন তার অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই। বিরুদ্ধবাদীদের ব্যক্তি সত্তা কিংবা তাদের জাতীয়তার সাথে এর কোন শক্রতা নেই। শক্রতা আছে শুধু তাদের গৃহীত জীবনধারা ও চিন্তা মতবাদের সাথে। তা পরিত্যগ করলেই তার রক্ত পিপাসু শক্রকেও প্রণভরা ভালবাসা দান করতে পারে। বুকের সঙ্গে মিলাতে পারে ।

পরন্তু সে আরও প্রমান করবে যে বিরুদ্ধ পক্ষের ধন -দৌলত কিংবা তাদের ব্যবসায় ও শিল্পপণ্যের প্রতিও তার কোন লালসা নেই, তাদের নৈতিক ও আধ্যাতিক কল্যাণ সাধনাই একমাত্র কাম্য । তা লাভ হলেই যথেষ্ট। তাদের ধন -দৌলত তাদেরই সৌভাগ্যের কারণ হবে। কঠিন কঠোরতম পরীক্ষার সময়ও এই দল কোনরূপ মিথ্যা, প্রতারনা ও শঠতার আশ্রয় নেবে না । কুটিলতা ষড়যন্ত্রের প্রত্যুত্তরে তারা সহজ-সরল কর্মনীতিই অনুসরণ করবে । প্রতিশোধ গ্রহণের তীব্র উত্তেজনার সময়ও অত্যাচার-অবিচার, উৎপীড়নের নির্মমতায় মেতে উঠবে না । যুদ্ধেও প্রবল সংঘর্ষের কঠিন মুহূর্তেও তারা নিজেদের নীতি আদর্শ পরিত্যাগ করবেনা । কারণ সেই আদর্শের প্রচার প্রতিষ্ঠার জন্যই তো তার জন্ম । এজন্য সততা, সত্যবাদিতা, প্রতিশ্রুতি পূরণ, নির্মল আচার-ব্যবহার ও নিঃস্বার্র্থ কর্মনীতির উপর তারা দৃঢ়তার সাথে দাড়িয়ে থাকে ।

নিরপেক্ষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে এবং প্রথমত আদর্শ হিসেবে সততা ও ন্যায়বাদের যে মানদন্ড বিশ্ববাসীর সামনে পেশ করেছিল, নিজেকে এর কষ্টিপাথরে যাচাই করে সত্য এবং খাঁটি বলে প্রমাণ করে দেয় । শত্রু পক্ষের ব্যভিচারী, মদ্যপায়ী, জুয়াড়ী, নিষ্ঠুর ও নির্দয় সৈন্যদের সাথে এই দলের আল্লাহভীরু, পবিত্র চরিত্র মহান আত্মা, দয়ার্দ্র হৃদয় ও উদার উন্নত মনোবৃত্তি সম্পন্ন মুজাহিদদের প্রবল মোকাবিলা হয়, তখন এই দলের প্রত্যেক ব্যক্তিরই ব্যক্তিগত মানবিক ও গুণ-গরিমা প্রতিপক্ষের পাশবিক ও বর্বরতার উপর উজ্জল উদ্ভাসিত হয়ে লোকচক্ষুর সামনে প্রকটিত হতে থাকে। শত্রু পক্ষের লোক আহত বা বন্দী হয়ে আসলে চতুর্দিকে ভদ্রতা, সৌজন্য, পবিত্রতা ও নির্মল মানসিক চরিত্রের রাজত্ব বিরাজমান দেখতে পায় এবং তা দেখে তাদের কলুষিত আত্মা ও পবিত্র ভাবধারার সংস্পর্শে কলুষমুক্ত হয়ে যায়।

পক্ষান্তরে এই দলের লোক যদি বন্দী হয়ে শত্রু পক্ষের শিবিরে চলে যায, সেখানে কার অন্ধকারাচ্ছন্ন পূতিগন্ধময় পরিবেশে এদের মনুষ্যত্বের মহিমা আরো উজ্জল ও চাকচিক্যপূর্ণ হয়ে উঠে। এরা কোন দেশ জয় করলে বিজিত জনগণ প্রতিশোধের নির্মম আঘাতের পরিবর্তে ক্ষমা করুণা পায়, কঠোরতা নির্মমতার পরিবর্তে সহানুভুতি ; গর্ব অহংকার ও ঘৃণার পরিবর্তে পায় সহিষ্ণুতা ও বিনয় ; ভৎসনার পরিবর্তে সাদর সম্ভাষন এবং মিথ্যা প্রচারণার পরিবর্তে সত্যের মূলনীতিসমূহের বৈজ্ঞানিক প্রচার । আর এসব দেখে খুশিতে তাদের হূদয় মন ভরে উঠে।

তারা দেখতে পায় যে, বিজয়ী সৈনিকরা তাদের নিকট নারীদেহের দাবী করে না, গোপন রহস্যের সন্ধান করার জন্যও এরা উদগ্রীব নয়, তাদের অর্থনৈতিক শক্তি সম্পদকে ধবংস করার চিন্তাও এদের নেই । তাদের জাতীয় সংস্কৃতি ও সম্মান মর্যাদার উপর ও এরা হস্তপেক্ষ করে না । বিজিত জনতা শুধু দেখতে পায়, এরা এক গভীর চিন্তায় নিমগ্ন এই জন্য যে বিজিত দেশের – একটি মানুষেরও সম্মান বা সতীত্ব যেন নষ্ট না হয়, কারো ধনমাল যেন ধ্বংস না হয়, কেউ যেন সংগত অধিকার হতে বঞ্চিত না থেকে যায়, কোনরূপ অসচ্চরিত্রতা তাদের মধ্যে যেন ফুটে না উঠে এবং সামগ্রিক জুলুম - পীড়ন যেন কোনরূপেই অনুষ্ঠিত হতে না পারে।

পক্ষান্তরে শক্র পক্ষ যথন কোন দেশে প্রবেশ করে, তখন সে দেশের সমগ্র অধিবাসী তাদের অত্যাচার, নির্মমতা ও অমানুষিক ধ্বংসলীলায় আর্তনাদ করে উঠে একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারা যায়, এই ধরনের আদর্শবাদী জিহাদের সাথে জাতীয়তাবাদী যুদ্ধ সংগ্রামের কত আকাশ ষ্পর্শী পার্থক্য হয়ে থাকে । এই ধরনের লড়াইয়ে উচ্চতর মানবিকতা নগণ্য বৈষয়িক শক্তি -সামর্থ সহকারে ও শক্রপক্ষের লৌহবর্ম রক্ষিত পাশবিকতাকে যে অতি সহজেই প্রথম আক্রমণেই পরাজিত করবে তাতে আর সন্দেহ কি ?

বস্তুত উন্নত নির্মল নৈতিকতার হাতিয়ার বন্দুক - কামানের গোলাগুলি অপেক্ষাও দূর পাল্লায় গিয়ে লক্ষ্যভেদ করবে । প্রচন্ড লড়াইয়ে কঠিন মুহূর্তেও শক্ররা বন্ধুতে পরিণত হবে। দেশের পূর্বে মানুষের হূদয় - মন বিজিত হবে, দেশের পর দেশ-জনপদের পর জনপদ বিনাযুদ্ধেই পরাজয় স্বীকার করে মুক্তির চিরন্তন স্বাদ গ্রহণ করবে। ওদিকে এই সত্যনিষ্ঠ আদর্শবাদী দল যখন নিজেদের মুষ্টিমেয় জনসংখ্যা অন্যল্প উপায়- উপাদান সহকারে গঠনমূলক কাজ শুরু করবে, তখন সেনাপতি, সৈনিক,যোদ্ধা, বিভিন্ন জ্ঞানবিজ্ঞানে পারদর্শী, অস্ত্রশস্ত্র, রসদ এবং যুদ্ধের অন্যান্য প্রয়োজনীয় সাজ- সরঞ্জাম -সবকিছুই ধীরে ধীরে বিরোধী শিবির হতে পাওয়া যাবে, তাতে সন্দেহ নেই।

আমার এই উক্তি নিছক কল্পনা -ধারনা এবং আন্দাজ অনুমানের উপরই ভিত্তিশীল নয়, নবী করীম (সাঃ) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের সোনালী যগের ঐতিহাসিক উদাহরণসমূহ হতে একথা প্রমাণতি হয় যে, ইতিপূর্বেও এরূপ ঘটনা ঘটেছে এবং আজও এরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। অবশ্য সেজন্য শর্ত এই যে, এরূপ অভিজ্ঞতা লাভের জন্য পরিপর্ণ প্রস্তুতি ও সৎ সাহস নিয়ে কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আমি আশা করি, আমার উপরোক্ত বিস্তারিত আলোচনা হতে আমার একথা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রকৃতপক্ষে নৈতিক শক্তিই হচ্ছে শক্তির আসল উৎস। কাজেই দুনিয়ার কোন মানব সমষ্টি যদিমৌলিক মানবীয় চরিত্রের সাঙ্গে ইসলামী নৈতিকতারর আধার হয় তখন তার বর্তমানে অন্য কোন দলের পক্ষে দুনিয়ার নেতৃত্ব এবং কর্তৃত্বের অধিকারী হয়ে থাকা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে কঠিন এবং স্বভাবতই তা অসম্ভব।

দ্বিতীয়ত, মুসলমানদের বর্তমান অধপতনের মূলীভূত কারণ কি উপরের আলচনা হতে তা আশা করি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যারা না বৈষয়িক উপায় –উপাদান প্রয়োগ করবে, না মৌলিক মানবীয় চরিত্রে ভুষিত হবে, আর না সমষ্টিগতভাবে ইসলামী নৈতিকতার অস্তিত্বই তাদের মধ্যে থাকবে, তারা যে দুনিয়ার নেতৃত্বের আসন কিছুতেই অধিষ্ঠিত থাকতে পারে না, এটা সর্বজন বিদিত সত্য । এমতাবস্থায় এমনসব কাফের লোকদেরই কর্তৃত্ব দান করা আল্লাহর স্থায়ী রীতি, যাদের ইসলামী নৈতিকতা না থাকলেও মৌলিক মানবীয় চরিত্র তো রয়েছে, আর জাগতিক জড় উপায়-উপাদান ব্যবহার এবং শাসন –শৃংখলা রক্ষার দিক দিয়ে নিজেদেরকে অন্যের তুনলায় শ্রেষ্ঠ প্রমান করেছে । এই ক্ষেত্রে মুসলমানদের কোন অভিযোগ করার থাকলে, তা তাদের নিজেদের বিরুদ্ধেই হতে পারে, এ ব্যাপারে আল্লাহর স্থায়ী নিয়ম-বিধানের আদৌ কোন ক্রটি নেই। আর নিজেদের বিরুদ্ধে যদি বাস্তবিকই কোন অভিযোগ জাগে তাদের অনিবার্য ফলে নিজেদের যাবতীয় দোষ -ক্রটি সংশোধন করার জন্য যতœবান হাওয়া এবং যে কারণে মুসলমান নেতৃত্বের আসন হতে বিচ্যুত হয়ে অনুগত হতে বাধ্য হয়েছে সেই কারণ দূর করতে বদ্ধপরিকর হওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়।

অতপর সুস্পষ্ট ভাষায় ইসলামী নৈতিকতার মূল ভিত্তিসমূহের পুংখানুপুঃখ বিশ্লেষণ করা একান্ত আবঞ্ছিতভাবে অস্পষ্ট এবং বিশিষ্ট হয়ে রয়েছে । এই অস্পষ্টতা ও অসংঘবদ্ধতার কারণেই ইসলামী নৈতিকতা আসলে যে কি জিনিস এবং এদিক দিয়ে মানুষের চরিত্র গঠন ও পূর্ণতা সাধনের জন্য কোন জিনিস কোন শ্রেণী পরস্পরা ও ক্রমিক ধারা অনুযায়ী তার মধ্যে লালিত –পালিত করা অপরিহার্য তা খুব কমলোকই জানতে পেরেছে।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম