বিশ শতকে মুসলমানদের প্রথম পুনর্জাগরণে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, যাদের চেষ্টা প্রচেষ্টায় ইসলামের ডিস্কোর্স গুলো আধুনিক মনস্কদের সামনে গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠেছে, সাইয়েদ কুতুব এবং তার পরিবার ছিলো তাদের অন্যতম। কুতুব পরিবারের এই সদস্যরা সাধারণ দুনিয়াবী দৃষ্টিতে ছিল বোকা প্রকৃতির, কিন্তু আখিরাতের জন্য তারা ছিলেন অগ্রসেনানি। সাধারণদের দৃষ্টিতে এরা ছিলেন দৃশ্যতঃ তাদেরি একজন, কিন্ত ইসলাম বিরোধীদের দৃষ্টিতে এরা ছিলো মারাত্মক হুমকি। তবে যাদের অন্তরে ঈমানের বিকাশ আছে, তারা এই পরিবারকে ভালোবাসতে পারা সৌভাগ্যের নমূনা মনে করে। আজ সেই পরিবারের সর্বশেষ মানুষ হামিদা কুতুব আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি প্যারিসে ইন্তেকাল করেছেন গত ১৩ই জুলাই, ২০১২ মুতাবিক ২৩শে শাবান ১৪৩৩ শুক্রবার জুমার নামাজের আযান শুনতে শুনতে, আর ১৮ই জুলাই তার জানাযা নামাজান্তে পাঠানো হয় মিশরে। সেখানে আবু বাকর সিদ্দিক মাসজিদে দ্বিতীয়বার জানাযা হয়। এরপর কায়রোতেই তাকে দাফন করা হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিলো ৭৫ বছর।
সামগ্রিকভাবে কয়েকটি পরিবার মিশরে ইসলামি আন্দোলনে বিশাল অবদান রেখেছেন। আর এই অবদান রাখতে যেয়ে ত্যাগের যে সুমহান আদর্শ তারা রেখেছেন তার তুলনা আমরা সাহাবাগণের সময়ে ইয়াসির (রা) পরিবারে, কিংবা হুমনা বিনতে জাহাশের (রা) পরিবারে দেখতে পেয়েছি। আমরা দেখেছি সাইয়েদ কুতুব এবং তার ভাগ্নে রিফআত বাকার কে কিভাবে শহীদ করা হয়। মুহাম্মাদ কুতুবকে কিভাবে জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে অত্যাচার করে করে অবশেষে দেশান্তরী হতে বাধ্য করা হয় কিভাবে। আমরা শুনেছি আমীনা কুতুবের তিলে তিলে শেষ হওয়ার কান্না, দেখেছি তার স্বামী কামালকে নির্যাতনের পর নির্যাতন চালায়ে কিভাবে শেষতক শাহাদাতের পেয়ালা পান করানো হয়। এগুলো পড়লে এবং শুনলে মনে হবে সাহাবাগণের ত্যাগ তীতীক্ষার পদ ধরে চলা কাফেলায় এরা ছিলো বিশ শতকের অকুতোভয় রাহি মুসাফির।
জন্ম এবং শিক্ষাঃ
তিনি ১৯৩৭ এ আসয়ূত এর মুশা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। বাবার নাম আলহাজ্জ কুতুব ইব্রাহীম। পাঁচ ভাইবোনের তিনি ছিলেন ছোট। এই পরিবারের সন্তানদের নিয়ে সাইয়েদ কুতুবের লেখা 'আতয়াফ আরবাআহ' বইয়ে হামিদা সম্পর্কে বলেছেনঃ "ছোট্ট এই বাড়ন্ত শিশুটা বড় অনুভূতি প্রবন। অজানা ছায়ার উপর তার খুব ভয়......"সাইয়েদ কুতুব কায়রোতে পড়া অবস্থায় আব্বা মারা যান, ফলে বড় এই সংসারের হাল তাকেই ধরতে হয়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন সবাইকে নিজের কাছে রেখে মানুষ করে বাবার অসমাপ্ত কাজ পূর্ণ করার দ্বায়িত্ব নেন। আমার মনে হয় এই জন্যেই সাইয়েদের জীবনে আর বিয়ে করা হয়নি।
হামিদাকে মানুষ করার দ্বায়িত্ব নিজ হাতে নিয়ে সাইয়েদ তাদের উপর ফেলেছিলেন দারুন প্রভাব। ফলে সব ভাই বোন গুলোই হয়ে ওঠেন একেকজন সাহিত্যিক, কবি এবং লেখক। তাদের লেখা পড়ার ধরণ ছিলো কিছুটা ব্যতিক্রম। সাইয়েদ বাসায় ফেরার পর চার ভাইবোন একসাথে বসে যেতেন। একেকটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। উম্মাহাতুল কুতুব বা জ্ঞানের মৌলিক বই গুলো তারা বাড়িতেই পড়াশুনা করেন। সাইয়েদের গ্রাজুয়েশান শেষ করতে না করতেই ১৯৪০ সনে আম্মা ইন্তেকাল করেন। এরপর সাইয়েদ কুতুবকে মা এবং বাবা দুইজনের ভূমিকা পালন করতে হয়, ফলে ছোট ভাইবোনদের পেছনে আরো বেশি সময় দিতে লাগলেন।
সাইয়েদ কুতুব ছিলেন ক্ষণজন্মা এমন একজন ব্যক্তিত্ব যার বহুমূখী প্রতিভা দ্বারা ইসলাম দারুন ভাবে উপকৃত হয়েছে। একজন মুরব্বি হিসাবে সন্তান লালন পালনে তার চিন্তাধারা বা কর্মকান্ড অনুসরনীয়। ইন্তেকালের আগে হামিদা কুতুব তার জীবন ও পরিবার নিয়ে প্রায় ৬ঘন্টার একটা সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। ইউ টিউবের কল্যানে যে কেও সেটা দেখতে পারেন।
http://www.youtube.com/watch?v=HeBHwygDzV4
http://www.youtube.com/watch?v=f5xeikOUII8&feature=relmfu
http://www.youtube.com/watch?v=YJfQK0tZNIo&feature=relmfu
http://www.youtube.com/watch?v=lyZLs3AVz_A
এখানে তার ও তার পরিবারে বিভিন্ন দিক দারুন বিস্তারিত ভাবে চলে এসেছে। এগুলো শোনার পর আমার কাছে মনে হয়েছে আল্লাহ তায়ালা নিজ ইচ্ছায় বিশ শতকে এমন এক পরিবারকে আমাদের জন্য তৈরি করে দিয়েছিলেন, সবাই আমরা সেই মডেলকে মানতে দ্বিধাণ্বিত হইনা।
সাইয়েদ তার ভাই বোনগুলোকে মানুষ করে তুলেছেন আপন করে। তিনি সব সময় মনে করতেন পরিবারের মুরব্বি তিনি, ফলে আল্লাহর কাছে এদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ তাকেই করা হবে। হামীদা কুতুব বলেনঃ " ভাই সব ব্যাপারেই দ্বায়িত্ব গ্রহন করতেন। কথা বলতেন মুরব্বি চালে। হাসতেন কম, তবে দয়ার সাগর ছিলেন। সব সময় আমাদের সাথে চিন্তা শেয়ার করতেন, আমাদের ভুল-ভাল হলে সেটা বুঝার চেষ্টা করতেন। বিভিন্ন বিষয়ে খারাপ কিছু আচরিত হলে ভয় দেখাতেন, তবে কোনদিন গায়ে হাত তুলেন নি। জীবনের বিভিন্ন ডিসেশন নিতে সাহায্য করতেন, চাপায়ে দিতেন না। যে কোন কাজ করতে চাইলে সমস্ত অপশন গুলো সামনে তুলে ধরে, আমাদের উপর সিদ্ধান্ত গ্রহনের দায়ভার দিয়ে দিতেন।"
হামীদার বয়স তখন ৯ বছর। প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রী তিনি। শিক্ষা সফরে যাবার তাগাদা আসলো ক্লাশ টিচারের মাধ্যমে। যেতে হবে সুয়েজ খালের ওখানে কয়েকদিনের জন্য। ক্যাম্পিং হবে। ছেলে মেয়েরা এক সাথে যাবে। হামীদার খুব শখ এতে অংশগ্রহন করবে, কিন্তু বাসার সবার মত পাওয়া গেলোনা। সাইয়েদ বাসায় ফিরে এলেন অনেক রাতে। তখনো হামীদার চোখ নির্ঘুম। ভাইকে খাইয়ে দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরলো। ইস্কুলের শিক্ষা সফরের কথা আবদারের ভাষায় বলে তাকালো ভায়ের মুখের দিকে।
সাইয়েদ বললেনঃ "এই ধরণের প্রোগ্রামে গেলে চোখ খোলে, অনেক জানা যায়। সামাজিকতার সবক নেয়া যায়। ইস্কুলের শিক্ষকদের খুব কাছাকাছি আসা যায়। কিন্তু মানুষের চরিত্র গেছে খারাপ হয়ে।
ওখানে গেলে দেখবা কোমলমতি ছেলেদের ও কেমন চারিত্রিক অবক্ষয়।" হামীদা এবার শক্ত গলায় বললোঃ 'সবার সাথে আমাকে তুলনা করলে, ভাইয়া। দেখবে আমি সব সময় ভালো থাকবো।' সাইয়েদ বোনের কথায় রাজি হলেন। কানে কানে বললেন, টাকা যা লাগে, তার চেয়ে কিছু বেশী নিয়ে যেয়ো, আর হাঁ, পরে যেন আমার বুকে মুখ রেখে কেঁদোনা। হামীদা শিক্ষা সফর থেকে ফিরে এলেন খুব ম্রিয়মান হয়ে। মন তার অসহ্য রকমের খারাপ। সাইয়েদের পাশে যেয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো। বললোঃ 'ভাইয়া, জীবনেও আর তোমার অপছন্দের পথে পা মাড়াবোনা। আসলে গোটা মিশরের চরিত্র গেছে খারাপ হয়ে। আর শিক্ষকরা হলো সেই খারাপের অনলে ইন্ধনদাতা।'
হামীদা তার স্মৃতিচারণায় বলেছেনঃ ' ভাইয়া কখনো আদেশের স্বরে কথা বলতেন না। আমি জীবনে কোনদিন 'এইটা কর' 'ঐটা করিসনা' এই ধরণের আদেশ নিষেধ তার কাছ থেকে পাইনি। ফলে তার পথ ধরে আমরা সব ভাই বোন চলতে আনন্দ বোধ করতাম। পুরো স্বাধীনতা ছিলো আমাদের, কিন্তু ভাইয়ের আদরের মাঝে থাকতাম সম্পূর্ণ বন্দি হয়ে। আজ এই পড়ন্ত বেলায় ঐটার জন্য ভাইয়াকে খুব মনে পড়ে।'
প্রাইমারিতে থাকা অবস্থায় তার মেধার পরিচয় পাওয়া যেতে শুরু করে। এ সময় থেকেই তার পড়া শুনার প্রতি মোহ তৈরি হয়। স্কুলে নিজের ক্লাশের বাইরে বড়দের বই পড়া শুরু করতো হামীদা। ছোট্ট লাইব্রেরিতে নতুন নতুন বই আনার জন্য হেড টিচারকে আবদার করতো। এরপর সেকেন্ডারি থেকেই শুরু হয় অন্য রকম জীবন। পড়ালেখার প্রতি তার ঝোঁক এত বেড়ে গেলো যে বাইরের লাইব্রেরিতে তার যাতায়াত দারুন ভাবে বেড়ে গেল। সে সময়ের স্মৃতি চারণ করতে যেয়ে হামীদা কুতুব বলেছেনঃ ' আমি খুব পড়তাম। বাসার পাশে লাইব্রেরি গুলোতে যেয়ে সমস্ত বই পড়ে ফেলতাম। তবে সাহিত্য এবং ইতিহাসের উপর বই পড়তে খুব ভালো লাগতো'। চৌদ্দ বছরে পা দিয়েই লেখা লেখি শুরু করেন তিনি।
প্রথমে কবিতা তার পর শুরু হলো গদ্য লেখা। বিশেষতঃ গল্প লেখায় দেখাতে লাগলেন পূর্ণ সফলতা।
তার জীবনের প্রথম লেখা 'লা ইলাহা ইল্লাহ' প্রকাশিত হয় 'আলইখওয়ান' নামক আলইখওয়ান আল মুসলিমুনের এর মুখপাত্র সাপ্তাহিকে। এতে তিনি কালিমাহ তাইয়েবার প্রভাব ব্যক্তি জীবনে কিভাবে পড়া উচিত তার আলোচনা করেছেন। এর পর 'আলমুসলিমূনের' পাতায় শোভা পেতে থাকলো তার গল্প, কবিতা এবং প্রবন্ধ। এভাবে তার লেখাপড়ার পাশাপাশি সাহিত্য চর্চা চলতে থাকলো সমান বেগে।
দাওয়াতী যিন্দেগীঃ
সাইয়েদ কুতুব আমেরিকা যান ১৯৪৮ সনে। সেখান যেয়েই তিনি দেখতে পান পাশ্চত্য সভ্যতার গতিপ্রকৃতি। এবং এখান থেকেই ইসলামের উপর তার আস্থা ভীষণ ভাবে বেড়ে যায়। হাসান আলবান্নার শাহাদাত বরণের সময় তিনি ছিলেন আমেরিকায়। ইমামের শাহাদাতে আমেরিকানদের উল্লম্ফ আস্ফালন এবং ক্রুর হাসি দেখে তিনি মনে অনেক ব্যাথা পেয়েছিলেন। এভাবেই তিনি ইখওয়ানের ব্যাপারে জানতে উদগ্রীব হলেন। ১৯৫০ এ মিশরে ফিরে ইখওয়ানের সাথেই প্রথম যোগাযোগ করলেন চাকুরিতে যোগদানের আগেই। ইখওয়ান ও তার মত সৃজনশীল ব্যক্তিত্বকে নিলো বুকে টেনে। প্রথম দিনেই তার হাতে ইখওয়ানের পত্রিকা 'আলইখওয়ান' পরিচালনার দ্বায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হলো। এখান থেকেই তার জীবনে ইসলামের আলো বিভাসিত হলো; তার হাতেই ইসলামি আন্দোলন আপন গতিতে ঢুকে পড়লো কুতুব পরিবারে। দুই বোন যোগ দিল ইখওয়ানের মহিলা গ্রুপে। ছাত্রজীবন, সাহিত্য জীবন এবং সেই সাথে দাওয়াতি জীবন চলতে থাকলো এক অদ্ভুত নিয়মানুবর্তিতায়।
১৯৫৪ সনে, যে সময় হামীদা কুতুব কেবল 'এ' লেভেলে উঠেছেন, ঘটে গেলো মিশরের ইসলামি আন্দোলনের আরেক ভূমিকম্প। আলেকজান্দ্রিয়ায় আলমুনশিয়া মাঠে সে সময়ের শাসক, জামাল আব্দুননাসের কে হত্যার জন্য ইখওয়ানের কথিত গুপ্ত বাহিনির একজন গুলি করে। এই ক'দিন আগেই জানা গেল এই গুলিটা ইখোয়ান কে শেষ করার জন্য করানো হয়েছিলো এবং এর পেছনে ছিলো সি আই এ এবং মোসাদের সার্বিক সহযোগিতা। যাই হোক, এই ঘটনায় একক ভাবে ইখওয়ান কে দায়ী করে এর ছয়জন নেতাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়। হাজার হাজার নেতা কর্মিকে অত্যাচারে অত্যাচারে জর্জরিত করা হয় জেল হাজতে। সাইয়েদ কুতুবকেও কারাবাসের অর্ডার হয় ১৫ বছর।
হামীদা কুতুব ভায়ের কারাবাসের পর সংগঠনে খুব তৎপর হয়ে ওঠেন। এই সময় সংগঠনের মহিলা বিভাগের দ্বায়িত্ব পালন কারিরা ছিলেন এই শতকের ইতিহাস সৃষ্টিকারি কিছু মহিলা; তার বোন আমীনা কুতুব, যায়নাব গাযযালী, লাতীফা আলসূলী, নাঈমা খাত্তাব, খালিদা হুদায়বি ছিলেন তাদের অন্যতম। হামীদা তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে লাগলেন। তারা বিভিন্ন ভাবে চাঁদা কালেকশান করে, জেলের প্রকোষ্ঠে মাজলুম নেতাদের বাসায় বাসায় খাবার পৌঁছানো, তাদের খোঁজ খবর রাখা, তাদের খবরাখবর কারাবাসিদের কাছে পৌঁছানো ইত্যাকার জটিল কাজের আঞ্জাম দিতেন তিনি।
১৯৫৭ সনে জেলে থাকা সত্বেও সাইয়েদ কুতুবকে ইখওয়ানের সাংগঠনিক কাঠামো ঢেলে সাজানোর দ্বায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি জেল থেকেই প্রত্যেকদিন সংগঠনের খোঁজ খবর নিতেন, এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশাদি পাঠাতেন সাক্ষাতের জন্য যাওয়া বোন হামিদার মাধ্যমে। এই সময়েই সাইয়েদ কুতুব 'ইসলামি সমাজ বিপ্লবের ধারা' গ্রন্থ রচনা করেন এবং হামীদার মাধ্যমে তা মিশরে ঘরে ঘরে পড়ার ব্যবস্থা করেন। এভাবে চলতে থাকা সংগঠনের গতি বৃদ্ধি পেতে থাকে দিন দিন। সাংগঠনিক এই ধারার বৈশিষ্ঠ ছিলো যুগান্তকারি। সাইয়েদ মনে করতেন ইসলামের আক্বীদাহ ও আমল হতে হবে যুক্তিবাদিতার উপর ভিত্তি করে। যে সমাজে ইসলামি আইন বলবৎ থাকবেনা, মুসলিম শাসিত হলেও সে সমাজকে ইসলামি সমাজ বলা যাবেনা, বরং তা হলো জাহিলিয়াত। এর মূল উৎপাটন ই হবে ইসলামি আন্দোলনের একমাত্র কর্মপন্থা। তা করতে হলে মহানবীর (সা) মক্কী জীবনের তের বছর এর উপর ভিত্তি করে তিনিও তের বছর মেয়াদি কর্মসূচি হাতে নেন। যার মূল কথা ছিলো, ইখওয়ানের প্রতিটি কর্মিকে একেকজন সাহাবির চরিত্রে গড়ে উঠে, তের বছর পর মাদানী জীবনে অগ্রসর হতে হবে। এরপর গোপনে দেশে একটা সমীক্ষা চালানো হবে। ৭৫% মানুষ ইসলাম চাইলে তখন ইসলামি রাস্ট্র গঠনের ডাক দিতে হবে।' এটা ছিলো মিশর কে ইসলামি রাস্ট্র বানানোর বিরাট পরিকল্পনা, যা ছিল জামাল আব্দুন নাসেরের জন্য হবে মরণ ঘন্টা।
কিন্তু অবশেষে হামীদা কুতুব ধরা পড়ে যান এক সময়, ফাঁস হয়ে যায় সাইয়েদ কুতুবের চিন্তার আলোকে সমাজ বিপ্লবের দুর্ণিবার ইশ্তেহার। ধরা পড়ার দিনে যে চিরকুটটা সাইয়েদ কুতুব হামীদার কাছে দিয়েছিলেন তা পরে উদ্ধার হয়। তিনি লিখেছিলেনঃ "আমাদের কথা গুলো মৃত হয়ে থাকবে, পড়ে থাকবে মোমের তৈরি নববধুর মত নিরব, নিস্পন্দ......... আমরা মরে যাওয়ার সাথে সাথে ওই গুলো জেগে উঠবেই এবং জীবন্তদের দেহে সেগুলো আগুন জ্বালাবেই...... হৃদয়ের গভীর থেকে যে বাণী ছড়িয়ে পড়ে, জীবন্তদের মাঝে তা জীবিতই থেকে যায়..
অসহনীয় কারাবাসঃ
১৯৬৫ সনে সাইয়েদ কুতুবের 'ইসলামি সমাজ বিপ্লবের ধারা' লেখা সহ গোপন সাংগঠনিক তৎপরতায় যুক্ত থাকার কারণে গোটা কুতুব পরিবারকে বন্দি করা হয়। এই সময় বন্দি করা হয় যায়নাব গাযযালি সহ অন্যান্য নেতাদের। যাদের সংখ্যা ছিলো গননার ও বাইরে। ১৯৬৫ আগস্ট মাসে বিশ দিনেই বন্দি করা হয় এক লাখ ইখওয়ান নেতা কর্মিকে। তাদের উপর যে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয়, আমার জানা ইতিহাসে তার নযির নেই। 'কারাগারে রাতদিন' বইটা পড়লেই বুঝা যায় কি অমানবিক জুলুম তাদের উপর চালানো হয়। এরপর শুরু হয় কোর্ট মার্শালে তাদের বিচার। প্রথম দফায় ৪৩ জনের বিচার হয়। যেহেতু এবারের ষড়যন্ত্র মামলায় সাইয়েদ কুতুব ছিলেন প্রধান আসামি কাজেই তার নামছিলো শীর্ষে। হামীদার নাম ছিল ৩৯ নাম্বারে। কোর্ট মার্শালে প্রধান বিচারক ছিল মুহাম্মাদ ফুয়াদ আদ্দাজাওয়ী। বিচারে সাইয়েদ সহ আর তিন জন কে ফাঁসির অর্ডার দেয়া হয়, হামীদা কে দেয়া হয় ১০ বছরের স্বশ্রম কারাদন্ড। রায় শুনেই হামীদা যায়নাব গাযযালিকে জড়িয়ে ধরে আল্লাহু আকবর বলে উঠেন। এরপর থেকে শুরু হয় এক সীমাহীন এক দুর্ভোগের জীবন।
ফাঁসির অর্ডার হওয়ার পরে সাইয়েদ কুতুব জিন্দান খানায় একদিন এসে বোন হামীদা কে এবং সহযোদ্ধা যায়নাব গাযযালি কে সান্তনা দিয়ে যান। তারা যখন একে অপরে ছাড়াছাড়ি হচ্ছিলেন, হামীদা কান্নায় ভেংগে পড়েন। এ দেখে প্রধান জেইলার মনে করলো এদেরকে ইখওয়ান থেকে আলাদা করার একটা সুযোগ নেয়া যেতে পারে। হামীদা কুতুব বলেনঃ
প্রধান জেইলার হামযা বাসয়ূনি আমাকে অফিসে তলব করে ভাইয়ার মৃত্যুদন্ডের সরকারি নির্দেশনামা ও তার আনুষ্ঠানিকতা শেষের কাগজ পত্র দেখিয়ে বললো, আপনার ভাই যদি এখনো আমাদের মত কাজ করে তাহলে সরকার তার মৃত্যুদন্ড প্রত্যাহার করতে রাজি আছেন। দেখুন আপনার ভায়ের মৃত্যু শুধু আপনার নয়, পুরো মিশরের জন্য ক্ষতি। আমি ভাবতেই পারছিনা আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পরে আমরা তাকে হারাতে যাচ্ছি। আমরা তাকে যে ভাবেই হোক, আর যে পন্থায় হোক, ফাঁসির হাত থেকে বাঁচাতে চাচ্ছি। দেখুন, কয়েকটা শব্দ মাত্র, কয়েকটা শব্দ তাকে বাঁচাতে পারে। আর আপনি ই পারেন তাকে রাজি করাতে। আপনি ই এই কথা গুলো তাকে বলতে বলুন। মাত্র কয়টা কথা।তিনি শুধু বলবেন, 'আমরা যে আন্দোলন করছি তা অন্য কোন পক্ষের হয়ে করছি......।' ব্যস এই টুকুই, এর পর আমরা তাকে স্বাস্থ্য গত কারণ দেখিয়ে ফাঁসির অর্ডার মওকুফ করানোর ব্যবস্থা করবো।
আমি বললাম, কিন্তু আপনি, এমন কি জামাল আব্দুন নাসের, তো জানেন ইখওয়ানের এই আন্দোলন কোন পক্ষের হয়ে আন্দোলন করা হচ্ছে না.........
হামযা বললো, আমি তা জানি। আমি জানি আপনারাই মিসরের একমাত্র দল যারা ইসলামের জন্য কাজ করছেন। আমরা এটাও জানি মানুষ হিসেবে আপনারাই সব চেয়ে ভালো,কিন্তু আমরা চাচ্ছি সাইয়েদ কুতুব কে ফাঁসি থেকে রক্ষা করতে।
আমি বললাম, ঠিক আছে আপনারা যখন এইটাই চাচ্ছেন, আমি ভাইয়ার কাছে যেতে পারি।
হামযা সাফওয়াতের দিকে তাকালো। বললো, ওকে সাইয়েদের কাছে নিয়ে যাও।
আমি ভাইয়ার কাছে গেলাম। সালাম দিয়ে ওদের কথা গুলো পৌঁছে দিলাম। তিনি আমার দিকে তাকালেন, আমার মুখের ভাব পড়ার চেষ্টা করলেন। এরপর বললেনঃ এটা কি তোমার কথা, নাকি তাদের শিখিয়ে দেয়া কথা? আমি তখন ইশারা ইংগিত করে বুঝালাম উনারাই আমাকে এটা বলেছেন। ভাইয়া তখন বললেনঃ আল্লাহর কসম, যদি এই কথাটা সত্য হতো তাহলে আমি অবশ্যই বলতাম......... দুনিয়ার কোন শক্তিই আমাকে এই কথা বলতে বাঁধা দিতে পারতোনা। কিন্তু এটা কখনো ঘটেনি। যা ঘটেনি সে মিথ্যা আমি বলি কি করে? সাফওয়াত তখন জিজ্ঞেস করলো, এটাই আপনার শেষ কথা? সাইয়েদ বললেন, হাঁ।
সাফওয়াত আমাকে ও ভাইয়াকে খানিক সময়ের জন্য আলাদা ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। তখন আমি ভাইয়াকে সব বুঝিয়ে বললাম, আসলে হামযা আমাকে আপনার কাছে পাঠায়েছে। মনে করেছে আমি আপনাকে বুঝাতে পারবো। ভাইয়া বললেনঃ আমি এটা বলি তাকি তুমিও চাও। আমি বললামঃ না, ভাই। তখন ভাইয়া বললেনঃ দেখ ওরা আমাকে ক্ষতিও করতে পারবেনা, উপকার করতেও পারবেনা। জীবন মরণের ফয়সালা আল্লাহর হাতে। তারা আমার জীবনের ফয়সালা গ্রহন করতে পারবেনা। আমার জীবন বাড়াতেও পারবেনা, কমাতেও পারবেনা। সবটাই আল্লাহর হাতে। আর আল্লাহ তাদের কে বেষ্টন করে আছেন।
তিনদিন পরে সাইয়েদ কে শহিদ করা হয়। হামীদার তখন ২৯ বছর বয়স। বিয়েও হয়নি তার। দশ বছরের স্বশ্রম কারাদন্ড দেয়া হলো। একদিকে ভায়ের শোক অন্যদিকে বেদনার কারাযাপন, তার সাথে সরকারি বাহিনির ক্রমাগত নির্যাতন এবং অপমান ভোগ তার জীবনকে করে ফেলেছিলো দুঃসহ । যায়নাব গাযযালির সাথে তার কারাজীবন চলেছে এক সাথে একই পাশবিকতার নিগড়ে। প্রথম ছয়বছর চার মাস নিদারুন কষ্টের মধ্যে রাখা হয়। এই সময় একদিন যায়নাব গাযযালি সাইয়েদ কে স্বপ্নে দেখেন তিনি জান্নাতে মহানবীর (সা) সাথে আছেন। হামীদাও ঠিক তাই দেখছিলেন। তিনি বললেন, আমি নিশ্চিত আমার ভাইয়া এখন জান্নাতে আছেন।
এরপর তাকে কানাতির কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে তাকে কারাজীবন থেকে মুক্তি দেয়া হয়। এরপর তাকে বিয়ে করার জন্য প্যারিসের ডক্টর হামদি মাসউদ প্রস্তাব করলে পরিবারের পিড়াপিড়িতে বিয়ে করে ফ্রান্সে চলে আসেন।
ইসলামি আন্দোলনে তার অবদানঃ
ইসলামি আন্দোলনে হামীদা কুতুবের অবদান কম নয়। নানামুখি প্রতিভার অধিকারী এই পরিবারের সবাই ছিলো সব্যসাচী লেখক। হামীদার রচনা সম্ভার একেবারে কম নয়। "নিদা ইলা আলদাফফাতিল উখরা" তথা "ঐ পারে চলো যাই" গ্রন্থ খুব পাঠক নন্দিত হয়। "রিহলাতুন ফী আহরাশিল লায়ল" বা 'বুনো রাতের দিকে যাত্রা' গ্রন্থে ইখওয়ানের উপর চলা অত্যচার ও নির্যাতিনের কাহিনী বিধৃত হয়েছে। "দারসুন ফিস সিগার" অর্থাৎ 'ছোট কালের শিক্ষা' গ্রন্থে নিজের জীবন কে শৈল্পিক ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। "জান্নাতুর রু'ব" তথা ভয়ের বাগিচাতে তিনি যুগে যুগে অত্যাচারিত মুসলিম দের জীবন তুলে ধরেছেন। 'আতয়াফ আরবাআহ' বা রাতের চার অতিথি গ্রন্থটা তিনি অন্য তিন ভাইবোনের সাথে রচনা করেছেন। তাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের বিভিন্ন বিষয় এখানে চলে এসেছে। এইসব গল্প সংগ্রহে লেখিকা তৈরি করেছেন আপন বলয়। মিশরের যে ভাষা এই পরিবার আয়ত্ব করেছিলেন তা আরবি ভাষা ও সাহিত্যে ছিলো অনাস্বাদিত। কুরআনিক আরবির থেকে সুর, ব্যঞ্জণা এবং রূপকল্পতা নিয়ে এই ধারার আরবি তারাই শুরু করেছেন। আর সত্যি বলতে কি এদের চার জনের রচনা পড়লে জ্ঞানের বিষয়গুলো ছাড়া আর সব কিছুতে কেমন সমান সমান মনে হয়। কেও হয়ত গুলিয়ে ফেলবেন তাদের লেখা কার কোনটা নির্বাচন করতে যেয়ে। এই কথার স্বীকৃতি আমরা পাই হামীদার লেখায়। তার 'বুনো রাতের দিকে যাত্রার' উৎসর্গ পাতায় তিনি লিখেছেনঃ "প্রিয় ভাই সাইয়েদকে......... এই গল্প সংকলনটা আমি তোমার কাছে পাঠাচ্ছি। এখানে তুমি এবং আমি যে নির্যাতন ভোগ করেছি তা গল্পে গল্পে তোমাকে শুনিয়েছি। তুমিতো জানো আল্লাহর রহমাতের সাথে সাথে তোমার অবদান আমাকে লেখক বানায়েছে। আমি যা লিখেছি কিংবা লিখবো তার ভাষা তো তোমারই..
তারা আক্কাদ, মানফালুতি, নাজিব মাহফুয গনের গদ্যধারা সম্পূর্ণ ত্যাগ করে কাব্য আবহে তৈরী একটা বাচনিক ধারা আমাদের চোখের সামনে মেলে ধরেছেন, যার গতি কান ও হৃদয় দুটোকেই প্লাবিত করে যায়। ইসলামি আন্দোলনের জন্য এই অধরা এক ভাষা পরবর্তি পর্যায়ে সবার মাঝে দারুন প্রভাবিত করে। তাদের লেখার ধারা ছিলো এই একই স্রোতে প্রবহমান, ভাষা ছিলো অলৌকিকতার পারদ চুবানো এক ধরণের ডিভাইন আশ্রিত কথামালা এবং তার সুর ছিল একই বিণায় প্রণোদিত। ভারতের শাইখ আবুল হাসান নাদাওয়ি সাইয়েদ কুতুবের আরবি কে ‘দাওয়াতি ভাষার কাব্যিক আবহ’ বলে উল্লেখ করেছেন। আক্কাদ এই ভাষাকে 'আললুগাতুশ শাইরাহ' বা কাব্যিক গদ্য নামে চিহ্নিত করেছেন। ডঃ ইমাদুদ্দিন খলিল বলেছেনঃ "কুতুব পরিবারের ভাষার স্রোতধারায় কল্লোলিত হয়েছে পুরানো কুরআনিক সুর অথচ আধুনিকতার খরস্রোতা ধবনিঝংকার সেখানে দিপ্যমান, বিশ দিকের সমস্ত রং তাদের ভাষায় মিলে মিশে বর্ণিল রংধনুর মতই বিকশিত। এদের সবার লেখায় এক ধরণের স্পন্দন অনুভূত হয়, সেখানে পাই জীবন সঞ্চালনকারী মাদকতা, শুনতে পাই দ্রোহের জয়গান। ফলে এদের আরবি এতই সুখপাঠ্য যে, কোন বই একবার ধরলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত ছাড়তে মনে চায়না।" ইসলামি আন্দোলনের জন্য এই অবদান এত বেশি, যার চৌহদ্দি চলে যায় অলিতে গলিতে, ঘরের অলিন্দে, চলে যায় সিনেমায় গানে, শ্রুত হয় জুমার খুৎবায় কিংবা ময়দানের ইসলামি জলসায়, হয়ে যায় সার্বজনীন।
হামীদা কুতুব ছিলেন ইখওয়ানের মহিলা শাখার নিবেদিত প্রান কর্মিদের অন্যতম। মহিলা শাখার প্রথম দ্বায়িত্বশীল মুহতারামা লাতীফাহ আলসূলি ছিলেন ইমাম হাসান আলবান্নার স্ত্রী। তবে তিনি পরিপূর্ণ দ্বায়িত্বশীলা ছিলেন না। কারন কাজ তখন খুব প্রাথমিক পর্যায়ে। এরপর মহিলাদের আগমন এমন বেড়ে গেলো যে, ১৯৩৭ সালে ইখওয়ানের মহিলা শাখা আলাদা করে দিতে হয়। এ শাখার প্রথম প্রধান হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন লাবীবাহ আহমাদ। ইমাম হাসান আলবান্না এদের জন্য পৃথক একটা পত্রিকা চালু করেন 'আলমারআহ আলমুসলিমাহ' নামে। এই পত্রিকা শত শত ইসলামি লেখিকা, গবেষক, কবি ও বুদ্ধিজীবি তৈরীতে ভূমিকা পালন করেছে। ইখওয়ানের মহিলা শাখার জন্য কাজের ক্ষেত্র তৈরিতে ইমাম আলবান্না বিভিন্ন প্রদেশে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ইখওয়ানের মহিলা শাখার দ্বায়িত্ব পালন করেন আমাল আলআশমাওয়ী, নাঈমা আলহুদায়বী, খালিদা হাসান হুদায়বী, ফাতিমা আব্দুল হাদী, যায়নাব জাব্বারাহ প্রমুখ।
হাসান আলবান্না শহীদ হয়ে যাওয়ার পরে মহিলা শাখার কাজ কার্যতঃ বন্ধ হয়ে যায়। অধিকাংশ দ্বায়িত্বশীলদের কে দেশ ছাড়তে হয়। ১৯৫৪ সালের সেনা বিপ্লবের পর সংগঠনের সবচেয়ে নাজুক সময়ে ক'জন মহিলা এগিয়ে এলেন সংগঠনের কাজ করার জন্য। যায়নাব গাযযালি এগিয়ে এলেন মৃতপ্রায় শাখাটাকে জীবিত রাখার জন্য। এই কাফেলায় যুক্ত হলেন আমীনা কুতুব, হামীদা কুতুব, ফাতীহা বিকর, আমীনাহ আলজাওহেরী, আলিয়্যাহ হুদায়বী, তাহিয়্যাহ সুলায়মান জিবিল্লি সহ শত মুজাহিদ নারী। এদের প্রায় সকলেই কোন না কোন ভাবে নির্যাতিত হয়েছেন ১৯৬৫ সনে জামাল নাসেরের হাতে। কিন্তু আন্দোলনের কাজ থেমে যেতে দেন নি তারা।
মিশরে ইসলামি আন্দোলন কর্মিদের মেরে শেষ করার যে প্লান নেয়া হয়েছিলো তার সুফল আল্লাহ তাআলা অন্যভাবে দিয়েছেন। এদের কর্মিরা, নারী হোক কিংবা পুরুষ, যেখানেই গেছেন ইখওয়ানের বীজ বপন করেছেন। সৌদি আরব, সূদান, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, বাহরাইন, উমান, কুয়েত, কাতার, তুর্কি, ইয়েমেন, লিবিয়া, আলজিরিয়া, জর্ডান, ফিলিস্থিন, ইন্দোনেশিয়া, মালেশিয়া, ভারত, পাকিস্থান, এমনকি ইউরোপ, আমেরিকা, , অস্ট্রেলিয়া, কানাডা পৃথিবীর সর্বত্র ইখওয়ানের কর্মিরা হিজরাত করে ইখওয়ানের কাজকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। মহিলারাও রেখেছেন অনন্য সাধারণ ভূমিকা। সত্যি বলতে কি বর্তমান পৃথিবীতে ইসলামি চেতনা ঋদ্ধ বুদ্ধিজীবীদের বিরাট অংশই হলো ইখওয়ানের। প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর প্রায় সবটাতেই ইখওয়ানের কর্মিদের পাওয়া যাবে।
হামীদা কুতুব যখন জেল থেকে ছাড়া পেলেন, ফ্রান্সে অভিবাসি প্যারিস ইউনিভার্সিটি হসপিটালের হৃদ রোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ হামদি মাসউদ এই রত্নকে চিনতে ভুল করেন নি। তিনি তাকে বিয়ে করে প্যারিসে নিয়ে আসেন। আমৃত্যু তিনি প্যারিসেই ছিলেন এবং সেখানে দাওয়াতি কাজ করে ইসলামের একজন সঠিক দায়িয়াহ ইলল্লাহির ভূমিকা পালন করেছেন। এখানে অবস্থান কালীন সময়েও তিনি দ্বীন থেকে বিচ্যুত হননি। তার স্বামী যখন তাকে ফ্রান্সের পাস্পোর্ট তৈরির জন্য দরখাস্ত করেছিলেন, তখন স্কার্ফ মাথায় দিয়ে ফটো গ্রহন করা হবেনা বলে জানানো হয়। তিনি খালি মাথায় ফটো তুলে পাসপোর্ট করতে চাননি। তিনি সাফ জানায়ে দেন এটা একজন মুসলিমের ব্যক্তিগত বিষয়, এখানে সরকারের হস্তক্ষেপ অনভিপ্রেত। পরে অবশ্য ফ্রান্স সরকার হিজাব সহ তার ছবি নিয়ে পাসপোর্ট করে দেন। ডঃ আব্দুল্লাহ কারমাযি বলেনঃ প্যারিসে এসে তিনি দ্বীনি দাওয়াতি কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য নিজ ঘরটাকে কেন্দ্র বানায়ে ফেলেন। এখানেই শত শত নারী তার হাতে সঠিক ভাবে ইসলাম পালনের শপথ নিয়েছে।
প্রফেসর উম্মুল বারা নাজিয়া বালহাজ ছিলেন তার হাতে শিক্ষা পাওয়া একজন মহিলা। তিনি স্মৃতি চারণ করতে যেয়ে বলেনঃ আমার জীবনে হামীদার মত ভালো মানুষ আর দেখিনি। এত উদারতার, এত মায়ার, এত আপন করার ক্ষমতা খুব কম মানুষের মাঝে আমি দেখেছি। আমি একদিন তার বাসায় যাচ্ছি, লিফটে এক খৃস্টান ফরাসী মহিলাকে দেখলাম। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে সালাম জানালো। আমি হামীদার কাছে যাচ্ছি জানতে পেরে মহিলা খুব খুশি হলো। বললোঃ হামীদা মানুষ না, এঞ্জেল। ফিরিশ্তা। আমি তার নেইবার হতে পেরে গর্বিত। নাজিয়া আরো বলেনঃ আমি ইখওয়ানের রাজনীতি বা তার কর্মপদ্ধতি পছন্দ করতাম না। কিন্তু এসব মতপার্থক্য আমাদের মাঝে কোন দিনই বিভেদ সৃষ্টি করেনি। আমাকে তিনি আপন বোনের মর্যাদা দিয়ে সম্মানিত করেছেন।
হামীদা কুতুব ইন্তেকালের আগেও মানুষদের আরবি ভাষা পড়াতেন। বলতেন, আরবী ভাষা শিখে রাখ, কুরানের বন্ধু হতে পারবে। ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের উপর তিনি ক্লাশ নিতেন। কুরআনের ব্যাখ্যা করতেন। প্রায়ই বলতেন, পাশ্চত্যে আল্লাহ তোমাকে নিয়ে এসেছেন, কাজেই নবী মুহাম্মাদের (সা) মত তুমি হও। তিনি লা ইলাহার বাণী প্রচার করে জাহিলি আরবদেরকে শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত করেছিলেন। পাশ্চত্যের এই ভালো ভালো জ্ঞানী মানুষদের বুকে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুর বাণী ঢুকায়ে ওদেরকেও শ্রেষ্ঠ মানুষ বানায়ে দাও।
আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে দুয়া করি আল্লাহ তার আত্মাকে সুউচ্চু ইল্লিয়্যিনে পৌঁছে দিন, এবং নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও সালিহীনদের সাথে জান্নাতে রাখুন।
ব্লগার আবু আফরার ব্লগ থেকে কপি
0 comments: