(লেখাটি দুটি অংশে বিভক্ত- আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর)
।।আলোচনা।।
ইসলামে উত্তরাধিকার আইন এত বিস্তৃত ও বিশাল পরিসরের যে সেটাকে একটা পোস্টে আলোচনা করা মোটামুটি দু:সাধ্য। তবে এটা নিয়ে লেখার তীব্র ইচ্ছা থেকে প্রায় সপ্তাহদুয়েক পরিশ্রম করে যথাসাধ্য সংক্ষিপ্ত পরিসরে নিয়ম কানুন শর্ত লিখবার কাজের একটা অংশ শেষ করি। এর জন্য আমাকে সাহায্য নিতে হয়েছে আমার সংগ্রহের ও অন্যান্য উৎস হতে পাওয়া অসংখ্য বই পত্রের ( কোন ওয়েবসাইট থেকে সাহায্য নেবার ব্যাপারে যথাসাধ্য শর্তকতা অবলম্বন করেছি)। এধরনের কয়েকটা বই হচ্ছে Islamic Inheritance Law,General Rules & Shares by Mohammad Razi,Sep-2008, Toronto, Canada, Moohummudan Law of Inheritance by A. Rumsey,london. The Islamic Law of Succession by Dr A Hussain
Islamic Inheritance Law by Dr Yusuf Ziya Kavakci
The Final Bequest by Muhammad Al-Jibaly,ইসলামী উত্তরাধিকার আইন,মো.ফজলুর রহমান আশরাফী,মুসলিম আইন-এম হাবিবুর রহমান এবং একই সাথে যারা এ বিষয়ে আগ্রহী তাদের দেখা উচিত অন্যান্য সমাজ ব্যবস্থার (পুঁজিবাদ,সমাজতন্ত্র ও প্রমাণ প্রধান ধর্মসমূহ) উত্তরাধিকার আইন ।
এ পোষ্টে প্রতিটা তথ্য যা নিয়েছি তা প্রধান উৎস কুরআন ,হাদীস থেকে দেখে নিশ্চিত হবার চেষ্টা করেছি। তারপরও এ ব্যাপারে যারা আরও বিজ্ঞ তাদের কাছে অনুরোধ থাকবে, যদি কোন ভুল থেকে থাকে বা কোন পরামর্শ থাকলে দয়া করে জানাবেন-কৃতজ্ঞ থাকবো।
প্রাথমিক শর্তাবলী:
মৃত ব্যক্তির সম্পদ হতে তার অন্তেষ্টেক্রিয়া খরচ,তার ঋন থাকলে পরিশোধ,স্ত্রীর অপরিশোধিত দেনমোহর প্রদান সম্পন্ন করতে হবে। বাকি সম্পদের সর্ব্বোচ্চ ১/৩ অংশ তার উইলে (যদি থাকে) ব্যয় হবে। এসব কাজ শেষে যে স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি থাকবে তা ইসলামি আইন অনুসারে উত্তরাধিকারিগণের মধ্যে বণ্টন করতে হবে।
উত্তরাধিকার আইনের উৎস:
ইসলামের জীবন যাপনের বিধি-বিধানকে বলা হয় শরীয়াত। আর এই শরীয়াতের উৎস হল চারটি: (১) আল কুরআন (২)সুন্নাহ বা হাদিস (৩)ইজমা ও (৪)কিয়াস। উত্তরাধিকার আইন একটি শরীয়া আইন হওয়ায় এর উৎসও এ ৪টি।
আল কুরআনের ৩৫ টি আয়াতে উত্তরাধিকার আইন নিয়ে বলা আছে,তাদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য-
সূরা বাকারা আয়াত ১৮০,২৪০
সূরা নিসা আয়াত ৭,৮,৯,১১,১২,১৯,৩৩,১৭৬
সূরা মায়িদাহ ১০৫,১০৮
কুরআন শরীফের আয়াতগুলো ব্যাখ্যা করা হয়েছে হাদীস বা সুন্নাহ হতে। বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থগুলিতে(৬টি) উত্তরাধিকার আইন নিয়ে আলাদা আলাদা অধ্যায় রয়েছে।
পরবর্তীতে কুরআন ও হাদীসকে আরও পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বিশ্লেষণ করে আরও কিছু নিয়ম প্রবর্তিত হয়, এদের বলা হয় ইজমা।
ইসলামী উত্তরাধিকারিগণ: তিন ভাগে বিভক্ত, যথা-
১.যাবিল ফুরুজ বা অংশীদার: যাদের অংশ শরীয়ত দ্বারা নির্দিষ্ট।
২.আসাবা: যাবিল ফুরুজদের মধ্যে বন্টিত হবার পর যারা অবশিষ্টাংশ পায়
৩.যাবিল আরহাম: দুর সম্পর্কের আত্মীয়স্বজন,উপরের দুই শ্রেনীর অনুপস্থিতে যারা অংশীদার হয়
ইসলামী উত্তরাধিকারি আইনের সংক্ষিপ্ত আউটলাইন:
উল্লেখ্য যে এটি উত্তরাধিকারি আইনের সংক্ষিপ্ত আউটলাইন, এ নিয়ম গুলো প্রাথমিক ,এদের দ্বারাই মোটামুটি সব বন্টন হিসাব করা যায়, আরও কয়েকটা শর্ত রয়েছে যা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রয়োগ হয়।
এখানে, অধস্তন= মৃত ব্যক্তির পুত্র,কন্যা, পৌত্র,পৌত্রি...ইত্যাদি
উর্ধ্বতন= মৃত ব্যক্তির পিতা,দাদা...ইত্যাদি
আসাবা=অবশিষ্টাংশ ভোগী
বোঝার নিয়মটা খেয়াল করুন,যেমন নীচে দেখুন ১(খ) এর নিয়ম হল"১.পিতা (খ)১/৬+আসাবা,যদি স্ত্রী অধস্তন থাকে"
এর অর্থ হল যদি মৃত ব্যক্তির কন্যা,পৌত্রী..ইত্যাদি জীবিত থাকে তাহলে মৃত ব্যক্তির পিতা মোট সম্পত্তির ১/৬ অংশ পাবে এবং পরবর্তীতে বাকি ওয়ারিশগনকে সম্পত্তির অংশ দিয়ে দেবার পর বাকি থাকলে সেখান থেকেও একটা অংশ পাবেন।
১ম উত্তরাধিকারি. যাবিল ফুরুজ বা নির্দিষ্ট অংশীদার(১২জন)
১.পিতা
(ক) ১/৬, যদি পুং অধস্তন(পুত্র,পৌত্র ইত্যাদি) থাকে
(খ)১/৬ + আসাবা, যদি স্ত্রী অধস্তন (কন্যা, পৌত্রী ইত্যাদি) থাকে
(গ)আসাবা, কোন অধস্তন না থাকলে
২.দাদা
(ক) ১/৬, যদি পুং অধস্তন থাকে
(খ) ১/৬ + আসাবা, যদি স্ত্রী অধস্তন থাকে
(গ)আসাবা, কোন অধস্তন না থাকলে
(ঘ) ০, যদি পিতা থাকে
৩. স্বামী
(ক) ১/২, মৃত স্ত্রীর কোন অধস্তন না থাকলে
(খ)১/৪, মৃত স্ত্রীর কোন অধস্তন থাকলে
৪. সৎ ভাই (মায়ের পক্ষের)
(ক) ১/৬ , (একজন হলে)
(খ) ১/৩, (একাধিক হলে)
(গ) ০, অধস্তন বা উর্ধ্বতন থাকলে
৫. স্ত্রী
(ক) ১/৪, অধস্তন না থাকলে
(খ)১/৮, কোন অধস্তন থাকলে
৬.কন্যা
(ক) ১/২, (একজন হলে) পুত্র নেই
(খ)২/৩, (একাধিক হলে) পুত্র নেই
(গ) পুত্র থাকলে ১:২=কন্যা:পুত্র
৭.পৌত্রী
(ক) ১/২, ( একজন) কন্যা নেই
(খ) ২/৩, ( একাধিক) কন্যা নেই
(গ)১/৬ ,কন্যা একজন
(ঘ)০ , কন্যা একাধিক
(ঙ)আসাবা, কন্যা একাধিক এবং পৌত্রির ভাই বা অধস্তন থাকে
(চ) ০, পুত্র থাকলে
৮. সহোদর বোন:
(ক) ১/২ (একজন)
(খ)২/৩ (একাধিক)
(গ)আসাবা, ভাই থাকলে (সেেেত্র বোন:ভাই=১:২)
(ঘ)আসাবা, স্ত্রী অধস্তন (কন্যা,পৌত্রী ) থাকলে
(ঙ) ০ ,পুং অধস্তন বা উর্ধতন থাকলে
৯. পিতার পক্ষের সৎ বোন
(ক) ১/২ (একজন)
(খ) ২/৩ (একাধিক)
(গ)১/৬, একজন সহোদর বোন থাকলে
(ঘ)০,একাধিক সহোদর বোন
(ঙ) আসাবা, একাধিক সহোদর বোন ও সৎ বোনের ভাই থাকলে
(চ) আসাবা, কন্যা বা পৌত্রী থাকলে
(ছ) ০ ,পুং অধস্তন বা উর্ধতন থাকলে ও ৮ এর (ঘ) হলে
১০.মায়ের পক্ষের সৎ বোন
(ক) ১/৬ (একজন)
(খ) ১/৩ (একাধিক বা সাথে সৎ ভাই থাকলে) শুধুমাত্র এখানে ভাই:বোন=১:১
(গ)০, যদি অধস্তন বা উর্ধ্বতন থাকে
১১.মাতা
(ক) ১/৬ যদি অধস্তন বা যে কোন প্রকারের ভাই বা বোন একাধিক থাকে
(খ) ১/৩ যদি অধস্তন না থাকে বা যে কোন প্রকারের ভাই বা বোন একাধিক না থাকে
(গ) অবশিষ্টর ১/৩, যদি অধস্তন না থাকে বা যে কোন প্রকারের ভাই বা বোন একাধিক না থাকে কিন্তু পিতা মাতা থাকে তাহলে মাতা অবশিষ্টর ১/৩ অংশ পাবে।
১২.দাদী
(ক)১/৬,পিতা-মাতা না থাকলে
(খ)০, পিতা-মাতা থাকলে
২য় উত্তরাধিকারি. আসাবাগণ (যাবিল ফুরুজদের মধ্যে বন্টিত হবার পর যারা অবশিষ্টাংশ পায়)
১. পুত্র,পৌত্র,প্রপৌত্র, পিতা,দাদা,পরদাদা, ভাই,ভাতিজা,ভাতিজা পুত্র, চাচা,চাচাত ভাই চাচাত ভাইয়ের পুত্র ক্রম অনুসারে আসাবা হবে
২.কন্যা,পৌত্রী,সহোদর ও পিতার পরে সৎ বোন: তাদের ভাই থাকলে আসাবা হবে এবং ১:২ অনুপাতে অংশীদার হবে
৩.যথাক্রমে সহোদর বোন ও পিতার পরে সৎ বোন: মৃত ব্যক্তির এক বা একাধিক কন্যা থাকলে ক্রম অনুসারে আসাবা হবে
*ক্রম অনুসারে হলে বোঝায় ১ম জন আসাবা হলে পরের আর কেউ হবে না, ১ম জন না থাকলে ২য় জন হবে ইত্যাদি
৩য় উত্তরাধিকারি. যাবিল আরহাম:
দুর সম্পর্কের আত্মীয়স্বজন,উপরের দুই শ্রেনীর অনুপস্থিতে যারা অংশীদার হয়,যেমন -দৌহিত্র,দৌহিত্রী,ভাগিনা,ভাগিনী,খালা,ফুফু ইত্যাদি।
।।প্রশ্নোত্তর।।
প্রশ্ন ১.ইসলামে উত্তরাধিকারি আইনের উৎস হিসেবে কোরআন ছাড়াও হাদীস, ইজমা ও কিয়াসকে ব্যবহার করা হয় কেন?
উত্তর: ইসলাম ধর্মে দিক্ষীত বা ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞাত ব্যক্তির কাছে প্রশ্নটা হয়তো দুর্বল মনে হবে। কিন্তু এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ইসলামে উত্তরাধিকারি আইন নিয়ে যখন আমি ইন্টারনেটে সার্চ করি তখন বিভিন্ন প্রশ্নোত্তর সাইট বা সমালোচক সাইট গুলোতে এ সম্পর্কে নানা প্রশ্ন পড়ে সর্বপ্রথম আমি উপলব্ধি করি এ প্রশ্নটার গুরুত্ব।
আসলে এ প্রশ্নটা সবচেয়ে বেশি এসেছে যারা খ্রিষ্ট ধর্ম বা ইহুদি ধর্মঅনুসারী বা এসব ধর্মের জ্ঞান থেকে যারা প্রশ্ন করে। কারন হল,খ্রিষ্টধর্মালম্বীদের সমস্ত ধর্মীয় আইন কানুনের উৎস একটিই, বাইবেল ((উভয় টেস্টামেন্ট) এবং ইহুদিদের ওল্ড টেস্টামেন্ট। অন্যান্য অনেক ধর্মের ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা কাছাকাছি।
কিন্তু ইসলাম ধর্মে বিষয়টা কী রকম? ইসলামের জীবন যাপনের বিধি-বিধানকে বলা হয় শরীয়াত। আর এই শরীয়াতের উৎস হল চারটি: (১) আল কুরআন (২)সুন্নাহ বা হাদিস (৩)ইজমা ও (৪)কিয়াস। কিন্তু এর প্রাথমিক শর্ত হল এ চারটি উৎস কখনো পরস্পরবিরোধী হবে না এবং অধিক গুরুত্ব অনুযায়ী ক্রমটি দেয়া।
(১)আল কুরআন : ইসলামিক সকল আইনের প্রথম ও প্রধান উৎস হল আল কুরআন। লক্ষ্যলনীয়, ইসলামী আইন তৈরির ক্ষেত্রে কুরআনের শুধুমাত্র একটি বা দুটি আয়াত অনুসরণ করলেই হবে না,সমগ্র কুরআন কে বিবেচনায় আনতে হয়।
(২)হাদীস: ইসলাম ধর্মের সর্বশেষ নবী মুহম্মদ(সা) এর নবী জীবনের সকল কথা,কর্ম, অনুমোদন,ব্যাখ্যা বিশ্লেষণই হল হাদীস। কুরআন মাজীদ নাজিল হয়েছিল তাঁর মাধ্যমে এবং কুরআনের সব সংপ্তি বিষয়ের ব্যাখ্যা বুঝিয়ে দেবার দায়িত্ব ছিল মুহম্মদ(সা)এর ওপর। যেমন-কুরআনে বলা আছে মদ্যপান নিষেধ, কিন্তু হাদীসে মদ্যপানের সাথে জড়িত কোন কোন পেশা নিষেধ তা ব্যাখ্যা দেয়া আছে। এ সম্পর্কে কুরআনের সূরা আননাহলের ৪৪ নং আয়াতে বলা আছে, আর আমি আপনার নিকট কুরআন নাযিল করেছি, মানুষকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেবার জন্য যা তাদের উপর নাযিল করা হয়েছে,যাতে তারা চিন্তা ভাবনা করে। এছাড়া সূরা হাশরের ৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে, রাসূল তোমাদের যা দেন তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তোমাদের নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক। লক্ষ্যনীয় হাদিস সর্বদা বিশুদ্ধ উৎস(যেমন-সহীহ বুখারী,সহীহ মুসলিম ইত্যাদি) হতে গ্রহণ করতে হবে।
(৩) ইজমা: ইজমার শাব্দিক অর্থ ঐক্যমত।অর্থাৎ কোন আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মের নিয়ম-কানুন সম্পর্কে বিশেষজ্ঞগন ঐক্যমতের ভিত্তিতে যে নিয়ম বা আইন তৈরি করেন তাই ইজমা। আসলে কুরআন ও হাদীস কোন দেশের সংবিধানের মত নয় কিন্তু এ উৎসদ্বয় হতে সংবিধান তৈরি করা যায়। যখন একটি দেশ গঠিত হয়, তার লিখিত আইন থাকতে হয়,সময়ের প্রয়োজনে নতুন আইনের প্রয়োগ দরকার হয়,সেইসব আইন তৈরির সময় কুরআন ও হাদীস অনুযায়ী যে নিয়ম তৈরি হয় তাই ইজমা দ্বারা নির্ধারিত হয়। এ উৎস কুরআন ও হাদীস দ্বারা নিশ্চিত করা হয়েছে,আল কুরআনের সূরা আননিসার ১১৫ নং আয়াতে মুমিনগনের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে চলার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে । মুহম্মদ(সা)বলেছেন, মুসলমানগণ যা ভাল বলে গ্রহণ করে তা আল্লাহর কাছেও ভাল। শরীয়াতের বিষয়ে ইজমা অকাট্য দলিলে পরিণত হয়। ইজমা কখনো কুরআন-হাদীসের পরিপন্থি হবে না,শুধুমাত্র নতুন কোন সমস্যার ক্ষেত্রে কুরআন হাদীস অনুযায়ী ব্যাখ্যা প্রদান করবে।
(৪)কিয়াস : নতুন কোন সমস্যায় পুরাতণ কোন সমস্যার সমাধানকে প্রবর্তন করাই কিয়াস, অর্থাৎ আগের তিনটি উৎসে যে ইসলামিক আইন রয়েছে তার কারন অনুসন্ধান করে নতুন সমস্যা সমাধানে সে কারন সংশ্লিষ্ট হলে তার মাধ্যমে সেই সমস্যা সমাধান করা, তবে তা কখনো আগের তিনটি উৎসের পরিপন্থী হবে না বা সেসব উৎসের মূলনীতি বিরোধী হতে পারবে না কখনো যদি দেখা যায় কিয়াস তাদের পরিপন্থি তাহলে তা বাদ হয়ে যায়।
ইসলামী উত্তরাধিকারি আইনে শরীয়াতের এ উৎসসমূহ ব্যবহৃত হয়, প্রকৃত পক্ষে ইসলামের সব আইন তৈরি হতে এ উৎসসমূহ ব্যবহার হয়,তাই এসব আইনকে শরীয়া আইন বলে। ইসলামে উত্তরাধিকার আইন কুরআন শরীফে একদম মূল বিষয়গুলি সংক্ষেপে বলা হয়েছে, তাঁর বিশদ ব্যাখ্যা রয়েছে হাদিসে, পরবর্তীতে আরও কিছু নিয়ম যুক্ত হয়েছে গভীর ভাবে কুরআনও হাদীস ব্যাখ্যার মাধ্যমে, কিন্তু কোন নিয়ম বা মূলনীতি কুরআন বা হাদীস এর পরিপন্থি নয়।
তাই প্রশ্নটা অবান্তর, শুধুমাত্র উত্তরাধিকার আইন নয়,প্রায় সকল ইসলামী আইনই ব্যাখ্যার জন্য কুরআনের পাশাপাশি হাদীস,ইজমা ইত্যাদি উৎসের সাহায্য নিতে হয়।
প্রশ্ন২. আউল বা রদ্দ নীতি কি কোরআন শরীফের নির্ধারিত অংশের বিরুদ্ধে যায় ?
উত্তর: এ প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কথা ছিল না, কিন্তু উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে জ্ঞানের স্বল্পতাহেতু এটা অমুসলিমদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্ব পূর্ণ ,এমনকি মুসলিমদের মধ্যেও এ নিয়ে পরিষ্কার ধারণা না থাকায় অনেকে বিভ্রান্ত হচ্ছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, এ নিয়মটার জন্য অনেকে দাবি করছে কোরআন শরীফে গানিতিক ভুল আছে, সৃষ্টিকর্তা গণিত জানে না।
বিষয়টা কিছুটা এরকম,
ধরুন কাসে গণিতের টিচার ছাত্রদের বললেন,নেক্সট পরীক্ষায় যে অংকগুলি থাকবে তা বোঝার জন্য টেক্সট বইয়ের বাইরে আরও কয়েকটি রেফারেন্স বইয়ের সূত্র লাগবে। তো পরীক্ষার আগে কোন ছাত্র শুধু টেক্সট বই পড়ে গেলো এবং যথারীতি পরীক্ষায় আসা কয়েকটি অংক পারলো না। পরে সবাইকে বলে বেড়াল ঐসব অংকে ভুল ছিল বা টিচার অংক জানে না।
কোরআন শরীফে বলে দেয়া হচ্ছে যে হাদীসের সাহায্য নেয়ার জন্য,তা না নিয়ে গাণিতিক ভুলের দাবিটা কিছুটা সেরকম।
এ আইন বহু বিখ্যাত গণিতবিদদের দ্বারা পরীক্ষীত হয়েছে। মুসা আল খোয়ারজমী,৮৫০ খ্রিস্টাব্দের সময়কালীন একজন গণিতবিদ, যার বইয়ের প্রভাব ইউরোপে এতটাই ছিল যে তখন তার হিসাব আল জাবর ওয়াল মুকাবিলাহ ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ল্যাটিনে অনূদিত হয়ে শ্রেষ্ঠ ও প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে পড়ানো হয়। তার বইয়ের আল জাবর থেকে আলজেবরা শব্দের উৎপত্তি। তার এই গ্রন্থে ইসলামিক উত্তরাধিকার আইনটির গানিতিক দিক নিয়ে একটা অধ্যায় আছে, যেখানে তিনি সম্পদ বন্টণের জন্য লিনিয়ার ইকুইশন প্রবর্তন করেন। উত্তরাধিকার আইন এতটাই গনিতের সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ যে এটি গণিতের একটি শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। ( Gandz, Solomon (1938), "The Algebra of Inheritance: A Rehabilitation of Al-Khuwarizmi", Osiris (University of Chicago Press 5: 319-91 )
তাছাড়া উত্তরাধিকার আইন তৎকালীন মুসলিম গণিতবিদদের জন্য একধরনের প্রেরণা ছিল, এটা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অর্থাৎ গানিতিক ভাবে কুরআনের মূলনীতির মাধ্যমে সম্পদ হিসাব করার জন্য গণিতের অনেক নতুন বিষয় আবিষ্কৃত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য উত্তর আফ্রিকার ১২ শতাব্দীর গণিতবিদ আল হাসার লব ও হরের হিসাবের জন নতুন গানিতিক নোটেশনের ধারণা প্রদান করেন। তার এই গাণিতিক নিয়ম পরবর্তীতে ১৩ শতাব্দীতে ইউরোপের বিখ্যাত গণিতবিদ ফিবোনক্কির কাজের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। ( Prof. Ahmed Djebbar (June 2008). "Mathematics in the Medieval Maghrib: General Survey on Mathematical Activities in North Africa". FSTC Limited.)
এসব কারনে ইসলামের ও কোরআনের অনেক বড় সমালোচক গনও উত্তরাধিকার আইন নিয়ে কোন বিরূপ মন্তব্য করার চিন্তাও করেনি-যেমন ড. ক্যাম্পবেল,যার পিএইচডি এর বিষয় ছিল কুরআন তথা ইসলামের দুর্বল দিক গুলো তুলে ধরা,সেও উত্তরাধিকার আইন নিয়ে কোন সভায় কোন মন্তব্য করেনি। শুধুমাত্র এ আইনে স্বল্প জ্ঞান সম্পন্ন অতি উৎসাহী ইসলামের সমালোচকরা নানা বাগাড়ম্বর করে থাকে।
এই আইন এতটা সুচিন্তিত,বিস্তৃত ও গণিতবান্ধব যে, অনেক অমুসলিম আইনবিদও এটাকে অকুন্ঠচিত্তে সমর্থণ জানিয়েছে,যেমন: কিংস কলেজ,ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের প্রফেসর,আইনবিষয়ক অনেক গ্রন্থের লেখক ও আইনবিদ(ব্যরিস্টার অ্যাট ল) আলমারিক রামসে তার এক বইয়ে বলেন-মুসলিম উত্তরাধিকার আইন হল সভ্য সমাজে প্রচলিত সবচেয়ে বিস্তৃত ও বিশুদ্ধ্ উত্তরাধিকার আইন ও সব প্রশ্নের উর্ধ্বে। ( Rumsey, A. Moohummudan Law of Inheritance. 1880)
আউল নীতি: আউল শব্দের আভিধানিক অর্থ বৃদ্ধি হওয়া। শরীয়তের নিয়মানুযায়ী যাবিল ফুরুজ বা অংশীদারদের অংশ প্রদানের পর তাদের অংশাবলীর যোগফল যদি মূল সম্পদ হতে বেড়ে যায় বা ১ এর চেয়ে বেশি হয় তাহলে যে নিয়মে তা সমাধান করা হয় সেটাই আউল। কোরআন শরীফে অংশীদারদের যে তালিকা রয়েছে তাদের বিভিন্ন বিন্যাস ও সমাবেশে কখনো কখনো তা ১ এর চেয়ে বেশি হওয়াটা গাণিতিক ভাবে ও অনুপাত ভিত্তিক বন্টনে যদিও সেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার কিন্তু এ বিন্যাস খুব সহজলভ্য নয়, তাই হাদীসে এ পরিস্থিতির উদাহরণ নেই,তবে চার খলিফা আমলে এটি আলোচিত হয় ও পরবর্তীতে শরীয়তের ৩য় উৎস কিয়াসের মাধ্যমে ইসলামী আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
রদ্দ নীতি: রদ্দ এর আভিধানিক অর্থ প্রত্যাবর্তন করা । এটি আউলের বিপরীত নিয়ম। শরীয়তের নিয়মানুযায়ী যাবিল ফুরুজ বা অংশীদারদের অংশ প্রদানের পর তাদের অংশাবলীর যোগফল যদি ১ এর চেয়ে কম হয় এবং মৃত ব্যক্তির কোন আসাবা না থাকে তাহলে অবশিষ্ট সম্পত্তি স্বামী স্ত্রী ব্যতিত অন্যান্য অংশীদারদের কাছে পুনরায় প্রত্যাবর্তন করা হয়।
তিনটি উদাহরণ :
১. জলিল সাহেব মৃত্যুকালে পিতা ও এক কন্যা রেখে গেল
প্রথমত, কন্যা পাবে ১/২ অংশ
পিতা পাবে ১/৬
এখানে ,১/২+১/৬=৪/৬ , সুতারাং আসাবা বা অবশিষ্টাংশ = ১-৪/৬= ২/৬
দ্বিতীয়ত, ১(খ) অনুযায়ী, পিতা এই আসাবা পাবে। তাহলে মোট পিতার অংশ=১/৬+২/৬ =৩/৬ =১/২ ও কন্যার অংশ=১/২
২.কামাল সাহেব ১ কন্যা ও মা রেখে মারা গেলেন।
প্রথমত, কন্যা পাবে ১/২
মা পাবে ১/৬
মোট ১/২+১/৬=৩/৬+১/৬=৪/৬
দ্বিতীয়ত, রদ্দনীতি প্রয়োগ করে পাই-৩/৪+১/৪=৪/৪=১
তাহলে, কন্যা ৩/৪ ও মা ১/৪ অংশ পাবে।
৩.আনিস সাহেব মৃত্যুকালে স্ত্রী, ২ সহোদর বোন ও ২ জন মায়ের পরে সৎ বোন রেখে গেল।
প্রথমত, এখানে স্ত্রী পায় ১/৪
সহোদর বোনদ্বয় ২/৩
সৎ বোনদ্বয় ১/৩
মোট= ১/৪+২/৩+১/৩ =৩/১২+৮/১২+৪/১২=১৫/১২
দ্বিতীয়ত, ১এর বেশি হওয়ায় আউল অবলম্বন করে হরকে ১৫ করে পাই,
৩/১৫+৮/১৫+৪/১৫=১৫/১৫=১
তাহলে স্ত্রী ৩/১৫,বোনদ্বয় ৮/১৫ ও সৎ বোনদ্বয় ৪/১৫ অংশ পাবে।
উদাহরণ তিনটিতে দেখা যায় প্রথম ২টি উদাহরনে অংশ বৃদ্ধি পায়, দ্বিতীয়টিতে অংশ কিছুটা হ্রাস পায়। এখন ১ম নিয়মটি সাধারন ভাবে আসাবা বা অবশিষ্টাংশভোগী নিয়মে করা হয়েছে ,২য় টি রদ্দ ও ৩য়টিতে আউল নীতি প্রয়োগ করা হয়েছে।
দেখা যাচ্ছে কুরআনে বর্ণিত অংশ প্রাপ্ত হবার পর সে অংশ দ্বিতীয় ধাপে বাড়তে বা কমতে পারে, আর সেটা মোটেও কোরআনের পরিপন্থি নয় । কোরআনে এ সংক্রান্ত আয়াতগুলোতে দেখা যায় কয়েকজনের অনুপাত উল্লেখ করা হয় নি, যেমন পুত্র,ভাই,চাচা ইত্যাদি। এখন কেউ যদি বলে এদের উল্লেখ নেই, তাহলে এদের ভাগ দেয়া হলে কুরআনের বিরুদ্ধে যাবে, তাহলে তা অবান্তর মন্তব্য হবে। আসলে কোরআনে উল্লেখিত অংশ দেবার পর যা বাকি থাকবে সেখান থেকে তাদের অংশ নির্ধারিত হয়। আবার কখনো নিদির্ষ্ট অংশভোগীরাও তা পেতে পারে (যেমন- উদা ১), রদ্দ নীতিতেও বেশি পেয়ে থাকে। তাই নির্ধারিত অংশের বেশি পাওয়া ইসলামী আইনের পরিপন্থি নয়।
অধিকাংশ প্রশ্নে আমি দেখেছি আউল নীতি নিয়ে যত প্রশ্ন অথচ বেশি পাওয়ার ক্ষেত্রে কোন প্রশ্ন নেই । কিন্তু গণিতের দৃষ্টিতে বলা যায়, বৃদ্ধি ধনাত্মক বা ঋণাত্মক দুইই হতে পারে আর আউল নীতিতে এই বেশি পাওয়া নীতি বা রদ্দ নীতির বিপরীত হয়, খুব স্বাভাবিক ভাবেই তা হয়।
ইসলামে উত্তরাধিকারি আইনে আউল ও রদ্দ নীতিতে পরস্পরের সম্পদের অনুপাত ঠিক রাখা হয়, তাই এভাবে বন্টন গাণিতিক ভাবে অত্যন্ত গ্রহনযোগ্য ও বৈজ্ঞানিক। যেমন ২ নং উদাহরণে প্রথমত অনুপাত থাকে, কন্যা:মা=৩/৬:১/৬=৩:১
রদ্দ নীতি প্রয়োগের পর এ অনুপাত, কন্যা:মা=৩/৪:১/৪=৩:১
৩নং উদাহরণের আউল নীতিতেও ৩:৮:৪ অনুপাত ঠিক থাকে।
তাই বলা যায়, রদ্দ আউল ও অন্যান্য শরীয়া নিয়ম যা শরীয়তের উৎসসমূহ থেকে করা হয়েছে তা কোনটিই পরস্পর পরিপন্থি বা কোরআন পরিপন্থি নয় এবং ইসলামি উত্তরাধিকার আইন একটি সম্পূর্ণ স্বয়ংসম্পূর্ণ গাণিতিক বা বৈজ্ঞানিক ব্যবহারিক ব্যবস্থা।
(allah knows the best)
পরবর্তীতে আলোচনার ইচ্ছা রইল-
>ইসলামিক আইনে সম্পদের অংশে পুরুষ নারীর প্রাপ্য অংশের দ্বিগুন পায়,এতে কি নারীর অধিকার খর্বিত হচ্ছে না!
>ইসলামে উত্তরাধিকার আইনে পরিবর্তন করার দাবি কতটা যৌক্তিক!
।।আলোচনা।।
ইসলামে উত্তরাধিকার আইন এত বিস্তৃত ও বিশাল পরিসরের যে সেটাকে একটা পোস্টে আলোচনা করা মোটামুটি দু:সাধ্য। তবে এটা নিয়ে লেখার তীব্র ইচ্ছা থেকে প্রায় সপ্তাহদুয়েক পরিশ্রম করে যথাসাধ্য সংক্ষিপ্ত পরিসরে নিয়ম কানুন শর্ত লিখবার কাজের একটা অংশ শেষ করি। এর জন্য আমাকে সাহায্য নিতে হয়েছে আমার সংগ্রহের ও অন্যান্য উৎস হতে পাওয়া অসংখ্য বই পত্রের ( কোন ওয়েবসাইট থেকে সাহায্য নেবার ব্যাপারে যথাসাধ্য শর্তকতা অবলম্বন করেছি)। এধরনের কয়েকটা বই হচ্ছে Islamic Inheritance Law,General Rules & Shares by Mohammad Razi,Sep-2008, Toronto, Canada, Moohummudan Law of Inheritance by A. Rumsey,london. The Islamic Law of Succession by Dr A Hussain
Islamic Inheritance Law by Dr Yusuf Ziya Kavakci
The Final Bequest by Muhammad Al-Jibaly,ইসলামী উত্তরাধিকার আইন,মো.ফজলুর রহমান আশরাফী,মুসলিম আইন-এম হাবিবুর রহমান এবং একই সাথে যারা এ বিষয়ে আগ্রহী তাদের দেখা উচিত অন্যান্য সমাজ ব্যবস্থার (পুঁজিবাদ,সমাজতন্ত্র ও প্রমাণ প্রধান ধর্মসমূহ) উত্তরাধিকার আইন ।
এ পোষ্টে প্রতিটা তথ্য যা নিয়েছি তা প্রধান উৎস কুরআন ,হাদীস থেকে দেখে নিশ্চিত হবার চেষ্টা করেছি। তারপরও এ ব্যাপারে যারা আরও বিজ্ঞ তাদের কাছে অনুরোধ থাকবে, যদি কোন ভুল থেকে থাকে বা কোন পরামর্শ থাকলে দয়া করে জানাবেন-কৃতজ্ঞ থাকবো।
প্রাথমিক শর্তাবলী:
মৃত ব্যক্তির সম্পদ হতে তার অন্তেষ্টেক্রিয়া খরচ,তার ঋন থাকলে পরিশোধ,স্ত্রীর অপরিশোধিত দেনমোহর প্রদান সম্পন্ন করতে হবে। বাকি সম্পদের সর্ব্বোচ্চ ১/৩ অংশ তার উইলে (যদি থাকে) ব্যয় হবে। এসব কাজ শেষে যে স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি থাকবে তা ইসলামি আইন অনুসারে উত্তরাধিকারিগণের মধ্যে বণ্টন করতে হবে।
উত্তরাধিকার আইনের উৎস:
ইসলামের জীবন যাপনের বিধি-বিধানকে বলা হয় শরীয়াত। আর এই শরীয়াতের উৎস হল চারটি: (১) আল কুরআন (২)সুন্নাহ বা হাদিস (৩)ইজমা ও (৪)কিয়াস। উত্তরাধিকার আইন একটি শরীয়া আইন হওয়ায় এর উৎসও এ ৪টি।
আল কুরআনের ৩৫ টি আয়াতে উত্তরাধিকার আইন নিয়ে বলা আছে,তাদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য-
সূরা বাকারা আয়াত ১৮০,২৪০
সূরা নিসা আয়াত ৭,৮,৯,১১,১২,১৯,৩৩,১৭৬
সূরা মায়িদাহ ১০৫,১০৮
কুরআন শরীফের আয়াতগুলো ব্যাখ্যা করা হয়েছে হাদীস বা সুন্নাহ হতে। বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থগুলিতে(৬টি) উত্তরাধিকার আইন নিয়ে আলাদা আলাদা অধ্যায় রয়েছে।
পরবর্তীতে কুরআন ও হাদীসকে আরও পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বিশ্লেষণ করে আরও কিছু নিয়ম প্রবর্তিত হয়, এদের বলা হয় ইজমা।
ইসলামী উত্তরাধিকারিগণ: তিন ভাগে বিভক্ত, যথা-
১.যাবিল ফুরুজ বা অংশীদার: যাদের অংশ শরীয়ত দ্বারা নির্দিষ্ট।
২.আসাবা: যাবিল ফুরুজদের মধ্যে বন্টিত হবার পর যারা অবশিষ্টাংশ পায়
৩.যাবিল আরহাম: দুর সম্পর্কের আত্মীয়স্বজন,উপরের দুই শ্রেনীর অনুপস্থিতে যারা অংশীদার হয়
ইসলামী উত্তরাধিকারি আইনের সংক্ষিপ্ত আউটলাইন:
উল্লেখ্য যে এটি উত্তরাধিকারি আইনের সংক্ষিপ্ত আউটলাইন, এ নিয়ম গুলো প্রাথমিক ,এদের দ্বারাই মোটামুটি সব বন্টন হিসাব করা যায়, আরও কয়েকটা শর্ত রয়েছে যা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রয়োগ হয়।
এখানে, অধস্তন= মৃত ব্যক্তির পুত্র,কন্যা, পৌত্র,পৌত্রি...ইত্যাদি
উর্ধ্বতন= মৃত ব্যক্তির পিতা,দাদা...ইত্যাদি
আসাবা=অবশিষ্টাংশ ভোগী
বোঝার নিয়মটা খেয়াল করুন,যেমন নীচে দেখুন ১(খ) এর নিয়ম হল"১.পিতা (খ)১/৬+আসাবা,যদি স্ত্রী অধস্তন থাকে"
এর অর্থ হল যদি মৃত ব্যক্তির কন্যা,পৌত্রী..ইত্যাদি জীবিত থাকে তাহলে মৃত ব্যক্তির পিতা মোট সম্পত্তির ১/৬ অংশ পাবে এবং পরবর্তীতে বাকি ওয়ারিশগনকে সম্পত্তির অংশ দিয়ে দেবার পর বাকি থাকলে সেখান থেকেও একটা অংশ পাবেন।
১ম উত্তরাধিকারি. যাবিল ফুরুজ বা নির্দিষ্ট অংশীদার(১২জন)
১.পিতা
(ক) ১/৬, যদি পুং অধস্তন(পুত্র,পৌত্র ইত্যাদি) থাকে
(খ)১/৬ + আসাবা, যদি স্ত্রী অধস্তন (কন্যা, পৌত্রী ইত্যাদি) থাকে
(গ)আসাবা, কোন অধস্তন না থাকলে
২.দাদা
(ক) ১/৬, যদি পুং অধস্তন থাকে
(খ) ১/৬ + আসাবা, যদি স্ত্রী অধস্তন থাকে
(গ)আসাবা, কোন অধস্তন না থাকলে
(ঘ) ০, যদি পিতা থাকে
৩. স্বামী
(ক) ১/২, মৃত স্ত্রীর কোন অধস্তন না থাকলে
(খ)১/৪, মৃত স্ত্রীর কোন অধস্তন থাকলে
৪. সৎ ভাই (মায়ের পক্ষের)
(ক) ১/৬ , (একজন হলে)
(খ) ১/৩, (একাধিক হলে)
(গ) ০, অধস্তন বা উর্ধ্বতন থাকলে
৫. স্ত্রী
(ক) ১/৪, অধস্তন না থাকলে
(খ)১/৮, কোন অধস্তন থাকলে
৬.কন্যা
(ক) ১/২, (একজন হলে) পুত্র নেই
(খ)২/৩, (একাধিক হলে) পুত্র নেই
(গ) পুত্র থাকলে ১:২=কন্যা:পুত্র
৭.পৌত্রী
(ক) ১/২, ( একজন) কন্যা নেই
(খ) ২/৩, ( একাধিক) কন্যা নেই
(গ)১/৬ ,কন্যা একজন
(ঘ)০ , কন্যা একাধিক
(ঙ)আসাবা, কন্যা একাধিক এবং পৌত্রির ভাই বা অধস্তন থাকে
(চ) ০, পুত্র থাকলে
৮. সহোদর বোন:
(ক) ১/২ (একজন)
(খ)২/৩ (একাধিক)
(গ)আসাবা, ভাই থাকলে (সেেেত্র বোন:ভাই=১:২)
(ঘ)আসাবা, স্ত্রী অধস্তন (কন্যা,পৌত্রী ) থাকলে
(ঙ) ০ ,পুং অধস্তন বা উর্ধতন থাকলে
৯. পিতার পক্ষের সৎ বোন
(ক) ১/২ (একজন)
(খ) ২/৩ (একাধিক)
(গ)১/৬, একজন সহোদর বোন থাকলে
(ঘ)০,একাধিক সহোদর বোন
(ঙ) আসাবা, একাধিক সহোদর বোন ও সৎ বোনের ভাই থাকলে
(চ) আসাবা, কন্যা বা পৌত্রী থাকলে
(ছ) ০ ,পুং অধস্তন বা উর্ধতন থাকলে ও ৮ এর (ঘ) হলে
১০.মায়ের পক্ষের সৎ বোন
(ক) ১/৬ (একজন)
(খ) ১/৩ (একাধিক বা সাথে সৎ ভাই থাকলে) শুধুমাত্র এখানে ভাই:বোন=১:১
(গ)০, যদি অধস্তন বা উর্ধ্বতন থাকে
১১.মাতা
(ক) ১/৬ যদি অধস্তন বা যে কোন প্রকারের ভাই বা বোন একাধিক থাকে
(খ) ১/৩ যদি অধস্তন না থাকে বা যে কোন প্রকারের ভাই বা বোন একাধিক না থাকে
(গ) অবশিষ্টর ১/৩, যদি অধস্তন না থাকে বা যে কোন প্রকারের ভাই বা বোন একাধিক না থাকে কিন্তু পিতা মাতা থাকে তাহলে মাতা অবশিষ্টর ১/৩ অংশ পাবে।
১২.দাদী
(ক)১/৬,পিতা-মাতা না থাকলে
(খ)০, পিতা-মাতা থাকলে
২য় উত্তরাধিকারি. আসাবাগণ (যাবিল ফুরুজদের মধ্যে বন্টিত হবার পর যারা অবশিষ্টাংশ পায়)
১. পুত্র,পৌত্র,প্রপৌত্র, পিতা,দাদা,পরদাদা, ভাই,ভাতিজা,ভাতিজা পুত্র, চাচা,চাচাত ভাই চাচাত ভাইয়ের পুত্র ক্রম অনুসারে আসাবা হবে
২.কন্যা,পৌত্রী,সহোদর ও পিতার পরে সৎ বোন: তাদের ভাই থাকলে আসাবা হবে এবং ১:২ অনুপাতে অংশীদার হবে
৩.যথাক্রমে সহোদর বোন ও পিতার পরে সৎ বোন: মৃত ব্যক্তির এক বা একাধিক কন্যা থাকলে ক্রম অনুসারে আসাবা হবে
*ক্রম অনুসারে হলে বোঝায় ১ম জন আসাবা হলে পরের আর কেউ হবে না, ১ম জন না থাকলে ২য় জন হবে ইত্যাদি
৩য় উত্তরাধিকারি. যাবিল আরহাম:
দুর সম্পর্কের আত্মীয়স্বজন,উপরের দুই শ্রেনীর অনুপস্থিতে যারা অংশীদার হয়,যেমন -দৌহিত্র,দৌহিত্রী,ভাগিনা,ভাগিনী,খালা,ফুফু ইত্যাদি।
।।প্রশ্নোত্তর।।
প্রশ্ন ১.ইসলামে উত্তরাধিকারি আইনের উৎস হিসেবে কোরআন ছাড়াও হাদীস, ইজমা ও কিয়াসকে ব্যবহার করা হয় কেন?
উত্তর: ইসলাম ধর্মে দিক্ষীত বা ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞাত ব্যক্তির কাছে প্রশ্নটা হয়তো দুর্বল মনে হবে। কিন্তু এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ইসলামে উত্তরাধিকারি আইন নিয়ে যখন আমি ইন্টারনেটে সার্চ করি তখন বিভিন্ন প্রশ্নোত্তর সাইট বা সমালোচক সাইট গুলোতে এ সম্পর্কে নানা প্রশ্ন পড়ে সর্বপ্রথম আমি উপলব্ধি করি এ প্রশ্নটার গুরুত্ব।
আসলে এ প্রশ্নটা সবচেয়ে বেশি এসেছে যারা খ্রিষ্ট ধর্ম বা ইহুদি ধর্মঅনুসারী বা এসব ধর্মের জ্ঞান থেকে যারা প্রশ্ন করে। কারন হল,খ্রিষ্টধর্মালম্বীদের সমস্ত ধর্মীয় আইন কানুনের উৎস একটিই, বাইবেল ((উভয় টেস্টামেন্ট) এবং ইহুদিদের ওল্ড টেস্টামেন্ট। অন্যান্য অনেক ধর্মের ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা কাছাকাছি।
কিন্তু ইসলাম ধর্মে বিষয়টা কী রকম? ইসলামের জীবন যাপনের বিধি-বিধানকে বলা হয় শরীয়াত। আর এই শরীয়াতের উৎস হল চারটি: (১) আল কুরআন (২)সুন্নাহ বা হাদিস (৩)ইজমা ও (৪)কিয়াস। কিন্তু এর প্রাথমিক শর্ত হল এ চারটি উৎস কখনো পরস্পরবিরোধী হবে না এবং অধিক গুরুত্ব অনুযায়ী ক্রমটি দেয়া।
(১)আল কুরআন : ইসলামিক সকল আইনের প্রথম ও প্রধান উৎস হল আল কুরআন। লক্ষ্যলনীয়, ইসলামী আইন তৈরির ক্ষেত্রে কুরআনের শুধুমাত্র একটি বা দুটি আয়াত অনুসরণ করলেই হবে না,সমগ্র কুরআন কে বিবেচনায় আনতে হয়।
(২)হাদীস: ইসলাম ধর্মের সর্বশেষ নবী মুহম্মদ(সা) এর নবী জীবনের সকল কথা,কর্ম, অনুমোদন,ব্যাখ্যা বিশ্লেষণই হল হাদীস। কুরআন মাজীদ নাজিল হয়েছিল তাঁর মাধ্যমে এবং কুরআনের সব সংপ্তি বিষয়ের ব্যাখ্যা বুঝিয়ে দেবার দায়িত্ব ছিল মুহম্মদ(সা)এর ওপর। যেমন-কুরআনে বলা আছে মদ্যপান নিষেধ, কিন্তু হাদীসে মদ্যপানের সাথে জড়িত কোন কোন পেশা নিষেধ তা ব্যাখ্যা দেয়া আছে। এ সম্পর্কে কুরআনের সূরা আননাহলের ৪৪ নং আয়াতে বলা আছে, আর আমি আপনার নিকট কুরআন নাযিল করেছি, মানুষকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেবার জন্য যা তাদের উপর নাযিল করা হয়েছে,যাতে তারা চিন্তা ভাবনা করে। এছাড়া সূরা হাশরের ৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে, রাসূল তোমাদের যা দেন তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তোমাদের নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক। লক্ষ্যনীয় হাদিস সর্বদা বিশুদ্ধ উৎস(যেমন-সহীহ বুখারী,সহীহ মুসলিম ইত্যাদি) হতে গ্রহণ করতে হবে।
(৩) ইজমা: ইজমার শাব্দিক অর্থ ঐক্যমত।অর্থাৎ কোন আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মের নিয়ম-কানুন সম্পর্কে বিশেষজ্ঞগন ঐক্যমতের ভিত্তিতে যে নিয়ম বা আইন তৈরি করেন তাই ইজমা। আসলে কুরআন ও হাদীস কোন দেশের সংবিধানের মত নয় কিন্তু এ উৎসদ্বয় হতে সংবিধান তৈরি করা যায়। যখন একটি দেশ গঠিত হয়, তার লিখিত আইন থাকতে হয়,সময়ের প্রয়োজনে নতুন আইনের প্রয়োগ দরকার হয়,সেইসব আইন তৈরির সময় কুরআন ও হাদীস অনুযায়ী যে নিয়ম তৈরি হয় তাই ইজমা দ্বারা নির্ধারিত হয়। এ উৎস কুরআন ও হাদীস দ্বারা নিশ্চিত করা হয়েছে,আল কুরআনের সূরা আননিসার ১১৫ নং আয়াতে মুমিনগনের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে চলার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে । মুহম্মদ(সা)বলেছেন, মুসলমানগণ যা ভাল বলে গ্রহণ করে তা আল্লাহর কাছেও ভাল। শরীয়াতের বিষয়ে ইজমা অকাট্য দলিলে পরিণত হয়। ইজমা কখনো কুরআন-হাদীসের পরিপন্থি হবে না,শুধুমাত্র নতুন কোন সমস্যার ক্ষেত্রে কুরআন হাদীস অনুযায়ী ব্যাখ্যা প্রদান করবে।
(৪)কিয়াস : নতুন কোন সমস্যায় পুরাতণ কোন সমস্যার সমাধানকে প্রবর্তন করাই কিয়াস, অর্থাৎ আগের তিনটি উৎসে যে ইসলামিক আইন রয়েছে তার কারন অনুসন্ধান করে নতুন সমস্যা সমাধানে সে কারন সংশ্লিষ্ট হলে তার মাধ্যমে সেই সমস্যা সমাধান করা, তবে তা কখনো আগের তিনটি উৎসের পরিপন্থী হবে না বা সেসব উৎসের মূলনীতি বিরোধী হতে পারবে না কখনো যদি দেখা যায় কিয়াস তাদের পরিপন্থি তাহলে তা বাদ হয়ে যায়।
ইসলামী উত্তরাধিকারি আইনে শরীয়াতের এ উৎসসমূহ ব্যবহৃত হয়, প্রকৃত পক্ষে ইসলামের সব আইন তৈরি হতে এ উৎসসমূহ ব্যবহার হয়,তাই এসব আইনকে শরীয়া আইন বলে। ইসলামে উত্তরাধিকার আইন কুরআন শরীফে একদম মূল বিষয়গুলি সংক্ষেপে বলা হয়েছে, তাঁর বিশদ ব্যাখ্যা রয়েছে হাদিসে, পরবর্তীতে আরও কিছু নিয়ম যুক্ত হয়েছে গভীর ভাবে কুরআনও হাদীস ব্যাখ্যার মাধ্যমে, কিন্তু কোন নিয়ম বা মূলনীতি কুরআন বা হাদীস এর পরিপন্থি নয়।
তাই প্রশ্নটা অবান্তর, শুধুমাত্র উত্তরাধিকার আইন নয়,প্রায় সকল ইসলামী আইনই ব্যাখ্যার জন্য কুরআনের পাশাপাশি হাদীস,ইজমা ইত্যাদি উৎসের সাহায্য নিতে হয়।
প্রশ্ন২. আউল বা রদ্দ নীতি কি কোরআন শরীফের নির্ধারিত অংশের বিরুদ্ধে যায় ?
উত্তর: এ প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কথা ছিল না, কিন্তু উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে জ্ঞানের স্বল্পতাহেতু এটা অমুসলিমদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্ব পূর্ণ ,এমনকি মুসলিমদের মধ্যেও এ নিয়ে পরিষ্কার ধারণা না থাকায় অনেকে বিভ্রান্ত হচ্ছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, এ নিয়মটার জন্য অনেকে দাবি করছে কোরআন শরীফে গানিতিক ভুল আছে, সৃষ্টিকর্তা গণিত জানে না।
বিষয়টা কিছুটা এরকম,
ধরুন কাসে গণিতের টিচার ছাত্রদের বললেন,নেক্সট পরীক্ষায় যে অংকগুলি থাকবে তা বোঝার জন্য টেক্সট বইয়ের বাইরে আরও কয়েকটি রেফারেন্স বইয়ের সূত্র লাগবে। তো পরীক্ষার আগে কোন ছাত্র শুধু টেক্সট বই পড়ে গেলো এবং যথারীতি পরীক্ষায় আসা কয়েকটি অংক পারলো না। পরে সবাইকে বলে বেড়াল ঐসব অংকে ভুল ছিল বা টিচার অংক জানে না।
কোরআন শরীফে বলে দেয়া হচ্ছে যে হাদীসের সাহায্য নেয়ার জন্য,তা না নিয়ে গাণিতিক ভুলের দাবিটা কিছুটা সেরকম।
এ আইন বহু বিখ্যাত গণিতবিদদের দ্বারা পরীক্ষীত হয়েছে। মুসা আল খোয়ারজমী,৮৫০ খ্রিস্টাব্দের সময়কালীন একজন গণিতবিদ, যার বইয়ের প্রভাব ইউরোপে এতটাই ছিল যে তখন তার হিসাব আল জাবর ওয়াল মুকাবিলাহ ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ল্যাটিনে অনূদিত হয়ে শ্রেষ্ঠ ও প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে পড়ানো হয়। তার বইয়ের আল জাবর থেকে আলজেবরা শব্দের উৎপত্তি। তার এই গ্রন্থে ইসলামিক উত্তরাধিকার আইনটির গানিতিক দিক নিয়ে একটা অধ্যায় আছে, যেখানে তিনি সম্পদ বন্টণের জন্য লিনিয়ার ইকুইশন প্রবর্তন করেন। উত্তরাধিকার আইন এতটাই গনিতের সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ যে এটি গণিতের একটি শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। ( Gandz, Solomon (1938), "The Algebra of Inheritance: A Rehabilitation of Al-Khuwarizmi", Osiris (University of Chicago Press 5: 319-91 )
তাছাড়া উত্তরাধিকার আইন তৎকালীন মুসলিম গণিতবিদদের জন্য একধরনের প্রেরণা ছিল, এটা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অর্থাৎ গানিতিক ভাবে কুরআনের মূলনীতির মাধ্যমে সম্পদ হিসাব করার জন্য গণিতের অনেক নতুন বিষয় আবিষ্কৃত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য উত্তর আফ্রিকার ১২ শতাব্দীর গণিতবিদ আল হাসার লব ও হরের হিসাবের জন নতুন গানিতিক নোটেশনের ধারণা প্রদান করেন। তার এই গাণিতিক নিয়ম পরবর্তীতে ১৩ শতাব্দীতে ইউরোপের বিখ্যাত গণিতবিদ ফিবোনক্কির কাজের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। ( Prof. Ahmed Djebbar (June 2008). "Mathematics in the Medieval Maghrib: General Survey on Mathematical Activities in North Africa". FSTC Limited.)
এসব কারনে ইসলামের ও কোরআনের অনেক বড় সমালোচক গনও উত্তরাধিকার আইন নিয়ে কোন বিরূপ মন্তব্য করার চিন্তাও করেনি-যেমন ড. ক্যাম্পবেল,যার পিএইচডি এর বিষয় ছিল কুরআন তথা ইসলামের দুর্বল দিক গুলো তুলে ধরা,সেও উত্তরাধিকার আইন নিয়ে কোন সভায় কোন মন্তব্য করেনি। শুধুমাত্র এ আইনে স্বল্প জ্ঞান সম্পন্ন অতি উৎসাহী ইসলামের সমালোচকরা নানা বাগাড়ম্বর করে থাকে।
এই আইন এতটা সুচিন্তিত,বিস্তৃত ও গণিতবান্ধব যে, অনেক অমুসলিম আইনবিদও এটাকে অকুন্ঠচিত্তে সমর্থণ জানিয়েছে,যেমন: কিংস কলেজ,ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের প্রফেসর,আইনবিষয়ক অনেক গ্রন্থের লেখক ও আইনবিদ(ব্যরিস্টার অ্যাট ল) আলমারিক রামসে তার এক বইয়ে বলেন-মুসলিম উত্তরাধিকার আইন হল সভ্য সমাজে প্রচলিত সবচেয়ে বিস্তৃত ও বিশুদ্ধ্ উত্তরাধিকার আইন ও সব প্রশ্নের উর্ধ্বে। ( Rumsey, A. Moohummudan Law of Inheritance. 1880)
আউল নীতি: আউল শব্দের আভিধানিক অর্থ বৃদ্ধি হওয়া। শরীয়তের নিয়মানুযায়ী যাবিল ফুরুজ বা অংশীদারদের অংশ প্রদানের পর তাদের অংশাবলীর যোগফল যদি মূল সম্পদ হতে বেড়ে যায় বা ১ এর চেয়ে বেশি হয় তাহলে যে নিয়মে তা সমাধান করা হয় সেটাই আউল। কোরআন শরীফে অংশীদারদের যে তালিকা রয়েছে তাদের বিভিন্ন বিন্যাস ও সমাবেশে কখনো কখনো তা ১ এর চেয়ে বেশি হওয়াটা গাণিতিক ভাবে ও অনুপাত ভিত্তিক বন্টনে যদিও সেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার কিন্তু এ বিন্যাস খুব সহজলভ্য নয়, তাই হাদীসে এ পরিস্থিতির উদাহরণ নেই,তবে চার খলিফা আমলে এটি আলোচিত হয় ও পরবর্তীতে শরীয়তের ৩য় উৎস কিয়াসের মাধ্যমে ইসলামী আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
রদ্দ নীতি: রদ্দ এর আভিধানিক অর্থ প্রত্যাবর্তন করা । এটি আউলের বিপরীত নিয়ম। শরীয়তের নিয়মানুযায়ী যাবিল ফুরুজ বা অংশীদারদের অংশ প্রদানের পর তাদের অংশাবলীর যোগফল যদি ১ এর চেয়ে কম হয় এবং মৃত ব্যক্তির কোন আসাবা না থাকে তাহলে অবশিষ্ট সম্পত্তি স্বামী স্ত্রী ব্যতিত অন্যান্য অংশীদারদের কাছে পুনরায় প্রত্যাবর্তন করা হয়।
তিনটি উদাহরণ :
১. জলিল সাহেব মৃত্যুকালে পিতা ও এক কন্যা রেখে গেল
প্রথমত, কন্যা পাবে ১/২ অংশ
পিতা পাবে ১/৬
এখানে ,১/২+১/৬=৪/৬ , সুতারাং আসাবা বা অবশিষ্টাংশ = ১-৪/৬= ২/৬
দ্বিতীয়ত, ১(খ) অনুযায়ী, পিতা এই আসাবা পাবে। তাহলে মোট পিতার অংশ=১/৬+২/৬ =৩/৬ =১/২ ও কন্যার অংশ=১/২
২.কামাল সাহেব ১ কন্যা ও মা রেখে মারা গেলেন।
প্রথমত, কন্যা পাবে ১/২
মা পাবে ১/৬
মোট ১/২+১/৬=৩/৬+১/৬=৪/৬
দ্বিতীয়ত, রদ্দনীতি প্রয়োগ করে পাই-৩/৪+১/৪=৪/৪=১
তাহলে, কন্যা ৩/৪ ও মা ১/৪ অংশ পাবে।
৩.আনিস সাহেব মৃত্যুকালে স্ত্রী, ২ সহোদর বোন ও ২ জন মায়ের পরে সৎ বোন রেখে গেল।
প্রথমত, এখানে স্ত্রী পায় ১/৪
সহোদর বোনদ্বয় ২/৩
সৎ বোনদ্বয় ১/৩
মোট= ১/৪+২/৩+১/৩ =৩/১২+৮/১২+৪/১২=১৫/১২
দ্বিতীয়ত, ১এর বেশি হওয়ায় আউল অবলম্বন করে হরকে ১৫ করে পাই,
৩/১৫+৮/১৫+৪/১৫=১৫/১৫=১
তাহলে স্ত্রী ৩/১৫,বোনদ্বয় ৮/১৫ ও সৎ বোনদ্বয় ৪/১৫ অংশ পাবে।
উদাহরণ তিনটিতে দেখা যায় প্রথম ২টি উদাহরনে অংশ বৃদ্ধি পায়, দ্বিতীয়টিতে অংশ কিছুটা হ্রাস পায়। এখন ১ম নিয়মটি সাধারন ভাবে আসাবা বা অবশিষ্টাংশভোগী নিয়মে করা হয়েছে ,২য় টি রদ্দ ও ৩য়টিতে আউল নীতি প্রয়োগ করা হয়েছে।
দেখা যাচ্ছে কুরআনে বর্ণিত অংশ প্রাপ্ত হবার পর সে অংশ দ্বিতীয় ধাপে বাড়তে বা কমতে পারে, আর সেটা মোটেও কোরআনের পরিপন্থি নয় । কোরআনে এ সংক্রান্ত আয়াতগুলোতে দেখা যায় কয়েকজনের অনুপাত উল্লেখ করা হয় নি, যেমন পুত্র,ভাই,চাচা ইত্যাদি। এখন কেউ যদি বলে এদের উল্লেখ নেই, তাহলে এদের ভাগ দেয়া হলে কুরআনের বিরুদ্ধে যাবে, তাহলে তা অবান্তর মন্তব্য হবে। আসলে কোরআনে উল্লেখিত অংশ দেবার পর যা বাকি থাকবে সেখান থেকে তাদের অংশ নির্ধারিত হয়। আবার কখনো নিদির্ষ্ট অংশভোগীরাও তা পেতে পারে (যেমন- উদা ১), রদ্দ নীতিতেও বেশি পেয়ে থাকে। তাই নির্ধারিত অংশের বেশি পাওয়া ইসলামী আইনের পরিপন্থি নয়।
অধিকাংশ প্রশ্নে আমি দেখেছি আউল নীতি নিয়ে যত প্রশ্ন অথচ বেশি পাওয়ার ক্ষেত্রে কোন প্রশ্ন নেই । কিন্তু গণিতের দৃষ্টিতে বলা যায়, বৃদ্ধি ধনাত্মক বা ঋণাত্মক দুইই হতে পারে আর আউল নীতিতে এই বেশি পাওয়া নীতি বা রদ্দ নীতির বিপরীত হয়, খুব স্বাভাবিক ভাবেই তা হয়।
ইসলামে উত্তরাধিকারি আইনে আউল ও রদ্দ নীতিতে পরস্পরের সম্পদের অনুপাত ঠিক রাখা হয়, তাই এভাবে বন্টন গাণিতিক ভাবে অত্যন্ত গ্রহনযোগ্য ও বৈজ্ঞানিক। যেমন ২ নং উদাহরণে প্রথমত অনুপাত থাকে, কন্যা:মা=৩/৬:১/৬=৩:১
রদ্দ নীতি প্রয়োগের পর এ অনুপাত, কন্যা:মা=৩/৪:১/৪=৩:১
৩নং উদাহরণের আউল নীতিতেও ৩:৮:৪ অনুপাত ঠিক থাকে।
তাই বলা যায়, রদ্দ আউল ও অন্যান্য শরীয়া নিয়ম যা শরীয়তের উৎসসমূহ থেকে করা হয়েছে তা কোনটিই পরস্পর পরিপন্থি বা কোরআন পরিপন্থি নয় এবং ইসলামি উত্তরাধিকার আইন একটি সম্পূর্ণ স্বয়ংসম্পূর্ণ গাণিতিক বা বৈজ্ঞানিক ব্যবহারিক ব্যবস্থা।
(allah knows the best)
পরবর্তীতে আলোচনার ইচ্ছা রইল-
>ইসলামিক আইনে সম্পদের অংশে পুরুষ নারীর প্রাপ্য অংশের দ্বিগুন পায়,এতে কি নারীর অধিকার খর্বিত হচ্ছে না!
>ইসলামে উত্তরাধিকার আইনে পরিবর্তন করার দাবি কতটা যৌক্তিক!
0 comments: