ইসলামী ব্যাংক : ইসলামী ব্যাংকিং বাংলাদেশের মানুষের কাছে এখন খুবই পরিচিত একটি নাম।
দুনিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এই দেশ। আমাদের দেশে ইসলামী ব্যাংকিং দ্রুততার সাথে বিকাশ লাভ করছে এবং এর প্রভাব এ দেশের অর্থনীতিতে চমক সৃষ্টি করেছে। তাই এই ব্যাংকিং নিয়ে দেশের মানুষের প্রচন্ড আগ্রহ রয়েছে। তবে অনেকেই ইসলামী ব্যাংকিংয়ের উৎপত্তি, ইতিহাস ও বিকাশ নিয়ে জানতে চায়। এই প্রবন্ধে ইসলামী ব্যাংক সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করা হয়েছে, যাতে মানুষ ইসলামী ব্যাংকিং, বিশেষ করে বাংলাদেশে এর অবস্থান ও বিকাশ নিয়ে খানিকটা ধারণা লাভ করতে পারে। প্রথমেই আমরা ইসলামী ব্যাংক কি তা বুঝার চেষ্টা করি। এর জন্য ব্যাংকের দু'একটি সংজ্ঞা পেশ করা যেতে পারে, যার মধ্য দিয়ে ইসলামী ব্যাংকিং কি তা বুঝা সহজ হবে।
মালয়েশিয়ার ইসলামী ব্যাংকিং অ্যাক্টে ইসলামী ব্যাংকের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘ইসলামী ব্যাংকিং এমন এক ধরনের ব্যবসা, যার লক্ষ্য ও কর্মকান্ডের কোথাও এমন কোনো উপাদান নেই, যা ইসলাম অনুমোদন করে না।'
ইসলামী সম্মেলন সংস্থাও (ওআইসির) ইসলামী ব্যাংকের একটি সর্বসম্মত সংজ্ঞা প্রদান করেছে। ওআইসি-এর সংজ্ঞাটি নিম্নরূপ:
Islami Bank is a financial institution whose statutes, rules and procedures expressly state its commitment to the principles of Islamic Sharia and to the banning of the receipt and payment of interest on any of its operations. অর্থাৎ ইসলামী ব্যাংক এমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যা তার মৌলিক বিধান ও কর্মপদ্ধতির সকল স্তরে ইসলামী শরীয়াতের নীতিমালা মেনে চলতে বদ্ধপরিকর এবং কর্মকান্ডের সকল পর্যায়ে সুদ বর্জন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।'
তা ছাড়া ইসলামী ব্যাংকগুলোর আন্তর্জাতিক সংস্থা International Association of Islami Banks ইসলামী ব্যাংকের যে সংজ্ঞা দিয়েছে তা হল, The Islamic bank basically implements a new banking concept, in that it adheres strictly to the ruling of the Islamic Shariah in the fields of finance and other dealings. Moreover, the bank which is functioning in this way must reflect Islamic principles in real life. The bank should work towards the establishment of an Islamic society; hence, one of its primary goals is the deepening of the religious spirit among the people. অর্থাৎ ইসলামী ব্যাংক মূলত একটি নতুন ব্যাংকিং ধারণাকে বাস্তবে রূপ দেয়, যাতে তা ফাইনান্স এবং অন্যান্য কার্যক্রমের ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়াতের বিধিবিধান কঠোরভাবে মেনে চলে। অধিকন্ত, ইসলামী ব্যাংক এভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে বাস্তব জীবনে ইসলামী বিধিবিধানকে অবশ্যই প্রতিবিম্বিত করবে। ব্যাংককে একটি ইসলামী সমাজ বিনির্মাণ করার লক্ষ্যে কাজ করা উচিত এবং সে জন্য এর অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য হল জনগণের মধ্যে ধর্মীয় চেতনা গভীরভাবে প্রোথিত করা।
ইসলামী ব্যাংকের বৈশিষ্ট্য : ইসলামী ব্যাংক তার লেনদেন ও বিনিয়োগসহ সব ধরনের কার্যক্রমে প্রচলিত ব্যাংকের চাইতে আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে কাজ করছে। ইসলামী ব্যাংক তার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও নীতিমালার দিক দিয়ে অন্যান্য ব্যাংক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইসলামী ব্যাংকের সংজ্ঞা থেকে আমরা এর বৈশিষ্ট্যগুলো সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে দেখি। ইসলামী ব্যাংকের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ :
১. আদর্শভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান : ইসলামী ব্যাংক ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়নে নিয়োজিত একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ইসলামী অর্থব্যবস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণে ইসলামী ব্যাংক বদ্ধপরিকর। শরীয়াতের বিধিবিধানকে মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আর্থিক লেনদেন পরিচালনা করা ইসলামী ব্যাংকের প্রধান লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনে ইসলামী ব্যাংক আল-ওয়াদিয়াহ ও মুদারাবা পদ্ধতিতে মানুষের কাছ থেকে টাকা জমা নেয়। এ ছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে শরীয়াহ অনুমোদিত ব্যবসায় ব্যাংক তার অর্থ বিনিয়োগ করে।
২. ইসলামী ব্যাংক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান : বিভিন্ন ব্যবসার সাথে ইসলামী ব্যাংক জড়িত। এ প্রতিষ্ঠান শিল্প-বাণিজ্য ও অন্যান্য ব্যবসায় অর্থ বিনিয়োগ করে এবং লাভ-লোকসানে অংশগ্রহণ করে। এটি শুধু লাভই হিসাব করে না, লোকসানের ঝুঁকিও বহন করে।
৩. ইসলামী ব্যাংক শরীয়াতের অনুগত : ইসলামী ব্যাংক শরীয়াতের নির্দেশাবলি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর। ব্যাংকের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, কার্যবিধি ও কর্মপদ্ধতিতে ব্যাংক সম্পূর্ণরূপে ইসলামী শরীয়াহর অনুসারী। কর্মচারী পরিচালনা, জমাগ্রহণ, বিনিয়োগ ও পরামর্শ প্রদানসহ কার্যক্রমের সকল ক্ষেত্রেই ব্যাংক শরীয়াহর বিধি-নিষেধের প্রতি খেয়াল রাখে। শরীয়াহর নীতির বাইরে ইসলামী ব্যাংক তার জমা গ্রহণ ও বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করে না।
৪. সুদবিহীন ব্যাংকিং : সুদ সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে চলা ইসলামী ব্যাংকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইসলামী ব্যাংক তার কর্মকান্ডের কোন পর্যায়েই সুদ গ্রহণ বা প্রদান করে না। ব্যাংকের যাবতীয় কার্যক্রম সুদ থেকে মুক্ত।
৫. ইসলামী ব্যাংক পণ্যের ব্যবসা করে : ইসলাম ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল এবং সুদকে হারাম মেনে তার কর্মকান্ড পরিচালনা করে। এ জন্য ব্যাংকের রয়েছে অনেকগুলো বেচাকেনা পদ্ধতি। বাই-মুয়াজ্জাল,বাই-মুরাবাহা, বাই-সালাম, বাই-ইসতিসনা ও বাই আস-সর্ফ প্রভৃতি পদ্ধতিতে ব্যাংক গ্রাহকের সাথে বেচাকেনায় অংশ নেয়। ব্যাংক অর্থের বিনিময়ে দ্রব্যসামগ্রী ও সেবা ক্রয় করে এবং তা অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করে। এ ক্রয়-বিক্রয় থেকে যে উদ্ধৃত্ত তা ব্যাংকের মুনাফা হিসেবে আসে।
৬. সুদ নির্মূল করে ইসলামী ব্যাংক : ব্যাংক তার কার্যক্রমে কখনই সুদ গ্রহণ করেনা। সুদ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থেকে ইসলামী ব্যাংক তার যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে। সুদের অভিশাপ থেকে মানুষ ও সমাজকে বাঁচাবার প্রধান কাজটি করে ইসলামী ব্যাংক। সুদহীন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইসলামী ব্যাংকের খ্যাতি আজ বিশ্বময়।
৭. ইসলামী ব্যাংক মুদ্রাস্ফীতি দূর করে : মুদ্রাস্ফীতি আধুনিক প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বড় প্রতিবন্ধক। এ মুদ্রাস্ফীতি সব অর্থনৈতিক বিশৃংখলার জন্য দায়ী। অথচ ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল মুদ্রামানের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। যেসব কারণে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়, যেমন: অর্থের বৃদ্ধির বা সরবরাহ বৃদ্ধির সাথে উৎপাদন প্রক্রিয়ার সমতা না থাকা, অনুৎপাদনশীল ও অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় বৃদ্ধি ঘটানো, এবং সরকারের ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি, এসবের কোনটাই ইসলামী অর্থনীতির বেলায় ঘটতে পারেনা। ইসলামী ব্যাংক সরাসরি উৎপাদনশীল খাতে এবং পণ্যে বিনিয়োগ করায় উৎপাদনশীলতা ঠিক থাকে। ফলে অপ্রয়োজনীয় খাতেও ব্যাংকের বিনিয়োগ ধাবিত হওয়ার সুযোগ থাকে না। শুধু শুধু অর্থকে বাজারে ছেড়ে দেয়া বা প্রয়োজনের বাইরে অর্থের সরবরাহ বাড়ানোর কোন সুযোগ ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় নেই। তাই মুদ্রাস্ফীতি ঘটার মত অবস্থা এখানে তৈরি হয় না।
৮. কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বেকারত্ব দূর করে ব্যাংক : ইসলামী ব্যাংকের প্রতিটি বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু ও উৎপাদনশীল কার্যক্রমের সাথে যুক্ত। ফলে এখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় অনায়াসে। ইসলামী ব্যাংক তার সম্পদ গুটিকতেক সম্পদশালী মানুষের কাছে জমা হতে দেয় না। ইসলামী বিধানের লক্ষ্যই হচ্ছে সম্পদকে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া এবং সমাজে একটা বৈষম্যহীন অবস্থার সৃষ্টি করা। ফলে স্বল্পবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের কাছেও ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ সম্প্রসারিত হয়। এতে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়। পরিণামে বেকারত্বের যে অভিশাপ তা থেকেও সমাজ অনেকটা মুক্ত হয়।
৯. ইসলামী ব্যাংক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটায় : আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটিয়ে একটি স্থিতিশীল ও কার্যকর সমাজকাঠামো বিনির্মাণে ইসলামী ব্যাংকের তুলনা হয় না। ইসলামী ব্যাংকের নানাবিধ কার্যক্রম এ আর্থিক ও সামাজিক উন্নতিকে নিশ্চিত করে। ইসলামী ব্যাংক সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের কাছ থেকে সঞ্চয় সংগ্রহ করে তার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিনিয়োগ প্রদান করে। ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রমে ন্যায় ও সততার বিধান চালু থাকায় সবার অগ্রগতি সাধিত হয়। ইসলামী ব্যাংক তার সম্পদ সুসম ও ন্যায়পূর্ণ বন্টনের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নতিকে ত্বরান্বিত করে।
১০. জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমকে উৎসাহিত করে : ব্যাংক তার অর্থ বিনিয়োগকালে সমাজের প্রয়োজনের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখে, বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ প্রয়োজনে বিনা লাভে ঋণ প্রদান করে থাকে। ব্যক্তিগত বা জনকল্যাণমূলক এ বিশেষ ঋণ ‘কর্জে হাসানা' বা ‘কল্যাণকর ঋণ' নামে পরিচিত। ইসলামী ব্যাংকে কর্জে হাসান ছাড়া অন্য কোনো ঋণের ব্যবস্থা নেই। আর্ত-মানবতার সেবা এবং বঞ্চিত ও অভাবী মানুষের কষ্ট লাঘবে কর্পোরেট সোস্যাল রেসপনসিবিলিটি কর্মসূচির আওতায় ইসলামী ব্যাংক ব্যাপক জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে।
১১. যাকাত ফান্ড গঠন : ইসলামী ব্যাংকের নিজস্ব যাকাত তহবিল রয়েছে। ব্যাংক তার অর্থ-সম্পদ ও আয়ের ওপর প্রদেয় যাকাত উক্ত তহবিলে জমা করে এবং এর অর্থ শরীয়াহ নির্ধারিত পন্থায় ব্যয় করে। উক্ত তহবিলে ব্যাংকের গ্রাহক ও জনগণের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত যাকাতও গৃহীত হয়। যাকাত ফান্ড গঠন ও এর সাহায্যে সমাজের দারিদ্র্যবিমোচন কার্যক্রম পরিচালনা ইসলামী ব্যাংকের অনুপম একটি বৈশিষ্ট্য।
নিচে ইসলামী ব্যাংক ও অন্যান্য প্রচলিত ব্যাংকের একটি তুলনা পেশ করা হলো-
ইসলামী ব্যাংক ও প্রচলিত ব্যাংকের তফাত :
ইসলামী ব্যাংক - প্রচলিত ব্যাংক
১ শরীয়াহর বিধি মোতাবেক পরিচালিত। শরীয়াহর নীতি মানার দরকার নেই।
২ সুদ নির্মূল করতে বদ্ধপরিকর। সুদী কারবারের ওপর পরিপূর্ণ নির্ভরশীল।
৩ অর্থ হালাল বা বৈধ ব্যবসায় বিনিয়োগ অপরিহার্য। অর্থে ঋণে হালাল-হারামের বালাই নেই।
৪ গ্রাহক ও ব্যাংকের সম্পর্ক অংশীদারীত্ব ও বিনিয়োগকারীর। গ্রাহক ও ব্যাংকের মধ্যে সম্পর্ক হচ্ছে ঋণগ্রহীতা ও ঋণদাতার।
৫ আমানতকারী বিনিয়োগের ঝুঁকি বহন করে। আমানতকারী ঋণ ঝুঁকি বহন করেনা।
৬ অর্থকে পণ্য বিবেচনা করেনা। অর্থের সাহায্যে ব্যবসা করে। ব্যাংক অর্থের ব্যবসা করে।
৭ এ ব্যবস্থা কল্যাণমুখী। এ ব্যবস্থায় যুলুম ও শোষণের জন্ম হয়।
৮ সকল কার্যক্রম শরীয়াহ মোতাবেক পরিচালিত। এসব ব্যাংকের কার্যক্রমে শরীয়াহ মানার ইচ্ছা ও ব্যবস্থা নেই।
৯ ব্যাংক তার সম্পদের ওপর যাকাত দেয় যাকাতের ধারনণর অস্তিত্ব নেই।
১০ এখানে বৈদেশিক মুদ্রার তাৎক্ষণিক লেনদেন বা ক্রয়-বিক্রয় হয়।অগ্রিম ক্রয়-বিক্রয় হয় না। বৈদেশিক মুদ্রার তাৎক্ষণিক বা অগ্রিম ক্রয়-বিক্রয়ে কোন বাধা নেই।
১১ খেলাপি বিনিয়োগ গ্রাহক থেকে অতিরিক্ত মুনাফা আদায় করা যায় না। খেলাপি ঋণগ্রহীতা গ্রাহক থেকে অতিরিক্ত সুদ আদায় করা যায় হয়।
১২ সুদের ভিত্তিতে কলমানির লেনদেন ইসলামী ব্যাংকে নিষিদ্ধ। কড়াসুদে কলমানির লেনদেন এসব ব্যাংকে অহরহ ঘটে।
ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রেক্ষাপট : গোটা বিশ্ব যখন সুদনির্ভর অর্থনীতির অক্টোপাশে জর্জরিত, তার পাশাপাশি একটি কল্যাণকামী অর্থব্যবস্থা হিসেবে ইসলামী অর্থনীতি আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। ফলে ইসলামী অর্থনীতিও মানুষের প্রয়োজন মেটাতে যে কোন অর্থনীতির তুলনায় অধিকতর পরিপূর্ণ ও কল্যাণকামী। আমরা জানি, অর্থনৈতিক ধারণার কার্যকর ও প্রায়োগিক রূপ হচ্ছে ব্যাংকিং। ফলে ইসলামী ব্যাংকিং ইসলামী অর্থনীতির একটি প্রায়োগিক প্রতিষ্ঠান। সাম্প্রতিককালে সারা বিশ্বে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রসার ও কল্যাণকামীতা ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। অমুসলিম দেশসহ বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশে ইসলামী ব্যাংকিংব্যবস্থা ইতোমধ্যেই চালু হয়েছে। তাই আধুনিক অর্থনীতিবিদদের অনেকেই ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রসার দেখে চমককৃত হচ্ছেন। আধুনিক বিশ্বে ইসলামী ব্যাংকিংপদ্ধতি এখন কোন তত্ত্বকথা নয়, বরং পরম বাস্তবতায় সমুজ্জ্বল। শুধু তাই নয়, একটি সঠিক অর্থব্যবস্থা হিসেবে ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং সময়ের প্রতিকূল পরিবেশ অতিক্রম করতে সক্ষম। ২০০৮-২০০৯ সালব্যাপী গোটা বিশ্বে যখন আধুনিক সুদী ব্যাংকগুলো একের পর এক দেউলিয়া হয়ে পড়ছিল, ব্যাংকগুলোকে যখন সরকার নানা প্যাকেজ ও আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে কোন রকমে টিকিয়ে রাখছিল, তখনও কিন্তু ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ওপর কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়েনি। বরং সারা বিশ্বের ইসলামী ব্যাংকগুলো মেরুদন্ড খাড়া করে সামনের দিকে এগিয়ে গেছে বিস্ময়করভাবে।
মহান আল্লাহতাআলার নির্ধারিত বিধানের আওতায় ইসলামী অর্থনৈতিক বিধানের প্রচলন সেই দেড় হাজার বছর আগে থেকে। তবে সভ্যতার বিকাশ ও আধুনিকতার আবেশে দুনিয়ায় ঘটতে থাকে ব্যাপক পরিবর্তন। নানান অর্থনৈতিক মতবাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার আলোকে যুগে যুগে সমাজে গড়ে উঠে ব্যাংকব্যবস্থা। এক সময় ব্যাংকিংব্যবস্থা ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের রূপ পরিগ্রহ করে। এ হিসেবে ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের আধুনিক বিকাশ শুরু হয় মূলত ১৯৬০ সালে। মিসরের মিটগামারে ‘সেভিংস ব্যাংক' নামে বিশ্বের প্রথম আধুনিক ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। মিসরীয় কেন্দ্রীয় শহরে প্রতিষ্ঠিত এ ব্যাংকের রূপকার ছিলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহমদ আল-নাগগার। ব্যাংকটি কায়রোতে অতি দ্রুত সাফল্য অর্জন করে এবং দেশজুড়ে এটির সুখ্যাতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত মিসরে মোট নয়টি ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কিন্তু মিসর সরকারসহ নানা দিক থেকে আসা প্রতিকূল পরিবেশে নতুন এ কল্যাণকামী ব্যাংকিং এগুতে পারেনি। তবে তাতে ব্যাংক প্রতিষ্ঠার তৎপরতা কিন্তু থেমে থাকেনি। ১৯৭২ সালে ‘নাসের সোস্যাল ব্যাংক' নামে একটি ইসলামী ব্যাংক মিসরে আবার কর্মকান্ড শুরু করে। এ সময় ইসলামী বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির লক্ষ্যে পৃথক ব্যাংকব্যবস্থা গড়ে তোলার তাগিদ মুসলিম চিন্তাবিদ ও রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যেও অনুভূত হতে থাকে। ফলে ইসলামী সম্মেলন সংস্থার পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে এটা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। ১৯৭৪ সালে জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে একটি পৃথক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । ওআইসির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৯৭৫ সালের অক্টোবরে ‘ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক' (আইডিবি) প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তারপর ইসলামী বিশ্বের মধ্যে জোরালো ও কার্যকর অর্থনৈতিক যোগসূত্র রচনা, জাতীয় পর্যায় ও আন্তর্জাতিক বিশ্বে অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে ইসলামের নীতি বাস্তবায়ন এবং মুসলিম দেশগুলোর সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত ‘আইডিবি' মুসলিম বিশ্বের দেশে দেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসে। ফলে ১৯৭৫ সালে ‘দুবাই ইসলামী ব্যাংক', ১৯৭৭ সালে কুয়েতে ‘কুয়েত ফাইন্যান্স হাউস', সুদান এবং মিসরে ‘ফয়সাল ইসলামী ব্যাংক' প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৭৮ সালে আরব-আমীরাত ও জর্ডানে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জর্ডান ইসলামিক ব্যাংক ফর ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট'। তারপর ১৯৭৮ সালে পাকিস্তান সরকার দেশের সকল ব্যাংকব্যবস্থা সুদমুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ সরকারও ওআইসির সদস্য হিসেবে এ দেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করতে থাকে। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৮৩ সালের ৩০ মার্চ বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড'। এটি তখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম ইসলামী ব্যাংক।
বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের উদ্ভব ও বিকাশ : ১৯৬৩ সালে মিসরে ‘সেভিংস ব্যাংক' প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিং ধারার যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল, ধীরে ধীরে তার প্রভাব অন্যান্য মুসলিম দেশেও পড়তে থাকে। মুসলিম বিশ্বের ইসলামী চিন্তাবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং রাষ্ট্রপ্রধানরা ইসলামী অর্থনীতির সফল বাস্তবায়ন নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন। এভাবে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক বন্ধন সুদৃঢ়করণের কাজ এগিয়ে চলে। এক্ষেত্রে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে ওআইসি'র পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্মেলনে ‘ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক' প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ইসলামী শরীয়াহমতে মুসলিম ও অমুসলিম দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ‘ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক' (আইডিবি) কাজ শুরু করে। আইডিবি'র প্রচেষ্টায় দেশে দেশে শুরু হয় ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপক তৎপরতা। বাংলাদেশও এ মহান প্রয়াসে এগিয়ে আসে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ইসলামী অর্থনীতির বাস্তবায়ন নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও কর্মতৎপরতা শুরু হয়। এক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘ইসলামী ইকনমিকস রিসার্চ ব্যুরো' গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। ইসলামী অর্থনীতির কল্যাণ ও বাস্তবতা মানুষের সামনে তুলে ধরার লক্ষ্যে ব্যুরো ১৯৭৯ সালের জুলাই মাসে ‘ঢাকা মিলনায়তনে' তিনদিনের এক সেমিনার এবং ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরে ইসলামী ব্যাংকের ওপর একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করে। ১৫ হতে ১৭ ডিসেম্বর তিনদিনের এ সম্মেলন শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দেশী ও বিদেশী গবেষক ও চিন্তাবিদরা প্রবন্ধ পাঠ করেন এবং আলোচনায় অংশ নেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদানীন্তন গভর্নর জনাব নূরুল ইসলাম এ সেমিনার উদ্বোধন করেন। ১৯৮১ সালের মার্চে ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট' ঢাকায় ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ক একটি সেমিনারের আয়োজন করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এ সেমিনার উদ্বোধন করেন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর প্রধান প্রধান ব্যাংকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক, গবেষক ও চিন্তাবিদগণ সেমিনারে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন এবং এতে দেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সুপারিশ পেশ করা হয়। ফলে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি অনুকূল পরিবেশ ধীরে ধীরে তৈরি হতে থাকে। এ সময়ের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কয়েকটি ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করলে বাংলাদেশেও ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার আগ্রহ এবং প্রয়াস জোরদার হতে থাকে। ফলশ্রুতিতে ১৯৮১ সালের ১৩ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সভাপতিত্বে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে অনতিবিলম্বে জেলা সদরের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে ইসলামী ব্যাংকের শাখা খোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু তা পরিশেষে বাস্তবায়িত হয়নি।
এদিকে এ দেশের কিছু সাহসী ব্যবসায়ী ও সমাজহিতৈষী ব্যক্তি ‘মুসলিম বিজনেসম্যান সোসাইটি'-র ব্যানারে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালুর জন্য বেসরকারি পর্যায়ে চেষ্টা চালাতে থাকেন। সরকারি সহযোগিতা ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রচেষ্টার ফলে বাংলাদেশে ১৯৮৩ সালে প্রথম সুদমুক্ত ব্যাংক ‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড' নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশে এ ব্যাংকটি ১৯৮৩ সালের ১২ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে তার ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করে।
ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এদেশের বাইরে বেশ কিছু ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশ এবং ধর্মীয়, সামাজিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা প্রণিধানযোগ্য। এদের মধ্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত সৌদি আরবের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ও ইসলামী সম্মেলন সংস্থার প্রাক্তন সহকারী মহাসচিব মরহুম শেখ ফুয়াদ আবদুল হামিদ আল খতিব, সৌদি আরবের প্রাক্তন বাণিজ্যমন্ত্রী শেখ আহমদ সালেহ জামজুম, কুয়েত ফাইন্যান্স হাউসের চেয়ারম্যান শেখ আহমদ বাজী আল ইয়াসমিন ও রিয়াদের আলরাজী কোম্পানির শেখ সোলায়মান আলরাজীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তা ছাড়া ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, দুবাই ইসলামী ব্যাংক, বাহরাইন ইসলামী ব্যাংকসহ আরো অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় সরাসরি ভূমিকা পালন করায় এদেশের মুসলিম জনগণের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ও ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটে। ১৯৮৩ সালে যে ব্যাংক পথচলা শুরু করেছিল, সেই ‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড' এখন এদেশে ব্যাংকিং ব্যবসায় বেসরকারি ক্ষেত্রে অদ্বিতীয় একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের প্রতি ব্যাপক মানুষের অকুণ্ঠ আস্থা ও আগ্রহের ফলে ইতোমধ্যেই এ দেশে আরো ছয়টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। ব্যাংকগুলো হল- ১) আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, ২) সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, ৩) শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, ৪) ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, ৫) আইসিবি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ৬) এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। তা ছাড়া আরো বেশ কয়েকটি ব্যাংক আলাদা ইসলামী ব্যাংকিং শাখা খুলে ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এগুলো হল ১. প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড, ২. ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড, ৩. যমুনা ব্যাংক লিমিটেড, ৪. দি সিটি ব্যাংক লিমিটেড, ৫. সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেড, ৬. প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড, ৭. আরব-বাংলাদেশ ব্যাংক লিমিটেড, ৮. পূবালী ব্যাংক লিমিটেড, ৯. সোনালী ব্যাংক লিমিটেড। বিদেশী ব্যাংকের মধ্যে যারা ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ে কাজ করছে সেগুলো হচ্ছে- ১. শামিল ব্যাংক (সাবেক ফয়সাল ইসলামিক ব্যাংক অব বাহরাইন), ২. দি হংকং এন্ড সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন লিমিটেড, ৩. স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। এখন আলোচনা চলছে অবশিষ্ট সরকারি ব্যাংকগুলোতেও ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার আদলে শাখা বা উইনডো খোলার। আশা করা যাচ্ছে, ইসলামী অর্থনীতির বিকাশ সাধনে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা বাংলাদেশে উত্তরোত্তর আরো বিকশিত হবে।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড : সেরা ব্যাংক : এ স্বাধীন বাংলাদেশে সাফল্য ও শ্রেষ্ঠত্বের আরেক নাম ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। একটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর উত্থান, বিকাশ ও অবদান অবাক করা গল্পের মত। ১৯৮৩ সালে যাত্রা শুরু করে ২০১০ সালে এ ব্যাংক সফলতার ২৭ বছর অতিক্রম করেছে। আইবিবিএল একটি বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে এ দুই যুগের বেশী সময়ে একটার পর একটা মাইলফলক ডিঙ্গিয়ে বাংলাদেশের ১৫ কোটি মানুষের কাছে প্রিয় ও আদর্শিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সবিশেষ সুনাম অর্জন করেছে। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের নাম ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক পরিচালিত এ কল্যাণমুখী ব্যাংকের কার্যক্রমের ব্যাপকতা, পরিচালন যোগ্যতা, প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতার কারণে সারা দুনিয়ার সবগুলো ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এ ব্যাংক সেরা স্বীকৃতি অর্জন করেছে। এ দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক কার্যক্রম ও মানবিক পরিসেবার পরিসরে ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং দেশ ও জাতির উন্নয়নে এ ব্যাংকের ভূমিকার কথা কার না জানা আছে। আমানতদার এবং ব্যবসায়িক মহলে ইসলামী ব্যাংক সেরা ব্যাংকের স্বীকৃতি লাভ করেছে। ইসলামী ব্যাংক সেরা কেন, তা জানতে হলে এর কার্যক্রম এবং তার অর্জনের কয়েকটি দিক আলোচনা করাই যথেষ্ট হবে বলে আমার বিশ্বাস। এই ব্যাংক আমানতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক। ২০১০ সালের ডিসেম্বর সমাপনীতে ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ ছিল ২৯ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২০ শতাংশ। যে কোন ব্যাংকের তুলনায় এ প্রবৃদ্ধি ও অগ্রগতি অতুলনীয়। বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনায়ও ইসলামী ব্যাংক সবার সেরা। বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশে এবং শিল্প ও কৃষি উন্নয়নে এ ব্যাংকের অবদান যে কোন একক ব্যাংক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। দেশের টেক্র্টাইল, বস্ত্র, চিনি, জাহাজ নির্মাণ, সিমেন্ট, রিয়েল এস্টেট প্রভৃতি খাতে ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ অংশ ব্যাপক। বিগত ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২৯ হাজার ২০৮ কোটি টাকা, যার প্রবৃদ্ধির হার ২২ শতাংশ। ইসলামী ব্যাংক একটি উচ্চ মুনাফা অর্জনকারী ব্যাংক। মুনাফা অর্জনের দিক থেকে বিগত কয়েক বছর যাবৎ ব্যাংকটি প্রথমস্থান অর্জন করে আসছে। ২০১০ সালে ব্যাংকটি সর্বোচ্চ ১১৪৩ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা অর্জন করে, যা পূর্ববর্তী বছরে ছিল ৮৪৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় খাত হল আমদানি ও রফতানি বাণিজ্য। বিগত বছরগুলোতে ইসলামী ব্যাংক বৈদেশিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে। ২০১০ সালে ব্যাংকের আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২৪ হাজার ৬২৮ কোটি ও ১৪ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা। বৈদেশিক বাণিজ্যের বড় একটি দিক হল রেমিট্যান্স। ইসলামী ব্যাংক রেমিট্যান্স অর্জনে বরাবরই সফলতার পরিচয় দিয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে শক্ত পাটাতনের ওপর দাঁড় করাতে এই জীবনীশক্তি রেমিট্যান্স ইসলামী ব্যাংকের সবচেয়ে বড় অহংকার। ২০১০ সালে ১০% প্রবৃদ্ধি নিয়ে ব্যাংকের রেমিট্যান্সের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ২১ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা, যা বাংলাদেশের যে কোন একক ব্যাংকের চেয়ে বেশী। ইসলামী ব্যাংক একটি দ্রুত সম্প্রসারণশীল আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে ব্যাংকের ২৫১টি শাখা রয়েছে, যার মাধ্যমে ব্যাংক ৬০ লক্ষাধিক গ্রাহককে প্রতিনিয়ত ব্যাংকিং সেবা প্রদান করে আসছে। ৬০ লক্ষাধিক গ্রাহকের পরিবারের সদস্য মিলে অন্তত আড়াই কোটি মানুষের সাথে এই ব্যাংকের নানাভাবে ব্যাংকিং যোগাযোগ ও পরিচিতি রয়েছে।
জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান : বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ প্রাইভেট ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। এ ব্যাংক ইতোমধ্যে মুনাফা ও বৈদেশিক বাণিজ্যে সরকারি ব্যংকগুলোকেও পেছনে ফেলে এগিয়ে আছে। বাংলাদেশের রেমিটেন্স প্রবাহের এক-চতুর্থাংশ একাই ইসলামী ব্যাংক আহরণ করে দেশের অর্থনীতির ভিতকে মজবুত করছে। ব্যাংকটির ইকুইটির সীমা বড় হওয়ায় বড় বড় শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠায় বড় বিনিয়োগ সীমা মন্জুরীর মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক যে ভূমিকা রাখছে তা ঈর্ষণীয়। ইসলামী ব্যাংক এককভাবে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে শীর্ষস্থানীয় ট্যাক্স প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। ব্যাংকের বিভিন্ন বিশেষ প্রকল্প যেমন- গৃহ সামগ্রী প্রকল্প, ক্ষুদ্র ব্যবসা বিনিয়োগ প্রকল্প, ডাক্তার প্রকল্পসহ আরো কয়েকটি প্রকল্প দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বেকার সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ব্যাংকের পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প ব্যাংকটির একটি অনন্য সফল মাইলফলক। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের অহংকার করার মত একটি সাহসী ও সফল কর্মসূচি হল ‘পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প।' পল্লী এলাকার দুর্গত, অভাবী ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেয়া এবং একটি দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্যে এ প্রকল্প প্রণয়ন করেছে ব্যাংক। গ্রামীণ মানুষের জন্য যে সেবা দেশের কৃষি ব্যাংকের মত বিশেষায়িত ব্যাংক এবং বিভিন্ন এনজিও বা ক্ষুদ্র প্রকল্পের মাধ্যমে সম্পন্ন হবার কথা, একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক হয়েও গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশে ইসলামী ব্যাংক এগিয়ে এসেছে। এনজিও'র উচ্চ সুদের হাত থেকে অভাবী গ্রামীণ মানুষ বিশেষ করে অবহেলিত মহিলাদের জীবনমান উন্নয়নে ইসলামী ব্যাংকের এ সেবা বাংলাদেশ কেন বিশ্বের অন্যান্য দেশেও বিরল ঘটনা। এ ছাড়া দেশের শিল্প-বাণিজ্যের উন্নয়ন, দেশের অবকাঠামো ব্যবস্থার উন্নতি, ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বেকার সমস্যার মত জটিল সমস্যার সমাধান করে কিভাবে একটি সুখি ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়া যায় তার জন্য ইসলামী ব্যাংক আরো কর্মসূচি গ্রহণে নিরলসভাবে কাজ করছে।
সেরা ব্যাংকের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি : দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক হিসেবে অভাবনীয় সাফল্য ও অগ্রগতির পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংক দেশে-বিদেশে এর কার্যক্রমের জন্য প্রশংসিত হয়েছে। সেরা ব্যাংক হিসেবে ১৯৯৯, ২০০০, ২০০৪ ও ২০০৫ সালে এবং সেরা ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০০৮ ও ২০০৯ সালে ইসলামী ব্যাংক নিউইর্য়কভিত্তিক বিখ্যাত ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিন গ্লোবাল ফাইন্যান্স কর্তৃক পুরস্কৃত হয়েছে। ইন্সটিটিউট অব কস্ট এন্ড ম্যানেজমেন্ট একাউন্টস অব বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংককে বেস্ট কর্পোরেট এ্যাওয়ার্ড-২০০৭ এবং ২০০৮ সালে বেস্ট কর্পোরেট পারফরমেন্স এ্যাওয়ার্ড প্রদান করে। ইন্সটিটিউট অব চার্টার্ড একাউন্টস অব বাংলাদেশ বেসরকারি ব্যাংকিং খাতে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডকে একাউন্টস ও রিপোর্ট উপস্থাপনায় ২০০১ ও ২০০৮ সালে যথাক্রমে সার্টিফিকেট অব এপ্রিসিয়েশন ও সার্টিফিকেট অব মেরিট প্রদান করেছে। সিটি ব্যাংক এন এ ২০০৯ সালে ইউরোপ-বাংলাদেশ ট্রেড করিডোর-এ সর্বোচ্চ বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য ইসলামী ব্যাংককে সিটি এন এ পদক এবং ব্যাংকার্স ফোরাম এ ব্যাংককে ২০০৮ সালের জন্য ‘কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতায় সেরা' পুরস্কার প্রদান করে। এদিকে দেশের শীর্ষস্থানীয় রেটিং কোম্পানি ক্রাইসেল ২০০৬, ২০০৭, ২০০৮ সালে ইসলামী ব্যাংককে দীর্ঘমেয়াদের জন্য ডাবল এ গ্রেড প্রদান করে এবং স্বল্পমেয়াদে ২০০৪, ২০০৫, ২০০৬, ২০০৭ ও ২০০৮ সালের জন্য সর্বোচ্চ গ্রেড এসটি-১ প্রদান করে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের এই সাফল্য ও স্বীকৃতি এ দেশের আপামর জন সাধারণের জন্য গর্বের বিষয়।
ব্যাংকের সামাজিক কার্যক্রম : অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সেরা অবদান রাখার পাশাপশি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড তার সামাজিক কার্যক্রম ও আর্ত-পীড়িতের সেবার আদর্শকেও ভুলে যায়নি। এ ক্ষেত্রেও অনন্য অবদান রেখে চলেছে এ ব্যাংক। ব্যাংক সামাজিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে অভাবী, দুস্থ, অসহায় ও রোগগ্রস্ত মানুষের দুঃখ-বেদনা ও দুর্গতি মোচন এবং নিঃস্ব মানুষের কাছে সাহায্যের হাত বাড়ানোর জন্য কাজ করছে। বাংলাদেশের ব্যাংকিংজগতে ইসলামী ব্যাংকের এ কার্যক্রম অনন্য ও অভাবনীয়। ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ব্যাংক এ কাজ সফলভাবে পরিচালনা করছে। ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন হাসপাতাল, ক্লিনিক, নারী পুর্নবাসন কেন্দ্র ইত্যাদির মাধ্যমে কম খরচে চিকিৎসা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুর্নবাসন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে বাংলাদেশের মানুষের জন্য সেবার বিরাট সাফল্য এনে দিয়েছে। দেশের কোটি কোটি মানুষ আজ এ ফাউন্ডেশনের সুবিধা পাচ্ছে। দেশের যে কোন দুর্যোগ, বন্যা, ঝড় বা অন্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় ফাউন্ডেশন দুর্গত মানুষের পাশে গিয়ে উপস্থিত হচ্ছে। আইলা দুর্গত মানুষের পুর্নবাসন কার্যক্রমে ফাউন্ডেশনের উপস্থিতি দেশের মানুষ অবশ্যই অবলোকন করেছে। অসহায় মহিলাদের কর্মক্ষম করার জন্য ফাউন্ডেশনের নিয়মিত কর্মসূচি রয়েছে। সারা দেশে এ ফাউন্ডেশন ৬টি হাসপাতাল ও ১টি মেডিক্যাল কলেজের মাধ্যমে কম খরচে আধুনিক চিকিৎসা সেবা প্রদান করছে। সম্প্রতি পিলখানার নির্মম হত্যাকান্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ব্যাংক প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণতহবিলে ২৫ লক্ষ টাকা দান করেছে এবং চারটি পরিবারের মাসিক নিয়মিত খরচ বহন করছে। গরিব ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের বৃত্তি ও আর্থিক অনুদান দিয়ে ব্যাংক সহায়তা করছে।
0 comments: