বিশ্ব-বিপ্লব
পূর্বোক্ত আলোচনা হতে একথা সুস্পষ্ট হয় যে, অনৈসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিলোপ সাধন করে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই হচ্ছে ইসলামী জিহাদের মূল উদ্দেশ্য (objective) বিশেষ কোনো দেশ কিংবা কয়েকটি মাত্র দেশই নয়, বরং সমগ্র দুনিয়ায়ই ইসলাম এ বিপ্লব সৃষ্টি করতে চায়। প্রথমত মুসলিম দলের নিজ নিজ দেশেই রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিপ্লব সৃষ্টির জন্য চেষ্টা করা কর্তব্য, কিন্তু সর্বাত্মক বিশ্ব-বিপ্লব (world revolution) সৃষ্টি করাই তাদের চূড়ান্ত ও সর্বশেষ লক্ষ্য। বস্তুত যে বিপ্লবী দল জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে গোটা মানবতার কল্যাণের জন্য চেষ্টা করবে তার মূল লক্ষ্য ও কার্যক্রম বিশেষ কোনো জাতি কিংবা বিশেষ কোনো দেশের চতুঃসীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকতে পারে না। বরং বিপ্লবের স্বাভাবিক প্রবণতায়ই তা এক বিশ্ব বিপ্লবের রূপ ধারণ করে। সত্য কখনো ভৌগলিকসীমার মধ্যে আবব্ধ থাকতে পারে না।। কোনো নদী কিংবা পর্বতের এক দিকে যা সত্য অপর দিকেও তা সত্যরূপে স্বীকৃতি পাবে, এটাই সত্যের চিরন্তন দাবি। মানব জাতির কোনো একটি অংশকেও এ সত্য হতে বঞ্চিত করা যেতে পারে না। মানুষ যেখানেই যুলুম নিপীড়ন এবং কড়াকড়ি ও বাড়াড়ির পেষণে জর্জরিত হচ্ছে সেখানেই তাদের মুক্তি বিধানের জন্য উপনীত হওয়া ‘সত্যের’ অবশ্য কতর্ব্য। পবিত্র কুরআন একথাই নিম্নলিখিত ভাষায় পেশ করছে।
وَمَا لَكُمْ لاَ تُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللّهِ وَالْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاء وَالْوِلْدَانِ الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْ هَـذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ أَهْلُهَا
‘তোমাদের কি হয়েছে যে, এসব পুরুষ, স্ত্রীলোক এবং শিশুদের সাহায্যার্থে তোমরা আল্লাহর পথে লড়াই কর না, যারা দুর্বল বলে নির্যাতিত হচ্ছে এবং যারা এই বলে প্রার্থণা করে যে, হে আল্লাহ! এই যালেম অধ্যুষিত জনপদ হতে আমাদের মুক্তি দাও।’ (সূরা আন-নিসাঃ ৭৫)
এতদ্ব্যতীত জাতীয় আঞ্চলিক বিভাগ সত্বেও মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও সম্বন্ধ এতো ব্যাপক যে, এর ফলে কোনো একটি রাষ্ট্রের পক্ষে বিশেষ কোনো আদর্শ অনুযায়ী পূর্ণরূপে চলা সম্ভব হয় না, যতোক্ষণ না প্রতিবেশী দেশসমূহেও অনুরূপ আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হবে। অতএব মানব সাধারণের পূর্ণাঙ্গ সংস্কার সাধন এবং আদর্শ ভিত্তিক আত্মরক্ষার জন্য একটি মাত্র দেশে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে ক্ষ্যান্ত না হয়, বরং শক্তি ও সামর্থ অনুসারে উক্ত রাষ্ট্রকে আরো অধিকতর সম্প্রসারণের চেষ্টা করাই একটি ইসলামী দলের প্রধানতম কর্তব্য। তারা একদিকে ইসলামের বিপ্লবী চিন্তাধারা ও মতবাদ প্রচার করবে এবং সকল দেশের অধিবাসীকে গ্রহণ করার আহ্বান জানাবে যেহেতু এটাতেই তাদের প্রকৃত ও সর্বাঙ্গীন কল্যাণ নিহিত রয়েছে এবং অপরদিকে তাদের শক্তি ও সামর্থ থাকলে অনৈসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করে উহার মূল্যোচ্ছেদ করবে এবং তার পরিবর্তে ইসলামের সর্বাত্মক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করবে।
বস্তুত হযরত নবী করীম (সা) এবং তার পরে খোলাফায়ে রাশেদীন এ পন্থায় কাজ করেছেন। ইসলামী দলের অভুত্থান কেন্দ্র আরব দেশকেই সর্বপ্রথম ইসলামী রাষ্ট্রের প্রভাবাধীন করে নেয়া হয়। অতপর নবী করীম (সা) পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের রাষ্ট্রনায়ক ও জনগণকে ইসলামের বিপ্লবী আদর্শ ও নীতি গ্রহণের আমন্ত্রণ জানান। ঐসব দেশের শাসকগোষ্ঠী ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনে অস্বীকৃতি জানালে তিনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এজাতীয় যুদ্ধগুলোর মধ্যে তাবুকের যুদ্ধ হচ্ছে প্রথম। নবী করীম (সা)-এর পর হযরত আবু বকর (রা) মুসলমানদের নেতা নির্বাচিত হন। তিনি রোম ও ইরান এই দুই অনৈসলামী রাষ্ট্রের উপর একই সংগে আক্রমণ করেন আর হযরত উমর ফারুক (রা)-এর সময় এ আক্রমণ সাফল্যের চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়। মিসর, সিরিয়া, রোম ও ইরানের জনগণ প্রথমত ইহাকে আরবের সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বলে মনে করেছিল। সাধারণত এক জাতি অপর জাতিকে দাসানুদাসে পরিণত করার জন্যে যেরূপ আক্রমণ করে থাকে আরবদের এ আক্রমণকেও তারা তদনুরূপ পদক্ষেপ বলে মনে করেছিল। এই ভুল ধারণার বশবর্তী হয়েই তারা কাইসার ও কিসরার পতাকাতলে সমবেত হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু পরে তারা মুসলিম দলের বিপ্লবী আদর্শের সাথে পরিচিত হলো। তারা নিঃসন্দেহে বুঝলো যে, তারা অত্যাচার ও নিপীড়নমূলক জাতীয়তাবাদের (aggressive nationalism) নিশানবরদার নয়, বরং তারা আক্রমণাত্মক জাতীয়তাবাদের উর্ধ্বে এক সুবিচার ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যই অগ্রসর হয়েছে এবং কাইসার ও কিসরার বেশে অত্যাচারী শ্রেণীসমূহের প্রতিষ্ঠিত যে প্রভুত্ব জনগণকে নির্মমভাবে নিষ্পেষিত করছে এটাকে নির্মূল করাই এ আক্রমনের উদ্দেশ্য। এই তত্ত্ব অনুধাবন করার সংগে সংগে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের অধিবাসীগণের নৈতিক সমর্থন মুসলিম দলের অনুকূলে এসে পড়লো। ফলে তারা ধীরে ধীরে ‘কাইসার’ ও ‘কিসরার’ দল হতে বিচ্ছিন্ন হতে লাগলো। তাদেরকে জোরপূর্বক সৈন্য বাহিনীতে শামিল করা হলেও লড়াইয়ের ব্যাপারে তাদের আর আন্তরিকতা থাকতো না। বস্তুত একটু তলিয়ে চিন্তা করলেই বুঝা যাবে যে, প্রথম পর্যায়ে মুসলমানদের ঐতিহাসিক ও বিস্ময়কর দেশ জয়ের মূলে এটাই হচ্ছে অন্যতম প্রধান কারণ। এজন্যই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভের পর ইসলামের সমাজ ব্যবস্থাকে বাস্তবে চালু ও কার্যকর হতে দেখে তারা বিশেষভাবে মুগ্ধ হয় এবং ঐকান্তিক আগ্রহের সাথে তারা এ আন্তর্জাতিক বিপ্লবী দলের অন্তর্ভূক্ত হতে শুরু করে। আর অপরাপর দেশসমূহেও অনুরূপ বিপ্লব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তারা এই বিপ্লবী আদর্শের ধারক ও বাহকে পরিণত হয়।
আক্রমণাত্মক ও আত্মরক্ষামূলক জিহাদের শ্রেণীবিভাগ অবান্তর উপরের আলোচনা সম্পর্কে একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে অতি সহজেই বুঝা যাবে যে, ‘আক্রমণাত্মক’ (aggressive) ও ‘আত্মরক্ষামূলক’ (defensive) প্রভৃতি আধুনিক পরিভাষা অনুযায়ী ইসলামী জিহাদকে কিছুতেই বিভক্ত করা যায় না। অবশ্য জাতীয় এবং আঞ্চলিক যুদ্ধসমূহকে এভাবে ভাগ করা যেতে পারে। কারণ পরিভাষা হিসেবে ‘আক্রমণ’ ও ‘প্রতিরোধ’ প্রভৃতি শব্দ একটি দেশে কিংবা একটি জাতি সম্পর্কেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কিন্তু কোনো আন্তর্জাতিক (মর্যাদাসম্পন্ন) দল যদি একটি সর্বাত্মক ও বিশ্বব্যাপক মতাদর্শ নিয়ে কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে, পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিকে মানুষ হিসেবেই তা গ্রহণ করার জন্য আহবান জানায় এবং প্রত্যেক জাতি হতে আগত লোকদেরকে সমান মর্যাদা সহকারে নিজেদের আদর্শের ভিত্তিতেই নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করে, তবে সে ক্ষেত্রে পারিভাষিক ‘আক্রমণ’ ও ‘প্রতিরোধের’ কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। উপরন্তু পরিভাষার কথা বাদ দিলেও ইসলামী জিহাদকে ‘আক্রমাণাত্মক’ ও ‘প্রতিরোধমূলক’- এ দু’ভাগে বিভক্ত করা কোনো মতেই সংগত নয়। কারণ ইসলামী জিহাদে একই সংগে এ উভয় প্রকার কাজ সম্পন্ন হতে দেখা যায়। বিরোধী মতাদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনার কারণে উহা আক্রমণাত্মক। আবার নিজ আদর্শ অনুযায়ী কাজ করার জন্য রাষ্ট্রশক্তি অর্জন করতে বাধ্য বলে তা প্রতিরোধমূলক। কিন্তু একটি দল হওয়ার কারণে, তার এমন কোনো ঘর-বাড়ি নাই যার প্রতিরোধ করতে হবে। ইহার নিকট আদর্শই হচ্ছে একমাত্র সম্পদ। এ আদর্শ রক্ষার জন্যই তার আপ্রাণ চেষ্টা এবং সাধনা। অনুরূপভাবে তারা বিরোধী দলের ঘর-বাড়ির উপরেও কখনো আক্রমণ করে না, আক্রমণ করে তার আদর্শ-নীতি ও কর্মপন্থার উপর। উপরন্তু জোরপুর্বক তার নিকট হতে আদর্শ কেড়ে নেয়াও এ আক্রমণের লক্ষ্য নয়, বরং তার আদর্শের হাত হতে রাষ্ট্রক্ষমতা কেড়ে নেয়ার জন্যই এ আক্রমণ হয়ে থাকে।
যিম্মীদের অবস্থা
ইসলামী হুকুমাতের অধীনে বিপরীত আদর্শ ও আকীদায় বিশ্বাসী এবং অনুসারীদের অবস্থা কি হয়ে থাকে প্রসংগত তাও উপরের আলোচনা দ্বারা সুষ্পষ্ট হয়েছে। বস্তুত ইসলামী জিহাদ জনগণের আকীদা-বিশ্বাস এবং তাদের ধর্মীয় উপাসনা ও সামাজিক নিয়ম-নীতির উপর কখনও হস্তক্ষেপ করে না। আকীদা, ধর্মবিশ্বাস ও মতাদর্শের ব্যাপারে ইসলাম মানুষকে পূর্ণ স্বাধীনতা দান করে। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কোনো আদর্শ ও নীতি অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকার কাকেও দিতে ইসলাম প্রস্তুত নয়। উপরন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে সামাজিক ও সমষ্টিগত কল্যাণ বিরোধী নিয়ম-নীতি অনুযায়ী সামগ্রীক কার্য সম্পাদনের কোনো অনুমতিই ইসলামী হুকুমাতে দেয়া যেতে পারে না। ইসলামী হুকুমাত রাষ্ট্র ক্ষমতা করায়ত্ব করেই সকল প্রকার সূদী কারবার বন্ধ করে দেবে। জুয়া খেলার অনুমতি কিছুতেই দেয়া হবে না ; ক্রয়-বিক্রয় অর্থনৈতিক আদান-প্রদান যেসব নিয়ম-পন্থাকে ইসলাম হারাম ঘোষণা করেছে তা সবই বন্ধ করে দেয়া হবে। বেশ্যালয় ও অশ্লীলতার যাবতীয় কেন্দ্র চুরমার করে দেয়া হবে। এমন কি অমুসলিম নারীগণকে ‘সতরে’র (অংগ আবৃত করা) নিম্নতম সীমা রক্ষা করে চলতে বাধ্য করা হবে। উলংগ ও অশ্লীল এবং প্রকাশ্যভাবে নগ্নতার সমর্থক রীতিসমূহ নির্মূল করা হবে। সিনেমা নিয়ন্ত্রিত করা হবে এবং উহার নৈতিকতা বিরোধী সকল অংশ ও ভাবধারা দূর করা হবে। সহ শিক্ষা প্রচলনের অনুমতি কাকেও দেয়া হবে না। এ ব্যাপারে ইসলামী হুকুমাতকে হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে হবে, যা অমুসলিমদের দৃষ্টিতে অসংগত না হলেও ইসলামের দৃষ্টিতে ধ্বংস ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী। কেবল সামাজিক কল্যাণ ও মংগল বিধানের জন্য নয়, আদর্শের দিক দিয়ে আত্মরক্ষার (self defence) জন্যও ইহাকে এরূপ করতে হবে। এপর্যায়ে কেউ যদি ইসলামের বিরুদ্ধে অনুদারতার অভিযোগ উত্থাপন করে, তবে তাকে একটি বিষয় চিন্তা করতে বলবোঃ ইসলাম এর বিরোধী অন্যান্য ধর্মমতের সাথে যতোখানি উদার ব্যবহার করে দুনিয়ার কোনো বিপ্লবী ও সংস্কারবাদী আদর্শই তা করতে প্রস্তুত নয়। বরং অন্যান্য সমস্ত সমাজেই দেখা যায় বিরোধী আদর্শের অনুগামীদের জীবন নানাভাবে জর্জরিত ও দুঃসহ করে তোলা হয়েছে। এমনকি অত্যাচারের নিষ্পেষণে বিড়ম্বিত হয়ে তাদের কতো লোক যে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয় তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু ইসলাম তার বিরোধী মতাবলম্বীদেরকে পূর্ণ শান্তি ও নিরাপত্তা সহকারে সকল প্রকার উন্নতি লাভের সুযোগ দিয়ে থাকে। ইসলাম সকল শ্রেণীর অমুসলিমদের সাথে যে ধরনের উদার ব্যবহার করেছে, পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও তার তুলনা পাওয়া যায় না।
সাম্রাজ্যবাদের সন্দেহ
এপর্যন্ত পৌঁছে আমাকে আবার বলতে হচ্ছে যে, ইসলাম কেবল আল্লাহর পথে কৃত সাধনাকেই ‘জিহাদ’ নামে অভিহিত করে এবং এরূপ জিহাদের ফলে ইসলামী হুকুমাত কায়েম হলেও সেখানে কাইসার ও কিসরার অনুরূপ আচরণ অবলম্বন করে দ্বিতীয় খোদা হয়ে বসা মুসলমানদের পক্ষে আদৌ বৈধ নয়, ব্যক্তিগত শাসন কায়েম করার জন্য, মানুষকে নিজের দাসানুদাসে পরিণত করার উদ্দেশ্যে এবং তাদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমলব্ধ ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে লুটিয়া নিয়ে নিজের লালসাবৃত্তি চরিতার্থ করার সুযোগ লাভ করার জন্য কোনো মুসলমান যুদ্ধ করে না, আর মুসলিম হওয়ার কারণেই এজন্য সে লড়াই করতেও পারে না। কারণ এই ধরনের জিহাদ ‘আল্লাহর পথে’ হয় না, হয় ‘তাগুতের পথে’। এপথে কোনো সরকার কায়েম হলে ইসলামের সাথে কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। মূলত ইসলামের জিহাদ একটি নিরস ও স্বাদহীন শ্রম মাত্র। তাতে জান-মাল এবং লালসার কুরবানী ভিন্ন আর কিছুই নয়। এ জিহাদ সাফল্যমন্ডিত হলে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা করায়ত্ব হলে সত্যিকার মুসলিম শাসকদের দায়িত্বানুভূতি অত্যন্ত তীব্র হয়ে পড়ে। এমন কি, বেচারাদের রাত্রের নিদ্রা এবং দিনের বিশ্রাম পর্যন্ত শেষ হয়ে পড়ে। কিন্তু এর বিনিময়ে তারা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও ক্ষমতালব্ধ কোনো সুযোগ-সুবিধা কিংবা আয়েশ-আরাম করতে পারে না। অথচ এসব ভোগ করার জন্যই অনেকে সাধারণত রাষ্ট্রক্ষমতা লাভের উদ্দেশ্যে চেষ্টা করে থাকে। ইসলামের শাসক প্রজা সাধারণ হতে উর্ধ্বে অবস্থানকারী কোনো বিশিষ্ট সত্তা নয়, বিশেষ ধরনের কোনো আসনেও সে বসতে পারে না, সে নিজের সম্মুখে অপর লোকদের অবনত করতে পারে না, শরীয়াতের আইনের বিপরীত নিজের ইচ্ছা মতো সামান্যতম কাজও সে করতে পারে না। নিজেকে ও নিজের আত্মীয়বর্গকে সে কোনো নিম্নতম ব্যক্তি সংগত দাবি পূরণের দায়িত্ব হতে নিষ্কৃতিও দিতে পারে না। ন্যায্য পাওনা ব্যতীত সে একটি কণা পর্যন্ত গ্রহণ করতে পারে না, এক বিন্দু জমিও সে নাজায়েযভাবে দখল করতে পারে না। মধ্যম ‘মান’ অনুযায়ী জীবন যাপনের উপযোগী বেতনের অধিক একপাই পরিমাণ অর্থও বায়তুলমাল হতে গ্রহণ করা তার পক্ষে হারাম। ইসলামী হুকুমাতের শাসনকর্তা কোনো রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করতে পারে না।
বিলাস-ব্যাসনের সরঞ্জাম গ্রহণ করাও তার পক্ষে নিষিদ্ধ। তার জীবনের যাবতীয় কাজ-কর্মের চূড়ান্ত ও পুংখানুপুংখ হিসেব নেয়া হবে এ আতংকেই বেচারা প্রতিটি মুহুর্তে কাতর হয়ে থাকে। কারণ তার সন্দেহাতীত বিশ্বাস এই যে, হারাম উপায়ে উপার্জিত একটি পয়সা, জোরপূর্বক দখলকৃত এক টুকরা জমি, একবিন্দু অহংকার ও ফিরাউনী চাল, অত্যাচার ও অবিচারের একটি ঘটনা এবং লালসা চরিতার্থের একটু ইচ্ছাও তার আমলনামায় প্রমাণিত হলে পরকালে তাকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। যদি কোনো ব্যক্তি প্রকৃতই নিজের বৈষয়িক সুবিধা লাভের জন্য লোভাতুর হয়ে ইসলামী বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের ইচ্ছা করে, তবে বলতেই হবে যে, তার তুলনায় নির্বোধ আর কেউ হতে পারে না। কারণ ইসলামী হুকুমাতের রাষ্ট্রপ্রধান অপেক্ষা বাজারে একজন সাধারণ দোকানদারের অবস্থা অনেক ভালো হয়ে থাকে। দিনের বেলা সে নিশ্চিন্তে পা মেলে ঘুমাতে পারে। কিন্তু খলিফা বেচারা না তার সমপরিমাণ উপার্জন করতে পারে, আর না পারে রাতের বেলা পরম তৃপ্তিতে নিদ্রায় অচেতন হতে। তার অবস্থা সত্যিই সহানুভূতির উদ্রেক করে।
বস্তুত এটাই হচ্ছে ইসলামী হুকুমাত ও অনৈসলামী হুকুমাতের মৌলিক পার্থক্য। শেষোক্ত রাষ্ট্রব্যবস্থায় শাসকগণ লোকদের উপর স্বীয় প্রভুত্ব বিস্তার করে থাকে এবং দেশের উপায়-উপাদান ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করে। পক্ষান্তরে ইসলামী রাষ্ট্রের পরিচালকগণ শুধু খেদমত-ই করে থাকে, জনসাধারণের অপেক্ষা অধিক কিছুই সে নিজের জন্য গ্রহণ করেন না। ইসলামী রাষ্ট্রের সিভিল সার্ভিসের জন্য নির্দিষ্ট বেতনের সাথে বর্তমান কালের কিংবা সেকালের সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রসমূহের অনুরূপ কাজের বেতনের হারের তুলনা করলে ইসলামের বিশ্বজয় এবং সাম্রাজ্যবাদের রাজ্যগ্রাসের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। ইসলামী রাষ্ট্রে খোরাসান, ইরাক ও মিশরের শাসনকর্তাদের বেতন একালের সাধারণ পুলিশ ইন্সপেক্টরের বেতন অপেক্ষা অনেক কম ছিলো। প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা) মাসিক মাত্র একশত টাকা বেতনে এতবড় রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন করতেন। হযরত উমর ফারুক (রা)-এর বেতন মাসিক দেড়শত টাকার অধিক ছিলো না। অথচ তখন ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমাল তদানীন্তন দু’টি রাষ্ট্রের ধন সম্পদে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। সম্রাজ্যবাদ দেশ জয় করে এবং ইসলামও দেশ জয় করে, কিন্তু উভয়ের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য রয়েছে। কবির ভাষায়ঃ
“যদিও উভয়ে উড়ে একই শূন্যলোক
শকুন ও বাজের রাজ্যে বহু ব্যবধান।”
বস্তুত এটাই হচ্ছে ইসলামী জিহাদের মুল কথা। অথচ এটার সম্পর্কে কতোই না বিরূপ কথাবার্তা আকাশ বাতাস মথিত করে তুলেছে। কিন্তু ইসলাম, মুসলিম দল এবং জিহাদের এ নির্মল ধারণা বর্তমান সময়ে কোথায় লুকিয়ে রয়েছে তা জিজ্ঞেস করলে এবং বর্তমান পৃথিবীর মুসলমানদের মধ্যে তার একবিন্দু পরিমাণ লক্ষণ না থাকার কারণ জানতে চাইলে, আমিই বলবো এ প্রশ্ন আমার নিকট কেন করা হচ্ছে? যারা মুসলিম জাতির দৃষ্টি তার আসল কাজ হতে ফিরায়ে তা’বীয, তুমার, মুশাহিদা ও মোরাকিবার কৃচ্ছ্রসাধনার দিকে আকৃষ্ট করেছে, যারা পারলৌকিক মুক্তি এবং ইহলৌকিক কল্যাণ ও উদ্দেশ্য লাভের অতি সহজ ও সংক্ষিপ্ত পথ দেখিয়েছে, এ প্রশ্ন আজ তাদেরকে জিজ্ঞেস করা উচিত। কারণ তারাই তো বলেছে যে, চেষ্টা-সাধনা ও সংগ্রাম ব্যতীত শুধু তাসবীহ পাঠ কিংবা কবরস্থ কোনো ‘বড়পীর’ সাহেবের অনুগ্রহ হলেই দুনিয়ার সবকিছুই করায়ত্ত হতে পারে। তারাই তো ইসলামের মূল ও বুনিয়াদী নীতি আদর্শ এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে বিস্মৃতির অন্ধকারে নিক্ষেপ করেছে। সশব্দে কি নিঃশব্দে ‘আমীন’ বলা ‘রাফয়ে ইয়াদাইন’ করা এবং ইসালে সওয়াব ও যিয়ারতের ন্যায় নিতান্ত খুঁটিনাটি ও অপ্রয়োজনীয় ব্যাপারে মুসলিম জাতিকে বিজড়িত করেছে। ফলে মুসলিম জাতি আত্মবিস্মৃত হয়েছে, বিস্মৃত হয়েছে ইসলামের মূল কথাকে, ভুলিয়েছে নিজের মূল উদ্দেশ্য-লক্ষ্যকে। তাদের দিক হতেও যদি সঠিক উত্তর না পাওয়া যায়, তবে এ প্রশ্ন দেশের তথাকথিত নেতৃবৃন্দ ও শাসনকর্তাদের নিকটেই পেশ করে দেখুন। কারণ তারা কুরআন মজীদ ও হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর প্রতি ঈমান আনার দাবি করে বটে, কিন্তু কুরআনের আইন অনুযায়ী জীবন যাপন ও রাষ্ট্র পরিচালনার কোনো কর্তব্যই তারা পালন করে না, যদিও কখনও কুরআন ‘খতম’ করানো ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে সভার অনুষ্ঠান করা এবং কুরআনের সাহিত্যের গুণ-গান করার কিছু না কিছু কাজ তারা নিশ্চয়ই করে। মনে হয় কুরআনের আইন ও হযরতের বিধানকে কার্যত জারি করা সম্পর্কে এদের যেনো কোনো দায়িত্ব নেই। এটার মূল কারণ এই যে, তাদের ‘নফস’ ইসলামের বিধি-নিষেধ মেনে চলতে এবং তার দায়িত্ব পালন করতে আদৌ প্রস্তুত নয়, বরং একান্ত সহজভাবেই মুক্তি লাভ করতে চায়।
0 comments: