দ্বিতীয় অধ্যায় : মুসলমান কাকে বলে

মুসলমান কাকে বলে
মুসলমানের ঘরে জন্মগ্রহণ করলেই মুসলমান হওয়া যায় না। মুসলমানের মত নাম রাখলেই তাকে মুসলমান বলা যায় না। ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হতে হয়। ইসলাম গ্রহণ করলেই কেবল মুসলমান হওয়া যায়। আর এই ইসলাম গ্রহণ অর্থ আমি মুসলমান হয়েছি কিংবা আমি মুসলমান এই কথা বলা নয়।
ইসলাম গ্রহণ করার অর্থ :
(ক) হযরত মুহাম্মদ (স) এর শিক্ষা-দীক্ষাকে অন্তরের সাথে সত্য বলে গ্রহণ করা;
(খ) নিজের জীবনে এই শিক্ষাকেই একমাত্র পথ হিসেবে মেনে নেয়া, এবং
(গ) এই ব্যবস্থা অনুযায়ী গোটা জীবনকে গড়ে তোলা।
আল্লাহ তাঁর কিতাব এবং তাঁর রাসূলের মাধ্যমে আমাদেরকে যে সমস্ত জিনিস বিশ্বাস করতে বলেছেন তা বিশ্বাস করার অর্থ হলো-ঈমান।
ঈমান
মুসলমান হতে হলে কতকগুলো জিনিসের উপর বিশ্বাস আনতে হয়। ইসলামী পরিভাষায় একে বলা হয় ঈমান বা আকীদা। যতক্ষণ পর্যন্ত ঈমান ঠিক না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত ইসলামের কোন প্রশ্নই আসে না। সাধারণভাবে ঈমানকে বলা যেতে পারে কতকগুলো বিষয় সুস্পষ্ট জ্ঞান বা ইলম। আমরা সবাই জানি যে কোন কাজ করতে হলে সেই কাজ সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা থাকতে হয়। এই ধারণাটুকু না থাকলে সে কাজও ভালভাবে করা যায় না। তেমনি ইসলামকে গ্রহণ করে মুসলমান হতে হলে জানতে হবে ইসলামী ধ্যান-ধারণার ভিত্তি কি। আর এ জন্য জ্ঞান বা ইসলামকে ইসলামে এতো গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
যে সমস্ত বিষয়ের উপর ইসলামের মূল ভিত্তি বলা হয়, তা হলোঃ
আল্লাহর উপর বিশ্বাস,
ফেরেশতাদের উপর বিশ্বাস,
আল্লাহর কিতাবের উপর বিশ্বাস,
আখেরাত বা পরকালের উপর বিশ্বাস,
তাকদীরের উপর বিশ্বাস,
পুনরুত্থান দিবসের প্রতি বিশ্বাস।
তাওহীদ
আমাদের চারপাশে বিরাট জগত-আকাশ, পৃথিবী, গাঠপালাত, কীট পতঙ্গ, পশু-পাখি, মানুষ-এসব কি আপনা-আপনি সৃষ্টি হয়েছে? এসব কিছু যে একটা সুন্দর নিয়ম মেনে চলেছে, তা কি কোন পরিচালক ছাড়াই হচ্ছে? না, তা কখনো হতে পারে না। কেননা আমরা সবাই এটা জানি যে সামান্য একটা বলও কেউ ধাক্কা না দিলে নড়তে পারে না। ছোট্ট একটা খেলনা একজন কারিগর ছাড়া আপনা-আপনি তৈরি হতে পারে না। তাই এই বিশ্ব জগতের একজন কারিগর আছেন-মালিক আছেন-পরিচালক আছেন। তিনি এক ও দ্বিতীয়। তাঁর দয়ায় আমরা বেঁচে আছি। তিনি আমদাদের রিজিক দেন। যা কিছু হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে-সবই তাঁর জানা আছে। কিন্তু এ কথাটি মুখে স্বীকার করলেই আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা সম্পূর্ণ হয় না। প্রয়োজন, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহকে প্রভু বা মালিক হিসেবে মেনে নেয়া। চাকর বা গোলাম যেমনভাবে তার প্রভুকে মেনে চলে, তার হুকুম অনুযায়ী চলে।
প্রভুর অনুপুস্থিতিতেও নিজের খেয়ালখুশী মত চলে না। মালিকের নিয়ম মত সব কাজ করে। তেমনি ভাবে আল্লাহকে প্রভু হিসেবে মেনে নিয়ে জীবনের কাজ তাঁর আইন অনুযায়ী করতে হবে। এটা অন্তর থেকে বিশ্বাস করতে হবে যে, আমাদের জীবনে একমাত্র তাঁরই আইন চলবে। এই দুনিয়ায় একমাত্র তাঁরই হুকুম চলতে হবে। মানুষের বানানো আইনের সামনে মাথা নত করা যাবে না। কিন্তু আমরা কি দেখি? আল্লাহর উপর ঈমান এনেও আমরা জীবনের এক এক সমস্যার জন্যে একটা একটা শক্তির দ্বারস্থ হচ্ছি। এইভাবে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে অংশীদার বানানোকে শিরক বলা হয়। শিরক মহাপাপ-সবচেয়ে বড় গোনাহ।
তাই আমাদেকে জেনে নিতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে এই দুনিয়ার কিভাবে জীবন-যাপন করতে বলেছেন। এসব কিছু জেনে নিয়ে পুরোপুরিভাবে মেনে চলতে পারলেই তাঁকে প্রভু হিসেবে মেনে নেয়া সার্থক হবে। আল্লাহর প্রকৃত গোলাম তাঁর দেয়া পথ সিরাতুল মুস্তাকিমকে আমরা বেছে নেবো। কোন কাজ করলে একমাত্র তাঁর জন্যেই করবো। কাউকে ভাল বাসলে একমাত্র তাঁর জন্যেই ভাল বাসবো। কাউকে ত্যাগ করলে একমাত্র তাঁর জন্যেই ত্যাগ করবো। তবেই তো হবে আল্লাহর প্রতি সত্যিকারেএ ঈমান আনা।
রিসালাত
এমনিভাবে ঈমান আনতে হয় নবী-রাসূলের প্রতি। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের জীবনটা সহজ নয়। জীবনে হাজারো সমস্যার সামনে তাকে পড়তে হয়। আর তখনই প্রশ্ন আসে কোনটা ঠিক কোনটা ভুল।কোন কাজ করতে হবে আর কোনটা থেকে দূরে থাকতে হবে। দুনিয়ার এসব ব্যাপারে সকলে সমান বুঝে না। তাই এমন একজনের নিকট থেকে তা জেনে নিতে হবে যিনি সব কিছু ভালভাবে জানেন। মানুষের জীবনের সব সমস্যার সমাধান একমাত্র আল্লাহ দিতে পারেন। তাই তিনি মানুষের মাঝে যাদেরকে দুনিয়া জাহানের এসব রহস্য জানিয়ে দিয়ছেন তাঁদের নিকট থেকে আমাদেরকে তা জেনে নিতে হবে।
জীবনের পথে তারাই আমাদের নেতা। আর এই নেতারই হলেন নবী-রাসূল। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন সমাজে আল্লাহ তাঁর নবী-রাসূলদেরকে পাঠিয়েছেন তাঁর বাণী দিয়ে। শেষ বারের মত যিনি অল্লাহর কাছ থেকে শান্তির পথ-নির্দেশ নিয়ে এসেছিলেন তিনি নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (স)। আমরা তাঁর উম্মত বা অনুসারী। কিন্তু এতটুকু বিশ্বাস করার মধ্যে কোন কল্যাণ নিহিত নেই। রাসূলের (সা) প্রতি বিশ্বাস আনার প্রকৃত অর্থ হচ্ছে নিজের জীবনকে পথের দিশারী বা নেতা হিসেবে তাঁকে মেনে নেয়া। রাসূলের শিক্ষা-দীক্ষার উপর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস এনে তাঁর দেখানো পথে দৃঢ় এগিয়ে যাওয়া। হযরত মুহাম্মদ (সা) কে শেষ এবং শ্রেষ্ঠ রাসূল হিসেবে মেনে নেয়ার অর্থই হলো একথা মেনে নেয়া যে, কিয়ামত পর্যন্ত তিনিই আমাদের নেতা। তিনি আমাদের মুক্তির দিশারী। মানবতার মুক্তি একমাত্র তাঁর দেখানো পথেই আসতে পারে।
আখিরাত
আল্লাহ ও রাসূলের (সা) উপর ঈমান আনার পর আমাদেরকে আর একটি বিষয়ের প্রতিও ঈমান আনতে হয়। তা হলো এই যে, দুনিয়ার এই জীবনই শেষ নয়। মানুষ এই দুনিয়ায় ভাল বা মন্দ কাজ করলে তার পল দুনিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং জীবনের প্রতিটি কাজের জন্যে মৃত্যুর পর পরকালেও তাকে জবাবদিহি করতে হবে। এবং তখনই তাকে চূড়ান্ত ফলাফল দেয়া হবে। ভাল কাজের জন্য পাবে বেহেশত আর খারাপ কাজের জন্য পাবে দোজখ। এই সবের উপর বিশ্বাস আনার অর্থ হলো আখেরাতের প্রতি ঈমান।এই ঈমানও সত্যিকারভাবে সম্পূর্ণ হবে তখন যখন জীবনের সব কিছুতে সব সময়ে পরকালের প্রতি ঈমানকে কাজে লাগানো হবে। আখিরাতের প্রতি ঈমান না থাকলে, আল্লাহার কাছে জবাব দেয়ার ভয় না থাকলে, মানুষ কখনো ভাল মানুষ হতে পারে না। যে কাজেই সে করবে নিজের খেয়াল খুশীমত করবে। খারাপ কাজ করতে, মানুষ ঠকাতে, মানুষের উপর জুলুম করতে, দেশের ক্ষতি করতে সে কোন পরোয়াই করবে না। ধীরে ধীরে সব মানুষ শঠ, অসৎ-চরিত্র ও খারাপ প্রকৃতির হয়ৈ গড়ে উঠবে। দুনিয়ায় নেমে আসবে সীমাহীন অশান্তি। যখন মানুষ ঈমান আনে আখিরাতের প্রতি, তখন আল্লাহর কাছে জবাব দিতে হবে এই ভয়ে নিয়ে সে কাজ করে। তখন তার দ্বারা কোন খারাপ কাজ হতে পারে না। সে হয়ে উঠে এক সুন্দর আর আদর্শ মানুষ।
কিতাব ও ফিরিশতা
আল্লাহ নবীদের কাছে যে বাণী পাঠয়ৈছেন তাকে অহী বলা হয়। অহীর মাধ্যমে আল্লাহ অনেক নবীর কাছে কিতাব পাঠিয়েছেন। যেমন হযরত মূসা (আ) এর কাছে এসেছে তাওরাত হযরত দাউদ (আ) এর কাছে জাবুর আর হযরত ঈসা (আ) এর কাছে ইঞ্জিল। এমনিভাবে সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর কাছে যে কিতাব এসেছে তার নাম আল কুরআন। কুরআনে রয়েছে মানুষের জন্যে আল্লাহর হুকুম-আহকাম। আমাদের জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্যে-দুনিয়ায় একসুখী-সুন্দর সমাজ গড়ে তোলার জন্যে মৌলিক নিয়ম নীতি এসেছে এই কুরআনে। আর আল্লাহর নবী কুরআনের আলোকেই নিজের জীবনকে গড়ে তুলেছিলেন। এই কুরআনকে দেখানো পথে কায়েম করেছিলেন এক সুন্দর ইসলামী সমাজ।
সেই কুরআনকে কি আমরা তেমনিভাবে আমাদের জীবনে গ্রহণ করেছি? না, বরং অতি ভক্তির সাথে কুরআনকে তাকের উপর তুলে রেখেছি। কুরআনে আমাদের রব আমাদের জন্যে কি কি নির্দেশ দিলেন তা জানার এবং তো মেনে চলার আগ্রহ আমাদের মধ্যে নেই। শুধু কুরআন তিলাওয়াত করছি অন্যদিকে কুরআনের বিধি বিধানের উল্টো কাজ করছি। প্রতি মুসলিম ঘরে আজ সুন্দর কাপড়ে মুড়ানো, সুন্দুরভাবে সাজানো আছে কুরআন। কিন্তু আমাদের চারপাশের সমাজে বিরাজ করছে ঠিক কুরআনের উল্টো আইন-কানুন। এই অবস্থায় কিভাবে আমরা দাবী করতে পারি যে, কুরআনের উপর রয়েছে আমাদের অবিচল বিশ্বাস? কুরআনের প্রতি আমাদের ঈমানের দাবী তখনই পূর্ণ হতে পারে যখন কুরআনকে জীবনপথের চলার দিশা হিসেবে মেনে নেবো। যখন কুরআনকে আমাদের নিজেদের এবং সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায় আমরা তৎপর হবো। তাওহীদ, রিসালাত, আখিরাত ও কিতাবের উপর ঈমান আনার সাথে সাথে তকদির ও ফিরিশতাদের প্রতিও আমাদের ঈমান আনা দরকার। ফিরিশতারা নূরের তৈরি। আল্লাহর হুকুমেই তারা প্রত্যেকেই এক একটি দায়িত্ব পালন করেন।
ইবাদত
ঈমানের আসল কথা হলো কোন প্রকার সন্দেহ ছাড়াই তাওহীদ, রিসালাত, আখিরাত এবং কিতাব ইত্যাদির উপর বিশ্বাস আনা। এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে জীবন গড়ে তোলার নাম ইবাদত অর্থাৎ দাসত্ব বা গোলামী করা। মানুষ ও জ্বীন জাতিকে সৃষ্টির উদ্দেশ্যই হলো তারা আল্লাহর ইবাদত করবে। তাই কোনো অবস্থাতেই মানুষ এই দাসত্ব থেকে মুক্তি পেতে পারে না। যেহেতু আল্লাহর গোলাম বা দাস হিসাবেই আমাদের জন্ম তাই আমাদের নিজেদের গোটা জীবনটাই তাঁর গোলামী বা দাসত্ব করে কাটিয়ে দেয়া উচিত। এর মানে এ নয় যে দুনিয়ার সব কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে কোথাও বসে আল্লাহ আল্লাহ করতে হবে। বরং ইবাদত করার আসল অর্থ হলো আমরা দুনিয়ায় যে সব কাজ করবো তা আল্লাহর আইন ও নিয়ম অনুযায়ী করবো। মানুষের জীবনের ঘম, বিশ্রাম, পানাহার, চলাফেরা, অন্যের সাথে ব্যবহার, টাকা পয়সার লেন-দেন মোটকথা প্রত্যেকটি কাজ আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী করার নামই ইবাদত। এই ভাবে মানুষের জীবন গড়ে তোলার জন্যে প্রাথমিকভাবে কতকগুলো কাজ করতে হয়। যেমন আল্লাহ ও রাসূলের উপর বিশ্বাস স্থাপন, নামাজ পড়া, রোজা রাখা, যাকাত দেয়া এবং সামর্থ্য থাকলে হজ্ব করা। এগুলো হচ্ছে মুসলমানদের আনুষ্ঠানিক কাজ। এসব কাজ মুসলমানদের উপর ফরয বা অবশ্যকরণীয় করা হয়েছে যেনো এ সবের মাধ্যমেই তাদের পুরো জীবন আল্লাহর দাসত্বে পরিণত হতে পারে। তাই একজন লোকজন সারাদিন নামাজ পড়ার পরে রোজার মাসে সারা মাস উপবাস থাকার পরে আর পয়সা খরচ করে হজ্ব করার পরেও যদি তার হৃদয় মনে খোদার ভয়, প্রেম ও ভালবাসা সঠিকভাবে সৃষ্টি না হয় তবে তার নামায, রোজা ও হজ্ব পালনের উদ্দেশ্য একেবারে ব্যার্থ হয়েছে বলতে হবে। লোক দেখানো নামায, রোজা হজ্ব ও যাকাতের কোন মূল্য নেই।
জিহাদ
নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত তাই অন্যান্য ধর্মের পূজা-উপাসনা ও যাত্রার মত কোন অনুষ্ঠানমাত্র নয়। এই কাজ করলেই আল্লাহ তায়ালা কারো উপর সন্তুষ্ট হয়ে যান না। ইবাদতের আসল উদ্দেশ্য হলো মানুষের উপর থেকে আল্লাহ ছাড়া অন্য শক্তির প্রভুত্বকে খতম করা। আর এই উদ্দেশ্যে জান মাল ব্যয় করে সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করার নাম জিহাদ। তাই জিহাদ ইসলামের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। মানুষের জীবনে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম ও প্রচেষ্টাকে বলা হয় জিহাদ। জিহাদ কথাটার অর্থ তাই ব্যাপক। আমাদের চারিদিকে সীমাহীন অন্যায়-অত্যাচার, জুলুম নির্যাতন, পাপ, কুশিক্ষা, নোংরামি ও উলঙ্গপনার মূল কারণ কি কখনো ভেবে দেখেছি? এ সবের প্রকৃত ও মূল কারণ হলো আজকের সমাজের নেতৃত্ব, কর্তৃক্ব ও শক্তি সামর্থ্য রয়েছে অত্যাচারী দূরাচারী লোকদের হাতে। সাধারণভাবে আমরা দেখি একজন ড্রাইভারই নিজের ইচ্ছামত গাড়িকে যেদিক ইচ্ছা সেদিকে নিতে পারে। তাই সমাজের উপর নেমে আসে অশান্তি বিপর্যয়। আর তা থেকে মুক্তির একমাত্র পথই হলো এই অসৎ নেতৃত্ব থেকে সমাজকে মুক্ত করে ফেলা। ইসলাম চায় দুনিয়ার সব জায়গায় এই অসৎ নেতৃত্বকে খতম করে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করতে আর এই প্রচেষ্টার নামই জিহাদ। এই জন্যে প্রয়োজন হলে শক্তি প্রয়োগ যেমন জিহাদ তেমনি এ উদ্দেশ্যে সাহিত্য রচনার জন্যে কলম ধরাও তেমনি জিহাদ।
কিন্তু একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে যাওয়া উচিত। তা হলো জিহাদের প্রথম পদক্ষেপ হলো নিজের সাথে জিহাদ। নিজের মন ও মানসিকতায় আল্লাহ ও রাসূলের শিক্ষা দীক্ষার বিরোধী কোন শিক্ষা ও ইচ্ছা থাকলে সর্বপ্রথম তার বিরুদ্ধেই জিহাদ করতে হবে। যে ব্যক্তির নিজের ভেতরের বিদ্রোহী আত্মার সাথে জিহাদ করেননি, সমাজের চার পাশের অন্যায় অসত্যর বিরুদ্ধে সে জিহাদ করতে পারে না। তাই জিহাদ বলতে যদি কেউ সাধারণত, যুদ্ধ মারামারি, কাটাকাটি বুঝে তবে ভুল হবে। জিহাদ একটি পবিত্র কাজ। মুসলমানদের পবিত্র দায়ত্ব।
মুসলামানদের দায়িত্ব
মুসলমানদের দায়িত্ব তাই নিজেদের জীবনে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার সাথে সাথে দুনিয়ার সবক্ষেত্রে আল্লাহর আইনকে কার্যকরী করা। মুসলিম জীবনের মিশন কি তা সুন্দরভাবে আল্লাহ বলে দিয়েছেন কুরআনের সূরা আল-হজ্ব। মুসলমানদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলা হয়েছে- হে ঈমানদার! রুকু কর, সিজদা কর এবং ইবাদত কর তোমাদের প্রভুর আর সৎ কাজ করতে থাকো তবেই তোমরা লাভভান হবে এবং জিহাদ কর আল্লাহর পথে যেভাবে জিহাদ করা উচিৎ। তিনিই তোমাদের এই দ্বীন বা পথ পছন্দ করে দিয়েছেন এবং এ ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন কঠোরতা আরোপ করা হয়নি। এতো তোমাদের পিতা ইব্রাহিমের পথ, পূর্ব থেকেই তিনি তোমাদের নাম মুসলমান রেখেছেন এবং এই কেতাবেও (সেই নাম রাখা হয়েছে) যেন রাসূল তোমাদের প্রতি সাক্ষী হতে পারেন এবং তোমরা মানব জাতির প্রতি সাক্ষী হতে পারে। অতএব তোমরা নামাজ কায়েম কর ও যাকাত দিতে থাকো। এবং আল্লাহ কে (আল্লাহর আইনকে) শক্ত করে ধরো, তিনিই তোমাদের রক্ষকর্তা, তিনিই অতুলনীয় মুরব্বী এবং অদ্বিতীয় সাহায্যকারী। সূরা হজ্ব : ৭৭-৭৮
আল্লাহ বলেছেন, মুসলমানদের কাজ হলো একমাত্র তাঁরই গোলামী করা। এজন্যে তাদের নিজেদেরকে ভালভাবে গড়তে হবে। আল্লাহ যখন ভাল কাজ করতে বলেছেন তখন এটা স্পষ্ট যে খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে একজন মুসলমানকে এ কাজ করতে হবে নিজের জন্য এবং সেই সাথে সমাজে এক বিরাট দায়িত্ব পালনের জন্য। নিজেকে প্রস্তুত করার পর মুসলমানদের আদেশ করা হয়েছে জিহাদ করার। তারা ন্যায় কাজেও আদেশ দিবে এবং সেই সাথে অন্যায় কাজে দেবে বাধা। যাতে করে আল্লাহর আহবান চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং মানুষ যুক্তি ও বিবেক খাটিয়ে ইসলামকে গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু দেখা যায় সমাজের কুসংস্কার, খারাপ নেতৃত্ব এ পথে বাধা সৃষ্টি করে, তখন শেষ ব্যবস্থা হিসেবে তরবারিও ধরতে হয়। নবী রাসূলরা এ দায়িত্ব পালন করেছেন। তারা এ দায়িত্ব পালন করে তাঁদের অনুসারীদেরকে এ কাজ বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। এখন এ দায়িত্ব তাদের অনুসারীদের।
এই দায়িত্ব যারা পালন করবে দুনিয়ায় তারা পাবে সম্মান আর আখেরাতে পাবে উত্তম পুরষ্কার। কিন্তু এ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে দুনিয়া ও আখেরাতে উভয় জায়গায় তারা হবে লাঞ্চিত। মুসলমানদের আগে এ দায়িত্ব ছিল বনি ইসরাঈলদের উপর। তারা ছিল হযরত মূসা (আ) এর উম্মাত। কিন্ত এ দায়িত্ব অবহেলা করার কারণে তারা হলে দুনিয়াতে লাঞ্চিত এবং আশ্রয়হীন। তাদের লাঞ্চনার কথা খোদ কুরআনেই আছে। তারপর এ দায়িত্ব এসে পড়ে মুসলমানদের উপর। রাসূলে খোদা (সা) এর নেতৃত্ব গড়ে ওঠা এই জাতি এ দায়িত্ব কে তাদের নিজেদের জীবন মৃত্যুর উদ্দেশ্য বানিয়ে নিলো। গড়ে উঠলো মুসলিম নামে এক নিঃস্বার্থ সৈনিক জাতি যাদের হাতে মানবতা পেলো মুক্তির স্বাদ, পেল সত্যের সন্ধান। রাতের অন্ধকারে তাদের মাথা নত হয় পড়তো মহান আল্লাহর দরবারে। দিনের বেলায় তাদের ঘোড়ার খুরের দাপটে কেঁপে উঠতো দুনিয়ার জাহেলিয়াত, অন্যায় পূর্ণ সজাগ। তারা এইভাবে কাজ করেছেন এবং ঈমানের পরীক্ষায় ত্যাগ ও করবানী স্বীকার করেছেন। আর তাই মানবতার ইতিহাসে তাদের নাম উজ্জ্বল ও ভাস্বর হয়ে আছে।
মুসলমানদের বিপর্যয়
কিন্তু আস্তে আস্তে মুসলমানদের মধ্যে এ দায়িত্ব পালনে দেখা দিলো শিথিলতা। আরাম-আয়েশের মধ্যে ডুবে গেলো তারা। অন্যদিকে ইসলামের দিকে ডাকা তো দূরের কথা নিজেদের জীবন থেকে বিদায় নিলো ইসলাম রীতিনীতি। শুধু কথায় ইসলাম মেনে চলা হতো, কাজে নয়। এ সময় পাশ্চাত্য বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশগুলো আধুনিক, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে শিল্পবাণিজ্যের ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলো অনেক। ব্যবসায়ের সওদা নিয়ে তারা ছড়িয়ে পড়লো পৃথিবীর আনাচে কানাচে। যখনই মুসলিম শক্তি দুর্বল হয়ে পড়লো তখনই তারা যে আঘাত হেনেছিলো সে আঘাত সহ্য করতে পারলো না মুসলিম শাসকরা। বুদ্ধি ও শক্তির কাছে হেরে গেলো মুসলিম শাসকরা। মুসলিম জাহানে নেমে এলো পরাধীনতার অন্ধকার। মুসলমানরা শুধু শাসন ক্ষমতাই হারালো না, তাদের শিক্ষ-দীক্ষা, আচার-অনুষ্ঠান ও আদর্শের উপর আসলো বিজাতীয় আঘাত।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম