ধ্রুবতারা



রাতের আঁধার ভেদ করে যখন আকাশে চাঁদ উকি দিল তখন রাত অনেক। কৃষ্ণপক্ষের শেষ পর্যায় তাই ক্ষয় হতে হতে খেজুর শাখার মত চিকন হয়ে যাওয়া  চাঁদ ওঠে দেরিতে। আলোও কম। সেই মৃদু আলোয় চারপাশ অস্পষ্ট দেখা যায়।
পড়াশুনা শেষ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মতিন। টেবিলের বইপত্র শেলফে গুছিয়ে রাখল। এত রাত ধরে পড়াশুনা করে না সে। পরীক্ষা নিকটবর্তী হওয়ায় পড়তে হচ্ছে। অনেক পড়া এখনো বাকি।
ঘুমুতে যাওয়ার আগে দাঁত ব্রাশ করতে করতে এসে দাঁড়াল জানালার পাশে। জানালা দিয়ে ঝিরঝির বাতাস আসছে। বাইরে তাকালে দেখল আকাশে সাদা সাদা মেঘ উড়ে যাচ্ছে। নারকেল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে দেখা দেখল সরু চাঁদ।

দাঁত ব্রাশ শেষে মুখ ধুতে বাথরুমে ঢোকার মুহূর্তে বাইরে ‘ধুপ’ করে শব্দ  হলে থমকে দাঁড়াল। কেউ যেন ওয়াল টপকে বাসার ভেতরে নামল। কান খাড়া করলে বাসার ভেতরে কারও পদধ্বনি, কারও উপস্থিতি স্পষ্ট বুঝতে পারল।
কোনো ভদ্রলোক এতরাতে কারও বাসায় চুপিসারে ঢুকবে না। তাহলে কে এলো? চোর? এখন চুরি করতে এসেছে ? তাহলে ধরতে হবে। ভাগ্য ভালো যে সে টের পেয়েছে।
নাকি ডাকাত? ডাকাতের কথা মনে হতেই ভয়ে কুঁকড়ে গেল সে। ডাকাত হলে বাসার সবাইকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে টাকা পয়সা, গহনাগাঁটি তো নেবেই, হতাহতের ঘটনাও ঘটতে পারে। ভয়ে, আতঙ্কে শরীর অবশ হয়ে এলো। মাথা কাজ না করায় কী করবে প্রথমে কিছুই ঠিক করতে পারল না। প্রাথমিক হতবুদ্ধি অবস্থা কাটিয়ে উঠলে দৌড়ে গেল মাস্টার বেডরুমের দিকে ওর আব্বা-আম্মাকে ডেকে তুলতে। থানায় ফোন করতে হবে।
দৌড়ে রুম ছেড়ে যাওয়ার আগে দেখল জানালা খোলা। কলাপসিবল গেইট, দরজা বন্ধ থাকায় সহজে ভেতরে ঢুকতে পারবে না। কিন্তু জানালা খোলা থাকায় জানালার গ্রিল কেটে সহজে ভেতরে ঢুকতে পারবে। কিংবা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে পিস্তলের নল বাড়িয়ে গুলি করে অঘটন ঘটাতে পারে।
পদধ্বনি জানালার দিকেই এগিয়ে আসায় ভয় বাড়তে লাগল। হাত থেকে ব্রাশ কখন পড়ে গেছে খেয়াল করেনি। ভয়ে ভয়ে জানালা বন্ধ করতে জানালার কপাটে হাত দেয়ার আগে সামনে উঠে দাঁড়াল হানীফ।
চমকে উঠে বিকট এক চিৎকার করতে গিয়েও চিৎকার করল না মতিন, হানীফকে চিনতে পেরে। চোর, ডাকাত নয় দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও রাতের বেলা এভাবে চুপিসারে এসে ভয় পাইয়ে দেবার জন্য রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘এতো রাতে এখানে কী করছিস? এভাবে কেউ আসে? আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।’
এভাবে এসে ভয় পাইয়ে দেবার জন্য অনুতপ্ত হলো না হানীফ, দুঃখিতও হলো না। শান্ত গলায় বলল, ‘ভয় পাবি কেন? তুই না বিকেলে বললি আমরা বড়বাড়িতে গেলে তোকে যেন ডেকে নিয়ে যাই। তাই তো তোকে ডাকতে এসেছি। আমরা এখন যাচ্ছি চল।’
মতিন নড়ল না। প্রচণ্ড ভয়ের পর রাগে তখনও শরীর কাঁপছিল। রাগের দমকে বলল, ‘ডাকতে এসেছিস এতরাতে? কেন?’
ডাকতে এসে এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে ভাবেনি হানীফ। ভেবেছিল হয়ত রেডি হয়েই থাকবে বলার সাথে সাথে চলে আসবে। বিকেলের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য বলল, ‘বড়বাড়িতে যাওয়ার কথা এর মধ্যে ভুলে গেলি?’
মতিন রাগ মেশানো আশ্চর্যের সুরে বলল, ‘আমি বড়বাড়িতে যাব তোকে কে বলেছে?’
মতিনের কথা শুনে হানীফ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘বলবে আবার কে? তুই আমার সাথে বলেছিলি।’
মতিন রাগে নাক দিয়ে শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘আর গল্প খুঁজে পেলি না, রাত-দুপুরে যাব বড়বাড়িতে চুরি করতে? খেয়েদেয়ে আর কাজ নাই। তুই যা, আমি এখন ঘুমুব।’
শেষের কথায় রাগ হল হানীফের। এতো রাতে কষ্ট করে ডাকতে এসেছে না যেতে চাইলে না যাবে, সেজন্য দুঃখ প্রকাশ করবে। তা না উল্টো ধমক? একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘বেশ তাই হবে। আমি গেলাম, তুই ঘুমা। তবে কাজটা ঠিক করলি না।’ মতিনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেল। বাসার ওয়াল টপকাতে কোনো বেগ পেতে হয়নি ওর। ওয়াল টপকানোতে বেশ এক্সপার্ট।শুধু ওয়াল টপকানো নয় বড়বাড়ির ফলফলাদি চুরি করা থেকে শুরু করে এলাকার ছেলেদের জয়েন্ট ঢিল করে দেওয়া পর্যন্ত সব কাজেই এক্সপার্ট।
ছবি আঁকার হাতও খুব ভালো। এমন ভালো ছবি আঁকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। ভালো নয় শুধু পড়াশুনায়। নিচের ক্লাসগুলোতে ভালোই ছিল উপরের ক্লাসগুলোতে ক্রমাবনতি।
হানীফ ফিরে এল বড়বাড়ির পেছনে। বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে হিজল গাছের নিচে অন্ধকারে বসে অপেক্ষা করছিল হাবলু, বাবু আর ইসহাক। হানীফকে বিষণœ মুখে ফিরতে দেখে বাবু বুঝল সমস্যা কিছু একটা হয়েছে। জিজ্ঞেস করল, ‘মতিন আসেনি?’
হানীফ রাগ চেপে বলল, ‘না।’
বাবু বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলল, ‘আমি আগেই জানতাম ও আসবে না।’
হানীফের রাগ চাপা রইল না। শক্ত গলায় বলল, ‘না এলে কি আমি জোর করে ধরে নিয়ে আসব? বিকেলে বলল, তোরা গেলে আমাকে ডেকে নিয়ে যাস। এখন ডাকতে গেছি। বলে, বলেনি।’
হাবলু পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মতিনের না আসার একটা কল্পিত কারণ দাঁড় করিয়ে বলল, ‘বিকেলে আমাদের কথা শুনে হয়ত মনে হয়েছিল আসলে খুব মজা হবে। কিন্তু এখন হয়ত আর ভালো লাগছে না, তাই আসেনি।’
হানীফের রাগ তাতে কমল না। বরং বাড়ল। তীক্ষè গলায় বলল, ‘না আসলে না আসুক, আমরা তো ওকে আসতে বলিনি, আসার জন্য জোরও করিনি। ও যে এতদিন আসেনি তাই বলে আমাদের কোনো কাজ বন্ধ ছিল? বিকেলে বলল কেন? এরপরও বললাম বড়বাড়ির পেছনের রাস্তায় চলে আসিস। ও বলল, আমাকে ডেকে নিয়ে যাস।’
বাবু থামানোর চেষ্টা করে বলল, ‘বাদ দে ওসব। আমাদের কাজ আমরা করি।’
বাউন্ডারি ওয়ালের উত্তর-পশ্চিম কোণে এসে একে একে উঠে গেল ওয়ালের উপর। অনেক পুরনো লাল ইটের  উঁচু বাউন্ডারি ওয়াল। ঝকঝকে পরিষ্কার নয়। শ্যাওলা জমেছে, কোথাও আগাছা গজিয়েছে। তবে ইট খসে পড়েনি। কেমন মজবুত তা দেখে সহজেই অনুমান করা যায়। বাউন্ডারি ওয়ালের কাছে বড় বড় সেগুন, মেহগনি, হরতকী গাছ। এসব গাছের নিচে ঘন লম্বা ঘাস জঙ্গলের মত হয়ে আছে। ওয়ালের উপর উঠে লাফ দিয়ে নিচে নামার প্রয়োজন পড়ে না সব জায়গায়। পাশের বড় গাছের ডাল বেয়ে অনায়াসে নামা যায়। বাসার ভেতরে আম কাঁঠাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন ফলফলাদির বাগান। মাঝখানে শান-বাঁধানো ঘাটের  পুকুর। পুকুরের দক্ষিণ পাশে পুরনো আমলের রাজকীয় বাড়ি।
বাসার পুবদিকে বাড়ির মেইন গেট। হাসপাতাল রোড সে দিক দিয়েই। দক্ষিণদিকের ওয়ালের পাশ দিয়ে অন্য একটা রাস্তা চলে গেছে পোস্ট অফিসের দিকে। উত্তরপাশে নবাব মসজিদের বিস্তীর্ণ ফাঁকা জায়গা।
শহরের মাঝে এতো বড় এরিয়া নিয়ে গাছগাছালিতে ভরা বাড়ি দ্বিতীয়টি নেই। গভীরভাবে খেয়াল না করলে মনে হবে  কয়েকটা বাড়ি এখানে।  উঁচু প্রাচীরের জন্যই বাড়ির পুরো এরিয়া অনুমান করা যায় না।
বাড়ির মালিক ওয়ারেসুল হক সাহেব সপরিবারে থাকেন দেশের বাইরে। তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন জমিদার। প্রচুর ধনসম্পদ, জমিজমা ছিল তাদের। সে সব বাসাবাড়ির একটি হচ্ছে এটি।
বাড়ি দেখাশোনার জন্য কেয়ারটেকার রেখেছেন। বাগানের ফলফলাদির প্রতি লোভ অনেকের। কিন্তু উঁচু বাউন্ডারি ওয়াল, কেয়ারটেকার, সাপখোপের ভয়ের কারণে সুবিধা করতে পারে না।
তবে হানীফদের কোনো অসুবিধা নেই। তারা উঁচু বাউন্ডারি ওয়াল পার হওয়ার সহজ রাস্তা বের করেছে। বাউন্ডারি ওয়ালের উপর উঠে গাছের ডাল বেয়ে নীচে নেমে যাওয়া, এক গাছ থেকে অন্য গাছে যাওয়া-আসা করে অনায়াসে। ঘাসের মাঝে লুকালে দূর থেকে বুঝার উপায় নেই এখানে কেউ আছে। ঘন ডালপাতায় ভরা গাছে উঠে পাতার আড়ালে লুকালেও খুঁজে বের করা কঠিন। গাছপালার জন্য পাখির আনাগোনা বেশি। হরেক রকম পাখি বাসা বেঁধেছে বিভিন্ন গাছে। ক্লান্ত দুপুরে শহরের এদিকটা নির্জন থাকলেও মুখরিত থাকে পাখির গুঞ্জরনে।
দক্ষিণ দিকের নারকেল গাছের নিচে এসে বাবু জিজ্ঞেস করল, ‘গাছে কে উঠবে হানীফ?’
হানীফ হাবলুর দিকে চেয়ে বলল, ‘হাবলু।’
হাবলু পেটে হাত দিয়ে বলল, ‘আমার পেটটা ভালো না, ব্যথা করছে, গাছে চড়তে বলিস না। অন্য কাউকে বল।’
‘ইসহাক?’ হানীফ ইসহাকের দিকে তাকাল।
ইসহাক বলল, ‘আমি কি প্রতিদিন গাছে চড়ব নাকি?’ গতদিনও সে গাছে চড়েছিল।
হানীফ বলল, ‘ঠিক আছে আমি গাছে চড়ছি।’
দা আর দড়ি নিয়ে উঠে গেল গাছে। একটা একটা করে ডাব ছিড়ে নিচে ফেলে। নিচে পড়ে ধুপধাপ শব্দ হলে কেয়ারটেকার টের পেয়ে ছুটে আসবে লাঠি হাতে।
নারকেলের বাদা দড়ি দিয়ে বেঁধে দড়ির অন্য অংশ ডালে বাঁধল। দা দিয়ে বাদা কেটে আস্তে আস্তে দড়ি ছাড়তে লাগল। বাদা মাটিতে ঠেকলে দড়ির অন্য অংশ ডাল থেকে খুলে নিচে ফেলে দিয়ে গাছ থেকে নেমে এল।
বড় ঘাসের মাঝে বসলে চারপাশের ঘন গাছপালার জন্য জায়গাটা জঙ্গলের মত লাগছিল। মৃদু বাতাসের দোলায় কয়েকটা ঘাস দুলে উঠলে চাঁদের হালকা আলোয় নিঝুম পরিবেশে অবাক করা সৌন্দর্য্য খুঁজে পেল হানীফ। দা দিয়ে ডাব কেটে খাওয়ার ফাঁকে বলল, ‘দেখেছিস কেমন সুন্দর লাগছে এই পরিবেশ! আমার মনে হচ্ছে গভীর কোনো জঙ্গলে বসে রাত কাটাচ্ছি। একটা অপার্থিব অনুভূতি হচ্ছে।’
‘আমি মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি।’ বলল হাবলু।
‘দু’চোখচাখ ভরে দেখছি।’ ইসহাক বলল। ‘আজকের পরিকল্পনা যথার্থ হয়েছে। আজকের রাতের কথা আমার মনে থাকবে অনেকদিন।’  ঘাসের উপর শুয়ে বলল, ‘এখন আমার কাব্য করতে ইচ্ছে করছে। আগে একটু চাঁদের আলো গায়ে মেখে নেই। চাঁদের চেয়ে সূর্য কত বড়, সূর্যের আলোতে পৃথিবী আলোকিত হয়। রাতের বেলা চাঁদ যে আলো দেয় তাও সূর্যের আলো। এরপরও চাঁদ নিয়ে যত কাব্য হয়েছে হয়নি সূর্য নিয়ে। কেমনে  বুঝব যার যত বেশি অবদান তার মূল্যায়ন তত বেশি? এই গোলমেলে বিষয় মাথায় ঢোকে না। চাঁদকে নিয়ে কাব্য সবার, মুগ্ধ চাঁদের আলোয়, উৎস কোথায় কেউ ভাবে না, কেউ দেখে না সূর্য কত ভালো।’
‘পান্না ভাইয়ের আব্বা যদি খুঁজে বের করতে পারে তাদের জানালার গ্লাস কে ভেঙ্গেছে তাহলে কাব্যচর্চা ছুটে যাবে।’ তীব্র কটাক্ষ করে মন্তব্য করল বাবু।
ইসহাক ওর কথার গুরুত্ব না দিয়ে বলল, ‘আমি ভাঙ্গিনি।’ হাবলুর দিকে নির্দেশ করে বলল, ‘ভেঙ্গেছে ওই হাবড়া।’
হাবলু আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলল, ‘আমি ইচ্ছে করে ভাঙ্গিনি। গুলতি ছুড়েছিলাম পাখির গায়ে। পাখির গায়ে না লেগে লাগল জানালার গ্লাসে।’
ইসহাক বলল, ‘এখন মজা বোঝ। এমনিতেই নালিশের অন্ত নাই। রায়হানদের গেটের কলিংবেল ভেঙ্গে ফেলেছিলাম বলে গত পরশুদিনও মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেয়েছি। আজ আবার বাসায় এই নালিশ গেলে ঘোরতর বিপদ হবে। সহজে ছাড়া পাব না।’
ওদের এই দোষারোপ আর সাজা পাওয়ার ভয় দেখে হানীফ শান্ত গলায় বলল, ‘এতো টেনশন করছিস কেন? ধর জানালার গ্লাস কে ভেঙ্গেছে পান্না ভাইয়ের আব্বা খুঁজে বের করে ফেলেছে। শাস্তি হিসেবে তোর আব্বা তোকে খুব মার দিবে। এজন্য টেনশন করে এই মুহূর্তটা নষ্ট করবি কেন? মার তো তুই খাবিই আবার টেনশন করে এই সময়টাও নষ্ট করবি। ডাবল শাস্তি হয়ে গেল না? নিজে নিজে ডাবল শাস্তি পেলে না করবে কে? একদিন চল ঘুরে আসি পানিহাটা বিল থেকে, যেখানে বালিহাঁস পাওয়া যায়, বক পাওয়া যায়, ঘুরে বেড়ায় আরও পাখি। শিকার করার প্রচুর সুযোগ পাবি। সারাদিনের জন্য একটা নৌকা ভাড়া করে নেব, বিলে সাঁতার কাটব, দুপুরে নৌকার ছইয়ের নিচে বসে বিলভোজন করব। খুব মজা হবে।’
বিলভোজন শব্দ শুনে বাবু বলল, ‘সেটা আবার কী?’
‘বনে বসে যে ভোজন তা যদি বনভোজন হয় তাহলে বিলে নৌকায় পানির উপর বসে যে ভোজন তা বিলভোজন হবে না কেন?’ ব্যাখ্যা করল হানীফ।
‘একটা নতুন টার্ম আবিষ্কার করলি।’ ইসহাক বলল। ‘বোধহয় আগে কেউ এই টার্ম ব্যবহার করেনি। বিলভোজন, হা হা হা।’
বাবু খুব প্রসন্ন হলো না। কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, ‘কিন্তু স্কুল তো খোলা।’
হানীফ বলল, ‘স্কুল তো খোলা থাকবেই। আমরা বিলভোজনে যাচ্ছি বলে স্কুল বন্ধ থাকবে নাকি?’
বাবু যা বোঝাতে চেয়েছিল এরা তা না বুঝে অন্য একটা বোঝায় সে বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আমি তাই বলেছি নাকি? আমি বলেছি স্কুল খোলা, স্কুলে যেতে হবে না?’
হানীফ স্কুলে যাওয়ার বিষয়টা মোটেও পাত্তা দিল না। বলল, ‘দু’একদিন না গেলে কিছু হবে না। এই সময় স্কুলে গিয়ে ওরা আর কত বেশি শিখবে? ফাইনাল পরীক্ষা দিবে আমাদের সাথেই। ক্লাস টেনে তো আমাদের আগে উঠতে পারবে না।’
বাবু চুপ করে রইল। এদের বুঝানো কঠিন। কিছু বললে উল্টো যুক্তি দেখায়, যা সে খণ্ডন করতে পারে না।
হানীফ বলল, ‘কাজের কথা বল। পানিহাটা বিলে কবে যাবি?’
ইসহাক বলল, ‘তুই পরিকল্পনা করে ফেল, আমরা চলে যাব।’
‘শুক্রবার সকালে রওয়ানা হলে কেমন হয়? শুক্র, শনি দু’দিন কাটিয়ে চলে আসব শনিবার রাতে।’ বলে হানীফ তাকাল বাকিদের দিকে।
বাবুর অনীহা লাগছিল। মুখে বলতে পারছিল না। শুধু বলল, ‘দূর তো অনেক।’
হানীফ ধমক দিয়ে বলল, ‘তুই কি হেঁটে যাবি? বাসে যাবি, বাসে আসবি। বাসে যেতে আর কতক্ষণ সময় লাগে? দু’চোখ ভরে বিলের পানি দেখব, ঠাণ্ডা হাওয়া খাব, নৌকা চালাব। মারো টান হেইয়ো হেইয়ো হেইয়ো, মার টান হেইয়ো।’ হাত দিয়ে নৌকা বাওয়ার ভঙ্গি করল। ইসহাককে লক্ষ্য করে বলল, ‘নৌকা চালাতে পারিস?’
ইসহাক বলল, ‘না।’
হানীফ বলল, ‘আমিও পারি না। শিখে নেব। কি থ্রিল হবে বুঝতে পারছিস?’
‘হু’ বলে মাথা ঝাঁকাল ইসহাক।
‘আমার তো এখনই যেতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে এখনই ঘুরে আসি। তবে মনে থাকে যেন আগামী শুক্রবার পানিহাটা বিলে যাচ্ছি।’
কথা থামিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘চল পুকুর পাড়ে কতক্ষণ বসে থাকব। পানিহাটা বিলের আগে বড়বাড়ির পুকুরের পানি চাঁদের আলোয় কেমন দেখায় দেখব।’
উঠে দাঁড়াল সে।
লম্বা লম্বা ঘাস সরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাবলু বলল, ‘পুকুর পাড়ের শিমুল গাছে নাকি ভূত থাকে। অমাবস্যার রাতে গাছে বসে  কাঁদে। পুকুর থেকে মাছ খায়। আরও কত কাহিনী শুনেছি!’
হানীফ হালকাভাবে বলল, ‘তাহলে চল ভূতের সাথে একটু দেখা করে আসি।’
হাবলু আবার বলল, ‘তোর কি ভয় করছে না?’
‘না। ভূত যদি থাকে তাহলে আজ দেখা হয়ে যাবে। আমিও দেখে নেব ভূতকে।’ কথা থামিয়ে আবার হালকা গলায় বলল, ‘এসব বানানো কথা। ভূত বলতে কিছু আছে নাকি?’
‘জানি না।’ ইসহাক বলল। ‘আমার ভূতের ব্যাপারে আগ্রহ নাই। ভূত থাকলেই কী, না থাকলেই কী?’
পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে শান-বাধানো ঘাট। ওদিকে যাওয়া উচিত হবে না। বাসা থেকে কেয়ারটেকার জিল্লু মিয়া দেখে ফেলতে পারে। উত্তর পাড়ে কামরাঙ্গা গাছের আড়ালে বসে থাকবে।
হেঁটে যেতে যেতে পুকুরের পশ্চিম পাড়ের কাঁঠাল গাছের দিকে তাকিয়ে হানীফ বলল, ‘কাঁঠালগুলো দেখা দরকার পাকল কি না।’
‘আগামী দিন যখন আসব তখন খাওয়া যাবে। যদি জিল্লু মিয়া পেড়ে না নিয়ে যায়।’ বলল হাবলু।
‘এটাই চিন্তার বিষয়।’ বলল হানীফ। ‘বাগানের উপর সে তীক্ষè নজর রাখে। একটা ফল অন্য কেউ পেড়ে নিয়ে যাক এটা সে হতে দেবে না। আচ্ছা জিল্লু মিয়াকে ভয় দেখানো যায় না? যাতে রাতের বেলা ঘর থেকে বেরই হতে না চায়। তাহলে আমরা আমাদের কাজ নির্বিঘেœ করতে পারব।’
‘কিসের ভয়?’ প্রশ্ন করল হাবলু।
কিছুক্ষণ আগে ভূতের কথা হচ্ছিল। সে কথাই বলল, ‘ভূতের ভয়।’
হাবলু বলল, ‘কিন্তু জিল্লু মিয়া তো ভয় পাওয়ার লোক না। ভূত সেজে ভয় দেখাতে গিয়ে উল্টো নিজেরাই ফেঁসে যাব। হয়ত দেখা যাবে যে নরকঙ্কাল দিয়ে ভূত সাজব, লাঠি দিয়ে বাড়ি দিয়ে নরকঙ্কালের মুন্ডু উড়িয়ে দেবে। তখন?’
হানীফ বলল, ‘আরে না, অত সহজ না। নরকঙ্কাল, মুন্ডু এসব কিছুই আনব না। একদম সাধারণ ভূত সাজব। সারা গায়ে থাকবে কালো পোশাক, কালি মেখে মুখ কিম্ভূতকিমাকার করে ফেলব। মুখ থেকে অনবরত ছুটাতে থাকব আগুন। ভয় পাবে না আবার? অন্ধকারে আগুন দেখে ওখানেই দাঁতে দাঁত লেগে ঠাস করে মাটিতে পড়ে যাবে।’
মুখ দিয়ে আগুন ছুটানোর কথা শুনে ইসহাক আগ্রহী হয়ে বলল, ‘মুখ দিয়ে আগুন বের করবি কিভাবে?’
হানীফ বলল, ‘জাদু দেখিসনি, মুখ দিয়ে আগুন বের করে?’
‘দেখেছি কিন্তু টেকনিক তো জানি না।’
হানীফ বলল, ‘আমি জানি। শুধু ফসফরাস যোগাড় করতে হবে। ভয় না দেখালে জিল্লুমিয়া সব সময় ডিস্টার্ব করবে। গতবার দেখলি না গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। অল্পের জন্য লাঠিটা আমার  মাথায় লাগেনি।’
ভয়ের স্মৃতি মনে হলে হাবলু বলল, ‘দৌড়ে ওয়াল পার হতে পেরেছিলাম বলে ধরা পড়িনি। সে রাতের কথা মনে হলে এখনও শিউরে উঠি।’
পুকুরের উত্তর পাড়ে কামরাঙ্গা গাছের কাছে এলে বাসার সামনের খোলা জায়গার দিকে তাকিয়ে রইল হানীফ। ওকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বাবু বলল, ‘কী হল? ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? ভূত দেখেছিস নাকি?’
হানীফ সেদিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে বলল, ‘দেখত লোকগুলো কী করছে? ’
‘কোথায়?’ বলে বাবু এগিয়ে এল। দেখে বলল, ‘হয়ত কোনো কাজ করছে। দেখছিস না ট্রাক থেকে জিনিসপত্র নামাচ্ছে।’
‘এ বাসায় ট্রাক কেন? আগে কোনোদিন ট্রাক দেখেছিস?’
‘এ বাসায় ট্রাক আসতে পারে না? কত কাজেই আসতে পারে।’ বাবু বলল।
‘ব্যাপারটা সুবিধার মনে হচ্ছে না। এতো রাতে ট্রাকে করে জিনিসপত্র আনার মানে কী?’
কথাবার্তা শুনে হাবলু, ইসহাকও এগিয়ে এলো।
‘তাই তো!’ বলল হাবলু।
হানীফ বলল, ‘দেখতে হয় তো একটু।’
পুকুরের পশ্চিম পাড় দিয়ে বাসার দিকে এগুলে বাবু বলল, ‘বাদ দে তো এসব, দরকার নেই ওদের কাজ দেখার। তারা হয়ত কোনো  জরুার কাজ করছে আমরা গিয়ে উল্টো ধরা পড়ব। আমাদের কাজ আমরা করি।’
হানীফ কথা মানল না। বলল, ‘তারা কী করছে দেখা জরুরি।’
‘এতো রাতে চুরি করতে এসে এমনিতেই বিপদে আছি। আব্বা যদি টের পায় আমি ঘরে নাই কী হবে ভাবতে পারছিস? তার উপর উপযাচক হয়ে অন্য একটা বিপদে জড়ানো? ভাবা যায়?’
হানীফ বলল, ‘তোরা চাইলে চলে যেতে পারিস, আমি বিষয়টা দেখে আসি।’
হানীফের অনমনীয় ভাব দেখে হাবলু, ইসহাক কোনো কথা না বলে পেছন পেছন হাঁটতে লাগল। বাবুও অনিচ্ছাসত্ত্বে এলো।
ততক্ষণে চাঁদ ডুবে যাওয়ায় আবার অন্ধকার নেমে এসেছে। পুকুরের পশ্চিম পাড় দিয়ে হেঁটে এসে বাসার কাছাকাছি একটা রঙ্গন ফুলগাছের ঝোপের আড়ালে দাঁড়াল। কয়েকজন লোক ট্রাক থেকে কার্টুনগুলো নামাচ্ছে। বাকিরা মাথায় করে বাসার ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। কার্টুনভরে জিনিসপত্র এ বাসায় আনার কী প্রয়োজন পড়ল? তাও আবার রাতের বেলা? সন্দেহ ঘনীভূত হতে থাকে হানীফের মনে। হানীফ ফিসফিস করে বলল, ‘কিছু বুঝতে পারছিস?’
বাবু বলল, ‘না।’
হাবলু বলল, ‘ব্যাপারটা খটকা লাগছে।’
জিনিসপত্র নামানোর পর চলে যাওয়ার জন্য ট্রাক স্টার্ট নিলে, হেডলাইটের তীব্র আলোও জ্বলে উঠল। হেডলাইটের আলো এসে পড়ল পুকুরের দক্ষিণ পাশের রাস্তাসহ রঙ্গন ফুলগাছের উপরও। হানীফ দ্রুত রঙ্গন গাছের ঝোপের  আড়ালে সরে এসে বলল, ‘সরে আয় সবাই।’
হানীফ হাবলুর দিকে চেয়ে বলল, ‘কার্টুনগুলো চেক করতে হবে। চোরাচালানের জিনিসপত্র হলে থানায় জানাতে হবে। এরা মনে হচ্ছে বড় ধরনের চোরাকারবারি। কি একটা মিশন সামনে এসে গেছে বুঝতে পারছিস?’
ইসহাক সংশয় প্রকাশ করে বলল, ‘এরা আসলেই চোরাকারবারি?’
হানীফ বলল, ‘তাই তো মনে হচ্ছে। কোন কষ্ট ছাড়া একেবারে আস্তানার খোঁজ পেয়ে গেছি। এদের ধরতেই হবে।’
হাবলু বলল, ‘কার্টুন চেক করতে ঘরে ঢোকা কি সহজ হবে? যদি চোরাকারবারি হয়ে থাকে তবে কেমন জোরদার  পাহারা থাকবে এদের ভেবেছিস?’
‘তা তো থাকবেই। এদের ফাঁকি দিয়ে ঘরে ঢুকতে হবে।’ হানীফ বলল।
‘কাজটা সহজ হবে না।’ হাবলু আবার বলল।
‘সহজ তো নয়ই, কঠিন। কঠিন হলেও বুদ্ধি একটা বের করতেই হবে। পাহারায় কেউ থাকলে কৌশলে কুপোকাত করতে হবে।’
কিছু সময় চিন্তা করে হানীফ বলল, ‘লিকুইড মরফিন হলে এদের সহজেই অজ্ঞান করে ফেলা যাবে। সাবধানে নাকে-মুখে ছুড়লেই হবে। কিছু মেল্টিং কেমিক্যালস পেলে দরজা কিংবা জানালা ভেঙ্গে সহজে ঘরের ভেতর ঢোকা যাবে। ভিডিও ক্যামেরায় জিনিসপত্রের ভিডিও করে থানায় গিয়ে দেখালে অবিশ্বাস করতে পারবে না। ব্যস কেল্লাফতে, পুরো গ্যাং ধরা পড়ে যাবে। একটা ছারপোকা হলে ভালো হতো। রুমের মধ্যে রেখে আসতাম এদের কথাবার্তা রেকর্ড করার জন্য। চোরাকারবারিদের উৎস সম্পর্কে তথ্য উদ্ধার করতে পারলে সমূলে বিনাশ করা যেত।’
উত্তেজনা অনুভব করছিল হানীফ। বলল, ‘এখনি কি ঢুকবি বাড়িতে? একেবারে হাতেনাতে ধরে ফেলব।’
বাবু মোটেও সায় দিল না। বলল, ‘এখন কোনো প্রস্তুতি আছে তোর?’
প্রস্তুতির কথা বলাতে হানীফ বলল, ‘আজ আর হচ্ছে না, প্রস্তুতি নিয়ে কাল আসতে হবে। সবাই মানসিকভাবে প্রস্তুতি নে, বড় একটা অপারেশনের। সফল হলে কী রকম বিখ্যাত হয়ে যাব ভাবতে পারছিস?’
‘হু ।’ চিন্তিতভাবে শুধু মাথা নাড়ল হাবলু।
‘নামডাক পড়ে যাবে। রাতারাতি হিরো বনে যাব। পত্রিকায় ছবি ছাপা হবে, টিভিতে সাক্ষাৎকার প্রচার করা হবে। এতো বড় কাজ করায় প্রশংসার তুবড়ি ফুটবে সবার মুখে। স্কুলে স্যাররাও দেখবি কেমন আলাদা গুরুত্ব দেয়।’ হানীফ উৎসাহ দিয়ে চাঙ্গা করতে  বলল।
‘এখন অপারেশনের কৌশল ঠিক করতে হবে। আজ রাতে বাসায় ফিরে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে ঠিক করব। এখন আর এখানে সময় কাটানোর দরকার নেই।’ হানীফ বলল।
ঘাসের মধ্যে দিয়ে হেঁটে উত্তর পশ্চিম কোণের বাউন্ডারি ওয়ালের কাছে এলো। যেখানে কয়েকটা ইট কিছুটা বেরিয়ে আছে। যেখানে হাত দিয়ে ধরা যায়, পা রাখা যায়। বাড়ির বাইরে এলো সবাই। বাইরে এসেও তারা নিরাপদ না। কেউ দেখলেও সমস্যা হবে। এতো রাতে বাসার বাইরে দেখে কুমতলব আছে বলে সন্দেহ করবে। বাপ-মায়ের কাছে নালিশ করবে। পুলিশ দেখলে থানায় নিয়ে যাবে।
রাতের অন্ধকার রাস্তা। ল্যাম্পপোস্টগুলোর সবক’টাতে লাইট জ্বলছে না। যানবাহন নাই। মানুষজনের চলাচলও নাই। দোকানপাট বন্ধ। একটা রিকসা দেখে রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াল। একটা মোটর সাইকেল শব্দ করে দ্রুত চলে গেল। এলাকার চৌকিদার বাঁশিতে ফুরুৎ ফুরুৎ করছে। কখনো মুখে হাইস হুইস করছে। ভাবটা এমন যেন সব চোর-ডাকাত পালিয়ে যা। এই চৌকিদারের সামনে না পড়লেই হল।
অন্ধকারে পথ মাড়িয়ে বাসার আঙিনায় ফিরে এলো হানীফ। অন্য সবাই চলে গেছে যার যার বাসায়। ওর রুমের পুব দিকের দরজা দিয়ে বাইরে বের  হওয়া যায়, ভেতরের প্রধান দরজা ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় না। কলাপসিবল গেটের চাবি থাকে ওর কাছে। খোলার সময় খেয়াল রাখতে হয় শব্দে কেউ যেন জেগে না ওঠে।
হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ল। কিভাবে অপারেশন সফল করা যায় সে চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। যদি সফল হয় তবে চারদিকে কেমন ধন্য ধন্য পড়ে যাবে সে দৃশ্য কল্পনা করে রোমাঞ্চিত হচ্ছিল।
দুই.
বিকেলে কলেজ মাঠে ফুটবল খেলা জমে ভালো। পাড়ার সব ছেলে এসে জড়ো হয়। আগ্রহী দর্শকেরও অভাব নেই। বড় ছোট সব বয়সী দর্শক মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে খেলা দেখে। বিকেলের এই সময়টাতে একটা নির্ভেজাল বিনোদন ব্যবস্থা সবার জন্য।
দুপুরের পর সামান্য বৃষ্টি হয়েছে। মাঠ ভেজা, এখনও শুকায়নি। তবে খেলা বন্ধ নেই।
নবীন ভাইয়ের সাথে কথা বলা শেষ করে যখন মাঠে এলো হানীফ তখন খেলা বেশ খানিকক্ষণ হয়ে গেছে। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মাঠে নামল না। কোন্ পক্ষে নামবে এসব নিয়ে ফ্যাসাদ হবে। দাঁড়িয়ে রইল মাঠের পাশে, যারা খেলা দেখছিল তাদের সাথে।
সাত্তার সাহেব তার দেড় বছরের ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছিলেন। হানীফকে দেখে বললেন, ‘আজ খেলতে নামলে না যে?’
হানীফ বলল, ‘আসতে দেরি হয়ে গেছে।’
‘তোমার সঙ্গী-সাথীদের কাউকে তো দেখছি না।’
হানীফ খেয়াল করল তাইতো বাবু, ইসহাক এরাও তো নাই। শুধু হাবলু খেলছে। টানটান উত্তেজনায় খেলা চলছে। মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে দৌড়ে প্রায় ডি-বক্সের কাছে চলে এসেছে সবুর। ওখানে কাশেম, মোশারফ বাঁধা দিয়েও আটকাতে পারেনি। সামনে এখন শুধু গোলকিপার হাশমত। গোল হয় হয়। দর্শকরাও মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছিলÑ ‘ডানে কাটো, সামনে আগাও’ ইত্যাদি। এর মধ্যে আরও কয়েক জন এসে উপস্থিত হয়েছে। গোলপোস্টের সামনে বল নিয়ে কাড়াকাড়ি। সাত্তার সাহেব সেদিকে তাকিয়ে রইলেন।
দাঁড়িয়ে ফুটবল খেলা দেখে লাভ নাই। তারচেয়ে বড়বাড়ি ঘুরে এলে অনেক বেশি লাভ। বড়বাড়ির আশেপাশে দাঁড়িয়ে খোঁজখবর নিতে হবে কে কে আসে ওখানে, কে কোথায় যায়। অপরাধী চিহ্নিত করতে পারলে ধরা সহজ হবে।
ওয়ারেসুল হক সাহেব নেই সেই সুযোগে হয়ত এখানে চোরাকারবারীরা আখড়া খুলে বসেছে। অথবা তাকে জানিয়েই সব করা হচ্ছে। দর্শকসারি থেকে সরে ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই দেখল জহির এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। খেয়াল করেনি হানীফ। অন্যদের দৃষ্টি এড়িয়ে যেন খুব গোপন কথা বলছে এমন ফিসফিস করে বলল, ‘হানীফ ভাই! ইসহাক ভাইয়ের খবর জানেন?’
হানীফ নিস্পৃহ স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘কী খবর?’
‘খুব খারাপ খবর আছে। ইসহাক ভাইকে তার আব্বা খুব মারধর করেছে।’
মারধরের কথায় চমকে গেল হানীফ। বলল, ‘কেন?’
‘গতরাতে কোথায় যেন গিয়েছিল, ফিরেছে অনেক রাতে।’
হানীফের বুক ধক করে উঠল। এখন যদি বড়বাড়িতে যাওয়ার কথা, বাকিদের নাম বলে দেয় তাহলে আরও বিপদ হবে। বিপদের কথা মনে হতেই বুকের ধুকধুকানি বেড়ে গেল। বলল, ‘তুই জানলি কী করে?’
‘ওদের বাসায় কাজ করে সখিনার মা, সে এসেছিল আমাদের বাসায়। আম্মার সাথে আলাপ করছিল আমি শুনেছি। ইসহাক ভাইয়ের কপালে আরো খারাবি আছে। তার আব্বা খুব ক্ষেপে আছে।’
হানীফ বুঝল আজ কেন ও খেলতে আসেনি। কিন্তু বাবুর কী হল? ও আসেনি কেন? ও-ও কি ধরা পড়ল? বাবুর সাথে স্কুলেও দেখা হয়নি। স্কুলে যায়নি আজ। দেখল, মতিন খেলছে।
বড়বাড়ির চারদিকে এক চক্কর ঘুরে এলো। বড়বাড়ির উল্টোদিকে জাফরানী নার্সারি। বেশ বড়ই বলতে হবে। প্রচুর পরিমাণে গাছের চারা আছে এখানে। শুধু যে ফলের চারা তাই না, ফুলের চারাও  আছে।
পাশের বড় পুকুর থেকে পানি এনে ঝরনা দিয়ে দু’জন লোক গাছে পানি দিচ্ছিল। সে নার্সারির সামনে দাঁড়িয়ে গাছ দেখার ছলে বড়বাড়ির গেটের দিকে নজর রাখছিল।
এখন কি গেটে গিয়ে নক করবে? বলবে বলটা ভেতরে পড়েছে। এ সুযোগে সে দেখে নেবে ভেতরটা। সাথে অন্য কেউ থাকলে ঢুকে পড়বে বাড়ির ভেতর? নাকি গল্প করবে জিল্লু মিয়ার সাথে? গতরাতে কে এসেছিল জানতে চাইবে। জানতে চাইলেই বলবে নাকি? হয়ত তখন আরও সতর্ক হয়ে যাবে। এসব ভাবল।
নার্সারির গাছ দেখার পরে পুকুর পাড়ে গিয়ে বসে রইল। এমন সময় দেখল বড়বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে এক লোক। মোটর সাইকেলে হুঁস করে চলে গেল। লোকটা নিশ্চয় এই কাজে জড়িত। পেছনে কিছু দূর যেতেই মোটর সাইকেল দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল।
তবে বুদ্ধি আছে হানীফের। মোটর সাইকেলের নম্বর দেখে নিয়েছে। মনেও রেখেছে। আরও কিছু ঘটে কি না দেখার জন্য বসে রইল পুকুর পাড়ে।
গাড়ির হর্ন শুনে বড়বাড়ির গেটের দিকে তাকাল। দেখল, একটা নীল রঙের প্রাইভেট কার এসে দাঁড়িয়েছে। গেট খুলে গেল, প্রবেশ করল গাড়ি। সে কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। ওদিকে তখন মাগরিবের নামাজের আজান দিয়েছে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। এমন সময় আরও কারও প্রয়োজন ছিল। হাবলুর খেলা শেষ হলো বোধহয়। ওকে ডাকতে হবে। আর বাসায় গিয়ে পূর্ণ প্রস্তুতি নিতে হবে।
ফিরে এলো বাসায়। ঢোকার মুহূর্তে বাসার কাজের মেয়ে আলেয়া বলল, ‘এখন বাসায় আইসেন না। খালুজান লাঠি নিয়া ঘোরাঘুরি করতাছে।’
লাঠি নিয়ে ঘোরাঘুরির কথা শুনে ভয়ে চমকে উঠল হানীফ। গেটের বাইরে মাথা নিয়ে বলল, ‘কেন?’
‘জানি না, আগে পালান। গতরাইতে কই গেছিলেন? চুরিচামারি না কি কইরা বাসায় ফিরছেন। অফিস থাইক্যা ফিরনের পথে কারা জানি খালুজানরে খবর কয়া দিছে।’
হানীফ দেখল তার ধারণাই ঠিক। সে বাসায় পৌঁছার আগেই খবর পৌঁছে গেছে।
বাসার ভেতর তার আব্বার গলার আওয়াজ শুনল। আম্মার সাথে রাগারাগি করছে।
রাস্তায় মানুষজন চলাচল করছে। কতক বাসাবাড়ি থেকে আলো এসে পড়ছে রাস্তায়। কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। কলেজ মোড়, হাইস্কুল মোড়, পুকুর পাড় সব জায়গায় খোঁজ নিয়েও হাবলুর কোনো হদিস পেল না। ওকে পেলেও দু’জন বিকেলের বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ করতে পারত।
বড়বাড়িতে আর একপাক ঘুরে আসার জন্য গেল। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে বাতি না জ্বলায় তখন বেশ অন্ধকার।
বড়বাড়ির পেছনের দিকে উত্তর-পশ্চিম ওয়ালের কাছে এসে ওয়াল টপকাল। ঘাস, জঙ্গল সরিয়ে পুকুরের পশ্চিম পাড়ে কাঁঠাল গাছের কাছে এসেই সতর্ক হয়ে গেল।
পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে কারা যেন। বাসার সামনে বাতির আলো পড়ে না এমন একটা অন্ধকারময় জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। তিনজন। ওদের আলাপ শুনতে পেলে ভালো হত। এই মুহূর্তে তার দরকার সহকারীর। কি সুযোগটাই সে মিস করছে। আবার উল্টো পথে ফিরে এলো বড়বাড়ি থেকে।
হাঁটতে হাঁটতে নতুন বাজারে প্ল্যানেট প্লাজার সামনে এসে দাঁড়াল। টিভি শো-রুমের অনেকগুলো টিভি একসাথে চলছে। একেক টিভিতে একেক অনুষ্ঠান, তবে শব্দ নেই। শুধু ছবি দেখাই সার।
ফিরে এলো বাসার কাছে। কিছুটা অসহায় লাগল নিজেকে। মনে হচ্ছে সবাই কত ভালো আছে। শুধু ও ভালো নেই। নওশাদদের বাসার জানালা দিয়ে আলো আসছে। নওশাদ নিশ্চয় পড়ছে। ওর তো পড়াই হয় না। পরীক্ষায় ভালো করবে কী করে? ইচ্ছে করে একেবারে শান্তশিষ্ট ভদ্রছেলেটি হয়ে যেতে। সবার নয়নমণি হতে। পড়ার সময় পড়ে, খেলার সময় খেলে, বাবা-মার অতি আদরের ধন। কিন্তু হতে পারে না।
এখন তো আর ইচ্ছে করলেই গিয়ে পড়তে বসতে পারবে না। এই অবস্থা অবশ্য প্রথম না। আরও ঘটেছে, অসংখ্যবার। তাতে শিক্ষা হয়নি। প্রতিবারই মনে হয়েছে এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেলে আর কখনো এমন দুষ্টুমি করবে না। বিপদ কেটে গেলে আর মনে থাকে না।
তিন.
পরদিন হাবলুর সাথে দেখা হল মাঠের পশ্চিম পাশের পানির ট্যাঙ্কির কাছে। ছোট একটা বল নিয়ে আপন মনে খেলছিল। হানীফ কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘কী খবর হাবলু?’
‘ভালো।’ বল উপরের দিকে ছুড়ে আবার তা ধরার ফাঁকে বলল হাবলু।
‘রাতে বাসায় গিয়েছিলি?’
‘না। ফুফুর বাসাতে আছি। তোর কী অবস্থা?’
‘পালিয়ে পালিয়ে থাকি। ইসহাককে নাকি খুব মারধর করেছে?’
‘হু। জহির তো তাই বলল।’
‘আর মারের চোটে নিশ্চয় আমাদের নাম বলে দিয়েছে?’
‘তাই মনে হয়। ওর আব্বা সবার বাসায় জানিয়েছে। তবু ভালো এখনও শাহী এলান দেয়নি। তাহলে সবাই জেনে যেত, আর পরিস্থিতি আরও খারাপ হতো। যদি অন্য কেউ ইসহাকের আব্বাকে বলে দিয়ে থাকে তবে তাকে শায়েস্তা করতে হবে।’
হাবলু কঠিন স্বরে বলল, ‘এমন ছ্যাঁচা দেব যে সারাজীবনেও এমন ভুল হবে না। আগে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে নিক। বাবুর কী হয়েছে?’
‘ভালোই আছে হয়ত।’
‘গতরাতে তোকে অনেক খুঁজেছি। আচ্ছা, এই সুযোগ কি হেলায় ছেড়ে দেওয়া যায়?’
‘কী করবি?’ জিজ্ঞেস করল হাবলু।
‘তোকে খুঁজে না পেয়ে আমি একাই গিয়েছিলাম বড়বাড়িতে।’
হাবলু কথার মাঝে আত্মপক্ষ সমর্থনের মত বলল, ‘খেলতে তো এলি না। আমিও তোকে খুঁজেছি। সন্ধ্যার পর বাসায় গিয়েছি, গিয়েই তো শুনি মহা হুলস্থূল। কে যেন বাসায় খবর দিয়েছে।’
‘সে যাই হোক, কাল গিয়ে দেখি তিন জন পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে আলাপ করছে। যে সব ক্লু পেয়েছি তাতে করে এদের ধরতে পারলেই আমরা একধাপ এগিয়ে যাব। যদি একবার শুধু সফল হতে পারি তাহলে দেখবি পরবর্তীতে আর এতো সমস্যা হবে না। তখন আমাদের প্রাইভেট ডিটেকটিভ হিসাবে নাম ছড়িয়ে পড়বে। পুলিশের সাথে আমাদের ভালো যোগাযোগ থাকবে। আমরা চারজন মিলে একটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ সেন্টার খুলে বসব। রাখ না তোর মতিন আর ফতিন। স্যারেরা আমাদের কী রকম দাম দেবে ভাবতেই পারবি না। আমি যখন এই স্বপ্ন দেখি তখন উত্তেজনায় আমার সারা শরীর শিহরিত হয়ে ওঠে। কিন্তু ইসহাক যে ফাদে আটকে পড়েছে সে কবে যে ছাড়া পাবে, বাবুরও ওদিকে কোনো পাত্তা নেই।’
‘সব কাজের শুরুতে একটু সমস্যা থাকবে। যেমন ধর মোটর সাইকেল স্টার্ট নেওয়ার সময় একটু বেশি খাটনি লাগে না? পরে কি আর কষ্ট করতে হয়? একবার স্টার্ট নিয়ে নিলে তখন অল্প পরিশ্রমেই অনেক দূর যায়। তেমনি এটা হচ্ছে আমাদের স্টার্ট দেওয়ার সময়। এখন একটু কষ্ট করতে হবে, ধৈর্য দরতে হবে। যখন সফল হয়ে যাব তখর আর এত কষ্ট করতে হবে না। তখন দেখবি কত জনে কেস নিয়ে আসবে। আমাদের পর্যায়ক্রমে পাহারা দেয়া প্রয়োজন। শোন্, কাল সকালে তোর দায়িত্ব হবে বড়বাড়ির আশেপাশে থাকা, যা কিছু ঘটে রিপোর্ট করা।’


ক’টা দিন খারাপই কাটল। খেলাধুলা বন্ধ, পড়াশুনাও বন্ধ। অন্য সময় হলে ভালোই লাগত। স্কুলে যাওয়ার ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্য। তবে এখন কেন যেন ভালো লাগল না। হয়ত মাথার উপর খড়গহস্ত ঝুলে আছে বলে।
এক দুপুরে কিচেনে বসে খাওয়া-দাওয়া করছিল হানীফ। ওর আম্মা রান্নাবান্না খাওয়া-দাওয়া শেষে বেডরুমে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। বিশ্রাম নিতে নিতে ঘুমিয়ে পড়বেন।
ভাতের প্লেট থেকে মুখ তুলে তাকালে চমকে উঠল হানীফ। মা বেডরুম থেকে উঠে আসছেন। ভাতের প্লেট রেখে যে টেবিলের নিচে কিংবা দরজার আড়ালে লুকাবে সে সুযোগ নেই। দরজার কাছাকাছি এসে দেখে ফেলেছেন। মাথা নিচু করে ফেলল সে।
ওর আম্মা রূঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘এখানে কী করছিস?’
হানীফের মনে হল ওর আম্মা বোধ হয় ওকে চিনতে পারছেন না। এমন মমতাহীন স্বরে জিজ্ঞেস করছেন। হানীফ কথা বলছিল না।
ওর আম্মা আবার বললেন, ‘এখানে খেতে বসেছিস কেন? চুরি-চামারি করে খাবার মেলে না? যা চুরি কর গিয়ে।’
হানীফ অনুতাপ ভরা কণ্ঠে বলল, ‘আর এমন হবে না।’
কথা শুনে ওর আম্মা মোটেও ঠাণ্ডা হলেন না। ঝাঁঝালো স্বরে বললেন, ‘তা তো সব সময়ই বলিস। তারপর মনে থাকে না। ক’টা ডাব খেতে ইচ্ছে করে বললে তোর আব্বা বাজার থেকে এনে দেবে না? লোকে ডেকে নালিশ করে।’
হানীফ কথা বলছিল না। ওর মন গভীর অপরাধবোধে ভরে গেল। মনে হল সত্যিই সে ভুল করেছে। আর কখনো এমন করবে না, যাতে তার আব্বার অন্যের নালিশ শুনতে হয়। খুব পড়াশুনা করবে। কেউ যেন বলতে না পারে সে অভদ্র, খারাপ।
ওর আম্মা কিচেন থেকে পানির জগ নিয়ে চলে গেলেন। অন্য সময় হলে কানে ধরে শপথ করাতেন। কখনো হালকা মারধর করতেন। নতুন সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে আনতেন। আজ সেসবের কিছুই করলেন না।
হানীফ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নিজে নিজে এসে পড়তে বসল। প্রথমে পড়তে ইচ্ছে হলেও বই খুলে আর পড়তে ইচ্ছে হল না। খানিক আগের আবেগ আর রইল না। কিছুক্ষণ খাতায় আঁকিবুঁকি করল, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। বিছানায় শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবল। একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।
বাবুর সাথে কয়েকদিন দেখা হয়নি। মাঠে আসেনি। স্কুলে গিয়েছে কি না জানা নেই। ওরা স্কুলে যেতে পারেনি। খেলা শুরু হওয়ার আগে হানীফ প্র্যাকটিস করছিল। বল মাটিতে না ফেলে দুই পা দিয়ে কিক করে কতক্ষণ বল শূন্যে রাখতে পারে সেই প্র্যাকটিস। হাবলু এসে বলল, ‘একটা খারাপ খবর আছে।’
‘কী খারাপ খবর?’ প্র্যাকটিস না থামিয়েই প্রশ্ন করল হানীফ।
‘বাবু আর আমাদের সাথে থাকবে না।’
‘কেন? কী হয়েছে?’
‘নতুন বন্ধু জুটেছে, মতিন। আমরা নাকি ওকে জোর করে বড়বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম। ওর আব্বা-আম্মার সাথে তাই বলেছে।’
‘মার থেকে বাঁচার ফন্দি।’
‘তাই বলে গাদ্দারি করে? ওকি কচি খোকা যে ওকে জোর করে বড়বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম? সব দোষ আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে ভালো ছেলের সাথে মিশে ভালো ছেলে হয়ে গেল। আর আমরা মার খেলাম, চোর ছ্যাচ্চর বদমায়েশ হয়ে রইলাম। কী দারুণ ব্যাপার তাই না?’
একে একে মাঠে ছেলেদের উপস্থিতি বাড়তে লাগল। দু’গ্র“পে ভাগ হয়ে খেলা শুরু হলো।
খেলা শেষে মাঠের দক্ষিণ পার্শ্বে গোলপোস্টের কাছে ঘাসের উপর বসে ছিল হানীফ। খেলাশেষ হলেই ওদের মেলা শেষ হয় না। গরমে ঘামে ভিজে যায় শরীর। একটু বিশ্রাম নেয়, গল্পসল্প চলে। মসজিদের ওজুখানায় গিয়ে হাতমুখ ধোয়। টুংকো  ভাইয়ের দোকান থেকে আইসক্রিম খেতে খেতে চলে আরও গল্প। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হলে বাসায় ফেরে।
হানীফ তাকিয়ে ছিল বাবুর দিকে। দেখল অন্যদের সাথে বাবু চলে যাচ্ছে রাস্তার দিকে। হানীফ ডাকল, ‘বাবু!’
ডাক শুনে গেঞ্জি কাঁধে ফেলে বাবু কাছে এলো।
হানীফ বলল, ‘বস।’
বাবু বসল না। খেলার পর সেও পরিশ্রান্ত। হাঁফাচ্ছিল। বলল, ‘কী বলবি বল, বাসায় যেতে হবে। সন্ধ্যার পর বাসার বাইরে থাকা যাবে না, আব্বার কড়া নির্দেশ।’
‘তা না হয় যাবি, একটু বস আলাপ করি। বড়বাড়ির রহস্যটা উদ্ঘাটনে কী করা যায়? আমরা অনেক চেষ্টা করেছি। আশা করি সফল হবই।’
‘রহস্য উদ্ঘাটনের মধ্যে থাকতে পারব না। এখন রাতে বেরুনো যাবে না।’
‘রাতে না হয় না গেলি, দিনের বেলায়ই তুই কাজ করবি। রাতে আমরা কাজ করব। পাহারার জন্য দিনেও কাজ করার প্রয়োজন পড়বে।’
‘দিনেও থাকতে পারব না।’
‘কেন? কী হয়েছে বলবি তো। আমাদের উপর রাগ করে থাকলে বল আমরা মীমাংসা করি।’
‘রাগের ব্যাপার না। পরীক্ষা এসে গেছে, পড়াশুনা করতে হবে। আব্বা কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন তোদের সাথে যেন না মিশি।’
‘না মিশলে কথাও বলা যাবে না? কথা বললেও পচে যাবি?’
রাস্তার দিকে তাকিয়ে অস্থিরভাবে বাবু বলল, ‘পরে বলব। এখন চলিরে।’ চলে গেল।
হানীফ নির্বাক তাকিয়ে রইল। হাবলুও কোনো কথা বলল না।
বাবু মাঠ ছেড়ে রাস্তায় গিয়ে উঠেছিল মতিনের সাথে। ওদিকে তাকিয়ে থেকে হাবলু বলল, ‘মতিনের সাথে দহরম মহরম চলছে।’
বিষণœতার মাঝেও হানীফ স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল। সান্ত্বনার বাণী শোনানোর মত করে বলল, ‘যে বাঁশি ভেঙ্গে যেতে চায় তাকে ভেঙ্গে যেতে দেওয়া উচিত। যে আমাদের ছেড়ে থাকতে পারে তার জন্য আমরা কাঁদব কেন? তারচেয়ে চল বড়বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। দিখে আসি পরিস্থিতি কী।’
‘ঘরে ঢোকা মোটেও সহজ হবে না। এনেসথেটিকস কিছু যোগাড় করতে পেরেছিস?’
‘আমি সব ব্যবস্থা করছি। তুই প্রস্তুতি নে।’
হানীফ থেমে গেল। হাবলুও কোনো কথা বলল না।
মুখে যাই বলুক বাবুর বিষয়টা তাকে খুব ব্যথিত করেছে। সেই ক্লাস থ্রি থেকে বন্ধুত্ব। কত ঘটনা জড়িয়ে আছে এক সাথে। নদীর তীরে ঘোরাঘুরি, চিকচিকে বালিতে খেলা করা। নদীর পাড়ে উঁচু একটা ঢিবি ছিল, সেই জায়গায় উঠে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ত। চারজন সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ত, শহরের এমন কোন প্রান্ত নেই যেখানে ওরা ঘুরে বেড়ায়নি। ঘুড়ি উড়ানো, মাছ ধরা, লাটিম ঘুরানো সব দৃশ্য যেন চোখের সামনে ভাসছিল। ক্লাসে সব সময় এক সাথে বসত তা না। তবে কোনো বিষয় নিয়ে একজন কিছু বললে বাকিরাও তাই সমর্থন করত।খেলার মাঠে যে সব সময় চারজন একপক্ষে খেলত তা নয়।হয়ত চারজন দুই পক্ষে। এরপরও একটা হৃদ্যতা ছিল, গভীর সমঝোতা আর ঐক্য ছিল। অক্টোপাসকে দেখে যেমন তিমিও ভয় পায় তেমনি এ গ্র“পকে দেখে বড় গ্র“পগুলোও ভয় পেত, সহজে ঘাটাতে আসত না। সেই দলের একজন সদস্য আজ বিদায় নিল।
সূর্য তখন লাল রঙ ধারণ করেছে। সন্ধ্যার সেই লালাভ আভার দিকে তাকিয়ে হানীফের মনে হলো এই রকম কত সন্ধ্যা কাটিয়েছে চার জন!
পাঁচ.
টিফিন পিরিয়ডে স্কুলের সামনে টুংকু মিয়ার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাচ্ছিল হানীফ। রিকসা, সাইকেল দেখে রাস্তা পেরিয়ে এলো জনি, অলি।
জনি এসে বলল, ‘কেন ডেকেছেন হানীফ ভাই?’
হানীফ আরও কারও আসার অপেক্ষা করছিল। দোকানিকে বলল, ‘টুংকু ভাই, আরও দু’টো আইসক্রিম দিন তো।’
দোকানি দু’টো আইসক্রিম দিলে ওদের দিকে  ইশারা করে বলল, ‘নে, আইসক্রিম খা।’
আইসক্রিম হাতে নিয়ে জনি আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কেন ডেকেছেন হানীফ ভাই?’
হানীফ বলল, ‘জুয়েল, মিশু ওরা কোথায়?’
জনি পেছন ফিরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখল স্কুল গেইট দিয়ে বের হচ্ছে দু’জন। বলল, ‘ওই তো ওরা আসছে।’
হানীফ বলল, ‘সবাই আসুক। একসাথে সবাইকে বলতে হবে।’
জুয়েল, মিশু এলো। জুয়েল হাঁফাচ্ছিল যেন খুব দৌড়ঝাপ দিয়ে এসেছে। ও এমনিতেই একটু মোটা, অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠে। বলল, ‘খুব তো আইসক্রিম খাওয়া হচ্ছে। আমাকে একটা আইসক্রিম দিন তো টুংকু ভাই।’
হানীফ উল্লসিত কণ্ঠে বলল, ‘এই তো ভালো ছেলে, কেমন নিঃসঙ্কোচে আইসক্রিম চেয়ে নিচ্ছে। টুংকু ভাই, আরো দু’টো আইসক্রিম।’
আইসক্রিম হাতে নেয়ার পর জুয়েল পকেট থেকে টাকা বের করছিল। হানীফ বলল, ‘রাখ টাকা আমি দেব।’
জুয়েল হাতঘড়ি দেখে বলল, ‘টিফিন পিরিয়ড শেষ হয়ে যাবে। বলুন কী জন্যে ডেকেছেন।’
দোকানে অন্যান্য ছেলেরা ভীড় করছিল। সরে এলো হানীফ। বাকিদের ইশারা করল সরে আসতে। দোকানের পাশে কড়ই গাছের ছায়ায় এসে দাঁড়াল সবাই।
হানীফ তার ঐতিহাসিক বক্তব্য শুরু করল। বলল, ‘যে জন্যে ডেকেছিÑ দেখ, পড়াশুনাই সবকিছু না, পড়াশুনার বাইরে খেলাধুলার যেমন প্রয়োজন আছে, বিনোদনের প্রয়োজন আছে, অন্যদের সাথে মেশার একটা ব্যাপার আছে। ঠিক কি না বল।’
মতামত জানার জন্য সবার দিকে তাকাল। জনি শুধু বলল, ‘জ্বী।’
বাকিরা তাকিয়ে রইল। কথা ঠিক বুঝতে পারেনি কিংবা এখনও মনোযোগ দিয়ে সারেনি। হানীফ সমর্থন আদায়ের জন্য আবার জুয়েল, মিশু, অলির দিকে তাকাল। বলল, ‘ঠিক কি না বল?’
জুয়েল আসল কথা শুনতে চাইছিল। সে অনিচ্ছুকভাবে বলল, ‘হু ঠিক।’
হানীফ আবার বলল, ‘মাঝে মাঝে পড়তে পড়তে একঘেয়েমি চলে আসে তখন পড়তে ভালো লাগে না, তাই না?’
আবার তাকাল সবার দিকে। ‘এজন্য মাঝে মাঝে একঘেয়েমি দূর করা চাই। একঘেয়েমি দূর করতে যে বিনোদনের ব্যবস্থা আছে তাতেও মাঝে মাঝে একঘেয়েমি চলে আসে। যেমন টিভি দেখা, কত সময় আর দেখা যায়? খেলা, কতক্ষণ খেলা যায়?’
অলি বলল, ‘কথা ঠিক। এখন আমার টিভি দেখতে খুব খারাপ লাগে। কার্টুন নেটওয়ার্কটাও ভালো লাগে না।’
‘এই তো তাহলে দেখ।’ হানীফ তার বক্তব্যের সমর্থন পেয়ে বলল, ‘এই জন্য বিনোদনেও বৈচিত্র্য আনা চাই। এই যেমন ধর আমরা কোথাও বেড়াতে গেলাম। মানে ভ্রমণ আরকি। শহর থেকে দূরে, শান্ত কোলাহলমুক্ত কোথাও। যেখানে সবুজের সমারোহ, গেলে হৃদয় প্রশান্ত হবে। সারাদিন ঘুরলাম, দেখলাম, ভালো লাগার কিছু অনুভূতি নিয়ে ফিরে এলাম। কেমন হয় বলতো?’
‘খুব ভালো হয়।’ জনি আবার বলল, ‘কোথায়  যাওয়া?’
‘একটা দর্শনীয় স্থান, প্রকৃতির কাছাকাছি কোথাও। যেখানে গেলে মনটা বিশাল আকাশ আর বিস্তৃত জলরাশি দেখে তৃপ্ত হবে। পানিহাটা বিলে গেলে কেমন হয়?’
অলি বলল, ‘ওটা তো অনেক দূর।’
‘দূর হলেই কি আমরা তো যাব বাসে। বাসে যেতে কতক্ষণ লাগবে? এক ছুটির দিন রওয়ানা হব, সন্ধ্যায় ফিরে আসব। সারাদিন বিলে থাকব। নৌকায় করে ঘুরব। দূরবীন দিয়ে পাখি দেখব। ওখানে নাকি প্রচুর পাখি পাওয়া যায়।’ হানীফ আবার সবার দিকে তাকাল।
মিশু এতক্ষণ কথা বলেনি। এবার বলল, ‘পরীক্ষা তো সামনে।’
হানীফ পরীক্ষার ব্যাপারে গুরুত্ব দিল না। ‘পরীক্ষা তো আমারও। সবারই পরীক্ষা। একদিন বেরিয়ে এসে পূর্ণোদ্যমে লেগে যাব পড়াশুনায়।’
জুয়েল মুখ গম্ভীর করে ছিল। এসব পরিকল্পনা যে মোটেও ভালো লাগছিল না তা বুঝা যাচ্ছিল। এবার মুখে  বলল, ‘আম্মা যেতে দিবে না।’
‘তোর আম্মাকে বলতে যাবি কেন?’
‘না বলে যাব?’
‘সমস্যা কোথায়? আব্বা-আম্মা সব সময় কড়া শাসনের মধ্যে রাখতে চায়। এটা করো না, ওটা করো নাÑ সব সময় নিষেধবাণী। ভালো কাজ করবি, না মন্দ কাজ করবি সেটা বিবেচ্য বিষয় না, তুই কিছু করতে পারবি না সেটাই বড় কথা। সব কাজে নিষেধ করে খবরদারি না করলে যেন তাদের গুরুজন ভাবটা থাকে না।’
অলি বলল, ‘ঠিক কথা। আমিও তাই দেখেছি। আমি খেলতে যাব তাতে মানা। আম্মু বলেন এখন বাসার বাইরে যাওয়া যাবে না, ঘুমাও। কিশোর ম্যাগাজিন পড়তে নিলে তাতে বাঁধা। বলেন, এসব কী পড়ছ? ক্লাসের পড়া পড়। আইসক্রিম খেতে নিলে বলেন, ঠাণ্ডা লাগবে। সব কাজে বাধা।’
হানীফ আবার বলল, ‘তাহলে আর দোদুল্যমানতা কেন? এমন কত হয় না যে, সকালবেলা খেলতে বের হোস, ফিরিস দুপুরে। ওইদিন না হয় তাই করলি একদিন। দুপুরের পরিবর্তে সন্ধ্যা হলো।’
জুয়েলের স্পষ্টত অনীহা। মিশু তাকাচ্ছিল জুয়েলের দিকে। জনি কিছুটা দ্বিধান্বিত। অলি শুধুমাত্র রাজি হলো। বলল, ‘আমি রাজী।’
হানীফ বাকিদের উদ্দেশ্যে বলল, ‘আরে থাকলি তো খাঁচায় বন্দি পাখি হয়ে। বাসা টু স্কুল, স্কুল টু বাসা এই দেখলি। মুক্ত আকাশটা একটু ঘুরে দেখ। কত কিছুই আছে দেখার।’
বাকিদের দ্বিধান্বিত ভাব তাতে মোটেও কাটল না।
হানীফ তার সাহস যোগানোর চেষ্টা চালিয়ে গেল। বলল, ‘বীরভোগ্য বসুন্ধরা। উপভোগের জন্য চাই সাহস, বীরত্ব। এতেই ভয় পাচ্ছিস? ভেবেছিলাম তোদের আরও কিছু অ্যাডভেঞ্চারের খবর দেব। সে সব অ্যাডভেঞ্চারে যেতে হলে তো আরও সাহস দরকার। নির্ভীক হতে হবে। তোদের খবর দেব কিভাবে?’
‘কী সেটা?’ অলি প্রশ্ন করল।
হানীফ উৎসাহ পেল। পুরনোরা ছেড়ে গেছে তো কী হয়েছে? এই তো সাগরেদ পেয়ে যাচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে এরা ছোট, সবে মাত্র ক্লাস ফোরে-সিক্সে পড়ে। একেবারে সব না বলে কিছুটা ইঙ্গিত দিল। বলল, ‘একটা ডিটেকটিভ কেস হাতে পেয়েছি কিন্তু রহস্য উদ্ঘাটন করা দুরূহ ব্যাপার।’
ডিটেকটিভ কেস শুনে অলি উৎসাহী হয়ে উঠল। বলল, ‘আমার ইচ্ছা আমি বড় হয়ে ডিটেকটিভ হব। প্রফেশনাল না অকেশনাল। কেসটা কী?’
‘আছে। সমস্যা হচ্ছে তোরা পারবি কি না? ব্যাপারটা যত রোমাঞ্চকর মনে করছিস ততটা রোমাঞ্চকর না, ভীতিপ্রদ। ধরা পড়ে গেলে সব শেষ। গুম করে ফেলবে। জানিস তো, এসবে কত বুদ্ধি, কৌশল আর সাহসের ব্যাপার থাকে।’
অলি বলল, ‘ভয় আছে উত্তেজনা আছে এটাই তো চাই। কোথায় এটা?’
হানীফ বলল, ‘সব বলব। আগে ডিটেকটিভ ইন্সট্রুমেন্টগুলো যোগাড় করে নেই।’
অলি খুব উৎসাহ বোধ করছিল। চাইছিল হানীফ শীঘ্রই যেন অপারেশন শুরু করে দেয়। সে হানীফকে উৎসাহ দিয়ে বলল, ‘আমাদের বাসায় স্ক্রু ড্রাইভার, প্লায়ার্স, চুম্বক আছে।’
‘শুধু এগুলো থাকলেই হবে না, এনেসথেটিকস লাগবে, মেল্টিং কেমিক্যালস লাগবে।’
অলি একটু চিন্তায় পড়ে গেল। বলল, ‘তাহলে?’
‘চিন্তার কিছু নেই। আমি যোগাড় করার চেষ্টা করছি। আগে পানিহাটা বিলে ট্যুরটা সেরে আসি।’
জুয়েল স্পষ্টই না করে দিল। বলল, ‘আমি যাব না।’ এর মধ্যে টিফিন আওয়ার শেষের ঘণ্টা বাজল। বলল, ‘ঘণ্টা পড়ে গেছে, আমি যাই।’
জুয়েল চলে গেল। জুয়েলের দেখাদেখি মিশুও ওর পেছন পেছন চলল। বলল, ‘আমিও আসি।’
অলি বলল, ‘জুয়েল ভাইয়া ফাস্ট বয় তো, অনেক পড়াশুনা করে। সে আসবে না আমি আগেই জানতাম। ওকে বলাই ঠিক হয়নি।’
বাকিরা চলে গেলে হানীফও স্কুলের ভেতরে চলল।
ছয়.
রাতে বাসায় কার যেন আসার শব্দ পেল হানীফ। পরে কথাবার্তা শুনে বুঝল নওশাদ। হয়ত কোনো নতুন খবর নিয়ে এসেছে। ওর আম্মা টেবিলক্লথে নকশা এঁকে দেয়ার জন্য কাপড় পাঠিয়েছে। কিংবা অন্য কিছু। কথা শেষে ডাইনিং রুমে বসে খাবার খাচ্ছে সেটাও টের পেল। নিশ্চয় বিকেলের নাস্তার জন্য বানানো চটপটি খাচ্ছে। এক বাটি খাওয়ার পর ওর আম্মা বলবেন, ‘আর একটু নিবি নওশাদ?’
নওশাদ বলবে, ‘দিন চাচী, চটপটিটা খুব মজা হয়েছে। রাস্তায় যেসব চটপটি বিক্রি করে সেগুলো তো যাচ্ছে তাই!’
ওর আম্মা খুশি হয়ে আরও খানিকটা চটপটি দেবেন। এ বাসায় এলে ওর ভারী আপ্যায়ন বরাবরই দেখে এসেছে। ওর আম্মা নওশাদের সাথে যতটুকু আদরের সাথে কথা বলেন ইদানিং তার সাথে ততটুকু আদরের সাথে কথা বলেন না।
নওশাদ কথা শেষ করে চলে গেল না। হানীফের রুমে এলো। হানীফ এতক্ষণ আনমনা হয়ে বসে ছিল। নওশাদ আসার শব্দ পেয়ে পড়ার ভান করে বসে রইল, যাতে করে ডিস্টার্ব না করে।
নওশাদ রুমে ঢুকে বলল, ‘হানীফ পড়ছিস? এবার কিন্তু সব প্রশ্ন ক্রিটিক্যাল হবে। বুঝে বুঝে পড়তে হবে।’ টেবিল থেকে বই নিয়ে খাটের উপর বসে বলল, ‘এই চ্যাপ্টারটা পড়েছিস?’
হানীফ চাচ্ছিল না সে এসে বসুক। কথা বলুক। তাই নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলল, ‘তথ্য দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।’ কথার স্বরে বিরক্তি স্পষ্ট। আসলেই সে বিরক্ত। কেননা ও এখন যা বলবে তা ভালো লাগবে না। ভালো ছেলেদের কথাবার্তা এখন বিরক্তিকর মনে হয়।
‘আলমাস মনে হচ্ছে এবারও ফার্স্ট হবে। পরপর তিনবার ফার্স্ট হলো। স্কলারশিপেও ফার্স্ট হলো। আসলেই সে একটা ডায়মন্ড। আলমাস মানে জানিস তো? ডায়মন্ড।’
এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই হানীফের। আলমাস মানে ডায়মন্ড হলেই কী আর গোল্ড হলেই কী? সে আছে তার চিন্তায়। সব প্ল্যান-প্রোগ্রাম মাঠে মারা যাচ্ছে। পানিহাটা বিলে যাওয়া হবে না হয়ত। রহস্য উদ্ঘাটন করা জরুরি।
‘কনক মানে জানিস? গোল্ড।’
হানীফ ধৈর্য ধরে মেজাজ ঠাণ্ডা রেখে বলল, ‘কনক মানে জেনে কী দরকার?’
‘নতুন শিখলাম তো তাই বলছি। খুবই ভালো লাগছে নতুন নতুন শব্দ শিখতে।’
‘তা আর কী কী শব্দ শিখেছিস?’
‘এই যেমন ধর রমনা। রমনা মানে কী জানিস? এটা একটা হিন্দি শব্দ। যার মানে হচ্ছে পার্ক। রমনা বললে আর পার্ক বলার দরকার নেই। খুব ইন্টেরেস্টিং না?’
‘খুব ইন্টেরেস্টিং। আরও নতুন নতুন শব্দ শিখগে।’
হানীফের কথায় ওর বিদায় হওয়ার আভাস স্পষ্ট। তবে নওশাদ উঠছিল না, বসেছিল। হানীফ চুপ করে রইল। নওশাদ যে কিছু বলবে এটা বেশ ভালভাবেই বুঝতে পারছিল। বলল, ‘খবর জানিস?’
‘কী খবর?’
‘এক নম্বর রোডের প্রথম বাসাটা যেটা এখন একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিস, ওই অফিসের দারোয়ানকে কে যেন রুমে আটকে রেখেছিল। বেচারা ভেউ ভেউ করে কাঁদছে।’
‘রুমে আটকে রাখাতেই কাঁদছে?’
‘হু। এর আগে একদিন টয়লেটে তালা মেরে রেখেছিল। টয়লেট থেকে বেরুতে পারছিল না। অনেক ডাকাডাকিতে কে যেন শুনতে পেয়েছিল। গিয়ে তালা ভেঙে উদ্ধার করেছিল। তার ডাক অন্য কেউ শুনতে পেয়েছিল নইলে কী হতো ভাবতে পারিস?’
হানীফ অবাক হচ্ছিল। নওশাদ আবার বলল, ‘আর একদিন কে যেন তার রুমে ব্যাগভর্তি তেলাপোকা ছেড়ে দিয়েছিল। বেচারা মধ্যরাতে শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে দেখে সারা ঘরভর্তি তেলাপোকা উড়াউড়ি করছে। ঘুমের ঘোরে চোখ মেলে দেখে কী ভাবতে কী ভেবেছিল ভয়ে এক চিৎকার দিয়ে সে রুমের বাইরে পড়েছিল বেহুঁশ হতে শুধু বাকি ছিল। এমন দুষ্টুমি কে করেছে?’
নওশাদকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে হানীফ বলল, ‘আমি কী জানি?’
‘তুই করিসনি?’
‘না।’
‘ঠিক আছে। জানার জন্য জিজ্ঞেস করলাম। দারোয়ান এখন ভাবছে চাকরি ছেড়ে চলে যাবে। এমন উৎপাত করলে থাকবে কিভাবে? আরেকদিন যে তার জানের উপর হুমকি আসবে না তার কী নিশ্চয়তা আছে? এমন কাজ তুই করিস না।’
‘কেউ বলেছে আমি করেছি?’
‘না।’
‘তাহলে আমকে জিজ্ঞেস করছিস কেন?’
‘এমনি।’
এলাকায় চুরি-ডাকাতি হলে দাগী আসামীদেরকেই তো প্রথমে ধরা হয়। হানীফ বুঝল ব্যাপারটা। কোথায় কোন্ দারোয়ান টয়লেটে আটকে রইল, ভেউ ভেউ করে কাঁদল, তার কারণ সে জানবে নাকি? তার কী দায় ঠেকেছে এসব জানার? অথচ ডানে-বামে কোনােদিকে না তাকিয়ে চলে এসেছে জিজ্ঞেস করতে কেন সে করেছে? হঠাৎ করে মনে পড়ল রাফিদ তো একদিন ব্যাগভর্তি তেলাপোকা নিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল যাচ্ছে দারোয়ানকে শায়েস্তা করতে। এ নিশ্চয় সেই দারোয়ান। সচকিত হয়ে উঠল সে। তবে প্রকাশ করল না। ওর আচরণের কারণেই এ তথ্য নওশাদকে জানানোর কোনো প্রয়োজন বোধ করল না, ইচ্ছেই করল না।
নওশাদ উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘কিছু মনে করিস না। আমাদের কাজ যেন একটা দরিদ্র মানুষকে তার জীবিকা উপার্জনের পথে বাঁধা সৃষ্টি না করে। একটা পরিবারকে বিপদের সম্মুখীন না করে।’
সাত.
স্কুলে বসেও ভাবছিল কী করা যায়? ক্লাস শুরুর আগে সবাই যখন রুমের বাইরে গল্প-গুজব করছে তখন দেখল রাফিদ বেঞ্চে বসে আছে। ওকে কেমন অসুস্থ অসুস্থ মনে হলো। ঠিক ব্যথার কারণে নড়তে পারছে না এমন একটা ভাব।
হানীফ ওর সিট ছেড়ে রাফিদের কাছে গিয়ে বলল, ‘রাফিদ অসুস্থ নাকি?’
রাফিদ অনেকটা কাতর কণ্ঠে বলল, ‘না।’
হানীফের বিশ্বাস হল না। অসুস্থ না হলে কেউ এমন করে বসে থাকে? ওকে ভালো করে দেখে বলল, ‘দেখে তো মনে হচ্ছে খুব কষ্ট হচ্ছে।’
রাফিদ বেঞ্চে মুখ রেখে বলল, ‘হু, সারা শরীরে ব্যথা।’
হানীফ ওর সামনের বেঞ্চে বসল আলাপ জমানোর জন্য। বলল, ‘সারা শরীরে ব্যথা কেন? কী হয়েছে?’
‘পিতাজী ধোলাই দিয়েছে।’
‘কেন?’
‘ক্যাটক্যাট মহিলা কোমর ভেঙে ফেলেছে সেজন্য আমাকে মারল।’
‘ক্যাটক্যাট মহিলা কোমর ভেঙেছে তো তোর কী হয়েছে? তোকে মারবে কেন? কী করেছিলি?’
‘কিছুই না।’
‘কিছু না করা সত্ত্বেও তোকে মারল?’
‘হু, আমি শুধু ক্যাটক্যাট মহিলার রুমের সামনে সয়াবিন তেল ঢেলে রেখে এসেছিলাম আর কিছু করিনি ।’
হানীফ আঁতকে উঠল। বলল, ‘বলিস কী? তারপর?’
‘তারপর আর কী? সকালবেলা রুম থেকে বেরুনোর সময় পা পিছলে পড়ে কোমর ভেঙে ফেলেছে।’
‘এক মহিলার কোমর ভেঙে ফেলেছিস আর বলছিস কিছু করিসনি?’
‘কেউ দেখেছে আমি এ কাজ করেছি? সাক্ষী-প্রমাণ ছাড়া কাউকে শাস্তি দেয়া যায়? বাংলাদেশ দণ্ডবিধিতে আছে?’
হানীফ মাথা নেড়ে বলল, ‘নেই। তোর আব্বা বাংলাদেশ দণ্ডবিধি লঙ্ঘন করেছে। কিন্তু ঘটনা কী ছিল বলত।’
‘ঘটনা কিছুই না। আমাদের পাশের দোতলা বাসার ক্যাটক্যাট মহিলার বাগান থেকে কে যেন গন্ধরাজ ফুল চুরি করে নিয়ে গেছে। উনি ডানে বামে না তাকিয়ে এই নিয়ে আব্বার কাছে নালিশ নিয়ে এসেছিল। আমি বললাম যে আমি ছিড়িনি। তবু বিশ্বাস করে না। সেই কবে একদিন আমি তার গাছ থেকে একটা গোলাপ ফুল ছিড়েছিলাম সেই জের ধরে আমাকে গালাগালি করে। তার বাসায় কেউ কিছু একটা করলে তার নালিশ দেয় আমার নামে। আর কত সহ্য করা যায়? রাতে উনার রুমের সামনে সয়াবিন তেল ঢেলে রেখে এসেছিলাম। তারপর তো এই ঘটনা।’
‘মহিলার এখন কী অবস্থা?’
‘হাসপাতালে আছেন। তিন মাস বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে।’
‘একটা বিরাট অন্যায় করেছিস ।’
‘অন্যায় না। এই মহিলার জন্য ক্রিকেট খেলা বন্ধ। তার বাসার বাউন্ডারি লাগোয়া ছোট্ট একটু জায়গায় আমরা ক্রিকেট খেলি। বল উনার বাসার ভেতর গেলে ক্যাট ক্যাট করে। বল দিতে চায় না। পরে বাদই দিলাম। ছেলেপেলেরা দৌড়াদৌড়ি করে খেলে। চিৎকার চেচামেচি করে তাও বন্ধ। তার ডিস্টার্ব হয়।’
‘আচ্ছা ওই দারোয়ানকে টয়লেটে তালা মেরে রেখেছিলি তুই?’
‘হ্যাঁ। ব্যাটা বহুত ফাজিল, বদমায়েশ। আমাকে একদিন অপমান করেছিল, তার শোধ নিয়েছি।’
‘কী অপমান করেছিল?’
‘একদিন বিকেল বেলা। মানাজির ভাই গেছেন পাশের বাসায় তার স্যারের কাছে। আমাকে বললেন সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। আমি সাইকেল নিয়ে ওই অফিসের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। দারোয়ান এসে বলে, ওই সইড়া খাড়াও। আমি গেট থেকে সরে এসে মানাজির ভাইয়ের স্যারের বাসার গেটের সামনে এসে সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে আছি। এর মাঝে দেখলাম কয়েকজন লোক ওই অফিসে ঢুকছে। লোকগুলো যাওয়ার পর দারোয়ান এসে বলে, এই ভদ্রতা শিখছ? দেখলা যে ভদ্রলোকগুলান আইল আর তুমি সাইকেলের উপরে ঠ্যাং তুইল্যা খাড়াইলা। আমি বললাম আমি তো গেট ছেড়ে এসেই দাঁড়িয়েছি। এবার দারোয়ান যা ইচ্ছা তাই বলল, জানস এরা কত বড় শিক্ষিত, কত মান্যিগণ্যি করে সবাই আর তুই কোনহানকার ছ্যাড়া বেয়াদবি করছ? আমি বললাম আপনার বস আপনি মান্যগণ্য করতে পারেন। আমার কী? আর আমি বেয়াদবির বা কী করলাম? দারোয়ান চড়া গলায় যা না তাই বলল। শেষে আমাকে মারতে এলো। আমার মেজাজ গেল খারাপ হয়ে। বদমায়েশ ব্যাটাকে শায়েস্তা করার পথ খুঁজতে লাগলাম। এখন নাকি ব্যাটা হাউমাউ করে কাঁদে। একদিন মুখে টেপ লাগিয়ে রুমে বেঁধে রেখে আসব। যাতে চিৎকার করতে না পারে।’
‘ওই দিন যে তেলাপোকা নিয়ে গেলি ওটা কি এই দারোয়ানের রুমে ছেড়ে দিয়ে এসেছিলি?’
‘হু।’
‘তোর তো মেলা বুদ্ধি। কিন্তু কথা হলো কি, এখন আমার পরিস্থিতি হলো কোথাও একটা ঝামেলা হলে সবাই আমাকে সন্দেহ করে। কী কপাল দেখেছিস? তুই দারোয়ানকে রুমে আটকে রেখেছিস আর অন্যরা সন্দেহ করছে আমি করেছি কি না।’
‘যারা সন্দেহ করে তাদের বল যে তুমি করনি।’
‘বললে কী হবে? এখন বিশ্বাসযোগ্যতাও হারিয়েছি।’ হানীফ চিন্তা করে বলল, ‘তোর তো ভালো বুদ্ধি। এক কাজ কর না, একটা কেস হাতে পেয়েছি। কিন্তু লোকবলের অভাবে এগুতে পারছি না। তুই চলে আয় না কেসটার সুরাহা করি। কিছু ইন্সট্রুমেন্টের অভাব।’
‘কিসের কেস?’
‘আছে, ধীরে ধীরে বলব। তার আগে বল, লিকুইড মরফিন কোথায় পাওয়া যায়?’
‘ফার্মেসিতে পেতে পারিস।’
‘কেনা যাবে?’
‘এসব ওষুধ রেজিস্টার্ড ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি করে না।’
‘এই তো আরেক সমস্যা হলো। তাহলে ক্লোরোফরম পাওয়া যাবে?’
‘এসব তোকে দেবে না মনে হয়। তোর কী দরকার?’
‘একটা ডিটেকটিভ কেস হাতে পেয়েছি কিন্তু খালি হাতে এগুনো সহজ হবে না।’
‘ডিটেকটিভ কেসে গিয়ে খুব একটা সুবিধা করতে পারবি না। বিষয়গুলো খুব সহজ না।’
‘সহজ না, কঠিনও তো না।’
এরপর দিন আর রাফিদকে স্কুলে দেখা গেল না। খুব নাকি জ্বর উঠেছে। স্কুলে যাওয়া বন্ধ।
আট.
মস্কিটো ¯েপ্রর সাথে বোতলে বিষাক্ত ঝাঁঝালো কীটনাশক ভরেছে। এটা ছিটালে লিকুইড মরফিনের মতো নিঃশব্দে ঘুমে ঢলে পড়বে না বরং চিল্লাচিল্লি করে হৈ চৈ বাঁধিয়ে ফেলবে যে কেউ। সুবিধা এটুকু যে চোখে লাগলে চোখ এতো জ্বালাপোড়া করবে যে কিছুই দেখতে পারবে না। সেই সুযোগে হাত পা বেঁধে ফেলে রাখতে হবে। হাত পা বাঁধার জন্য দড়ি, চিল্লাচিল্লি যেন না করতে পারে সে জন্য মুখে গুজার কাপড়, স্কচ টেপ যোগাড় করেছে।
হাবলুদের বাসার কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। হাবলুর আসার কথা ছিল রিপোর্ট করতে। কোনো পাত্তা নেই দেখে খোঁজ নিতে পাঠিয়েছে জহিরকে। হাবলুদের বাসায় গেল না নিরাপত্তার খাতিরে। বলাই বাহুল্য ওকে সহ্য করতে পারে না কেউ। ওদের বাসার কারও সাথে দেখা হলে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠার সম্ভাবনা আছে।
জহির এসে খবর দিল হাবলু বাসায় নেই। কোথায় গেছে বলতে পারছে না। তবে এতটুকু খবর দিল যে আজ বাসায় কিছু প্রলয়ঙ্করী ঘটনা ঘটে গেছে। সেই যে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে এখনো ফেরেনি।
টুল কীটস সব রেডি করে রওয়ানা হবে আজ রাতে। যন্ত্রপাতি সব রেডি করে রেখেছে। এ সময় কোনো খবর না দিয়ে লা-পাত্তা হওয়া কি ঠিক হয়েছে? এদের কাণ্ডজ্ঞান কবে হবে?
জহিরকে বলল, ‘আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি। তুই রেডি হয়ে থাকবি।’ তবে বুঝল জহির কিছুটা ভয় পাচ্ছে। ভয়ের বিষয়ে কিছু বলল না। সাথে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জহিরদের বাসার কাছে এলে জহিরের আম্মা ছাদ থেকে ডাক দিলেন জহিরকে। উনি ছাদে শুকাতে দেওয়া কাপড়-চোপড় ঘরে নিচ্ছিলেন।
জহির ওর আম্মার ডাকের সুর শুনেই ত্রস্ত-ব্যস্ত হয়ে বাসার ভেতরে দৌড়ে গেল।
সময় পার হওয়ার পরও জহিরের আসার লক্ষণ দেখা গেল না। মিনি গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলে জহিরের আম্মার গলার আওয়াজ শুনল। জহিরকে বকাঝকা করছেন। জহির আত্মপক্ষ সমর্থন করে বাঁচার চেষ্টা করছিল। কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিল হানীফ। একটা কথা কানে এলে মন খারাপ হয়ে গেল। জহিরের আম্মা বললেন, ‘ইতরটা এই বেলায় এখানে এসে জুটেছে।’
বুঝল জহিরের এখন আর বেরুবার সম্ভাবনা নেই। নিঃশব্দেই গেট পেরিয়ে বেরিয়ে এলো।
থানা মোড়, কলেজ ক্যান্টিন, হাইস্কুলের পেছনে খোঁজ নিতে হবে।
নবরূপ গলি দিয়ে শর্টকাটে থানা মোড়ে যাওয়ার পথে পাশের দোতলা বাসার ছাদ থেকে শব্দ শুনে উপরের দিকে তাকাল। দেখল ছাদে ইমতিনান, মিশু, জুয়েলসহ কয়েকটা ছেলে খেলছে। ছাদের কিনারে দাঁড়িয়ে ইমতিনান দাঁত বের করে হাসছে। টিটকিরি দিয়ে বলল, ‘প্রাইভেট ডিটেকটিভ। হানীফ হোমস।’
পেছন থেকে বাকিরাও সমস্বরে বলল, ‘প্রাইভেট ডিকেকটিভ! হানীফ ডিটেকটিভ! হানীফ হোমস!’
কাঁটা ঘায়ে নতুন করে নুনের ছিটার মতো আঘাতটাকে শুধু বাড়িয়ে দিল। হানীফ কিছু বলল না। এদের কিছু বলা মানে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলা।
সম্ভাব্য সব জায়গা খুঁজেও হাবলুর কোনো খোঁজ পেল না হানীফ। রাফিদের খোঁজে ওদের বাসায় যেতে মন চাচ্ছিল না।
রাস্তার লোকজনের দৃষ্টি এড়িয়ে এলো বড়বাড়ির পেছনের বাউন্ডারি ওয়ালের পশ্চিম-উত্তর কোণে।
মাল্টি পকেটওয়ালা প্যান্ট-শার্ট যোগাড় করতে পারেনি। ব্যাগে করে জিনিসপত্র আনতে হয়েছে। ব্যাগ নিয়ে ওয়াল টপকাতে গিয়ে কয়েকবার পিছলে পড়লে বুঝল একা একা কাজ করা কতটা দুরূহ। তবে সহজে দমে যাওয়ার পাত্র নয় সে। একদিক দিয়ে ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। সে একাই হবে গ্যাংস্টার ধরিয়ে দেওয়ার কৃতিত্বের দাবিদার। পত্রিকায় ছবি উঠবে তার একার। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে সাক্ষাৎকার প্রচার করা হবে তার একার। অন্য কেউ ভাগীদার নেই।
হঠাৎ মনে হল ওয়ালের উপর দিয়ে ব্যাগ ছুড়ে দিলেই তো হয়। নিজেকে তিরস্কার করল নিজেকে। লোকবল প্রয়োজন নেই শুধু বুদ্ধির প্রয়োজন।
ওয়াল টপকে ভেতরে নেমে ব্যাগ কোমরে বেঁধে নিল। হাতে ¯েপ্রর বোতল। সহজভাবে ঘরে ঢুকতে পারলে ভালো নইলে দু’একজন বিষাক্ত তরলের প্রভাবে লুটিয়ে পড়বে মাটিতে। এটুকু করতেই হবে। ঘাস লতাপাতা সরিয়ে এগুচ্ছিল। ভয় ছিল কোনদিক থেকে আবার জিল্লু মিয়ার লাঠি এসে পড়ে ওর মাথায়।
বাসার পূর্ব দিকে সার্চ লাইটের আলোতে খোলা ঘাসের চত্বরের অনেকটা জায়গায় আলো এসে পড়ছে। সেই আলোতে দেখল গেটের কাছে, বাসার সামনের খোলা জায়গা উত্তর পাশের পুকুর ঘাটে কেউ নেই। কোনো গাড়িও দাঁড় করানো নেই।
বাসার পশ্চিম পাশের দিকে অন্ধকারের মাঝ দিয়ে এসে দাঁড়াল একটা পিলারের আড়ালে। উঁকি দিয়ে দেখল বারান্দায় সিঁড়ির উপর বসে আছে দু’জন লোক। ব্যাগ থেকে কেমিক্যালসের বোতল ছুড়ে মারল খোলা চত্বরে ঘাসের মাঝে। ঘাসের মধ্যে পড়ে শব্দ হলে ফিরে তাকাল দু’জন। একজন অন্যজনকে কী বলল শুনতে পেল না হানীফ।
একজন উঠে গেল বোতলের দিকে। অন্য লোকটাকেও সরাতে পারলে সহজে উঠে যাবে বারান্দায়। বারান্দায় উঠে একটা দরজা ভেঙ্গে ঢুকে যাবে ভেতরে। ঘাসের মধ্য থেকে বোতল উঠিয়ে লোকটা সিঁড়ির পাশে বসে থাকা লোকটাকে দেখিয়ে বলল, ‘একটা বোতল। বোতলে কী যেন সবুজ সবুজ জিনিস।’
‘বোতল আইল কোইত্তে?’ বসে থাকা লোকটা প্রশ্ন করল।
‘রাস্তা থাইক্যা ছুইড়া মারছে বোধ হয় কেউ।’
‘কী কছ? রাস্তার থাইক্যা ছুইড়া মারলে এত দূর আইব ক্যামনে?’
‘তাইলে আইলো ক্যামনে?’
কথোপকথন আরও চলত। কিন্তু সেসব শোনার সময় ছিল না হানীফের। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল সিঁড়ির কাছে বসা লোকটির দিকে। বিষাক্ত ¯েপ্রর বোতলের নজল তাক করল লোকটির দিকে। আওতার মধ্যে এলে ট্রিগার চাপবে এমন সময় ধমকে উঠল কে যেন। দেখল করিডোরে বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে আছে জিল্লু মিয়া। দেখেই পিলে চমকে গেল। ততক্ষণে সিঁড়িতে বসা লোকটিও ফিরে তাকিয়েছে। দেরি না করেই ট্রিগার চাপল হানীফ। বিষাক্ত তরল পদার্থ জিল্লু মিয়া পর্যন্ত পৌঁছল না তবে সিঁড়িতে বসা লোকটির গায়ে কিছুটা ছোয়া লাগল। ‘ওরে আল্লাহরে’ বলে দু’হাতে চোখ চেপে ধরল লোকটা। জিল্লু মিয়া মাঠের লোকটিকেই হয়ত বলল, ‘সালামত ধর, ধর।’
সালামত প্রথমটায় বুঝতে পারেনি। সে আওয়াজ দিল, ‘কী ধরব?’
জিল্লু মিয়া আরও কিছু বলার আগেই হানীফ ¯েপ্রর বোতল ছুড়ে মারল জিল্লু মিয়ার দিকে। জিল্লু মিয়া এক পাশে সরে যাওয়ায় গায়ে লাগল না। তবে মেঝেতে পড়ে বোতল ফেটে তরল পদার্থ ছড়িয়ে পড়লে তার ঝাঁঝে চোখ বন্ধ করে জোরে চিৎকার করে উঠল।
সালামত নামের লোকটা তখনও বুঝতে পারেনি কী হয়েছে। জিল্লু মিয়া আবার বলল, ‘শয়তানটাকে ধর, আজ হাড্ডি গুড়া করে ফেলব।’
সালামত সিঁড়ির কাছে আসার আগেই পিছিয়ে অন্ধকারের মধ্যে চলে এল হানীফ। অবস্থা বেগতিক দেখে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল বাসার পেছনের অন্ধকারের মধ্যে। ঝামেলা কমাতে কোমরের ব্যাগ ছুড়ে ফেলল একদিকে। ঘাস লতাপাতার মাঝে জড়িয়ে একবার উল্টে পড়ল। জিল্লু মিয়া টর্চ হাতে পেছন পেছন ছুটে আসছে। বাকি দু’জনের হাকডাকও শুনল। চোর ভেবেছে হয়ত। গ্যাংস্টারের লোকজন ওকে পেলে পুলিশে দেবে না নিশ্চয়, গুম করে ফেলবে। ধরিয়ে দিয়ে নিজেদের আস্তানা সর্বসমক্ষে প্রকাশ করবে না।
হাতে কোনো গাছের পাতা লেগে যেন চামড়া জ্বলে গেল। হাতের জ্বলা শেষ হতেই মুখের ডানপাশে ছ্যাৎ করে আরেক গাছের পাতা লাগল। জিল্লু মিয়া ধরার আগে কোনোরকমে ওয়াল টপকে বড়বাড়ির বাইরে এলো। রাতারাতি বিখ্যাত হওয়ার একটা সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় মুষড়ে পড়ল। বড়বাড়ির ত্রিসীমানায় থাকা ঠিক হবে না ভেবে একেবারে পোস্ট অফিসের সামনে এসে সুস্থির হল।
হাতের কয়েক জায়গা থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। মুখের ডানপাশে জ্বলছে। হাত মুখে লাগিয়ে দেখল রক্ত বেরুচ্ছে কিনা। হাতে রক্ত লাগল না। বিষণœ, বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ।
দিনের বেলা গেল বাস স্ট্যান্ডে। পানিহাটা বিল দেখতে যাবে। কেউ যাবে না বলে সে বসে থাকবে না।
বাস ছাড়ল নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করতে যাচ্ছে কত আনন্দ হওয়ার কথা। কিন্তু তার কিছুই হচ্ছিল না। কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল, শঙ্কা জাগছিল মনে। তা কি কেউ তার সঙ্গী হয়নি সে জন্য না কি আগামী কাল হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা সে জন্য? অর্ধেক পথে গিয়ে বাস থেকে নেমে গেল। অন্য বাসে করে আবার বাসায় ফিরে এলো। এভাবে কোনো দর্শনীয় স্থান দেখতে যাওয়া যায় না।
নয়.
পরীক্ষার হলে যেতেই ভয় করছিল হানীফের। সকালবেলা নাস্তা খেয়ে স্কুলড্রেস পরে পরীক্ষার হলে যাওয়ার জন্য যখন কলম পকেটে ঢোকাচ্ছিল তখন মনে হলো কী পরীক্ষা দেবে? কোনো প্রশ্নই তো ভালোভাবে মুখস্থ করেনি। বইয়ের চ্যাপ্টারগুলোর নামও বলতে পারবে না ঠিকমত। বুক ধুকধুক করছিল।
বছরের শুরু থেকে তো পড়া হয়ইনি। পরীক্ষার আগেও না। অন্যান্যবার অন্তত যেমনটি করে থাকে।
পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে সব অন্ধকার দেখতে লাগল। অন্যদের দিকে তাকিয়ে দেখল সবাই মনোযোগ দিয়ে লিখছে। পেছনে বা সামনে অন্য ছাত্রকে যে কিছু জিজ্ঞেস করবে সে সুযোগও নেই। জিজ্ঞেস করলেই কি উত্তর লিখতে পারবে?
অন্যপাশে সিট পড়েছে হাবলুর। দেখল হাবলু কী যেন লিখছে। দেখে মনে হচ্ছে না কোনো টেনশন কাজ করছে। পরীক্ষার খাতায় নিশ্চয় হিসাব নিকাশ করছে। ও এ কাজটা করে। পরীক্ষার খাতায় প্রশ্নের উত্তর জানা না থাকলে জানা অন্য উত্তর লিখে দিয়ে আসে।
এবার নিশ্চয় অন্য উত্তরও লিখছে না। অন্য উত্তরও জানা নেই। এখন হিসাব নিকাশ ছাড়া উপায় নেই। আরেকটা কাজ করতে পারে এক প্রশ্নের উত্তর লিখতে সারা সময় কাটিয়ে দেবে। হয়ত একটা প্রশ্নের উত্তরই জানা আছে। তাড়াতাড়ি লিখে শেষ করে বসে থাকলে স্যার এসে জিজ্ঞেস করবেন, কি লিখছিস না? তখন কী করবে? পরীক্ষা শেষের সময় যত ঘনিয়ে আসতে লাগল ওর অস্থিরতা তত বাড়তে লাগল। হিসাব করে দেখল পাস করার মতো উত্তর সে লিখেনি, লিখতে পারেনি।
জীবনে প্রথম ফেল করতে যাচ্ছে সে। বিগত বছরগুলোতে ক্রমাবনতি, পরীক্ষায় খারাপ করে, ফার্স্ট-সেকেন্ড হয় না। রোল থাকে পেছনের দিকে। কিন্তু ফেল তো আর করে না। এই প্রথম ফেল করল। দুনিয়াটা অন্ধকার হয়ে এলো। চেপে আসছে পৃথিবী। শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। যেমনটি আর কখনো লাগেনি। ফাইনাল পরীক্ষায় পাস করবে কিভাবে? আর বোধহয় পাস করা হবে না।
হাবলু প্রশ্ন গুটিয়ে হল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। হানীফ ডাকল, ‘হাবলু?’
হাবলু কাছে এলো।
‘পাস হবে?’
‘না।’
অন্য ছাত্রদের দেখল কে কোন প্রশ্নের উত্তর লিখল, কোনটা ভুল লিখল, কোনটা শুদ্ধ লিখল এসব আলোচনা করছিল। কারও কথা হয়ত বা সময় ছিল না তাই শেষের প্রশ্নটা শর্ট করে লিখতে হয়েছে। কারও বা একটা শর্ট কোশ্চেন ভুল হয়ে গেছে। আপসোস করছে।
হানীফের মনে হল একটা প্রশ্ন ভুল হয়েছে তো কী হয়েছে? সে পাস করার মতো উত্তর লিখতে পারলেই খুশি হতো। কিন্তু পাস করার মতো উত্তর লিখতে পারেনি।
রুম থেকে সবাই বেরিয়ে যাচ্ছে। রাফিদের দিকে দেখল অন্য এক ছাত্র তাকে প্রশ্ন দেখিয়ে কী যেন বলছে। রাফিদ জবাব দিচ্ছে। রাফিদের নিশ্চয় ফুল এনসার হয়েছে। অন্য ছাত্রদের সাথে এমনভাবে হেঁটে যাচ্ছে যে কথা বলাই যাবে না।
ইসহাককে দেখল অন্য একটা ছেলের সাথে বেরিয়ে যাচ্ছে। ওর পরীক্ষাও নিশ্চয় ভালো হয়েছে। আর কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। হাবলুর সাথেও না। অবশ্য হাবলু অন্যদিকে চলে গেল।
অন্যদের আনন্দ উৎসব ভালো লাগছিল না। আগামীকালও পরীক্ষা আছে। বুঝতেই পারছিল কী পরীক্ষা দেবে। তারচেয়ে পরীক্ষা না দেয়া ভালো। কিন্তু বাসায় বলতেই পারবে না যে পরীক্ষা দেবে না।
দশ.
পরীক্ষার কারণে এ ক’দিন মাঠে ছেলেদের উপস্থিতি কম ছিল, খেলা জমেনি। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ছেলেদের ভীড় বাড়তে থাকায় আবার আগের মতো মাঠ সরগরম হয়ে উঠল।
সকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। দুপুরের পর বৃষ্টি থামলেও মাঠ ভেজা। মাঠের কোথাও কোথাও পানি জমেছে। খেলতে গেলে কাদা-পানিতে মাখামাখি হবে বলে পুরনো জামা-কাপড় পরে খেলতে এলো কেউ কেউ। কিন্তু খুরশীদের পোশাক দেখে সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
দিনার প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘এটা কী পরেছিস খুরশীদ?’
সবার প্রশ্নবোধক দৃষ্টি দেখে খুরশীদ অবাক হওয়ার ভান করল। যেন এই সহজ বিষয় বুঝতে না পারায় খুব অবাক হয়েছে। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘কেন? টি পাঞ্জাবি আর স্লীভলেস পায়জামা।’
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল বাকিরা।
একটু ভাব নিয়ে খুরশীদ বলল, ‘এটা আমার গ্রীষ্মকালীন ফ্যাশন।’
মাঠের মাঝে খানিকক্ষণ ক্যাটওয়াক করল। অঙ্গভঙ্গি দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ল সবাই।
সারাদিন রুমে বসে ছিল হানীফ। খেলার মতো মানসিক অবস্থা ছিল না। জানতে চাইল না অলি, জনির পানিহাটা বিলে যাওয়ার প্রস্তুতির খবর। বড়বাড়ির চোরাকারবারীদের ধরিয়ে দেয়ার অদম্য আগ্রহটাও দেখা গেল না। ইসহাক কি আবার আসবে ওদের সাথে? এই উত্তরও জানতে চাইল না। মতিনকে কৌশলে শায়েস্তা করার বাসনাও রইল না। কোথাও বেরুতে ইচ্ছে করল না। মনে হলো কোথাও লুকিয়ে থাকতে পারলে ভালো হতো, যাতে কেউ খুঁজে না পায়। এই গরমেও খুব শীত শীত লাগছিল। কিন্তু কিছু সময় পার হতেই ছুটে এলো মাঠে।
দু’দল ভাগ হয়ে গিয়েছে। খেলা শুরু হবে। বল রাখা হয়েছে মাঝমাঠে। হানীফ মাঠে এসে বলল, ‘আমিও খেলব।’
ওর কথায় কেউ কান দিল না। বরং শুরু করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। হানীফ আবার বলল, ‘আমি খেলব।’
সাইডে দাঁড়িয়ে ছিল উৎপল। বলল, ‘এখন খেলা শুরু হবে ঝামেলা করিস না। আগে আসতে পারলি না?’
হানীফ বলল, ‘তাতে কী হয়েছে, একপক্ষে নেমে গেলেই হলো।’
‘এখন কাকে উঠিয়ে দিব? কাল আগে আসিস।’
উৎপলকে ঠাট্টার মত করে বলল, ‘উৎপল ভাই আমাকে না নিলে আপনার পক্ষে স্ট্রাইকিং-এ খেলবে কে?’
এ প্রশ্নে উৎপল যে উত্তর দিল তা মোটেও আশা করেনি সে। উৎপল তার খেলোয়াড়দের সাজানো রেখে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, ‘তুই ছাড়া আর স্ট্রাইকিং-এ খেলার প্লেয়ার নাই নাকি? একাই খেলোয়াড়?’ ওর দিকে মুখ বাঁকিয়ে তাকিয়ে থেকে আবার খেলোয়াড় সাজানোয় মন  দিল।
মাঝমাঠে বল কিক করতে নিয়েছে জোবায়ের। হানীফ এসে বল ধরে ফেলল।
উভয় পক্ষই হই হই করে উঠলÑ ‘কী হলো বল রাখ খেলা শুরু হবে এখন।’
হানীফ বলল, ‘আমাকে না নিলে খেলা হবে না।’
সেন্টার করতে আসা খেলোয়াড়রা বুঝানোর চেষ্টা করছিল। এর মধ্যে জগলু দৌড়ে এসে বল কেড়ে নিতে চাইল। বলল, ‘বল রাখ।’
ওর উদ্ধত ভঙ্গি দেখে হানীফের রাগ চড়ে গেল। বলল, ‘বল রাখব না, তোর বল নাকি?’
জগলু আগের মতই তেড়ে বলল, ‘আমার বল না হোক তুই বল রাখ।’
‘তোর কথায় বল রাখতে হবে নাকি?’
‘আমার কথায়ই রাখতে হবে। রাখ।’
জগলুর ধমকে হানীফের মেজাজ ক্রমেই চড়ে যাচ্ছিল। বলল, ‘আমি বল রাখব না, যা তুই কী করতে পারিস কর।’
‘কী বল রাখবি না? দাঁড়া!’ বলে জগলু ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল হানীফের উপর। পাশ থেকে এজাজ ধরে ফেলল।
হানীফ বিস্মিত হচ্ছিল। যে ছেলে চোখ তুলে তাকাতেই পারত না, সে আজ তার সাথে লাগতে আসে। ভাবতেই পারছিল না। হানীফের মনে হল হাবলুকে বলতে, ‘ধরতো হাবলু প্যাঁদানি লাগাই।’ ইসহাক আসবে মুঠি বাগিয়ে। টুটি চেপে ধরে শূন্যে তুলে ধরবে। বাবু এসে শেষ বেলায় চাপা ভেঙ্গে ফেলবে দু’ঘুষিতে।
একটু সজাগ হলে মনে হল আজ তার পাশে কেউ নেই। সে একা।ম াঠে বাবু থাকলেও এগিয়ে আসবে না।
ডাব্লু ওর ডান হাত ধরে টানতে টানতে মাঠের বাইরে নিয়ে এলো। বলল, ‘তুই ওর সাথে লাগতে গেলি কেন?’
‘ওর সাথে লাগতে যাব কেন? ওই তো আমার সাথে লাগতে এলো। কত বড় সাহস!’ জগলুর দিকে চেয়ে বলল, ‘দেখিস তোকে একদিন ঠিক দেখে নেব।’
‘এখন আর মাথা গরম করিস না। বাসায় যা।’
‘বাসায় যাব কেন? খেলতে আসিনি?’
‘হ্যাঁ খেলতে এসেছিস। কিন্তু আজ আর খেলিস না। দেখছিস না দু’দলে এগার জন করে হয়ে গেছে। এখন কোন্ পক্ষে নামবি?’
হানীফকে রেখে ডাব্লু আবার মাঠে চলে গেল।
হানীফ তাকিয়ে দেখল জগলু রাগী চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। পাশে ফাহিমকে কী যেন বলছে। মেজাজটা চড়ে যাচ্ছিল। কিছু করতে না পারায় ক্ষোভ আরও বাড়ছিল।
খেলা শুরু হল। কাদা-পানিতে মাঠ পিচ্ছিল ফলে বল নিয়ে দৌড়াতে গিয়ে ধুপধাপ করে একেকজন পড়তে লাগল। কাদা-পানির মাঝে বল লাত্থি দিলেও এগুচ্ছিল না। যেখানে বল সেখানে সব খেলোয়াড় জড়ো হয়ে যাচ্ছে। বল সহজে কোনোদিকে এগুচ্ছিল না। ভীড়াভীড়ি থেকে গোলপোস্টের সামনে ফাঁকায় বল পেয়ে গেল শরাফত। গোলকিপার দৌড়ে এলো বল ধরতে। শরাফত ডজ দিয়ে আরেকটু এগুল। গোলকিপার ঝাঁপিয়ে পড়েও বল ধরতে পারল না।
শরাফত বল নিয়ে একেবারে গোলপোস্টের সামনে। জোরে কিক করলেই গোল। কয়েক হাত সামনে বল কিক করতে গেল। দর্শকদের মাঝে দারুণ উত্তেজনা। সবাই চেঁচাচ্ছিল। শরাফত দৌড়ে গিয়ে কিক করল। সবাই ধারণা করল গোল। কিন্তু বল গোলপোস্টে ঢোকেনি। বল আগের জায়গায়ই আছে। কিক করার আগ মুহূর্তে পিছলে চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেল সে। ওর পিছলে চিৎ হয়ে পড়ে যাওয়া দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ল সবাই। গোলকিপার এসে বল ধরে ফেলল।
হাসির মাঝে যোগ দিল না হানীফ। খেলতেই যখন পারবে না তখন এদের খেলা দেখবে না। এরা এমন কোনো খেলোয়াড় হয়ে যায়নি যে না দেখলে চলবে না। উঠে গেল সে।
বাসায় যেতে ইচ্ছে করল না। কোনো নির্জন জায়গায় লুকিয়ে থাকতে পারলে ভালো হত। সে রকম কোনো জায়গাও নেই।
এলজিইডি ভবনের পাশের রাস্তা দিয়ে লাভলু ভাইয়ের টং ঘরের কাছে এলে দেখল নির্জীব ভাবে বসে আছে হাবলু। চোখে-মুখে ক্লান্তি, ঘুম জড়ানো ভাব। কাছে এসে দাঁড়াল হানীফ। হাবলু চোখ তুলে তাকাল না। ওর হাতে সিগারেট, ধোঁয়া উড়ছে ।
হানীফ ডাকল, ‘হাবলু?’
হাবলু অস্ফুট স্বরে বলল, ‘হু।’
হানীফ বিস্মিত হয়ে বলল, ‘তুই সিগারেট টানছিস?
কথা শুনে মুখ তুলে তাকাল হাবলু। ঢুলুঢুলু চোখে বলল, ‘হ্যাঁ। গাঁজাও টানি।’
এই অভ্যাসটা এখনো গড়ে ওঠেনি ওদের। আর যাই করুক এসবের ধারে কাছে যায়নি। আবার বলল, ‘কেন?’
‘কী করব? পড়াশুনা ভালো লাগে না। আম্মা-আব্বা, বড় ভাই গালিগালাজ করে। এক সময় গায়ে মাখতাম না। এখন গায়ে বড় লাগে। মনে হয় বাড়ি ছেড়ে পালাই। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চাই। গাঁজায় একটা টান দিলে কেমন যেন ঘোর এসে যায়। সব ভুলে যাই।’ হাবলুর চোখ বুজে এলো।
হানীফ চেয়ে দেখল একটু দূরে গলির মুখে বসে আছে শফি, জয়নাল। তার মানে এদের পাল্লায় পড়েছে। গাঁজাখোর সম্প্রদায়। বলল, ‘তাই বলে তুই গাঁজা টানবি? গাঁজা খেয়ে কি তুই সমস্যার সমাধান করতে পারবি?’
‘না খেয়ে কী করব বল। আর কী করতে পারি আমি?’
‘কবে থেকে এটা ধরেছিস?’
‘পরীক্ষার আগে থেকে।’
‘তাই তো বলি তুই এমন ঝিমাস কেন?’
হাবলুর হাতের উন্মুক্ত অংশে কালো দাগ দেখে হানীফ বলল, ‘এখানে ব্যথা পেলি কিভাবে?’
‘ব্যথা পাইনি, ব্যথা দিয়েছে। মেরেছে।’
ওদের কথাবার্তার মাঝে শফি উঠে এল। হাবলুকে বলল, ‘কি রে হাবলু, তোর দোস্ত বুঝি তোকে গাঞ্জা খাইতে  নিষেধ করতাছে?’
‘হ্যাঁ।’ হাবলু লুকানোর চেষ্টা করল না।
শফি হানীফের দিকে ফিরে বলল, ‘গাঞ্জা বড় কঠিন জিনিস। যারে ধরে তারে সহজে ছাড়ে না। আর মজা পাইলে মানুষই গাঞ্জা ছাড়ে না। চলে না, চলে না, গাঞ্জা ছাড়া দিন চলে না।’ শেষের কথাগুলো সুর করে বলল শফি। একটু হেলছিল দুলছিল।
কিছু বলতে চেয়েও বলল না হানীফ। এরা স্কুলের গন্ডিই পেরুতে পারেনি। তিনবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে অবসর নিয়েছে। হাবলু এদের খপ্পড়ে পড়েছে।
শফি ওর দিকে চেয়ে বলল, ‘ওই ধূমপান ত্যাগ করার উপায় কী?’
হানীফ কথা বলতে চাইছিল না। ওর নেশা করা বদখত চেহারা দেখেই মেজাজ বিগড়ে আছে। যথাসম্ভব শান্ত মেজাজে বলল, ‘ধূমপান না করা।’
শফি অট্টহাস্যে ভেঙ্গে পড়ল। ‘হা হা হা কী কয় পোলা? ধূমপান না করা?’ হাসি থামিয়ে হানীফকে বলল, ‘একটা টান দিবি কেমন লাগে?’ সিগারেট বাড়িয়ে দিল সে।
রাগে হানীফের শরীর জ্বলে গেল। এ বদমায়েশটা তাকে তুই করে বলছে কেন? হানীফ রাগে ফুসতে ফুসতে বলল, ‘না।’
সুর করে গান ধরল শফি। নাচছিলও। গান থামিয়ে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে বলল, ‘ওই পোলা হর, এইহানে গাঞ্জা না টানলে জায়গা নাই। তোর লাহান ভালা পোলা বাড়িত বয়া থাক গা।’
হানীফ চলে এলো। টানুক হাবলু গাঁজা টানুক। যারা তার সহচর ছিল সবাই কেমন দূরে সরে গেছে। একা হয়ে গেছে সে। ইসহাক এখন ধারে কাছে আসে না। খেলার মাঠেও আসে না। বাবু তো আগেই বিদায় নিয়েছে।
এগারো.
ক্লাসে আনমনে বসেছিল। ক্লাসরুম অচেনা মনে হলো। সবাই মনে হলো আনন্দে ভাসছে। পরীক্ষা নিয়ে আলাপ করছিল মতিন। পাশে দাঁড়িয়ে ছিল জগলু। এদের উপস্থিতি যেন তার খারাপ লাগার মাত্রা বাড়িয়ে দিল। খেলার মাঠ ছেড়েছে এখন স্কুলও ছাড়বে নাকি? তাই মনে হল। ঘণ্টা পড়লে নেয়ামত স্যার এলেন। ক্লাস টিচার উনি। এসে রোল কল করছিলেন। ছেলেরা রেসপন্স করছিল। সিটে বসে ছিল হানীফ। প্রথমদিকে খেয়াল ছিল যে রোল কল চলছে, ওর রোল কল করলে উঠে ‘ইয়েস স্যার’ বলবে। জানালা দিয়ে বাইরে চোখ গেলে স্কুলের বাউন্ডারি ওয়াল পেরিয়ে দূরে রাস্তায় এক লোক মাথায় ঝাঁকা নিয়ে যাচ্ছিলÑ সেদিকে দেখতে দেখতে কখন যে আনমনা হয়ে গিয়েছিল খেয়াল ছিল না। পাশ থেকে একজনের খোঁচায় সম্বিৎ ফিরে পেল। দেখল স্যার তীক্ষè দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ক্লাসের সবাই যেন ওর দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝল যে ওর রোল কল করেছে। বলল, ‘ইয়েস স্যার।’
স্যার বজ্রবাণ হেনে বললেন, ‘কোথায় থাকিস? রোল কল করছি আর অন্যদিকে তাকিয়ে আছিস? ক্লাসে মনোযোগ থাকে না?’
সে কোনো কথা বলতে পারছিল না।
স্যার বললেন, ‘দাঁড়িয়ে থাক। কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক। সারা ক্লাস কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকবি, যাতে আর কোনোদিন রোল কলের সময় মন অন্যদিকে না যায়।’
রোল কল শেষে স্যার পড়ানো শুরু করলেন। সবাই মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করছিল। কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকাতে লজ্জায় মাথা দিয়ে ধোঁয়া উঠতে শুরু করেছিল হানীফের। চারপাশ ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছিল না। কথাগুলো ঠিকভাবে শুনতে পাচ্ছিল না। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলেও কথাগুলো দূর থেকে ভেসে আসছে।
এখন তো আর ক্লাস থ্রি-ফোরের ছাত্র না। পড়া পারুক আর না পারুক কান ধরে সারা ক্লাস দাঁড়িয়ে থাকা মোটেও সম্মানজনক শাস্তি মনে হলো না। রাগে দুঃখে চোখে পানি আসার উপক্রম। কিন্তু চোখে পানি এলে আরেক ঝামেলা। সে নিশ্চয় এখন আর কচি খোকাটি নেই। চোখে পানি আসবে কেন?
থার্ড পিরিয়ডে সোলায়মান স্যার ঢুকলেন। ক্লাসে ঢোকার স্পিড দেখেই বুঝা গেল উনি খুব রেগে আছেন। তার মেজাজ সব সময়ই চড়া থাকে। এসেই পড়া জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। পরীক্ষার আগে কী পড়া দিয়েছিলেন সেই পড়া জিজ্ঞেস করছিলেন। যা কিনা পরীক্ষাতেও এসেছিল। স্যার একে একে পড়া জিজ্ঞেস করছিলেন। হানীফ দেখল সবাই কী যেন বলে দিচ্ছে স্যারও মেনে নিচ্ছেন। তাকিয়ে দেখল তার মতো কেউ আছে কি না? হাবলু ক্লাসে নেই। বাকি থাকে কে? কেউ বাকি থাকে না।
স্যার পড়া জিজ্ঞেস করে যখন ওর কাছে এলেন, দাঁড়াল সে। স্যার কী যেন সূত্র জিজ্ঞেস করলেন। বলতে পারল না। স্যার কানে এক থাপ্পড় দিলেন। প্রস্তুত ছিল না সে, মাথা ঘুরে গেল। তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল। খানিক বাদে স্থির হলো। দেখল, সবাই তার দিকে চেয়ে আছে।
স্যার চেয়ারে বসলেন। বই খুলে কী সব বললেন। বোর্ডে গেলেন। ‘আজ আমরা যে সম্পাদ্যটা করব…’ অর্ধেক বলে থেমে গেলেন। বললেন, ‘সবাই জ্যামিতি বক্স এনেছিস তো?’
ছাত্ররা বলল, ‘এনেছি স্যার।’
‘কে কে আনিসনি দাঁড়া।’
হানীফের মনে হলো সে জ্যামিতি বক্স আনেনি। আশা করছিল তার সাথে অন্য কেউ দাঁড়াবে। কেউ দাঁড়াল না। তাকে দেখে স্যারের মেজাজ আবার খারাপ হয়ে গেল। হাতের বই টেবিলে রেখে এসে আরও কয়েকটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিলেন। রাগে গজগজ করতে করতে বললেন, ‘জ্যামিতি বক্স আনিসনি কেন? পড়াশুনা করবি না, জ্যামিতি বক্স আনবি না তাহলে স্কুলে আসিস কেন? চেহারা দেখাতে আসিস? চলে যা স্কুল থেকে। আর আসিস না।’
স্যার আরও অনেক কথা বললেন। এবার আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না। কেঁদেই ফেলল। পাশ থেকে কেউ কেউ তাকিয়ে রইল। এখন তার আর এতো খারাপ লাগছে না। সব তো শেষইÑ মান-ইজ্জত যা ছিল। খানিক কান্নার পর বিষয়টা আরও হালকা হয়ে এলো। যে গোমর এতক্ষণ ছিল তা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় শান্তি পেল।
স্যার কী কী পড়ালেন বুঝল না সে। অন্যরা ‘জ্বী স্যার, হ্যাঁ স্যার’ বলে সায় দিল। স্যার বুঝানো শেষে বললেন, ‘কারো কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারিস ।’
এক ছাত্র উঠে প্রশ্ন করল। স্যার হাত নেড়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে কী যেন বুঝালেন। টেবিল থেকে ডাস্টার, খাতা নেয়ার সময় ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওই পড়াশুনা করবি? না করলে স্কুলে আসিস না। আর ক্লাসে জ্যামিতি বক্স নিয়ে আসবি।’
এটাই যেন বাকি ছিল। চরম পূর্ণতা প্রাপ্তির জন্য আর কী অপমান অপেক্ষা করছিল শেষ ক্লাসগুলোতে সে প্রতীক্ষা করল।
বারো.
স্কুল ব্যাগ কাঁধে বাসার বাইরে এসে দাঁড়াল হানীফ। রিকসাওয়ালাকে বলল ট্রেজারি মোড়ে যেতে। সেন্টুর দোকানে বসে থাকবে। স্কুল ছুটির সময় হলে বাসায় চলে আসবে। প্রতিদিন স্কুলে গিয়ে মার খাওয়ার কোনো মানে হয় না। সব টিচার যেন ওর প্রতি ক্ষেপে আছে। প্রতিটা মানুষ ক্ষেপে আছে।
ট্রেজারি মোড়ে এলে রিকসা থেকে নেমে ঢুকে গেল দোকানের পেছনে। সামনের অংশে চায়ের দোকান। পেছনে ফাঁকা জায়গা। সেখানে কয়েকটা ক্যারাম বোর্ড বসানো আছে। যত আজে বাজে ছেলেপেলে ক্যারাম খেলছে।
এক কোণায় দেখল আমির বসে সিগারেট টানছে। ছেলেটা একসময় ওদের সাথে খেলত। বয়সে ওর চেয়ে বড় তবু সে তুই করেই সম্বোধন করত। গোয়ার টাইপের ছেলে। বুদ্ধিশুদ্ধির ধার ধারে না। গায়ের জোরেই চলত। হানীফের সাথে খেলা নিয়ে বেশ কয়েকবার মারামারি বাঁধার উপক্রম হয়েছিল। ওর আব্বা রিকসা চালাতেন। টানাটানির সংসারে কাউকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ানোর অবস্থা ছিল না। আর ও ছাত্র হিসাবেও ভালো ছিল না।
আমিরকে দেখে ওসব স্মৃতি মনে পড়ে গেল। এতদিন অবশ্য সেসব ক্ষোভ ধরে রাখার কথা নয়। এরপরও এখন বিনা উস্কানিতে খুঁচাখুচি শুরু করলে বিপদ হবে। ওর আগের চেয়ে পেশীবহুল শরীর হয়েছে। তার উপর মোটর গ্যারেজে কাজ করায় চেহারায় কালি তেল মেখে বিদঘুটে হয়েছে। আগেভাগেই পরিবেশ অনুকূল করার জন্য হানীফ বলল, ‘আমির! ভালো আছিস? এখানে কী করছিস?’
আমির পুরো প্রশ্নের উত্তর দিল না। যেমন ভাবে সিগারেট টানছিল তেমনিভাবে সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘ভালো।’
আমিরের পাশে মাটিতে ব্যাগ রেখে বসে বলল, ‘কী করছিস এখন?’
আমিরের নির্লিপ্ত উত্তর, ‘আগে যা করতাম।’
‘আজ ডিউটি নাই বুঝি?’
‘আছে।’
‘তাহলে এখানে বসে আছিস যে?’
‘আছি আর কি ।’
আমির অনেকক্ষণ পর প্রশ্ন করল, ‘এখানে কেন?’
হানীফ কোনো তথ্য ফাঁস করল না। এড়িয়ে গিয়ে বলল, ‘না এমনি। স্কুলে তো প্রতিদিনই যাই। আজ এখানে একটু এলাম। তোদের দেখতে।’ হানীফ আর কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। বেফাস ভাবে বলে ফেলল, ‘দে তো একটা সিগারেট, একটা টান দেই।’ কথাটা বলেই বুঝল অনর্থক একটা কথা মুখ ফসকে বলে ফেলেছে।
আমির  সিগারেট এগিয়ে দিল না। বলল, ‘সিগারেট খাওয়া ভালো না।’
হানীফ হাফ ছেড়ে বাঁচল। মুখে বলল, ‘তুই খাচ্ছিস কেন?’
‘আমরা না হয় গোল্লায় গেছি, তোদের যেতে হবে না।’
খাতার পাতা ছিড়ে এককোণে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বুজল হানীফ। কেমন ঘুম ঘুম লাগতে শুরু করেছে এমন সময় এক দঙ্গল ছেলে হাউকাউ করতে করতে দোকানের ভেতরে এলো। এটাই হয়ত ওদের আনন্দ প্রকাশের ভাষা এবং ভঙ্গি। বিশ্রী ঠেকল হানীফের কাছে। এদের যে সে কখনো দেখেনি তা নয় তখন এড়িয়ে যেত। গায়ে মাখত না এসব। কিন্তু আজ এড়িয়ে যেতে পারল না। মনে হচ্ছিল গায়ের উপরই বোধ হয় এসে পড়বে। সে যেখানে সেখানে এরা আসবে কেন? এটাই মেনে নিতে পারছিল না। তবে এখন বলে তো লাভ নেই। সে শুনতে পেল একজন প্রশ্ন করছে, ‘এটা কে?’
কেউ  উত্তর দেয়ার আগে অন্যজন ধমক দিল, ‘উঠ ঘুমাস ক্যা?’
হানীফ চোখ বন্ধ করে ছিল। ভয় ঢুকে গেল যদি এসে বলে, ‘এখানে ঘুমিয়েছিস কেন?’ ছেলেটা হয়ত টেনে উঠিয়ে দিতে এসেছিল অন্য কেউ বাধা দিয়ে বলল, ‘থাক ঘুমাইতাছে, ঘুমাক।’
যখন ঘুম ভাঙল তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। আড়মোড়া ভেঙে দেখল এক ক্যারাম বোর্ডে আমির খেলছে। লোকজন কম।
স্কুলে অনিয়মিত হয়ে পড়ল হানীফ। যেদিন সুযোগ পায় স্কুলেই যায় না। গেলেও টিফিন পিরিয়ডে চলে আসে। দিনগুলো এভাবেই কেটে যাচ্ছিল। এখন ক্যারাম খেলার সুযোগ হয়েছে। তবে এদের সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না।
তেরো.
যে খারাপ পরিস্থিতির আশঙ্কা করছিল হানীফ, একদিন তাই ঘটল। ষান্মাসিক পরীক্ষার রেজাল্ট দিলে রেজাল্টশীট বাসায় দেখানোর ইচ্ছা ছিল না। কারণ সে চার সাবজেক্টে ফেল করেছে। কিন্তু সেটা গোপন রইল না।
সন্ধ্যার পর বিছানায় শুয়ে শুয়ে উপন্যাস পড়ছিল। ওর আম্মার এদিকে আসার পায়ের আওয়াজ পেয়ে এক লাফে বিছানা থেকে উঠে চেয়ারে বসল। উপন্যাস টেবিলে অন্যান্য বইয়ের মাঝে লুকিয়ে রেখে পাঠ্যবই খুলে পড়ার ভান ধরল। তার আগেই দরজায় এসে দাঁড়ালেন ওর আম্মা। হানীফ ফিরে তাকাল না। পড়ায় খুব মগ্ন থাকায় যেন বুঝতেই পারেনি রুমে কেউ এসেছে। ওর আম্মা থমথমে গলায় বললেন, ‘রেজাল্ট দিয়েছে?’
হানীফ ঘাড় ফিরে তাকাল। ওর আম্মাকে দেখে এমন ভাব করল যে, সে টেরই পায়নি যে তিনি রুমে এসে দাঁড়িয়ে আছেন। আবার ঘাড় ফিরিয়ে পড়ায় মনোযোগ দেয়ার ভান করে বলল, ‘না।’ প্রথম প্রথম মিথ্যা বলতে মুখে বাঁধত এখন আর বাঁধেনা। প্রায়ই মিথ্যা বলতে হয়।
ওর আম্মা আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কবে দিবে?’
কিছু সময় চিন্তা করে হানীফ বলল, ‘আর কয়েকদিন পরে।’
আর কয়েকটা দিন যেন ব্যাপারটা না জানে এবং সে নিশ্চিন্তে থাকতে পারে। ভেবেছিল এরপর হয়ত তিনি এ বিষয়ে কিছু বলবেন না। অন্য কোনো কথা থাকলে বলবেন। কিংবা চলে যাবেন। কিন্তু হানীফের ধারণা ভেঙ্গে দিয়ে বললেন, ‘নওশাদের রেজাল্ট দিল, তোরটা দিল না কেন?’
হানীফের বুক ধক করে উঠল, মুখ শুকিয়ে গেল। নওশাদের রেজাল্ট দিয়েছে ওর আম্মা জানলেন কিভাবে? নওশাদ কি তাহলে এসে বলে গেছে? তাহলে তো ওর রেজাল্টের খবরও জানিয়ে দিয়ে গেছে মনে হচ্ছে। ওর রেজাল্টের খবর বাসায় জানিয়ে দেয়ার দায়িত্ব নিশ্চয় নওশাদরে নয়। নওশাদের প্রতি রাগে ফুসে উঠল।
ক্ষোভ চাপা রেখে না জানার ভান করে বলল, ‘নওশাদের রেজাল্ট দিয়েছে?’
ওর আম্মা ওর দিকে মুখ শক্ত করে তাকিয়ে ছিলেন। বললেন, ‘হুঁ,তোর রেজাল্ট দিল না কেন?’
হানীফ কথা বলছিল না।
ওর আম্মা কঠিনস্বরে বললেন, ‘রেজাল্টশীটটা দেখি।’
ও মাথা নীচু করে বসে ছিল। তিনি আবার বললেন, ‘কী হলো?’
ও ভয়ে ভয়ে বলল, ‘রেজাল্ট খারাপ হয়েছে।’
‘কী ফার্স্ট হতে পারিসনি?’ কথায় স্পষ্ট ব্যঙ্গ। বিগত বছরগুলোতে ফার্স্ট তো দূরে থাক পাস করেছে টানাটানি করে। তা তার অজানা নয়। তাই এমন প্রশ্ন করার কারণ নেই, রাগ ছাড়া।
হানীফ শুধু বলল, ‘না খারাপ হয়েছে।’
‘কী, প্লেসে নাই?’ এ প্রশ্নও যে বিদ্রুপের কারণে করছেন তাও বুঝল। তবু হানীফ বলল, ‘না আরও খারাপ।’
‘দেখি রেজাল্টশীট।’ কয়েকবার বলায়ও হানীফ চেয়ার থেকে না নড়লে তিনি রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। ফিরলেন লাঠি হাতে। তিনি যে কত রেগে আছেন তা কল্পনাও করতে পারেনি হানীফ। বুঝল কিছুক্ষণ পর। এসে বললেন, ‘কথায় যখন কাজ হবে নাÑ’ কথা শেষ না করে লাঠি দিয়ে কাঁধে কষে একটা বাড়ি মারলেন। কঁকিয়ে উঠল হানীফ। দ্বিতীয় বাড়ি দেয়ার আগে কাঁধে হাত বুলাতে বুলাতে টেবিলে বইয়ের মাঝখান থেকে রেজাল্টশীট বের করে দিল।
রেজাল্টশীট দেখে যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পাচ্ছিলেন না ওর আম্মা। বললেন, ‘ফেল? চার  সাবজেক্টে ফেল!’ রাগে দিগি¦বিগি¦ক জ্ঞান শূন্য হয়ে গেলেন। রেজাল্টশীট হাত থেকে ফেলে দিয়ে লাঠি দিয়ে সজোরে বাড়ি দিলেন পিঠে। আঘাতটা এমন লাগল যে হানীফ চেয়ার ছেড়ে রীতিমত লাফিয়ে উঠল। ব্যথায় কাঁতরাতে কাঁতরাতে প্রতিশ্র“তির সুরে বলল, ‘আর এমন হবে না। বার্ষিক পরীক্ষায় রেজাল্ট ভালো হবে।’
ওর আম্মা দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললেন, ‘রেজাল্ট ভালো হবে তারই তো নমুনা এসব?’
একটা বাড়ি ফেরাতে গিয়ে হাতে লাগল। এবার ব্যথায় কেঁদে ফেলল। হাত ঝাঁকাতে লাগল। করুণভাবে  বলল, ‘বললাম তো এখন থেকে পড়ব।’
ওর আম্মা সে কথা কানে তুললেন না। মুখের কঠিনভাব তখনও কমেনি। বললেন, ‘আর পড়তে হবে না। অনেক পড়েছিস।’
শত অনুনয় বিনয় কোনো কিছুতেই কাজ হল না। লাঠির আঘাত পড়তে লাগল সারা শরীরে। আঘাত অসহ্য হলে চিল্লাচিল্লিতে সারাঘর মাথায় তুলে ফেলল। দু’বার পায়ে পড়ে ক্ষমা চাওয়ার চেষ্টা করল। পারল না। হাঁটুতে বাড়ি লাগলে মেঝেতে শুয়ে পড়ল। ব্যথায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। জোরে চিল্লাচিল্লিরও শক্তি ছিল না।
ওর আম্মার হাতও হয়ত ব্যথা হয়ে গিয়েছিল। গালিগালাজ তখনো থামেনি। যাওয়ার সময় বলে গেলেন, ‘বাইরে গিয়ে শয়তানি বদমায়েশি করবি সে সুযোগ পাবি না। হাত-পা ভেঙ্গে ঘরে ফেলে রাখব।’ তিনি রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দরজার হ্যাসকল লাগিয়ে দিলেন। যাতে বের হতে না পারে। এটাই ছিল হানীফের জীবনের সর্বোচ্চ মার খাওয়া।
ওর আব্বা এখনও বাসায় ফেরেননি। তিনি এসব শুনলে রাতে ছোটখাট কেয়ামত হয়ে যাবে তা সহজেই অনুমেয়। মেঝেতেই পড়ে রইল হানীফ। যেসব জায়গায় বাড়ি লেগেছে যন্ত্রণা হচ্ছে। চোখের পানি যেন কিছুতেই বাঁধ মানছে না। গাল বেয়ে পড়ে মেঝেতেও পড়ছে। এভাবে শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল তা বলতে পারবে না।
যখন ঘুম ভাঙল ওয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল রাত সাড়ে দশটা বাজে। বাসায় পিনপতন নীরবতা, থমথমে আবহ। যেন যে কোনো মুহূর্তে বড় ধরনের কোনো অঘটন ঘটে যাবে। ওর আব্বা এখন নিশ্চয় এসেছেন এবং পুরো ঘটনা শুনে অগ্নিমূর্তি হয়ে আছেন। প্রতিটা মূহূর্ত কাটতে লাগল অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার আশঙ্কায়Ñ কখন ওর আব্বা হুঙ্কার ছেড়ে মারধর শুরু করবেন। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে রাত বাড়তে লাগল। ওর আব্বা হুঙ্কার ছেড়ে এলেন না। রাতে আর কিছু ঘটল না।
চৌদ্দ.
সকাল বেলা ঘুম থেকে জেগে উঠে বসতে পারছিল না হানীফ। শরীর ভীষণ দুর্বল হয়ে আছে। একে তো প্রচণ্ড মার তার উপর রাতে খাওয়া হয়নি। সারা শরীর ব্যথা করছে। শীত শীত লাগছিল, মনে হচ্ছে জ্বর এসে গেছে।
কষ্টে উঠে বসল। বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসে দাঁড়াল দরজার কাছে। খোলার চেষ্টা করে দেখল বাইরে থেকে লাগানো নয়। বেরিয়ে এলো বাসা থেকে। গেট খুলে এসে দাঁড়াল রাস্তায়। সকাল বলে মানুষজন নেই। দু’একজন ডায়াবেটিসের রোগী বাধ্যতামূলক হাঁটা হাঁটছে। 

সে হেঁটে কলেজ মোড় পার হয়ে চলে এলো রেললাইনে। আশেপাশের বাড়িঘর ছাড়িয়ে রেললাইন দিয়ে হেঁটে হেঁটে নির্জন একটা জায়গায় চলে এলো। দু’পাশে ক্ষেত, জলাশয়, দূরে গ্রাম। জলাশয়গুলোতে কলমিলতা, কচুরিপানা, শাপলা এসব ঘন হয়ে ঢেকে আছে। রেললাইনের দু’ধারে বনজ বৃক্ষগুলো এখন অনেক বড় হয়েছে। গাছগুলো যখন ছোট ছিল তখন থেকেই দেখে আসছে। রেললাইনের উপর লম্বালম্বিভাবে শুয়ে পড়ল। যথেষ্ট হয়েছে, আর না। এভাবে বেঁচে থাকার চাইতে না বাঁচাই ভালো। শুয়ে বলল, ‘বিদায় হে পৃথিবী! তোমার বুকে আমার আর বাঁচার ইচ্ছা নাই।’
আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল সাদা মেঘগুলো ভেসে ভেসে যাচ্ছে। নীল আকাশের মাঝে কেমন একটা সাদা ছোপ রয়ে যাচ্ছে। পাশে বৃক্ষগুলোর দিকে চেয়ে বলল, ‘বিদায় হে বৃক্ষ।’
সকাল বেলা এদিক দিয়ে দু’টো ট্রেন যায়। একটা ট্রেন হলেই হবে। চাকা শুধু উপর দিয়ে গেলেই দুই টুকরো হয়ে যাবে। কায়দা মতো পড়লে আরও বেশি টুকরো হবে। ট্রেন আসার জন্য অপেক্ষায় শুয়ে রইল। শুয়ে শুয়ে দেখল কয়েকটা সাদা বক উড়ে এসে বসল একটা জলাশয়ের পাড়ে। মাছের খোঁজে এখানে আসে। থাকেও হয়ত পাশের গায়ের বড় বড় গাছের ডালে। এক সময় এখানেই বক শিকারের জন্য আসত। ফাঁদ পেতে বসে থাকত। কিন্তু একটা বকও ফাঁদে পড়েনি। সেসব স্মৃতি মনে হতেই মনটা কেমন যেন আর্দ্র হয়ে উঠল। অনেক অনেক স্মৃতি কেন যেন দ্রুত চোখের সামনে ভাসতে লাগল। পৃথিবীর প্রতি কেমন যেন মায়া লাগল। খানিকটা সময় আরো বাঁচতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু এই মায়া তাকে বেঁধে রাখতে পারবে না।
লাইন কাঁপতে লাগল। শোঁ শোঁ শব্দ শুনল কানে। তারমানে ট্রেন আসছে। প্রস্তুত হলো সে। শেষবারের মতো মনে মনে বলল, ‘বিদায় হে পৃথিবী।’
চিরকুট লিখে যাওয়ার কথা মনে হলোÑ আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয় কিংবা ওমুক ওমুক দায়ী। পরমুহূর্তে মনে হলো কার জন্য চিরকুট লিখে রেখে যাবে? কাউকেই আর তার ভালো লাগছে না।
প্রস্তুত হয়ে চোখ বুজে রইল। ক্রমে শোঁ শোঁ আওয়াজ প্রকট হল। রেললাইনের কাঁপন বাড়ছিল। এক সময় ট্রেনের আওয়াজ পাওয়া গেল। ভয় লাগছিল। উঠে যাবে কিনা এ চিন্তাও মনে এলো। কিন্তু এত সহজে সিদ্ধান্ত বদলাবার লোক সে নয়। ট্রেনের হুইসেল কানে বাজল। তখনও চোখ বন্ধ। আর কিছুক্ষণ পর সে মুক্তি পাবে এ যন্ত্রণা থেকে। ‘মুক্তি মুক্তি’ মনে মনে উচ্চারণ করল। মুক্তি হয়ত না, আত্মহত্যা মহাপাপ এবং এতে নিশ্চিত জাহান্নাম জুটবে। পরক্ষণে মনে হলো, জাহান্নামের আজাবই ভোগ করবে কিন্তু এদের আচরণ নয়।
এমন সময় পাশে কথার আওয়াজে চোখ মেলল। দেখল কয়েক জন শ্রমজীবী লোক কথা বলতে বলতে ঘুন্টির ওদিক থেকে আসছে। সে উঠে এলো। এদের সামনে শুয়ে থাকলে পাশে এসে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করবে। সে কারও প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য প্রস্তুত নয়। হাসাহাসিও করতে পারে কিংবা ধরাধরি করে সরিয়ে আনবে। সে আত্মহত্যা করবে শান্তিতে, জোরজবরদস্তি করে না। লোকগুলো চলে গেলে শুয়ে পড়বে ভাবল।
লোকগুলো ওর সামনে দিয়ে হেঁটে হেঁটে নিরাপদ দূরত্ব অতিক্রম করার আগেই ট্রেন পাশ কাটিয়ে চলে গেল অনেক দূরে। এর পরের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করা যায় না। এখন মানুষজনের চলাচল আরও বাড়বে। লোকজনের কারণে শান্তিতে আত্মহত্যাও করতে পারবে না। তাহলে কিভাবে আত্মহত্যা করবে ভাবল। আত্মহত্যা না করলেও এখন আর বাসায় যাওয়ার ইচ্ছে নেই। দূরে কোথাও চলে যাবে।
পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে নেমে এলো রেললাইন থেকে। জামতলার রাস্তা দিয়ে কলেজ মোড়ে এসে একটা রিকসায় উঠল। এখন যাবে স্টেশনে। লোকাল ট্রেনগুলোর ভাড়া কম। টিকিট না কাটলেও চলে। ও রকম কোনো লোকাল ট্রেনে চড়ে বসে থাকবে। চলে যাবে যতদূর ট্রেন যায়। ওখানে ওকে কেউ চিনবে না। এরপর সেও কোনো শ্রমজীবী মানুষের মতো হবে।
পাঁচ রাস্তার মোড়ে এলে রাস্তার পূর্ব দিকে লাল ইটের বাসার দিকে নজর পড়লে কেন যেন মনে হল নবীন ভাইয়ের সাথে শেষ দেখাটা করে যাওয়া যায়। এই একটা মানুষকে এখনও ভালো লাগে। রিকসাওয়ালাকে বলল ডানে মোড় নিয়ে মসজিদের কাছে যেতে। নবীন ভাইদের বাসার কাছে এলে রিকসা থেকে নেমে এসে দাঁড়াল গেটের সামনে।
বাসার ভেতরে ঢুকতে বেশি হাঙ্গামা পোহাতে হলো না। দারোয়ানকে বললে সে বাগানের বড় শিউলি ফুলের গাছটার দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা  করল। নবীন ভাই খালি পায়ে বাগানে হাঁটছিলেন। সে এগিয়ে গেল। শিউলি ফুলের গাছের নিচে অনেকগুলো লাল সাদা শিউলি ফুল পড়ে আছে। সে সেদিকে ভ্রƒক্ষেপও করল না। পাশে একটা গোলাপ ফুল গাছে থোকা থোকা সাদা গোলাপ ফুল ফুটে আছে। সেদিকেও তার দৃষ্টি গেল না। অথচ একদিন এ গোলাপ ফুল গাছের জন্য কত হৈ চৈ করত। হাঁটা থামিয়ে হানীফকে দেখে তাকিয়ে ছিলেন নবীন ভাই। হানীফ কাছে এলে বললেন, ‘এতো সকালে, কী ব্যাপার?’
হানীফ ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘দেখা করতে এলাম। আর কখনো দেখা হবে কি না সে জন্য।’
‘কী হয়েছে? আর দেখা হবে না কেন?’
‘আমি চলে যাচ্ছি।’
‘কোথায়?’
‘জানি না। অজানার উদ্দেশ্যে।’
নবীন ভাই হানীফের মুুখের দিকে ভালোভাবে তাকালে। দেখলেন, কপালের কোণায় লাল হয়ে আছে। যেন কিছু একটা আচড় কেটেছে। বাম হাতের কব্জিতে ফোলা দাগটাও চোখে পড়ল। হাতটা সোজা  করে রাখতে পাচ্ছে না। বললেন, ‘কপালে কী হয়েছে? হাতেও তো দাগ বসে গেছে।’
‘কিছু না।’
নবীন ভাই রুমের দিকে হাঁটা ধরলেন। বললেন, ‘ভেতরে আয়।’
নবীন ভাইয়ের পেছন পেছন গেল সে। রুমে এসে বসলেন চেয়ারে। বসে আবার বললেন, ‘কী হয়েছে বল।’
এখনও যাকে বিশ্বাস করা যায়, যদি সমস্যার কথা আলাপ করা যায় তিনি হলেন নবীন ভাই। বয়সে বড় হলেও ভালো সম্পর্ক। যখন তিনি অহর্নিশ সাংস্কৃতিক সংগঠনের জন্য কাজ করতেন অফিসের ফুটফরমায়েস খাটার জন্য তাকে রাখতেন। ফুটবল মাঠে যখন প্র্যাকটিস করতেন তখনও সাথে রাখতেন। বলটা এনে দেয়ার জন্য, পানির বোতলটা এগিয়ে দেয়ার জন্য। যেখানে যেতেন সাথে নিয়ে যেতেন। স্নেহের পরশ ছিল তার মাথায়।
এই দুঃসহ পরিস্থিতিতে তার কাছে যেন সব কথা বলা যায়। আর যাই হোক তিনি অন্তত দুঃখগুলো বুঝবেন। তার সাথে রাগারাগি করবেন না। সমবেদনা জানাতেও পারেন।
হানীফ তার দুঃসহ অবস্থার কথা বর্ণনা করার ফাঁকে কয়েকবার চোখ মুছল। জনসমক্ষে কখনো কেঁদেছে এমন নজীর নেই। অন্য একটা মানুষের সামনে কাঁদছে এই সঙ্কোচবোধও চোখের পানি আটকাতে পারল না। নবীন ভাই দয়ার্দ্র হলেন না, সান্ত্বনার সুরে বললেন না, ‘কাঁদিস না সব ঠিক হয়ে যাবে। চোখের পানি আগে পড়ছে তাও ভালো, পরে পড়লে কোনো লাভ হতো না। চোখের পানিতে বালিশ ভেজালে কিংবা অর্ধেক রাতে ঘুম থেকে জেগে উঠে বসে থাকলেও না। এ জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় কর। নিজের শক্তি সামর্থ্যের ব্যবহার কর। এখনও সময় আছে যা টেবিলে বস, পড়াশুনা কর পরিস্থিতি পাল্টে যাবে।’
‘কিন্তু এমন হলো কেন? সবাই কেমন রূঢ় আচরণ করা শুরু করল, যে যা বলার উপযুক্ত না তাই বলল। যে যে আচরণ করার যোগ্য না সে সেই আচরণ করল।’
নবীন ভাই সহজ ভাষায় সে উত্তর দিলেন না। বললেন, ‘তুই যদি বোবা, কালা হতি, পড়াশুনা না করে কোনো রিকসার গ্যারেজে কাজ করতি তাহলে কি আমি তোর সাথে এভাবে কথা বলতাম? আমি যদি ভীষণ অসুস্থ হতাম কিংবা ভার্সিটিতে না পড়ে বাসের হেলপার হতাম তুই আসতি আমার কাছে? আমার তোর মধ্যে ভালো সম্পর্ক আছে সত্য, তবু কিছু শক্তি সামর্থ্য, যোগ্যতা আছে বলেই একে অপরের সাথে কথা বলছি। অন্যেরা আমাদের সাথে কী আচরণ করবে সেটা নির্ভর করে আমাদের অবস্থানের উপর। সবাই যখন দেখছে বছরের পর বছর তোর পড়াশুনায় মন নেই, রেজাল্ট খারাপ করছিসÑ লোকজন তোকে কী ভাববে? সে রকম আচরণই করেছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে তখন, যখন তুই ভেবেছিস তোর দ্বারা আর পড়ালেখা হবে না। তখন তুই হয়ে গেছিস একেবারে ফেল্টুস। যে কোনো পরিবর্তনের সূচনা হয় আমাদের মনে। তুই বাস্তবে পড়াশুনা বন্ধ না করলেও যেহেতু তোর মন ও রকম হয়ে গেছে তখন লোকজনের খারাপ ব্যবহার হয়েছে অনেক বেশি। এই হচ্ছে সমস্যা। কিন্তু দ্বন্দ্ব হচ্ছে তুই যে আচরণ পেয়ে অভ্যস্ত সে আচরণই পেতে চাচ্ছিস। দ্বিতীয়ত হতে পারে হতাশা, দুশ্চিন্তা, বিষণœতা, রাগ ক্ষোভের কারণে তুই সঠিক আচরণ করতে পারছিস না। অন্যের আচরণে হঠাৎ রেগে যাচ্ছিস। অন্যের আচরণে মনে হচ্ছে তোকে অবজ্ঞা করছে। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে। ফেল্টুস ভাবার পর তোর গতিপথও পরিবর্তিত হয়ে গেছে। তুই গিয়েছিস সেন্টুর দোকানের পেছনে, আমিরের সাথে গিয়েছিস সমীহ করে কথা বলতে। সিগারেট খাওয়ার চেষ্টা করেছিস। গতিপথ পাল্টে ফেলার দরুণ কুল্যে বদমায়েশ তোর সাথে ইতরামী করার সাহস পেয়েছে। তৃতীয়ত যারা খারাপ আচরণ করছে সেগুলো শক্তভাবে প্রতিরোধ করতে পারছিস না মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকার কারণে। পড়াশুনা না করলে বাপ-মা মারবেই। স্যাররা দেখতে পারবে না। কোনো পিতা-মাতাই চায় না তার সন্তান খারাপ ছেলেদের সাথে মিশুক, পড়াশুনা না করুক, নষ্ট হয়ে যাক। তাই তোর সাথে মিশতে বাঁধা দিয়েছেন। শোন, ওসব চিন্তা বাদ দে। এখন বাসায় যা পড়াশুনা কর। পরিস্থিতি পাল্টে যাবে।’
‘এখন কি পড়াশুনা করতে পারব? বছরের কয় মাস চলে গেছে দেখেছেন? পড়াশুনা এখন মনে হয় আমার দ্বারা আর হবে না।’
‘হবে। অন্যরা পারলে তুই পারবি না কেন? তুই কি ওদের কারও চেয়ে খারাপ ছাত্র ছিলি নাকি? ক্লাস ফাইভেও তো ট্যালেন্টপুলে স্কলারশিপ পেয়েছিলি।’
নবীন ভাই পড়াশুনার কিছু টেকনিক বলে দিলেনÑ যা তিনি বই পড়ে জেনেছেন, অন্য কারও মাধ্যমে জেনেছেন, নিজে পালন করেন। আর কিছু উপদেশ দিলেন যেগুলো প্রায়োগিক।
পনেরো.
ক্যালেন্ডারে সরকারি ছুটির দিনগুলো লাল রঙ করা থাকে। হানীফ লাল কলম দিয়ে ওর সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে ক্রস চিহ্ন দিল। গুনে দেখল পরীক্ষার আগে অনেকগুলো দিন পড়বে না, পড়ার কথা চিন্তাও করবে না। নবীন ভাইয়ের প্রথম উপদেশ সপ্তাহে একদিন ছুটি। একদিন ছুটি থাকলে বাকি ছয়দিন পড়ায় পূর্ণ উৎসাহ পাওয়া যায়।
বইপত্র, সিলেবাস ঘেটে দেখল অনেক পড়া। টার্গেট ঠিক করে পড়তে বসল।
বাসার কেউ কথা বলত না। প্রয়োজন হলে সংক্ষেপে বলত। সেও নিজেকে গুটিয়ে নিল। স্কুল থেকে আসার পর বাসা থেকে বের হতো না, মাঠে খেলতে যেত না। কেউ এসে ডাকতও না খেলার জন্য। স্কুলে একা  একা বসে থাকত। স্যার ক্লাসে না থাকলে কিংবা টিফিন পিরিয়ডে সবাই গল্পগুজব করত, হৈ হল্লা করত। ও বসে থাকত একা একা।
টিভি দেখত না। বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানগুলোও না।
ইন্টার স্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতায় ওদের স্কুল চ্যাম্পিয়ন হল। খেলা নিয়ে অনেক হৈ চৈ হলো। টিম গঠনের সময় ওকে কেউ কিছু বলেনি। খেলা দেখতে মাঠে যেতে বলেনি। ক্লাস টেনের মানু ভাই ছিল ক্যাপ্টেন, ওদের ক্লাসের এহসান ছিল ভাইস ক্যাপ্টেন।
স্কুল ম্যাগাজিন বের হলো। আনোয়ার স্যার প্রচুর পরিশ্রম করে লেখা সম্পাদনা করে প্রেসের সব ঝামেলা সয়ে বের করলেন। ওদের ক্লাসের কয়েকজন কবিতা, গল্প দিল ম্যাগাজিনে। আলমাস দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ইংরেজিতে একটা প্রবন্ধ লিখল। মতিন ছিল বিজ্ঞাপন ম্যানেজার। ওকে কেউ কিছু জিজ্ঞেসও করেনি।
সন্ধ্যার আগে এসে দাঁড়াত বারান্দায়। কখনো ছাদে পাইচারি করত। রাতে আবার রুমে এসে পড়তে বসত।
সোবহান স্যারের বাসায় সকালে পড়তে যেত। সোবহান স্যার ওদের স্কুলেরই টিচার ছিলেন। রিটায়ার্ড করেছেন। তেমন কাজ থাকত তার। গণিতের জটিল, আশ্চর্য বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতেন। ছাত্র-শিক্ষকের আলোচনা জমত ভালো।
পৃথিবী চলছিল নিজের গতিতে। তার জন্য কোনো কিছু থেমে ছিল না। পাখির কলকাকলি থেমে ছিল না একদিনের জন্যও। কারও খাওয়া-দাওয়া বন্ধ ছিল না, হাসি বন্ধ ছিল না। শুধু সে ছিল না কোনো কিছুতে।
এক  বিকেলে ছাদে হাঁটছিল। দুই বাসা পুবে তিনতলা বাসায় আলোকসজ্জা দেখল, গেট সাজানো হয়েছে। সাজানো দেখে বুঝল বিয়ে বাড়ি। সন্ধ্যা পেরুনোর আগেই দেখল গেটের সামনে ঝলমল পোশাকের লোকজন। আজ গায়ে হলুদ হয়ত। গেটের সামনে ভিডিও করা হচ্ছে। নওশাদকে দেখল ভিডিও ক্যামেরার সামনে। নাফিজ, জুয়েলসহ আশেপাশের বাসার সব ছেলেরাই আছে বড়দের পাশাপাশি।
সে জানত না। বিয়ের দাওয়াত পেয়েছিলেন হানীফের আব্বা, গিয়েছিলেনও। অনেক হৈ চৈ, আমোদ আহ্লাদ হলো। ওর যাওয়া হয়নি।
এরপরও ভালো কিছু লক্ষণ দেখা গেল। প্রথম যেটা হলো স্কুলে পড়া না পারার একটা প্রবণতা হয়ে গিয়েছিল। সেটা দূর হলো। স্যারেরা মারধর করার সুযোগ পেলেন না। বকাবকিও করার সুযোগ পেলেন না।
এর অনেক পরে স্কুলে ইসহাক এসেছিল কথা বলতে, ও কিছু বলেনি। নি¯পৃহভাবে কথা বলেছে। যাতে আর কখনো কথা বলতে না আসে।
পরীক্ষার আগে এক দুপুরে হানীফ রুমে বসে পড়ছিল। জানালা দিয়ে দেখল গেট দিয়ে ঢুকছে  হাবলু। মলিন চেহারা। হাবলুর সাথে অনেকদিন দেখা হয়নি। কারণ সে স্কুলে যায় না। হানীফ ওদিকে তাকাল না। উঠে গেল না কলাপসিবল গেট খুলতে। হাবলু কলিং বেল টিপল না। রুমের জানালার সামনে দাঁড়াল।
হানীফ নিস্পৃহভাবে বলল, ‘ভেতরে আয়।’
হাবলু এলো না। বলল, ‘ভেতরে আসব না। তোর খবর শুনেছি। খুব ভালো লেগেছে পড়াশুনা করছিস।’
‘কী খবর তোর?’ জিজ্ঞেস করল হানীফ। ‘গাঁজা ছেড়ে হেরোইন ধরেছিস?’
হাবলু বলল, ‘গাঁজা খাই না।’
হানীফ সচকিত হলো। বলল, ‘কেন?’
হাবলু বলল, ‘গাঁজা টেনে কী হবে? ভবিষ্যৎ পরিণতি কী? আজ গাঁজা টানছি কাল হেরোইন খাব। গাঁজার টাকার জন্য এখনই বাসা থেকে চুরি করি, ক’দিন পর বাসা থেকে যখন চুরি করতে পারব না তখন শফির সাথে ছিনতাই করব। ছিনতাই করতে গিয়ে পাবলিকের হাতে ধরা পড়ে গণপিটুনিতে প্রাণ হারাব। বেঁচে থাকলে অথবা ধরা না পড়লে বড় সন্ত্রাসী হব। জীবনটা এভাবে নষ্ট করব কেন?’
হানীফ তন্ময় হয়ে শুনছিল। বলল, ‘হঠাৎ এই পরিবর্তন। ধোলাইয়ের ডোজ বেশি পড়েছে?’
হাবলু ঠাট্টায় গেল না। বলল, ‘ধোলাই দিলে কাজ হতো না। ধোলাই তো আর কম দেয়নি। মামা এসেছিলেন বাসায়। আমার অবস্থা শুনেছিলেন হয়ত। একরাতে বাসায় ফিরলে তিনি একাকী আমার সাথে আলাপ করলেন। ত্রিশ বছর আগেও গাঁজা ছিল, ছাত্র ছিল। তার দু’জন সহপাঠীর তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরলেন। একজন এখন ভার্সিটির টিচার। অন্যজন রাজমিস্ত্রি। ক্লাস নাইনে উঠে যে গাঁজা ধরেছিল কলেজের গণ্ডি পেরুবার সুযোগ তার হয়নি। ত্রিশ বছর পর আমার অবস্থান বেছে নেয়ার সুযোগ দিলেন। তিনি আমার উপর জোর করলেন না, ধমক দিলেন না। তার বুঝানোর মাঝে কেমন যেন একটা মাদকতা ছিল। আমি আকৃষ্ট হয়ে গেলাম। তুই পড়াশুনা করছিস আশাকরি ভালো করবি। আমিও আশা করি ফেল করব না। আরও আগে পড়তে বসলে হয়ত আরও ভালো করতাম। যাই হয়েছে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। আরও পরেও তো পড়তে বসতে পারতাম। তখন থেকে পড়লে হয়ত পাসও করতে পারতাম না। এর মাঝে মনে হলো তোর সাথে অনেকদিন দেখা হয়নি, দেখা করে আসি। আসি।’
হানীফ বলল, ‘ভেতরে আয়।’
হাবলু বলল, ‘না। তোর নিশ্চয় ডিস্টার্ব হচ্ছে। এখন কারও সাথে দেখা করার নিশ্চয় কথা ছিল না।’
চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে ফিরে তাকাল। বলল, ‘ইসহাকের খবর জানিস?’
‘ভালো আছে। হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষায় ভালো করেছে। ফাইনালেও ভালো করবে।’
‘ওর আব্বা-আম্মা বড় ভাইয়া খুব টাইট অবস্থায় রেখেছে। আমি ভয়ে ত্রিসীমানায় ঘেষিনি।’
হানীফ বলল, ‘তুই গাঁজা ধরেছিলি কেন?’
‘এক বিভ্রান্তিকর অবস্থার মধ্যে। যখন তুই বললি বড়বাড়ির চারদিকে নজর রাখতে সেদিন খুব সকালে বেরিয়েছিলাম সাইকেল নিয়ে। দুপুরে যখন বাসায় ফিরলাম তখন বাসায় এসে দেখি প্রচণ্ড রাগারাগি চলছে। স্কুলে যাইনি এক অপরাধ তার উপর ছোট বোনটা চাকু দিয়ে হাত কেটে ফেলেছে। সেই রাগ ঝাড়ল আমার উপর। আমি বড় বাড়িতে যাওয়ার জন্য চাকু যোগাড় করেছিলাম, সেই চাকু কেমন করে ওর হাতে পড়ে। বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম ফুফুর বাসায়। ফুফুর বাসায়ও দেখলাম কেমন বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে। চলে এলাম সেখান থেকেও। মন খারাপ করে বসেছিলাম লাভলু ভাইয়ের দোকানের সামনে। এর মধ্যে শফি এসে বলল, ‘হাবলু একা বসে আছিস মুখ ভার করে, মন খারাপ?’ আমি কথা বলছিলাম না। ও আবার বলল, ‘সমস্যা হলে সমস্যার সমাধান আছে, মন খারাপ হলে ভালো করার মেডিসিন আছে। দুনিয়াতে এতো মজা থাকতে মন খারাপ করে বসে থাকবি কেন? নে একটা টান দে।’ একটা সিগারেট আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। আমি নিচ্ছিলাম না। ও আরও অনেক কথা বলছিল। আমিও ভেবে দেখলাম জায়গা যেহেতু কোথাও মিলছে না, এখানেই যোগ দেই। সিগারেট হাতে নিলাম। প্রথম প্রথম ওই আমাকে সিগারেট দিত। কিনতে হতো না। গাঁজাও দিত। খেতে খেতে নেশা হয়ে গেল। তখন ওরা দিত না। আমি নিজে কিনে খাওয়া শুরু করলাম। সেই ছিল শুরু।’
ষোলো.
পরীক্ষার দিন সকাল বেলা কেমন যেন স্বপ্নবিভ্রম মনে হচ্ছিল। এই যে টেবিলে বইপুস্তক, এই দৃশ্য আগেও দেখেছে। মনে পড়ে ক্লাস ফাইভে বার্ষিক পরীক্ষার দিনগুলোতে সে এমনিভাবে সারা বই একবার রিভিশন দিয়ে যেত। পরীক্ষাগুলো হতো খুবই ভালো। সে রকম একটা দিন মনে হচ্ছিল।
নাস্তার টেবিলে দেখল ওর আব্বা নাস্তা শেষ করেছেন প্রায়। হানীফকে দেখে বললেন, ‘কী পরীক্ষা, সাধারণ গণিত?’
‘জ্বী’ বলে মাথা নাড়ল হানীফ।
‘তাড়াহুড়ো করিস না। উত্তর দেয়া শেষ হলেও পরীক্ষার সময় থাকতে হল থেকে বের হবি না। বারবার খাতা উল্টে দেখবি কোথাও শূন্য দেয়া বাদ পড়ে গেছে কিনা। যোগের জায়গায় বিয়োগ হয়ে গেছে কি না। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে কলম, পেন্সিল, জ্যামিতি বক্স যা লাগে নিয়ে যাবি। ভুল করে কিছু ফেলে রেখে যাস না।’
পরীক্ষার আগে অনিবার্য সব উপদেশ। তবু স্মরণ করিয়ে দেয়া। ব্যাগ নিয়ে অফিসে রওয়ানা হওয়ার আগে ওর আম্মার সাথে কথা শেষ করে ওর দিকে ফিরে বললেন, ‘আল্লাহ হাফেজ।’
পরীক্ষার হলে স্থির হয়ে বসে ছিল হানীফ। আশেপাশে অন্য ছাত্রদের চাঞ্চল্যপূর্ণ কথা ওর কানে আসছিল। সে গায়ে লাগাল না। স্যার এলেন খাতা হাতে।
স্যার খাতা দিলে খাতায় নাম রোল লিখে বসেছিল। ঘণ্টা বাজলে প্রশ্ন দিলেন স্যার। প্রশ্নে চোখ বুলিয়ে দেখল প্রতিটা অঙ্কা সে পারবে। প্রথম থেকেই উত্তর লিখতে শুরু করল। অঙ্কগুলো করা শেষ করেও চুপ করে বসেছিল ওর আব্বার কথা মতো। আবার কেন জানি স্বপ্নবিভ্রমের মতো লাগল। এমন দিন যেন সে আগেও কখনও কাটিয়েছে।
পরীক্ষার হল থেকে বের হওয়ার সময় সামনে দু’জনের কথাবার্তা কানে এল। অঙ্কের রেজাল্ট মিলাচ্ছিল। একজন বলল, ‘যাহ অঙ্কটা ভুল হয়ে গেল।’
হানীফ কিছু বলল না। তবে মনে মনে বলল, একটা অঙ্ক ভুল হওয়া মানে অনেক নম্বরের হেরফের হওয়া।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর পড়াশুনা থেকে সাময়িক ছুটি। বিগত দিনগুলোর পড়াশুনার চাপের পর মন হালকা লাগছিল। এখন সারাদিন খেললেও কেউ বকবে না, সকাল বেলা গল্পের বই পড়লেও ওর আম্মা লাঠি নিয়ে আসবেন না। সন্ধ্যারাত থেকে ঘুমিয়ে সকাল বেলা উঠলেও রাগারাগি করবেন না।
হানীফ বাসা থেকে খুব একটা বের হতো না। কারও সাথে দেখা করতে যেত না, মাঠে খেলতে যেত না।
সন্ধ্যায় বসে ছিল ছাদে। পশ্চিম আকাশের লাল আলোর রেখা মিলিয়ে গিয়ে অন্ধকার নেমে এসেছে তখন। বাসা বাড়ি, রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের বাতি জ্বলে উঠেছিল অনেক আগেই। দেখল নইমুদ্দি, খালেদ, ইদ্রিস ব্যাডমিন্টনের র‌্যাকেট হাতে গল্প করতে করতে টিএনটি অফিসের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। টিএনটি অফিসের সামনের ফাঁকা জায়গায় এবারও কোর্ট কেটেছে খেলার জন্য। লাইট জ্বালিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত ব্যাডমিন্টন খেলবে। অলি, জনি, নতুনদের দেখল ওদের বাসার ভেতরে অল্প জায়গায় স্ট্যাম্প গেড়ে ক্রিকেট খেলছে।
এদের দেখে বিষণœ হলো। একবার মনে হলো যাবে নাকি সব ভুলে এদের সাথে খেলতে? বলবে, ‘আমায় নিবি তোদের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলায়? খরচ আমিও সমান দেব।’ আবারও কি অপমানিত হতে চায়? ভেতরে ভেতরে হাঁসফাস করল।
পাশের রুম থেকে ওর আম্মা ডেকে বললেন, ‘স্কুলে যা।’
আম্মা চেয়ারে বসে সোয়েটার বুনছিলেন। হানীফ তার কথা ঠিকভাবে শুনল না। হানীফের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আবার ডাকলেন, ‘রেজাল্ট দিবে ছেলেরা সেজেগুজে কত আগ্রহ ভরে স্কুলে যাচ্ছে, সেদিকে কোনো খেয়াল নেই?’
স্কুলের কথা শুনে বিরক্ত হয়েছিল। রেজাল্টের কথা শুনে মনে হলো তাই তো, আজকে রেজাল্ট দিবে। গোসল করার সময় ছিল না। হাত-মুখ ধোয়ে রওয়ানা হল স্কুলে।
স্কুলে কারো হাতে বই-খাতা নেই। পড়া মুখস্থ বলতে হবে না, হোমওয়ার্ক দেখাতে হবে না বলেই যেন আনন্দ বেশি। স্কুলের সামনের মাঠে, করিডোরে বিভিন্ন স্থানে জটলা করে কথা বলছিল সবাই। রেজাল্টই আলোচনার মুখ্য বিষয়। কে ফার্স্ট হবে, কে সেকেন্ড, কে থার্ড এসব অনুমান করছিল। একেকজন একেক রকম বলছে।
হানীফ যখন স্কুলে পৌঁছল তখন ছাত্ররা সব ক্লাসে চুপচাপ বসে আছে। হেডস্যার এলেন রেজাল্ট ঘোষণার জন্য। যারা প্লেসে আছে তাদের নাম তিনি ঘোষণা করেন। বাকিদেরটা ক্লাস টিচার।
ক্লাসে পিনপতন নীরবতা। সবাই অপেক্ষা করছিলÑ কী ঘোষণা করবেন হেডস্যার। কার নাম প্রথমে ঘোষণা করবেন। কিন্তু তিনি যে নাম প্রথমে ঘোষণা করলেন তাজ্জব বনে গেল সবাই। ক্লাস টিচারও। প্রথম হয়েছে মোহাম্মদ হানীফ।
হানীফ ভালো করবে এমন একটা আভাস পেয়েছিল সবাই, পরীক্ষার আগে ক্লাসগুলোতে ওর রেসপন্স দেখে তাই মনে হয়েছিল। কিন্তু এতটা ভালো করবে ভাবতে পারেনি কেউই। দ্বিতীয় আলমাস, তৃতীয় মতিন। চতুর্থ রাফিদ পেছনে চলে গেছে। তার স্থানে উঠে এসেছে খালিদ। ইসহাক প্লেসের পর পরই। বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই লাগল খানিকক্ষণ। কী শুনল সবাই! অবশ্য এতো বিস্ময়ের কিছু নেই। এক সময় যে প্রথম ছিল সে তার স্থান পুনর্দখল করে নিয়েছে।
হানীফ একদম স্বাভাবিক। যেন এ রেজাল্টের জন্যই অপেক্ষা করছিল। কিংবা এমনটি না হলেও সে দুঃখিত হতো না।
সতেরো.
গত দু’দিনে তিনবার চেষ্টা করেও নবীন ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারল না হানীফ।
নবীন ভাইদের বাসার বাগান পেরিয়ে বারান্দায় এলে নবীন ভাইয়ের আব্বার হানীফ মুখোমুখি হয়ে গেল। তিনি বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। তাকে দেখেই চমকে গেল। রাশভারী স্বভাবের এই লোকের সামনে সে পড়তে চায় না। বরফ-শীতল গম্ভীর গলায় কথা বলেন, শুনলেই দুনিয়াটা নিরানন্দ লাগে। দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া শোভনীয় হবে না মনে করে সালাম দিল। পত্রিকার পাতা থেকে মুখ তুলে তাকালে দৃষ্টির গম্ভীরতায় ঝাঁকুনি খেল সে। দেখে হয়ত চিনতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু চিনলেন না, এটা নিশ্চিত। নবীন ভাইয়ের কাছে যখন ঘনঘন আসত তখন অনেকবার পরিচয় দিয়েছে। এরপরও পরবর্তীতে আসলে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করতেন, ‘কী নাম?’
হানীফ জিজ্ঞেস করল, ‘আঙ্কেল ভালো আছেন?’
সংক্ষেপে বললেন, ‘ভালো।’ তখনো তার দৃষ্টিতে না চেনার ছাপ। কিন্তু জিজ্ঞেস করছেন না। হানীফ বুঝতে পেরেও পরিচয় দিল না। বরং আবার জিজ্ঞেস করল, ‘নবীন ভাই কি বাসায় আছেন?’
তিনি পত্রিকার পাতায় চোখ নামিয়ে বললেন, ‘ওর রুমে দেখ। টিকিট বুকিং দিয়ে ফিরেছে।’
‘টিকিট বুকিং? নবীন ভাই কোথাও যাচ্ছেন?
‘ও কানাডা চলে যাচ্ছে।’
হানীফরে মুখ থেকে অনিচ্ছাকৃতভাবে প্রশ্ন বেরিয়ে এলো, ‘কেন?
‘ট্রিনিটি ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করবে।’
খুশির কথা। হানীফের কেন যেন খারাপ লাগল। কানাডা চলে গেলে তো যখন খুশি দেখা করতে পারবে না, কথা বলতে পারবে না। মনে হলো একটা ছায়া তার উপর থেকে চলে যাচ্ছে।
বিছানায় অনেক কাগজপত্র, ফাইল ছড়ানো। নবীন ভাই একটা একটা করে দেখে ফাইলে গুছিয়ে রাখছিলেন। দরজায় দাঁড়িয়ে হানীফ সালাম দিল। সালামের জবাব দিয়ে ক্লান্ত গলায় নবীন ভাই বললেন, ‘আয়।’
হানীফ রুমে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, ‘খুব ব্যস্ত?’
নবীন ভাই বললেন, ‘না, তেমন না। তোর কী খবর?’
হানীফ শার্টের বুক পকেট থেকে রেজাল্টশিট বের করে এগিয়ে দিল। রেজাল্টশীটে চোখ বুলিয়ে ক্রমশ তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, হাসির রেখা ফুটে উঠল মুখে। উচ্ছ্বসিতভাবে বললেন, ‘এই তো চাই। এই তো চাই! স্থির লক্ষ্য আর একাগ্র চেষ্টা মানুষকে সব সময়ই সফল করে। সাহসী মানুষেরাই পৃথিবীর নানা রহস্যের অবগুণ্ঠন উন্মোচন করেছে। পালতোলা জাহাজে করে দুঃসাহসে যারা নতুন পৃথিবী আবিষ্কারে বেরিয়েছিল তারাই আবিষ্কার করেছে নতুন নতুন দেশ। জীবন জয়ে চাই সাহস। যারা সাহসের সাথে স্বপ্ন দেখে তারাই হয় ব্যতিক্রম। সাহসী মানুষেরাই হয় সবার শ্রদ্ধা, সম্মানের পাত্র।’ নবীন ভাই বলে চলছিলেন, ‘যোগ্যতাকেই মানুষ সম্মান করে। ও তোকে তো বলাই হয়নি আমি কানাডা চলে যাচ্ছি।’
হানীফ ছোট্ট করে বলল, ‘তাই তো শুনলাম।’
কথা বলতে বলতে নবীন ভাইয়ের গলার স্বর নিচু হয়ে এলো। কাগজপত্র গুছাতে গুছাতে শুধু বললেন, ‘নিজের শক্তি সামর্থ্যরে উপর নির্ভর কর। নিজের সম্ভাবনা বিকশিত করার গতি সচল রেখে সকল কাজ কর। নিজের সম্ভাবনা বিকাশের গতি রুদ্ধ করে কোনো কিছু করতে গেলে এমনকি ভালো কাজও করতে গেলে মুখ থুবড়ে উল্টে পড়বি।’
নবীন ভাইকে তার কাজ শেষ করার সময় দিতে গল্প থামিয়ে  হানীফ চেয়ার ছেড়ে উঠে বুক-শেলফের সামনে দাঁড়াল। এর আগে যতবার এ বাসায় এসেছে তখন বই দেখার আগ্রহ ছিল না। নাড়াচাড়া করে শেলফ থেকে একটা বই বের করল। চমৎকার গ্লোসি পেপারের মোটা বই। ইংরেজি হওয়াতে সব বুঝতে পারছিল না। কিন্তু পাখির ছবিগুলো আকৃষ্ট করল। পাখি, পাখির বাসা, ডিম, বাচ্চা পর্যবেক্ষণের ইন্সট্রুমেন্ট দেখে ভাবনার জগৎ প্রসারিত হচ্ছিল। হানীফ অভিভূত হয়ে বলল, ‘পৃথিবীতে এতো প্রজাতির পাখি আছে আমার ধারণাই ছিল না। পাখিগুলোর আকার, আকৃতি, রং, বৈশিষ্ট্য, বৈচিত্র্যময়তা দেখে পাখির প্রতি আগ্রহ জাগছে।’
নবীন ভাই ফাইলপত্র, আলমারির ড্রয়ারে রেখে বিছানায় বসে বললেন, ‘পাখি সম্পর্কে জানবি।’
হানীফ মাথা নেড়ে আপত্তি জানিয়ে বলল, ‘আমার লক্ষ্য অরনিথলজি নয়, আর্কিটেকচার।’
স্বল্পবুদ্ধিতার জন্য অন্য কেউ হলে হয়ত উপহাস করত। নবীন ভাই করলেন না। বললেন, ‘আর্কিটেক্ট হলেই কি অরনিথলজি সম্পর্কে জানা যাবে না? মানুষ পাখির উড়াউড়ি দেখেই প্রথম উড়ার স্বপ্ন দেখেছিল। পাখির উড়বার কৌশল দেখেই বিমানের ডিজাইন এঁকেছিল। একই বিষয় থেকে বিভিন্নজন বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে। পাখি দেখে জুওলজিস্ট পাখির বায়োলজিক্যাল বিষয় নিয়ে চিন্তা করে, চিত্রশিল্পী ছবি আঁকে, কবি কবিতা লেখে, শিকারী শিকার করে। তুইও হয়ত পাখির বাসার আর্কিটেকচারাল ডিজাইন দেখে নতুন কোনো ডিজাইনের বাড়ি বানানোর ধারণা পেয়ে যেতে পারিস। মেরু অঞ্চলের পাখিদের ফিজিওলজিক্যাল ক্যারেক্টারেস্টিকস দেখে মেরু অঞ্চলের উপযোগী বাড়ি বানানোর বুদ্ধি মাথায় আসতে পারে।’
হানীফ খুশি মনে বলল, ‘মেরু অঞ্চলের পাখি দেখার সাথে মেরু এলাকাও দেখা হবে। আফ্রিকার গহীন অরণ্যের পাখি দেখতে গেলে গহীন অরণ্য দেখা হবে।’
নবীন ভাই বললেন, ‘আমি পড়াশুনা করতে যাচ্ছি ব্যক্তিগত খরচে। মামা সুযোগ করে দিয়েছেন। গিয়ে উঠব মামার কাছে। তোর সুযোগ আছে গৌরবজনক উপায়ে পড়াশুনার সুযোগ গ্রহণের, স্কলারশিপের। যোগ্যতাকে সুযোগ সব সময় হাতছানি দিয়ে ডাকে। ওমর খৈয়াম ছিলেন একজন বিখ্যাত গণিতশাস্ত্রবিদ, এনালাইটিক্যাল জিওমেট্রির উদ্ভাবক। তাই বলে কি তিনি কবি হননি? এখন তো সবাই তাকে কবি হিসাবেই জানে। শোন্, অর্থহীন কথা কাজ বাদ দিলে প্রচুর সময় পাবি। যখন কোনো কাজে সফল হবি দেখবি কাজ করতে আরো ভালো লাগছে। একটা সাফল্য দশটা সাফল্যের পথ খুলে দেয়। কোনো কাজ না পারা গর্বের বিষয় নয়, পারাটাই গর্বের।’
আঠারো.
বাসায় ফিরে দেখল ছোট চাচা বিছানায় শুয়ে আছেন। হানীফ বিস্ময়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মুহূর্তকাল। এমন সময় তাকে বাসায় দেখবে ভাবেনি। বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে আনন্দে লাফিয়ে উঠে বলল, ‘ছোট চাচা! কখন এলেন?’
ছোট চাচা হানীফের বিস্ময়, আনন্দ দেখেও খুশি হলেন না। হালকাভাবে বললেন, ‘এই মাত্র।’
যেমনভাবে শুয়ে ছিলেন তেমনিভাবেই শুয়ে রইলেন। পাশ ফিরে চোখ তুলে তাকালেনও না। হানীফ অভিযোগের সুরে বলল, ‘আপনি আসবেন আগে জানাননি কেন?’
‘জানিয়েছি।’
‘কোথায়, আমাকে তো কেউ কিছু বলেনি।’
‘না জানালে আমি কী করব?’
ছোট চাচা বিছানায় চোখ বুজে রইলেন। জার্নি করে আসায় পরিশ্রান্ত। এখন হয়ত ঘুমুবেন। হানীফ অপেক্ষা করছিল তার রেজাল্টের খবর জানতে চান কি না। ঘুমিয়ে পড়েছেন ভেবে রুম থেকে চলে যাওয়ার মুহূর্তে বিছানায় উঠে বসলেন। মনে হলো এবার বুঝি জানতে চাইবেন ওর রেজাল্টের খবর। তিনি বিছানা থেকে নেমে ব্যাগ থেকে কাপড় বের করলেন গোসল করার জন্য। হানীফ ধৈর্য ধরে থাকতে না পেরে বলল, ‘ছোট চাচা, আমার কোনো খবর জানতে চাইলেন না যে।’
‘কী জানতে চাইব?’
‘আমার রেজাল্টের খবর।’
‘তোর রেজাল্টের কী খবর?’ এমনভাবে জিজ্ঞেস করলেন যেন জানার কোনো আগ্রহ নেই তার।
‘আমি প্রথম হয়েছি।’
‘প্রথম হয়েছিস? ভালো।’ আবারও তিনি ভাবলেশহীনভাবে বললেন।
‘আমার পুরস্কার?’
‘কিসের পুরস্কার? ক্লাস ফোর ফাইভে এমন ফার্স্ট-সেকেন্ড হলে কিছুই হয় না।’
হানীফ বাধা দিয়ে বলল, ‘ক্লাস নাইন।’
‘ওই একই কথা। এখন ফার্স্ট হলেই কি, লাস্ট হলেই কি? কোন দাম নেই। এসএসসি, এইচএসসিতে ভালো করলে দাম আছে। তখন ভালো করলে আসিস, চিন্তা করে দেখব কী করা যায়।’
হানীফ রীতিমতো থমকে গিয়ে বিছানায় বসে পড়ল। এ কেমন করে কথা বলছেন ছোট চাচা। যেন অচেনা কোনো মানুষ। ছোট চাচা তো এমন ছিলেন না। একটা সাফল্যে উৎসাহ দিবেন তা না করে কেমন খাটো করে দেখছেন। সাফল্য ছোট হোক বড় হোক অন্যকে উৎসাহিত করতে হয় এই বিষয়টাও ভুলে গেছেন?
ােট চাচা বোধ হয় হানীফের মুখাবয়ব খেয়াল করছিলেন। বললেন, ‘তোর রেজাল্টের খবর পেয়েছি গত পরশুদিন। তোর আম্মা ফোন করে জানিয়েছেন। তুই তো আমাকে খবরটা দিলি না। আমার সাথে একবারও কথা বললি না।’
হানীফ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। রেজাল্টের খবরটা যে ছোট চাচাকে দেওয়া প্রয়োজন কিংবা কথা বলা প্রয়োজন, এ কথাটা খেয়ালই ছিল না। ছোট চাচার দিকে তাকাল কতটুকু রাগ করেছেন দেখার জন্য। তার চেহারায় রাগের কোনো ছাপ না দেখে হানীফ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘তাহলে এতক্ষণ এসব বলছিলেন যে।’
‘তুই আমাকে স্মরণ রাখিস না, আমি তোর খোঁজখবর রাখব কেন?’
হানীফ ভুল স্বীকার করে অনেকটা ক্ষমা চাওয়ার মতো করে বলল, ‘ভুল হয়ে গেছে ছোট চাচা। আমার খেয়াল ছিল না।’
‘কী পুরস্কার চায়?’
ওকে এভাবে পুরস্কার বেছে নেয়ার দায়িত্ব দেয়ায় খানিক চিন্তিত হলো। হঠাৎ করে এমন সুযোগ আসবে ভাবেনি। এমন কিছু চাওয়া বোকামি হবে যা জোরজবরদস্তি করে সে যে কোনো সময় আদায় করতে পারবে। আবার যা চাইবে তাই দেবেন তাও তো না। অনেক ভেবে বলল, ‘লোনা পানির হাওয়া খাব।’
অপ্রত্যাশিত উত্তর এলো, ‘মঞ্জুর।’
হানীফ খুশির ধাক্কা সামলে বলল ‘পনেরো দিন থেকে আসব।’
ছোট চাচা এতে রাজী হলেন না। বললেন, ‘এতো লম্বা ছুটি নিতে পারব না। পনেরো দিন হবে না, চারদিন।’
লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে হল হানীফের । বলল, ‘তাই হবে।’
এত সহজে রাজি হয়ে যাবেন ভাবেনি। তবে কি তাই সত্যি যে প্রবল স্পৃহা সুযোগ সৃষ্টি করে? চেষ্টা করলে তাহলে তার বড় লক্ষ্যও পূরণ সম্ভব। ওর মন কল্পনায় চলে গেল সমুদ্র সৈকতে। হু হু করে বাতাস বইছে। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউগুলো এসে আছড়ে পড়ছে বালুকাময় তীরে। আকাশের নীল রং সাগরের পানিতে মিশে পানি নীল দেখাচ্ছে। নবীন ভাইয়ের রুমে দেখা সমুদ্রের ছবিটার কথা মনে পড়ে গেল। এখন সে রকম একটা সমুদ্র দেখবে কাছ থেকে। কখন যাত্রা শুরু হবে তার জন্য এখন শুধু অপেক্ষা। তার আগে এখানের কাজগুলো শেষ করতে হবে।
ছোট চাচা কথাবার্তা এবং খাওয়া-দাওয়া সেরে রুমে ফিরলে হানীফ এসে বসল বসল পাশে। বলল, ‘আমরা কোথায় কোথায় যাব? পুরো ভ্রমণের পূর্ব-পরিকল্পনা থাকলে ভালো হত না?’
‘তুই পরিকল্পনা করে ফেল। প্রথম দু’দিন থাকব সী বীচে।
হানীফ দাঁড়িয়ে বলল, ‘একটু থামুন, আমি খাতা-কলম নিয়ে আসছি।’ দৌড়ে ওর রুম থেকে খাতা-কলম নিয়ে এলো। খাতায় লিখে বলল, ‘সমুদ্রে সাঁতার কাটব?’
‘তা তো বটেই। সুইমিং কস্টিউম আছে না?’
‘না। ওসব লাগবে না। ট্রাউজার দিয়েই কাজ চালিয়ে নেব। থাকব কোথায়? হোটেলে?’
‘হুঁ। ইচ্ছে করলে আমার এক কলিগের বাড়িতে থাকতে পারি। কিন্তু যেতে চাইছি না। একেবারে সমুদ্রের কাছে কোনো হোটেলে উঠব। সী ভিউ স্যুট থেকে যাতে সমুদ্র দেখা যায়। সকালের ঘুম ভাঙবে সমুদ্রের গর্জন শুনে।’
‘ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া।’
‘তারপর যাব হিমছড়ি। সেই সাথে কক্সবাজার শহরটা ঘুরে ঘুরে দেখব। এরপর যাব সেন্টমার্টিন। সেন্টমার্টিনে একদিন থাকব। এসবের ফাঁকে ডুলাহাজরা সাফারি পার্কটা দেখতে হবে। এই মোটামুটি।’
‘সাথে কী কী নিতে হবে? আমার তো অভিজ্ঞতা নেই।’
‘টুথপেস্ট, টুথব্রাশ থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র। শীতের কাপড়-চোপড় তো লাগবেই। যে কোনো ভ্রমণের জন্য অপরিহার্য ফাস্ট-এইড বক্স নিতেই হবে।’
ওর আম্মা রান্নাঘর থেকে এসে বললেন, ‘কী কথা হচ্ছে চাচা ভাতিজাতে?’
ছোট চাচা বললেন, ‘প্ল্যান-প্রোগ্রাম। কক্সবাজার যাচ্ছি আমরা।’
‘ভালো তো যাও। কিন্তু আমরা বাদ থাকব কেন?’
‘আপনারা তো পরীক্ষায় প্রথম হতে পারেননি।’
হানীফের আম্মা যেন বিষয়টা বুঝলেন। বললেন, ‘তাই বলো।’
বাসার কলিংবেল বেজে উঠল সাথে কিছু ছেলের হইচই, চেঁচামেচি। হানীফ উঠে গেল। ব্যাট, বল, স্ট্যাম্পসহ জহির, নাফিজ, রায়হান ও আশেপাশের বাসার কিছু ছোট ছেলে এসেছে। হানীফকে দেখে রায়হান বলল, ‘হানীফ ভাইয়া, মসজিদের পূর্ব পাশের বাসার ছেলেদের  সাথে আমাদের খেলা আছে, আমাদের সাথে খেলতে হবে। চলুন।’
‘এখন আমি খুব ব্যস্ত আছি। খেলতে পারব না।’
‘না কেন? আমরা হারব কেন? আমাদের একটা মানইজ্জত আছে না? মসজিদের পূর্ব পাশের বাসার  মুসা, আইয়ুব বেশি লাফালাফি করছিল। আমরা নাকি কিছুই খেলা জানি না। ওদের বড় বড় কথায় বিরক্ত হয়েই না খেলার কথা বললাম। আমাদের দলে কোনো বড় প্লেয়ার নাই।’ বাকিদের দিকে নির্দেশ করে বলল, ‘এরা তো ঠিকমত ব্যাটই ধরতে পারে না। বোলিং করতে গেলে বল পিচের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তেই নিতে পারে না।’
‘আমি কক্সবাজার যাচ্ছি বেড়াতে। প্রস্তুতির কাজ আছে ।
‘কক্সবাজার!কবে?’
‘পরশু দিন।’
‘তাহলে আজ খেলতে অসুবিধা কী?’
‘প্রস্তুতির ব্যাপার আছে না? কক্সবাজার যাব বললেই তো ব্যাগে দু’টো শার্ট, প্যান্ট ভরে দৌড় দেওয়া যায় না।’
রায়হান বলল, ‘কক্সবাজার থেকে ফিরে এলে আমরা আরেকটা খেলা খেলব। তখন কিন্তু না করতে পারবেন না।’
হানীফ বলল, ‘তখন দেখা যাবে।’
বাক-বিতণ্ডা আর তর্ক বিতর্কে পাখির মতো কিচির মিচির করতে করতে সবাই বেরিয়ে গেল।
ঊনিশ.
আপন মনে ছবি আঁকছিল হানীফ। বেড়াতে যাওয়ার আগেই ছবিটা শেষ করতে হবে।
হাবলু রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে কাকে যেন ডাকল, ‘আয়’
হাবলুর কথা শুনে হানীফ  ইজেল থেকে ঘাড় ফিরে তাকাল। ইসহাক রুমে প্রবেশ করলে হানীফ ক্ষোভ মিশ্রিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ওর দিকে।
ইসহাক বুঝতে পেরে  বলল, ‘আশা করি রাগ করিসনি।’
হানীফ যে ক্ষোভভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল তা ধরে রাখতে পারল না। অস্ফুটভাবে বলল, ‘না।’ তবে গলার স্বরটা ভারী হয়ে এলো।
ইসহাক তার অবস্থা বোঝানোর চেষ্টা করে বলল, ‘খুব সতর্ক প্রহরার মধ্যে রেখেছিল। কেমন সতর্কতা বুঝতে পারছিস? বাইরে বের হতে দিত না, বিকেলে খেলা ছিল বাসার মধ্যে। স্কুলে কার সাথে মিশি এটাও খেয়াল রাখতেন। তোদের কারও সাথে মেশার ব্যাপারে ছিল কড়া নিষেধাজ্ঞা। লঙ্ঘন করার সাহস হয়নি। তাছাড়া স্কুলে তোর সাথে কয়েকবার কথা বলার চেষ্টাও করেছিলাম তুই কেমন এড়িয়ে গেলি।’
হানীফ গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমি জানি। এখন এসেছিস কেন?’
‘এখন তো সমস্যা নেই। পরীক্ষা শেষ, রেজাল্টও খারাপ করিনি। তোর অবস্থাতো আরও ভালো। এখন মনে হয় আব্বা-আম্মার শাসনে ভালোই হয়েছে। নইলে পড়াশুনা হয়ত খারাপ করতাম।’
হাবলু হানীফকে বলল, ‘চল, একটু হাঁটব।’
‘শীতের রাত কনকনে ঠাণ্ডা। কোথায় যেতে চাস?’
‘বিশেষ কোথাও না। একটু হাঁটব আর কি। বড়বাড়ির ওদিকে যাব।’
হানীফ চেয়ার ছেড়ে উঠছিল, বড়বাড়ির কথা শুনে অর্ধেক পথে থেমে গেল। বলল, ‘মনে আছে?’
‘সব মনে আছে। বড়বাড়িতে গিয়ে ধরা খেয়েই এই অবস্থা।’
‘কী হয়েছিল সেদিন ইসহাক? ধরা পড়লি কিভাবে?’ গেটের বাইরে এসে জিজ্ঞেস করল হানীফ।
‘সেদিন কপালটা খারাপ ছিল নয়ত কুকুরটা ওমন ঘেউ ঘেউ করবে কেন? আর ভয়ে আমিই বা ওয়াল টপকে অন্যের বাসায় ঢুকব কেন? তোদের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার পর বাসার দিকে যাচ্ছিলাম। কিছু দূর এগুতেই একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠল। আমি পাত্তা দিলাম না। হেঁটে আসছিলাম। কিন্তু কুকুরের ঘেউ ঘেউ কমছিল না। পেছন পেছন দৌড়ে আসছিল। কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনে কে যেন পেছন থেকে আসছিল। চৌকিদার হবে হয়ত। রাস্তার পাশে বড় ইটের টুকরা খুঁজলাম কুকুরের মাথা থেতলে দেওয়ার জন্য। কিন্তু হাতের কাছে কোনো ইট, লাঠি কিছুই খুঁজে পেলাম না। আমি ভয় পেয়ে ওয়াল টপকে জামান সাহেবের বাসার ভেতরে ঢুকে পড়লাম। কুকুরের ঘেউ ঘেউ তবু থামছিল না। ওয়ালের কাছে এসে ঘেউ ঘেউ করছে। এর মধ্যে বাসার ভেতরে কেউ একজন জেগে উঠল। একটা রুমের বাতি জ্বলে উঠল। ওয়ালের উপর দাঁড়িয়ে থাকলে ধরা পড়ে যাব ভেবে ভেতরে নেমে গেলাম। এর মধ্যে দরজা খুলে চড়া গলায় কে যেন বলল, ‘কে? কে?’ তালে তালে বাঁশি ফুঁকতে ফুঁকতে চৌকিদার এসে হাজির। চৌকিদার এসে বলল, ‘কী হইছে স্যার?’ জামান সাহেবই সম্ভবত ভেতর থেকে বললেন, ‘কে যেন বাসার ভেতরে ঢুকল।’
‘গেট খুলেন স্যার দেখি।’ চৌকিদার বলল।
বাসার আরও দু’একজনও তখন জেগে উঠেছে। জামান সাহেব গেট খুললেন না। কিন্তু টর্চ জ্বালিয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন। আমার তো ভয়ে আত্মা খাঁচাছাড়া। পাতাবাহার গাছের আড়াল থেকে সরে এসে বাসার পেছনের ওয়াল টপকে যেই ডোবার পাড়ে নামতে যাব, আবার কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করতে লাগল। তোয়াক্কা না করে নিচে নেমে দৌড়াতে লাগলাম। পেছনের ডোবার পাড়ের সরু রাস্তা দিয়ে এসে কিশলয় কিন্ডার গার্টেনের সামনের রাস্তা দিয়ে মেইন রোড ধরে আমাদের বাসার কাছে এসেছি তখনও কুকুরটা দৌড়ে আসছিল। বাসার ওয়াল টপকে ভেতরে নামলাম। চৌকিদার হয়ত খুঁজে পেত না কিন্তু কুকুরটার ঘেউ ঘেউয়ের কারণেই আমার অবস্থান সনাক্ত করা সহজ হয়ে পড়ল। চৌকিদার গেটে এসে কলিংবেল টিপল। আব্বা, দাদু সবার ঘুম ভেঙে গেল। উঠে এলেন। চৌকিদার বলল, ‘স্যার আপনার বাসায় চোর ঢুকছে।’
আব্বা গেট খুলে দিলেন। বাসায় খোঁজাখুঁজি শুরু হলো। আমি পেছনের দিকে কিচেনের সানশেডের উপর বসে ছিলাম। এরপরও ধরা পড়ে গেলাম। তবু রক্ষা এটুকু যে চৌকিদার খোঁজাখুঁজি করে চলে যাওয়ার পর যখন সবাই আবার ঘুুমুতে যাবে তখন আম্মা এসে বললেন, ইসহাক তো রুমে নাই। গেল কোথায়? আমার রুমে গিয়ে হয়ত আমাকে না দেখে সারাবাসা খুঁজে না পেয়ে সবাইকে জানালেন। উপায়ন্ত না দেখে বেরিয়ে এলাম। আমাকে দেখে সবার চক্ষু তো চড়ক গাছ। জেরার পর জেরা চলতে লাগল। বের করে ফেলল সব তথ্য। বাকিটা তো সবাই জানিস।’
তিনজন এসে দাঁড়াল বড়বাড়ির পেছনের রাস্তায়। হিজল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে নীরব হয়ে গেল। হয়ত সবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল সেইদিনের সব কথা।
হানীফ দেখল এই সেই বড়বাড়ি। ছয়মাস আগেও ছিল এখনও আছে। তখন যে দৃষ্টিতে দেখত আজ তা অনুপস্থিত। তখন যে রকম অনুভূতি হতো আজ তা হচ্ছে না।ব ড়বাড়ি বদলে গেছে? গুরুত্ব হারিয়েছে?
বদলেছে ওরা। কিন্তু কোথায় বদলেছে? হাত পা যা ছিল তাই আছে। তাহলে? বদলেছে চিন্তাধারা, আচরণ, বিশ্বাসে।
হাবলু বলল, ‘আমি জেনেছি।’ দু’জনেই তাকাল ওর দিকে। ‘ওটা আসলে কোনো চোরাকারবারী ছিল না। কিছু ফার্নিচার আনা হয়েছিল। কার্টুন যেগুলো দেখেছিলাম তাতে ছিল মোটর সাইকেলের পার্টস। ওয়ারেসুল হক সাহেবের ছোট ভাই জাওয়ায়েদুল হক সাহেব এ বাসার খালি কামরাগুলো গোডাউন হিসাবে ব্যবহার করেন। সেই গোডাউনে ফ্যাক্টরি থেকে মালামাল এনে নামিয়েছিল।’
‘কে বলল তোকে?’ জিজ্ঞেস করল হানীফ।
‘দারোয়ানের কাছ থেকে জেনেছি।’
ওয়ালের কাছ ঘেষে দাঁড়াল হানীফ। ওয়ালে হাত দিয়ে কি যেন অনুভব করার চেষ্টা করল। অস্ফুট স্বরে বলল, ‘কী দিন ছিল কী দিন গেছে।’
‘আজও খাবি নাকি ডাব?’ কৌতুক করে বলল হানীফ।
ইসহাক বলল, ‘চুরি করে খেতে হবে না। আজ কেয়ারটেকারকে বললে পেড়ে দিবে। এমনকি ওয়ারেসুল হক সাহেব যদি আসেন, তাকে বললেও তিনি দেবেন।’
হানীফ বলল, ‘আজ দিলেও খাব না।’
ইসহাক বলল, ‘এখানেই পরিবর্তন। আমাদের সামনে এখন অনেক কাজ, আছে জয়ের স্বপ্ন।’
বিশ.
ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে। তাদের খেলা দেখে আপসোস হচ্ছিল না, খেলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। এখানে খেলার চেয়েও বেশি আনন্দদায়ক কিছু সময় অপেক্ষা করছে তার সামনে।
মাঠের পশ্চিম পাশের রাস্তাটা তখনো  পার হয়নি, পেছন থেকে ডাক শুনল। গলার স্বর শুনে সচকিত হয়ে উঠল হানীফ। পেছন ফিরে তাকালে রীতিমত বিস্মিত হল। মতিন তাকে ডাকছে। রিকসাওয়ালাকে রিকসা  দাঁড় করাতে বলল। মাঠের দিক থেকে দৌড়ে কাছে এসে মতিন বলল, ‘কোথায় যাচ্ছিস?’
এতদিন যাকে প্রতিপক্ষ ভেবেছে সেই আজ তার সাথে কথা বলতে এসেছে। কিংবা যাকে প্রতিপক্ষ ভেবেছে সে তা ভাবেনি। ও নিজে মনে মনে বানিয়েছে। দেখল মাঠে জগলুও আছে। খেলা থামিয়ে যেন ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।
মাঠের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে এনে বলল, ‘মার্কেটে। কিছু কেনাকাটা করব।’
‘কী কিনবি?’
হানীফ বিরক্তিতে সে প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে  বলল, ‘অনেক কিছু।’
মতিন আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। মূল প্রসঙ্গে এসে বলল, ‘সে যাই হোক, প্র্যাকটিস করতে আসছিস না কেন? জুনিয়র ক্রিকেট টুর্নামেন্টে এবার আমরা ভালো করব।’
হানীফ বাকিটুকু শুনতে চাইল না। মতিনকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি খেলব না।’
মতিন বলল, ‘কেন?’
‘কাজ আছে। আমি আজ রাতের ট্রেনে কক্সবাজার যাচ্ছি। সপ্তাহখানেক থাকব।’
‘বেড়িয়ে এসে খেলবি। টুর্নামেন্ট তো শুরু হবে আরও দু’সপ্তাহ পর।’
হানীফ তাতেও রাজি হলো না। বলল, ‘বেড়ানো শেষ হলেও আমার আরও কাজ আছে।’
‘তুই অমত করছিস কেন? গতবারও তো খেললি। ব্যাটিংয়ের জন্যই তোকে খেলতে হবে। বোলার আমাদের আছে কিন্তু ব্যাটসম্যান কোথায়? ওপেনিং ভালো করবে এমন ব্যাটসম্যান আর কে আছে?’
হানীফের একবার বলতে ইচ্ছে হল, ‘জগলুকে নামিয়ে দে।’ বলল না। জগলু না কাকে নামাবে সে তাদের ব্যাপার।
হানীফকে নীবর থাকতে দেখে মতিন আবার বলল, ‘কথা বলছিস না কেন? একজন অলরাউন্ডার হাতছাড়া হলে দলের কতটুকু ক্ষতি হবে বুঝতে পারছিস? এমনিতেই অন্যান্য টিম বাইরে থেকে খেলোয়াড় হায়ার করে আনবে শুনছি। আমরা কাউকে আনছি না। আচ্ছা ঠিক আছে, এখন ঘুরে আয়। আমি রশীদ ভাইকে বলব তোর সাথে কথা বলতে। এবারও রশীদ ভাই আমাদের টিম ম্যানেজার।’
রিকসাওয়ালাকে হাত দিয়ে চলার ইশারা করল হানীফ।
ট্রেনের প্রথম শ্রেনণীর কামরায় বসে ছিল হানীফ। গায়ে সোয়েটার, পায়ে সু, উলের টুপিতে ঢেকে আছে মাথা, কান। হাতে হাতমোজা। শীত যেন কোনোভাবেই কাবু করতে না পারে তাই এতসব ব্যবস্থা। হাতের বই রেখে জানালা দিয়ে তাকাল প্লাটফর্মের দিকে। ট্রেন ছাড়ার সময় বেশি বাকি নেই। এখনও ছোট চাচা আসেননি।
ফাস্ট এইড বক্স নেয়া হয়েছে,বক্সে সম্ভাব্য প্রয়োজনীয় ওষুধ নেওয়া হয়েছে কিন্তু তার গ্যাসট্রাইটিসের ওষুধ শেষ, সেগুলো নেয়া হয়নি। কখন বেশি দরকার পড়ে বলা যায় না। সে সব ভেবে ট্রেনে ওকে বসিয়ে রেখেই নেমে গেছেন ওষুধ কিনতে। এই বাজে অসুখটা তার কখনই ছিল না। লোহা খেয়ে হজম করতে পারেন এমন একটা কৃতিত্ব ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন বাড়ির বাইরে থাকায় খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম করেছেন। তাতে অসুখটা বাসা বেঁধেছে।
ট্রেন যদি ছেড়ে দেয়, ছোট চাচা যদি না আসেন তাহলে কী করবে ভেবে বেশ উদ্বিগ্ন হলো। হুইসেল বেজে উঠল একসময়। ট্রেন নড়তে লাগল। টেনশন করবে না মনে করলেও টেনশনে হার্টবিট বেড়ে গেল, অস্থির লাগছিল। ব্যস্তভাবে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল আসছে কি না। অনেক যাত্রীই তাড়াহুড়ো করে ট্রেনে উঠছে কিন্তু ছোট চাচা নেই। এরপর ট্রেন চলতে শুরু করল। প্রথমে আস্তে, খানিক বাদে জোরে।
ট্রেন ছাড়তেই হানীফের হার্টবিট এত বেড়ে গেল যে মনে হচ্ছিল পাশের লোকজন তার আওয়াজ শুনতে পাবে। ব্যাগ-সুটকেস নিয়ে তাড়াতাড়ি নামতে পারবে না। পাশের যাত্রীকে বলবে কি না, ‘আমি যাব না,দরজা দিয়ে নেমে যাচ্ছি দয়া করে আমার ব্যাগ গুলো জানালা দিয়ে নামিয়ে দেবেন?’ ইতস্তত করে যখন দাঁড়াবে ভাবছিল তখন দেখল ছোট চাচা ওষুধের প্যাকেট হাতে ব্যস্তভাবে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাকে দেখে সুস্থির হলো, হার্টবিট স্বাভাবিক হয়ে এলো।
হানীফের হাতে বই দেখে বললেন, ‘পড়বি নাকি ঘুমুবি?’
‘পড়ব। বইটা ভালো লাগছে।’
‘আমি তাহলে ঘুমাই। ট্রেনে, বাসে ঘুমুতে কোনো অসুবিধা হয় না।’ তিনি চোখ বুজলেন।
বইয়ের পাতায় ডুবে ছিল হানীফ। একবার মুখ তুলে তাকাল। কামরায় আলো জ্বলছে। যাত্রীরা আয়েসী ভঙ্গিতে বসে কেউ সহযাত্রীর সাথে কথা বলছে, কেউ ঝিমুচ্ছে। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। ট্রেনের আলো রেললাইনের পাশের বিল-ঝিলের অল্প একটু অংশে পড়ছে। দূরে গ্রামের বাড়ির বৈদ্যুতিক বাতি চোখে পড়ল। রেললাইনের পাশে কয়েকটা গাছ দেখে মনে পড়ল এক সকালে এমনি জায়গায় সে এসেছিল। শুয়ে ছিল রেললাইনের উপর। বিষাদ নিয়ে বলেছিল বিদায় পৃথিবী। সেদিন যদি সত্যিই সফল হতো তাহলে আজকের এই আনন্দদায়ক মুহূর্ত উপভোগ করতে পারত না। সমুদ্র দেখার পরিকল্পনা করতে পারত না। বিষাদগ্রস্ত হলেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়া বোকামী।
আবার বইয়ে ডুবে গেল হানীফ। কামরার মধ্যে লোকজনের কথাবার্তা কমে এলো। ঘুমে ঢুলছিল কেউ, বাকিরাও চুপ। রেললাইনের দু’পাশেও বিস্তীর্ণ মাঠ, শস্যক্ষেত, জলাশয়ও শান্ত। রাতের আঁধার আর নিস্তব্দতা ভেদ করে শব্দ করে এগিয়ে চলছে ট্রেন।  

হাসান মুহাম্মদ মিনহাজে আউয়াল

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম