এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে ইসলাম কর্তৃক উপস্থাপিত সমাজ ব্যবস্থার বিস্তারিত আলোচনার অবতারণা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, সময়-সুযোগ হলে অন্যত্র তার চেষ্টা করা হবে। এখানে নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুর মধ্যে থেকে আমি বিশেষভাবে যে কথা বলতে চাই তা এই যে, ইসলাম নিছক একটি ধর্মবিশ্বাস এবং কতকগুলো ইবাদাত অনুষ্ঠানের সমষ্টিমাত্র নয়। মূলত ইসলাম এক পরিপূর্ণ ও ব্যাপক জীবন ব্যবস্থা। বিশ্ববাসীর জীবনক্ষেত্র হতে সকল প্রকার অত্যাচার ও বিপর্যয়মূলক নিয়ম-নীতি মুলোৎপাট করে তদস্থলে এক পূর্ণাঙ্গ সংস্কারমূলক কর্মসূচী বাস্তবায়িত করাই এর একমাত্র লক্ষ্য। কারণ মানবতার কল্যাণ ও মংগল বিধানের জন্য তার দৃষ্টিতে এটাই হচ্ছে সর্বোত্তম ব্যবস্থা।
এই ভাঙ্গাগড়া এবং বিপ্লব ও সংশোধনের জন্য ইসলাম বিশেষ কোনো জাতিকে আহবান জানায় না। ইহার ডাক হচ্ছে সমগ্র মানবতার প্রতি গোটা মানবজাতি এমন কি স্বয়ং যালেম, শোষক ও দূর্নীতিপরায়ণ জাতি ও শ্রেণীসমূহের প্রতি রাজা, বাদশাহ, সমাজপতি ও নেতৃবৃন্দকে ইসলাম এই বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণের আহবান জানায় আর সকলের প্রতিই ইহার পয়গাম এই যে, সৃষ্টিকর্তার নির্ধারিত সীমার মধ্যেই জীবনযাপন ও যাবতীয় কার্য সম্পাদন কর, তোমরা সত্য ও সুবিচারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই তোমাদের জীবনে সর্বাংগীন শান্তি ও নিরাপত্তা সূচিত হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো মানুষের সাথে ইসলামের শত্রুতা নেই, শত্রুতা যুলুমের সাথে, বিপর্যয় ও বিশৃংখলার সাথে, নৈতিকতা বিরোধী কার্যকলাপের সাথে, আর আল্লাহর নির্ধারিত স্বাভাবিক ব্যবস্থা অনুযায়ী যা একজনের প্রাপ্য নয় তা লাভ করার জন্য কেউ চেষ্টা করলে তার সাথে শত্রুতা রয়েছে।
এ আহবান যারাই গ্রহণ করবে তারা যে কোনো জাতির, বংশের, শ্রেণীর বা দেশেরই লোক হোক না কেন, তারা সকলেই সমান অধিকার ও সমান মর্যাদার ভিত্তিতে ইসলামী দল ও সমাজের সদস্যরূপে গণ্য হবে এবং এরূপে এরাই সেই আন্তর্জাতিক বিপ্লবী দলে রূপান্তরিত হংবে, যাকে কুরআন মজীদ ‘আল্লাহর দল’ নামে অভিহিত করেছে এবং যার অন্য নাম হচ্ছে ইসলামী দল কিংবা মুসলিম উম্মাত।
এই দলটি অস্তিত্ব লাভ করেই স্বীয় উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য জিহাদ শুরু করে দেয়। এই দলের বর্তমান থাকাই অনৈসলামিক রাষ্ট্রব্যবস্থা চূর্ণ করা এবং ইহার পরিবর্তে এক সুবিচারপূর্ণ ও ভারসাম্যযুক্ত রাষ্ট্রব্যবস্থা- কুরআন যাকে ‘কালেমাতুল্লাহ’ বলেছে- প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা শুরু করা অপরিহার্য সাব্যস্ত করে। এই দল যদি রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন এবং ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা না করে, তবে এর অস্তিত্ব লাভের মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যায়। কারণ ইহার অন্য কোনো উদ্দেশ্য তো আদৌ ছিলো না। আর উহার অস্তিত্ব টিকে রাখার জন্য এই জিহাদ ভিন্ন অন্য কোনো পন্থাই থাকতে পারে না। কুরআনের ভাষায় এই দলে অস্তিত্ব লাভের একটি মাত্র উদ্দেশ্যই রয়েছে এবং তা এইঃ
كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللّهِ
‘তোমরা সেই সর্বোত্তম জাতি, বিশ্বমানবতার কল্যাণ সাধনের জন্যই তোমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা সৎ ও ন্যায় কাজের জন্যই লোকদেরকে নির্দেশ দাও। আর অন্যায়, পাপ, মিথ্যা প্রভৃতি নিষিদ্ধ কাজ হতে তাদের বিরত রাখ এবং আল্লাহর প্রতি তোমরা আস্থা জ্ঞাপন কর।’ (সূরা আলে-ইমরানঃ ১১০)
বস্তুত ইহা কোনো ধর্ম প্রচারক (preachers) ও সুসংবাদ বাহকের (missionaries) দল নয়। মূলত ইহা আল্লাহর সৈন্য বাহিনী মাত্র ;
لتكونوا شهداء على الناس পৃথিবী হতে যুলুম, শোষণ, অশান্তি, চরিত্রহীনতা ও বিপর্যয় এবং সকল প্রকার আল্লাহদ্রোহিতাকে বলপূর্বক নির্মূল করাই তার কতর্ব্য ارباب من دون الله আল্লাহকে বাদ দিয়ে যারা মানুষের রব হয়ে বসেছে, তাদের খোদায়ী প্রভুত্ব চূর্ণ করা এবং অন্যায় ও পাপ বন্ধ করে পুণ্য ও ন্যায়ের প্রচলন করা এ ইসলামী দলের দায়িত্ব। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ
قاتلوا هم حتى لاتكون فتنة ويكون الدين لله
‘তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করো, যতোদিন না অশান্তি ও বিপর্যয় চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় এবং মানুষ একমাত্র আল্লাহরই আনুগত্য করার সুযোগ লাভ করে।’
الا تفعلوه تكن فتنة فى الارض وفساد كبير.
‘তোমরা যদি এ দায়িত্ব পালন না করো তবে সারা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে, ধ্বংস এবং ভাঙ্গন ব্যাপক ও মারাত্মক আকার ধারণ করবে।’
هو الذى ارسل رسوله بالهدى ودين الحق ليظهره على الدين كله ولوكره المشركون . الصف
‘আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসূলকে জীবন যাপনের সঠিক পন্থা এবং সত্য অনুসরণের নির্ভুল ব্যবস্থাসহ প্রেরণ করেছেন, যেন তিনি প্রচলিত সকল প্রকার আনুগত্য অনুসরণ চূর্ণ করে দিয়ে সত্য অনুসরণের এই ব্যবস্থাকে সকলের উপর জয়ী করেন। যদিও আল্লাহর কর্তৃত্বের ব্যাপারে ইহা অংশীবাদীগণ মোটেই পছন্দ করে না।’
অতএব রাষ্ট্রযন্ত্র দখল করা ছাড়া এ দলের জন্য অন্য কোনো উপায় থাকতে পারে না। কারণ বিপর্যয়মূলক সমাজ ব্যবস্থা আসলে একটি ভারমাস্যহীন রাষ্ট্রব্যবস্থার সমর্থন ও সহযোগিতার ফলেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। পক্ষান্তরে কোনো সুস্থ, নির্ভুল ও কল্যাণময় সমাজ ব্যবস্থাই কায়েম হতে পারে না, যতোক্ষণ না রাষ্ট্রব্যবস্থা বিপর্যয়কারীদের হাত হতে সত্যাশ্রয়ী ও সংস্কারবাদীদের হাতে ন্যস্ত হবে।
বিশ্ব সংস্কারের কথা বাদ দিলেও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা বিপরীত আদর্শবাদীদের কুক্ষিগত থাকবে। এ দলের পক্ষে নিজের ব্যক্তিগত আদর্শ অনুযায়ী জীবন যাপন করাও আদৌ সম্ভব নয়। একটি দল যে ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো জীবন ব্যবস্থাকে সত্য ও কল্যাণকর বলে মনে করে সেই ক্ষেত্রে কোনো বিপরীত ধরণের রাষ্ট্রব্যবস্থার অধীন নিজেদের আদর্শ অনুযায়ী কিছুতেই জীবন যাপন করতে পারে না। ইংল্যান্ড কিংবা আমেরিকায় থেকে কোনো কমিউনিষ্টের পক্ষে কমিউনিজমের পূর্ণ আদর্শ অনুযায়ী জীবন যাপন করা কিছুতেই সম্ভব নয়। কারণ রাষ্ট্রশক্তির প্রবল চাপে সেখানকার পুঁজিবাদী জীবনব্যবস্থা স্বতই তার উপর কার্যকর হবে। উহার এই দুর্নিবার চাপ হতে আত্মরক্ষা করা তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হবে না। অনুরূপভাবে একজন মুসলমানও অনৈসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার অধীনে থেকে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা অনুযায়ী জীবন যাপন করতে চাইলে কিছুতেই সাফল্যমন্ডিত হতে পারে না। যেসব আইন বিধানকে সে বাতিল মনে করে, যেসব কাজ-কর্মকে সে অন্যায় ও অসংগত বলে ধারণা করে, যে ধরনের আচার-আচরণ ও জীবন পদ্ধতিকে সে বিপর্যয়মূলক মনে করে, যে ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি তার দৃষ্টিতে মারাত্মক ইহার প্রত্যেকটি এবং সব ক’টিই তার নিজের ঘর-বাড়ি ও সন্তান-সন্ততির উপর প্রবলভাবে প্রভাব বিস্তার করতে থাকবে। ইহার আক্রমণ হতে সে কিছুতেই রক্ষা পাবে না। কাজেই বিশেষ কোনো আদর্শ ও আকীদায় বিশ্বাসী লোকেরা স্বভাবত বিরোধী আদর্শের শাসন নির্মূল করে তাদের নিজেদের আদর্শ রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় যত্নবান হতে বাধ্য। তা না করলে তারা নিজেদের আদর্শ অনুযায়ী জীবন যাপন করার কোনো সুযোগ পাবে না। এ চেষ্টা না করলে কিংবা এতে অবজ্ঞা ও উপেক্ষা পরিলক্ষিত হলে নিশ্চিতরূপে মনে করতে হবে যে, মূলত কোনো আদর্শের প্রতিই তাদের বিশ্বাস নেই। বিশ্বাসের দাবি করলেও তা যে মিথ্যা তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।
عَفَا اللّهُ عَنكَ لِمَ أَذِنتَ لَهُمْ حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكَ الَّذِينَ صَدَقُواْ وَتَعْلَمَ الْكَاذِبِينَ - لاَ يَسْتَأْذِنُكَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ أَن يُجَاهِدُواْ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ ............ - إِنَّمَا يَسْتَأْذِنُكَ الَّذِينَ لاَ يُؤْمِنُونَ بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ
‘হে নবী! আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন। তুমি লোকদেরকে জিহাদে অংশগ্রহণ করতে বিরত থাকার কেন অনুমতি দিলে? তোমার অনুমতি দেওয়া সমীচীন ছিলো না। জিহাদই এমন একটি মাপকাঠি যা দ্বারা তোমাদের খাঁটি ঈমানদার এবং মিথ্যা ঈমানদারদের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য প্রমাণিত হতে পারে। বস্তুত যারা আল্লাহ এবং পরকাল বিশ্বাস করে, জান ও মাল দ্বারা জিহাদ করার দায়িত্ব হতে নিষ্কৃতি লাভের জন্য তারা কখনো তোমার নিকট আবেদন করতে পারে না। .............. অবশ্য যারা না আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, না পরকালের প্রতি, একমাত্র তাহারাই এই জিহাদের কতর্বø হতে বিরত থাকার আবেদন পেশ করতে পারে, অন্য কেহ নয়।’ (সূরা আত-তাওবাঃ ৩৪-৩৫)
এ আয়াতে কুরআন মজীদ সুস্পষ্ট ও অকুণ্ঠ ভাষায় এই নির্দেশ দিয়েছে যে, কোনো দল যে আদর্শ ও মতবাদের প্রতি ঈমান ও আস্থা এনেছে তাকে রাষ্ট্রক্ষমতার সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য জান ও মালসহ জিহাদে আত্মনিয়োগ করা হচ্ছে তাদের উহার প্রতি সত্যিকার ঈমানদার হওয়ার একমাত্র মাপকাঠি। বিরোধী আদর্শের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে যদি কেও সহ্য করে, তবে তার আদর্শে বিশ্বাস যে সম্পূর্ণ মিথ্যা তাতে কোনোরূপ সন্দেহ থাকতে পারে না। এরা স্বাভাবিক পরিণতি এই যে, শেষ পর্যন্ত ইসলামী আদর্শের প্রতি নামকা ওয়াস্তে বিশ্বাসটুকুও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। প্রথম দিকে বিরোধী আদর্শের সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সে অত্যন্ত ঘৃণা সহকারেই বরদাশত করতে থাকবে। কিন্তু ধীরে ধীরে মন ইহার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়বে। ফলে ঘৃণা শেষ পর্যন্ত ঐকান্তিক আগ্রহে পরিণত হবে ও সেই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং প্রতিষ্ঠিত রাখার ব্যাপারে সে সাহায্য করতে থাকবে। ইসলামী আদর্শের পরিবর্তে অনৈসলামী আদর্শের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য জান-মাল দ্বারা সে জিহাদ শুরু করবে। এভাবে মুসলমানদেরই শক্তি-ক্ষমতা ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কাজেই ব্যবহৃত হবে। আর এই চরম পর্যায়ে উপনীত হওয়ার পর এ মুসলমান এবং কাফেরদের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোনো পার্থক্যই থাকবে না। অবশ্য তখনো হয়তো মুসলিমদের মুখে ইসলামের মুনাফেকী দাবি একটি নিকৃষ্টতম মিথ্যা ও প্রচারণার শ্লোগান হিসাবে বর্তমান থাকবে। হযরত নবী করীম (সা) এ পরিণামের কথাই স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেনঃ
والذى نفسى بيده لتامرن بالمعروف ولتنهن عن المنكر والتاخذن يد المسئ ولتطرنه على الحق اطراء وليضر بن الله قلوب بعضكم على بعض او ليلعنكم كما لعنهم .
‘যে আল্লাহর মুষ্টিতে আমার জীবন তাঁর শপথ করে বলছি, তোমাদেরকে সৎ ও ন্যায় কাজ করতে হবে, অন্যায় ও পাপ কাজ হতে লোকদের বিরত রাখতে হবে এবং পাপী ও অন্যায়কারীর হস্ত ধারণ করে শক্তি প্রয়োগ করে, তাকে সত্যের দিকে ফিরায়ে দিতে হবে অন্যথায় আল্লাহর স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী পাপী ও বদকারের প্রভাব তোমাদের মনের উপর এবং শেষ পর্যন্ত তোমরাও তাদের ন্যায় অভিশপ্ত হবে।’
0 comments: