ভয়াল রাত



চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঠাণ্ডা বাতাসে গা শিরশির করে ওঠে। এতো রাতে কারো বাইরে থাকার কথা না। বিস্তীর্ণ মাঠ পেরিয়ে বন জঙ্গলের মাঝ দিয়ে এগিয়ে চলেছে এক যুবক। ঝিঁঝি পোকার ডাক বড় বড় গাছগাছালি অন্ধকারের সাথে মিশে অন্ধকারকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
প্রথম প্রথম খুব ভয় লাগতো। গা ছম ছম করতো। হৃদপিণ্ডটা যেন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইতো। কিন্তু এখন আর কিছুই হয় না। কারণ গত সাড়ে তিন মাস ধরে সে এই কাজই করে এসেছে। যেতে যেতে এক জায়গায় গিয়ে ও থেমে গেল। আঙুল তুলে কিছু নির্দেশ করলো।

পুরনো আমলের একটা রাজবাড়ি। বাড়ির গায়ে শেওলা, মেঝে স্যাঁতস্যাঁতে। বহু বছরের অবহেলাতে জানালা দরজায় ঘুণ ধরে গেছে। ছিটকেনিগুলোতে মরিচা। এক পাশে অনেক জানালা। সামনে বিশাল একটা দরজা। দেখেই বুঝা যায় বহু বছর কেউ এখানে বসবাস করেনি। ভুল। মানুষ বসবাস না করলেও এ বাড়ি আশ্রয়স্থল হয়েছে অনেক পোকামাকড় ও ইঁদুরের। এখানে বাতাস যেন হঠাৎ করেই আরও ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ঝিঁঝি পোকার ডাক থেমে গেছে। এখন আর কোনো পেঁচার ডাক শোনা যায় না। নৈঃশব্দে যেন তলিয়ে গেছে চারদিক।
বাড়িটাকে ঘিরে রয়েছে প্রবল আকর্ষণ। যদিও সে আকর্ষণ ভয়মিশ্রিত। অনেকে কৌতূহলী হয়ে, কেউবা সাহস দেখাবার জন্য, কেউ আখের গুছাবার আশায়, কেউ আশ্রয় খুঁজতে গেছে ওই বাড়িতে। যে যায় সে আর ফিরে আসে না। কেন আসে না, কোথায় যায় ওরা তা-ও কেউ জানে না। একবার একটা ডাকাতদল ডাকাতি করার পর পুলিশের নজরদারি থেকে বাঁচার জন্য ও বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। বেশ ক’দিন পর দলপতিকে পাগলের মতো ছুটে বেরোতে দেখা গিয়েছিল ও বাড়ি থেকে। তার মুখে শুধু একটাই শব্দ ছিল, ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর! তাকে ঘিরে নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদে জানা গিয়েছিল প্রতিদিন দলের একজন করে কমতো। ওই একজনের কী হতো এই প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগেই আবোল তাবোল বকতে শুরু করেছিল সেই দুর্দান্ত প্রতাপ ডাকাত সর্দার। বদ্ধ উন্মাদের সমস্ত লক্ষণ তার মাঝে ফুটে উঠেছিল। পাগল অবস্থায় দিন দুয়েক বেঁচেছিল সে। তারপর প্রচণ্ড ভয়ে কুঁকড়ে যেতে যেতে মারাই গিয়েছিল। মৃত্যুর পূর্বে যেন ভয়ে ঠিকরে বেরুচ্ছিল তার চোখ। এসব ঘটনা এখানে হরহামেশাই ঘটে। মাঝে মাঝে বাড়িটার ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। পুলিশ এসেছে বাড়িতে। তাদের বুটের শব্দে নিঃশব্দ বাড়িটার নৈশব্দ ভেঙে খান খান হয়েছে। ওরা আঁতিপাতি করে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে বাড়ির রহস্য। পায়নি। চলে গেছে। গবেষকরাও এসেছেন এ বাড়িতে। প্রাচীন বাড়ির প্রাচীনত্ব আর প্রচলিত জনশ্রুতি নিয়ে গবেষণা করতে চেয়েছে। গবেষণা বেশি দূর এগোয়নি। এই বাড়ির গভীর নির্জনতা এমনভাবে ওদের বুকের ওপর চেপে বসেছে যে একসময় গবেষণা করার ইচ্ছে কর্পূরের মতো উবে গেছে।
বাড়িটার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল এক যুবক। ওর চোখ মুখ সর্বশরীরে গভীর উত্তেজনা। সে উত্তেজনা ঢেকে রাখার কোনো প্রচেষ্টাও তার মধ্যে নেই। ওর সাথে আছে আরও দু’জন। সবাই উত্তেজিত। বাড়িটার দিকে তাকিয়ে ভাবল সে, আজই সব শেষ। আজকের রাত মুক্তির রাত।
দুই.
জ্যৈষ্ঠ মাস। প্রচণ্ড রোদ, প্রচণ্ড গরম। মাটি ফেটে চৌচির। একটু পর পরই শুকিয়ে আসে গলা। ঝাকড়া বটগাছটার নিচে একটু বাতাসের আশায় বসে অছে দু’ চারজন বৃদ্ধ। কিন্তু হাওয়ায়ও যেন আগুনের হলকা। পথচারীদের মুখ গলা বেয়ে নামছে ঘামের ধারা। গামছা দিয়ে মোছার পরক্ষণে আবার ভিজে উঠছে শরীর। মোরগ-মুরগি, গুরু-ছাগল যেন একটু ঠাণ্ডার খোঁজে ঘরের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে। সবাই কাবু, সবাই ক্লান্ত। কিন্তু এই প্রচণ্ড গরম যেন কাবু করতে পারেনি দামাল ছেলেদের। চৌচির হয়ে যাওয়া মাঠে তারা খেলছে ক্রিকেট। আর দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে রাজিব। রাজিব তার বয়সের তুলনায় বেশ লম্বা। শক্ত সমর্থ শরীর, দৃঢ় চোয়াল, খাড়া নাক। আত্মপ্রত্যয়ী মানুষের যেমন হয়। খুব সাহসী আর খুব পরিশ্রমী রাজিব, বুদ্ধিমান। তার পুরস্কার সে পেয়েছে সহজেই। এ ছেলেদের দলে খেলছে সে বেশি দিন নয়। বাবার চাকরি সূত্রে মাত্র মাস দুয়েক এই এলাকায় তারা এসেছে। প্রথম খেলতে এসে ফয়সালকেই দলের নেতৃত্ব দিতে দেখেছে। কিন্তু দিন পনের যেতে না যেতেই কিভাবে যেন এই এলাকায় নতুন আসা রাজিব ছেলেদের নেতা হয়ে গেল। অনেক দুঃখে ফয়সাল এখানে খেলতে আসাই ছেড়ে দিয়েছে। দলের পুরো নেতৃত্ব এখন রাজিবের হাতে। কেউ কেউ এ জন্য অবশ্য রাজিবকে হিংসাও করে। কিন্তু রাজিবের গুণাবলির কারণে প্রতিযোগিতায় তার সাথে পেরে ওঠে না। তাই মনের হিংসা অভিযোগ মনেই চেপে রেখে ওরা রাজিবের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে।
এখন ব্যাট করছে রাজিব। বলটা যেন উড়ে এল। জোরসে ব্যাট করল রাজিব। বলটা যেন আকাশে উঠে গেল। কোথায় কতো দূরে গেল বোঝা গেল না। সবাই সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল। আম্পায়ার হাত তুলে ছয় দেখালেন। দলের একজন চেঁচিয়ে বলল, অনেক উপরে উঠেছে, ছয় নয় বারো দিতে হবে।
হাসির হল্লা পড়ে গেল মাঠজুড়ে। ঠিক তখনই কাঁদো কাঁদো মুখে রাজিবের কাছে ছুটে এলো আসিফ, এ তুমি কী সর্বনাশ করলে রাজিব! কেবল আজ সকালেই বল আর টেপ কিনেছি আমি। ভেবেছিলাম অনেক দিন খেলব। কিন্তু তাতো আর হবে না। ওই বল দিয়ে তো আর খেলা যাবে না। বাবাকে বললে নতুন বল কিনে দেবেন না।
কেন কী হয়েছে? ওই বল দিয়ে খেলা যাবে না কেন? বলটা কুড়িয়ে আনলেই হয়। এই তোরা বলটা কুড়িয়ে আনতো।
অসুবিধাটা তো সেখানে। বল আর কুড়ানো যাবে না। ও বল গিয়ে পড়েছে পোড়ো বাড়িতে। কে যাবে ওই পোড়ো বাড়িতে!
লিটন লুফে নেয় আসিফের কথা। বাবু আর সুমনের দিকে তাকায়। উচ্চস্বরে বলে, রাজিবের বল হারানো নতুন কিছু নয়। এর আগেও তিন চারটে বল হারিয়েছে। ও ইচ্ছে করে এমনভাবে ব্যাটিং করে যাতে বল না পাওয়া যায়। আমরা যাতে খেলতে না পারি তাই এসবই ওর চালাকি। ও চায় না যে আমরা নির্বিঘেœ খেলাধুলা করি। কি বলিস তোরা?
বাবু আর সুমন মাথা নেড়ে লিটনকে সমর্থন করে।
মাথা নাড়লে হবে না। যা বলতে চাস মুখে বল।
শোন রাজিব এখন আমরা বলের অভাবে খেলা বন্ধ করতে পারবো না। হয় বলটা এনে দিবি নাহলে বল কিনে দিবি। আজ আর তুই ফাঁকি দিতে পারবি না। খুব নাকি সাহসী তুই? তা যা না বলটা আন না।
ও সাহস আসলে মুখে মুখে, কাজে না। আসলে ওটা ভীতুর ডিম। হাসিতে ভেঙে পড়ে তিনজন।
ভীষণ বিরক্ত হয় রাজিব। লিটন আর তার সাগরেদরা রাজিবকে হিংসা করে তা সে জানে। আর সেই হিংসা থেকেই বলের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। রাজিব ক্ষণকাল চিন্তা করে। আসিফের শুকনো মুখ কাঁদো কাঁদো চোখের দিকে তাকায়। এ গ্রামের সবাই জানে সে খুব সাহসী। তাকে মানুষ সাহসী ভাবে এটা রাজিব এনজয় করে। রাজিব সবসময়ই চায় তাকে নিয়ে মানুষ আলাপ করুক, তার সাহসিকতা আর বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করুক। ভীরু হয়ে বেঁচে থেকে লাভ কী! তার চেয়ে ভালো সাহসিকতার সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে হিরো হয়ে মরে যাওয়া। সে হিরো হতে চায়। রাজিব ধীরে ধীরে এগোতে থাকে পোড়ো বাড়িটার দিকে। মাঠ থেকে বেশ কিছুটা দূরে বাড়িটা। রাজিব মাঠ পেরিয়ে একটা বনের মধ্যে ঢোকে। বন পেরোলে ওপারে পোড়ো বাড়ির বিশাল দেয়াল। আর সে দেয়ালের মাঝখানে বড় একটা গেট। রাজিব বন পেরিয়ে গেটের দিকে হাঁটতে থাকে।
পেছন পেছন এগিয়ে আসে আসিফ, যাসনে যাসনে রাজিব। ফিরে আয়। আমার বলের দরকার নেই।
রাজিব থামে না। তার মনজুড়ে হিরো হবার উত্তেজনা। এই বল নিয়ে যদি সে ফিরতে পারে তাহলে সবাই তাকে হিরো বানিয়ে মাথায় তুলে রাখবে। তা ছাড়া লিটন আর তার সাগরেদ দু’জন বরাবরই ওকে হিংসা করে। কারণে অকারণে জ্বালাতন করে। বেশ ক’বার বিদ্রƒপ করেছে। বলটা যদি পায় সে সবার আগে বোলিং নেবে। আর লিটনের নাক সই করে ঝেড়ে মারবে বল। ওর নাকটা উড়িয়ে দেবে। যাতে আর কখনও কোনো কিছুতে নাক গলাতে না পারে। রাজিব প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় হয়। দেখা যাক একটু চেষ্টা করে বলটা পাওয়া যায় কি না। গেটের সামনে এসে দাঁড়ায় রাজিব। বিশাল একটা তালা ঝুলছে। এখান থেকে মানুষ হারিয়ে যায় বলে গ্রামবাসী স্বউদ্যোগে গেটে এই বিশাল তালাটা লাগিয়ে দিয়েছেন। যেন কেউ ওই পোড়ো বাড়িতে ঢুকতে না পারে। রাজিব গেটের দুই পাল্লা ফাঁক করে ভেতর তাকায়। ওইতো সামনেই পড়ে আছে লাল টেপ জড়ানো বলটা। দেয়াল টপকালেই বলটা হাতে পাবে। রাজিব কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে। এ বাড়িতে কেউ গেলে ফেরে না। কিন্তু এখনতো দিনের আলো ঝলমল করছে। কী হবে এই এতো আলোয় ওই বাড়িতে গেলে? তাছাড়া ও তো বাড়িতে ঢুকবে না। গেটের একটু সামনেই পড়ে আছে বলটা। বাড়িটা ওখান থেকে অনেক দূরে। ও বলটা নিয়ে আবারও দেয়াল টপকে চলে আসবে। বাড়ির দিকে যাবে না কিছুতেই। এতো ভাবাভাবির সময় নেই। সে এ বাড়িতে না ঢুকে যদি ফিরে যায় বন্ধুরা তাকে ভীতু বলে ক্ষেপাবে। তার কর্তৃত্ব আর কেউ মেনে নেবে না। এতো কষ্টে গড়া তার ইমেজটা ভেঙে খান খান হয়ে যাবে। না তা কিছুতেই হতে দেয়া যায় না। রাজিব দেয়াল টপকাবার প্রস্তুতি নেয়। বনের মধ্যে দাঁড়িয়ে আসিফ বলে, আমি বলছি তুই ফিরে আয়। সামান্য একটা বল। ও বলে আমার দরকার নেই। ও বাড়িতে মানুষের জীবন চলে যায়। কেউ ফিরে আসে না। তুই ও বাড়িতে ঢুকিস না বন্ধু।
তুই একটা ভীতুর ডিম। আমি এখনই বলটা নিয়ে ফিরছি। সবাইকে বল আমি বল নিয়ে ফিরছি।
তিন.
অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর রাজিবের মধ্যে যেন এক অদৃশ্য শক্তির জন্ম হলো। দ্রুত কয়েক পা ফেলে সে এগিয়ে গেল বাড়িটার বিশাল দরজার দিকে। সর্বশক্তি দিয়ে বাড়ির গেটের হ্যাচ ঘুরালো।
ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে খুলে গেল গেট। এই গভীর নির্জনতার মধ্যে সে শব্দ এক বিকট আকার নিলো।
তিনজনেই কেঁপে উঠল অকস্মাৎ। এমন শব্দ যেন আর কখনও শোনেনি তারা। ভয়ে পশম খাড়া হয়ে গেল তিনজনেরই। গভীর ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে চেতনা হারাবার উপক্রম হলো। কিন্তু কী এক শক্তি যেন ওদের জাগিয়ে রাখল। ওরা ভয়ে ফিরে যেতে চাইল কিন্তু পারল না। রাজিবের পেছন পেছন ওরাও তাই গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল। ভয়ে সর্ব শরীর শিউরে উঠছে। তারপরও ওদের ফিরে যাবার পথ নেই। কী এক অমোঘ আকর্ষণে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। দরদর করে ঘামছে সবাই। অন্যরা ঘামছে ভয়ে, রাজিব ঘামছে উত্তেজনায়। সবার পশম খাড়া হয়ে গেছে ভয়ে। রাজিবের উত্তেজনায়। যদিও রাজিব বুঝতে পারছে না কেন এই উত্তেজনা। এই কাজ তো সে গত তিন মাস ধরে প্রতিরাতেই করে আসছে। তবে আজ কেন এমন লাগছে। ও শুধু উত্তেজিত নয়, আনন্দিতও প্রচণ্ড। যা ও করতে পারেনি এখনও, যে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে ও পৌঁছাবে কিছুক্ষণের মধ্যে সেই বিজয়ের আনন্দে ও বিভোর। ও বুঝতে পারছে তার মুক্তি তার বিজয় সন্নিকটে। তাই যেন ও আজ উন্মাতাল, নেশাগ্রস্ত।
সাথের দুু’জনের পরিণতি ভেবে বড় মজা পাচ্ছে রাজিব। আশ্চর্য মানুষ কতো বোকা আর লোভের কাছে কত নতজানু। প্রথম যখন দু’জনকে এ বাড়িতে লুকানো গুপ্তধনের কথা বলল ওরা বিশ্বাস করতে চায়নি। অবিশ্বাস মাখানো কণ্ঠে বলেছিল, এটা একটা নিরেট গুল। কিন্তু রাজিব গভীর আত্মপ্রত্যয়ের সাথে বলেছিল, সে খুব ভালো করেই জানে ও বাড়িতে গুপ্তধন আছে। আর গুপ্তধনের পরিমাণ এতোই বেশি যে একা একা সরানো সম্ভব না। সে কোথায় গুপ্তধন আছে তার ম্যাপ এঁকে ওদের দেখিয়েছিল। আস্তে আস্তে ওদের কপালে ভাঁজ পড়েছিল। লোভ ফুটে উঠেছিল চোখে। অবিশ্বাসে চিড় ধরে সেখানে ফুটে উঠেছিল বিশ্বাসের চিহ্ন। বাড়িটাকে ঘিরে ভয় অনিশ্চয়তা ডিঙিয়ে লোভেরই জয় হয়েছিল। অনেক গুপ্তধন সোনা দানা নিরাপদ নিশ্চিন্ত জীবন, মুফতে বড়লোক হবার এমন সুযোগ ছাড়তে রাজি ছিল না ওরা। তাই সহজেই রাজিবের সাথে আসতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু রাজিবকে বুঝতে দিতে চায়নি সেটা। আঙুল তুলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিল, গুপ্তধন যদি না পাওয়া যায় রাজিবের গর্দান নেবে তারা। হাসিমুখে রাজি হয়ে গেছিল রাজিব। এখন এসর ভেবে বড় মজা হচ্ছে রাজিবের। ওরা গর্দান নিতে চেয়েছিল। এখন কিছুক্ষণের মধ্যে ওদের যে কী পরিণতি হবে তা কি ওই লোভী ছেলে দুটো জানে!
এই ফর্মুলা আগেও আরো অনেকের ওপর প্রয়োগ করেছে। কিন্তু মানুষ কী অদ্ভুত! প্রথমে এ ছেলে দুটোর মতো কেউই তার কথা বিশ্বাস করতে চায়নি। বলেছে রাজিব মজা করছে কিংবা গল্প করছে। কেউ কেউ তাচ্ছিল্যের স্বরে বলেছে, ওসব ফাজলামি রাখো তো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবাই লোভে পড়ে নতি স্বীকার করেছে। আর বরণ করেছে একই পরিণতি।
সাথী দু’জনকে নিয়ে বাড়ির  ভেতর এগিয়ে গেল রাজিব। উঠোনের একপাশে একটা অতি পুরাতন কুয়া। কুয়ার পাশে একটা ভাঙাচোরা বালতি। কুয়া আর বালতি দেখে সাথী দু’জন ভয়ার্ত কণ্ঠে ফিসফিস করে।
বাড়ির ভয়াবহ নির্জনতা, পুরনো দাঁত বের করা কুয়ো, ভাঙাচোরা বালতি তার মনে তীব্র ভয়ের উদ্রেগ করলেও এখন আর বিন্দুমাত্র বিকার হয় না তার। ভয় নামক জিনিসটি তার জীবনের এক অতীত অধ্যায়। এ বাড়ি তাকে প্রচণ্ড সাহসী করে তুলেছে। সে জানে এখন সে সহজেই যেকোনো কিছু করতে পারে। উঠোনের অপর পাশে একটা বিশাল টাওয়ারের মতো। তার ওপর এক বিশাল গোলাকৃতি ঘণ্টা। কবে এই ঘণ্টা এখানে বসানো হয়েছে, কে বসিয়েছে কেউ তার ইতিহাস জানে না। সচরাচর ঘণ্টাটা নিঃশব্দই থাকে। কিন্তু বাতাস যখন প্রবল বেগে বইতে থাকে তখন ঘণ্টার দড়িতে টান পড়ে আচমকা বেজে ওঠে ঘণ্টা। প্রচণ্ড শব্দে ঘণ্টার পিটুনিতে নৈঃশব্দ ভেঙে খান খান হয়। আত্মার ভেতর পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। কিন্তু এখন আর ঘণ্টার শব্দে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না রাজিবের। এমন দশটা ঘণ্টার বাজনাও এখন তাকে ভয় দেখাতে অসমর্থ।
চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো সাথী দু’জন। কয়েক পা সামনে এগিয়ে হঠাৎ করেই বুঝতে পারলো রাজিব। বিরক্তির সাথে এগিয়ে এসে দেখল একটা ঝোপের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সাথী দু’জন। ওদের মুখের রক্ত সরে গেছে। রাজিব বুঝতে পারল কেন ওরা ভয়ে নীল হয়ে উঠেছে। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে ভাবল, সামান্য দু’ একটা নরকঙ্কাল দেখে ভয় পাওয়ার কী আছে? রাজিব বিরক্তির সুরে বলল, ভয় পেলে চলবে না, থামলে চলবে না। এগিয়ে যেতে হবে। সামনে আমাদের অনেক বড় মিশন।
নড়ে উঠল সাথী দু’জন। চারপাশের এই ভীতিকর পরিবেশেও ওদের মনে হলো নতুন করে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বরং ওরা কৌতূহলী হয়ে উঠল রাজিবের প্রতি। যাত্রা শুরুর পর এই প্রথম কথা বলল রাজিব। এর আগে একটি কথাও বলেনি। রাজিবের ভাবভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে এ জায়গাটা ওর ভীষণ চেনা। আসলে কী চায় রাজিব, কী ভাবছে ও?
কয়েকটা বাদুড় ডানা ঝাপটে উড়ে গেল। আবার ফিরেও এল। চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করল মাথার উপর। ওরা যুগপৎ উপরের দিকে তাকাল। সাথী দু’জন একবার কেঁপে থেমে গেল।
ইতোমধ্যে এতো বেশি ভীতিকর জিনিস দেখেছে যে এই বাদুড় তাদের মনে নতুন করে কোনো ভয়ের সৃষ্টি করল না। যদিও তারা জানে ড্রাকুলার কাহিনী, রক্তখেকো সেই বাদুড়ের গল্প। রাজিব ভাবল, এখন বাদুড়দের শিকারের রাত। ওদের বরং অনেক কৌতূহল রাজিবকে ঘিরে। ওরা রাজিবকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাইল। তার আগেই ওদের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল রাজিব। হেসে নিজেই থেমে গেল। কতোদিন পর আজ সে এভাবে হাসতে পারল। তার মুক্তি আসন্ন বলেই কি সে এভাবে হাসতে পারল? এরপর থেকে সে শুধুই হাসবে। হাসবে, খেলবে, দৌড়াবে, যা ইচ্ছে করবে। পরিসমাপ্তি ঘটবে তার বন্দিজীবনের।
সাথী দু’জন দ্রুত হেঁটে এসে রাজিবকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাইল। কিন্তু ওরা জিজ্ঞাসা করার আগেই সামনে অঙ্গুলি নির্দেশ করল রাজিব। ওরা সবিস্ময়ে দেখল সেখানে বিশাল একটা কাঠের দরজা। রাজিবের বুকের মাঝে একটা মোচড় দিয়ে উঠল। অদ্ভুত এক অনুভূতি ওর মনে কাজ করতে থাকল। এই অনুভূতি ওর প্রথম হয়েছিল যখন তিন মাস আগে প্রথম এ বাড়ির দরজা খুলেছিল রাজিব।
চার.
রাজিব গেট টপকে ভেতরে ঢোকে। শুকনো পাতার উপর দিয়ে হাঁটতে থাকে। পায়ের চাপে কড়মড় করে ভাঙতে থাকে পাতা। একটু দূরে এসে বলটা দেখতে পায়। লাল টেপে পেঁচানো বল। রাজিবের মন প্রশান্তিতে ছেয়ে যায়। এখনই বল নিয়ে সে বন্ধুদের কছে ফিরে যাবে। রাজিব বল স্পর্শ করে। বলটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে। এখনই সে চলে যাবে। পেছনে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে আবারও সে সামনে তাকায়। ভাবে এই অদ্ভুত বাড়িটাতে সে যখন এসে পড়েছে আর এখন পর্যন্ত ভয়ের কিছুই ঘটেনি কাজেই অতো ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। আর যদি তেমন কিছু ঘটে গেট তো সামনেই। দ্রুত দেয়াল টপকে বের হয়ে যেতে পারবে। সে সামনের দিকে এগোতে থাকে। তখনই ভাঙাচোরা কুয়াটা চোখে পড়ে। রাজিব কুয়োর সামনে এসে ভেতরে তাকায়। নিচে কিছুই দেখতে পায় না। না মাটি না পানি। তাহলে কি কুয়োটা খুবই গভীর? রাজিব একটা ইটের ছোট টুকরো তুলে ভেতরে ফেলে। কান পেতে শব্দ শোনার অপেক্ষা করে। কিন্তু কোনো শব্দই শুনতে পায় না। আশ্চর্য এ কুয়োর কি তবে কোনো শেষ নেই! এবার একটা বড় ইটের টুকরো কুয়োর ভেতরে ফেলে তাকিয়ে থাকে রাজিব। টুকরোটা পড়ছে পড়ছে। কিছুক্ষণ পর আর টুকরোটা দেখা যায় না। তারপর বহু বহুক্ষণ কান পেতে থেকেও সে টুকরো পতনের কোনো শব্দ শুনতে পায় না। না পানিতে ঝপ করে পড়ার কোনো শব্দ, না মাটির সাথে ঠোক্কর খাওয়ার কোনো শব্দ। এবার রাজিবের শীত শীত লাগতে থাকে। সে বুঝতে পারে একটা অন্তহীন কুয়োর পাশে এখন সে দাঁড়িয়ে।
এবার সে সামনে এগোয়। তার মনে একটু একটু করে ইচ্ছে জাগে চার পাশ থেকে বাড়িটা ঘুরে দেখার। আজ সে অনেক সাহস করে এ বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু আর কখনও সে এ বাড়িতে আসবে না এটা নিশ্চিত। যে বাড়িতে কেউই কখনও ঢোকে না, সে বাড়িতে দ্বিতীয়বার ঢোকার চিন্তা কি কেউ কখনও করে? বিশাল বিশাল গাছে ছেয়ে আছে বাড়ির পেছন দিকটা। গাছের পাতা সবুজ থেকে আরও সবুজ হতে হতে যেন পাতায় কালচে রং ধরেছে। গাছ যেন পেঁচ দিয়ে দিয়ে জালের মতো সৃষ্টি করেছে। সে গাছের মাঝ দিয়ে চলাও দুঃসাধ্য। চলতে চলতে হঠাৎ করেই একটা দড়ির ফাঁদের মধ্যে আটকা পড়ে রাজিব। ফাঁদে আষ্টেúৃষ্ঠে জড়িয়ে যায় তার শরীর। ভীষণ ভয় পায় রাজিব। তবে মনোবল অটুট রাখার চেষ্টা করে। অনেক কষ্টে পকেট থেকে ছুরি বের করে ফাঁদ কেটে জাল থেকে বের হয় সে। দর দর করে ঘামছে। আজ ছুরিটা না থাকলে কী যে হতো! নিরাপত্তার জন্য সবারই সাথে ছোটখাটো একটা অস্ত্র থাকা উচিত। এবার পট করে গাছের একটা ডাল ভাঙে সে। চারপাশের প্রকট নৈঃশব্দের মাঝে সে শব্দ যেন প্রচণ্ড আকার নেয়। রাজিব ছুরি দিয়ে গাছের শাখা প্রশাখা পাতা ছেঁটে ফেলে সামনে এগোতে থাকে। এবার যেন আর সে কিছুতেই ভয় পায় না। হঠাৎ করে তার হাতের ডাল ইস্পাতের সাথে বাড়ি খেয়ে ভেঙে যায়। রাজিব লক্ষ্য করে দেখে এটা আর একটা ফাঁদ তবে ইস্পাতের তৈরি। ইস্পাতের দাঁতওয়ালা এ ফাঁদ ভল্লুক ধরার জন্য বানানো। অর্থাৎ যারাই এখানে বসবাস করেতো তারা কখনই চায়নি এখানে কোনো মানুষ বা পশু-পাখি আসুক। আবারও আরেকটা ডাল ভেঙে নেয় রাজিব। সামনে এগোয়। গাছপালা এখন কিছুটা হালকা। পাশাপাশি বেশ কয়েকটা ঝোপ। সে ঝোপের আড়ালে কেউ যেন ফিস ফিস করে কথা বলছে রাজিবের এমনই মনে হয়। হঠাৎ করে সামনে থেকে সরসর করে সরে যায় কিছু। কী সরে যায় বুঝতে পারে না রাজিব। ওর পশম দাঁড়িয়ে যায়। একটু একটু করে ঘামতে থাকে। ছুরিটা স্পর্শ করে। এই স্পর্শ যেন তার সাহস বাড়িয়ে দেয়। মনে ভয় কিন্তু সাথে অদম্য কৌতূহল। এ বাড়ি ভালো করে ঘুরে না দেখে সে যাবে না। যতো ভয় পায় ততোই শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ছুরি। ছুরি সে ভালোই চালাতে জানে। প্রয়োজনে সেটাই চালাবে। এখানে গাছ খানিকটা হালকা হয়ে এসেছে। হঠাৎ করেই রাজিবের নজরে পড়ে দালানের গা ঘেঁষে উপরে উঠে যাওয়া লোহার ঘোরানো সিঁড়িটা। দীর্ঘদিনের অব্যবহার আর অযতেœ সিঁড়িটায় জং ধরেছে। কেউ ধরলে এখনই বুঝি ঝুর ঝুর করে ভেঙে পড়বে ওই জং। ও সিঁড়ি দিয়ে এখন আর কিছুতেই উপরে ওঠা সম্ভব নয়। মানুষের শরীরের ভার বহন করতে পারবে না ও সিঁড়ি। ঘোরানো সিঁড়িটা একটা নির্দিষ্ট ঘর পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। কেন ওই ঘর পর্যন্ত গিয়েই থেমে গেল সিঁড়ি? ও ঘরের উপরেও তো আরও ঘর আছে। সে ঘর পর্যন্ত কেন গেল না? তাহলে এই সিঁড়ি দিয়ে যারা যাতায়াত করতো তাদের ওই নির্দিষ্ট ঘর পর্যন্তই যাবার অধিকার ছিল। তার উপরে নয়। কারা তারা? এখন তারা কোথায়? রাজিবের খুব ইচ্ছে হয় ওই সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে সিঁড়ির মাথার ঘরটাতে ঢুকে দেখে আসতে ও ঘরে কী আছে। কিন্তু আবারও মনে হয় তার অলক্ষ্যে কী যেন সরে যায় আর শক্ত হয়ে ওঠে রাজিব। ও নিশ্চিত হয় এ সিঁড়ি তাকে নিয়ে এখনই ভেঙে পড়বে নিচে আর তখনই হয়তো দেখা যাবে এ বাড়ির কুয়োর যেমন তল নেই, এ বাড়ির শক্ত মাটি হয়ে গেছে কুয়ো। তাই অদম্য ইচ্ছে দমনের চেষ্টা নিতে নিতে সামনে এগোয় রাজিব। বাড়ির সামনের দিক থেকে পেছন দিকটা আরও জরাজীর্ণ। পেছন থেকে ওপরের দিকে একটা জানালা ঝুলতে দেখা যায়। কব্জা খুলে গেছে জানালার। পাল্লাটা তাই দুলছে বাতাসে। যে কোনো সময় যে কারো মাথার উপর খুলে পড়তে পারে ওই জানালা। তবে এ বাড়িতে আসেই বা কে আর কার মাথার উপরেই বা পড়বে। ঠিক তখনই আচমকা এক ঝলক বাতাস বয়ে যায়। প্রবল বেগে দুলে ওঠে জানালাটা। ছিটকে পেছনে সরে যায় রাজিব। গাছের গুঁড়িতে হোঁচট খায়। আচমকা কি ওই জানালার পাশ থেকে সরে যায় কোনো একটা মুখ? সে মুখ কি কোনো নারীর? নাকি ভয়াল দর্শন কোনো পুরুষের। দ্বিতীয়বার তাকাবার সাহস হয় না রাজিবের। কিন্তু ওই জানালাটা রাজিবের মনে তীব্র ভয়ের সৃষ্টি করে।
রাজিব দ্রুত এগোয়। হাঁটতে হাঁটতে সে এসে দাঁড়াল বাঁধানো ঘাটের বিশাল পুকুর পাড়ে। ঘাটের অনেক সিঁড়িই ভাঙাচোরা। পুরু শ্যাওলা জমে আছে সিঁড়িতে। বোঝাই যায় এ সিঁড়ি কেউ ব্যবহার করে না। কিন্তু আচমকা ওই সিঁড়ির মাঝে দু’চারটে পদচিহ্ন দেখে মনে হয় কেউ বুঝি কিছুক্ষণ আগেও এ ঘাটে এসেছিল। কে সে? কে? শক্ত করে চেপে ধরে ছুরি। যেই-ই হোক তাকে মোকাবেলা করার শক্তি রাজিবের আছে। অবশ্য এই বাড়ি ঘুরতে ঘুরতে আর অদ্ভুত সব জিনিস দেখতে দেখতে রাজিব নিজেই এখন কিছুটা বিচলিত। বিশাল পুকুরজুড়ে ফুটে আছে অজস্র পদ্ম। আর বিরাট বিরাট পাতা সেসব পদ্মের। যেন ও পাতার উপর বসে হাত দিয়ে পানি কেটে কেটে সহজেই পাড়ি দেয়া যায় পুকুরের এধার ওধার। অবশ্য সমস্যা আছে। অজস্র পদ্মে এমনই জট সৃষ্টি করেছে ও পাতা খুলে জট ডিঙিয়ে সামনে এগোনো খুবই শক্ত।
পুকুর বাঁয়ে ফেলে এগিয়ে যায় রাজিব। চমৎকার একটা দোলনা দেখে থমকে দাঁড়াল। স্টিলের জং ধরা দোলনাটা স্থির হয়ে আছে। রাজিব এক দৃষ্টিতে তাকালো দোলনাটার দিকে। তখনই মৃদু বাতাসে দুলে উঠল দোলনাটা। রাজিব কি বসবে দোলাটাতে? একটু দোল খাবে? দোলনায় দুলতে রাজিব বরাবরই পছন্দ করে। কিন্তু না থাক। যে সব তিক্ত ঘটনা ঘটছে একের পর এক দোলনায় সে আর নাই বা চড়ল। হঠাৎ করে কোথায় যেন প্রচণ্ড শব্দে বেজে উঠল একটা ঘণ্টা। বাজতেই থাকল। সে শব্দে বেশ কিছুক্ষণের জন্য যেন রক্ত চলাচল থেমে গেল রাজিবের। এই বিরানপুরীতে কোথা থেকে ভেসে এলো ঘণ্টার আওয়াজ? কে বাজাচ্ছে ঘণ্টা? কোথায় সে ঘণ্টা? একটু ধাতস্থ হয়ে চলৎশক্তি ফিরে পেয়ে বাড়ির পেছন থেকে সামনে এলো রাজিব। আর তখনই রাজিবের নজরে পড়ল ঘণ্টাটা। সাধারণত মন্দিরে ঘণ্টা থাকে কিন্তু এ বাড়িতে ঘণ্টা কেন? কিন্তু বাড়ির বয়স থেকে ঘণ্টার বয়স অনেক কম বলে মনে হয়। এ ঘণ্টা যারা বাজাতো তারা কোথায়? ঘণ্টা পেরিয়ে এগিয়ে রাজিব এবার এসে দাঁড়ায় বাড়িতে ঢোকার সেই কাঠের দরজার সামনে। এখন তার মনের মাঝে দ্বিধা। সে কি ভেতরে ঢুকবে নাকি ঢুকবে না?
পাঁচ.
রাজিব বিশাল দরজার দিকে তাকায়। মস্ত বড় কাঠের দরজা। দরজার ওপরে দুটো দড়ি ঝুলছে। আগের দিনের বড়লোকের বাড়ির দরজায় এ ধরনের দড়ি ঝুলত। দড়িটা কোনো একটা ঘণ্টা জাতীয় জিনিসের সাথে লাগানো থাকতো। দড়ি ধরে টান দিলে ঘণ্টা বেজে উঠতো। কালের বিবর্তনে সেই দড়ির ঘণ্টা এখন কলিংবেলে রূপ নিয়েছে। দরজার মাঝখানে বিশাল এক ধাতব পাত লাগানো। আর একখণ্ড গোল চাকতিও রয়েছে যা নড়ানো যায়। ওই চাকতি নাড়লে শব্দ হয় বলে রাজিবের ধারণা। এটা দিয়ে নক করা যায়। চাকতিও কলিংবেলের কাজ করে। অর্থাৎ বাড়ির মালিক সৌখিন আর বিলাসী। সে একই জায়গায় বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পছন্দ করে। দরজার কাঠ অনেক পুরনো। কতো পুরনো তার কোনো ধারণা নেই রাজিবের। তবে কাঠের বার্নিস এখনও যেন তেলচিকচিকে এমনই মসৃণ। প্রতিদিনই এ কাঠের দরজায় ধুলো পড়ে। কিন্তু সেই ধুলোবালি কাঠের গুণেই বুঝি আটকে থাকে না। ঝরে ঝরে পড়ে। দরজার মাঝখানে একটা নব। এই নব ঘুরিয়েই দরজা খুলতে হয় বুঝল রাজিব।
রাজিব আলগোছে নবটা ঘোরানোর চেষ্টা করল। খুব মোলায়েম হাতে আদবের সাথে ধীরে ধীরে। কিন্তু নবটা ঘুরছে না। আদ্যিকালে লাগানো নব। জং ধরে ধরে লাল রঙ হয়েছে। নড়বড়ে হয়েছে কিছুটা। চাপ দিলে এখনই হয়তো দরজাটা খুলে যাবে। তাতে শব্দ হবে। রাজিব সেই শব্দ হওয়াটাই চাচ্ছে না। যদিও সে জানে এ বাড়ির ভেতরে এখন কারো জীবিত থাকার কথা না। এ বাড়ি থেকে বহু দূরে গ্রাম। দু’ চার মাইলের মধ্যে কোনো জন মনীষী নেই। কাজেই শব্দ হলে সে শব্দ কারো শোনার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাহলে কেন এই বাড়তি সতর্কতা? তা নিজেই জানে না রাজিব। তাই কোমল হাতে নবটা ঘোরাতে থাকে রাজিব। কিন্তু যতো কোমল হাতেই হোক নবটায় ক্রমাগত চাপ পড়ায় একসময় সেটা খুলে মাটিতে পড়ে যায়। সিমেন্টের মোঝের উপর লোহার নবটা পড়ে ঠক্ করে শব্দ হয়। ওই সামান্য শব্দেই কেঁপে ওঠে রাজিব। তার মনে হয় এ বাড়ির আনাচে কানাচে যদি কেউ থেকে থাকে সেও কেঁপে উঠবে এ শব্দে। সে জেনে যাবে একজন মানুষ ঢুকতে চেষ্টা করছে এ বাড়িতে। রাজিবের মনে একসাথে ভয় এবং রোমাঞ্চ কাজ করল। সে আত্মরক্ষার তাগিদে আবার স্পর্শ করল ছুরিটা। অনেক জোর পেল মনে। যদিও রাজিব জানে এ বাড়িতে কেউ থাকার কথা অযৌক্তিক। সে নিশ্চিত কেউ নেই এ বাড়িতে। থাকলে জীবন যাপনের প্রয়োজনে সপ্তাহে একদিন হলেও তাকে লোকালয়ে যেতে হতো। আচ্ছা সপ্তাহে যদি না হয় মাসে একদিন হলেও তো যেতে হতো। বহু বছর ধরে এ বাড়ি থেকে কেউ বের হয়নি। এ বাড়ির দরজা খোলেনি। এ বাড়িতে কোনো শব্দ হয়নি। কোনো মানুষের পদচারণা মুখর করেনি এ বাড়িকে। বাড়িটা যেন নির্জন নির্জীব নিষ্প্রাণ পোড়োবাড়ি হয়ে পড়ে আছে বছরের পর বছর। কতো বছর তা কেউই জানে না।
রাজিব এখন আরও সতর্ক। যদিও নিজেই জানে না কেন কার জন্য এ সতর্কতা। ও দরজায় কান লাগিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে ভেতরে কোনো শব্দ শোনা যায় কি না। শব্দ শোনা যায় না। অনেকক্ষণ অনেকক্ষণ কান লাগিয়ে থাকে রাজিব। বিন্দুমাত্র কোনো শব্দও তার কানে আসে না। এবার রাজিব জায়গা পরিবর্তন করে। সে দরজার অন্য পাশে কান লাগিয়ে শোনার চেষ্টা করে। কিন্তু ফল একই। জমাট নৈঃশব্দ যেন আরও জমাট বাঁধে। সে দরজায় চাপ দিয়ে আবারও দরজা খোলার চেষ্টা করে। তিলমাত্র দরজা নড়ে না। দরজার ডান পাশে একটা জানালা। জানালাটাও বন্ধ। রাজিব এবার জানলায় কান পাতে। আলতো হাতে জানালায় চাপ দেয়। কোনো লাভ হয় না।
রাজিব বাগানের দিকে হাঁটতে থাকে। একটা ডাল ভাঙে। ঢাল ভাঙার শব্দে আবারও চমকে ওঠে নিজেই। ডালের পাতা ঝেড়ে ফেলে সে এবার সর্বশক্তি দিয়ে দরজাটা ফাঁক করে ডালটা ঢোকানোর চেষ্টা করে। তার ধারণা একবার ডালটা ঢোকাতে পারলে চাপ দিয়ে সে দরজা খুলতে পারবে। ডাল ঢোকানোর চেষ্টা করে চলে রাজিব। পারে না। পারে না। এক পর্যায়ে মট করে ভেঙে যায় ডাল। রাজিবের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। এখন আর কোনো ভয়ই তার মনে কাজ করছে না। এখন তার একটাই লক্ষ্য, যে কোনো প্রকারে হোক এ বাড়িতে ঢুকতে হবে। কী আছে এ বাড়িতে, কেন এ বাড়িতে ঢোকার ব্যাপারে এতো সতর্কতা, কেন এই বাড়িটাকে আগলে রাখার এতো চেষ্টা?
রাজিব এবার সর্বশক্তি দিয়ে দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে। ধাক্কার পর ধাক্কা দিয়ে চলে। সে ধাক্কার শব্দে নিরেট নির্জনতা ভেঙে যায়। অধৈর্য রাজিব এবার উপর্যুপরি লাথি চালাতে থাকে দরজার উপর। কিন্তু এ দরজা যেন নিরেট পাথরের। যেন কোনো একটা পাহাড়। রাজিবের জোড়া পায়ের লাথিতে সে পাহাড়ের গায়ে আঁচড় পর্যন্ত যেন পড়ে না। এদিকে লাথি দিতে দিতে ক্লান্ত রাজিব। হাঁটুতে তীব্র ব্যথা। পায়ের গোড়ালিতে কখন রক্ত জমেছে বোঝেনি রাজিব। কিন্তু থামে না। সে এবার দূর থেকে ছুটে এসে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলতে চেষ্টা করে। রেগে গিয়ে একটা ইট খুঁজে নিয়ে আসে। ইট ছুড়ে মারে দরজার উপর। ঠক্ করে শব্দ হয়। খান খান করে ভেঙে পড়ে ইট। আশ্চর্য একটা পুরনো আমলের শক্ত ইট এভাবে ভেঙে পড়ল। না জানি এ দরজা তাহলে কতো শক্ত। রাজিব বুঝতে পারে এখন সে যা করছে তা পাগলামি। ব্যর্থ লোকেরা যখন কিছু করতে পারে না তখনই এসব পাগলামি করে। কিন্তু নিজেকে সামলাতে পারে না রাজিব। আবার লাথি চালায়। একটু থামে আবারও চালায়। আবারও। রাজিবের সর্বশরীর দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। এক পর্যায়ে ধপ করে বসে পড়ে মাটির উপর। সে এতটাই ঘেমেছে যে তার মাথার চুল পর্যন্ত ঘামে জবজব করছে। কানের গোড়া বেয়ে নামছে ঘামের ধারা। হাঁফাচ্ছে রাজিব হাঁফাচ্ছে। কিন্তু এভাবেই কি পরাজিত হবে রাজিব? এটা ঠিক যে তার জয় পরাজয় কেউ দেখছে না। কেউ রাজিবকে দেখে হেসে বলবে না পোড়ো বাড়ির দরজা খুলতে ব্যর্থ হয়েছে সে। সে যে এখানে এভাবে দরজা খোলার মিশনে গোহারা হয়ে গেছে তার সাক্ষী নেই কেউই। কিন্তু এটা তো ঠিক যে নিজের কাছেই হেরে যাবে রাজিব। নিজেকে ফাঁকি দেবে সে কী করে?
না এভাবে হারা চলবে না। একদিকে মনোবল অন্যদিকে সর্বশক্তি একত্র করে উঠে দাঁড়ায় রাজিব। সে খুঁজছে ধারালো কিছু, শক্ত কিছু যা দিয়ে দুই পাল্লার ভেতরে ঢুকিয়ে চাপ দেয়া যায়। আগে ডাল দিয়ে চাপ দিতে গিয়ে সে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু শক্ত কিছু দিয়ে চাপ দিলে নিশ্চয়ই ভাঙবে না। রাজিব বারান্দার এদিক ওদিক খুঁজতে থাকে। খুঁজতে খুঁজতে পুরনা কুয়োটার কাছে চলে আসে আতিপাতি করে খোঁজে চারদিকে। তখনই দেখতে পায় লোহার রডটাকে। শক্ত লোহার রড। রাজিবের মুখে হাসি ফুটে ওঠে, মুহূর্তেই উবে যায় সব ক্লান্তি। গভীর আত্মবিশ্বাসে আবার ও দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। হাঁটু দিয়ে দরজার নিচের পাল্লায় চাপ দেয়। একটু একটু করে ফাঁক করতে চেষ্টা করে দরজাটা। কিন্তু এক চুল যেন ফাঁক হয় না দরজা। রাজিব হাঁটুর চাপ বাড়ায় আর চেষ্টা করে দরজা খানিকটা ফাঁক করে রডটা ঢোকাতে। কিন্তু না, অসম্ভব। দরজা ফাঁক হচ্ছে না কিছুতেই। আবারও হতাশা ছেয়ে ধরতে চায় রাজিবকে। তখনই তার মনে পড়ে প্যান্টের  ভেতরে গোঁজা ছুরিটার কথা। চুরির ফলা ঢুকিয়ে দরজা যদি একটু ফাঁক করা যায় তাহলে সহজেই রড ঢুকিয়ে চাপ দিতে পারবে। রাজিব তাই করে। ছুরির ফলা একটু একটু করে ঢুকিয়ে আলতো চাপ দেয়। ঢুকছে ঢুকছে। বেশ একটু ফাঁক হয়। সে সর্বশক্তি দিয়ে রডটা ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। ছুরি ছিটকে পড়ে দূরে। মোচড় দিতে থাকে রাজিব, মোচড় আরও মোচড়। ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে খুলছে দরজা। রাজিব আচমকা স্থান কাল ভুলে চিৎকার করে ওঠে, হুররে দরজা খুলেছে। রাজিবের সামনে এখন পাল্লা খোলা একটা বিশাল দরজা আর সেই দরজার ওপাশে প্রায়ান্ধকার একটা ঘর।
ছয়.
রাজিব পায়ে পায়ে ঘরে ঢোকে। সারা ঘরের মেঝেতে ময়লার স্তূপ। যেন কোন স্মরণাতীত কাল থেকে ঝাড়– পড়েনি এ ঘরে। দেয়ালগুলোতে ঝুল আর মাকড়সার জাল। আপন মনে বছরের পর বছর ধরে জাল বুনে চলেছে মাকড়সারা। বাধা দেবার কেউ নেই। এমন স্বচ্ছন্দে বাধাহীন আনন্দে জাল বোনার আর কোনো জায়গা যেন এ বাড়ি ছাড়া আর কোথাও নেই। সত্যি এ বাড়ির মাকড়সা সম্প্রদায় অত্যন্ত ভাগ্যবান। নইলে এমন অভয়ারণ্যের সন্ধান তারা পেল কী করে! অন্য যে কোনো বাড়িতে সপ্তাহে না হলেও পনের দিনে অন্তত একবার ঝুল ঝাড়া লাঠির বাড়ি তাদের খেতে হয়। আর ছত্রাখান হয়ে যায় অনেক কষ্টে বোনা জালখানা। সে সবের কোনো ভয় নেই এখানে।
ঘরের মধ্যে বেশ কয়েকটা চেয়ার। ঘুণে খেতে খেতে সে চেয়ারের ঝরঝরে অবস্থা। চেয়ারের কাঠামোটা কোনোক্রমে দাঁড়িয়ে আছে। পায়ার কাছে স্তূপ হয়ে আছে রাজ্যের ঘুণ। আর ঘরের এক কোণে দেয়ালে হেলান দেয়া একটা জিনিস। চারকোনা লম্বাটে দেখে মনে হয় ওটা আলমারি জাতীয় কিছু হবে। তবে ওটার আর কিছুই এখন অবশিষ্ট নেই। নিচে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে কিছু পিতলের জিনিস। আধুনিককালে যেগুলোকে শোপিস বলে এগুলো অনেকটা সে ধরনের। পিতল বলেই বোধ হয় কালো হয়ে যাবার পরও টিকে আছে। রাজিব নিশ্চিত তেঁতুল দিয়ে ঘষে ঘষে কয়েকদিন মাজলেই ও জিনিসগুলো ঝকঝকে হয়ে যাবে। রাজিব অবাক হয়, এ বাড়ির কাঠের জিনিসগুলো এভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে অথচ কাঠের দরজাটা কী সুন্দর নিরেট! সম্ভবত দরজা বলেই সবচেয়ে মজবুত কাঠ দিয়ে বানানো হয়েছে। রাজিব ঘরের মাঝে আর এক পা ফেলে। অজস্র পোকা মাকড় ছেয়ে ধরে ওকে। ওর গা বেয়ে পোকা হাঁটতে থাকে। বহুদিন পরে ঘরে মানুষের অস্তিত্ব অনুভব করে কাঠের কড়ি বরগার মাঝ থেকে ডানা ঝাপটে উড়তে থাকে কয়েকটা পাখি। দু’ একটা উড়ে বাইরে চলে যায় খোলা দরজা দিয়ে। দুটো পাখি রাজিবকে লক্ষ্য করে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে।
রাজিব প্রথম ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের একটা ঘরে প্রবেশ করে। এ ঘরটা অনেক বড়। বিশাল বিশাল জানালা। কিন্তু জানালাগুলো সবই বন্ধ। এ ঘরও আগের ঘরের মতো ময়লা। কিন্তু এ ঘরের সব কিছু আগের ঘরের থেকে অন্যরকম। কোনো কিছুই যেন আগের ঘরের সাথে মেলে না। ঘরের এককোণে বর্ম পরা দুটো পুরুষ মূর্তি। এখানে এই পুরনো নির্জন বাড়িতে বর্মপরা মূর্তির কী প্রয়োজন বুঝে উঠতে পারে না। ঘরের মাঝখানে একটা ভাঙা ঝাড়বাতি। নিচে অজস্র কাচের টুকরো। আর সেই টুকরাগুলোর মাঝে কিসের যেন দাগ। ঝাড়বাতির সাথে ইলেকট্রিক বাল্ব বসানো। রাজিব অবাক হয়ে ভাবে, সেই আদ্যিকালে ইলেকট্রিকের বাল্ব এলো কী করে। এ ঝাড়বাতিতে তো বাল্বের জায়গায় মোমবাতি থাকার কথা। সেটাই তো এ ঝাড়বাতি আর এ বাড়ির সাথে মানানসই। কিন্তু মোম না হয়ে ইলেকট্রিকের বাল্ব! তার মানে এ বাল্ব বা ইলেকট্রিসিটি পরে সংযোজন করা হয়েছে। এ কথা ভাবার সাথে সাথে রাজিবের বুদ্ধি যেন খুলে যায়। এ ঝাড়বাতিই বুঝি কোনো মানুষের মাথার উপর ভেঙে পড়েছিল। আর তার মাথা কেটে যে রক্ত ঝরেছিল যে কোনো কারণেই হোক সে রক্ত তখন মোছা হয়নি। হতে পারে মানুষটাকে নিয়েই তখন সবাই এতো ব্যস্ত ছিল যে রক্ত মোছার কথা ভুলে গিয়েছিল। আর সেই রক্ত শুকাতে শুকাতে কালের বিবর্তনে কঠিন কালো রঙ নিয়েছে। রাজিব কৌতূহলী চোখে আবারও চারদিকে দেখতে থাকে। বিশাল বিশাল অনেকগুলো ঢাল তলোয়ার দেয়ালে রাখা। ইস্পাতের কুড়ালও আছে অনেকগুলো। কতো বছর ধরে এগুলো ঝোলানো রয়েছে তারপরও ধারালো। দেয়ালে একটু পর পরই মশাল। রাজিব অবাক হয়, ঝাড়বাতিতে বৈদ্যুতিক বাল্ব লাগিয়ে আধুনিক হবার চেষ্টা অথচ দেয়ালে বিশাল বিশাল পাটের মশাল। কী অদ্ভুত বৈপরীত্য! একপাশে একটা টেবিলের উপর অনেকগুলো পাত্র। দেখলেই বোঝা যায় ওগুলো পানপাত্র। পানপাত্রগুলো এক একটা এক এক ধরনের। সিলভার আর গোল্ডেন কালারের পানপাত্রগুলোর গায়ে মণিমুক্তার ডিজাইন করা। দেখলেই বোঝা যায় এগুলো বহু মূল্যবান। পুরো ঘরের সাজশয্যা দেখে রাজিবের মনে হয় সে মধ্যযুগের কোনো রাজমহলে ঢুকেছে।
এ ঘরের সবকিছু যেন অন্য ঘর এমনকি বাড়িটার সাথে একেবারেই বেমানান। পাশের ঘরে যেখানে ফার্নিচারগুলো ঘুণে খেয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে সে তুলনায় এ ঘরের ফার্নিচারগুলো অনেকটাই নতুন। যেন আরোপিত, অনেকটাই কৃত্রিম। তাহলে কি এ ঘরের ফার্নিচার ঝাড়বাতি সাজসজ্জা সব কিছুই পরে সংযোজন করা হয়েছে?
সাত.
এ ঘর থেকে পাশের ঘরে ঢোকে রাজিব। এ ঘরটা বেশ বড় আর খোলামেলা। বন্ধ জানালার কোন্ কোনা দিয়ে যেন এক চিলতে আলো এসে পড়েছে। মেঝেতে আলোর একটা সরু রেখা। সে সরু রেখা ধরে তাকাতে তাকাতে এক কোণে বিশাল একটা পিয়ানোর উপর চোখ যায় রাজিবের। কে বাজাতো এই পিয়ানো? হঠাৎ করে কাশতে থাকে রাজিব। তার হাঁটাচলার কারণে ঘরের ধুলো উড়ছে। আর সেই ধুলো উড়ে এসে ঢুকছে রাজিবের মুখে। রাজিব এবার ভালো করে ঘরটা দেখে। ঘরের অন্য কোনায় বেশ বড়সড় একটা ফায়ার প্লেস। রাজিব মৃদু হাসে। এ এলাকায় আশপাশের অন্য জেলাগুলো থেকে শীত বেশি পড়লেও ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালাবার মতো শীত পড়ে না। তবে এ বাড়িটা ঘিরে প্রচুর গাছ বলে শীত একটু বেশি পড়ার কথা। রাজিব ঘুরে ঘুরে ফায়ার প্লেস আর চিমনিটা দেখতে থাকে। বাড়ির লোকজন খুব সৌখিন আর খুবই আধুনিক ছিল তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। সর্বশেষ প্রযুক্তিকে ধরার চেষ্টা ছিল তাদের সবসময়। ফায়ার প্লেসের পাশেই দুটো চমৎকার ইজি চেয়ার। ইজি চেয়ারের কাপড়ের রং এখন আর বোঝা যায় না। কোনো কালে এটা হয়তো বাজারের সেরা কাপড় ছিল কিন্তু এখন এটা ময়লা ছাওয়া বিবর্ণ কোনো কাপড় ছাড়া আর কিছু না। একদিন এ চেয়ারগুলোতে দুলে দুলে যারা আরাম করতো তারা এখন কোথায়? রাজিবের মনে এখন কিছুটা ভয় কাজ করছে। হঠাৎ করেই যেন তার মনে পড়েছে রহস্যঘেরা বাড়িটাতে বহুক্ষণ ধরে সে একা। যে বাড়ি থেকে নাকি কেউ কখনও ফিরে আসে না। রাজিব ফিরে যাবার একটা তাড়া অনুভব করে অথচ কী এক অদৃশ্য শক্তি যেন তাকে কেবলই সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ঘরের দেয়ালে ঝুলছে বিশাল একটা পেন্ডুলাম ঘড়ি। কতো কাল ধরে এ ঘড়ির পেন্ডুলাম থেমে আছে কে জানে। আশ্চর্য ঘড়িটা যেন রাজিবকে ডাকছে, এসো এসো আমাকে বাজাও। আমি কতো কাল ধরে বাজিনি। কতো কাল ধরে এ বাড়ির মানুষের প্রহর ঘোষণা করে সচেতন করিনি। কি যেন এক জাদুকরী শক্তি রাজিবকে ঘড়িটার দিকে টেনে নিয়ে যায়। ঘড়ির সমস্ত শরীর জুড়ে ধুলোর পুরু প্রলেপ। কিন্তু ওই ধুলোর মাঝে হাত দিতে রাজিবের একটুও বাধে না। ও ঘড়িতে চাবি দেয়। ঢং ঢং শব্দে বেজে ওঠে ঘণ্টা। আর একই সাথে উড়ে যায় একটা বাদুড়।
ভয়ে কেঁপে ওঠে রাজিব। ঘড়ির শব্দ কিংবা বাদুড়ের ওড়া কোনোটার জন্যই তৈরি ছিল না রাজিব। ঘড়ি কি তবে বাদুড়ের ঘুম ভাঙাল? ও কি বিরক্ত ঘড়িটার উপর? ঘড়িটার দিকে ভীত চোখে আবারও তাকায় রাজিব। ঘড়ি চলছে বটে কিন্তু টাইম ঠিক নেই। বহুকাল আগে কী কারণে এগারোটার উপর এসে থেমে গিয়েছিল ঘড়ির কাঁটা। এখন সেই এগারোটা থেকে একটু একটু নড়ছে সেকেন্ডের কাঁটা। এরপর নড়বে মিনিট তারপর ঘণ্টা। রাজিব ইচ্ছে করলেই তার হাতের ঘড়ি দেখে টাইমটা ঠিক করে দিতে পারে। কিন্তু সে ইচ্ছে তার হয় না। আবারও কোনো বাদুড়ের সাক্ষাৎ সে পেতে চায় না। আর কোন সুদূরকালে বন্ধ হওয়া ঘড়ি চাবি দেয়ামাত্র চলতে শুরু করল এটাও অদ্ভুত। এ বাড়ির সব কিছুই যেন অলৌকিক। বাস্তব জীবনের কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ বেশিক্ষণ এ অলৌকিকতার মধ্যে থাকতে পারে না। চলে যেতে হবে এখান থেকে যতো দ্রুত সম্ভব।
কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে না। রাজিবের মন এবং মস্তিষ্ক এ বাড়ি থেকে তাকে বেরিয়ে যাবার তাগিদ দিলেও শরীর তাকে টেনে নিয়ে যায় পাশের ঘরে। এ ঘরটা আগের ঘরের মতোই সাইজ। তবে দেয়ালে নোনাধরা। চুন খসে পড়ছে জায়গা জায়গা থেকে। এক পাশে খানিকটা ইট বেরিয়ে যেন দাঁত বের করে হাসছে। দেয়ালে বিশালাকার কিছু ছবি ছিল বলে মনে হয়। কিন্তু এখন আর সে ছবি চেনার কোনো উপায় নেই। হতে পারে এ বাড়ির বাসিন্দাদের ছবি টানানো ছিল দেয়ালে। সুখী পারিবারিক কোনো ছবি কিংবা কোনো ব্যক্তিবিশেষের একক ছবি অথবা কোনো মানুষের ছবিই নয়। কোনো বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর আকা আর্ট। কিন্তু আসলে কী ছিল তা এখন আর বোঝার উপায় নেই। রাজিব একবার ভাবে এই ছবিগুলোক ঝেড়ে মুছে দেখলে হয়তো এর মাঝে কোনো মহামূল্যবান ছবি পাওয়া যাবে। সে ছবির নিশ্চয়ই রয়েছে কোনো অ্যান্টিকস ভ্যালু। হয়তো এ ছবি নিলামে উঠতেও পারে। দাম হতে পারে কোটি কোটি ডলার। সে কি তবে সেই কাজই করবে? করতে পারলে সবই তার। এখানে ভাগ করে দেবার মতো কেউ নেই। কিছুটা লোভও তার মনে কাজ করে। মন একবার স্থির করে আবার পিছিয়ে আসে। এতোগুলো ছবি একা পরিষ্কার করা খুবই কঠিন। তাছাড়া পরিষ্কার করবে কী দিয়ে, কোনো ঝাড়ন তো আশপাশে দেখছে না। তাছাড়া অবর্ণনীয় চেষ্টা করে ছবিগুলো পরিষ্কার করে হয়তো দেখবে ছবিগুলো পোকায় খেয়ে ফেলেছে। কিংবা নষ্ট হয়ে গেছে। কাজেই ও চিন্তা মন থেকে বাদ দেয় রাজিব। ছবির পাশে একটা টেবিলের উপর চমৎকার একটা লণ্ঠন রাখা। ধুলো পড়ে এ লণ্ঠনকে এখন আর লণ্ঠন বলে চেনারও উপায় নেই।
পাশের ঘর থেকে একটা শব্দ হয়। দ্রুত পাশের ঘরে ঢোকে রাজিব। ঢুকেই অবাক হয়। এ ঘরের অবস্থা একেবারেই সঙ্গিন। দেয়ালে শুধু ইটগুলোই আছে। সিমেন্ট চুনের বালাই নেই। ছাদের একপাশ থেকে অনেকটা আস্তর চাই ধরে ভেঙে পড়েছে। রাজিব ভেবে পায় না কী করে এ ঘরটার অবস্থা এমন হলো। মেঝের অবস্থা আরো করুণ। শ্যাওলা পড়া মেঝের জায়গায় জায়গায় মাটি বেরিয়ে পড়েছে। সে মাটির মাঝে গজিয়ে উঠেছে ঘাস। বেশ সতেজ আর সবুজ সে ঘাস। আলো বাতাসবিহীন এমন একটা ঘরে ঘাস সবুজ থাকে কী করে! আর একটা পরিপূর্ণ বাড়ির একটা ঘর এতোটা নষ্টই বা হয় কী করে যে মেঝেতে ঘাস গজাতে পারে! তাহলে কি নির্মাণে কোনো ত্রুটি ছিল নাকি অবিশ্বাস্য কোনো ঘটনা? রাজিব অবাক হয়ে সবিস্ময়ে ঘরটা দেখছে আর পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় তার পায়ের পাশ দিয়ে দ্রুত সরসর করে চলে গেল যেন কী। রাজিব কেঁপে উঠল। ছোট্ট একটা লাফ দিল। অবাক হয়ে দেখল তাকে ছুঁয়ে চলে গেল একটা সাপ। কিছু দূরে গিয়ে গোল হয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে রইল। আর তখনই খেয়াল করল আরও কয়েকটা সাপ ঘুরে বেড়াচ্ছে পুরো ঘরজুড়ে। এমন সাপ সে কখনই দেখেনি। এ সাপের নামও জানে না। শরীরের চেয়ে যেন ওদের মুখটা বড় আর লকলক করছে লাল জিহ্বা। যে কোনো সময় যে কাউকে ঠোক্কর দিতে ওরা উদগ্রীব। অনেকদিন কাউকে ঠোক্কর দেয়া হয় না সে জন্য ওদের ক্ষুধা যেন বড় বেশি। রাজিব ঝুঁকড়ে যায়। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তখনই একসাথে দুটো সাপের চোখ পড়ে রাজিবের উপর। আয়েশে শরীর মেলে দিয়ে দ্রুত রাজিবের দিকে এগিয়ে আসে ওরা। রাজিব বুঝতে পারে এখনই তার এখান থেকে সরে পড়া দরকার। নইলে নিশ্চিত সাপের ছোবলে মারা যাবে সে। কিন্তু তার পা যেন মাটির সাথে আটকে গেছে। সাপগুলো এগিয়ে আসছে, এগিয়ে আসছে। একটা একটু সামনে অন্যটা পেছনে। রাজিবের একেবারে কাছে এসে পড়েছে ওরা। ফোস করে ফণা তুলল। আর রাজিব আর্তচিৎকার করে পেছনে দৌড় দিলো। এক দৌড়ে বেরিয়ে এসে ঢুকল পাশের ঘরে। সর্বশক্তি দিয়ে বন্ধ করল কাঠের মোটা দরজা। দ্রুত ওঠানামা করছে ওর বুক। হাঁফাচ্ছে। দরদর করে ঘাম ঝরছে। তবে কি এ যাত্রা সাপের কবল থেকে বেঁচে গেল রাজিব!
আট.
আট.
রাজিব ধাক্কা দিতেই বিশাল দরজাটা সহজেই খুলে গেল। ওরা যতোটা ভেবেছিল তেমন কোনো ক্যাচ ক্যাচ শব্দও হলো না। অর্থাৎ নিয়মিত এই দরজা খোলা হয় তাই দরজায় কোনো জং নেই বা দরজা খুলতে জোর জবরদস্তি বা শক্তি প্রয়োগের কিছু নেই। ওরা দু’জন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে কথা বলল। কী বলল মুখে উচ্চারণ না করলেও দু’জনই বুঝল। সামনে থেকে রাজিব মৃদু হাসল। কী বোকা ওরা, ওরা ভাবছে ওদের ভাবনা চিন্তার কিছুই বুঝতে পারছে না রাজিব। রাজিব ঘরের ভেতরে পা রাখল। আর পেছন পেছন ওরা দু’জন। ওদের চোখে ভয়, পায়ে জড়তা। ঠিক তখনই ঘরের ভেতর একটা বিশালাকৃতির সাপ দেখে আর্তচিৎকার করে উঠল দু’জন। ভ্রƒ কুঁচকে বিরক্তির সাথে তাকাল রাজিব। চোখে মুখে তাচ্ছিল্য। সাপটা দ্রুত ওদের দিকে এগিয়ে আসছে আর ওরা দরজার দিকে পিছু হটছে। রাজিব এগিয়ে গিয়ে সাপের মাথায় লাথি মারে। হালকা একটা স্যান্ডেল রাজিবের পায়ে। স্যান্ডেলের চামড়ার ফাঁক দিয়ে সহজেই ছোবল দিতে পারত সাপ। অথচ কী অবলীলায় সাপের মাথায় লাথি মারল রাজিব। ভয় নেই, উত্তেজনা নেই, দ্বিধা নেই। মাথায় আঘাত পেয়ে নুয়ে পড়ল সাপ। রাজিব তার পায়ের স্যান্ডেল দিয়ে সাপের মাথা মেঝেতে পিষে ফেলল। ওরা দু’জন এখন রাজিবকে ভয় পাচ্ছে। সাপকে যে এভাবে পিষে মারতে পারে সে অনেক ভয়ানক কাজ করতে পারে। সে যেন অজয় অমর অক্ষয় অব্যয় এমনই ভাব তার প্রতিটি পদক্ষেপে। কোনোদিনই সে মরবে না। কারো কাছে নতি স্বীকার করবে না। তার খাড়া নাক আরও যেন খাড়া দেখাচ্ছে। তার চোখ ধক ধক করে জ্বলছে। তার দিকে তাকিয়ে ওরা দু’জন ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। মরা সাপটা নেতিয়ে পড়ে আছে। সাপটাকে অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে রাজিব। রাজিবের মনে পড়ছে সেদিনের কথা যে দিন সে সাপের ভয়ে একটা ঘর থেকে ছুটে পালিয়ে এসেছিল। সেদিনের সেই ভয় এখন রূপ নিচ্ছে প্রতিহিংসায়। দাঁত পিষে সে বলে, সাপের বংশ ধ্বংস করবো আমি।
তার মাথার রগগুলো ফুলে উঠেছে। শরীরে মাসল ফুলেছে ততোধিক। পেশিগুলো শক্ত হয়ে গেছে। হাতের মুঠি সে খুলছে আর বন্ধ করছে। তাকে দেখাচ্ছে দানবীয়। তীব্রবেগে বড় বড় পা ফেলে সে সাপের ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ঠিক তখনই ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল বাড়িটা। কাঁপতে শুরু করল। প্রথমে মৃদুলয়ে তারপর দ্রুত। দেয়াল থেকে ঝনঝন শব্দে খসে পড়ল অনেকগুলো জিনিস। বাড়িটা যেন আছাড়ি পিছাড়ি খেতে লাগল। কখনও দোলনার মতো সমতালে দুলছে, কখনও ধাই করে কিছুটা উপরে উঠছে, কখনও আবার খানিকটা নিচে নেমে যাচ্ছে। কখনও মনে হচ্ছে একটা মোচড়ানো কৌটার মতো দুমড়ে মুচড়ে যাবে। মেঝের উপর পা রাখা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠল রবিন আর হুমায়ুনের পক্ষে। এমন কোনো সাপোর্ট নেই যা ধরে ওরা দাঁড়াতে পারে। ভয়ে ওরা পরস্পরের দিকে এগিয়ে গেল। আর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে পড়ে গেল মেঝেতে। মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে ওরা। ওদের বুক চিরে বেরিয়ে আসছে আর্তস্বর। মাকে ডাকছে, আল্লাহকে ডাকছে। আর লম্বা পা ফেলে যেতে যেতে থেমে গেল রাজিব। সাথে সাথে থেমে গেল কম্পন। বাড়িটা আস্তে আস্তে সোজা হয়ে গেল। চারপাশ একদম শান্ত। একটু আগে যে এতোবড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে এখন দেখে তার কিছুই বোঝার উপায় নেই। ধীরে ধীরে রাজিবের শক্ত মুঠি খুলে গেল। ফোলা রগ আর মাংসপেশি স্বাভাবিক হয়ে উঠল। ওর চোখের রক্তবর্ণ এখন স্বাভাবিক। সব কিছুই স্বাভাবিক তারপরও যেন ভৌতিক চারদিকে। রবিন আর হুমায়ুন মাটি থেকে উঠে দাঁড়ালো। ওরা পরস্পর ফিস ফিস করে কথা বলতে শুরু করে ভয়ে থেমে গেল। রাজিবকে ওদের যতো ভয়। এ বাড়িতে এসব ঘটনা ঘটবে তার আভাসও তো তাদের রাজিব দেয়নি। ওরা তার বন্ধু। সব কিছুই তো খুলে বলা উচিত ছিল। এই পরিবেশ এই নির্জনতা পাথরের ভার হয়ে চেপে বসেছে রবিন আর হুমায়ুনের বুকে। হঠাৎ করেই রবিন দরজার দিকে পিছু হটতে শুরু করে। না না এখানে সে কিছুতেই থাকবে না। গুপ্তধনের তার প্রয়োজন নেই। তিন পুরুষ বসে খাওয়ারও দরকার নেই।
পা শক্ত হয়ে যায় রবিনের। এখন আর তার চলার শক্তি নেই। রাজিব একবারও পেছনে ফেরেনি অথচ জেনে গেছে সে পালাবার চেষ্টা করছে। কিভাবে কিভাবে? তবে কি রাজিবের মাঝে কোনো অলৌকিক শক্তি আছে? রবিন থেমে গেলেও উত্তেজিত হয়ে ওঠে হুমায়ুন। এখন আর রাজিবকে সে একটুও বিশ্বাস করতে পারছে না। ওর ওপরে আস্থা রেখে অজানার পথে পাড়ি জমানোর মতো মনের অবস্থা এখন আর হুমায়ুনের নেই। রাজিবকে এখন রীতিমতো ওদের প্রতিপক্ষ বলে মনে হচ্ছে। যে কোনো মূল্যে এখান থেকে পালাতে হবে। ফিরতে হবে ভাই-ভাবীর সোনার সংসারে। এইতো দিন কয়েক পরে তার ভাবীর কোলজুড়ে আসছে সন্তান। তাই নিয়ে তাদের কতো আনন্দ কতো আহ্লাদ। আর সে কি না বোকার মতো গুপ্তধনের লোভে এখানে চলে এসেছে। ছি: ছি:! তাকে ফিরতে হবে। দু’ভাই মিলে কাজ করলে নিশ্চয়ই নিজের অবস্থা ফেরাতে পারবে তারা। ঘরের একপাশে একটা লণ্ঠন দেখে দ্রুত হাতে তুলে নেয় হুমায়ুন। সর্বশক্তি দিয়ে রাজিবের মাথায় আঘাত করতে উদ্যত হয়। ঘুরে দাঁড়ায় রাজিব। হিমশীতল দৃষ্টিতে তাকায় হুমায়ুনের দিকে। সে দৃষ্টি এতোই শীতল আর এতোই অন্তর্ভেদী যে মনে হয় হুমায়ুনের ভেতর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে সে। হুমায়ুন কী ভাবছে, তার মনের অতলান্তে কী ঘটছে সবই যেন জানে রাজিব। সে দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে হুমায়ুনের শুধু মুখ নয় সর্বশরীর থেকে রক্ত সরে যায়। হাত থেকে খসে পড়ে লণ্ঠন। দাঁতে দাঁত পিষে ভীতিকর কণ্ঠে ফ্যাস ফ্যাসে গলায় হিসহিস করে রাজিব বলে, উল্টোপাল্টা কিছু করার কথা স্বপ্নেও ভেবো না। খালাস হয়ে যাবে।


তেরো.
রাজিব ধীরে ধীরে চোখ খোলে। আস্তে আস্তে দম নিতে থাকে। প্রচণ্ড ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে তার শরীর। কিন্তু ক্লান্ত হলে চলবে না। এখন থেকে তাকে চলে যেতে হবে। একটু আগে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিল সে। অদ্ভুত এক শীতলতা গ্রাস করে ফেলছিল তাকে। এক অস্পষ্ট ফিসফিসে আওয়াজও শুনতে পাচ্ছিল সে। কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। কে ছিল কিংবা কারা ছিল জানে না রাজিব। জানে না কারা তাকে মৃত্যুর গহ্বরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে রাজিব। এখন তার যতো দ্রুত সম্ভব গ্রামে ফিরেও যাওয়া দরকার। দরকার এই অদ্ভুত ভুতুড়ে বাড়ি ত্যাগ করা। রাজিবের নিঃশ্বাস ততক্ষণে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ক্লান্তি আছে অপরিসীম। কিন্তু ক্লান্তিকে আমল দিলে চলবে না। বাড়িতে ফিরতে পারলে অনেক বিশ্রাম নিতে পারবে সে, অনেক ঘুমাতে পারবে। রাজিব উঠে দাঁড়াতে যায় আর তখনই ভেসে আসে একটা গম্ভীর কণ্ঠ। গম্ভীর কিন্তু অত্যন্ত মিষ্টি আর কিঞ্চিৎ ক্লান্ত সেই কণ্ঠে বলে, উঠো না, পালানোর চেষ্টা করো না।
কেঁপে ওঠে রাজিব। ঘরের প্রতিটি কোণ তন্ন তন্ন করে দেখে। কেউ নেই, কেউ না। কে তাহলে কথা বলছে? কোথা থেকে কথা বলছে। ভয়ার্ত রাজিব কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে, কে আপনি। আমি তো আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না। কোথায় আপনি?
এই ঘরে। তোমার আশপাশে। আমাকে দেখতে পাচ্ছো না কারণ আমার কোন শরীর নেই। আমার অস্তিত্ব আছে কিন্তু কোন শরীরে তার প্রকাশ নেই।
আপনার নামটা দয়া করে বলবেন?
আমার নাম আদিত্য। আর কিছু জানতে চাও?
কী চান আপনি আমার কাছে? কেন আমাকে যেতে বারণ করছেন?
একটু আগেই না তুমি কাকুতি মিনতি করে বলছিলে আমি যদি তোমাকে বাঁচিয়ে দিই তাহলে আমি যা চাইবো তাই করবে। বল এখন কি করবে তুমি আমার জন্য? এই বাড়িতে ঢোকার পর থেকে তুমি কি কি করেছ সবই আমার জানা। তুমি বড় লোভী। এখন সেই লাভের খেসারত তুমি কিভাবে দেবে?
বিশ্বাস করুন আমি কিছুই করিনি। আমি একটা বল খুঁজতে এ বাড়িতে ঢুকেছিলাম। কাঁপা এবং কিছুটা সতর্ক কাঁপা কণ্ঠে রাজিব বলে।
অদৃশ্য কণ্ঠস্বর হাসতে থাকে। সে হাসি শুনে হিম হয়ে আসতে থাকে রাজিবের পুরোটা শরীর।
তুমি কিছুই করোনি তাই তোমার পুরোটা পকেট ভর্তি সোনাদানা হীরে জহরত। আরো ধন সম্পদ পাবার লোভে ঢুকেছ এ ঘরে!
এবার রাজিব একেবারে ভেঙে পড়ে। অদৃশ্য এই শক্তির কিছুই অজানা নয়। তার প্রতিটি পদক্ষেপ তার নখদর্পণে। তার কাছে কিছু লুকোনোর চেষ্টা করা রীতিমতো বিপজ্জনক। তার চেয়ে সব কিছু খোলাখুলি বলে দিলে যদি রক্ষো পাওয়া যায়।
আমি ভুল করেছি, অন্যায় করেছি। আমাকে মাফ করে দেন। এই সোনাদানা সব আপনাকে দিয়ে দিচ্ছি। আপনি শুধু আমাকে ছেড়ে দেন।
হাসি আরও বিস্তৃত হয়। সে হাসি যেন আরও কাছে এগিয়ে আসে। ধূম্রজাল সৃষ্টি হয় যেন রাজিবের সামনে। সে ধোঁয়ার মধ্যে আবছা একটা অবয়ব যেন দেখা যায়।
কিন্তু কেন তোমাকে আমি ছাড়ব। এই অদৃশ্য অবস্থা থেকে শরীরে ফিরে আসতে তোমার রক্ত আমার খুবই প্রয়োজন। এই রক্তের তৃষ্ণা এখানে যারা আসে তাদের আমি ফিরতে দিই না। তাদের রক্ত আমি শুষে নিই। তোমারটাও নেবো। ভেঙে খান খান বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত রাজিব কাঁদতে কাঁদতে হাত জোড় করে মিনতিমাখা কণ্ঠে বলে, আমাকে ছেড়ে দেন। আপনি যা বলবেন আমি তাই করব।
বেশ তাহলে সেই কথাই হোক। আমি তোমার জীবন ভিক্ষে দেবো। তার বিনিময়ে কমপক্ষে দশ জন মানুষকে তুমি এখানে নিয়ে আসবে। প্রতিদিন অন্তত একজন করে। তাদের রক্ত আমি শুষে নেব। শেষ মানুষটাকে যেদিন তুমি আনবে সেদিন তোমার মুক্তি। তারপর তোমাকে আমি অসীম ক্ষমতাধর করে দেবো।
কিন্তু অতো মানুষ আমি কোথায় পাব। আর ওরা আমার সাথে আসবে কেন?
আসবে কারণ এখান থেকে তুমি যখন ফিরে যাবে আমার ক্ষমতার কিছু অংশ তোমার সাথে যাবে।
আর একটা গ্রামে কি মানুষ কম। আমি তো মাত্র একশ জনের কথা বলেছি। তুমি ওদের কি টেকনিকে আনবে সেটা তোমার ব্যাপার।
রাজিব ক্ষণকাল ভাবে। এখান থেকে মুক্তি পাওয়াই এখন সবার আগে দরকার। একবার এখান থেকে বেরোতে পারলে আর যদি এখানে না আসে ওই অদৃশ্য শক্তি তার কী করতে পারবে। কিছুই না।
ভাবনা শেষ হয় না। তার আগেই ভেসে আসে সেই গুরু গম্ভীর কণ্ঠস্বর, আমার ক্ষমতা সম্পর্কে তোমার কোন ধারণা নেই তাই ভাবছ গ্রামে গেলেই তোমার বিপদ কেটে যাবে। শোন হে মানুষের বাচ্চা, তুমি যেখানেই যাবে আমার ছায়া তোমার পিছে পিছে থাকবে। সেখানেই প্রভাব বিস্তার করব আমি। কাজেই ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করো না।
আমি রাজি।
এইতো বুদ্ধিমানের মতো কথা। আমি খুব খুশি হয়েছি। শোন তোমার পকেটে যা আছে সব তুমি নিয়ে যাও। ওসবে আমার কোন আগ্রহ নেই। আমার একমাত্র আগ্রহ মানুষে। তরতাজা মানুষে। বিকৃত হাসি হাসে আদিত্য। কেঁপে ওঠে রাজিব। আদিত্যকে কথা দেয় পরদিনই সে মানুষ নিয়ে হাজির হবে এ বাড়িতে।
রাজিব দ্রুত বাড়িটি থেকে বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে দেখে মূল ফটকের সামনে অনেক মানুষ। যে ছেলেটিকে সে ফিরিয়ে দিয়েছিল সে গিয়ে গ্রামে খবর দিয়েছে। গ্রামের লোক ছুটে এসেছে বাড়িটার সামনে। ধরেই নিয়েছে রাজিব কোনদিন ফিরবে না। কারণ এ বাড়িতে যে যায় সে আর কখনও ফেরে না। রাজিব ভিড়ের মাঝে মাকে দেখতে পায়। মা কাঁদতে কাঁদতে এসে জড়িয়ে ধরেন রাজিবকে।
ফিরেছিস বাবা। ভগবান তোকে ফিরিয়ে দিয়েছে। ভেবেছিলাম আর কোনদিন তোকে ফিরে পাবো না।
গ্রামের লোক তাকে মাথায় নিয়ে হইহই করে চলল গ্রামের দিকে।
চৌদ্দ.
পরদিন দুপুর। বাড়িতে শুয়ে আছে রাজিব। বড্ড ক্লান্ত সে। বিশ্রামের খুবই প্রয়োজন। কিন্তু শুয়ে থাকলেও তার মনের কোন বিশ্রাম নেই। মনে মনে ভীষণ উত্তেজিত সে। এক একটা মুহূর্ত পার হচ্ছে আর তার উত্তেজনা বাড়ছে। সময় যে দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে। আজ দিনের মধ্যে একটা মানুষ নিয়ে তাকে যেতে হবে ওই বাড়িতে। বিকেলেই যাওয়া ভাল। কারণ মানুষটাকে রেখে তাকে ফিরতে হবে। সন্ধ্যের আগেই সে ওই ভূতের বাড়ি থেকে ফিরতে চায়। কিন্তু মানুষ সে কোথায় পাবে? কিভাবে পাবে? পারত পক্ষে কেউ ওই ভূতের বাড়িতে যেতে রাজি হবে না। তাহলে! রাজিব ঘামতে থাকে। মা ঘরে ঢোকেন। বড় শখ করে রাজিবের জন্য পায়েস রেঁধেছেন তিনি। তার ছেলেটা ওই ভূতের বাড়ি থেকে সুস্থ অবস্থায় ফিরে এসেছে। যে বাড়ি থেকে কেউ কখনও ফেরে না সে বাড়ি থেকে তার ছেলেটা ফিরেছে। তাহলে নিশ্চয়ই অন্যদের চেয়ে তার ছেলের গুণ অনেক বেশি আছে। হয় সে বুদ্ধিমান না হয় সাহসী। একটা কিছু তো অবশ্যই। তা না হলে তার ছেলেটা ফিরল কী করে। মার চোখে মুখে ছেলের জন্য গর্ব। যেন তার ছেলে দিগি¦জয় করে ফিরেছে। এই গর্বের পেছনে একটু শঙ্কাও আছে। যদি তার ছেলে না ফিরতো তাহলে কি হতো! ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে রাজিবের মায়ের। বালাই বালাই। মায়ের মনে কি এমন দুশ্চিন্তা আসতে আছে। ছি। নিজেকে ধিক্কার দিয়ে ছেলের পাশে বসেন মা। এই নে বাবা পায়েসটা খেয়ে নে। বেশি করে গুড় আর দুধ দিয়ে রেঁধেছি।
আমার এখন খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না মা। তুমি রেখে দাও, পরে খাবো।
সে কিরে পায়েসে তো কখনও তোর অরুচি দেখিনি। বাটির পর বাটি শেষ করে ফেলিস। আমি আজ বেশি করে রেঁধেছি। নে খেয়ে নে। মুখে দিয়ে দেখ ভাল লাগবে।
না মা আমার ইচ্ছে হচ্ছে না।
কিরে তোর শরীর খারাপ নাকি। জ্বর জারি নাতো? দেখি দেখি।
মা রাজিবের কপালে হাত দেন। কপাল ঠাণ্ডা।
জ্বর তো নেই। পেটে ব্যথা নাকি অন্য সমস্যা?
আহ মা আমি তো তোমাকে বললাম আমার কোন সমস্যা নেই। এখন খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। পরে খাব। তুমি পায়েসের বাটিটা রেখে এসে আমার পাশে বস।
মা পায়েসের বাটি রেখে এসে রাজিবের পাশে বসেন। রাজিব পকেট থেকে সোনা দানাদগুলো বের করে দেয়। শুধু একটা আংটি পকেটে রেখে বাকিগুলো মার হাতে তুলে দেয়। মা অবাক হন। সোনা দানা হাতে নিতে ভয় পান।
এ যে অনেক সোনা। অনেক টাকার জিনিস। পেলি কোথায়? মায়ের কণ্ঠে ভয় আর সন্দেহ।
ভয় পাবার কিছু নেই আমি চুরি করিনি মা। ওই পোড়োবাড়িতে একটা বস্তার মধ্যে পেয়েছি। ওখানে আরও অনেক সোনাদানা আছে।
কিন্তু না বলে কিছু আনা তো অন্যায়। শেষে যদি কোন অসুবিধায় পড়িস। দেখ বাবা আমরা গরিব মানুষ। তবে গরিব হলেও মা আর ছেলেতে ভালোই আছি। লোভ করতে গিয়ে শেষে আবার কোন বিপদে পড়ি। থানা পুলিশের কোন বিপদে জড়াবো না তো?
বিপদের কোন ভয় নেই মা। ওই বাড়িতে বলার মতো কেউ নেই।
বলে বটে কিন্তু সিঁটিয়ে ওঠে ভয়ে। সত্যিই কি কেউ নেই ও বাড়িতে। তাহলে যে অশরীরী মানুষের সাথে তার কথা হল সে কে? যার অদৃশ্য অঙ্গুলি হেলনে তার সারাটা শরীর শীতলতার স্পর্শে নির্জীব হয়ে যাচ্ছিল সে কেন? সে যে রাজিবের জীবনে মূর্তিমান আতঙ্ক। তবে এ কথা ভেবে আশ্বস্ত হতে চেষ্টা করে যে ওই অশরীরী যেই হোক সেইতো তাকে সোনা দানাগুলো নিয়ে আসতে বলেছে। সে বলেছে বলেই রাজিব এনেছে। নইলে যে পরিস্থিতি ছিল ওই পরিস্থিতিতে সোনা নিয়ে আসার চিনন্তা সে ভুলেও করতো না।
ছেলের কথা শুনে আশ্বস্ত হন মা। সোনাগুলো আঁচলে মুছতে মুছতে ঘরের এক কোণে চলে যান। তার স্বামী ছোটখাটো একটা চাকুরি করে। গরিব নয়, তবে ধনী বলতে যা বোঝায় তা-ও না। এতো সোনা তিনি জীবনেও দেখেননি। এ সোনা তিনি এখন লুকাবেন কোথায় এটাই তার সমস্যা। অবশ্য তার মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়। এ সোনা একটু একটু বিক্রি করে এক সাথে টাকা জড়ো করবেন তিনি। তারপর সেই টাকা গুছিয়ে রাখবেন ছেলের ভবিষ্যতের জন্য। ছেলেকে একটার জায়গায় তিনটে টিউটর দেবেন। মার চেহারায় গভীর প্রশান্তি নেমে আসে। মা চলে যাবার পর আবারও ভাবনা চেপে ধরে রাজিবকে। দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে সময়। ওই বাড়িতে যেতে হলে এখনই তাকে উঠতে হবে। রাজিব মনে মনে ভাবে, না গেলে কী হয়। সে তো আর এখন ওই বাড়ির ত্রিসীমায় নেই। নিজের বাড়িতে মায়ের আঁচলের নিচে নিরাপদ আশ্রয়ে আছে সে। ওই বাড়ির ওই অশরীরী ছায়া আর কিছুতেই তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। সে যাবে না, কিছুতেই না। এখন সে মায়ের হাতে বাটিভর্তি পায়েস খাবে তারপর লম্বা একটা ঘুম দেবে। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে মাকে সে ডাকতে যায়। এই দুই মিনিট আগে তার কোন ক্ষিধে ছিল না এখন তার পেটে চূড়ান্ত ক্ষিধে। সে মাকে ডাকার জন্য মুখ খুলেছে কি খোলেনি তখনই শুরু হয় সেই একই অনুভূতি। যে অনুভূতি তাকে গ্রাস করেছিল পোড়ো বাড়িতে। প্রথমে তার আঙুলগুলো কাঁপতে থাকে তারপর সারা শরীর। জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে আসে। তীব্র এক শীতলতা জেঁকে ধরে তাকে। সে জমে যেতে থাকে। তার শরীর থেকে যেন রক্ত সরে সরে যেতে থাকে। রাজিবের মনে হয় সে মরে যাচ্ছে। এখনই সে মরে যাবে। রাজিব বিড়বিড় করে।
আমাকে ক্ষমা কর। আমি আসছি, এখনই আসছি তোমার কাছে। তুমি যা বলবে আমি তাই করবো। আর কখনও অন্য চিন্তা করবো না। আমাকে মাফ করো।
দূর থেকে যেন রাজিবের কানের মাঝে ধ্বনিত হতে থাকে, তোকে শেষ সুযোগ দিলাম। আর কোন সুযোগ তুই পাবি না। তাড়াতাড়ি আয়। আমি তৃষ্ণার্ত।
রাজিব ধড়মড় করে উঠে বসে। এখনই তাকে মানুষ নিয়ে যেতে হবে ওই বাড়িতে। কিন্তু সে কোথায় মানুষ পাবে, কাকে পাবে? কিভাবে নিয়ে যাবে ওই পোড়োবাড়িতে? ওই বাড়িতে যে পারতপক্ষে কেউই যেতে চায় না।
ভাবতে ভাবতে খেলার মাঠে আসে রাজিব। বন্ধুরা সবাই ক্রিকেট খেলছে। দূর থেকে লিটন, বাবু ও সুমনকে দেখতে পায়। ঠিক তখনই বিদ্যুৎ চমকের মতো রাজিবের মনে হয় লিটনকে নিয়ে গেলে কেমন হয়। লিটন বড় দুষ্টু। তাকে অনেক জ্বালিয়েছে, অনেক কষ্ট দিয়েছে তাকে। আজ তার প্রতিশোধ নেয়ার সময় এসেছে।
রাজিব সামনে এগিয়ে যায়। ইশারায় লিটনকে ডাকে। একটু দ্বিধা করে লিটন এগিয়ে আসে।
পোড়োবাড়ি থেকে অক্ষত অবস্থায় ফেরার পর সে এলাকায় হিরো হয়ে গেছে। লিটন এসে গা ঘেঁষে দাঁড়ায় যেন কতকালের বন্ধু,
ওই বাড়িতে কি কি দেখলি?
আর বলিস কেন। সে কথা বলার জন্যই তো তোকে ডাকলাম। তবে এখানে নয়, একটু আড়ালে চল সব তোকে বলছি।
রাজিবের কথায় লিটন যেন রহস্যময়তার গন্ধ পায়। একটু এগিয়ে রাজিবের সাথে একটা আড়ালে দাঁড়ায়। রাজিব পকেট থেকে সোনার ঝকঝকে আংটিটা বের করে লিটনের হাতে দিয়ে বলে, নে এটা তোর জন্য।
কিন্তু এ যে অনেক দামি আংটি! এতো দামি আংটি তুই কোথায় পেলি?
ওই বাড়িতে। ওই বাড়িতে এমন জিনিস বস্তা বস্তা আছে। যে কেউ গেলেই আনতে পারে। বাধা দেবার কেউ নেই।
লোভে লিটনের চোখ চকচক করে। সে রাজিবের হাত জড়িয়ে ধরে, তুই কি আবার যাবি ওই বাড়িতে?
যাবো আজই, এখুনি। সোনা দানাগুলো আনতে হবে না।
আমাকে নিবি ভাই তোর সাথে?
কিন্তু তুইতো মানুষ ভালো না। অনেক জ্বালিয়েছিস আমাকে।
অতীতের কথা কেন টেনে আনছিস। কেন লজ্জা দিচ্ছিস শুধু শুধু। আমি অন্যায় করেছি। মাফ করে দে ভাই। আমাকে নিয়ে চল তোর সাথে।
এতো করে যখন বলছিস চল তাহলে আমার সাথে।
রাজিব লিটনকে নিয়ে ওই বাড়ির দিকে হাঁটে। এক সময় ঢুকে পড়ে ওই পোড়োবাড়িতে।
পনেরো.
পরদিন। সোনাদানাগুলোর দিকে হিংস্র চোখে তাকিয়েছিলে রমেশ। ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল স্ত্রীর ওপরও। কী স্পর্দ্ধা সৎ ছেলের সাথে তার তুলনা করেছে!
ডাকো তোমার গুণধর পুত্রকে। দখি সে কোথা থেকে এ সোনাদানা চুরি করে আনল। খুব আনন্দ হচ্ছে না? বাড়িতে যখন পুলিশ এসে হাতকড়া পরিয়ে ধরে নিয়ে যাবে তখন সব আনন্দ উবে যাবে। শুধু রাজিবকে নয়, সাথে তোমাকেও নিয়ে যাবে ওকে আশকারা দেয়ার জন্য। কই ডাকো তোমার ছেলেকে।
ওকে ডাকাডাকি করে কী লাভ। ও এ সোনাদানা চুরি করেনি। ওই পোড়োবাড়িতে পেয়েছে। আর যা পেয়েছে সবই আমাদের দিয়ে দিয়েছে। কোথায় তুমি খুশি হবে তা নয় ছেলেটাকে গালমন্দ করতে শুরু করেছ।
এখনও কথা বলছ, তর্কও করছ! তোমার সাহস তো কম নয়। নাকি সোনাদানা হাতে পেয়ে সাহস বেড়ে গেছে। থাক তোমাকে আর ডাকতে হবে না। আমি নিজেই ওকে ডাকছি।
বাবার ডাকে রাজিব আসে। এতক্ষণ সে বাবা মায়ের ঝগড়া শুনছিল আর ভাবছিল বাবা জিজ্ঞাসা করলে সে কী বলবে। এর মধ্যেই বাবার ডাক শোনে। কোন কথা শোনার আগেই বকতে থাকে রাজিবকে। রাজিব তাকে যতোই বোঝাতে চায় ও ততই উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এক সময় হাল ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বকা শুনতে থাকে রাজিব। ক্লান্ত হয়ে এক সময় থামে সৎ বাবা। রাজিব বহুক্ষণ ধরে নিজের ভেতরে কিসের যেন তাড়া অনুভব করছে। বেলা পড়ে আসছে। তাকে এখনই ওই বাড়িতে যেতে হবে। একা গেলেও চলবে না। সাথে মানুষ নিতে হবে। কাল পেরেছে আজ সে কাকে পাবে। রাজিব ধীরে ধীরে বাবার সামনে থেকে সরে আসে। পাশের ঘরে ঢোকে। ওর এখন একটাই চিন্তা বাবার চোখ বাঁচিয়ে বেরিয়ে পড়া। এক সময় উঁকি দিয়ে দেখে বাবা যেন মদের নেশায় ঘুমাচ্ছে। ঝুঁকি নেয় রাজিব। দ্রুত দরজা দিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করে আর সাথে সাথে চেঁচিয়ে ওঠে রমেশ। এই কই যাস?
ধরা পড়ে আবারও ঘরে ফিরে আসে রাজিব। কেটে যায় আরও কিছু সময়। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। ভেতরে ভেতরে ছটফট কছে রাজিব। বারবার উঁকি দিচ্ছে পাশের ঘরে। একসময় তার সৎ বাবা মদের নেশায় গুটি সুটি হয়ে শুয়ে পড়ে। ঘুমিয়েও পড়ে অচিরেই। কালবিলম্ব না করে দৌড় দেয় রাজিব। বেরিয়ে তো এলো কিন্তু মানুষ পাবে কোথায়! কাল লিটনকে পেয়েছিল আজ! লিটনের কথা মনে হতেই ভেসে ওঠে বাবু আর সুমনের মুখ। বাবু সুমন লিটনের সাগরেদ। বারবার রাজিবের পিছু লেগেছে। ওকে জ্বালিয়েছে। আজ তার প্রতিশোধ নেয়ার সময় এসেছে। লক্ষ্য আর কৌশল স্থির করে ফেলে রাজিব। মাঠের পাশে গিয়ে ওদের খুঁজতে থাকে। ভাগ্য ভালো, পেয়ে যায়। ওরা তখন খেলা শেষ করে বাড়ি ফিরছে। রাজিবকে দেখে ওরা এড়িয়ে যেতে চায়। কিন্তু রাজিব নিজেই এগিয়ে যায়।
আজ একটু অন্য দিকে গিয়েছিলাম। তাই খেলা হলো না। তোমাদের খেলা কেমন হলো?
ওরা কথা বলে না। এগিয়ে যেতে থাকে।
কী হল বললে না খেলা কেমন হলো। আমরা একই গায়ের ছেলে, একসাথে খেলাধুলা করি।
তারপরও তোমরা আমাকে এড়িয়ে চলতে চাও এ কেমন কথা। দেখ না আগে লিটন আমার সাথে মিশত না। এখন আমার ভালো বন্ধু। একটু আগেও আমার সাথে কথা হল। এই তো পাঠালো আমাকে তোমাদের কাছে।
ওরা পরস্পর মুখ চাওয়া চাউয়ি করে। রাজিবের সাথে লিটনের বন্ধুত্ব হয়েছেও এ খবর তাদের অজানা। কবে হলো, কবে?
লিটন তো আজ খেলতে আসেনি তুমি তাকে দেখলে কোথায়?
ওই তো ওই পোড়োবাড়ির সামনে অপেক্ষা করছে তোমাদের জন্য। তোমরা গেলে আমরা সবাই মিলে ঢুকব ওই পোড়োবাড়িতে। আসলে আমি ওই পোড়োবাড়ি থেকে সুস্থ অবস্থায় ফেরাতে ওর খুব কৌতূহল হয়েছে বাড়িটা সম্পর্কে। ভাল চল সবাই মিলে দেখে আসি।
সুমন আর বাবুর মাঝে চোখে চোখে কথা হয়।
না আমরা যাবো না। লিটনের সাথে আজ আমাদের দেখা হয়নি। আর ওই ভূতের বাড়িতে যাওয়ার কথাও আমাদের বলেওনি। যাকগে দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমরা আসি।
ওরা হাঁটতে শুরু করে। রাজিব দ্রুত গিয়ে ওদের পথ আটকায়। ওনেকটাই মরিয়া। পকেট থেকে কয়েকটা স্বর্ণমুদ্রা বের করে। হাতের তালুতে মেলে ধরে বলে, এমন অনেক আছে বাড়িতে অজস্র। এরপরও কি আপত্তি করবে?
ওরা আর দ্বিরুক্তি করে না। পোড়োবাড়ির সামনে এসে একবার শুধু জিজ্ঞাসা করে, লিটন কোথায়?
রাজিব গতকাল নিজ চোখেই দেখেছিল লিটনের পরিণতি। দেখেছিল কিভাবে একটু একটু করে রক্তশূন্য হয়েছিল লিটনের শরীর। নিঃসাড়ে সব রক্ত টেনে নিয়ে রাজিব রক্তশূন্য ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকিয়ে সেই ভয়াল কণ্ঠ বলেছিল, যদি তুমি আমার সাথে কোন বেঈমানি করো তোমারও একই অবস্থা হবে। কাজেই সাবধান। আজ আর সে দৃশ্য দেখতে চায় না রাজিব। চলে যায় খানিকটা সময়। তারপর এক সময় ভেতর থেকে গুরুগম্ভীর ডাক ভেসে আসে, এই মানুষের ছেলে ভেতরে এসো।
রাজিব ভেতরে যায়। তোমার আজ এতো দেরি হল কেন? জান না একটা নির্দিষ্ট সময়ে আমার রক্ত পিপাসা পায়। আর কখনও এমন হলে তার সাজা তোমাকেই বহন করতে হবে।
এরপর রাজিব, সুমন আর বাবুর পা ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসে নিচে। ধাক্ক দিয়ে শরীর দুটো ফেলে দেয় কুয়োয়। তারপর বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। সন্ধ্যা পার করে বাড়িতে ফেরে রাজিব। দূর থেকে দেখতে পায় তাদের বাড়ির সামনে অনেক লোক। বাড়ির কাছাকাছি এসে মায়ের কান্না শুনতে পায়।
কী হয়েছে, হয়েছে কী?
দ্রুত বাড়িতে ঢোকে রাজিব। আর ঢুকেই দেখে মারা গেছে তার সৎ বাবা।
ষোলো.
সে একটা শয়তান। তাকে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, তবে অনুভব করা যায়। অসীম ক্ষমতাধর সে।
সে ক্ষমতার বলে সে পারিপার্শ্বিক সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে। সে মানুষের মাথার মধ্যে ঢুকে যেতে পারে। পারে মানুষকে প্রলোভন দেখাতে, প্ররোচিত করতে। যে কোন মানুষকে যখন তখন মেরে ফেলা তার জন্য কিছুই না। যেমন মেরেছে রাজিবের বাবাকে। এ জন্য তাকে রাজিবের বাবার কাছে যেতে হয়নি। তার ইচ্ছেটাই ছিল যথেষ্ট। তার দেহটা চলে গেছে কিন্তু সর্বগ্রাসী অস্তিত্ব রয়েই গেছে।
অনেকবার রাজিবের চিন্তাকে এলোমেলো করে দিয়েছে সে। রাজিব যতবার তার কাছ থেকে ছুটতে চেয়েছে ততবারই তার মাঝে ভীতির জন্ম হয়েছে। এলোমেলো হয়ে গেছে সব চিন্তা। যেন রশি ধরে টান দিয়েছে শয়তানটা আর সে সুড়সুড় করে এসে হাজির হয়েছে আদিত্যের সামনে। দাসানুদাসের মতো তার ইচ্ছে পূরণ করেছে। ইচ্ছে পূরণের জন্য তাকে কোথাও যেতে হয় না। ঘরের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় সে বসে থাকে। আর সব কিছু ঠিকঠাক মতো হাজির হয়ে যায় এ ঘরে। তার মনের মধ্যে কোন ইচ্ছের উদয় হওয়া মানে ইচ্ছেপূরণ। তবে কখনও কখন ওই ইচ্ছে পূরণের জন্য দ্বিতীয় কোন ব্যক্তির সাহায্য লাগে। যেমন সে ব্যবহার করছে রাজিবকে। এতদিন তার সম্পর্কে কেউ কিছু জানতো না। এলাকার লোক জানতো এটা একটা ভূতের বাড়ি। ভূতের বাড়িতে যারা এসেছে জীবন নিয়ে কেউ ফেরেনি। ফেরেনি চরম ক্ষমতাধর ডাকাত দল পর্যন্ত। কাজেই ওর কথা জানার কোনো সুযোগ কারও ছিলো না। প্রথম জানলো রাজিব। জানলো এক সময় সে দুর্দান্ত ক্ষমতা আর প্রভাবশালী একটা মানুষ ছিল। কিন্তু কোন একটা বিপর্যয়ে সে তার দেহ হারায়। দেহ ছাড়াই এখনও সে অসীম ক্ষমতাধর। তবে রক্ত পানের কোর্সটা পূরণ হলেই সে তার হারানো দেহটা ফিরে পাবে। তখন তার ক্ষমতা কতো হবে ভাবলেই শিউরে ওঠে রাজিব।
প্রথম দিকে আদিত্যকে দেখা যেত না। কেমন যেন একটা ধোঁয়াটে ধোঁয়া দেখতে পেত। কিন্তু এখন আদিত্যের চেহারা অনেকটাই স্পষ্ট। যত দিন যাচ্ছে যত বেশি রক্ত পান করছে, চেহারা ততই আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। একজন শক্তিশালী ক্ষমতাধর লোকের সাথে থাকলে যা হয় রাজিবের মধ্যেও তা হয়েছে। সে এখন অনেক আত্মপ্রত্যয়ী, অনেক স্মার্ট। তবে স্মার্ট না বলে ওভার স্মার্ট বলাই ভালো। গ্রামের কোন মানুষকে এখন আর সে মানুষ বলে মনে করে না। আগে যে সব মুরব্বির সাথে সে মুখ তুলে কথা বলত না, দেখা হলে আগ বাড়িয়ে সালাম দিতো এখন তাদের দিকে ফিরেও তাকায় না রাজিব। গায়ে গায়ে ঠেস লাগলেও কথা বলে না। গায়ের লোকের সাথে সে বেশ উচ্চস্বরে কমান্ডিং ভয়েজে কথা বলে। এই নিয়ে গাঁয়ে বেশ ফিসফাস হয়। হঠাৎ ধনী হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছে, তবে আড়ালে এসব কথা বললেও রাজিবের সামনে কেউ কিছুই বলে না। যেচে পড়ে রাজিবের শত্রু হতে চায় না তারা। যে কোনভাবেই হোক তারা জেনে গেছে রাজিবের ক্ষমতা অনেক। যদিও ক্ষমতার উৎস তাদের অজানা।
রাজিব সর্বক্ষণ উপলব্ধি করে আদিত্যের ছায়া যেন তাকে ঘিরে থাকে। আর সে ছায়া তাকে বার বার বাঁচিয়েও দেয়। রাজিব এটাও বোঝে আদিত্যের নিজের শরীর ফিরে পাবার প্রয়োজনে রাজিবের বেঁচে থাকা খুবই প্রয়োজন। তাই বিপদ আপদ নিয়ে আজকাল মোটেও ভয় পায় না রাজিব। একবার শহরেও গিয়েছিল রাজিব ব্যবসার কাজে। বিকেল বেলা ট্যাক্সির খোঁজে ও ফুটপাথ ধরে হাঁটছিল। হঠাৎ কয়েকজন লোক তাকে ঘিরে ধরে। একজন বুকে ছুরি ঠেকিয়ে বলল,
: যা আছে ঝটপট দিয়ে দে। দেরি করলে ফুটা কইরা দিমু।
ঘাবড়ে গেলো রাজিব। তার পকেটে অনেক টাকা। ভাবলো টাকা গেলে টাকা পাওয়া যাবে বিশেষ করে আদিত্য যখন রয়েছে। কিন্তু জীবন গেলে আর জীবন ফিরে পাওয়া যাবে না। রাজিব টাকা বের করার জন্য পকেটে হাত দেয়। কিন্তু তখনই সামনের লোকের বিস্মিত আর্তস্বর শুনে তাকিয়ে দেখে ছিনতাইকারীর হাতের ছুরিটা গলে গলে পড়ছে। লোকগুলো ভয়ে বিস্ময়ে দৌড় দিয়ে চলে যায়। হো হো করে হেসে ওঠে রাজিব। সে বুঝতে পারে আদিত্যই এ ঘটনা ঘটালো। আর একবার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হতে যাচ্ছিল তার জেবরা ক্রসিং ছেড়ে খালি রাস্তা দিয়ে পার হচ্ছিল রাজিব। হঠাৎ কোথা থেকে ধেয়ে এলো একটা বাস। রাজিবের গা ছুঁয়ে গেল। রাজিব বুঝল এখনই সে বাসের নিচে পড়বে। বাসের একেবারে সামনে। সে মুহূর্তে অনেক কিছু ভেবে নিল। সে এখানে এই শহরে মারা গেলে কেউ তাকে চিনবে না। তার লাশ দাফনের জন্য গ্রামেও নেবে না কেউ। ঠিকানাই জানবে না, নেবে কী করে। বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম তার লাশ দাফন করবে। এই যা সে তো হিন্দু। তাহলে কী করবে। আর কি সৎকার হবে না। হিন্দুর বেওয়ারিশ লাশের কী হয় তা জানা নেই রাজিবের। তাকে কি ফেলে দেবে কোথাও। কে জানে। মা দিনের পর দিন পথ চেয়ে থাকবে। বুক চাপড়ে কাঁদবে। কাঁদতে কাঁদতে একদিন মারাই যাবে। পড়ে থাকবে তার বিত্তবৈভব সহায় সম্বল। ভাবনা শেষ হবার সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করে গাড়ির মাথাটা যেন তার পিঠ স্পর্শ করে। কিন্তু কই সে যে চাপা পড়ছে না। হলো কি! দু’চার মিনিট চোখ বন্ধ রেখে চোখ খোলে রাজিব। কোথায় বাস আর কোথায় কী।
রাস্তাঘাটে বাসের কোনো চিহ্নই নেই। বাসটা যেন বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে। রাজিব বুঝতে পারে এবারও তাকে বাঁচিয়ে দিল আদিত্য।
সতেরো.
বাবা মারা যাওয়ার পর বেশ কয়েকদিন খুব কান্নাকাটি করে মা। অসুখ না বিসুখ না একবারেই ভালো মানুষ কি করে হঠাৎ মারা গেল। এ প্রশ্নের মীমাংসা তার কাছে নেই। তবে শেষ পর্যন্ত নিজেকে সান্ত¦না দিয়েছে এই বলে যে ভগবান বোধ হয় এই চেয়েছিলেন। এই পর্যন্তই তার পরমায়ু লেখা ছিল। তার বাইরে যাবে কী করে। ধীরে ধীরে স্থির হয়ে আসেন মা। রাজিবের দিকে মনোযোগ দেন। দ্বিতীয় স্বামীর কারণে এতদিন রাজিবের দিকে কোনই মনোযোগ দিতে পারেননি। আদর করে কাছেও ডাকতে পারেননি। এখন সব আদর সব স্নেহ ঢেলে দেন অকাতরে। কিন্তু নিজের ছেলেকে যেন ঠিকমতো চিনতে পারেন না। দিন দিন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। তাদের দারিদ্র্য অবস্থা কাটিয়ে এখন তারা অনেক ধনী। এত অল্প দিনের মধ্যে কী করে তারা এত ধনী হলো এটাও বোঝেনা মা। বুঝতেও চান না। সারা জীবন দুঃখ দারিদ্র্যে অনেক কষ্ট করেছেন। এখন একটু আরাম আয়েশ একটু বিলাসিতা করতে পারছেন ছেলের কারণে, এতেই তিনি মহা খুশি।


আফরোজা পারভীন

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম